Skip to main content

আলতো ছোঁয়া

#আলতো_ছোঁয়া#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"না না আমি মায়ের কাছে যাবোনা। ও ঠাম্মু আমাকে নিয়ে চলোনা,আমি টিভিতে সিনচ‍্যান দেখবো। চলোনা গো,আমাকে নিয়ে। আমি এই ঘরে থাকবোনা।"
...দুচোখ জলে ভরে যায় সৌমির,যে ছেলের মাকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতো না সে আজ মায়ের কাছে আসতে চাইছেনা। সংসারে সত‍্যি বুঝি তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আগে শাশুড়িমা সব কিছুতে একটু হলেও মতামত নিতেন। এখন যেন সংসারে ও একটা অকেজো মানুষ।
           আগে শান্তনুর অফিসে যাবার সময় হলেই চেঁচামেচি শুরু করতো," সৌমি আমার রুমাল কোথায়? তাড়াতাড়ি খেতে দাও। ইশ্ এই শার্টটা বের করেছো কেনো? খুব গরম হয় এটাতে।"
      সব সামলাতে রীতিমত ছুটোছুটি করতো একতলা আর দোতলা। শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করতো, "দেখেছো মা,কেমন আদর দিয়ে ছেলে বানিয়েছো তোমার! একটা কাজও করেনা নিজে।"
    এই কদিন আর কেউ ওকে বিরক্ত করছেনা। সবেই অপারেশনের পর বাড়ি ফিরেছে। অনেকদিন মুম্বাই আর কলকাতা করে কেটেছে শান্তনুর,ওর অপারেশন কেমো সব কমপ্লিট হতে অনেকদিন লেগেছে তাই অতদিন শান্তনু একটানা থাকতে পারেনি। চলে এসেছিলো,ঐ সময়টা সৌমির বাবা আর ভাই পাল্টাপাল্টি করে থেকেছে মুম্বাইয়ে।
        অনেকদিন ধরে সৌমির প্রাণের টুকরো টিনটিন মা ছাড়া,খুব কষ্ট পেয়েছিলো,যখন শুনেছিলো বেশ কিছুদিন ওকে ছেলেকে ছেড়ে থাকতে হবে। কেঁদে অস্থির হয়েছিলো,হয়ত অসুখের চেয়ে ছেলেকে ছেড়ে থাকার কষ্টটা বেশি ভাবিয়েছিলো। মনটা অদ্ভুত এক মনখারাপের কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছিলো। শাশুড়িমা আর বলেছিলেন ," এতো চিন্তার কি আছে, ভালো হয়ে যাবে মামনি তুমি একদম,টিনটিন দাদুভাইয়ের জন‍্য কোন চিন্তা নেই। আমি আছি,বেয়ান আছে। তাছাড়া তোমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে তো ও দিব‍্যি থাকে।"
    ....মুম্বাই যাওয়ার আগে দুচোখ ভরা জল নিয়ে ওদের বাড়ীর সরলাদিকে বলেছিলো,"বাবুটা খুব দুষ্টু একটু নজর রেখো,যেন রাস্তায় বেড়িয়ে না যায়।"
        অনেকটা ভালো আছে সৌমি এখন দীর্ঘ লড়াইয়ের পর,ডাক্তার বলেছেন আউট অফ রিস্ক, তবে ট্রিটমেন্ট চলবে। ওর মা বলেছিলো এখন কিছুদিন ওবাড়িতেই থাকতে মায়ের কাছে,একটু সেরে উঠলে যেতে। শান্তনুর ও তেমনিই ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু কেন যেন খুব অভিমান হয়েছিলো শান্তনুর ওপর,ইচ্ছে করে ওকে দূরে রাখতে চায় মনে হয়েছিলো। তাই একরকম জোর করেই শ্বশুরবাড়ি চলে এসেছিলো।
     কিন্তু এসে যেন মনে হচ্ছে সবাই কেমন পর হয়ে গেছে। ওর নিজের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে স্বামী আর সন্তান। বাড়ির কোন কাজেই আর ওকে লাগেনা। সব ওকে ছাড়াই চলে যাচ্ছে বাধাধরা নিয়মে। আজকাল শান্তনুও আর ডাকেনা," আমার রুমাল কই,এদিকে এসো একবার জলদি।"....হাতের হলুদ মুছতে মুছতে আসতো ছুটে সৌমি।শান্তনু একটানে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে বলতো," কোন অজুহাতে না ডাকলে কি মহারানীর দেখা পাওয়া যায় সারাক্ষণ রান্নাঘরে কি যে করো কে জানে?"
         পুরোনো টুকরো কথাগুলো মনে করে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে,ছেলেটাও আর স্কুল থেকে এসে মা মা করে বাড়ি মাতিয়ে তোলে না। সব যেন কেমন চুপচাপ। ওর কাছে পড়তেও বসেনা,শাশুড়িমা বলেন," তোমার বাবার কাছে এখন বসে,ওর আর কতটুকু পড়া বলতো, ও আমরা দেখিয়ে দেবো। তুমি বিশ্রাম নাও, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো।"
    নিজের চুলছাড়া মাথাটায় হাত চলে যায় সৌমির,হয়ত এইজন‍্যই ছেলেটা কাছে আসেনা। নিজেকে আজকাল আয়নায় দেখতেও ভালো লাগেনা হয়ত বা চমকে ওঠে। মাঝে কেটে গেছে আরো একমাস,এখন অনেকটা ভালো আছে সৌমি। সেদিন শান্তনুর সাথে কথা বলছিলো হঠাৎই পর্দাটা ফাঁক করে উঁকি দেয় টিনটিন। সৌমি ডাকে," কে রে ওখানে? দেখি দেখি একটু আয় না বাবু।" ..." আমি খেলছি এখন,তুমি ঘুমু করো।" বলে চলে যায় টিনটিন। শান্তনুর কাছে কেঁদে ফেলে সৌমি আগেও কেঁদেছে এমন করেই," তোমরা কি আমায় সবাই পর করে দিলে,কি হয়েছে আমার কোন ছোঁয়াচে অসুখ?"
......" সব ঠিক হয়ে যাবে,মন খারাপ কোরোনা। একটু সময় দাও,সবাই চাইছে তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো।"
    এরমাঝেই শান্তনু বলে," বাবুর স্কুলে সামনের মাসে আ্যনুয়াল ফাংশান,কেন যেন ছেলেটা বেঁকে বসেছে
কিছুতেই পারফর্ম করতে চাইছেনা। ওর ক্লাশটিচার আমাকে ফোন করেছিলো একবার দেখা করতে বলেছে। কিছুদিন হলো একটু বেশিই চঞ্চল আর অবাধ‍্য হয়ে গেছে। আমাকে হয়ত কালই যেতে হবে ওর স্কুলে।"
           মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় সৌমির,কিছুতেই ছেলেটা ওর কাছে আসছেনা। আর ওর সাথে ছোটাছুটি করা এখন ওর বারণ। কি যে করবে বুঝতে পারেনা। শান্তনু পরদিন স্কুলে যায়,খুব চিন্তা লাগে সৌমির কি বলবে টিচার কে জানে,অথচ এর আগে কখনো কোন সমস‍্যা ছিলোনা স্কুলে ওর। বাড়ির সবার অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে ছেলেটা খারাপ হচ্ছে।
               শান্তনু খুশি হয়েই ফেরে রাতে, ওর হাসিমুখটা দেখে একটু শান্তি লাগে সৌমির।..." কি বললো গো,ওর ক্লাশটিচার?"
        "আমার সামনে ওকে ডেকেছিলেন টিচার,আমরা কথা বলেছি তুমি চিন্তা কোরনা। বাবু এদিকে আয় সোনা,মাকে একটা মিত্তি কিশি দিয়ে যা তো..."
           পর্দাটা সরিয়ে আস্তে আস্তে ঘরে ঢোকে বাবু ছোট ছোট পায়ে এসে বাবার পাশে দাঁড়ায়। শান্তনু ওকে দুহাতে ওপরে তুলে সোজা বসিয়ে দেয় সৌমির কোলে। মুখে একটু ভয়ের ছাপ টিনটিনের, ছোট্ট করে বলে," মায়ের ব‍্যাথা লাগবে না তো?"
........চোখ দিয়ে একঝাপটা জল বেড়িয়ে আসে সৌমির,রোগা হাতদুটো দিয়ে আঁকড়ে ধরে ছেলেকে বুকের কাছে।
                      "ছেলের প্রোগ্ৰামের দিন কিন্তু তোমাকে যেতে হবে সৌমি,আমি নিয়ে যাবো গাড়ি করে,ওদের ক্লাশটিচার ওকে এই বলেই রাজি করিয়েছে যে তুমি আসবে সেদিন ।"
.........নিজের চেহারার কথা ভেবে একটু ঢোক গেলে সৌমি," আমি যাবো? ফাংশানে এইভাবে?"
......মায়ের মুখের দিকে গভীর প্রত‍্যাশায় তাকিয়ে থাকে টিনটিন,খুব মায়া হয় সৌমির।
....." কেনো নয় সৌমি, বেশিক্ষণ থাকতে হবেনা অল্পসময় আমরা থাকবো শুধু টিনটিনের প্রোগ্ৰামটা দেখেই চলে আসবে।"
          নিজের সংকোচের কথা বলতে পারেনা সৌমি,চুপ করে অনুভব করে হারানো হৃদয়কে শরীরের মাঝে প্রতিস্থাপন করার সুখ। হঠাৎই চমকে ওঠে..
......"এই দেখ তো বাবু মাকে কেমন লাগছে?"
          সামনের আয়নায় নিজেকে আজ আবার আগের মত লাগে সৌমির,মুগ্ধ হয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বাবুও মায়ের দিকে। গলা জড়িয়ে একটা হামু খেয়ে বলে," সব ঠিক হয়ে গেছে বাবা তাইনা, এইতো মা ভালো হয়ে গেছে।"
......." আর বোলোনা,নিউমার্কেটে ঘুরে এটা আর তোমার জন‍্য একটা শাড়ি কিনতে অফিসটাই মিস করে ফেললাম আজ,প্রথম কেনাকাটা করা তো অভ‍্যেস না থাকলে যা হয়। উইগের আইডিয়াটা টিনটিনের ক্লাশটিচারের,এই তো কটা দিন তারপর সব আগের মতো হয়ে যাবে।"
         কেনো যেন আজ চোখদুটো বাঁধনহারা সৌমির এতো মিষ্টি সম্পর্কগুলো ছেড়ে কোথাও যাবেনা সে,যতই দেখাক ভয় মারণ রোগ। মনের জোরে সে জিতবেই,বাঁচতে যে হবেই ওকে।
........কানের কাছে এসে আলতো আওয়াজে বলে যায় শান্তনু," আজ কিন্তু আমারও একটু আদর চাই"....
             বহুদিন বাদে সৌমির উজ্জ্বল মুখটা আলো ছড়িয়ে গেলো ওদের সবার জীবনে।

     সমাপ্ত:-

                       

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...