Skip to main content

#ছাতিম￰ পাতা #

ছাতিম পাতা

কাল সারারাত প্রায় ঘুমোয়নি সুচরিতা,অনেক আবছা স্মৃতি ফেলে যাওয়া দিনের কথা জাগিয়ে  রেখেছে সারা রাত। দিল্লি থেকে প্রায় একমাস হলো কলকাতার কলেজে ট্রান্সফার হয়েছে আর এখানেই আলাপ পূর্বা র সাথে।
একটু বয়েসে ছোট হলেও খুব মিষ্টি মেয়ে পূর্বা, আজ পূর্বা র জন্যই বসন্ত উৎসবে শান্তিনিকেতনে  আসা ।

শনিবার কলেজ করেই ইন্টারসিটি ধরে সোজা  বোলপুর,বসন্ত উৎসব সোমবার।ভালোই হলো একটা দিন একটু বসন্তের আমেজ নেয়া যাবে।
সুচরিতা একটু আপত্তি করলেও পূর্বা শোনেনি ।

দশ বছর আগে ফেলে আসা শান্তিনিকেতন! কত মধুর স্মৃতি,বন্ধুরা,ক্যাম্পাসের প্রতিটা গাছপালা  সবকিছু ভুলতে পারেনি সু।
কিন্তু আসতেও মন চায়নি তার,স্মৃতি টুকু বড়ই মিষ্টি তাকে বর্তমানের মোড়ক দিতে চায়না মন। তবু আজ সুচরিতা তার প্রিয় বিশ্বভারতীতে।

ভোরের আলো ফুটে উঠতেই একটু ফ্রেশ হয়ে  বেড়িয়ে পরে সুচরিতা,পূর্বাকে একটা ছোট মেসেজ করে যায়।
পৌষালি থেকে বেড়িয়ে পথ,গাছ,লালমাটি আর পলাশের রং সবই তার চেনা,হাঁটতে থাকে সু। আরে ওই তো পাখিগুলো কি সুন্দর ভোরের সানাইয়ের মতো সুর করে গাইছে।ওমা !দূরে শিমুল আর পলাশ ফুলে রাঙা গাছগুলো।

আবার যেন চঞ্চল হয়ে ওঠে বাংলার অধ্যাপিকা  সুচরিতা।বাবার ইচ্ছে তাই  বিশ্বভারতী থেকে মাস্টার্স করতে এসেছিলো দিল্লির সুচরিতা।

আর সেই দুটো বছর,"এই আকাশে  আমার মুক্তি  আলোয় আলোয় "__আনন্দের জোয়ার আর মুক্তির আনন্দে ভেসে গিয়েছিলো।কবিগুরুর আশীর্বাদ ধন্য শান্তিনিকেতনে সমৃদ্ধ হয়েছিল সুচরিতা।

কলাভবন,পাঠভবন,শিশুনিকেতন,সঙ্গীতভবন  সব পেরিয়ে ভোরের আলো গায়ে মেখে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ছাতিমতলায় এসে পড়েছে খেয়ালই হয়নি।

ছাতিমতলায় এসে থমকে যায় সুচরিতা , একঝলক খুশির খেয়ালে নিজেই হেসে ফেলে আর হলদে লাল আঁচল উড়িয়ে বসে পড়ে গাছের তলায়।

সত্যি আজ বড় মনে হচ্ছে ওদের আড্ডার কথা -- উজানী,সুমিতা,শুভ্র,প্রিয়াম,সুপ্তি,তনুজা,রাহুল আরো সবাইকে মনে হচ্ছে খুব খুব বেশি করে। মনে হচ্ছে এইতো সেদিনের কথা!কত গল্প,গান, আড্ডা,কবিতা আর প্রাণখোলা হাসি।

আজ বেশি করে মনে হচ্ছে শুভ্রর কথা,ছোট থেকেই মা হারা শুভ্র শান্তিনিকেতনের বোর্ডিংয়ে মানুষ।অপূর্ব উদাত্ত গলায় আবৃত্তি করতো,প্রথম শুনেছিলো সুচরিতা নবীন বরণ উৎসবের দিন, 'অমল কান্তি রোদ্দুর হতে চেয়েছিলো।

কি যেন এক ব্যাথা লুকোনো ছিল চোখ দুটোতে কিন্তু সুচরিতার তখন সেই চোখের ভাষা খোঁজার  সময় কোথায় ?
বাবা র বন্ধুর ছেলে দিল্লী IITর মেধাবী ছাত্র অর্ক ওর মন প্রাণ জুড়ে।সুচরিতার সাথে দেখা করতে অর্ক বসন্তউৎসবে শান্তিনিকেতন এসেছিলো  সেবার জার্মানি যাবার আগে।
অর্কর জন্য নিজেকে যেন অপরূপা  করে সাজিয়েছিল সুচরিতা,হলুদ লাল শাড়ি,গলায় লাল পুঁতি আর ডোকরার মালা,হাত ভর্তি লাল হলুদ চুড়ি,খোঁপায় পলাশ ফুলের গোছা,কি যে সুন্দর লাগছিলো বলার নয়!

মুগ্ধ হয়েছিল অর্ক,আরেক জোড়া বিষণ্ণ  চোখে  যেন এক মুহূর্তের জন্য ভালোলাগা দেখেছিলো  সুচরিতা,"শুভ্র।"
সারাদিন বন্ধুদের সাথে আর অর্কর সাথে ফুলের আবির মেখে সুচরিতা গেয়েছিল,'রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো এবার যাবার আগে'।

আর অর্ক র হাত দুটো ধরে খোয়াইয়ের ধারে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলো জার্মানি গিয়ে আমায় ভুলে যাবেনা তো ? অর্ক বলেছিলো,'না,সাক্ষী  রইলো খোয়াই।

ফাইনাল পরীক্ষার  পর সবার বাড়ি যাবার পালা , সেদিন ছাতিম তলায় ছিল ওদের শেষ আড্ডার সন্ধ্যে।সবাই নানা কথা বলছে,চলছে বাড়ির ঠিকানা দেয়া ,,প্রিয়াম সবাই কে ক্যাডবেরী খাওয়ালো ,কত কথা,কত গান,আড্ডা চলছে।

আজ শুভ্র যেন বেশি বিষন্ন,হাতে কুড়িয়ে নেয়া ছাতিম পাতায় কি যেন আঁকিবুকি কাটছে  মাথা নিচু করে | প্রিয়াম হঠাৎ ছাতিম পাতা টা পেছন  থেকে গিয়ে শুভ্র র হাত থেকে তুলে নেয় | কি করছিস দেখি ? লজ্জায়  রাঙা হয় শুভ্র বাধা দেয় প্রিয়াম কে |প্রিয়াম হা হা হা করে হেসে  বলে, 'ছাতিম পাতায়  প্রেমপত্র?দেখি দেখি ,যাহ !শুধু সু লেখা?এই বলনা এই সু কে ? শুভ্রা ? সুপ্তি? সুমিতা ? না সুচরিতা ?

লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে শুভ্র।সবাই তখন একসাথে হো হো করে হাসছে।শুধু সুচরিতা হাসতে পারে না শুভ্রর বিষণ্ণ চোখ দুটোর  দিকে তাকিয়ে।
আজ কেন যেন মনে হলো করুন চোখ দুটো ওকেই দেখছে।

দিল্লি ফিরে আসতে হয় সুচরিতাকে পেছনে পড়ে থাকে ফেলে আসা একরাশ স্মৃতি,পৌষ মেলা, বসন্তউৎসব,খোয়াইয়ের পার,ছাতিম তলা।

অর্ক তার খোয়াই এর পাড়ে দেয়া কথা রাখেনি। কোনো এক জার্মান  সুন্দরীর প্রেমে ডুবে আজ আর তার মনে নেই সুচরিতাকে। স্পষ্ট করে সে জানিয়েছে সে কথা।সুচরিতার মন এতোটাই অশান্ত আজও অর্কর ব্যাবহারে,যে বাবার বার বার অনুরোধে এখনো মনকে বোঝাতে  পারেনি সংসারী হবার জন্য।

সুচরিতার সমস্ত ভালোলাগা যেন কেড়ে নিয়েছে  অর্ক,বিশ্বাসও।ভয় পায় সু কাউকে বিশ্বাস করতে।

এর মাঝেই এই ট্রান্সফার অর্ডার,কলকাতার পরিবেশে একটু যেন হাফ ছেড়েছে  সু ..

আজ ছাতিমতলায় বসে কত কথাই মনে হচ্ছে , কিছু আনন্দের আবার অনেক টাই কষ্টের | এই জন্যই পুরোনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখেনি,কি বলবে ওদের ?

নাহ্ অনেক দেরি হয়ে গেছে এবার ফেরা যাক ..উঠে দাঁড়িয়েছে  সুচরিতা এমন সময় পেছন থেকে খুব পরিচিত একটা গলা ,

" সু , যাসনা প্লিজ ,"__চমকে ওঠে সুচরিতা , পেছন ফিরে দেখে শুভ্র।সেই বুদ্ধিদীপ্ত  সুন্দর বিষণ্ণ দুটো চোখ।

ভাষা হারায়  সুচরিতা শুধু তাকিয়ে থাকে শুভ্রর দিকে। নীরবতা ভাঙে শুভ্র বলে,'শান্তিনিকেতন আমার জীবনরে, তাই আমি এখানেই থেকে গেছি।এখন কলাভবনে  আমি পড়াই ,আর প্রতিদিন  সকাল বিকেল ছুটে আসি ছাতিম তলায় , সেদিনের না বলা কথা আজ বলে ফেললাম," সু যাস না রে"।

'জানতাম কোনোদিন তুই আসবি ,আজ  জমানো

অনেক কথা বলবো তোকে শুনবি তো ? আজ শুভ্র বক্তা সুচরিতা শুধুই শ্রোতা,শুভ্র যেন আজ মনের সব দরজা  খুলে দিয়েছে।কি বলবে সুচরিতা?শুভ্র তার না বলা সব কথাই বুঝে গেছে আজ তার চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে।যে চোখে আজ শুধু শুভ্রকে নতুন করে পাওয়ার আনন্দ। অনেক কিছু না পেয়েও আজ সুচরিতা সব পেয়েছির দেশে।শুভ্রর চোখ দুটো আজ অনেক পরিণত  আর উজ্জ্বল। আজ সুচরিতার মনে হলো খোয়াই  কখনো মিথ্যে  বলেনা।

সত্যি এবারের  বসন্ত উৎসব আর একবার সত্যিকারের রঙ ছুঁইয়ে দিলো সুচরিতা আর শুভ্রর জীবনে।হাতে হাত রেখে প্রকৃতিকে আর খোয়াই কে সাক্ষী রেখে ওরা গাইলো ,'রাঙিয়ে দিয়ে যাও।'

সমাপ্ত:-

Comments

  1. ছোট চেষ্টা , খুশি র খেয়াল

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...