Skip to main content

বার্ধক‍্যে বারাণসী

#বার্ধক‍্যে_বারাণসী#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

ঢাউশ ট্রলিটা টানতে টানতে আনে শ্রীপর্ণা,কালই ওরা এসেছে কলকাতায়।প্রায় দুবছর বাদে এবারের পূজোয় কলকাতায় আসা‌। শ্রীপর্ণা থাকে চেন্নাইয়ে। ওখানে আইটি সেক্টরে কাজ করে,সিঙ্গেল মাদার বছর দুয়েক আগেই ডিভোর্স হয়ে গেছে শীর্ষর সাথে। সত‍্যি আর কিছুতেই নাকি থাকতে পারছিলোনা,যদিও বাবা মা পুরোনোপন্থী মানুষ তারা অনেক বুঝিয়েছিলেন দুজনকেই মেয়েটার কথা ভেবে একটু আ্যডজাষ্ট করতে। কোন লাভ হয়নি,এখনকার আধুনিক ছেলেমেয়েদের কাছে বাবা মায়ের ভূমিকা অনেকটা ওই আছে কেউ এইরকম,থাকলে থাকো না থাকলে না থাকো এমনিই। তারা নিজেরাই বেশি ভালো বোঝে।
     মেয়ের কাছে শুনেছেন সুবিমল আর সুষমা যে সে হয়ত খুব শিগগিরি বিয়ে করবে অশোককে। ছেলেটি সাউথ ইন্ডিয়ান কিন্তু বেশ ভালো। "যা ভালো বুঝিস কর। শুধু দেখিস আমাদের দিদিভাইয়ের যেন কোন কষ্ট না হয়।"
      "ওইসব নিয়ে ভেবোনা একদম। ও ভীষণ আ্যডজাষ্টেবল বরং তোমার দিদিভাই একদম ওর বাবার মত একরোখা আর জেদি। যেমন বাবা তেমন মেয়ে। বাদ দাও ওসব কথা, কেনো হঠাৎ জরুরী করে ডাকলে বলো। শুনলাম দাদাও তো আসছে। তোমরা যে কেন এই ভাবে হঠাৎ হঠাৎ তলব করো। জানো তো আমরা প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করি যখন তখন ছুটি পাওয়া যায়না। আচ্ছা এই নাও এটা তোমার শাড়ী,তোমার তো সাউথ সিল্কের শখ ছিলো। আর এটা বাবার। কি পছন্দ হয়েছে তো?"
     শাড়ীটা হাতে নিয়ে সুষমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লেও বলেন," খুব সুন্দর হয়েছে রে।" মনে মনে ভাবলেন কোথায় আর যান এখন! আজকাল জিনিসের থেকে সন্তানকেই কাছে পেতে ইচ্ছে করে। বড়ো অসহায় লাগে এই বুড়ো বয়সে। দুজনেরই শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা। এই তো সেদিন সুবিমল মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন ব‍্যাংকে। পাড়ার ছেলেরা বাড়ী পৌঁছে দিয়েছিলো ,আর বলে গিয়েছিলো উনি যেন এভাবে একা না বেরোন। তাই এই বয়সে ছেলেমেয়েরা যদি ওদের একটু দেখতেন। কিন্তু দুজনেই কলকাতার বাইরে।
          ছেলেকেও আসতে বলেছেন,ওদের দুই ভাইবোনকেই বলবেন ব‍্যাপারগুলো। সুষমার পক্ষেও রান্না বাজার সবটা সামলে ওঠা আজকাল আর সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কখনো কখনো কাজের লোক কামাই করলে হিমশিম খান। সামনে সপ্তাহেই তো ওদের পঞ্চাশতম বিবাহবার্ষিকী। ভালোই হবে ছেলেমেয়েদের নিয়ে দিনটা আনন্দে কেটে যাবে। সত‍্যি বলতে সংসারের টানাপোড়েনে তেমনভাবে কোনদিনই পালন করা হয়নি দিনটা। যদিও সুবিমল মনে করে শাড়ী আর মিষ্টি আনেন সেদিন। হয়ত ছেলেমেয়েদের মন থেকেও মুছে গেছে দিনটা ধীরে ধীরে। কারণ কোনদিনই কোন উৎসব হয়নি এই দিনটা ঘিরে।
        দুদিন পরেই ছেলে বৌ আর নাতি আসে। সবাই জানতে চায় হঠাৎ তলব কেন? তবুও বাড়ীতে একটা উৎসবের মেজাজ। কতদিন বাদে জমজমাট বাড়ী। খুব ভালো লাগছে সুবিমল আর সুষমার।
            সুষমাই কথাটা শুরু করেন যে তাদের আর এভাবে থাকা সম্ভব হচ্ছেনা। খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। মাঝে মধ‍্যে দুজনের মধ‍্যে কারো না কারো শরীর খারাপ হচ্ছে। ছেলেমেয়ে দুজনেই বলে ওঠে, ওই জন‍্যই তোমাদের ভালো করে মোবাইল টা শিখতে বলেছিলাম আজকাল অনলাইনে কি না হয়?
মুখটা একটু কালো হয়ে যায় সুষমার। মশলা,তেল আর চালের হিসেব করতে করতে কখন যে বুড়ি হয়ে গেছেন বোঝেননি। মোবাইল চালানোর চেয়ে মোচাঘন্ট,থোড়ের ছেচকি,বিউলির ডাল রান্না করা এগুলোই তার সহজ লাগে।
        "তাহলে কি চাইছো তোমরা?" শ্রীপর্ণা জিজ্ঞেস করে।
....না তোরা যদি এই সময়ে একটু দায়িত্ব নিতিস আমাদের। কিছুদিন করে যদি পাল্টাপাল্টি করে দেখতিস? এইসময়ে বড়ো আপনজনের সাথে থাকতে ইচ্ছে করে রে। খুব একা লাগে , ভয় হয়।
      ছেলে মেয়ে দুজনেরই মুখটা শুকিয়ে যায়। বৌমা হাল্কা গুতো মারে ছেলেকে।
...."তোমরা তো জানো,আমাদের টু বেডরুম ফ্ল্যাট। তাই এককাজ করো মা তুমি আমার কাছে থাকো। আর বাবা বরং শ্রীপর্ণার কাছে থাক। কি বলিস।"
        ....." নানা দাদা মা আমার কাছে থাক। বাবা বরং তোর কাছে থাক দাদা।"
    দুজনেই জানে মা এখনো কর্মক্ষম। মাকে রাখলে অনেক সুবিধা,অন্তত ভালোমন্দ রান্না করে খাওয়াতে পারে। দরকার মতো ঘরও সামলাতে পারবে। ছেলে মেয়ে দুজনেরই তাই শুধু মাকেই দরকার। অসুস্থ বাবাকে আর কারো দরকার নেই। এককালে যে মানুষটা পুরো সংসারটা ধরে রেখেছেন তিনি এখন একটা অকম্মা লোক। তাকে আর সংসারে এখন কারো কাজে লাগেনা‌। সত‍্যি অকেজো মানুষ শুধুই বোঝা সমাজ সংসারের কাছে‌। মুখটা কালো হয়ে যায় সুষমার,সুবিমল উঠে ঘরে চলে যান।
....."কি পছন্দ হলোনা আমাদের প্রস্তাব? তাহলে বরং একটা হোম দেখি ,ওখানে তো সব ব‍্যবস্থাই থাকে,তোমাদের কোন হেডেক থাকবেনা।"
           অনেকদিন বাদে স্বামীর বুকে মাথা রাখেন সুষমা। একমাত্র আপনজনকে ছেড়ে থাকবেন কি করে? তার চেয়ে বরং হোমই ভালো। কিন্তু তার এতোদিনের সংসার,প্রতিটা জিনিসে যে তার আদর জড়ানো তাই বড় মায়া যে এখানে। কি করে ছেড়ে যাবেন এই সংসার।
               ছেলেমেয়েরা হোমের খোঁজ করতে থাকে। সুবিমল ও এরমধ‍্যে খুব ছোটাছুটি করছেন ব‍্যাংকে।
       সবই মোটামুটি ঠিকঠাক,অনেকদিন বাদে নিশ্চিন্ত হয়েছে ওরা ভাইবোন। যাক একটা মাঝারি খরচের হোম পাওয়া গেছে। সেদিন রাতে অনেক কিছু ভালো রান্না করেছিলেন সুষমা। শুতে বেশ রাত হয়ে যায় সবার। পরদিন সকালে অনেক দেরীতে ঘুম ভাঙে শ্রীপর্ণার। দাদারা তখনো ওঠেনি। কিন্তু মা তো এতক্ষণে রান্না শুরু করে দেয়। কি হলো?
              কাউকেই না দেখতে পেয়ে,বাবার নম্বরে ফোন করে। কিন্তু ফোনটাতো বালিশের পাশেই রাখা। তাহলে? তাড়াতাড়ি দাদাকে ডাকে শ্রীপর্ণা। সত‍্যিই তো কোথায় গেলো মানুষ দুটো।
         হঠাৎই একটা চিঠি নজরে পড়ে যায় ওদের।
   "স্নেহের বাবু ও শ্রীপর্ণা,
                                       তোমাদের সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে আমি তোমার মাকে নিয়ে চলে গেলাম। হাজার হোক অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে করেছিলাম ওকে। পঞ্চাশ বছর ধরে সুখে দুঃখে আমাকে আগলে রেখেছে আবার অবলম্বনও করেছে। তাই ওর পাকাপোক্ত ব‍্যবস্থা করে ফেললাম‌। তোমরা যখন এই চিঠিটা পাবে তখন আমরা বেনারসের পথে। বার্ধক‍্যে বারাণসীকেই বেছে নিলাম। ওখানে গঙ্গা স্নান করে আর বিশ্বনাথ দ‍র্শন করে বাদবাকী জীবনটা কাটিয়ে দেবো। তোমাদের মায়ের অনেক দিনের শখ ছিলো। ভালো থেকো,তোমরা। নিশ্চিন্তে সংসার কোরো। আমাদের কোন দায়িত্ব ই তোমাদের নিতে হবেনা।বাড়ীটা বিক্রীর ব‍্যবস্থা করে দিয়েছি। অর্ধেক টাকা তোমাদের দিয়ে দেবে ভাগ করে। বাকিটা আমাদের।"
                 পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকীটা আজ গঙ্গায় স্নান করে,বিশ্বনাথের পূজো দিয়ে আর গঙ্গার ঘাটে স্বামীর পাশে বসে স্মৃতিরোমন্থন করেই কাটলো সুষমার। স্বামীর পায়ে প্রণাম করে বললেন," আশীর্বাদ কোরো জন্মজন্মান্তরে যেন তোমাকেই পাই এভাবে"।
          
        

       

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...