#পরিবার#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"আচ্ছা এই ড্রেসটা আমি নেবো? দেখোনা একটু..আর এটা..এটা কেমন? তার সাথে এই জুয়েলারীটা এটা নিয়ে নি?"...নাও না,যেটা যেটা ভালো লাগে ,সবসময় আমাকে জিজ্ঞেস করো কেন? কার্ড তো তোমাকে দেওয়াই আছে তাই না?"
..." সত্যি তুমি যে কেমন হয়ে গেছো না আমায় একটুও আ্যটেনশন দাওনা এখন। অথচ একটা সময় নিজেই কত কি কিনে আমায় গিফ্ট করতে"।
...বকবক করে যায় মিম,হাই তোলে রাজ.." কি আবার দিলাম বিয়ের আগে,কে জানে ঐ তো একসাথে শপিং মলে গিয়েই কেনা হত সবটা। আর দু একটা যা দিয়েছি তা তো মাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কেনা। মায়ের পছন্দ খুব ভালো ছিলো।"
...ওহ্ আবার সেই পুরোনো কথা। দেশ ছেড়ে এত দূরে এসেও শান্তি নেই। কোথায় নিজেদের মত এ দেশে একটু এনজয় করবে তার উপায় নেই,সামনেই সামার চারিদিকে সবাই বেশ একটা ভালো মুডে আছে এখন কিছুদিন একটু আনন্দ করে ড্রেসগুলো পরা যাবে। অথচ রাজ যে কেন সবসময় এত ডিপ্রেসড হয়ে থাকে আজকাল ওর মা চলে যাবার পর থেকে। খারাপ লাগে মিমেরও এবার দেশে গিয়ে একটুও ভালো লাগেনি। যদিও একটা সময় ও দেশে গিয়ে ও শ্বশুরবাড়িতে থাকতোই না,দেখা করেই চলে যেত নিজের বাবা মায়ের কাছে আর রাজও বেশিরভাগ সময়ই ওর সাথেই থাকতো কারণ তখন ছেলেটা ছোট। একা সামলাতে পারতোনা। এই নিয়ে কখনো অভিযোগ করেননি মমতা আর প্রবীর। আসলে সব অভিযোগ বোধহয় মুখে করা যায়না বা অনেকে করতে চাননা।
আজ রাজের বড় মনে হয় মায়ের কথা,ছয় মাস হয়ে গেলো মা চলে গেছে। অবশ্য তাতে তেমন আর কি ফারাক হয়েছে আগেও ব্যস্ত থাকতো এখনো তাই আছে বরং কথা বলার লোক কমে গেছে। বাবা এমনিতেই কম কথা বলতো এখন আরো কম বলে। বরং মিমের একটু অসুবিধে হয়েছে, সেবার দেশে গিয়ে সৌজন্যের খাতিরে শ্বশুর বাড়িতে বেশি থাকতে হয়েছে। শ্বশুর মশাই একা হয়ে গেছেন তাই সঙ্গ দেবার ব্যাপার একটা ছিলোই। চলে আসার সময় বাবা বলেছিলেন," এবার বেশ টানা অনেকদিন থাকলি,ইশ্ মমতা থাকলে কত খুশি হত!"
"কি হলো রাজ? আবার তুমি মন খারাপ করছো? আমারও খারাপ লাগে বাট কি করার আছে,এত দূর থেকে তো আর কিছুই করার থাকেনা তাইনা"...." আসলে মা বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে,ছোটবেলায় আমি খুব ভুগতাম। এখন মনে হয় খুব কম সময় ওদের দিয়েছি। ওদের আর কি চাহিদা বলো? হয়ত আমাদেরই একটু পাশে চেয়েছিলেন। বাবা এখনো নিজেই বাজার করে খায়,কিছুই করার নেই। কে আর সাহায্য করবে? ঐ অত বড় বাড়িটাতে একা থাকে।"....." আমরা তো বলেছিলাম এখানে কিছুদিন থেকে যেতে তাও তো মানলেন না। আচ্ছা একটা কথা বলবো,আগে বলো তুমি রাগ করবেনা। প্রমিস..."
চোখ বুজেই রাজ বলে,প্রমিস। আয়নার সামনে কানের দুলটা খুলতে খুলতে বলে আচ্ছা আমরা যদি বাবার বিয়ে দিয়ে দি।" ওর কথা শুনে বিছানার ওপর উঠে বসে রাজ," মানে তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে নাকি? কি বলছো এসব,এই বয়সে বাবা আবার বিয়ে করবে? আমার মা হয়ে একজন এসে বসবে আমাদের বাড়িতে? জাষ্ট ডিসগাস্টিং।"...রাজের একদম গায়ের কাছে এসে বসে মিম," আচ্ছা বাবাকে নিয়ে তো আমাদের টেনশন তো কমবে। আমি বুঝতে পারি মা চলে যাওয়ার পর তুমি খুব চিন্তা করো। তাই বাবাকে দেখার জন্য যদি কাউকে আনি তাহলে আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো।"
হঠাৎই খুব রেগে যায় রাজ," আচ্ছা এইসব বোগাস আইডিয়া কোথা থেকে পাও বলতো? ছেলে হয়ে বাবার দায়িত্ব নিতে পারছিনা বলে তাকে জোর জুলুম করে একটা বিয়ে দিয়ে দাও। মানে তুমি এনজয় করো বাবা,আর আমরাও এদেশে বিন্দাস থাকি আর ঘুরে বেড়াই। আর যাকে আনবো সেও যদি মারা যায় হঠাৎ তখন?"
চুপ করে যায় মিম বুঝতে পারে রাজ খুব রেগে আছে। থাক পরে বরং বুঝিয়ে বলবে। একটা ছেলের বৌ হওয়া এই এক জ্বালা একসময় শাশুড়ি মা বাবু বাবু করে অস্থির হত। এইদেশে আসার সময়ও একগাদা খাবার দাবার বানিয়ে দিত,অনেক সময়ই কায়দা করে মিম বাপের বাড়ি কিছুটা রেখে আসত। তখন কেন যেন ওগুলো বাড়াবাড়ি মনে হত। এখন উনি চলে গেছেন,তাতেও আরেক চিন্তা। আর ভালো লাগেনা, অথচ রাজের বন্ধুরা সবাই কি সুন্দর এদেশে এসে বিন্দাস আছে ফ্যামেলি নিয়ে।
একটু একটু করে রাজকে বোঝাচ্ছিলো মিম। ওর বন্ধুরাও মিমের হয়েই কথা বলছিলো। " তুমি যদি বলো আমি ম্যাট্রিমনি সাইটে দেখতে পারি। কি দেখবো?"...মনটা তেতো লাগলেও কিছু বলেনা রাজ,বাবাকে ফোনে কিছু বলার সাহসও পায়না। যাক পুজোর সময় গিয়ে বলবে নাহয়।
দেখতে দেখতে ওদের দেশে যাবার সময় এসে যায়,মিম এর মধ্যে অনেকগুলো দেখেছে,কিছু ফোননম্বর রেখেছে। একটা,দুটো জায়গায় কথাও বলেছে। ওর তো দুজন মহিলাকে বেশ লেগেছে।
পুজোর কয়েকদিন বাদে একটু অবকাশ পেয়ে বাবাকে বলে কথাটা রাজ সাথে মিমও থাকে। বলতে বলতে মায়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে চোখটা একটু ছলছল করে ওঠে রাজের। সবটা শোনেন মাথা নীচু করে প্রবীর কিছু বলেননা। নীরবতা ভাঙে মিম," বাবা,তাহলে আমি এর মধ্যে যোগাযোগ করবো? আপনি কথা বলে দেখতে পারেন।".....বৌমাকে কিছু না বলে সরাসরি ছেলের দিকে তাকান প্রবীর," তুমি বড় হয়েছো,স্বাবলম্বী হয়েছো। পছন্দ মত পাত্রীকে বিয়ে করতে চেয়েছো। আমরা খুশি হয়ে মেনে নিয়েছি। এদেশে থাকতে চাওনি বিদেশের হাতছানি তোমাদের মুগ্ধ করেছে ওখানে চলে গেছো,ওখানেই আছো বা থাকবে। তাতেও আমরা বাধা দিইনি,আমাদের কোন প্রয়োজনেই তোমাদের বিরক্ত করিনি। এখানে যখন এসেছো খুব কম সময়ই পেয়েছি তোমাদের। আমাদের জীবনের গোল্ডেন পিরিয়ড তোমাদের দিয়েও কখনো প্রত্যাশা করিনি কিছুই। হঠাৎ আমার ওল্ডএজ নিয়ে এত মাথাব্যাথা কেন তোমাদের? নিছক দেখানো চিন্তা না দায়িত্ব এড়ানো?"
বাবার এমন গুরুগম্ভীর রূপ অনেকদিন দেখেনি রাজ। তাই আর বেশি কিছু বলার সাহস পেলোনা। প্রবীরই বললেন," বৌমা চিন্তা কোরনা,আমি ঠিক থাকবো আমার জীবনে। তোমরা ভালো থেকো,সুখে থেকো আমার দাদুভাইকে নিয়ে।"
ঘরে এসে গজগজ করে মিম,তবে কেন যেন বুক থেকে একটা ভার নেমে গেলো রাজের। তবে বাবার খারাপ লেগেছে এই ভেবে খারাপ লাগলো,শুধু শুধু কতগুলো অপ্রিয় সত্যি শুনতে হলো।
ওরা চলে যাবার আগে বাবাকে বললো রাজ," তোমার যদি এত বড় বাড়িতে একা থাকতে অসুবিধে হয় তাহলে আমাদের ফ্ল্যাটে গিয়েও থাকতে পারো।"..." তোমরা সাবধানে যেয়ো,অত চিন্তা কোরোনা। দরকার হলে তোমায় জানাবো।"
ওদেশে ফিরে গিয়ে আবার রাজ ব্যস্ত হয়ে গেলো। মিমও ওর বন্ধুবান্ধব পার্টি,ছেলে,সংসার সব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিত্য নতুন ড্রেস, সেল্ফি সবই চলতে লাগলো আগের মত। রাজের সাথে বাবার কথা হয় প্রতিদিনই প্রায়। মা মারা যাবার শোকটা কিছুটা স্তিমিত,বাবাও বলেন ভালো আছেন। তাই জীবন চলতে শুরু করলো সবারই আপন ছন্দে।
হঠাৎই পরের বছর আবার দেশে যেতে হলো রাজকে ওদের ফ্ল্যাটের একটা প্রয়োজনে,মিমও বায়না ধরলো যাবে বলে। বাবাকে ফোন করলো রাজ কিন্তু অদ্ভুত এক উদাসীনতা লক্ষ্য করলো যেন বাবার গলায়। প্রবীরবাবু বললেন," ও সবাই আসছো,তাহলে এবার তুমি ফ্ল্যাটেই উঠো প্রথমে কারণ এখানে তোমাদের অসুবিধে হবে। পরে এসে দেখা করে যেয়ো।"..কেন এমন বললেন বাবা ভেবে পেলোনা রাজ,অথচ একসময় ওদের আসার খবরে বাড়িতে উৎসবের মহল তৈরি হয়ে যেত। অনেক সময় তো বাবা বাড়ি রঙ করে ফেলতেন,পাল্টানো হত পর্দা আর অন্যন্য অনেক কিছু।
ওরা বাবার কথা মত ফ্ল্যাটেই ওঠে,পরে যখন ওদের বাড়িতে যায় বাড়িটাকে ঠিক চিনতে পারেনা। ওদের বাড়িটা তো এত বড় ছিলোনা,তবে সামনে অনেকটা জায়গা ছিলো। একি পাশের বাড়ির ময়না কাকিমার বাড়ি ওপাশের পাল কাকুর বাড়ি আর ভট্টাচার্য কাকুর বাড়িটা সব যেন মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। বেশ চট করে একবাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যাবার পথ। বাগানে অনেক শাক সব্জির গাছ,আর উঠোনে বেশ জমাটি আড্ডা। ঐ তো ওর মধ্যে বাবাও বসে আছে,বেশ হাসিখুশি লাগছে বাবাকে," এসো,এসো।"..একটু অস্বস্তিতে পড়ে রাজ আর মিম অনেকগুলো অপরিচিত মুখকে দেখে।
বাবা যা বললেন তা শুনে রাজ যেন আজ নতুন করে নিজের ভবিষ্যত দেখতে পেলো বাবার কথার মাঝে। " আসলে আমাদের পাড়াটাতে আর কোন ছেলেপুলে নেই। এই দেখো পরপর সব বাড়িতেই ছেলেমেয়েরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের খোঁজে হয় মুম্বই বেঙ্গালুরু বা লন্ডন,আমেরিকা,দুবাই অষ্ট্রেলিয়াতে। একসময় ছেলে বিদেশে আছে বলে বেশ আত্মপ্রত্যয় লাভ করতাম কিন্তু সেটাই এখন একাকীত্বের কারণ। যৌথ পরিবারগুলো আমরা নিজেরাই ভেঙেছি টুকরো টুকরো করে। সবার হাতে এখন আমাদের অগাধ টাকা কিন্তু একাকীত্বই হচ্ছে একমাত্র অসুখ। সবই আছে অথচ অনেকেই আমরা ভীষণ নিঃসঙ্গ,অনেকেরই কথা বলার মতও বাড়িতে কেউ নেই ঐ টিভি বা গানই ভরসা। কারণ আমরা অনেকেই তেমন মোবাইল নেট ঘাঁটতে অভ্যস্ত নই। আগে ঠাকুমা ঠাকুরদাদের দেখেছি পাড়া প্রতিবেশীদের সাথে আড্ডা,নাতি নাতনি সামলানো বা অবসর সময়ে রামায়ণ মহাভারত পড়েই সময় কাটাতেন।
সে অভ্যেসও আমাদের তেমন নেই,তাই এ এক অদ্ভুত শেষবেলা আমাদের। নাতি নাতনির আদর নেই,ছেলে বৌমা বা মেয়ে জামাইয়ের বাবা বাবা ডাক নেই আবার সেল্ফি বা শপিংমলেও আমাদের মন নেই। মন ফিরে যেতে চায় এই সময় বড় ছেলেবেলায়। মনে পড়ে যায় মায়ের হাতের পায়েশ,আর ঠাকুমার হাতের নাড়ু মোয়ার কথা।
কিন্তু সে সব তো কবেই অতীত হয়ে গেছে। একসময় আমরাও একই ভাবে শহরমুখো হয়েছি,সন্তান মানুষ আর কাজের তাগিদে। গ্ৰামের বাড়ি এখনো কারো কারো আছে তবে এই বয়সে নিজের বাড়িই স্বর্গ। তাই আমরা এখানেই একটা পরিবার করে ফেলেছি,আমাদের যৌথ পরিবার। এই আমার যেমন নিচতলাটা খালি ছিলো, আমার ছোটবেলার দুই বন্ধু আর আরেক বান্ধবীকে নিয়ে এসেছি,ওদের কাজের লোকেরা খুবই খারাপ ব্যবহার করত। অনেকদিনই খাবার জুটতোনা। অবশ্য ওরা সবাই খরচ করেই থাকে এখানে। পাশের বাড়ি থেকে যাতে চট করে চলে আসা যায় রাতবিরেতে সেই ব্যবস্থাও করেছি। যৌথ পরিবারের মতই আমরা থাকি,নিজেরাই নিজেদের জন্মদিন,বিবাহবার্ষিকী পালন করি মজা করে। আবার এবছর তো ভাইফোঁটাও হবে,তারও প্ল্যানিং চলছে। রান্নাঘর বড় করে নিয়েছি,লোক রেখেছি বেশ কয়েকজন। সবাই সবাইকে দেখি।"
বাবাকে এত কথা একটানা কখনো বলতে শোনেনি রাজ। বেশি কথা মা বলতো,মায়ের চিৎকার বকাঝকায় একসময় বাড়ি জমজমাট হয়ে থাকতো। তাই তো ওর আর ভালো লাগেনা আজকাল এখানে আসতে। স্তব্ধ হয়ে যায় মিমও ওরা শ্বশুরকে পরিবার করে দিতে চেয়েছিলো। উনি তো নিজেই একটা বড় পরিবার তৈরী করে ফেলেছেন,সত্যি ভাবা যায়না।
.....এবার সবাই হৈ হৈ করে ওঠে,আলাপ পরিচয় হয়ে যায় সবার সাথে। বাগানের কচি শশা,পেঁয়াজ আর গরম গরম বেগুনী দিয়ে মুড়িমাখা অনেকদিন বাদে জমিয়ে খেলো ওরা। সবার মাঝে খাওয়ার আনন্দ কতদিন বাদে পেলো রাজ,সেই কবে ছেলেবেলায় ওর মামাবাড়িতে এমন হত। " আচ্ছা,তোরা যাবার আগে বলিস। টিফিন ক্যারিয়ারে রাতের খাবারটা গুছিয়ে দিতে বলবো। সব রান্না করানো আছে। ".....একটু ঢোক গেলে রাজ,একবার তাকায় মিমের দিকে," বাবা আজকে আমরা এখানেই থেকে যাবো ভাবছি,একসাথে জমিয়ে খাবো।"...একঝলক হাসি খেলে যায় প্রবীরবাবুর মুখে," কিন্তু তোদের এখানে থাকতে অসুবিধে হবেনা?"...' না বাবা অনেকদিন তোমার কাছে থাকিনা,বেশ মজা হবে। দেখছোনা তোমার দাদুভাই কেমন বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে।" মুখে হাসির রেশ থাকলেও চোখের কোলটা আজ বড় ভিজে ওদের বাবা আর ছেলের।©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment