Skip to main content

#আলোয়_স্নান#

#আলোয়_স্নান#

#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"গায়ে হলুদের তত্ত্ব নিয়ে তোরা কখন বেরোবি শুনি? ওদিকে যে মেয়েটাকে স্নান না করিয়ে ওরা বসিয়ে রাখবে। তোদের নিয়ে আর পারিনা, কি যে সারাক্ষণ মুখে মাখছিস কে জানে? আমাদের কালে এইসব ছিলনা বাপু।"
       মায়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে টুয়া," তোমাকে যা দেখতে না মা, মানে এখনো। আর ঐ ইয়ং বয়সের কথা তো ছেড়েই দাও। তোমার আর ঐসব মাখতে লাগেনা। আরে ঐজন‍্যই তো বাবা বেঁকে বসেছিলো,টাকা পয়সা চাইনা ঐ মেয়েকেই বিয়ে করবো। দাদু কিন্তু খুব দুঃখ পেয়েছিলো মানে রাগ করেছিলো কোন পণ না পাওয়াতে ঠাকুমার কাছে শুনেছি।"
    একটু হাল্কা লজ্জা পান শুভ্রা," খুব পাকা হয়েছিস না,কবেকার কোন কথা তুই জানলি কি করে? বুদ্ধিসুদ্ধি আর হোলোনা,জামাই আছে দাঁড়িয়ে দেখছিস না। আমার শ্বশুরমশাই দেবতুল‍্য মানুষ ছিলেন। আমাকে কি ভালোবাসতেন।"
   " তোমাকে কেউ কি ভালো না বেসে পারে মা? সত‍্যি বোধহয় এমন মা কজনের আছে কে জানে! চিৎকারে বাড়ীতে কাক চিল বসতে পারেনা। সকাল হলেই শুরু হয়ে যেতো আমাদের তিন ভাইবোনের ওপর তর্জন গর্জন। ওরে বাবা বই নিয়ে না বসলেই পেটানি খেতে হোত কখনো সজনেডাঁটা দিয়ে কখনো বা বেলনা দিয়ে। আর হাতের কাছে কিছু না পেলে কখনো লাউ বা বেগুন দিয়ে এক ঘা।" বোনের কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসে শান্তনু। তিন ভাই বোনের সবচেয়ে শান্ত ওই। টুয়া বলে মায়ের প‍্যায়ারা বেটা। সব আদর তো দাদাই নিয়ে নিয়েছে। আমি আর ছোড়দা তো বানের জলে ভেসে এসেছি।
       শান্তনু বড়,টুয়া আর অনুরাগ যমজ পাঁচ মিনিটের ছোটো বড়। অনুরাগ এসে পৌঁছয়নি তাই ওরা দেরি করছে। প্রথমে তো শুনেছিলো ছুটিই পাবেনা ছেলেটা,তারপর অনেক কষ্টে আসতে পারছে ছুটি ম‍্যানেজ করে। " ইশ্ ছোড়দা না এলে একদম জমছে না,কখন যে আসবে?"
       " তোরা যাবি কিনা,মেয়েটার সত‍্যি ঠান্ডা লেগে যাবে এবার। বিকেলে আবার সেজেগুজে বসতে হবে।"
   " মা এরপর আমাদের ভুলে যাবেনা তো? বৌদি মনে হচ্ছে সব ভালোবাসাটা নিয়ে নেবে। ভালো লাগেনা,কেনো যে আমি সবার ছোট হলাম! সবাই আদর পেয়ে শেষটা আমার জন‍্য পরে রইলো একেবারে চাছিপুছি।"
   কথার মাঝেই অনুরাগ এসে পড়ে। শুভ্রাকে এসেই একেবারে একবার কোলে তুলে একচক্কর ঘুরিয়ে নেয়। " ওরে ছাড়,ইশ্ বন্দুক চালিয়ে হাতগুলো লোহার মত শক্ত হয়ে গেছে। ফেলে হাড়গোড় ভাঙবি নাকি?.." এই যে মা আগের চেয়ে হালকা হয়ে গেছো,ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছোনা তাইতো।" "...প্রত‍্যেকবার এক কথা,পাজি ছেলে।" অনুরাগকে দেখে পুরো হই হই করে ওঠে টুয়া। "ওহ এই তো রিয়েল হিরো এসে গেছে এবার দারুণ জমবে। এতো দেরি করলি কেন রে? পুরো ফিউজ হয়ে আছে বাড়িটা তোকে ছাড়া। দাদা তো একদম বিয়ের আনন্দে আমাদের পাত্তাই দিচ্ছেনা,ভোরবেলা থেকেই গপগপ করে খাওয়া শুরু করেছে। কি সব খই দই মিঠাই সমানে খেয়ে চলেছে।"
    আরে আমি এসে গেছি না এবার দেখি একা একা ভালোমন্দের সবটা ও খায় কি করে? আমিও ভাগ বসাবো বলে দিচ্ছি। কি রে দাদা আমার জন‍্য সব কিনে রেখেছিস তো? জামাকাপড় আমার কিন্তু কিছুই কেনা হয়নি। দেশ মাতৃকার সেবা বলে কথা। ডিউটি থেকে ছুটি পাওয়াই মুশকিল আবার শপিং!"
    ছেলেমেয়েদের খুনশুটি দেখছিলেন শুভ্রা এবার প্রায় ঠেলে পাঠিয়ে দেন মেয়ের বাড়িতে ওদের। শুভ্রারা বাড়ি থেকে পছন্দ করেছেন মেয়েটিকে, এক দেখাতেই শান্তনুরও পছন্দ হয়ে যায়। অনুরাগের দেখা হয়নি,যদিও হোয়াটসআ্যপে ছবি পাঠিয়েছিলো টুয়া। ওরও পছন্দ হয়েছে। মেয়ের বাড়িতে তত্ত্ব দিতে গিয়ে টুয়া আর অনুরাগ খুব মজা করলো সৌরভীর সাথে। " এই যে অনেক কষ্ট করে হলুদ এনেছি,ভালো করে মেখে সুন্দর করে সেজেগুজে থাকবে। আমার দাদাটি তো তপস‍্যা করে না খেয়ে বসে আছে। আর মা তো আমাদের ভুলেই গেছে দিনরাত শুধু সৌরভী।"
     লজ্জা পায় সৌরভী, ওর সাথে শান্তনুর বয়েসের ফারাকটা একটু বেশি। তবে বাবার অবর্তমানে মামারাই ওর গার্জেন,ওদের সবারই পছন্দ হয়েছে ছেলেকে। ভালো চাকরি করে,তাছাড়া পরিবারটাও ভালো। খুব বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি,তবে বিয়ের কেনাকাটা একসাথেই করেছে ওরা। ওদের এই ছোট মফস্বল শহরে বিয়ে ঠিক হওয়ার পর দেখা করার সুযোগ একটু কম। তাছাড়া মামারা বলেছেন,দেখাশোনা না হওয়াই ভালো বেশি। তবে শান্তনু মাঝে মাঝে ফোন করতো। ফোনেই অনেক কথা বলতো,যদিও ওদের দুজনেরই স্বভাব অনেকটা এক। দুজনেই একটু চুপচাপ। কিন্তু ওর ননদ আর দেওর দুটোই কথার ফুলঝুড়ি ওদের বাড়ি এসে পুরো হাসি গল্পে সবাইকে মাতিয়ে দিলো। মিলিটারীতে চাকরি করে এতো মজাদার কি করে যে অনুরাগ ভাবাই যায়না। প্রথমে একটু অন‍্যরকমই ভেবেছিলো সৌরভী হয়ত বা রাগী হবে।
           বিয়ের সন্ধ‍্যেয় হৈ হৈ করে সবাই এলো,ওর বান্ধবীরা তো বেশ মজাই করলো," আরে দুটো বর বসে আছে পাশাপাশি। কি ব‍্যাপার বলতো,একসাথে কটাকে বিয়ে করবি?" মাথা নিচু করে সৌরভী আরে ও আমার দেওর অনুরাগ যে একটু শ‍্যামলা আর লম্বা। আর যে ফর্সা বেশি.."
  "বুঝেছি আর বলতে হবেনা। ভীষণ মজাদার তো দিব‍্যি বরের মতো একই পোশাকে এসেছে।"
..." ওদের খুব মিলরে তাই তো ওর দাদা সব আরেকটা সেট কিনেছে। নাহলে এসে হয়ত অভিমানে মুখ ফোলাতো।"
       মজা করে রিনি," সব দু সেট করে কিনেছে! শুধু একটা জিনিস ছাড়া।"
     মুখ তোলে সৌরভী,"কি বলতো?"
" আরে একটা বাকি রয়ে গেছে রে,তোর মতো একটা লালটুকটুকে পুতুল পুতুল বৌ।দেখি আমরা যদি সুযোগ পাই,দেখতে তো বেশ হ‍্যান্ডসাম!"
   আনন্দ হাসি আর মজায় বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো বেশ হয়ে গিয়েছিলো। বাসী বিয়ের দিন পুকুর পার করানোর সময় টুয়ার বর আর অনুরাগ মজা করেছিলো," আমরা হেল্প করবো না কি দাদা?"
  দুজনেই হেসে ফেলেছিলো ওরা। সত‍্যি কিছু মজা করে ওরা।
    বিয়ে বৌভাত সব নিয়ে খুব ব‍্যস্ততার মধ‍্যে কোথা দিয়ে যে সময় কেটে গেলো বোঝা গেলোনা। শান্তনুর অনুরাগের রঙে লাল হয়ে গেলো সৌরভী,সবাই পেছনে লাগলো ফুলশয‍্যার দিন। সত‍্যিই ননদ হিসেবে খুব ভালো টুয়া,এতো ভালো ভাইবোনের সম্পর্কগুলো মনটা ভালো হয়ে যায় সৌরভীর,ওর মাও অনেকটা নিশ্চিন্ত যাক মেয়েটা ভালো থাকবে। বিয়ের পর ওরা যখন এলো,সব ননদ আর দেওরেরা মিলে দরজা আটকে বসে ছিলো। আগে টাকা দাও তারপর যেতে দেবো, সৌরভীর হাত দিয়ে শান্তনুই টাকা দেয় ওদের। শুভ্রা তো খুব বকুনি দেন," মেয়েটা কেঁদে কেটে এসেছে তোরা ঢুকতে দেতো।"
....." মা তুমি যাওতো এখান থেকে বড়দের ছোটদের ব‍্যাপারে থাকতে নেই,ঠাকুর পাপ দেয়।"
     সৌরভীও হেসেছিলো ওদের কান্ড দেখে। আর ফুলশয‍্যার দিন তো শান্তনু পুরো তল্লাশি করে দরজা বন্ধ করেছে আর তারপর লাইট বন্ধ,কোথায় কি লাগিয়ে রেখেছে কে জানে?
       সত‍্যি সৌরভীর একটু লজ্জা লজ্জাই করে ফুলশয‍্যার পরের দিন,বাড়ি ভর্তি লোকজন,তাই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ে,গতকাল রাতে তো...ভাবতেই একটু রাঙা হয়ে যায় গালদুটো। শান্তনু তখনো ঘুমোচ্ছে। ঘর থেকে কাপড় ছেড়ে বেরিয়ে দেখে শাশুড়ি উঠে পরেছেন। একটু বাদেই ননদরা পেছনে লাগে," কি গো বৌদিভাই কাল রাতে ঘুমাওনি নাকি?" সৌরভীর লজ্জায় রাঙা মুখটা অনেক কিছুই বলে যায়।
         ওদের অষ্টমঙ্গলা সেরে আসার পর হঠাৎই হুজুগ ওঠে দীঘা যাওয়া হবে তবে সবাই মিলে। খুব আপত্তি করে শুভ্রা,ছেলে বৌয়ের সাথে বাড়ী সুদ্ধু সবাই যাবে এ আবার কি, অনুরাগই বলে," মা আমি চলে যাবো আর চারদিন বাদেই, দাদার বিয়েতে আমার তো কিছুই দেওয়া হয়নি। তাই ওদের হানিমুনের খরচটা আমার। ওখানে গিয়ে আমি সব টিকিট পাঠিয়ে দেবো। তখন ওরা একা একা আনন্দ করবে যত খুশি। তবে এটা একদম ফ‍্যামেলি ট্রিপ সবাই যাবে।"
      ওহ্ ফ‍্যামেলি বলে ফ‍্যামেলি,বাস রিজার্ভের মতো অবস্থা। মোটামুটি কুড়িজন হয়ে গেলো দলে। আর টুয়ার তো আনন্দের শেষ নেই। সবার মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে বর,দাদা,বৌদি,মা,বাবা সবাই জব্দ ওর কাছে। শান্তনু হেসে বলে," অনুরাগ এমন প্ল‍্যান করলি,ক্ষেপিটা কেমন ক্ষেপেছে দেখ।"
......" এই আমার বরের সামনে আমাকে ক্ষেপি বলবিনা বলে দিলাম,এই যে তুমি হাসছো কেন শুনি?"
    কিছু কিছু ঘটনা মনের মণিকোঠায় রয়ে যায় অনেকদিন ঠিক তেমনি আনন্দ করলো ওরা দীঘায়। বাবা মারা যাওয়ার পর সৌরভী কতদিন দেখেনি এমন আনন্দের মুখ। গানে,গল্পে,খাওয়ায় আর সমুদ্রস্নানে দুটো দিন যেন কোথা দিয়ে শেষ হয়ে গেলো। এই দুদিন শুধু মজাই মজা আর আনন্দের হাটে হা হা হি হি।
     ওরা ফিরে আসার পর অনুরাগেরও যাবার সময় এসে যায়। সবারই মনটা খারাপ হয় ছেলেটা আবার কবে ছুটি পাবে কে জানে? " আসবো খুব তাড়াতাড়ি এতো মন খারাপের কি আছে রে,আচ্ছা মা দেশকেও তো দেখতে হবে। সাধে কি কবিগুরু বলেছেন সাতকোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি। আর এই যে বৌদিভাই তোমাদের হনিমুনের সব আ্যরেঞ্জমেন্ট করে আমি মেল করে দাদার অফিসে পাঠিয়ে দেবো।"
   সৌরভীরও মনটা খারাপ লাগে,অনুরাগও চলে যাচ্ছে। টুয়াও চলে যাবে,বাড়ি এরমধ‍্যেই বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে সত‍্যিই ওর খারাপ লাগছে এবার।সারাদিন একা একা এবার কাটবে ওর।
          শুভ্রার সাথে একটু একটু করে কাজে হাত লাগায় সৌরভী,শুভ্রার মন ছুঁয়ে যায় সৌরভী। সত‍্যিই ভালো ছেলের বৌ পেয়েছেন তিনি। মেয়েটা খুব ভালো,যদিও একটু শান্ত আর চুপচাপ। তবে মুখটা বেশ হাসিমাখা আর লক্ষ্মীমন্ত,এর মধ‍্যেই পাড়ার লোকেরাও শুভ্রাকে এক কথাই বলে গেছে কপাল করে ছেলে মেয়ে এমন কি ছেলের বৌ পেয়েছে শুভ্রা। আর ওর কর্তাটি তো একদম ভোলা মহেশ্বর। শুভ্রার কথায় ওঠাবসা করে। তবে মাধবীদি বললেন আসলে শুভ্রা নিজেই ভালো তাই ওর সাথে সবই ভালো হয়েছে। মনে মনে ঠাকুরের কাছে বলেন শুভ্রা ভালো থাক তার সাজানো সংসার। সত‍্যি ছেলে আর বৌকে দেখে মনটা ভরে যায়,ভালো মিলমিশ হয়েছে দুটিতে। বয়সের ফারাকটা একটু বেশি বলে প্রথমে একটু আপত্তিই ছিলো তার। শুধু মাঝে মাঝে ছোট ছেলেটার জন‍্য খারাপ লাগে কতদূরে পরে আছে ছেলেটা। খুব তাড়াতাড়ি হয়ত কাশ্মীরে পোষ্টিং হয়ে যাবে তেমনই তো বলছিলো।
         দেখতে দেখতে মাসখানেক পেরিয়ে গেছে ওদের বিয়ের। সব ব‍্যবস্থা করে অনুরাগ ওদের হানিমুনের হোটেলবুকিং আর টিকেট সব মেল করে পাঠিয়ে দিয়েছে। নর্থ সিকিম যাচ্ছে ওরা বেড়াতে,খুব ভালো লাগছে ওদের দুজনেরই। শান্তনু তো সেদিনই সাথে করে নিয়ে গিয়ে অনেকগুলো ড্রেস,জ‍্যাকেট,টুপি সব কিনে দিলো।..." দেখি দেখি বৌদিভাই কি সুন্দর হয়েছে গো ড্রেসগুলো। আমাদের কিন্তু লাভবার্ডস দের অনেক ছবি চাই। পর পর পাঠাতে থাকবে। প্রতিদিন আপডেট করবে।"
        টুয়ার হাতে একটা প‍্যাকেট দিয়ে শান্তনু বলে," এই যে ক্ষেপি এটা তোর,ও খুব পছন্দ করে এই ড্রেসটা তোর জন‍্য কিনেছে।" আনন্দে লাফায় টিয়া। সত‍্যি বোনটা এখনো ছেলেমানুষ। শুভ্রা মনে মনে ভাবেন এখনি তো আনন্দ করবে ওরা।
দেখতে দেখতেই চলে এলো ওদের যাবার দিন। সকাল থেকেই চলছে তোড়জোড় যদিও ট্রেন রাতে তবুও লাষ্ট মোমেন্ট প‍্যাকিং। শুভ্রাও ব‍্যস্ত ওদের একটু খাবার দাবার করে দিতে হবে রাতে ট্রেনের জন‍্য। টুয়া এর মাঝেই একগাদা জিনিসপত্র দিয়ে গেছে । ট্রেনে তুলতে রাতে আসবে বলে গেছে। শুভ্রা তো পাখি পড়ার মত বারবার বলছেন," সাবধানে ঘুরবি,একা বৌমাকে ছেড়ে কোথাও যাবিনা। ঠান্ডা লাগাবিনা,পাহাড়ের খাদের দিকে যাবিনা। বাড়িতে টাইম টু টাইম ফোন করবি। না হলে বোনকে হোয়াটসআ্যপ করে দিবি। " শান্তনু হাসে," মা একটু তো ভরসা রাখো,আগে তো বন্ধুদের সঙ্গেও গেছি। এই প্রথম তো যাচ্ছিনা।"
       ট্রেনে উঠে বসে ওরা,বোনটা এসেছিলো। তবে একসাথে সবাই গেলেই হয়ত বেশি মজা হোত তাই সৌরভী বলেই ফেলে," তোমরা গেলে খুব ভালো হোত।"
   ....." ছোড়দাটা আমাদের টিকিটই পাঠালোনা কি করি বলো.. আরে না না মজা করলাম আনন্দ কোরো তোমরা খুব।" এই বলে সৌরভীর কানে কানে বলে, "হানিমুনে শুধু একা একা চাঁদ দেখো দুজনে আর ভালোবেসো প্রাণভরে।"
           একে অপরের আরো কাছাকাছি এলো ওরা,সমস্ত মন আর মুহূর্তগুলো শুধুই যেন দুজনের দুজনের জন‍্য। বেশ আলাপ হয়ে গেলো একটি পরিবারের সাথে শান্তনুর ওরাও মজা করে বললো হানিমুন কাপল্ তাহলে তো কখন যে রাত আর দিন হবে কোনকিছুর হিসেব থাকবেনা। আ্যরেঞ্জন্ড ম‍্যারেজ আপনাদের,বাহ্ তাহলে দুজনকে চেনার একটু নিরিবিলি সুযোগ। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা খুবই প্রাণবন্ত,বেড়াতে ভালোবাসেন তবে কোন সন্তান নেই। ওরাও যাচ্ছেন সিকিমে। মোটামুটি ওদের ট‍্যুর প্রোগ্ৰামটা এক শান্তনুকে ভদ্রলোক বললেন ভালোই হবে এক গাড়ী শেয়ার করা যাবে। গ‍্যাংটকে এসে একই হোটেলে ওঠে ওরা,সৌরভীকে নতুন ড্রেসে দেখে একঝলক তাজা হাওয়া যেন ভরিয়ে দেয় আর আবেশ ছড়িয়ে দেয় শান্তনুর নিশ্বাসে প্রশ্বাসে। কোথায় যেন হারিয়ে যায় ওরা দুজন। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ হয়ে বেশ লাগছে সৌরভীর। তবুও বেড়াতে এসে এমন কেউ সাথে থাকা ভালো। ওদের পাঠানো ছবিগুলো টুয়া আর অনুরাগ দেখে মুগ্ধ। যাক দাদাভাই ভালো এনজয় করছে ভালো লাগে অনুরাগের। টুয়া তো প্রায় প্রতিদিন একবার মায়ের কাছে আসে," মা দেখো দেখো,বৌদিভাইকে কি সুইট লাগছে,একদম হিরোইনের মতো। ওহ্ কত বরফ পেয়েছে ওরা জিরো পয়েন্টে ওই দেখো বরফ ছুড়ছে দাদাভাই। আচ্ছা ওদের একসাথে তো অনেক ছবি,কে তুলে দিচ্ছে বলতো?"
   সৌরভী ফোন করলে জিজ্ঞেস করে টুয়া,ঐ ভদ্রলোকদের কথা বলে। একসাথে গাড়ী শেয়ার করছে সেটাও বলে। নিশ্চিন্ত লাগে শুভ্রার যাক বাবা বিদেশে তবুও তো কাউকে পেয়েছে নিজেদের সাথে।
         লাচেন লাচুং দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় সৌরভীর সত‍্যিই এতো সুন্দর বরফের পাহাড়ে ওর আগে আসা হয়নি। শান্তনু আদর করে বলে," আমার ভাইটা কি ভালো বলতো, কতো ভাবে আমাদের কথা,এমন ভাই কজনের আছে বলতো?" সত‍্যিই বোধহয় টুয়া আর অনুরাগের কোন তুলনা হয়না। ফোনে কথা হয় অনুরাগের সাথেও।
  লাচেন থেকে গুরুদোংমার যাবে ওরা,সাথে ঐ দাদা বৌদিও। সবাই খুব আনন্দ করছে ওরা,এটা দেখা হলেই মোটামুটি ফেরার পালা। গুরুদোংমার লেক যেন পৃথিবীর বুকে একটুকরো শান্তির ছোঁয়া। মন জুড়িয়ে যায় ওদের। পিঙ্ক জ‍্যাকেটে সৌরভীকে খুব সুন্দর লাগছে। দাদা বৌদিদের অনেকগুলো ছবি তুললো ওরা ওনারাও বিভিন্ন পোজে তুলে দিলো ওদের অনেক ছবি। "আরে একটু ক্লোজ হও সৌরভী,এই তো বাহ্।"
            মাঝে বেশ কিছুটা সময় টাওয়ারের জন‍্য ফোন করতে পারেনি বাড়িতে। শুভ্রার খুব চিন্তা হচ্ছিলো,তারপর রাতে দাদার ফোন থেকেই খবর দেয়। একটু নিশ্চিন্ত হন ওরা স্বামী স্ত্রী,কবে যে ফিরবে ছেলে বৌ বাড়িটা বড় ফাঁকা হয়ে গেছে।
        গুরুদোংমার থেকে ফেরার পথে জানলা দিয়ে ক‍্যামেরা বের করে ছবি তুলছিলো শান্তনু,সৌরভী মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো পাহাড়ের অপরূপ রূপ। হঠাৎই অদ্ভুত ভাবে একটা পাথর গড়িয়ে আসে ওপর থেকে ওদের গাড়িটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে যায় অনেকটা ঢালে,শান্তনু চোট পায় জড়িয়ে ধরে সৌরভীকে গাড়ির ব্রেক নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনা ড্রাইভার বড় গাছটায় ধাক্কা মারে গাড়ি,হয়ত গড়িয়ে যায়নি খাদে সেটাই রক্ষা। তুবড়ে যায় একটা দিক,পাথরে আর গাছে লেগে। সৌরভীর কিছু মনে নেই,যখন চোখ খোলে দেখে শান্তনু জড়িয়ে ধরে আছে ওকে। ছাড়াতে চেষ্টা করে, কিন্তু না পারেনা। শান্তনু সাইডে বসে পুরো ধাক্বাটা নিজে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে চিরকালের মতো,সবাই আহত,রক্ত পড়ছে দাদার হাত ভেঙেছে। কিন্তু তবুও ওরা আছে,শুধু চলে গেলো শান্তনু। সৌরভীর আর কিছু মনে নেই,কারা ওকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলো কি হয়েছিলো কোন কিছুই মনে করতে পারেনা।
         যখন চোখ খুলেছিলো তখনও মাথায় অসহ‍্য যন্ত্রণা,ব‍্যান্ডেজ করা মাথা থেকে কখন মুছে গেছিলো অতি যত্নে আঁকা শান্তনুর ভালোবাসার রঙ বুঝতেই পারেনি।
          শুভ্রার সুখের সংসার আজ বড় এলোমেলো,পাড়ার লোকজন সামলাচ্ছে ওদের। পাগলের মত হয়ে গেছে টুয়াও। কে যে কাকে সামলায়! শুধু ওদের বাবা আছেন বুকে পাথর চাপা দিয়ে। সৌরভীর মা তাকাতে পারেননা মেয়ের দিকে," হে ভগবান,শেষে এই ছিলো মেয়েটার ভাগ‍্যে আমার মতোই পোড়া কপাল হলো ওর। আমার প্রাণটা তো ভগবান নিতে পারতো।" মেয়ের মাথাটা কোলে নিয়ে বসে থাকেন চুপ করে। হঠাৎই আশ্চর্য হয়ে যান শুভ্রার কথায়," ওকে নিয়ে যান এখান থেকে। ওকে বাঁচিয়ে আমার ছেলেটা চলে গেলো। নিয়ে যান ওকে।"
......ধমকান শান্তনুর বাবা," তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? কি বলছো তুমি? সৌরভীও তোমার মেয়ের মত,একবার ওর মনটা ভাবো। কোথায় যাবে ও। "
    টুয়াও বোঝায় মাকে," মা কি করছো,বৌদিভাইয়ের কি দোষ! ওর কষ্টটা একবার বোঝো।"
....আর্তনাদ করে ওঠেন শুভ্রা," আমার মতো কারো কষ্ট না,বত্রিশ বছর ধরে ছেলেটাকে আগলে রেখেছি,ও কতদিন এসেছে।"
   অস্থির হয়ে ওঠে অনুরাগ,পাগলের মতো লাগে। ভাবতেই পারেনা দাদাভাই নেই। নিজেকে অপরাধী লাগে কেনো যে ওদের পাহাড়ে যাবার টিকিট কেটে দিয়েছিলো। এরচেয়ে দিল্লী,মুম্বাইয়ে বেড়ানোর কথা মাথায় এলোনা কেনো?দাদাকে ছাড়া কিছুই যেন ভাবতে পারেনা। ছোট থেকে দাদাই ওদের দুইভাইবোনকে আগলে রেখেছে সবসময়। বাড়িটা জমজমাট হয়ে থাকতো সবসময় ওদের আনন্দে। অথচ ছুটি পাচ্ছেনা যে ফিরবে,কয়েকদিন দেরি হবে কারণ ওর ট্রান্সফারের অর্ডার এসে গেছে।
                সৌরভীর মা ফিরে গেছেন, ফাঁকা ঘরে কি করে যে ওর দিন কাটে,কেমন কাটে কিছুই যেন বুঝতে পারেনা। শুধু একরাশ স্মৃতি তাড়া করে বেড়ায় সব সময়,মনে হয় সবই হয়ত আছে আগের মতো। এই তো শান্তনুও আছে,ড্রেসিং টেবিলের ওপর কি সুন্দর হাসিখুসি মুখের দুজনের দুটো একসাথে ছবি। এরমাঝেই একদিন ওর ফোনটা বেজে ওঠে,অবাক হয়ে যায় শান্তনু কল করেছে,ওর ছবিটা ভেসে উঠেছে স্ক্রীনে। কথা বলতেই চমকে ওঠে পুলিশের ফোন,শান্তনুর ফোনটা পাওয়া গেছে। ওর শ্বশুর মশাই আর নন্দাই গিয়ে ফোনটা নিয়ে আসে। ফোন ভর্তি ওদের বেড়ানোর ছবি। ছবি দেখতে দেখতে সবাই হারিয়ে যায়,মনে হয় সব আছে একরকম।
         বাড়ির আনন্দের সুরটা কেটে গেছে। সবসময় একটা দীর্ঘশ্বাস,কি করে সংসার চলছে তাও বলা মুশকিল। অনুরাগ বাড়ি আসে,এক দম বন্ধ করা গুমোট বাড়ি যেন ওর গলা টিপতে আসে। পুরোনো কথাগুলো ঘুরে ফিরে আসে। এসেই অন‍্যবারের মতো এবারও মাকে জড়িয়ে ধরে এবার আর কোলে তোলা হয়না। যেন এই কদিনে কঙ্কাল হয়ে গেছে মা। কয়েকদিন বাড়ি থেকে এটা বুঝতে পারে মা যেন অদ্ভুতভাবে পাল্টে গেছে আগের সেই মাতৃরূপটা খুব মিস্ করে। শোকে দুঃখে মা কেমন যেন হয়ে গেছে।
          সবচেয়ে অবাক লাগে অদ্ভুত একটা ব‍্যাবহার করছে মা বৌদিভাইয়ের সাথে। বুঝতে পারেনা বৌদিভাইয়ের কি দোষ,টুয়াও একই কথা বলে অনুরাগকে আচ্ছা মা কি সত‍্যিই পাগল হয়ে গেছে? এতো ভালোবাসতো বৌদিভাইকে। এখন যেন দেখতেই পারেনা। বোঝায় ওরা দুজনেই মাকে,খুব একটা ফল হয়না। বার বারই বলেন শুভ্রা ওকে বাঁচাতে গিয়েই আমার ছেলেটা শেষ হয়ে গেলো।" আচ্ছা মা দাদাভাই চোটটা বেশি পেয়েছিলো,তুমি কেনো বুঝতে চাইছো না।"
  শুভ্রার সাথে সাথে ওরা দুইভাইবোনও যেন সমস্ত দুঃখ উজাড় করে কাঁদে। বুঝতেই পারেনি সৌরভী কখন এসে দাঁড়িয়েছে ওখানে,সত‍্যিই হয়তো ওর কষ্ট ওদের চেয়ে কম মাত্র তো কমাস আর বিয়ে হয়েছে ওদের? তবুও কেন যেন ওর জীবনটাই বড্ড বেশি ফ‍্যাকাশে হয়ে গেছে সমস্ত রঙ চাপা পড়েছে একটা বর্ণহীন সাদা পর্দায়।
            অনুরাগ চলে যায়,ওর পোষ্টিং কাশ্মীরে হয়েছে,আতঙ্ক গ্ৰাস করেছে শুভ্রাকে তাই বলছিলেন," তুই চাকরি ছেড়ে দে।'....." সবার জীবন কি এক হয় মা? তুমি দেখো আমার কিছু হবেনা।" প্রতিদিনই ফোনে কথা হয় জানায় ভালো আছে। হয়ত আবার মাস ছয়েক বাদে আসবে। টুয়ার কাছে সব খবর পায় অনুরাগ। কাছে শ্বশুরবাড়ি হওয়াতে প্রতিদিনই প্রায় চলে আসে। শান্তনু চলে যাওয়ার প্রায় পাঁচমাস বাদে খুব জোর করে একদিন সৌরভীকে সাথে নিয়ে বেরোয় টুয়া। অনেকদিন বাদে বাইরের হাওয়া লাগে শরীরে,দেখে খোলা আকাশ,লোকজন। হঠাৎই রাস্তায় ওর মাসিশাশুড়ির সাথে দেখা হয়ে যায়। সবটাই জানেন উনি,বলেন," ভালো করেছো,বৌদিকে নিয়ে একটু বেড়িয়েছো। কত অল্প বয়স মেয়েটার কি করে সারাজীবন কাটবে ওর!"
        কথাটা নাড়া দেয় টুয়াকেও সত‍্যিই তো,বৌদিভাই দাদার চেয়ে প্রায় নয় বছরের ছোট,কতটুকু বয়েস! ওর থেকেও তো ছোট। কি করে কাটবে ওর জীবনটা।
       বাড়ি ফিরে বাবা মায়ের কাছেও একি কথা বলে সৌরভীর আড়ালে। " ওই জন‍্যই তো ওর মাকে বলেছিলাম নিয়ে যেতে,তোরাই তো শুনলিনা।"
....." এটা কোন বিহিত নয় মা,ওর বাবা নেই। মাকে কে দেখে সেটাই মুশকিল,তার ওপর আবার..." সৌরভী এসে দাঁড়ায় ফ‍্যাকাসে মুখটা নিয়ে," আমাকে একটু জায়গা দিন মা।"
         টুয়া হেসে বলে তোমার জায়গা তো দাদা করেই গেছে আমাদের মনে আর বাড়িতে। আছি তো আমরা,বরং আরো পড়াশোনা বা অন‍্য কিছু করতে ইচ্ছে করলে বোলো। সৌরভীর ভাঙা মন বোধহয় শুধু শান্তনুকেই চায়। ওর স্মৃতি ঘিরে রাখে সবসময়।

         মাস ছয়েক বাদে অনুরাগ আসে, ছুটি খুব বেশিদিন নয় তবুও বড় মন কেমন করছিলো বাড়ির জন‍্য। একটু বাড়ির পরিবেশটা অন‍্যরকম হয়,সৌরভীরও ভালো লাগে, টুয়াও কদিন এসেছে থাকবে বলে। শুভ্রাও চাইছেন দুয়েকটা সম্বন্ধ এসেছে ছেলের সেগুলো দেখুক যদি ভালো লাগে বিয়ে দিয়ে দেবেন। একা একা অতদূরে রয়েছে ছেলেটা। অনুরাগ বলে ভেবে বলছে,কখন মেয়ে দেখতে যাবে। শুভ্রা ছবিগুলো দেন টুয়াকে দাদাকে দেখানোর জন‍্য।
        .....পরদিন টুয়ার মুখটা দেখে শুভ্রা জিজ্ঞেস করেন," কি হয়েছে রে? তোর মুখটা এমন কেনো,জামাইয়ের সাথে ঝগড়া করেছিস?"
  ....." না মা মনটা ভালো লাগছে না,দাদার কথা খুব মনে পড়ছে।"
          ছলছল চোখে মেয়েকে কোলের কাছে টেনে নেন শুভ্রা। ....." আচ্ছা মা ছোড়দা যদি ওর পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে চায় তুমি আপত্তি করবে না তো?"
...." ভালো হলে আপত্তির কি আছে...কোন মেয়ে? তুই দেখেছিস?"
....." তুমিও দেখেছো মা।" শুভ্রা একটু আশ্চর্য হয়ে যান। কোন মেয়ে মনে করতে চেষ্টা করেন।
       ......" সৌরভী আমাদের বৌদিভাই মা।"
    স্তম্ভিত হয়ে যান শুভ্রা এদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রাগে ফেটে পড়েন,"---এই কিছুদিন আগে বিধবা হয়েছে তাও আবার সম্পর্কে বৌদি। তাকে বিয়ে করতে চায় কি করে অনুরাগ,হাজার হোক ওর দাদার বৌ। দুমাস হলেও একসাথে থেকেছে। এইজন‍্যই এই মেয়েটাকে বাড়িতে রাখতে চাইনি,এরা সব পারে।"
.....আশ্চর্য হয়ে যায় টুয়া,এই কি সেই মা যাকে বিয়ের দিন দেখেছিলো বৌদির কষ্ট হবে বলে রাগ করতে। ছোড়দার যুক্তিটাও ফেলে দেয়া যায়না, সৌরভীর ভবিষ‍্যতটা ভাবা ওদের কর্তব‍্য,অন‍্য কোথাও বিয়ে দিয়ে অযত্ন হওয়ার চেয়ে ওদের কাছে থাকাই ভালো। মেয়েটা তো সত‍্যিই খুব ভালো মেয়ে। বয়সের দিক দিয়েও মানানসই ছোড়দার সাথে। কিন্তু মাকে কি করে সামলাবে?
                অনুরাগ চলে যায় সেবারের মতো,শুধু বলে যায়,ওরা মত না দিলে এর মধ‍্যে আর আসতে পারবেনা। সব কিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে সৌরভী প্রস্তুতি নিয়েছে বাপের বাড়ি চলে যাবার। সত‍্যিই তো এ হয়না। নিজেকে আজকাল অপয়া ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না ওর,হয়তো ওর জন‍্যই ওদের সংসারটা নষ্ট হয়েছে,ছেলে চলে গেছে এইসব কত কথা মনে হয় আজকাল। মনে হয় জীবনটা আর না থাকলেই ভালো হোত,সেদিন তো ওই চলে যেতে পারতো শান্তনুর বদলে।
            সেদিন জিনিসপত্র গোছাচ্ছে সৌরভী, কিই বা আছে গোছানোর,কয়েকটা জামাকাপড় আর কিছু ছবি,সত‍্যি এই দমবন্ধ করা পরিবেশ আর ওর ভালো লাগছেনা। এক মাকে ছেড়ে এসে আরেক মায়ের ভালোবাসায় সব ভুলেছিলো। ভালোবেসেছিলো এ বাড়ির সবাইকে। আজ যেন চোখের জল ফেলার আর মনের কথা বলারও কোন জায়গা নেই,আছে শুধু টুয়া এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া।
       ওর মা এসেছেন,নিয়ে যেতে। যাওয়ার আগে প্রণাম করে শুভ্রাকে,দুচোখ ভরা জল তখন। হঠাৎই হাউ হাউ করে সৌরভীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কত কষ্ট জমিয়ে গুমোট মনদুটো আজ অঝোরে ঝরিয়ে দিচ্ছে বুকের মাঝে জমে থাকা দুঃখ যন্ত্রণা আর অভিমানের পাহাড়। বড্ড নিরাপদ লাগে আজ শুভ্রার বুকের মাঝখানটা সৌরভীর। অস্ফুটে কান্নাভেজা কয়েকটা কথা বলেন শুভ্রা," আমায় এই বাড়িটাতে একা ফেলে সবাই স্বার্থপরের মতো চলে যাবে,কিছুতেই হবেনা।"
        সৌরভীর যাওয়াটা সত‍্যিই সেদিন হোলোনা,হয়ত যেতে সেও চায়নি,শান্তনুর স্মৃতিঘেরা চারদেওয়ালেই ছিলো ওর মুক্তি। শুধু চেয়েছিলো একটু ভালোবাসা।
            অনুরাগ এসেছে,টুয়া আবার একটু ব‍্যস্ত কেনাকাটায়। "আচ্ছা মা ছোড়দা,এই শাড়িটা কিনেছে বৌদিভাইয়ের জন‍্য,তোমার পছন্দ তো?"
কিন্তু বৌদিভাই কিছুতেই এই রঙের শাড়ি পরবেনা। কোন অনুষ্ঠানও করতে চাইছে না। " আচ্ছা আমি কথা বলবো",বলেন শুভ্রা।
......" না না কিছুতেই আমি পারবোনা,ঐ রঙটা ওর খুব পছন্দ ছিলো। কোনো কিছু আমার চাইনা। তোমার জন‍্য আমি রাজী হয়েছি মা,সত‍্যিই তো আমি অপয়া।"
......" আর কোনদিন যেন এ কথা শুনিনা,আমার ছেলেটার তো এটা প্রথম বিয়ে,তোর না হয় লাগবেনা। কিন্তু ও যখন চাইছে সব শখই আমি পূরণ করবো। ছেলেটা আমার বড় অভিমানী।
             সৌরভীর ফাঁকা সিঁথি আবার রাঙা হলো অনুরাগের রঙে। বন্ধুরা এবারও মজা করলো," একেই বলে রিয়‍্যাল হিরো,সাচ্চা দিলের জওয়ান।সত‍্যি তুই লাকি রে!"
      মাথা নীচু করে সৌরভী। শুধু কেন যেন এক অদ্ভুত ভয় ওকে ঘিরে ধরে,পারবে তো অনুরাগকে ধরে রাখতে শান্তনুর মতো..... আর ভাবতে পারেনা।
        নিয়ম মেনেই সব অনুষ্ঠানই হোলো। ফুলশয‍্যার রাতে শান্তনুর ছবির কাছে গিয়ে অনুরাগ বললো," তোর জিনিসের ওপর খুব লোভ ছিলোরে আমার দাদা, তাই তোর ফেলে দেওয়া জিনিস সব যত্ন করে রাখতাম। আর সেইজন‍্যই তো তোর ভালোবাসার জিনিসটাকে যত্নে রাখবো বলে নিজের করে নিলাম। ঠিক করেছি তাই না রে?" দুচোখে তখন অঝোর ধারা সৌরভীর।
             কয়েকদিন বাদেই ফিরে যেতে হবে অনুরাগকে। সৌরভীকে সাথে নিয়ে যাবে ঠিকই ছিলো। বাড়িটা বড় খালি হয়ে গেলো,তবুও শুভ্রা মাথায় হাত ঠেকিয়ে বলেন," ওদের ভালো রেখো।সুখে থাক ওরা।"
......." আমরাও আসছি ছোড়দা কয়েকদিন বাদে, কাশ্মীরে যাবো,ওহ্ কি যে ভালো লাগছে!" বলে টুয়া।
       জম্মু থেকে পাহাড়ের ধাপ ধরে এগিয়ে যায় অনুরাগের অফিসের জিপটা। পাহাড় দেখে বড় ভয় হয় সৌরভীর, সহ‍্য করতে পারেনা। আতঙ্কে চোখ বুজে ফেলে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অনুরাগের হাতটা, যত্ন করে সৌরভীকে আগলে রাখে অনুরাগ। কাশ্মীরের পাহাড় আর অনুরাগের গভীর আলিঙ্গন,রেখে যায় একঝলক নির্ভরতা আর ভালোবাসা সৌরভীর অনিশ্চিত ভেসে যাওয়া জীবনে। ভালো থাক ওরা আর ভালো থাক এমন অনেক সৌরভী ভালোবাসার আর যত্নের মিষ্টি ছোঁয়ায়।

সমাপ্ত:-
         
  

          
    
          
    
   
    

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...