Skip to main content

#আলিঙ্গনে_স্বর্গ#

#আলিঙ্গনে_স্বর্গ#
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"ওহ্ আর পারিনা! দাদুরাও আজকাল হাগ করছে দেখ দেখ।"
  বাইকে যেতে যেতে আবার একবার ঘুরে একচক্কর মেরে ছেলেটা পাশ দিয়ে একটু জোরেই বলে গেলো," মজা করে নাও দাদু জীবনের শেষ বেলায়।"
    কথাগুলো কানে এলেও আলিঙ্গনের স্বর্গসুখ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ইচ্ছে করলোনা অনিরুদ্ধর। বারাসতের রাস্তায় অনেকেই কৌতূহলী হয়ে একটু আড়চোখে দেখলো ব‍্যাপারটা। আসলে এ যে কোন দেখানো ভালোবাসা নয়। রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ এক স্নেহের নিবিড় বন্ধন। প্রথমে একটু আড়ষ্ট লাগলেও পরে নিজের চোখের কোলদুটোও ভিজে গিয়েছিলো এক অনাবিল আনন্দে।
        হাগ এই শব্দটার সাথে একদমই পরিচিতি ছিলোনা কৈশোরে বা যৌবনের শুরুতে বছর পঁচাত্তরের অনিরুদ্ধর। মা বাবাকে বা গুরুজনকে পায়ে হাত দিয়ে শ্রদ্ধাভরে প্রণাম করতেই শিখেছেন। আর বিজয়ায় কোলাকুলি করেছেন বন্ধুদের সাথে। বাবাকে দেখেছেন কাকা প্রণাম করলেই জড়িয়ে ধরতেন ওটাই ছিলো স্নেহের আলিঙ্গন।এখনো পুরোনো চিঠিতে দেখা যায় শ্রীচরণেষু বা শ্রীচরণকমলেষু  বাবা,পুরোনো কিছু চিঠি যত্ন করে রেখে দিয়েছেন ঘরের আলমারিতে
সময়ে বার করে দেখেন ভালো লাগে। হঠাৎ করে যেন অতীত এসে উঁকি মারে জীবনে। আছে কমলার লেখা কিছু একান্ত ব‍্যক্তিগত প্রেমের মাধুর্যে ভরা কিছু চিঠি। একটু আলতো ছোঁয়া টুকরো টুকরো ভালোবাসার কথাগুলো আজও উজ্জ্বল স্মৃতিতে। আসলে হয়ত সবটাতেই অনুভূতির প্রাধান‍্যই ছিলো বেশি। হয়ত ছিলো অনেক বেশি ধৈর্যও তাই কমলার বাপের বাড়ি থাকাকালীন বারাসত থেকে আসামে চিঠি পৌঁছতে দেরী হলেও কখনো কমলার সন্দেহ হতনা অনিরুদ্ধ এখানে পরকীয়া করছেন। বা কমলাকে ভুলেই গেছেন। আসলে বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে সরল করার সাথে সাথে করেছে জটিলও। তাই ফোন না পেলেই মনে হয় গেলো বুঝি সব হাতের বাইরে। সবসময় যেন অদ্ভুত এক সন্দেহ আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। অনিরুদ্ধর মনে হয় শরীর ছোঁয়া বা ছুঁতে দেওয়া আর অনুভূতি পূর্ণ ভালোবাসা দুটো বোধহয় একটু আলাদা। আর তাই তিনিও মন ভরে উপভোগ করছেন সেই আবেগ আর অনুভূতিমাখা আলিঙ্গন হয়ত এই জীবনে এ এক অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা আর স্বর্গীয় সুখ।
           মাথায় ঝাঁকড়া লালচে চুলের আধুনিকা মেয়েটি দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরেছে একদম রাস্তায়, তাকিয়ে দেখছে অনেকেই। বয়স হলেও পরিমিত খাওয়াদাওয়া আর যোগাভ‍্যাসে এখনো সুন্দর চেহারা তার। দীর্ঘদিন তিনি নিরামিশাষী অথচ একসময় আমিষ ছাড়া তার চলতো না। এই নিয়ে কমলার সাথে অশান্তিও হোত। কমলার উপোশের দিনগুলোতেও রাঁধতে হোত কোন সময় তার পছন্দমতো আমিষ পদ। অথচ কমলা চলে যাওয়ার পর আর ছুঁয়ে দেখেননি মাছ মাংস। সত‍্যি জীবনটা বড়ো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো,আজও হয়ত তেমন ফাঁকা আর নিঃসঙ্গ। যখন জানতে পারলেন একমাত্র মেয়ে আর নেই মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গিয়েছিলেন তারা দুজনেই। মেয়েকে বিয়ের পরেই বিদেশে নিয়ে চলে গিয়েছিলো জামাই,সুখেই ছিলো মেয়েটা যদিও জামাই কখনো ছেলে হয়ে উঠতে পারেনি তাদের কাছে। দু তিনবছর বাদে বাদে একবার এসে ঘুরে যেতো। জামাই নিজের বাড়িতে থাকলেও মেয়ে আর নাতনিকে পেতেন কাছে। সুখের হাট বসতো তখন বাড়িতে,রান্না বাজার আর মেয়ের আদর যত্ন নিয়ে কদিন ব‍্যস্ত হয়ে পড়তেন কর্তা গিন্নী। ছোট্ট নাতনি আর মেয়ে জামাই নিয়ে সুখের সংসার ছিলো তাদের। বাকি সময়টা ফোনেই হোত কথা। কোথা দিয়ে কি হয়ে গিয়েছিলো বুঝতে পারেননি ওরা স্বামী স্ত্রী,শুনেছিলেন রোড আ্যক্সিডেন্ট। কিছুই করার ছিলোনা। শুধু একরাশ অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিলো জীবনটা। সহ‍্য করতে পারেনি কমলাও তাই হয়ত ছয়মাসের মধ‍্যেই চলে গিয়েছিলো। প্রথম প্রথম ফোনে কথা হলেও জামাইয়ের সাথে কখন যে ফোননম্বরের সাথে সাথে সম্পর্কটাও একটু একটু করে পাল্টেছিলো বুঝতে পারেননি।
           শেষ কথা হয়েছিলো অনেক বছর আগে দিদিভাইয়ের সাথে। নাতনি হওয়াতে খুব খুশি হয়ে নাম রেখেছিলেন অনন‍্যা, মেয়ের নাম রাজন‍্যার সাথে মিলিয়ে। যদিও ওদেশে নামটা হয়ে গিয়েছিলো আ্যনা। খুব কেঁদেছিলো মেয়েটা," ডাডু,পাপা এগেন মম আনছে,নিউ মম। সি উইল নট লাভ মি। টেক মি ফ্রম হেয়ার।"
        ফোনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গিয়েছিলো আর কথা হয়নি। জানতেন তার কিছুই করার নেই,বিয়ে আটকানো বা নাতনিকে কাছে রাখা কোনটাই তিনি পারবেননা। শুধু চাইতেন একটু যদি দিদিভাইয়ের সাথে কথা বলা যায়। খুব মন কেমন করতো মেয়েটার জন‍্য,মা হারা মেয়েটা কেমন আছে কে জানে? কি করছে? ওর নতুন মা কি ওকে ভালোবাসে? চেষ্টা করছিলেন নিজের মতো করে কিছুটা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে, যদি কোন ফোননম্বর পাওয়া যায় ,তারা জানিয়েছিলেন অনেকদিন তাদের সাথেও যোগাযোগ নেই। আসলে মা বাবা নেই জামাইয়ের,তাই কি জন‍্যই বা আসবে দেশে? ওরা বলে দিলো ফোননম্বর ওদের জানা নেই। তবে বিয়ে করেছে বা করবে এটা শুনেছে। আশ্বস্ত করে জামাইয়ের ছোটভাই," মেসোমশাই চিন্তা করবেন না খবর পেলে জানাবো।"মনটা খারাপ করে বেরোনোর সময় হঠাৎই পেছন থেকে দাদু ডাকটা শুনে ফিরে তাকান,নাতনির খেলার সাথী ওর খুড়তুতো বোন মিলি। মনটা ছুঁয়ে গেলো দুচোখ ভরে দেখেন ওকে মনে হলো অনন‍্যা দিদিভাইটাও তো ওরই বয়সী। " তুমি চলে যাচ্ছো দাদু,আ্যনা আসবে না?" ওর মতো এই উত্তর তারও জানা নেই এই উত্তর খুঁজতেই তো এখানে আসা যদি একবার অন্ধকার জীবনের মধ‍্যে শিবরাত্রির সলতেটা একটু জ্বালানো যায়।
       কোথা দিয়ে যে দিনগুলো কেটেছে কেমনভাবে কেটেছে বুঝতে পারেননি। কখনো খাওয়া হয়নি,পরের দিন কাজের মেয়েটি এসে বলেছে," ও মেসোমশাই কাল খাননি কেনো? সবই তো তেমনই পড়ে আছে ঢাকা দেওয়া।"
      সত‍্যিই তো কাল খাননি,কেনো যে এমন হয়? আ্যলবাম দেখতে দেখতে কখন যে মন ছুটে গিয়েছিলো অতীতে বুঝতেই পারেননি। কাল মনে মনে পৌঁছে গিয়েছিলেন কাশ্মীরে,লজ্জায় মাথা নীচু কমলার,উনি মাথায় গোলাপফুল গুঁজে দিচ্ছেন। কোনো বন্ধু বোধহয় মজা করে ছবিটা তুলেছিলো। সাদাকালো ছবি কিন্তু গাঢ় অনুভূতি আর ভালোবাসায় আজো রঙিন।
          কোনদিন রাতে খাওয়া হয়না,রাজন‍্যার মুখেভাতের ছবিতে তার বাবা মাকে দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন। মনে প্রাণে ক্লান্ত বর্তমানে মানিয়ে চলা এক জীবন্ত মৃত হয়ে জীবন চলে যাচ্ছিলো। একটু উদ্ধার করেন বন্ধুরা, জোর করে একদিন রামকৃষ্ণমিশনে নিয়ে যান তাকে। দীক্ষা নেন অনিরুদ্ধ,হয়ত মনটা কিছুটা শান্ত হয়। সময় কাটানোরও কিছুটা ব‍্যবস্থা হয়। মৃত‍্যুকে বার বার আমন্ত্রণ জানালেও সুন্দর পৃথিবীকে ভালোবেসে রয়ে গেলেন অনিরুদ্ধ তার বয়সী আরো কিছু একা মানুষের মতো।
                এরমাঝেই বাড়িটা বিক্রী করে দিলেন,সত‍্যি আর সম্ভব হচ্ছেনা বাড়ি সামলানো। খুব কষ্ট হচ্ছিলো তবুও বুক বাঁধলেন। কমলা আর রাজন‍্যার স্মৃতি পরে রইলো ঐ বাড়িতে। বন্ধুরা কোঅপারেটিভে ফ্ল্যাট করাতে সেখানেই চলে এলেন। শুধু ল‍্যান্ডফোনটা তোলেননি একই নম্বর রেখে দিলেন যদি কোনোদিন দিদিভাই ফোন করে। আজো ফোন এলে প্রথমেই মনে হয় দিদিভাই নাকি?
           নিজের অফিসিয়াল কাজকর্ম নিজেকেই করতে হয়,কে আর করবে? এরমাঝেই একদিন অনেকদিন বাদে ব‍্যাঙ্কে যেতে হোলো। আজকাল এ টি এমেই বেশি টাকা তোলেন।"কতটাকার নোট দেবো আপনাকে?" মেয়েটি মুখ তুলতেই হঠাৎ চোখ পড়ে অনিরুদ্ধর দিকে,চেকটায় চোখ রাখে আবার। " যদি একটু খুচরো দাও খুব ভালো হয়।"
      ইশ্ হঠাৎই মুখ দিয়ে তুমি বেড়িয়ে এসেছে। মনে মনে একটু লজ্জা পান। মেয়েটি হঠাৎই বলে," একটা কথা বলছি আচ্ছা আপনি কি দাদু?"
         আশ্চর্য হন অনিরুদ্ধ সত‍্যি তো উনি দাদু,অনেকদিন আগেই দাদু হয়েছেন,শুধু দাদু বলে ডাকার আর ভালোবাসার কেউ নেই। মুখ দিয়ে হ‍্যাঁ বেড়িয়ে আসে।
...." আমি মিলি দাদু,চিনতে পারছো আমায়?"
     কেমন যেন আবেগে চোখের কোল দুটো ভিজে যায়,সত‍্যি আজকাল বড় তাড়াতাড়ি চোখে জল আসে। এক মুহূর্তের জন‍্য যেন মিলির মধ‍্যে খুঁজে পান অনন‍্যাকে। কবিগুরুর কাবুলিওয়ালার মতো মিলির মধ‍্যে খুঁজে পান কোন সুদূর প্রবাসে থাকা তার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারীর মুখটা।
....." মিলি দিদিভাই,কত্ত বড় হয়ে গেছিস? ব‍্যাঙ্কে চাকরি করছিস? কি করে চিনলি আমায়?"
....." ধুতি পাঞ্জাবী পরা তোমার চেহারাটাই তো দাদু বললেই চোখের সামনে ভাসে। ছোটবেলায় আ্যনার সাথে আমিও তো গেছি তোমাদের বাড়িতে। দিদুর হাতের পায়েশ আর নারকোল নাড়ু,ইশ! এখনো ভাবলে জিভে জল আসে। তুমি একটু বোসো আমি একটু ফ্রী হয়ে নিই।"
          ব‍্যাঙ্কের চেয়ারে গা এলিয়ে দেন অনিরুদ্ধ,মনটা ডুবে যায় এক অনাবিল আনন্দে,মনে পড়ে যায় দুটো ছোট্ট মেয়ে তার বাগানে শিউলি তলায় ছুটছে। কমলার আসেপাশে ঘুরছে নাড়ুর জন‍্য। আজ হয়ত এমনি বড় হয়েছে দিদিভাইও,ওর বাবা তো কোন সম্পর্কই রাখতে দেয়নি আর এতোদিনে বোধহয় ..." আমি এসে গেছি দাদু,তুমি কিছু খাবে তো? চলো একটু পাশেই একটা ক‍্যাফে আছে। আমারও ব্রেক,আমিও খাবো।"
             অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় মনটা ছুঁয়ে যায়,কতদিন কেউ বলেনি কিছু খাবে নাকি। এ যেন এক অন‍্যরকম আনন্দের আস্বাদ তার নিরানন্দ জীবনে। খাবারের অর্ডার দিয়ে হঠাৎই মিলি জিজ্ঞেস করলো," তুমি ফেসবুক করোনা কেনো দাদু?" হাসেন অনিরুদ্ধ," এই বয়সে ঐসব আর মাথায় ঢোকেনা দিদি। আমাকে কে শেখাবে ওগুলো? এই বুড়োটার খোঁজ নেবার আর কে বা আছে রে সোনা? ল‍্যান্ডফোনেই চলে যায় আমার। তবুও আছে একটা ভ্রাম‍্যমান ফোন।" বোতামটেপা মোবাইলটা পকেট থেকে বার করেন। একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করেন," সেকি আসে? মানে দিদিভাই,আমার অনন‍্যা?"
...."আ্যনা আসেনি,আঙ্কেল এসেছিলো একবার। আ্যনাও ভালো জব করছে ওখানে।"
....নিশ্বাস ফেলেন,স্বস্তি হয় যাক ভালো আছে মেয়েটা। তবে নিশ্চয় এতোদিনে দাদুকে ভুলে গেছে। ওদেশের ছেলেমেয়েরা তো একসময় বাবা মায়ের সাথেই থাকেনা। আর বিদেশে থাকা দাদু কি আছে তার স্মৃতিতে,তাহলে নিশ্চয় যোগাযোগ করতো।
        অনিরুদ্ধর অনেক না বলা কথা মিলির মনকে ছুঁয়ে যায়। "দাদু আ্যনাকে দেখবে? ও ফেসবুকে আছে।"
      সারা শরীরটা উত্তেজনায় কেমন যেন অস্থির করে। ফেসবুকের আ্যকাউন্টটা খুলে মিলি দেখায় কত ছবি,চোখ যেন আর সরতেই চায়না অনিরুদ্ধর দুচোখ ভরে দেখেন রাজন‍্যার প্রতিচ্ছবিকে। সত‍্যি একদম রানী, মেয়েকে আদর করে এই নামেই ডাকতেন। শুধু চুলগুলো ঝাঁকড়া আর লালচে।" আমায় একটা ছবি দিবি দিদি? আমি রাখবো আমার কাছে। দিদিভাই তো আমাকে ভুলেই গেছে।"
      ..." তোমাকে ওর মনে আছে দাদু, মনখারাপ কোরোনা। ঐজন‍্যই তো তোমায় জিজ্ঞেস করলাম তুমি ফেসবুক করোনা কেনো? আজকাল সবাইকে ওখানেই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরাই তো জানতাম না তুমি কোথায়। তাই তো বাবাকে পাঠিয়েছিলাম খোঁজ নিতে পুরোনো বাড়িতে।ইশ্ তোমার একটা স্মার্টফোন থাকলে আমি সব করে দিতাম। এক্ষুণি হোয়াপে ছবিগুলো পাঠিয়ে দিতাম। আচ্ছা আমি একদিন অফিস ফেরত তোমায় দিয়ে যাবো।"
        সত‍্যি কি ভালো মেয়েটা! আর ভগবানও বোধহয় এতোদিন বাদে এক খেলা খেললেন। খুব ইচ্ছে করছিলো একটা বড় ফোন কিনতে কিন্তু নিজের ওপর ভরসা হোলনা হয়ত চালাতে পারবেননা। তাছাড়া মায়া বাড়িয়ে কি লাভ আবার নতুন করে?
               মিলির দেওয়া ছবিগুলো ডিভানের ওপর ছড়ানো থাকে। বর্তমানে ডুব দেন অনিরুদ্ধ অতীত ছেড়ে। মাসচারেক বাদে হঠাৎ মিলি আসে সন্ধ‍্যেবেলায়,ফোন করেছিলো আসবে বলে," দাদু আগে কিছু খেতে দাও তারপর বলবো।ও আসবে জেনে নিজেই খাবার এনে রেখেছিলেন। কতদিন এমন আবদার কেউ করেনি।..." ইশ্ কি খিদে পেয়েছিলো! তোমার জন‍্য গ্ৰান্ড গুড নিউজ,আ্যনা আসছে নেক্সট মাসে।"
       বুকটা চেপে ধরে যেন নিজেকে সামলান অনিরুদ্ধ,একরাশ আনন্দ এসে ঢোকে ঘুঁণধরা জীবনে। ঢোক গিলে বলেন," আমায় একবার নিয়ে যাবি?"
.....একঝলক দুষ্টু হেসে মিলি বলে," আগে বলো কি দেবে আমায়?"
         হাসেন অনিরুদ্ধ," সব দেবো যা চাইবি।"
           ক‍্যালেন্ডারের পাতাগুলো যেন শেষ হতে চায়না। তবুও ভয় হয় বিদেশে বড় হওয়া নাতনি এতো বছর বাদে এসে তাকে আর কতটা বুঝবে? হয়তো দেখা হয়ে আরো দূর্বল হয়ে যাবেন তিনি। হঠাৎ মেয়েটা আসছেই বা কেনো? মিলি তো কিছুই বললোনা। মনটা বড় চঞ্চল হয়ে যায় তবুও ভাবলেন একবার চোখে দেখতে তো পাবেন। নাইবা ভালোবাসলো দাদুকে, ওটাই হয়ত মৃত‍্যুর আগে অনেক বড় প্রাপ্তি।
             অপেক্ষার দিন প্রায় শেষ, কাল আসার কথা দিদিভাইয়ের মিলি তো তেমনই বলেছে। অনিরুদ্ধর আর মন টেকেনা ঘরে,বার বারই দরজা খুলে দেখেন কেউ এলো নাকি, আসলে আজকাল কানেও কম শোনেন। মিলিকে একবার ফোন করলেন নট রিচেবল এলো। অগত‍্যা রাস্তায় বেড়িয়ে এলেন, সত‍্যিই তো এতো দেরী করছে কেন? বলেছিলো তো এইসময় আসবে। এমনই অস্থিরতা করতেন রানীর জন‍্য,বকুনি খেতেন কমলার কাছে।
               এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বড্ড আনমনা হয়ে গিয়েছিলেন,হঠাৎই চমকে ওঠেন, হয়ত সারা শরীরে মনে ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি। ডাডু.... দুই হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে অনন‍্যা। চিনতে ভুল হয়নি তার,দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝরছে অনিরুদ্ধর। শুনেছেন আসলের চেয়ে সুদ দামী,সত‍্যিই কি এতো মিষ্টি হয় নাতি নাতনীর আদর! কতদিন পাননি। " হোয়ার আর ইউ ডাডু, তোমাকে মিস করেছি কতো, সার্চিং ইউ।"
        কি সুন্দর ভাঙা ভাঙা বাঙলা বলছে মেয়েটা এতো বছর বাদেও,মনটা জুড়িয়ে যায়। এতো ভালো কি করে হলো মেয়েটা! ওর আন্তরিকতায় আজ অনিরুদ্ধর মনে হয় এতোগুলো বিচ্ছেদের দিন হয়ত মাঝখানে ছিলোই না। একদম মনের কাছাকাছি আছে মেয়েটা ঠিক আগের মতো, সেই ছোটবেলার মতো।
                রাস্তার ছেলেটার কথাগুলো আজ কোন প্রভাব ফেলেনা তার মনে। কোনো উত্তর দিতেও ইচ্ছে করেনা আজ। সব কথার উত্তর না দেওয়াই ভালো।একটু দূর থেকে সবটা দেখছিলো মিলি,ছেলেগুলোর কথা শুনে খুব রাগ হচ্ছিলো।তবুও কিছু বলতে পারেনা। দাদুর আদর পাবার ইচ্ছেতে এগিয়ে আসে মিলি," দাদু আমায় ভুলে গেলে? এবার অনিরুদ্ধই জড়িয়ে ধরেন পরম অবলম্বনে এযুগের দুই নবীনাকে। এক নতুন বন্ধনে বাধা পড়লেন আবার তিনি অনেকদিন পরে।
      অনিরুদ্ধর ছোট্ট ফ্ল্যাটের বাইরে আজ অনেকগুলো চটি রাখা,ভেতর থেকে আসছে হাসি গল্পের আওয়াজ। মাঝে মাঝে তারও গলার আওয়াজ আর হাসি শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। তবে সবাইকে ছাপিয়ে পাহাড়ী ঝর্ণার মত কলকল করছে তার দুই নাতনি। আর তাদের সাথে যোগ দিয়েছে আরেকজন ইয়ং চ‍্যাম্প। আজ এই নবীনরাই বোধহয় অনিরুদ্ধর মত আধমরাকে বাঁচাবে। খুব মনে পড়ে যায় কবিগুরুর কবিতা,' ওরে নবীন,ওরে আমার কাঁচা... ওরে সবুজ ওরে অবুঝ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।' খুব মনে ধরেছে ইয়ং চ‍্যাম্পকে আ্যনার দাদু অনিরুদ্ধর। ভাবতেই পারছেননা শেষে সম্পর্ক আর শিকড় খুঁজতে মেয়েটা বাঙালী ছেলের প্রেমেই পড়লো। ছেলেটা ওদেশেই দিদিভাইয়ের অফিসে কাজ করে তবে বাড়ি এখানে। মা বাবা সবাই এখানে থাকেন। মজা করে দাদু নাতনিকে বললেন," মিলিদিদির সাথে না দেখা হলে আমায় কি করে পেতিস শুনি?"...." বাই হার্ট যা চাওয়া যায় পাওয়া যায়। আমি ডিটেক্টিভ ধরতাম,তোমার পুরোনো বাড়িতে এগেন যেতাম। না হলে তোমার নাতনি তো আমায় বিয়েই করতো না।"....ও বাবা! একজনকে প্রশ্ন করলেন আর উত্তর দিচ্ছে আরেকজন। সত‍্যি খুব ভালো লেগেছে ছেলেটিকে ওনার নামটাও বেশ মিষ্টি সৌমিত্র, অদ্ভুত নষ্টালজিয়া আছে অনিরুদ্ধর এই নামটায়। কমলা আর রানীর কথা বড় মনে পড়ছে আজ। আজ থাকলে ছেলে মেয়েগুলোকে কত যত্ন করে খাওয়াতো,কত খুশি হোত। মনটা বড় ছুঁয়ে যায় ছেলেমেয়েগুলোর ভালোবাসায়। না না সত‍্যিই কিছু হারায়নি সব ঠিক আছে,নতুন যুগের দিশারীদের বন্ধুত্বে আপ্লুত হলেন অনিরুদ্ধ। ঘরে ঘরে থাক এমন নাতি নাতনি। এর মধ‍্যেই এলেন সৌমিত্রর বাবা মাও, ওরাই বলে গেলেন অনিরুদ্ধকেই সম্প্রদান করতে হবে অনন‍্যার বড় শখ।
              অনিরুদ্ধর বড় ব‍্যস্ততা,অনন‍্যার যে বিয়ে। অনেকগুলো গয়না অবহেলায় পরেছিলো দুই নাতনিকে দিয়ে দিলেন, মিলিও যে ওনার হৃদয়ের টুকরো। কেনাকাটা যোগাড় যন্ত্র সব ওরাই করছে। শুধু মাঝে মাঝে মেয়েটা বলে ডাডু সব ওকে তো? ".....এই ডাডু না দাদু"। "নো ডাডু ইজ সুইট"..  বিয়েতে আ্যনির বাবাও এলো। অনিরুদ্ধর নিঃশব্দ জীবনে আরেকবার বাজলো সানাইয়ের মিষ্টি সুর, বেলাশেষে একটুকরো খুশির ঝলক ছড়িয়ে দিলো অনিরুদ্ধর একলা মনে প্রবাসে বড় হওয়া অনন‍্যা।  সম্পর্কগুলো সংস্কার আর ভালোবাসার মিশেলে এভাবেই একটু মিষ্টি ছোঁয়া দিয়ে যাক জীবনে। ভালো থাক নবীন আর প্রবীণ মিষ্টি সম্পর্কের মেলবন্ধনে।
   "সৌমিত্রদা আমার পাওনাটা দাও" তোমার কত কাজ কমিয়ে দিয়েছি আমি,দাদুর নাম আর দাদুকে দেখেই চিনেছিলাম আসলে আমার তো দাদু ছিলোনা তাই দাদুর আদরগুলো ভুলতে পারিনি। ..." সুন্দরী শালীজি তোমার হনিমুনের সব দায়িত্ব আমি নিলাম,সবাই মিলে এনজয় করবো প‍্যারিসে, দাদুও থাকবে সাথে।"
      "আমি কি পারবো অত দূরে যেতে?" চিন্তিত হন অনিরুদ্ধ। সৌমিত্র আর মিলির খুনশুটি দেখছিলো অনন‍্যা মনে মনে ভাবছিলো এত সুইট রিলেশনগুলো শুধু বোধহয় এদেশেই হয়, আর এনজয় করছিলো।
...." ইউ ক‍্যান ডাডু....উই লাভ ইউ আ লট।"
স্বপ্ন দেখা বোধহয় শেষ হয়না কোনোদিন,তাই অনিরুদ্ধও স্বপ্ন দেখলেন এযুগের নবীন প্রজন্মের হাত ধরে ভালো থাকার স্বপ্ন।
  সমাপ্ত:-
           
          
  
       

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...