Skip to main content

আমার কাম্বোডিয়া বেড়ানো

#আঙ্কোরভাট_এক_বিস্ময়#

স্বপ্ন অনেক থাকে আমাদের তবে হয়ত পূরণ হয়না সবসময়। ইতিহাসের পাতায় পড়েছিলাম আঙ্কোরভাটের কথা,ছবি দেখেছিলাম আর মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে  আশা ছিলো আঙ্কোরভাট দেখার। কে জানে মন থেকে কিছু চাইলে বোধহয় সত‍্যি পূরণ হয়। তাই বোধহয় হঠাৎই কি করে যে সুযোগ এসে গেলো বুঝতেই পারিনি। আসলে এই দেশগুলোর বৈশিষ্ট‍্য এখানে ভিসা অন আ্যরাইভাল হয় তাই হয়ত চট করে যেতে পেরেছি। তাই আর কি উঠাকে ঝোলা,চল ভোলা। বেড়িয়ে পরা সপরিবারে কাম্বোডিয়ার উদ্দেশ‍্যে। কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমে ব‍্যাঙ্কক সেখান থেকে অন‍্য ফ্লাইটে সিয়েম রীপ। আঙ্কোরভাটে যেতে হলে এখানেই আসতে হয়। আঙ্কর ওয়াত শব্দের অর্থ শহরের মন্দির। মধ‍্যযুগে রাজা দ্বিতীয় সূর্যবর্মনের আমলে নির্মিত হয়েছিলো এই বিষ্ণু মন্দির। প্রথমে এই মন্দিরে বিষ্ণুর উপাসনাস্থল হিসেবে তৈরি হলেও পরে বৌদ্ধমন্দিরে পরিবর্তিত হয়। খামের রাজাদের শিল্পশৈলীর নিদর্শন বহন করছে এই মন্দির। বিশাল এবং অনেক উঁচু এই মন্দির। মন্দিরের চারিদিকে পরিখা এবং জলাশয় আছে,তাতে এখনো ফোটে পদ্মফুল। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এই মন্দির,এই মন্দিরের মূল দরজা পশ্চিমদিকে মুখ করা অন‍্য মন্দিরের মত পূর্বদিকে নয়। আঙ্কোরভাটের আগে এখানে সমস্ত পূজা শিবকে উৎসর্গ করা হত। রাজা সূর্যবর্মনই প্রথম বিষ্ণুমন্দির হিসেবে এর প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ওনার রাজধানীও ছিলো। একসময় সূর্যবর্মনের পরবর্তী রাজা এই মন্দির লুঠ করে তার নতুন রাজধানী আঙ্কোরথমে নিয়ে যান। মন্দিরের চারপাশে প্রাচীর এবং জলাশয় থাকাতে মন্দিরটি জঙ্গল গ্ৰাস করতে পারেনি। এত বড় বিষ্ণুমন্দির সারা বিশ্বের এক অন‍্যতম অনবদ‍্য সৃষ্টি। প্রতিদিন কয়েকহাজার লোক আসেন সারা পৃথিবী থেকে এই অনবদ‍্য সৃষ্টিকে দেখতে। মন্দিরটি গ‍্যালারীর ধাঁচে তৈরী চারিদিকে এবং মাঝখানে মেরুপর্বতের আদল যা হিন্দু দেবদেবীর বাসস্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মন্দিরে সর্বমোট এমন তিনটে বিশাল গ‍্যালারী আছে। সর্বোচ্চ শেষ উচ্চ মেরুপর্বতের আদলে তৈরি যে মন্দির তাতে ওঠার জন‍্য কৃত্রিম সিঁড়ির ব‍্যবস্থা করা হয়েছে। মন্দির যদিও অনেক বিনষ্ট এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে তবুও এর গঠনশৈলী বিশাল পরিধি এবং না বলা ইতিহাস সবাইকে মুগ্ধ করবে। প্রতিটি দেওয়ালে অপূর্ব সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম মুগ্ধ করে আর আকৃষ্ট করে। ঢোকার মুখেই রয়েছে সুবিশাল বিষ্ণুমূর্তি,প্রতিটি তলাতেই বিষ্ণুমূর্তি দেখা যায় কোথাও বুদ্ধমূর্তি আছে। একদম মন্দিরের সর্বোচ্চ তলায় আছে শায়িত বিরাট বুদ্ধমূর্তি। এখনো আঙ্কোরভাট চোখের সামনে ভাসে আর মনে হয় এই মন্দির দেখে শেষ করা একদিনে সম্ভব নয় কিছুতেই। কারণ এর প্রতি পাথরে আছে এক অজানা ইতিহাস। আমি মুগ্ধ,আমি স্তব্ধ,আমি বিস্মিত এই অপূর্ব সৃষ্টি দেখে। মধ‍্যযুগে আমাদের সভ‍্যতা এত উন্নত ছিলো কি ভাবে,এ কি মানুষের সৃষ্টি না স্বয়ং বিষ্ণু বানিয়েছেন তার মন্দির এই শুধু ভেবেছি। মানুষ সৃষ্টি করে আবার যুদ্ধ আর ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে মানুষই তা ধ্বংস করে। ইতিহাস চাপা পড়ে যায় কালের অন্ধকারে। সত‍্যি খারাপ লাগে মন্দিরগুলোর জীর্ণদশা দেখে। তবুও যা দেখেছি মনের মণিকোঠায় রয়ে যাবে আজীবন।

    # জীবন্ত_ইতিহাস_আঙ্কোরথম#
         #বেয়ন_প্রাসাদ#

সিয়েম রীপ এক সুন্দর ইতিহাস মাখা শহর। কম্বোডিয়ার বেশিরভাগ মন্দিরই এই অঞ্চলের চারপাশে ছড়ানো। আঙ্কোরভাট নির্মিত হয়েছিলো রাজা সূর্যবর্মনের আমলে। রাজা সূর্যবর্মনের পর রাজা জয়বর্মনের আমলে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় আঙ্কোরভাট থেকে আঙ্কোরথমে। এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে গড়ে ওঠে অনন‍্য ভাস্কর্যসম্পন্ন এক সুন্দর নগরী। যে রাজধানীতে প্রবেশ করার সময় এক দীর্ঘ পাথরের পুলের ওপর দিয়ে যেতে হয়। পুলের দুই পাশে যত্নে বসানো অনন্ত নাগ হাতে সারিবদ্ধ সুর এবং অসুরদের মূর্তি যা দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিলো আমার। যদিও সুর অসুর উভয় মূর্তিই এখন বিনষ্টের পথে। বেশি করে যেন খারাপ হয়েছে অসুরের মূর্তিগুলো সে তুলনায় ভালো আছে দেবতাদের মূর্তি। খারাপ কাজের ফল বোধহয় সবসময় খারাপই হয়,এক্ষেত্রে সেটাই মনে হয় দেখলাম। কেমন যেন রোমাঞ্চ হলো এই প্রাচীন নগরে প্রবেশ করার গেটটা দেখে কারণ সুর আর অসুরদের সাথে সাথে আছে গেটের মাথায় বসানো চারটে মুখ যারা নজর রাখছে চারদিকে। এক সময় হয়ত অনেক অনুশাসন মেনে প্রবেশ করতে হত এই শহরে যেখানে আমরা টিকিট কেটে সহজেই ঢুকে পড়লাম আমাদের গাড়ি নিয়ে।
  নিরাপত্তার জন্য সে সময়ের নিয়ম মেনে রাজধানী এংকরথম ছিল চারিদিকে গভীর জলাশয় আর উঁচু প্রাচীর ঘেরা। 
রাজধানীতে প্রবেশ করেই মাটির পথ ধরে কিছুদুর এগুতেই গাছের আড়াল থেকে উকি দিল সেদিনের সেই অদ্ভুত আকৃতির সৌধটি তার অনন্য রূপ নিয়ে । 

গাছের ছায়াতে ঢাকা শীতল পথ। মাঝে মাঝে নজরে পড়লো ধ্বংসপ্রাপ্ত সৌধ। একটা বিরাট উঁচু লম্বা বেদীর গায়ে চোখ আটকালো,তার গায়ে চিহ্নিত হাতির আর যোদ্ধাদের ছবি। শুনলাম ঐ উঁচু জায়গায় বসে রাজা জয়বর্মন উপভোগ করতেন হাতির লড়াই তার মন্ত্রীদের সাথে। কল্পনা করলাম নিজের মানসচক্ষে যেন সবটাই দেখতে পেলাম চোখের সামনে। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নানা প্রকার মন্দির ও রাজধানী সুসজ্জিত করতে জয়বর্মনের সময় লেগেছিলো প্রায় বারো বছর এ কথা শোনা যায়। ভাবলে আশ্চর্য হয় মধ‍্যযুগে নির্মিত হয়েছিলো এক অপূর্ব ভাস্কর্য যা দেখতে ভিড় জমায় এই আধুনিক যুগেও সমস্ত দেশ থেকে আসা পর্যটক। আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ায় গাছের ছায়ায়,বাঁ হাতে এক উঁচু বৌদ্ধমন্দিরের  বেদী বানানো হয়েছে যা দেখতে খুবই সুন্দর এবং রঙিন কারুকার্য করা। তাতে রয়েছে বুদ্ধমূর্তি,তবে কি জয়বর্মনের মূর্তিই কি এখানে পুজো করা হয় বুদ্ধমূর্তিরূপে? চোখ যায় উল্টোদিকের মধ‍্যযুগীয় স্থাপত‍্যে যা হয়ত কালের প্রহারে বিনষ্ট এবং ধ্বংসের মুখে তবুও পড়ন্ত সূর্যের আলোয় তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে মনে হলো তাকিয়েই থাকি সেই স্মিত হাসিমাখা মুখগুলোর দিকে। সূর্যের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে স্নিগ্ধ মুখগুলো আর ওরা অবলোকন করছে চারিদিকের অপার সৌন্দর্যময় প্রকৃতি আকাশ সবটাই। আমার মনে হচ্ছিলো দেখে মুখগুলো যেন ব্রহ্মা,বিষ্ণু ও মহেশ্বরের। কিন্তু রাজা জয়বর্মন ছিলেন বৌদ্ধ তাই হয়ত মুখে বুদ্ধদেবের আদলই আছে,তবে শিল্পী তার শিল্পকে কিভাবে সৃষ্টি করেন তা কেউ বলতে পারে না। অনেকে আবার বলেন এই বোধিস্বত্ব মূর্তি জয়বর্মনের মুখের আদলেই তৈরি। সারাদিনের গরম এবং মন্দিরে ঘুরে বেড়িয়ে আমরাও ক্লান্ত তাই বড় সাধ জাগে ঐ মূর্তির স্নিগ্ধতায় একটু বিশ্রাম করতে। তবে আজকাল ফটো তোলার অত‍্যাচারে কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। ঐ মুখগুলোর মধ‍্যে পাথরের রঙের বিন‍্যাস মনকে আলোকিত করে। কি অসাধারণ সৃষ্টি! সারা মন্দির চত্বর জুড়ে রয়েছে অসংখ‍্য ছোট ছোট ঘর বা বিশ্রামকক্ষ। আমরা একদম সিঁড়ি বেয়ে সর্বোচ্চ ধাপে উঠে গিয়েছিলাম। শোনা যায় পত্নী এবং উপপত্নী মিলিয়ে জয়বর্মনের তিনহাজারেরও বেশি শয‍্যাসঙ্গিনী থাকলেও তিনি এক নাগকন‍্যাকে নিয়ে ওপরের একটি ঘরে রাত্রি কাটাতেন।
              শোনা যায় সপ্তম জয়বর্মনের পর ত়াঁর নাতি যখন সিংহাসনে বসেন তিনি হিন্দুধর্মালম্বী হওয়াতে মূল চূড়ায় বসানো বোধিস্বত্ত্ব মূর্তিটি ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেন। পরে একটি কুয়ো থেকে সেটি পাওয়া যায়। দেওয়ালে দেওয়ালে দেখা যায় সুন্দর কারুকার্য যা বলে যায় অনেক না বলা ইতিহাস কথা বলে ফিসফিস করে সেখানে। তাই হাতে সময় নিয়ে পুরো একটা দিন ধরে বেয়ন রাজপ্রাসাদ দেখলেই ভালো। যদিও আমরা সেই সময় পাইনি। আমরা যখন আঙ্কোরথম থেকে বেরোচ্ছি তখনও আমার চোখ ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে পেছনে বারবার মুগ্ধ হয়ে আবার দেখতে চাইছে বিপুল সৃষ্টিকে। বেরোনোর পথে সমুদ্রমন্থনের অনন্তনাগ হাতে নিয়ে দেবতাদের সাথে একটা ছবি তুলে মুগ্ধচিত্তে বেরোলাম। মনে আঁকা রইলো ছবির মত ধ্বংসপ্রাপ্ত জয়বর্মনের রাজধানী আঙ্কোরথম আর বেয়ন প্রাসাদ। চোখ বুজলে এখনো দেখতে পাই লোকেশ্বরার হাস‍্যোজ্জ্বল স্নিগ্ধ মুখ।
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...