#মেয়েরা_সব_পারে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
(নারী দিবসের প্রাক্কালে)
'আজকে আটাটা একটু ভালো করে নরম করে মেখো বৌমা,ওই শক্ত চামড়া রুটিগুলো গলা দিয়ে নামেনা। সারাদিন পরিশ্রম করে আসে ছেলেটা,ভালো করে একটু যদি খেতে না পারে তাহলে কিসের জন্য সংসার করা? তুমি আর কি বুঝবে যখন যা চাইছো এসে যাচ্ছে। আটাটা মেখে ঢাকা দিয়ে রাখো,ও খেতে বসার আগে একদম গরম রুটিগুলো করে দিয়ো। অন্ততপক্ষে এই সুখটুকু দাও ছেলেটাকে। কিছুই তো পেলোনা,এত রোজগার করে যে কি লাভ!'
কথাগুলো মাঝে মাঝেই শোনে সুমি। এখন খুব একটা গায়ে লাগেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় সব কিছুই হয়ত খারাপের জন্য নয় শাশুড়ির গালাগাল শিখে একটু হলেও কাজ শিখেছে ও। কারণ বিয়ের আগে তেমন কোন কাজ করার অভ্যেস ছিলোনা ওর। যতই উনি বলুন আজকাল রান্নাটা মন্দ করেনা ও। অন্ততপক্ষে রঞ্জনের খাওয়া দেখে তেমনই মনে হয়। রাতে কানে কানে বলে," শোন তোমার রান্নার হাতটা কিন্তু বেশ খুলেছে,মায়ের সামনে কিছু বলতে পারিনা বোঝই তো। হাসে সুমি,' না বলাই ভালো,এই যে বললে এটাই তো অনেক।'
মা আর মেয়ের ছোট্ট সংসার ছিলো ওদের। মা তেমন কিছু করতে দিতেননা। বাবা মারা যাবার পর খুব সীমিত আয়ে চলতে হত। তাই বেশি রান্নাবান্না শেখা হয়নি। ওর মামা উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর যখন সম্বন্ধটা নিয়ে আসেন রাজি হয়ে গিয়েছিলেন মা। ছেলেটা কাজকর্ম ভালোই করে যাক মেয়েটা ভালো থাকবে আর ছোট সংসার কোন ঝামেলা নেই।
ঝামেলা সত্যিই নেই শুধু শাশুড়িমায়ের খোঁচাটাই একটু বেশি। সুমি মাঝে মাঝে ভাবে আর হাসে ওর গায়ে বোধহয় সত্যিই গন্ডারের চামড়া। আসলে উনিই বা কি করবেন,বাড়িতে তো তেমন কেউ নেই তাই বোধহয় ওর পেছনে টিক টিক করাটাই কাজ। তবে স্বামীর আদর ছিলো পর্যাপ্ত তাই ওটুকু সয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার ছিলোনা। "শোন,মা অনেক কষ্টে এই সংসার রক্ষা করেছেন,তাই তোমার ব্যবহারে মা যেন কষ্ট না পায়।"...আহা মাতৃভক্ত ছেলে,মা কষ্ট পেলে ওনার কষ্ট হবে,আর বউকে যে সারাক্ষণ খোঁচা মারছে সে বেলা কি তাই বলেই ফেলে,'যত কষ্ট সব আমার জন্য তোলা থাক।'...'আমি আছি তো তোমার কষ্ট ভোলাতে,দেখোতো এই চাঁদমুখটা দেখবো বলেই তো আজ এই সুগন্ধটা আনলাম।'...সুমির গায়ে সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে ওকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় রঞ্জন, বেশ অনেকটা রাত হয়ে যায় ঘুমোতে ঘুমোতে।
সকালে দরজাতে জোরে খটখট শব্দে লাফিয়ে ওঠে সুমি,তাড়াতাড়ি শাড়িটা ঠিক করে চুলটা খোঁপা করে বেড়িয়ে আসে।'ছেলেটা ঘুমোচ্ছে ঘুমোক,তুমিও তাই বলে এত বেলা অবধি! এদিকে ভাত বসিয়ে দিয়েছি কখন,শুধু কি ভাত খেয়েই যাবে?'...'আপনি যান,আমি এই যে আসছি। ওদিক থেকে রঞ্জন আদুরে গলায় বলে আজ ডাল আর অমলেট করে দিলেই হবে। একটু কাছে এসো একবার। উপায় নেই তাই আঁচলটা ছাড়িয়েই ছুটলো রান্নাঘরে।যাওয়ার আগে বলে গেলো,'তুমি ঘুমোও এবার মনের সুখে,আমাকে রাতে ঘুমোতে দিলেনা আর এখন সকালে মায়ের মুখ শুনতে হচ্ছে।'
এইভাবেই কেটে গেছে তিনটে বছর তবুও সন্তান না হওয়ায় সবসময় শাশুড়ি বলতেন কোন কম্মের নয় একটা বাচ্চাও হলোনা এতদিনে। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে এবার সত্যিই মা হতে চলেছে সুমি। শাশুড়ি আবার বললেন," শোন শুয়ে থাকবেনা সবসময় এইসময় কাজকর্ম করবে,না হলে তোমারই অসুবিধে হবে।"...বৌয়ের সাধের অনুষ্ঠানটা ভালো করেই হল রঞ্জনের ইচ্ছেয়।'এত খরচ করছিস!শেষে ছেলে হলেই হয়। নাহলে বংশরক্ষা হবেনা।' বংশরক্ষা করা হলনা সুমির,ভগবান শুনলেন না শাশুড়ির কথা, ঘরে এলো মেয়ে। কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সন্তানের বায়না ধরলেন শাশুড়ি কিন্তু না এবার সব চেষ্টাই বিফলে গেল ডাক্তার বলে দিলেন আর মা হওয়া সম্ভব নয় ওর পক্ষে।
সারাক্ষণই এই নিয়ে অভিযোগ শুনতে শুনতে দেখতে দেখতে মেয়ের তিনবছর বয়েস হয়ে গেল। এরমধ্যেই এক বিপর্যয় এলো ওদের জীবনে,রঞ্জনের আ্যক্সিডেন্টে শরীরের নিচের অংশটা অবশ হয়ে গেল। ওর চিকিৎসায় জমানো সবটাই মোটামুটি খরচ হয়ে গেল। বেসরকারি সংস্থা তাই চাকরির মাইনে পেলোনা। ওরা বললো সুস্থ হয়ে গেলে ভাববে ওরা আবার কাজে রাখা যাবে কিনা।
বাড়ির ছেলে অসুস্থ সংসার চলবে কি করে এই ভেবেই শাশুড়িমা বলেই ফেললেন,"পড়াশোনা জানলে তবুও হত,সেই জন্মও দিলো আবার মেয়ের। এখন যে কি করে কি হবে,এত খরচ কোথা থেকে আসবে?" একেক করে গয়নাগাটি সবই মোটামুটি চলে যায় সুমির। রঞ্জনের অসহায় মুখটা দেখে কিছু ভালো লাগেনা। ওকে সবটাই করিয়ে দিতে হয়। সুমি ঠিক করে মেয়েকে ইংরেজী মিডিয়াম ছাড়িয়ে বাংলা মিডিয়ামে দেবে। স্কুলে গিয়ে জানায় ব্যাপারটা। যখন মানুষের বিপদ আসে তখন হয়ত আশার আলো দেখায় কেউ। ওদের প্রিন্সিপাল এসে দাঁড়ান ওর পাশে। 'শুনুন আপনি এখানে কাজ করুন,তেমন কিছুনা বাচ্চাদের খেয়াল রাখা ওদের সমস্যা হলে দেখা এইসব। সকালে বাড়িতে আপনার স্বামীকে দেখে,মেয়ের সাথে চলে আসবেন স্কুলে ওকে আমরা ফ্রী করে দেবো,মেয়েটি খুব ভালো। আপনিও মাইনে পাবেন। আপনার যদিও কষ্ট হবে তবুও বিকেলে যদি আমাদের যে অরফ্যান হোম আছে ওদের রুটিটা করে দিতে পারেন তাহলে আরো ভালো হয়।"....হার মানেনি সুমি,মেয়েকে পড়িয়েছে। নিজে কাজ করেছে সকাল বিকেল। রুটির সাথে সাথে বানিয়েছে মোমোও। অবশ্য এর জন্য ওর শাশুড়িকেই মনে মনে ধন্যবাদ দেয় ভাগ্যিস গালমন্দ করে আটাটা ভালো মাখতে শিখিয়েছিলেন। এখন মেয়েও ছোটছোট হাতে মোমোর লেচি কেটে মোমো বানায়,শাশুড়িমা বাইরের বারান্দায় টেবিলে বসেন ওগুলো নিয়ে একদম পাত্রে গরম গরম সাজিয়ে। কলেজের ছেলেমেয়েরা লাইন দিয়ে খেয়ে যায়। এক এক সময় ওরা জোগান দিতে পারেনা। " আমাকে দাওনা,টেবিলে বসে বানিয়ে দিই কিছুটা বলে রঞ্জন।" এখন অনেকটা ভালো আছে ডাক্তার বলেছেন মাসছয়েকের মধ্যেই হাঁটবে।
সামলে নিয়েছে সবটা সুমি অনেক কষ্ট করেছে একথা বুঝিয়ে দিয়েছে চেষ্টা করলে হয়ত মেয়েরাই সব পারে। পারে এগিয়ে যেতে আর এগিয়ে নিয়ে যেতে বিনিময়ে চায় হয়ত একটু ভালোবাসা আর সহানুভূতি বা হয়ত একটু শুনতে চায় তুমি অনেক কর সংসারের জন্য।
'তোর মা কোথায় রে?'...'মা ঘুমোচ্ছে ঠাম্মু,ডাকবো?'..'না না সারাদিন অনেক করে মেয়েটা,দরজাটা ভিজিয়ে দে দিদি আজ আটাটা আমিই মেখে দিচ্ছি।' শাশুড়িমায়ের কথায় মনটা ছুঁয়ে যায় সুমির যাক সব ভালো যার শেষ ভালো দেরিতে হলেও বুঝেছেন অনেক করে মেয়েটা।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment