Skip to main content

সন্ধি

#সন্ধি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

কবিগুরুর দুইকলি গান বেজে ওঠে কানে," খোলো খোলো দ্বার রাখিয়োনা আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে।"
         ওহ্ শ‍্যালিকা একখানা বাঁশ দিয়ে গেছে, নতুন বাড়ীতে গৃহপ্রবেশে অনেককিছুর সাথে উপহার দিয়ে গেছে একখানা কলিংবেল। আহা প্রথমে শুনে মনটা বেশ ছুঁয়ে গেছিলো। তবে কলিংবেলেও কবিগুরু সত‍্যি কি যে অপপ্রয়োগ!
কোথায় গান শুনে মনটা খুশি হবে তা না করে, দেখোতো কে এলো এই অসময়ে!
      ......"কি জামাইবাবু দারুণ না? দিদি একদম দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেবে। এই গান শোনানোর পর আর কি কেউ থাকতে পারে? কি রে দিদি?"
             "ঠোঁট ওলটায় অলকা,যা হাঁটু ব‍্যাথা বেড়েছে, যা গানই শোনাও বাপু দরজা খুলতে দেরি হবেই।"
                   রাজ‍্যের কাজ সেরে দুপুরে ভাত ঘুম দিচ্ছিলেন সবে। মাথাটা গরম হয়ে যায়। কে এলো কে জানে? একটা গুঁতো মারেন রমেনকে।
...." এই শুনছো, দেখোতো কে এলো। ওহ্ আর পারিনা।"
             অগত‍্যা রমেন গিয়ে দরজা খোলেন,মাঝবয়সী একটা বৌ দাঁড়িয়ে," আপনেরা নাকি রান্নার লোক খুঁজতেছেন,তাই এয়েছি। ওই বাড়ির বিমলা পাঠালে।"
       হাতে স্বর্গ পান রমেন প্রায় দুমাস রান্নার লোক নেই। যদিও এই সুযোগে গিন্নীর হাতের ভালোমন্দ খাওয়া হচ্ছে কিন্তু তার সাথে উপরি পাওনা উঃ আঃ আর দাঁত খিঁচুনি।
                রান্নার লোক এসেছে শুনে লাফ দিয়ে উঠে পড়েন অলকা। বৌটিকে আপাদমস্তক দেখে প্রশ্ন করেন," তুমি ঘটি তো,নাকি বাঙাল?"
             ঢোক গেলে শেফালি,এ আবার কি ধরণের প্রশ্ন। "আজ্ঞে ইয়ে"....মানে বাঙাল হলে আসতে পারো,আমাদের বাঙাল রান্না চলেনা।
                "না না আমরা ঘটি গো,এদেশেই জম্ম কম্ম।"
  "যাক তাও ভালো,তা রান্নাবান্না সব জানো তো?"
           "সবই জানি,তারপর আপনি একদিন দেখায়ে দেবেন। সব শিখে নেবো।"
         আসলে কাজটা ওরও খুব দরকার। কাজের দরকারে কখনো বাঙাল বা ঘটি হয়ে যায়। কখনো কখনো তো বামুনও হতে হয়। এই যুগেও কিছু লোকজন এত বাতিকগ্ৰস্ত কেন কে জানে!
                বহাল হয়ে যায় শেফালি। নিশ্চিন্ত হয় অলকা। একেই তো ওর নীচতলার ভাড়াটে জ্বালিয়ে মারছে। কি কুক্ষণে যে ঢুকিয়েছিলো ওদের! রমেনের অফিসের লোকের পরিচিত তাই আর না বলতে পারেনি। ছোট পরিবার স্বামী,স্ত্রী আর মেয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলো ওরা। মেয়েটা ঠাকুমার কাছে থাকতো মাসদুয়েক হলো এখানে এসেছে পড়াশোনার জন‍্য।
                   তারপর থেকেই উৎপাত শুরু একদিন হঠাৎ বিটকেল গন্ধে ঘুম ভাঙে অলকার,প্রায় বমি হবার অবস্থা। ঘরে টেকাই দায়,কোথা থেকে এমন বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে বুঝতে পারেনা। তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে ওনাদের মেয়ের খুব পছন্দ শুঁটকি মাছ,ওই মাছের ঝাল একদিন করে রাখলেই লক্ষ্মীমেয়ের মতো ভাত খেয়ে নেয়।
                বাঙাল নামেই আজকাল ভীতি অলকার অথচ এমন আগে ছিলোনা। নোনা ইলিশ,শুটকি,কাকচি,মাছ পেলেই হলো ওদের। ওরে বাবা পূজো পাব্বনের দিনেও মাছ ভাত খাচ্ছে। আসলে রমেন আর অলকা দুজনেই ঘটি। শুধু ছেলেটাই মাঝে মাঝে বলে কেনো যে তোমার এতো বিরক্তি কে জানে? আমার তো বেশ ঝাল ঝাল কষা কষা রান্না দারুণ লাগে। রমেন হেসে বলেন,"দৈত‍্যকুলে প্রহ্লাদ"।
                     এরমাঝেই একদিন নাকে চাপা দিয়ে অভিযোগ করতে যান অলকা, কিন্তু তেমন কিছু সুবিধা করতে পারেননি। ভদ্রমহিলা এতো মিষ্টি করে বললেন," দিদি একটু জ্বালাচ্ছি এই তো কটা দিন,এরপর আমরা চলে যাবো আর কটা দিন একটু কষ্ট করুন। মেয়েটা আমার বড় আদুরী, কিছুই খেতে চায়না। আসলে বাড়ীর একমাত্র মেয়েতো। শাশুড়ি আদর দিয়ে দিয়ে এমন করেছে।"
           ...."আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি দিদি।"
  প্রত‍্যেকদিন মায়ের নালিশে উত্তক্ত হয়ে যায় আনন্দ, ভেবেছিলো,সুযোগ পেলে দেবে একচোট শুনিয়ে দেবে মেয়েটাকে। কিন্তু কিই বা বলবে, কথায় তো আছে কি আপ রুচি খানা তাছাড়া দুএকবার দেখা ছাড়া তেমনভাবে কথা বলার সুযোগই হয়নি কখনো। সত‍্যিই রাগ হয় এ আবার কি ,উনি রসিয়ে খাবেন আর ওরা গন্ধে মরবে একদম যাচ্ছেতাই।
                   মায়ের যন্ত্রণামুক্তির জন‍্য এসেছে অনেক সুগন্ধের সমাহার বাবা আর ছেলে চেষ্টা করছে প্রাণপণ। আসলে সবাই বলে অলকার সন্তানভাগ‍্য খুব ভালো আর স্বামীভাগ‍্য তো বটেই।
এইসব নিয়ে কোন আক্ষেপ নেই তার আসলে সংসারটাকে তো আগলে রেখেছেন এতোদিন,কষ্টও অনেক করেছেন। অনেক শখ আহ্লাদও হয়তো পূরণ হয়নি বাড়ী করতে গিয়ে আর ছেলে মানুষ করতে । নিজের সাজানো সংসারের দিকে তাকিয়ে ভালো লাগে অলকার।
                  রবিবারটা একটু অন‍্যরকম,সেদিন রান্নায় হাত লাগান অলকাও। সকালে বেশ সুন্দর সাদা ময়দার ফুলকো লুচি আর তার সাথে আনন্দর খুব প্রিয় কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি। আজ বাটি পোস্ত করেছেন অলকা,আনন্দর খুব পছন্দ। এই পদটা শাশুড়ি মায়ের হাতে অপূর্ব হোত।
......"আজ সব টপ পদ করেছো মা,উহ্ বাটিপোস্ত আর বিউলির ডাল আর সাথে কাদা চিংড়ীর বড়া। ইশ্ কতদিন বাদে খাচ্ছি। ওহ্ আবার কষা মাংসও আছে। জাষ্ট জমে গেছে।"
                  খেতে খুব ভালোবাসে আনন্দ,বিশেষ করে মায়ের হাতের রান্না তো ইউনিক।
.....হাসেন রমেন আর অলকা,সত‍্যি অনেকদিন বাদে বাজারে কাদাচিংড়ী পাওয়া গেছে। এইসব পদগুলো ঠিক রান্নার লোককে দিয়ে করানো যায়না। যদিও উনি তো নাকি সবই পারেন,"দাওনা আমি করে দেবো ঠিক।" খারাপ না শেফালি ভালোই।
                 দুপুরের খাওয়ার পর আকাশটা বেশ মেঘলা,ভালোই হয়েছে। পকেটে সিগারেটের প‍্যাকেটটা নিয়ে ছাদে ওঠে আনন্দ। সিগারেটটা ধরাতে যাবে এমন সময় একটা ঝোড়ো হাওয়া উঠলো, ইশ্ বৃষ্টি নামবে নাকি! নামলে মন্দ হয়না,ভালোই লাগবে ছুটির দিনে। আকাশের দিকে চোখ রেখে মনটা বেশ রোমান্টিক হয়ে ওঠে আনন্দের।
              হাওয়ার ছন্দে হঠাৎই ছুটে এলো আরো এক দমকা হাওয়া,ছুটোছুটি করতে লাগলো ছাদে। কাপড় তুলতে গিয়ে কাপড়ে জড়িয়ে হিমশিম অবস্থা। উহ্ আর পারা যায়না," মা যে কেন এই সময়েই মাসির বাড়ি গেলো কে জানে? রবিবার রাজ‍্যের কাপড় মেলে গেছে ছাদে। ভিজলে আর রক্ষে নেই।"
                    নিজের মনেই বিড়বিড় করতে করতে ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কাপড় টানাটানি করছিলো ঝিলিক।
      ......" কাজের অভ‍্যেস না থাকলে এমনই হয়। একদম নাকানিচোবানি অবস্থা।"
               কথাটা কানে আসতেই আনন্দকে দেখে লজ্জা পায় ঝিলিক,তবুও বলে ওঠে," আমার কাজ পড়াশোনা করা,ঠাকুমা কোনদিন এইসব করতেই দেয়নি। শিলিগুড়িতেই ভালো ছিলাম। কেন যে মা এখানে নিয়ে এলো।"
                     ততক্ষণে কাপড়গুলোর সাথে মোটামুটি সন্ধি হয়ে গেছে। কাপড়ের আড়াল থেকে মুখটা বার করে ঝিলিক। একমাথা কোঁকড়া চুল ঢেকে রেখেছে মুখের আর্ধেকটা। সরল নিষ্পাপ একটা সুন্দর মুখ। আধুনিকতার তেমন ছোঁয়া নেই। তবে চোখদুটো দুষ্টুমিতে ভরা।
                      ......"রাগ করবেননা,ঠাকুমা তো একদম আদর দিয়ে সর্বনাশ করেছেন। কাজকর্ম না শিখিয়ে শুধু শুঁটকি মাছ,বেলে মাছ খাওয়া শিখিয়েছেন। আর বিটকেল গন্ধে আমরা মরছি।"
                 কোমরে হাত দিয়ে কাপড়গুলো কাঁধে ফেলে একদম আনন্দর সামনে এসে দাঁড়ায় ঝিলিক," আপনি তো খুব বাজে, আমার ঠাকুমার সম্বন্ধে বাজে কথা বললে খুব খারাপ হবে কিন্তু।"
             হেসে ফেলে আনন্দ,"বাবা আপনি কি ঝগড়ুটে! এবার থেকে পচা মাছের গন্ধটা নিজেদের কাছে রাখবেন।"
......." উঃ বয়ে গেছে আমার, ভাড়া দেবার সময় পারফিউম কেনার টাকা দিয়ে দেবো। আপনারা যখন বাজার থেকে ওই পচা চিংড়ি এনে খান। ওগুলো খেলেই তো ডায়রিয়া হয়।"
        "না হয়না ,এই তো বহাল তবিয়তে আছি।"

     মনে মনে ভাবে আনন্দ উরিব্বাস এতো ধানি লঙ্কা,নারী ভয়ঙ্করী। কিচ্ছু করার নেই,হাল ছেড়ে দেওয়াই ভালো। যা খুশি খা বাপু,আর তো মেয়াদ ছয়মাস মতো। হজম করে নেবো। খারাপ লাগে মায়ের কথা ভেবে,বেচারা মা।
               ভাবতে ভাবতেই বৃষ্টি নামলো,'ইশ্ ভালো লাগেনা,দিলো ভিজিয়ে"..বলতে বলতে দৌড়ে সিঁড়ির দিকে যায় ঝিলিক। আনন্দ শেডের তলায় একটু চুপ করে দাঁড়ায়। ঝিলিকের দুষ্টুমি ভরা প্রাণচ্ছোল হাসিটা বোধহয় একটু ছুঁয়ে যায় আনন্দর বৃষ্টিভেজা মনটাকে‌।
                    কয়েকদিন বাদে অফিস থেকে ফেরার সময় গাড়ি থেকে নজর পড়ে যায় কলেজ স্ট্রীটের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে,ধানি লঙ্কা। পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনা একটু সাইড করে ডাকে," শুনছেন উঠে আসুন।"
পাত্তা দেয়না ঝিলিক,মনে মনে ভাবে ঝগড়ুটে ছেলে একটা। গাড়িতে তুলে হয়তো আবার ঝাড়বে।
   ....." কি হলো আপনাকে ডাকছি তো"
   অগত‍্যা এগিয়ে আসে ঝিলিক।
....." বাড়ি যাচ্ছেন তো,উঠে আসুন।"
......" উঠবো,শুঁটকি মাছের গন্ধ পাবেননা তো আবার?
...."তা আর বলতে,পেছনে বসুন। বৃষ্টি আসছে তাই ভাবলাম।"
                    বাড়ি আসার একটু আগেই নেমে গেলো ঝিলিক। তবে আনন্দর লিফ্ট দেওয়াটা একটু বেড়ে গেলো। অলকার অজ্ঞাতসারে ধানি লঙ্কার সাথে বেশ মিষ্টি সম্পর্ক হয়ে গেলো আনন্দর। একটু খারাপ লাগলো,ইশ্ মা জানলে যে কি করবে কে জানে।
              হঠাৎ একদিন অলকা বললেন," কদিন বেশ শান্তিতে আছি, বাজে গন্ধটা পাচ্ছিনা। মেয়েটা বোধহয় নেই।"
                  মুখ টিপে একটু হাসে আনন্দ, মনে মনে বলে নেই আবার! আসলে এরমধ‍্যেই সন্ধি হয়ে গেছে যে ওদের। আর সন্ধিটা অবশ‍্যই নিঃশর্ত তবুও বোধহয় আজকাল শুঁটকি চচ্চড়ি খাবার আগে ঝিলিক অনেকবার ভাবে। ওর মা আশ্চর্য হন বাবাকে ডেকে বলেন," মেয়েটার কি হলো বলতো? খাওয়ার হ‍্যাপাটা তেমন নেই ,যা দিচ্ছি লক্ষ্মী হয়ে খেয়ে নিচ্ছে। মাঝে একদিন তাল তুলেছিলো কি একটা কাদা চিংড়ীর বড়া খাবে বলছিলো,পাওয়া যায় নাকি বাজারে? শিলিগুড়িতে তো দেখিনি।"
          একমাত্র মেয়ের আবদার অগত‍্যা," ওমা এগুলো যে পোকার চেয়ে ছোট,কিসুই তো হয়নি। সত‍্যিই কাদা।"
                 ঝিলিক মুখে দিয়ে বলে," বেশ হয়েছে খেতে তো,একদম ক্রাঞ্চি। মা কয়েকটা দিয়ে দাও বন্ধুরা খেতে চেয়েছে।'
             আনন্দর সামনে খুলে দেয় কৌটোটা।...."খাবো? ডায়েরিয়া হবেনা তো? উঁহু তবে মায়ের মতো হয়নি।"....ছোঁ মারে ঝিলিক,"খেতে হবেনা,ফেরৎ দিন।"
নিরুপায় হয়ে আঙুলটা একটু চেটে নেয় আনন্দ অতঃ কিম্ মায়া হয়, মুখে গুজে দেয় একটা।
               নাহ্ ধানিলঙ্কা একটু ঝাঁঝালো এই যা, কিন্তু মেয়েটা খাট্টি মিঠ্ঠি, বেশ মিষ্টি। আর ওর নো মেক আপ লুকে ফিদা হয়ে গেছে আনন্দ।
   মাঝে মাঝে ঝগড়াও হয়,আর তারপরের দিনই কষে শুঁটকি মাছের গন্ধে পাগলা হবার অবস্থা।
মান ভাঙলে ধানি বলে ওর ডিপ্রেশনের দাওয়াই নাকি ওটা।
হাসতে হাসতে আনন্দ বলে তা আর হবেনা," গন্ধে  ভূত পালায়,ডিপ্রেশন তো পালাবেই।"
....... " আবার.. তাহলে এবার সত‍্যি আমি শিলিগুড়ি চলে যাবো।"
              ধানিলঙ্কা ছাড়া ঝাঁঝহীন জীবন জাষ্ট ভাবতে পারেনা আনন্দ। মায়ের ঝাঁঝে আর ঝিলিকের মিষ্টি ঝগড়ায় বেশ আছে। কাউকে ছাড়াই ওর চলেনা। মায়ের রান্নার হাতটা তো সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখার মতো। ওহ্ বিউলির ডাল আর বাটিপোস্ত জিভে জল এসে যায় ভাবলেই। আহা চালতার টকটাও দুর্দান্ত করে মা। এছাড়া লুচি,পরোটা,কচুরী আহা আহা ভাবলেই মনটা ভালো হয়ে যায়।আরে পেটে না খেলে পিঠে সইবে কেনো?এর মাঝেই একদিন মনটা খারাপ হয়ে গেলো আনন্দর, যদিও মা ভীষণ খুশি। " ওহ বাঁচলাম ওরা সামনের মাসেই চলে যাচ্ছে। বাপরে একটা সত‍্যনারায়ণ দেবো,শান্তি পাবো এবার।"
            শুধু আনন্দর মনটা খচখচ করে, ছাদের প্রেমটা বড্ড মিস করবে, রবিবারের দুপুরের খাওয়াগুলো আর বোধহয় হজম হবেনা,এলোচুলে ঝিলিককে না দেখলে।
               এদিকে যেন কোন তাপউত্তাপ নেই ঝিলিকের,উঃ বাঁচা যাবে বাবা ইচ্ছেমতো খাবে তারিয়ে যা ইচ্ছে তাই। রান্নাঘরে নাকগলানো বাইরের লোকের, একদম মানা যায়না। ওরে বাবা আপ রুচি খানা বলে কথা।
                  শেষপর্যন্ত চলেই গেলো ধানি লঙ্কাটা, একদম অনেকটা দূরে ওদের বাড়ি থেকে,পানসে হয়ে গেলো আনন্দর। কি যে করে,বলেই ফেললো একদিন বলি বলি করে মা বাবাকে। মায়ের মুখটা বোধহয় চিরতা তেতো আর শুঁটকিমাছের বিটকেল গন্ধেও এমন হয়নি। কিন্তু একমাত্র ছেলে আনন্দ,রমেন আড়ালে বোঝালেন,"এমন কোরোনা অলকা,বোঝোই তো আজকালকার ছেলে,আপত্তি করবে তো আলাদা ফ্ল্যাটে উঠে যাবে। ছেলেটা সত‍্যি ভালো তাই তোমার মত চেয়েছে।"
......." হায় হায় ভগবান,টকের ভয় পেয়ে সেই তেঁতুলতলায় ঘর বাঁধলাম। ওই শুঁটকি মাছ শেষে উঠলো আমার ঘরে।"
           ছেলের মুখ চেয়ে মত দিতেই হলো অলকাকে,ছেলেকে হারাতে চাননা। ঝিলিকের মাও আপত্তি জানিয়েছিলেন," ওরে না খেয়ে তো উপোসী হয়ে মরবি। তোর খাওয়ার যা হ‍্যাপা। আর তোর শাশুড়ি মনে হয় একটু বেশিই কড়া।"
            মনে মনে ঝিলিক হাসে আর ভাবে ঝাঁঝ তো তারও আছে বেশ,মানে মেজাজ। শুধু চাপে আছে আনন্দ,দুই ঝাঁঝালো মহিলা যে কিভাবে সহাবস্থান করবে! অথচ ওর তো কাউকে ছাড়াই চলবেনা। এবার মনে হয় স‍্যান্ডউইচ হয়ে যেতে হবে ওকে।
          অলকার কড়া নির্দেশ," ওকে আসতে বল বাড়ীতে,একদিন এখানে খাওয়াদাওয়া করুক ওরা সবাই। আমাদের খাওয়াদাওয়ার খেয়ে দেখুক। ভালো করে আলাপ করি।"
                 যাক বিপদসীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে ঝিলিক,খাবারগুলো একটু মিষ্টি মিষ্টি আর ঝোল ঝোল। তবে মন্দ নয়, মনের আনন্দে আর আনন্দের প্রেমে মশগুল হয়ে খেয়ে নেবে।
                বিয়েটা ভালোভাবেই হয়েছে। নাহ্ খারাপ না মেয়েটা,ভালোই তো মনে হচ্ছে। শাড়ি পরে বেশ সুন্দর লাগে,একমাথা কোঁকড়া চুলে,আগে তো এভাবে দেখেননি।
                        খাওয়াদাওয়া নিয়ে খুব একটা ঝামেলা নেই,তবে সপ্তাহে দুবার করে বাপের বাড়ি যায়। বোঝেন অলকা,নিশ্চয় শুঁটকি খেতে। বাবা মায়ের আদুরে মেয়ে,কিছু করার নেই। তবুও ভালো,এখন ঘরে ঘরে যা অশান্তি। বেশিরভাগই তো শোনেন বৌ ভালোনা, খাওয়া দাওয়া কথা সবেতেই বিপদ। আসলে সবারই এখন একটা দুটো ছেলেমেয়ে তাই ওরাও স্বাধীনচেতা। আর কিছু হলেই শুরু ঠান্ডা লড়াই।
          তবে আজকাল অনেকেরই সম্পর্ক বেশ ভালো। এইতো ওর দিদির বৌমা একদম মেয়ের মতো। আবার ওর এক বান্ধবীর বৌমা শাশুড়ি শুধু ছেলেকেই যত্ন করেন এই অভিযোগে একদম হাঁটা দিলো বরকে নিয়ে। আরে বোকা,ওখানে গিয়েও তো সেই বরের যত্ন তোকেই করতে হবে।
                রান্নাঘরে পুরো রাজত্ব করতে দিয়েছেন ঝিলিককে অলকা,শুধু একটা জিনিসই ব‍্যান। বাদবাকি কোন সমস‍্যা নেই। আর শেফালি তো আছেই একদম ওর ব্লাইন্ড সাপোর্টার। বাঙাল পদগুলো শেফালি ভালোই রাঁধে। অলকা মাঝে মাঝে টিপ্পুনি কাটেন," কি ব‍্যাপার বলতো,এতো বাঙাল রান্না শিখলি কোথায়?.."আরে আমাদের শিখতে লাগেনা গো বাবুদের বাড়ীতেই শেখা হয়ে যায়।"
             ঝিলিক খুশি,একসময় যাকে আড়ালে গালমন্দ করতো সেই মানুষটা এখন শাশুমা, বাট নট ব‍্যাড আ্যট অল। অকারণে ঝামেলা করতে যাবে কেন?
                 আরে বিয়েটা তো একধরনের সন্ধি,মানে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সন্ধি। শর্ত বেশি হলেই ঝামেলা। পরিস্কার কথা ভাই,তুমি আমাকে স্পেশ দাও আমিও তোমায় দেবো। নাকগলানো ব‍্যাপারটা অনেকেরই না পসন্দ। আনন্দ বিন্দাস আছে আজকাল,মাঝে মাঝে ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুর শাকও খাচ্ছে আবার কখনো মালাইকারি। কোনদিন ইলিশ পাতুরি,আর কোনদিন গলদা মালাইকারি জাষ্ট জমে গেছে।
                      এরমাঝে একদিন ধানিলঙ্কা বাপের বাড়িতে আনন্দর পাতে একটু শুঁটকি চচ্চড়ি তুলে দিয়েছিলো জোর করে। কিন্তু কিন্তু করে খেয়েই ফেললো। মন্দ না খেতে, উরিব্বাস কি ঝাল! অক্টোপাশ স্কুইড কত কিনা খাচ্ছে এটা বাদ যায় কেনো। রাতে ধানিলঙ্কাকে আদর করতে গিয়েই মুশকিল,বলে কিনা ঘুম পাচ্ছে। উরিব্বাস খোঁচা মারতেই বলে,"মাকে বলে দেবো আজ শুঁটকি খেয়ে এসেছো ওই বাড়ি থেকে।" মহা পাজি তো মেয়েটা! এইরকম ব্ল্যাকমেল ভাবাই যায়না। তবেরে এবার সত‍্যি ইচ্ছে করছে একদম কামড়ে দিতে।
                        পূজোর জোগাড় করতে এখন আর অসুবিধে হয়না অলকার,ঝিলিক বেশ হাতে হাতে করে দেয়। হাঁটুব‍্যাথা নিয়ে বেশি উপর নীচ করতে হয়না। তবে ঝিলিকের হাসি পায় ওহ্ পূজো মানেই ময়দা খাওয়া। তবে আহা আহা লুচিগুলো বেশ লাগে খেতে। কিন্তু আনন্দ অভিযোগ করলো," ঘটি,বাঙালের রান্না খেয়ে বেশ তো বাড়ছো,কন্ট্রোল সোনা।" একটু লজ্জা পায় ঝিলিক।
                     মা হতে চলেছে ঝিলিক,কিছুই তেমন খেতে পারেনা। অলকা আর শেফালি অনেক চেষ্টা করে কি রান্না হলে ও একটু খেতে পারে। এর মাঝেই হয়েছে একটা মুশকিল কিছুদিন আগেই ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে শিলিগুড়ি চলে গেছেন,তার মাঝে ওখানে গিয়ে ওর মা আবার পা ভেঙেছে। বেচারা ঝিলিক, এইসময়টা মাকেই চায় মেয়েরা। অথচ আনন্দর ইচ্ছা এখানেই বাচ্ছাটা হোক,আসলে ঝিলিকের ঝলকানিতে কুপোকাৎ মনেহয় ওই বাড়ির সবাই।
                          মনটা একটুও ভালো লাগেনা ঝিলিকের বড্ড মা মা করছে মনটা। কিছু খেতেও পারছে না,শেফালি মান,কচু যা পারছে এনে বেটে দিচ্ছে। রমেন বাজার থেকে কাঁচামিঠে আম,তেঁতুল সব আনছেন।
                      রাতে বমি করে শরীরটা খুব খারাপ,সকালে ঘুমটা ভাঙেনি। আনন্দরও মায়া হয় ধানিলঙ্কাটা একেবারে নেতিয়ে পরেছে ওই ঝাঁঝটা খুব মিস করছে। আসলে যে যেমন তাকে সেভাবেই ভালোলাগে।
                            হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে যায় ঝিলিকের,লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে। নাক উঁচু করে শ্বাস নেয়। আহ্ কোথা থেকে যেন একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসে,কতদিন বাদে আঃ আঃ,মনটা চনমনে হয়ে ওঠে।
                         বিছানা থেকে উঠে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসে, সত‍্যি বেলা হয়ে গেছে। অলকা ঠাকুরঘরে পূজো করছেন। ইশশ্ শেফালিদিও রান্না করে চলে গেছে মনেহয়।
                   কিন্তু গন্ধটা কোথা থেকে আসছে? জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায় ঝিলিক,হঠাৎই শোনে শেফালিদির গলা, " বৌদি,এলাম গো।"
                       খাওয়ার টেবিলে বোধহয় গ্ৰেট সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো,ইট জাষ্ট আ ম‍্যাজিক। শুঁটকিমাছের ঝাল চচ্চড়ি,ওহ্ গ্ৰেট। অলকা দেখে শান্তি পেলেন অনেকদিন বাদে মেয়েটা যেন চেটেপুটে ভাত খাচ্ছে। অনেককিছু ছেড়ে তো মেয়েরা আসে শ্বশুর বাড়িতে,অলকাও এসেছিলেন। আজ অলকাও নাহয় কিছুটা ছাড়লেন।
                   কিন্তু এই ম‍্যাজিকটা কি করে হলো,ভাবতেই পারেনা ঝিলিক। "আচ্ছা মামনি...
  বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেন অলকা। "কদিন ধরেই দেখছি তুই খেতে পারছিসনা, আমি তো গন্ধ নিতে পারিনা। তোর বাবুকে দিয়ে বাজার থেকে আনিয়ে শেফালিকে দিয়ে নীচতলায় ইন্ডাকশনে রান্না করালাম। শেফালিটা মিচকে পাজি,ওই তো বুদ্ধিটা দিলো। ঐ পাজিটা যে বাঙাল আমাকে বলেনি। হা হা হা ভালোই হয়েছে,নাহলে তো আমাকেই রাঁধতে হোত।
                         মুডটা যেন একনিমেষে ভালো হয়ে যায় ঝিলিকের, আজ অলকাকে একটা মিষ্টি হাগ দিয়ে বললো," সন্ধিটা আমি আগেই করেছিলাম মামনি তোমার ছেলের সাথে। আজ একটা নতুন সন্ধি হোলো তোমার সাথে ঐ বিটকেল গন্ধওয়ালা শুঁটকিগুলোর। সেই ওগুলো লাফাতে লাফাতে তোমার খাবার টেবিলে এলো।"
"যে সন্ধি করলে শান্তি আর আনন্দ পাওয়া যায় সেটা করে ফেলাই ভালো।তাইনা রে?" রমেন হাঁক মারেন,একচামচ টেস্ট করা যাবে নাকি?"
               কটমট করে তাকিয়ে অলকা বলেন," অল্পই দিচ্ছি। বাকীটা তোলা থাক মেয়েটা খাবে।"
                   "যাহ্ বাবা এতো কষ্ট করে বাজার করে আনলুম।"হেসে ফেলে অলকা আর ঝিলিক। একটা ঢেকুর তুলে রমেন বলেন," শেফালিকে সামনের মাস থেকে আরো একশোটাকা বেশি দিয়ো, খাসা রেঁধেছে কিন্তু।"

       সমাপ্ত:-

                   
                
             

                  
             

                

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...