Skip to main content

ব‍্যাডটাচে বিপন্ন পুরুষ

#ব‍্যাডটাচে_বিপন্ন_পুরুষ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

যীশু ওঠ বাবা,"আর কত ঘুমোবি,আজ যে তোর ইন্টারভিউ মনে নেই নাকি? ওখানে একদম ঠিক এগারোটায় পৌঁছতে হবে,জানিস তো।"
   ছোটবেলার মতো বালিশে মুখটা ঢেকে পাশ ফেরে যীশু,"মামণি ছাড়োনা,আজ যাবোনা ইন্টারভিউ দিতে। ভালো লাগছে না কিছু। আবার সেই জব,প্রেসার,সিডিউলড টাইম আমি আর পারছিনা নিতে। খুব ডিপ্রেসড লাগে গো।"
.....কণিকা হেসে ফেলেন"সব বুঝলাম,কিন্তু এমনভাবে সারাক্ষণ বাড়ীতে বসে যদি বইয়ের মধ‍্যে ডুবে থাকিস তাহলে তো তুই বইয়ের পোকা হয়ে যাবি। আর একদম কুড়ে হয়ে যাবি। আমি আর তোর বাবা কি সারাজীবন থাকবো এভাবে তোকে দেখার জন‍্য?"
  "থাকোনা,মামণি এই ভাবেই একদম ছোটবেলার মতো আমার একদম কাছে। যেমন করে তোমার কোলে মাথা দিয়ে শুতাম তেমনি। আচ্ছা মামণি,আমাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতেই তো পারতে,ছোটবেলার মতো। কেন আবার চাকরীতে পাঠাচ্ছো ওসব আমার ভালো লাগেনা।"
......" শোনো বুড়ো ছেলের কথা। এখন এই বয়েসে মায়ের আঁচলের তলায় বসে থাকবে। এই যা তো ওঠ ওঠ। এবার আমি গায়ে জল ছিটোবো।"
    হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেও নিঃশব্দে চোখের জলটা মুছে নেন কণিকা। পুরোনো ছবিটার দিকে তাকিয়ে দেখেন,কি সুন্দর ঝকঝকে স্মার্ট লাগছে টেনিস কোর্টে দাঁড়িয়ে থাকা যীশুকে। আর সেই ছেলের সাথে এখনকার ছেলেকে কিছুতেই মেলাতে পারেননা।
             আবার মাথায় হাতটা বুলিয়ে দিয়ে উঠতে বলেন ছেলেকে। " আচ্ছা চল আমিই না হয় যাচ্ছি তোর সাথে,তোর বাবার প্রেসারটা একটু বেড়েছে।"
     তৈরি হয়ে কণিকা বেরোন ছেলের সাথে,আজকাল আর ড্রাইভও করতে চায়না একদম। অথচ কি ভালো হাত ছিলো ওর। যখন দেরাদুনে কনভেন্টে পড়াতো তখন কত গাড়ি নিয়ে দেরাদুন মুসৌরী করেছে। একটা গভীর শ্বাস বেড়িয়ে আসে বুক থেকে কণিকার।
    কলকাতার ইংলিশ মিডিয়মে চাকরিটা হয়ে গেলো যীশুর। না হওয়ার মত কোন কারণ ছিলোনা। ওদের রিকোয়ারমেন্টের থেকেও অনেক অনেক বেশি এলিজেবল যীশু। শুধু ওনারা জানতে চেয়েছিলেন দেরাদুনের এত ভালো চাকরিটা ছেড়েছিলো কেন ? ওখানকার আ্যডমিনিষ্ট্রেশনের সার্টিফিকেট চিঠি সবই এগিয়ে দেয় যীশু। নেক্সট উইকেই ওর জয়েনিং,আ্যপয়েন্টমেন্ট লেটারটাও পেয়ে গেলো মেলে।
   হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন কণিকা যাক তবুও ছেলেটা এই কোটরবন্দী জীবন থেকে বেড়িয়ে একটু মুক্তির আলো দেখবে। দুঃস্বপ্নের রাত্রি কাটিয়ে যেন নতুন ভোর দেখে যীশু।
       এখানকার স্কুলটা ভালোই,তবে দেরাদুনের স্কুলটা ছিলো পাহাড়ের ওপরে একদম ছবির মত। কি অদ্ভুত বন্ডিং হয়ে গিয়েছিলো ওই স্কুলটার সাথে,কখনোই ভাবেনি একসময় দেরাদুনের স্মৃতি এইরকম অসহ‍্য হয়ে যাবে ।
প্রিন্সিপাল খুব খুশি যীশুর কাজে,অদ্ভুত ডেডিকেটেড টিচার। শুধু একটু আত্মভোলা,কখনো মুখে হাসি দেখেন না ছেলেটার। অদ্ভুত একটা বিষন্নতার ঘেরাটোপে নিজেকে বন্দী করে রেখেছে। টিচারদেরও একটু অসন্তোষ এই কারণে।
             এই সেদিনই ওর অনুপস্থিতিতে একজন বলছিলেন,"দেরাদুনের কনভেন্টে পড়াতো বলে কি অহংকারী দেখেছো? আমাদের যেন মানুষ বলেই ভাবেনা। কথাই বেরোয়না মুখ থেকে অথচ প্রিন্সিপাল একেবারে গদগদ ওনাকে পেয়ে। অসহ‍্য লাগে,এতো কাজ আমরা করি তবুও সারাক্ষণ এই রুলস সেই রুলস আছেই। আর দুদিন এসেই একেবারে স‍্যারের রাইট হ‍্যান্ড হয়ে বসে আছে। অথচ দুবার তিনবার জিজ্ঞেস করলে কোন কথার উত্তর দেয়।সবসময় একটা ইগনোরিং আ্যটিটিউড। এই দেখোনা এখন লাইব্রেরীতে গিয়ে বসে আছে।"
        কণিকার বেশ ভালো লাগে,অনেকদিন বাদে ছেলেটাকে আবার কাজে ফিরে যেতে। কণিকা নিজেও অবসর নিয়েছেন একসময় পড়াতেন। এখনো মনোবিকাশ নামে একটা কাউনসিলিং সংস্থার সঙ্গে যুক্ত তিনি। অনেকদিন তারও নিয়মিত যাওয়া হচ্ছেনা সেখানে।
....'কি রে স্কুলটা কেমন? তোর কোন অসুবিধে হচ্ছেনা তো?"
....."না মামণি,সব ঠিকই আছে। শুধু আমারই প্রতিদিন যেতে ইচ্ছে করেনা।"
....."যেতে যেতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। জীবন থেকে আর কতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবি। আমাদের জন‍্য,নিজের জন‍্য তো তোকে বাঁচতে  হবে বাবা।"
  স্কুলে অনেক ছেলেমেয়ে। ছোট ক্লাসেই বেশি ক্লাশ থাকে যীশুর। স‍্যার তেমনই বলেছেন। বাচ্ছাদের নিয়ে ভালো সময় কেটে যায়। মনটা ভালো হয়ে যায়। অনেক সময় ওদের গালদুটো ধরে একটু আদরও করে দেয়। এই তো সেদিন ক্লাশ ওয়ানের নেহা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ব‍্যাগ পিঠে করে নামতে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো। ওর ব‍্যাগটা কাঁধে নিয়ে ওকে কোলে তুলে নামে যীশু। দেখে ফেলেন মিষ্টার সেন," কি করেছেন স‍্যার এইভাবে বাচ্চা মেয়েদের কোলে নেবেন না। কখন কে দেখে একেবারে ব‍্যাড টাচের কেসে ফাঁসিয়ে দেবে। ওদের সাথে এতো ক্লোজ হওয়ার কি আছে?"
     লজ্জায় তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় যীশু। অদ্ভুত এক স্নেহের টান অনুভব করে এই বাচ্চাগুলোর প্রতি। কি আছে দোষের এত! অথচ একসময় দেরাদুনে ঝিমলি আর ওর বন্ধুরা তো ওর ঘাড়ে উঠেই ঘুরতো।
        একটু একটু করে যীশু ভালোবেসে ফেলছিলো স্কুল আর বাচ্চাগুলোকে‌। যদিও বুঝতে পারে ওর কলিগরা সবাই ঠিক ওকে পছন্দ করেন না। তবুও বই আর বাচ্চাদের নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছিলো।
      এর মাঝেই নতুন অনেকের মাঝে আ্যডমিশন নিয়েছে শ্রুতি বলে একটা বাচ্চা মেয়ে,একটু পা টা টেনে হাঁটে। ওকে দেখে মনটা ছুঁয়ে যায় যীশুর, যেন খুব পরিচিত একটা হারিয়ে যাওয়া মুখ দেখতে পায়। বাড়ীতে গিয়েও মাকে বলে একই কথা। নিশ্বাস ফেলেন কণিকাদেবী ভাবেন তবুও যদি ছেলেটা ভালো থাকে।
      মানুষের খারাপ সময়ে বোধহয় একের পর এক বিপদ এভাবেই আসে। সেদিন ছিলো একটা বৃষ্টিভেজা দিন। ছোট বাচ্ছাদের সবে ছুটি হয়েছে, বেল বেজেছে। বড়দের আরো একটা ক্লাশ বাকি। তাড়াহুড়ো করে নামতে থাকে বাচ্ছারা। বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়ে শ্রুতি একটু দাঁড়িয়ে যায় রেলিংয়ের ধারে। হঠাৎই ছুটে বেরোয় আরেকটা ক্লাশ ড্রিলের জন‍্য,ওদের ধাক্বা খেয়ে ছিটকে পড়ে শ্রুতি। একটা ধারালো কোণে লেগে চামড়া উঠে
যায় আর কেটে যায় ,হাঁটু আর ওপরের অংশ। যীশুও ঠিক সেইসময় বেরিয়েছিলো ক্লাশ থেকে আসছিলো করিডোরের দিকে। ছোট্ট গলার কান্না শুনে এগিয়ে দেখে শ্রুতি। ওর পায়ে আর স্কার্টে রক্ত দেখে মাথাটা কেমন যেন ঘুরে ওঠে। মনে পড়ে যায় দুবছর আগের কথা। তাড়াতাড়ি ওকে কোলে তুলে স্কার্টটা সরিয়ে দেখে অনেকটাই কেটে গেছে। সমানে কেঁদে চলেছে শ্রুতি। ওকে কোলে নিয়ে নেমে আসতেই কয়েকজন টিচার আর ডে সেকশন এর ছেলেমেয়ে দেখে ফেলে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পরে খবর, নির্যাতনের শিকার হয়েছে শ্রুতি। ততক্ষণে গেটের বাইরে জমেছে ডে সেকশন আর ম‍র্ণিং সেকশন মিলিয়ে কয়েকশো গার্জেন।
          বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সবাই,দাবী একটাই যীশুকে বের করে দেওয়া হোক ওরা দেখে নেবে। একদম রক্ত বের করে ছেড়েছে ওইটুকু বাচ্চার শরীর থেকে। ভয়ে, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেছে শ্রুতি,যীশু অনেক আবেদন জানালো অন্তত আহত মেয়েটাকে একটু ওষুধ দেওয়া হোক।
         কিন্তু কে শোনে কার কথা। ততক্ষণে পাথর ইট সবই পড়েছে স্কুলে। আহত হয়েছে যীশুও,পুলিশও হার মেনেছে। প্রিন্সিপাল অনেক কষ্টে একটা ঘরে বসিয়ে রেখেছেন যীশুকে। মিডিয়া,প্রেসের লোকে ছড়াছড়ি।
        পাগলের মতো এসে শ্রুতিকে কোলে টেনে ওর মা কয়েকজনের সাহায‍্যে সোজা হসপিটালে যান। রাগে ফুঁসতে থাকে সবাই,দেখে ওর স্কার্টে রক্ত লেগে। অনেক জিজ্ঞেস করাতে ভয় পেয়ে শুধু কাঁদতে থাকে শ্রুতি,মুখ দিয়ে একটা কথা বেরোয় "স‍্যার"।
           হসপিটালে ডাক্তারবাবু সব দেখে সবাইকে বলেন,"আপনারা স্কার্টে রক্ত দেখে এতো কিছু করে ফেললেন। ওর তো উরুটা ডিপ হয়ে কেটে গেছে,অনেকটা ছড়ে গেছে। তাই এত রক্ত,কোন রকম নির্যাতন হয়নি ওর ওপর। মেয়েকে একটু শান্ত করুন ওই সব বলবে।"
       সবাই ততক্ষণে অপেক্ষা করছে বাইরে, ডাক্তারবাবু একই কথা বললেন। সত‍্যি ভুল বুঝে অনেকসময় কত কি ঘটে যায়!ততক্ষণে ব‍্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যায় সবার কাছে কিছুটা তবুও অনেকেই মানতে নারাজ। অনেকেরই দাবী সি সি টিভি ফুটেজ দেখাতে হবে। এমন টিচারকে না রাখাই ভালো। সব চ‍্যানেলগুলোতে দেখানো শুরু হয়ে গেছে অনেকক্ষণ ঘটনার লাইভ। কণিকা দেবী আর ওনার স্বামীও জেনেছেন। স্তব্ধ হয়ে যান তারা,ভেঙে পড়েন সন্তানের কথা ভেবে। তবুও মনের জোর টুকু এক জায়গায় করে প্রিন্সিপালকে ফোন করেন। গন্ডগোল চাপা পড়লে কোন রকমে নিয়ে যান সম্পূর্ণ মানসিকভাবে বিদ্ধস্ত ছেলেকে।
          বাড়ীতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ভয় পেয়ে যাওয়া শ্রুতি, মায়ের কোলে। ঘুম ভাঙলে মায়ের কাছে একটু একটু করে সবটাই বলে। সত‍্যি এবার নিজেদের খুব ছোট মনে হয় ওর মা বাবার। সব ধারণাই বোধহয় সবসময় সত‍্যি হয়না।
       মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। দিনকয়েক স্কুল বন্ধ থাকার পর আবার খুলেছে। যীশুকে যে কি ভাবে সামলেছেন তা একমাত্র কণিকা দেবীই জানেন। এর মধ‍্যেই আছে পাড়া প্রতিবেশীর আলগা সহানুভূতি আর কৌতূহল,সবটাই সহ‍্য করতে হয়েছে মুখ বুজে। স্কুলের সবাই ভাগ হয়েছে দুইদলে অনেকেরই মত যীশুকে সাসপেন্ড করাই ভালো। শুধু প্রিন্সিপাল নোটিশ দিয়েছেন সবটাই হবে সবাই যা চাইছে তার ওপর ভিত্তি করে তবে একটা গার্জেনস মিটিংয়ের পর,সেখানে থাকবে যীশুও আর মনোবিকাশ বলে একটি সংস্থা।
         শ্রুতি সেদিনের ঘটনায় এতটা ভয় পেয়েছে ওকেও সামলানো খুব মুশকিল। শুধু বলছে, "মা স‍্যার খুব ভালো,তোমরা মারলে কেন?"
         অনেক কষ্টে ওকে বুঝিয়ে স্কুলে নিয়ে আসা হয়েছে মিটিং এর দিন‌।  সেদিন শনিবার অন‍্য বাচ্ছারা আসেনি। বিরাট হলঘরে সবাই এসেছে,অনেক কষ্টে রাজী করিয়ে ছেলেকে এনেছেন কণিকাদেবী বলেছেন,"মুখ লুকিয়ে অপরাধী হয়ে থাকবি কেন তোকে মুখোমুখি হতেই হবে।"
              এককোণে বসে যীশু,ঠিক যেন বিচারের কাঠগড়ায়। সঙ্গে নিয়ে এসেছে রেজিগনেশন লেটার। প্রিন্সিপালের হাতে দিয়েছে যদিও উনি তা আ্যকসেপ্ট করেননি। কণিকাদেবী এসেছেন মনোবিকাশের হয়ে,যীশুর মা হয়ে নয়। সভা শুরু করেন প্রিন্সিপাল কিন্তু অনেকেই স্তব্ধ হয়ে যায় শুনে,কি বলছেন তিনি! যীশু এখানে জয়েন করার পর যে কোন ভাবে উনি জানতে পারেন,দেরাদুনের কনভেন্টের খুব পপুলার আর দ‍্য বেষ্ট টিচার ছিলো ও। সমস্ত দিকে ব্রাইট,খেলাধূলায়,পড়াশুনায়,গাড়ী চালানো,সাঁতার,হর্সরাইডিং। এছাড়াও খুব ভালো পিয়ানো বাজাতো। ওখানে পাহাড়ের কোলে কোয়ার্টাসে থাকতো মেয়ে ছোট্ট ঝিমলি আর স্ত্রী অনুকে নিয়ে। কিন্তু হঠাৎ একদিন এক বর্ষার দিনে যখন মুসৌরি থেকে ফিরছিলো,গাড়ী আ্যক্সিডেন্টে পাহাড়ের খাদে পড়ে শেষ হয়ে যায় ঝিমলি আর অনু শুধু প্রাণ বেঁচে গিয়েছিলো ওর। বারবারই আহত অবস্থায় নিজের মৃত‍্যু কামনা করেছিলো কিন্তু সবই কপাল। হয়ত জীবন্ত লাশ হয়েই বেঁচে ছিলো। কিন্তু এই স্কুলে ঝিমলির বয়সের বাচ্চাগুলো ওকে দেখিয়েছিলো একটু খুশির ঝলক‌। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবার হয়ত অন্ধকারেই চলে যাবে ছেলেটা। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে যীশুর।
                    সাদা চোখে দেখা জিনিসও যে অনেক সময় ভুল হয়। কিছু করার নেই হয়ত বর্তমান পরিস্থিতিই মানুষকে এমন ভাবতে শিখিয়েছে। তাই আজকের সমাজে নারীদের চেয়েও কোথায় যেন বিপন্ন পুরুষ। হয়ত কিছু লোকের লালশার ফল ভোগ করছে সমগ্ৰ পুরুষ সমাজ।
               শ্রুতির মা বাবাও নিজেদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। পুরোটাই হয়েছে ভয় আর নিরাপত্তাহীনতা থেকে। তাদের কৃতজ্ঞতা জানান স‍্যারের প্রতি যিনি সন্তান স্নেহে দেখতেন বাচ্ছাদের। কিন্তু তবুও বিশ্বাস বড়ো ঠুনকো হয়ে গেছে মানুষের।
            সবশেষে প্রিন্সিপাল অনুরোধ করেন মনোবিকাশ সংস্থাকে কিছু বলতে। কণিকা দেবী বলেন," বর্তমান পরিস্থিতিতে আজ বোধহয় সবচেয়ে বেশি বিপদে আছে পুরুষ,কারণ তাদের আর কেউ বিশ্বাস করেনা। আর এর জন‍্য দায়ী কিছু লালসা লোলুপ বিকৃতমনস্ক মানুষ। কিন্তু সবাইকে এক দলে ফেলা যায়না।      
        লৌকিকতা,বিজয়া,নববর্ষ সবটাই মুঠোতে ছবির আদানপ্রদানে হয়ে যায়। এর কুফল অনেকটাই ভোগ করছে শিশুরা, তারা জানেইনা সম্পর্কগুলো কেমন হয়। সেভাবে সুযোগই পায়না বুঝতে স্কুল আর ঘরের বাইরেও একটা জগৎ আছে যেখানে অনেকেই সম্পর্কে তার আত্মীয় বা হয়ত আত্মীয়ের চেয়েও বেশি। প্রাচীনকাল থেকে এখনো নারী নানা ভাবে নির্যাতিতা হয়েছে, আর সবসময়ই বিপক্ষে তখন কোন না কোন পুরুষ। নানা উপাধিতে আমরা ডেকেছি তাদের,কখনো তারা ধর্ষক,কখনো বা শাসক আবার কখনো পালক। তবুও আমার পিতা একজন পুরুষ ,আমার স্বামীও একজন পুরুষ এবং আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, আর আমার সন্তান যে আমার সবচেয়ে প্রিয় সেও একজন পুরুষ। পৃথিবীর সব পুরুষই কোন না কোন সম্পর্কে নারীর সাথে বাঁধা। সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হাতে হাত মিলিয়ে একসাথে কাজ করেছে নারী,পুরুষ। সাম্প্রতিক কালে যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা অত‍্যন্ত লজ্জাজনক এবং অমানবিক এই ঘটনায় নারীসমাজ যত না বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার থেকে বহুগুণ সঙ্কটে আজ ছেলেরা । তাদের এরপর আর কেউ রাখতে চাইবেনা গৃহশিক্ষক হিসেবে, কেউ বিশ্বাস করে তাদের কাছে বাচ্ছাকে নাচ শেখাতে দেবেনা। একজন রুগী ভয় পাবে ডাক্তারকে। ছাত্রী ভয় পাবে মাস্টারমশাইকে। শুধু একটাই প্রশ্ন সমাজের সব পুরুষই কি নারী শরীর লোভী ধর্ষক, অত‍্যাচারী আর কাপুরুষ?নারীর মধ‍্যে যে মায়া,মমতা আর অনুভূতি আছে তা কি পুরুষদের মধ‍্যে একটুও নেই? মায়ের মত একজন বাবাও পরম যত্নে সন্তান পালন করেন,আদর করেন,তার ন‍্যাপি পাল্টানো থেকে স্নান করানো,স্কুলে নিয়ে যাওয়া কত কি যে করেন তার কোন হিসেব থাকেনা। নিজের সন্তানের বয়সী আরেকটি শিশুকে যে বাসে সীট পায়নি তাকে কোলে নিলে সেটা কোন টাচ হবে,গুড না ব‍্যাড? আমার তো মনেহয় এটা শুধুই মানবিকতার টাচ।
        একজন শিশুকে একটি মেয়ে যদি গাল টিপে আদর করতে পারে,চুমু খেয়ে কোলে নিতে পারে। তখন এই অনুভূতি একটি ছেলের হওয়া কি খুব দোষের? সেও তো মানুষ, তাই মানবিক আবেগ তো তার মধ‍্যে থাকতেই পারে। নিশ্চয় উত্তরে বলবেন তাহলে কেন শিশুকে যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে? নারী ,পুরুষ উভয়ের মধ‍্যেই লুকিয়ে আছে কিছু বিকৃতমনস্কতা আর অসুস্থতা। কিন্তু সবাই সেই দলে পরেননা। শিশুদের গুড টাচ আর ব‍্যাড টাচ শেখাতে গিয়ে এমন দিন আসবেনা তো যেদিন বাবার জড়িয়ে ধরে আদর করা,দাদার আদর করে চুমু দেওয়া সবটাই ব‍্যাড টাচ বলে মনে হবে? বা একসময় স্বামীর স্পর্শও ব‍্যাড টাচ বলে মনে হবে?
      আগামীতে হয়ত এমন দিনও আসছে যেদিন কোন মহিলা রাস্তায় পড়ে থাকলেও ব‍্যাড টাচ হবে এই ভেবে কেউ তাকে তুলবেনা,নদীতে ডুবে যাচ্ছে তবুও তাকে বাঁচাবেনা কারণ দুই ক্ষেত্রেই মহিলাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে বা তার শরীরের খুব কাছে গিয়ে টেনে তুলতে হবে। ছাত্রীরা প্রণাম করলে শিক্ষক মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করবেন না,জড়িয়ে ধরার কথা তো আসেই না। পুরুষ ,নারী সবাই বাঁচুক এই পৃথিবীতে নির্ভয়ে, নিশ্চিন্তে। অনুভূতি,আবেগ আর উচ্ছ্বাসগুলো হোক একদম নির্মল, সেখানে যেন কোন গন্ডী না থাকে।  ব‍্যাড টাচের খাঁচায় বন্দী বিপন্ন পুরুষকে বাঁচাতে হবে আমাদেরই কারণ এরা কেউ আমাদের পিতা,কেউ সন্তান,কেউ ভাই আবার কেউ স্বামী। নারীর অনুভূতির মতো পুরুষদের সুস্থ স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো একরাশ আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে পাখনা মেলুক আকাশে।"
          বলতে বলতে দুচোখে জলে ভরে যায় কণিকাদেবীর। " আমায় ক্ষমা করবেন,আমি হয়ত একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। আমার বলা শেষ করলাম। আমাদের কাউন্সিলিং ইউনিটের ছেলেমেয়েদের স‍্যার পারমিশন দিয়েছেন,ওরা এখানে সপ্তাহে একদিন করে এসে বাচ্চাদের সাথে কথা বলবে ওদের সমস‍্যা নিয়ে,মায়েদের সাথেও।"
               স্কুলের গেটের দিকে এগিয়ে যায় যীশু সাথে কণিকা দেবী,পেছনে তখন অনেকেরই ভীড়। আজ বাচ্চাদের আওয়াজ নেই শনিবার,তাই ওদের ছুটি। পেছন ফিরে একবার তাকায় স্কুলটার দিকে। হঠাৎই দেখে মায়ের হাত ধরে পা টেনে টেনে এগিয়ে আসছে শ্রুতি। মুখ ফিরিয়ে এগিয়ে যায় ও। পেছন থেকে কানে আসে একটা ছোট্ট গলার কান্নাভেজা কাতর আকুতি," তোমরা স‍্যারকে চলে যেতে দিয়োনা।"
   সমাপ্ত:-
          
            
                 

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...