Skip to main content

#সৃষ্টি সুখ #

সৃষ্টি সুখ #
#রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী#
বাস স্টপেজে বাস এর জন্য প্রায় দশ মিনিট  দাঁড়িয়ে মধুজা , ভীষণ অস্থির লাগছে এই সময় তো প্রতিদিন এসে পড়ে আজ কি যে হলো ? বাড়ী থেকে প্রায় একঘন্টা পনেরো মিনিট লাগে স্কুলে   পৌঁছতে । মর্নিং স্কুল তার তাই সকালে একটুও সময় নষ্ট করা যায় না ।
        অ্যালার্ম দিয়ে ভোর চারটেয় উঠেই পড়তে হয় আর তারপর মধুজা যেন চার্লি  চ্যাপলিন। ভাবলে  নিজেও আশ্চর্য হয়ে যায় ,কি ভাবে এতো কিছু সামলায় সে। প্রথমে খুব অসুবিধে হতো এখন অনেক বছর চাকরী আর সংসার করে একেবারে দশভূজা সে । মনে মনে হেসেই ফেলে ইশ !  মা দুগ্গা কেন যে মেয়েদের আরো দু  চারটে হাত বেশি দিলেন না ।
         সকালে বেরোনোর আগে ছেলেমেয়েদের  টিফিন দুপুরের খাবার গরম , কখনো টুকটাক রান্না , রুটি অনেক কিছুই করে নিতে হয় । গীতার বিয়ে হয়ে যাবার পর তেমন বিশ্বাসী  আর কাউকে এখনো পায় নি ।তাই সব টা হাসিমুখে ম্যানেজ  করে মধুজা ।ছেলে মেয়ে স্বামী সবার খুঁটিনাটি  দিকে নজর রাখতে গিয়ে কখনো নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি  সে , তার ভালোবাসা আর ভালো লাগা কে বাঁচিয়ে রেখেছে হাজারো কাজের মাঝে ।
        জীবন মধুজা কে শিখিয়েছে কাজ মানুষ কে ভালো রাখে , সুস্থ রাখে । অকেজো লোকের কোন দাম নেই সমাজে।তাই ক্লান্ত হয়ে গেলে তার কবিগুরু র গান টাই বেশি মনে পড়ে," ক্লান্তি  আমার ক্ষমা করো প্রভু ।"
         দেখতে দেখতে অনেক বছর কেটে গেছে এই স্কুলে , অদ্ভুত একটা  মায়া পরে গেছে | দীপ্ত  মাঝে মাঝেই বলে ,'  দেখোনা  কলকাতার মধ্যে কোনো স্কুলে হেডমিস্ট্রেস  হয়ে আসা যায় নাকি আমাদের বাড়ীর কাছাকাছি '।
কিন্তু মধুজা কখনো  চায়নি ছাত্রীদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে অফিস এর ফাইল এর মধ্যে ডুবে যেতে । একটু যাতায়াতের  কষ্ট হলেও কলকাতার থেকে কিছুটা দূরে প্রকৃতি র কোলে এই স্কুল টা মধুজা র এখন শুধু কর্মক্ষেত্র নয়, ভালোবাসা ও ভালোলাগা । স্কুলে ঢুকলেই  মনটা ভালো হয়ে যায়  মধুজার , সবুজ যেন তার কোল উজাড় করে দিয়েছে । প্রতিবারই  বিশ্ব পরিবেশ দিবসে অনেক গাছ লাগানো  হয় । তাই মধুজার স্কুল যেন  ঋতু বৈচিত্র্যর সাক্ষী ।
         বসন্তে কৃষ্ণচূড়া ,রাধাচূড়া লালের আভায়  ভরিয়ে  দেয় । বর্ষায় কদমফুলের মিষ্টি গন্ধে  আর সবুজের সমারোহে মধুজা মুগ্ধ হয়ে গুনগুন করে ,'  বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছো দান '। মাধবী লতা ,টগর, বেল , নয়নতারা , দোলনচাঁপা  কি সুন্দর সুন্দর সব ফুলের গাছ বাগান আলো করে রেখেছে ।
       শরতের আগমনে  যখন টিচার্স রুমের  পাশের গাছটায় শিউলি ফুল  ফোঁটে তখন নীচু হয়ে কয়েকটা  ফুল কুড়িয়ে মিষ্টি গন্ধ নিয়ে মধুজা ভাবে মা আসছে ।
      প্রায় আঠেরো  বছর এই স্কুলে মধুজা , তখন সবে এম.এ পাশ করেছে ।কত ছাত্রী কে এতো বছরে নিজের হাতে গড়েছে । মধুজার ছাত্রী রা অনেকেই দুঃস্থ অবহেলিত , কারো বাড়ীর লোকেরা তেমন পড়াশোনা জানে না বা মায়েরা সংসারের প্রয়োজনে  লোকের বাড়ী কাজ করে এমন ঘর থেকে আসে । এখন তবুও কন্যাশ্রী  প্রকল্প ,মিড ডে মিল, সর্ব শিক্ষা মিশনের  নানা  গ্র্যান্ট পাবার জন্য মধুজার ছাত্রী রাও আলোর মুখ দেখেছে অনেকটা ।
        মধুজার খুব ভালো লাগে অন্তত রাতে খাওয়া হয়নি বলে সকালে পেট ব্যাথা তে ওরা কষ্ট পায় না । মায়ের কাছে টাকা নেই বলে বই খাতা ,ড্রেস না কিনে ওদের থাকতে হয় না ।
       তরতাজা  মুখগুলো যখন হই হই করে স্কুল বাড়ী মাতিয়ে  রাখে তখন আনন্দে মনটা ভরে যায় ।একটু আদর ভালোবাসা পেলে কত সুন্দর প্রস্ফুটিত হয় এই ফুলগুলো । মধুজা আপ্রাণ  চেষ্টা করে তার ভালোবাসা স্নেহ উজাড় করে শুকনো , অবহেলিত মুখগুলো তে হাসি আনার ।
          ওরা ও একটু স্নেহ ভালোবাসা পাবার জন্য দিদিদের কাছে গায়ে ঘেঁষে দাঁড়ায়।
      ওই ছোট মিষ্টি মুখ গুলো অনেক সময় হয় কত অত‍্যাচারের শিকার। বাড়িতে অনেকের পড়াশোনা করার পরিবেশ নেই, কারো বাবা থেকেও নেই। মা খুব কষ্ট করে মানুষ করছেন। কেউ বা ঠাকুমার কাছে মানুষ ।  একটু পড়ার জায়গা আর পরিবেশ ও পায়না বাচ্ছা মেয়েগুলো। অথচ এর মধ‍্যেও মোবাইলের কুপ্রভাবও আছে। মাঝে মাঝে ওদের আলোচনায় স্তব্ধ হয়ে যায়। এই তো সেদিন একটি ক্লাশ ফাইভের ছাত্রী নাকি বাড়ী গিয়ে রান্না করতে গিয়ে সাঙ্ঘাতিকভাবে পুড়ে গেছে। উঃ ভাবা যায়না।কত সমস‍্যা ওদের, তার  প্রতিফলন পরে ওদের লেখা পড়াতেও । তাই কখনও মা এর মত কখনও বা বড় দিদির মত মধুজা কাছে টেনে নেয় ওদের ।
         এদের মধ্যে ও কত মেধাবী ছাত্রী আসে , যারা অনেক দিন ছাপ রেখে যায় মনে । হঠাৎ যখন কোন পুরনো কৃতী ছাত্রী পায়ে  হাত দিয়ে প্রণাম করে বলে,"দিদি মাথায় একটু হাত দিন, যেন আর ও এগিয়ে যেতে পারি ।" মনটা ভরে যায়। আবার যখন টিভি তে খবরে দেখে সব চেয়ে অমনযোগী অথচ খেলাধূলায় ভাল ছাত্রীটি দৌড়ে রাজ্য স্তরে প্রথম হয়েছে খুশীতে পাখনা মেলে মন ।
           তবুও মধুজার নিজেকে খুব অসহায় লাগে যখন দেখে মলিন কাপড় পরা কোন ছাত্রীকে , কোলে একটা ছোট বাচ্ছা নিয়ে লজ্জাতে আড়ালে চলে যায় দিদির সামনাসামনি হবেনা বলে।
            কত মেধা , কত প্রতিভা হারিয়ে যায় , কখনো তাদের উদ্ধার করতে পারে কখনো পারেনা। তখন নিজেকে বড় অসহায় লাগে।অনেক ছাত্রীরই কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া আটকাতে পারেনি মধুজা, বাধা দিতে গিয়ে অপমানিত হয়েছে অনেকবার। কখন ও হামলা হয়েছে স্কুলে ।
        তাই এখন guardian's meeting এ অভিভাবকদের বোঝায় তারা সকলে , ১৮ বছরের আগে বিয়ে দিলে কন্যাশ্রীর ২৫০০০ টাকা পাবেনা । তবুও যদি টাকার জন্য মেয়েটার ১৮ বছর অবধি স্বপ্ন গুলো ডানা মেলতে পারে ।
     ওহ! শেষ অবধি বাস এলো, ভোরবেলা বাসের জানালাতে বসে শহর কলকাতার তিলোত্তমা রূপ দেখতে দেখতে মধুজা দুচোখ মেলে উপভোগ করে কলকাতা ছাড়িয়ে একটু দূরে সবুজ মেখলা চাদরের স্নিগ্ধতা । বড়ো বড়ো ভেড়ি ছাড়িয়ে বাস এগিয়ে চলেছে। ভোরের রাঙা আলোতে চারদিক ঝলমল করছে। ঠান্ডা বাতাস চোখে মুখে ছড়িয়ে দেয় শীতলতা। চোখ বুজে ফেলে মধুজা।
      হাতঘড়িতে সময় দেখে হয়ত ঠিক সময়ে পৌছতে পারবে,বাসটা ভালই চলছে। স্কুলের সামনে এসে কন্ডাকটারের তাড়াহুড়োয় অসাবধানতাবশত বাস থেকে পা পিছলে রাস্তায় পড়ে মধুজা।
       এক মুহূর্তে চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যায়। অসহ্য ব্যাথায় সারা শরীর অবশ হয়ে যায়। ভীড় জমে যায় লোকের,অভিভাবকদের।কিছুক্ষণের মধ্যে ছাত্রীরা, অন্য টিচার রাও এসে পড়ে । ছাত্রীদের সাহায্যে কোনরকমে ওঠে মধুজা, ছাত্রীদের চোখেও জল ওরাও বুঝতে পারছে মধুজা খুব কষ্ট পাচ্ছে।
     বরফ , ওষুধ যতটুকু যোগাড় করা যায়,সব এনে ছাত্রীরা চেষ্টা করলো মধুজাকে সুস্থ করতে। বড়দি বাড়ীতে ফোন করে দীপ্ত কে অ্যম্বুলেন্স নিয়ে আসতে বললেন।
   মধুজার চোখে জল টলটল করছে, কি করে চলবে তার সংসার? আবার কবে সব ঠিক হবে কে জানে? ছাত্রীরাও পিছিয়ে পড়বে। আর ভাবতে পারেনা ও।এর মাঝেই দীপ্ত এসে পড়ে অ্যম্বুলেন্স নিয়ে। খুব চিন্তিত লাগছে ওকে,তবুও মুখে হাসি এনে বললো সব ঠিক হয়ে যাবে।হয়ত একটু চিড় ধরেছ, আর কিছুনা। অ্যম্বুলেন্সে ওঠানো হয় মধুজাকে,পেছনে রইলো অনেকগুলো ভালবাসা মাখানো মুখ।
কলকাতার নামী বেসরকারী হাসপাতালে ভরতি হলো মধুজা। এক্স রে প্লেট দেখে ডাক্তার বললেন অপারেশন করতে হবে।
    মনটা ভারী হয়ে যায় মধুজার,দীপ্তর হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেলে। দীপ্ত সাহস দেয়,' দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
        অপারেশন টেবিলে ঘুমের ঘোরে ডুবে যেতে যেতে মধুজার মনে হল,কার যেন হাতের একটা শীতল পরশ তার কপালে । কিন্তু তখন আর চোখ খোলার ক্ষমতা নেই তার।
           বেডে দেওয়ার অনেক পরে চোখ মেলে মধুজা, তখনও যেন সারা শরীর অবশ আর চোখে ঘুমের রেশ লেগে , দেখে বেডের পাশে দাড়িয়ে দীপ্ত আর মা। ঘাড় নেড়েই আবার চোখ বোজে মধুজা। ঘুমের মধ‍্যেই অনুভব ‌করে মাথায় , গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এক শীতল স্পর্শ, ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় মধুজা।
         সকালে ঘুম ভাঙে মধুজার, কাল সারারাত এক অদ্ভুত ঘোরে কেটেছে, কখনও খুব যন্ত্রণা হয়েছে,আবার কখন ও বা সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে ইন্জেকশনের জন্য। তবুও যেন মনে হয়েছে সারা রাত মাথার কাছে কে যেন সেবা করেছে তার।ঘুম ভেঙে মধুজা দেখে পাশের টেবিলে একটা কাঁচের বাটিতে কি সুন্দর করে জুঁইফুল রাখা!
মনটা ভালো হয়ে যায় মধুজার, কি সুন্দর ব‍্যাবস্থা এদের! রুগীদের কত খেয়াল রাখে এরা।সিস্টার এসে গুড মর্ণিং বললে , মধুজা বলে কাল রাতে আমার মাথার কাছে তুমিই কি ছিলে ? মেয়েটি হাসে,বলে আমি এই এলাম। তাহলে হয়ত রাতের সিস্টার।
       সারাক্ষণের যত্নে,সেবায় মধুজা অনেক সুস্থ বোধ করে। সবচেয়ে ভালো লাগে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা জুঁই ফুলের গন্ধ,কখনও রাতে ঘুমের মধ‍্যে মনে হয় অতি যত্মে কে যেন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,নাকে আসে মিষ্টি চন্দনের গন্ধ।
      খুব প্রিয় এই গন্ধগুলো মধুজার। কে যেন ওর পছন্দের সব কিছু দিয়ে এই কেবিনটা ভরিয়ে রেখেছে।  সিস্টার কে বলে মধুজা,এখানে কি সব কেবিনেই এমন বেল,জুঁই আর চাঁপা ফুল রাখা হয়?💐
       সিস্টার হেসে বলে সব ঘরেই ফুল রাখা হয় ম‍্যাডাম তবে আপনার ঘরের ফুল পছন্দ করে আনেন আমাদের ইনচার্জ ম‍্যাম।
        অবাক হয় মধুজা,কে এই ইনচার্জ? মধুজার ছোট ছোট পছন্দ জানলো কি করে? কেন এত খেয়াল রাখছে ওর? অনেক প্রশ্ন ভীড় করে মধুজার মনে? বিকেলে দীপ্ত কেও বলে, এখানকার ইনচার্জ কি তোমার চেনা? দীপ্ত হেসে ফেলে বলে, আমার চেনা? কি বলছো!
   হয়ত তোমারই কোন পরিচিত বন্ধু হবে। আবার মধুজা অন‍্যমনস্ক হয়ে যায়। দীপ্ত নীরবতা ভাঙে,"
কাল বা পরশু তোমায় ছেড়ে দেবেন বলছেন ডাক্তারবাবু। সত‍্যি আর ভাল লাগছেনা, ছেলে মেয়েদের ও খুব মন খারাপ।"
        শুনে খুব খুশি হয় মধুজা একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এখন সত‍্যি অনেকটা ভাল আছে ও। অনেকদিন পর আজ হয়ত একটু নিশ্চিন্তে  ঘুমোতে পারবে।
        পরদিন সিস্টার বলে ম‍্যাডাম কাল তো বাড়ী চলে যাচ্ছেন এবার তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবেন। মধুজা হেসে বলে ,অনেকদিন মনে থাকবে তোমাদের যত্নের কথা। একবার যদি ইনচার্জ ম‍্যাডাম কে একটু ধন‍্যবাদ জানাতে পারতাম।
       "--উনি রিলিজ এর আগে একবার আসেন,নিশ্চয় আসবেন।"
             পরদিন ভোরবেলা মধুজার ঘুম ভেঙে গেল এক শীতল স্পর্শে।অনুভব করলো তার পায়ের পাতায় কোমল ছোঁয়া।
       চোখ মেলে এ কাকে দেখছে মধুজা?মুছে ফেলতে চাইলেও যে মুখ মুছে ফেলতে পারেনি গত বারো বছরে।
       "-অন‍ন‍্যা"-কিন্ত এ কি ক‍রে সম্ভব! অন‍ন‍্যা কে বাঁচাতে পারেনি মধুজারা,হার মেনেছিল ভয়ে,লজ্জায় একদল অমানুষ এর কাছে। তাই সেই হারের কথা ভুলে যেতে চায় মধুজা।কি অসাধারণ মেধাবী ছাত্রী ছিল অন‍ন‍্যা! মাধ‍্যমিকে সেবার প্রথম হয়েছিল জেলায়। গর্বে ভরে উঠেছিল ওদের মত ছোট স্কুলটি। মধুজার হাতে গড়া অন‍ন‍্যা।
কিন্তু মামা বাড়ীতে মানুষ মা বাবা হারা অনন‍্যার যখন জোর করে এগারো ক্লাসে পড়তে পড়তে মামারা বিয়ে দিয়ে দেয় তখন খবর পেয়ে মধুজারা ছুটে গিয়েও কিছু করতে পারেনি। অন‍ন‍্যা মাথা নীচু করে বলেছিল, 'মামারা  যা করছেন আমার ভালোর জন‍্যই করছেন,আপনারা চলে যান।"
পাড়ার একদল মাস্তান এসে হুমকি দিয়ে গিয়েছিল স্কুলে , বিয়েতে বাধা দিলে দেখে নেবে।
এখানে চাকরী করা বার করে দেবে। বড়দি খুব অসন্তুষ্ট হয়ে মধুজাকে বলেন আর কোন ঝামেলায় না যেতে।
      '"দিদি' মুখ ফিরিয়ে নেবেন না, আমি জানি আমার সেদিনের ব‍্যাবহার আপনাদের কতটা আঘাত করেছিল কিন্তু আমার কোন উপায় ছিলনা । মামারা নাহলে আপনাদের ক্ষতি করতো।"
         সত‍্যি মুখ ফেরাতে পারলো না মধুজা,বলে ফেললো,"কিন্তু তুমি কি করে?"মধুজার চোখে তখন অনেক প্রশ্ন। অন‍ন‍্যার দুচোখে জল।
      অনন্যা বলে, "আমি সত‍্যিই হার মেনেছিলাম দিদি,প্রায় ছয়মাস সুন্দরবনে শ্বশুরবাড়ীতে ধানসেদ্ধ করে ,মুড়ি ভেজে আর কখনও শাশুড়ীর গালমন্দ খেয়ে কাটছিলো। রাতে নেশা করে প্রায়দিন বর মারতো।" বইপত্র সব ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল ওরা,দুপুরে সব কাজের শেষে পড়তে বসতো বলে।
          তার অন্ধকার জীবন থেকে তাকে উদ্ধার করে ওই এলাকায় কাজ করা এক প্রভাবশালী এন জি ও স্থানীয় কিছু ভালো মানুষের সাহায্যে।
         ওরাই তুলে নেয় অনন্যার সব দায়িত্ব। গত দশ বছর শুধু তপস্যা আর লড়াই করেছে সে। ভুলে যেতে চেয়েছে তার যন্ত্রণাময় অতীত আর পুরনো আত্মীয়দের। কোন কিছুর সাথেই যোগাযোগ রাখেনি সে।
      শুধু মনের মণিকোঠায় যত্ম করে রেখেছিলো তার স্কুলের সোনালী দিনগুলো আর দিদিমণিদের। অনেক অবহেলা অত্যাচার ভুলে যেত সে স্কুলে এসে।সবার ভালবাসায় মন অনেক না পাওয়া কে ভুলিয়ে এগিয়ে দিত সামনে।
         সবার থেকে বেশী মনে হত মধুজা দিদির কথা। বড় দিদির মত কখনও যেমন শাসন করত মধুজা,তেমনি অন‍ন‍্যার অনেক ছোটখাটো আব্দার মধুজাই মেটাতো। নাইন টেন পরপর দুটো বছর মধুজাই ওদের ক্লাস টিচার ছিলো।
         মধুজার কাছেই অনন‍্যা শিখেছিল মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া কেন প্রয়োজন। রাজা রামমোহন রায়,বিদ‍্যাসাগর এরা কেন চেয়েছিলেন আমাদের দেশের মেয়েরা শিক্ষার আলো পাক। অনন‍্যা ও স্বপ্ন দেখেছিল সেও একদিন স্বাধীন স্বনির্ভর হয়ে আত্মসম্মানের সাথে বাঁচবে।
         মধুজার পাদুটো দুহাতে ছুঁয়ে আবার প্রণাম করে অনন‍্যা বলে, দিদি আমি কথা রেখেছি আমি হারিয়ে যাইনি। খুব ইচ্ছে করত স্কুলে যেতে কিন্তু আমি ঐ গ্ৰামে আর ফিরতে চাইনি।
          ভগবান তাই মনেহয় এই ভাবে আমার ইচ্ছে পূরণ করলেন।
        আজ মধুজা অনন্যা কে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে, এ যেন এক অদ্ভুত আনন্দ। জীবন যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া অনন‍্যা এখন ডঃ অনন্যা রায়! এ যেন স্বপ্ন দেখছে মধুজা। মধুজা হেরে যায়নি, অনন‍্যা হারতে দেয়নি মধুজাকে। আজ শিক্ষকতা জীবনে মধুজার এক স্মরণীয় দিন।
   গতবছর তার নিজের ছেলেও স্কুলে প্রথম হয়েছিল মাধ‍্যমিকে,খুব খুশী হয়েছিল মধুজা। কিন্তু আজ যেন তার জীবনের সবচেয়ে খুশীর দিন। মধুজার দৃষ্টিপথের হারিয়ে যাওয়া এক খানা উজ্জ্বল মুখ তার সঠিক পথ খুঁজে পেয়েছে।
        এই সুখকেই বোধহয় বলে সৃষ্টিসুখ।

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...