Skip to main content

আত্মজ

বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে সকাল বেলা রোজকার  মতো আজও খবরের কাগজে  চোখ রাখেন  হরনাথ | একটা ছোট খবরে চোখ আটকে যায় , গ্রাম থেকে বৃদ্ধা মা কে শহরে চিকিৎসা করাতে নিয়ে এসে মেট্রো তে বসিয়ে রেখে মাঝপথে নেমে যায় ছেলে,বৃদ্ধা মা অসহায় অবস্থায় রেল পুলিশের হেপাজতে আছে ।সত্যি কি বৃদ্ধ মা বাবা আজ সন্তানের বোঝা ?


ঝাপসা চোখে চেয়ে থাকেন সামনের শিউলি গাছটার দিকে,গৌরীর বড় প্রিয় ছিল শিউলি  ফুল।ভোরবেলা  উঠে সাজি ভরে ফুল  কুড়িয়ে ঠাকুরঘরের বারান্দায় রাখতো।লাল পাড় শাড়ি আর সিঁদুরের টিপ পরে গৌরী যখন এক ঢাল কোঁকড়া  চুল ছেড়ে চন্ডীপাঠ করত দেবীপক্ষে হরনাথ মুগ্ধ হতেন। 
              
তবে গৌরী কার ওপর অভিমান করে চলে গেলো ? এর উত্তর গৌরী আর কোনদিন দেবে না | ছেলের অবহেলা পেলেও হরনাথ তো কোনদিন অবহেলা করেননি গৌরী কে ,বরং তাকে সবাই  স্ত্রৈণ ভাবতো । তাতেও কোন সংকোচ  ছিল না হরনাথের।
নিজে সারাদিন বাজার টুকু করে দেওয়া  ছাড়া অফিস সামলে সংসারে বিশেষ করতে পারতেন না।কত টুকুই বা মাইনে পেতেন তখন ? 
   গৌরী তার মধ্যেই  যে কি করে সব চালিয়ে নিতো  অবাক  হতেন হরনাথ ।অন্য আর পাঁচ টা বৌ এর মতো কোনো চাহিদাই তার ছিল না । গৌরী র একমাত্র ধ্যান জ্ঞান  ছিল বাবু , হরনাথ আর গৌরীর একমাত্র সন্তান। সারাটা  দিন মা আর ছেলের একসাথে কাটতো , বাবুকে  স্কুলে নিয়ে যাওয়া , স্কুল থেকে আনা পড়তে বসানো সব কিছু গৌরী একাই সামলাতো 
  মা ছেলের জগতের  মধ্যে হরনাথ ঢুকতেন  না। মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে গৌরীকে বলতেন এই অভাগাটাকে একটু দেখো। গৌরী হাসতে হাসতে বলতেন কি হিংসুটে  বাপু, ও কি একা আমার  ছেলে ? তোমার নয় বুঝি ?
   নিজেকে গর্বিত মনে করতেন হরনাথ সত্যি গৌরীর পরিশ্রম আর যত্নে বাবু আজ একজন কৃতী ছাত্র , ইউনিভার্সিটি তে প্রথম হয়েছে বাবু । সাথে সাথে পেয়েছে  গবেষণার  সুযোগ। ছেলের  দিকে তাকিয়ে আনন্দে বুক  ভরে যায় গৌরীর এ যেন তার  সেরা অলঙ্কার।
           গবেষণা  করার পর একটু একটু করে যেন গৌরীর চেনা আত্মজ পাল্টাতে থাকে , হরনাথ লক্ষ না করলে গৌরীর চোখে কিছুই এড়ায় না।আজকাল আর বাবু মায়ের কোল ঘেঁষে গল্প করেনা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে যায় গৌরী বাবুর ফিরতে যে কত রাত হয়ে যায় । গৌরী বুঝতে পারে বাবুর সাজানো মিথ্যেগুলো । তবুও বিশ্বাস হারাতে চায়না ।সন্তান যে বড় আপন তাকে অবিশ্বাস করলে তো কাউকেই আর কোনোদিন বিশ্বাস করতে পারবে না।


  রাতে হরনাথের কাছে কেঁদে ফেলে গৌরী, বাবু কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে গো । হরনাথ বলেন নিজের জগৎ করো গৌরী , বাবুকে নিয়ে আর ভেবোনা ও বড় হয়েছে। এখনো নিজেকে সামলাও নাহলে পরে কষ্ট পাবে।
      বাবু গবেষণা শেষ করে কলেজের  অধ্যাপকের চাকরি পেয়ে যায়।গৌরী আর হরনাথের খুশির  সীমা থাকে না ।ছেলেকে নিয়ে বৌমা নিয়ে নিশ্চিন্ত সংসার হবে তাদের।


   হঠাৎ বাবু বলে ওর এক সহপাঠিনীকে ও ভালোবাসে বিয়ে করতে চায়।আপত্তি করেনি গৌরী খুশি হয়েছিল । ধূমধাম করে বিয়ে দিয়েছিলো বাবুর , ভেবেছিলো মেয়ে হয়ে এলো বৌমা । কিন্তু হরনাথ আর গৌরীর অন্ধ স্নেহ বাবুর প্রতি মালবিকার মনে হয়েছিল বাড়াবাড়ি।
   
মালবিকার কেন যেন মনে হয়েছিল গৌরী তার আর বাবুর ভালোবাসা মধ্যে ভাগ বসাচ্ছে।ছেলেকে যেন আর কাছে পাননা গৌরী তবুও মনে হয় ওরা সুখী থাক। নাইবা পেলেন বাবুকে কাছে তবু চোখের সামনে দেখতে তো পান তাতেই শান্তি ।
      কিন্তু সে সুখও কপালে সইলোনা গৌরীর।মালবিকা ভেতরে ভেতরে বিদেশে যাবার চেষ্টা করছিলো ওর জামাইবাবু ওখানে থাকে।বাবু কে রাজী করিয়েছিল। সব ব্যবস্থা পাকা করে কলেজে রেজিগনেশন দিয়ে যাবার একসপ্তাহ আগে বাড়িতে জানিয়েছিল বাবু।ওরা সামনের সপ্তাহে আমেরিকা চলে যাচ্ছে।
     কান্নায় ভেঙে পড়েছিলো গৌরী শুধু বলেছিলো , বাবু আমাকে আর তোর বাবাকে কার কাছে রেখে গেলি বাবা ? কোনো উত্তর দেয় নি বাবু । হরনাথ গৌরীকে ভেজা গলায় বলেছিলেন,' আমি তো থাকলাম , ওদের যেতে দাও|' 
   দীর্ঘ পাঁচ বছর বাবু দেশে আসেনি,কথা হত শুধু  টেলিফোনে, কোন অভিযোগ করেনি গৌরী।শুধু হরনাথ কে নিয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াত শান্তির জন্য কিন্তু শান্তি সে পায়নি | 
   ঠিকমত খাওয়া  দাওয়া করত না গৌরী, ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাকুরঘরে  কেটে যেত হরনাথ বুঝিয়ে পারতেননা ।যেদিন জানতে পারেন তার অধ্যাপক ছেলে বিদেশে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীতে চাকরী নিয়েছে সেদিন নিজেকে স্থির রাখতে পারেন নি । এই কি তাদের অলংকার ?


     অনিয়মে ভেঙ্গে পড়ে গৌরীর শরীর।এর মাঝে ঠাম্মি হয়েছে গৌরী । নাতনি কে নিয়ে প্রায় সাত বছর পর দেশে পনের দিনের ছুটিতে আসে বাবু। মালবিকা এবার শুধু গৌরীর সাথে চোখের দেখা করে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়।
     আকুল  হয়ে পড়ে গৌরী নাতনি কে একটু কাছে পাবার জন্য।হরনাথ বোঝান বাবু তো আছে তোমার কাছে গৌরী।এই জন্য বলেছিলাম নিজেকে ভালোবাসো গৌরী , জীবন কে উপভোগ করো কিছুই করলেনা।
     বাবু ফেরার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন গৌরী, কিছুই খেতে পারেন না ,পেট ভার শ্বাসকষ্ট, পঁচাত্তর বছর বয়েসের বৃদ্ধ হরনাথকেই ছুটোছুটি করতে হয় নার্সিং হোম থেকে বাড়ী, ডাক্তার বলেন লিভার ক্যান্সার পেটে জল জমছে। হাল তখনও ছাড়েননি হরনাথ, তিনি যে গৌরীকে কথা দিয়েছেন বিপদে সম্পদে পাশে থাকবেন ।


  গৌরী বছরে দুই তিন বার নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয় গৌরীকে। গৌরী র অসুস্থতার পর হরনাথের ভাইপোবৌ লিলি প্রায় অফিস ফেরত আসে গৌরী র কাছে। লিলিকে দেখে মুগ্ধ হয় গৌরী কি সুন্দর আধুনিকা লিলি , দুই সন্তান অফিস ,সংসার সব কিছু সামলেও  নিজের জগৎ আর শখ কোনো কিছুকেই অবহেলা করেনি সে।
    অথচ গৌরী কোনোদিন নিজেকে চেনার চেষ্টাই করেনি।শুধু মন দিয়ে সংসার আর সন্তানকে তৈরি করেছে । স্মার্টফোনে বাবুর সাথে কথা বলেন গৌরী ভিডিও কলে।এই ফোন চালাতেও গৌরী ভয় পায় কিছুই মাথায় থাকে না। 
     ভিডিও কলে বাবুর আমেরিকার বাড়ি দেখে গৌরী  ভাবেন সত্যি এতো স্বর্গ রাজ্য !কি সুন্দর পরিবেশ  এসব ছেড়ে ওরা এখানে আসবে কেন ? নীরবে ভগবান কে বলেন ,ওদের ভালো রেখো।
        গৌরীকে এখন ঘন ঘন নার্সিং হোমে দিতে হয়, বৃদ্ধ হরনাথ সব সামলান একা।গৌরীর চোখে জল গড়িয়ে পড়ে,কি কষ্ট মানুষটার ! এতো টাকা কোথা থেকে জোগাড় করছে কে জানে ? গৌরীর বড়ো দেখতে ইচ্ছে করে বাবু , বৌমা , দিদিভাইকে।কিন্তু অভিমানে মুখ  ফুটে বলতে পারেনা।
    লিলি মেসেজে আর মেল করে বাবুকে আসতে বলে , কিন্তু বাবু জানায় আরো মাস ছয় লাগবে আসতে।
      হরনাথের আজ বড় মনে পড়ে সেই রাতের কথা। আগের দিন সবে নার্সিং হোম থেকে ফিরেছে গৌরী ,একটু ভালো সে।হরনাথকে বাড়ী এসে গৌরী বলে কি চেহারা করেছো? তোমাকে ছাড়া যে আমি বড় অসহায় ।হরনাথ হেসে বলে তোমায় ছেড়ে আমি যাবো না গো।
     সেদিন রাতে গৌরী বড় খুশি আজ লিলি বড় ট্যাব এনেছিলো তাতে আজ মন ভরে সবার সাথে গল্প করেছে।দিদিভাই কি যে মিষ্টি হয়েছে ! 
    রাতে হরনাথ কে বলেন আয়া তো আছে , তোমার ও অনেকদিন বিশ্রাম হয় না আমি আজ একটু শান্তিতে ঘুমোই খুব ভালো লাগছে আজ। তুমি আজ পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়।


        সেই ঘুম আর ভাঙ্গেনি গৌরীর , কোথা থেকে যে এতগুলো ঘুমের ওষুধ পেয়েছিল গৌরী হরনাথ আজও ভাবেন । তবে কি তার ওষুধের বাক্স থেকে , না অন্য কোন ভাবে ?
         মুক্তি দিয়ে গিয়েছিল এভাবেই গৌরী তাকে।কিন্তু তিনি তো কোনোদিন গৌরীকে বোঝা ভাবেননি তবে কেন এভাবে ইচ্ছামৃত্যু বেছে নিলো গৌরী? সন্তানের প্রতি অভিমান করে নাকি হরনাথকে ধনে প্রাণে বাঁচানোর জন্য?
    বাকি জীবন টা হয়তো শুধু উত্তর খুঁজেই কেটে যাবে তার।যে গেছে সে তো আর ফিরবেনা , যারা আছে তাদের তুমি ভালো রেখো।ভালো থাক, সুখে  থাক আমার আত্মজ।

সমাপ্ত:-


Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...