#অন্য_মাতৃত্ব#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"শুনুন এই মেডিসিনগুলো আপাতত নিন,তবে একটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করে আসুন নেক্সট উইকে। সব লেখা আছে প্রেসক্রিপশনে।"ডাক্তার বলাতে কিছুক্ষণ আর কিছু ভাবতে পারেনা পূরবী মাথাটা ঘুরে যায় কেমন।" কিন্তু ডাক্তারবাবু আমার তো পিরিয়ডস".." হ্যাঁ অনেকসময় এমন হয়,সত্যিই তো আপনার মেনোপজের সময় হয়ে গেছে। টেনশন করবেন না আচ্ছা দেখা যাক।"
কি বলবে ও অতনুকে, এতদিন ধরে যে সংযম ওরা দেখিয়েছে তার শেষ রক্ষা হলোনা। তাও আবার এই বয়সে! কিছু না বলেই টেষ্ট করে,রিপোর্টও নিয়ে আসে। আনন্দ তো হয়ই না। দুশ্চিন্তায় খাওয়ার ওঠেনা মুখে। ওর স্বামী অতনু ওর থেকে প্রায় দশ বছরের বড়। ওদের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। যদিও রুম তো ওর দিদির মেয়ে, তবুও এখন সবাই জানে ওই রুমের মা। আসলে দিদি যখন মারা যায় তখন ওর কোলেই পাঁচবছরের রুমকে তুলে দিয়ে গেছিলো," বোন অতনু যদি বিয়েও করে তুই আমার রুমকে দেখবি বল কথা দে।".. আর তারপর থেকে কখন যে প্রথমে রুমের মা আর অতনুর স্ত্রী হয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। অতনুই বলেছিলো ওদের আর সন্তানের দরকার নেই রুমের অবহেলা হলে সুধা কষ্ট পাবে। সুধাও ছোটবোনকে এত ভালোবাসা দিয়েছিলো যে দিদিকে দেওয়া কথা রাখতে ওর আর কোনদিন ইচ্ছে করেনি সন্তান আসুক ওর গর্ভে। রুমের কাছে কখন যে ও মিমি থেকে মা হয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। আর এখন তো রুমের বেষ্ট ফ্রেন্ড ওর মা। সারাদিন বাদে ফোনে একঘন্টা বকবক না করলে ওর ভাত হজম হয়না।
রুমের বিয়ে হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর,ছেলের বাড়ি থেকে খুব জোর করছিলো বলে কম বয়েসেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয় ওরা। এখন ওরা গুজরাটে থাকে। বিয়ের পরও মেয়েটা মা মা করে অস্থির হয়,বাবার থেকে ওর মায়ের সাথেই ভাব বেশি। বলে," তুমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড মা,বাবা এত গম্ভীর সব কথা বলা যায়না।"
সারাদিন কিছু খেতে ইচ্ছে করেনা পূরবীর ডাক্তার বলেছে দুমাস হয়ে গেছে। মেয়ে জামাই আত্মীয়স্বজন ছিঃ ছিঃ ভাবতেই মাথাটা ঘুরে বমি আসে,অতনুকেই বা কি করে বলবে। তবুও বলতে হবে ওকেই। রাতে কান্নায় মুখ ঢাকে পূরবী সব বলে অতনুকে। অতনু রাগ করে," তুমি তো বলেছিলে তোমার বন্ধ হয়ে গেছে। ইশ্ এই বয়েসে কেমন করে হলো! এতদিন আমরা সাবধানে থাকলাম। আমি কিছু ভাবতে পারছিনা।"..." আমিও ভাবতে পারছিনা,কি করবো।"ওর ঘাড়ে হাত রাখে অতনু কাছে টেনে নেয় পূরবীকে," তুমি কি চাও? বলো লজ্জা বা ভয় পেয়োনা। একসময় হয়ত আমিই বলেছিলাম তোমায় রুমের কথা ভাবতে। তুমি তোমার সবটুকু দিয়েছো পূরবী।"..." আমি আর কিছু চাইনা,আমার রুমের কাছে আমি ছোট হতে পারবোনা। তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলো,আমি আ্যবরসন করে নেবো।" একদলা কান্না এসে গলায় ধাক্বা মারে,মনে মনে বলে ক্ষমা করে দে আমায় তোকে আমি পৃথিবীতে আনতে পারবোনা কিছুতেই।
ডাক্তারের সাথে কথা বলে অতনু,এই উইকএন্ডেই হয়ে যাবে সবটা। তার আগে পূরবীর আরো কয়েকটা টেস্ট করে নেওয়াটা জরুরী। কদিন ভালো করে খেতে পারেনা ও চোখের তলায় কালি পড়েছে এর মধ্যেই,অতনুরও মনটা খুব খারাপ অদ্ভুত এক অপরাধবোধ ওর মনে। পূরবী রুমের সৎমা,এটা ঠিক ও ওর মাসি তবুও অতনু যেন একটু বেশিই চেয়ে ফেলেছিলো ওর কাছে।
কদিন ধরেই মায়ের সাথে কথা বলে সেই হাসি আর আনন্দে ভরা গলাটা পায়না রুম। গতকাল তো ফোনটা সুইচড অফ ছিলো,বাবাকে ফোন করে জানে মায়ের শরীরটা খারাপ ঘুমোচ্ছে। তাই আজ কর্তাকে অফিসে পাঠিয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে বসে। ও অনেকটা দূরে,মা বাবা একা থাকে তাই চিন্তাও লাগে। কালই পূরবীকে ভর্তি হতে হবে,আজ কেন যেন নিজেকে সামলাতে পারেনা ও সবটাই বলে দেয় ওর বেষ্টফ্রেন্ড মেয়েকে। বলেই কাঁদতে থাকে," কি লজ্জা বল এই বয়েসে! আমি কি করবো কালই সব শেষ করে দেবো। তুই ভাবিসনা,কেউ জানবেনা। আজ পর্যন্ত সবই তোকে বলেছি তাই না বলে থাকতে পারলামনারে।"
....স্তব্ধ হয়ে যায় রুম,কি শুনছে ও? এমনও হতে পারে? তখন আর বেশি কথা হয়না ফোন রেখে দেয় রুম। ফোনটা রেখে বেসিনে বমি করে পূরবী চোখে মুখে জল দিয়ে শুয়ে পড়ে। পেটের ভেতরটা কেমন যেন করে।
আজ রাতে কেন যেন ওদের দুজনের কারো খাওয়া হয়না ভালো করে। পূরবী খাওয়ার নাড়াচাড়া করে উঠে যায়,শুয়ে পড়ে। একটু ঘোরের মধ্যে ছিলো,হঠাৎই একটা ফোন আসে। এত রাতে রুম কেন,মেয়েটার আবার কি হলো? মেয়ে ফোনে যা বলে তা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলোনা পূরবী। " মা প্লিজ,প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো আমি তীর্থর সাথে কথা বলেছি। তুমি তো জানো ডাক্তার আমাকে কি বলেছে। তীর্থর সমস্যাটাও তুমি জানো। তুমি আ্যবরসন কোরোনা,মা। আমি জানি এই বয়সে তোমাদের অনেক সমস্যা,অনেক অসুবিধে। ও আমাদের বাচ্চা হয়ে বড় হবে। সবাই তাই জানবে।"...কান্নায় ভেঙে পড়ে পূরবী," না না তা হয়না, সব ঠিক হয়ে গেছে। তারপর আমার এতটা বয়েস যদি সুস্থ না হয় বাচ্চাটা।"
তবুও হয়ত অনেক কিছুই জীবনে হঠাৎই ঘটে যায় গল্পেরই মত। বা এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা নিয়েই গল্প হয়। সব টেস্ট হলো পূরবীর,না না সবই ঠিক আছে। রুমের মনে জাগলো মাতৃত্বের আশা,যা চিকিৎসায় ফল না পেয়ে দিন দিন ক্ষীণ হচ্ছিলো। পূরবী লালন করতে লাগলো এক ছোট ভ্রূণকে একটু একটু করে নানা শারীরিক কষ্ট সহ্য করলো অনাগত সন্তানের মুখ চেয়ে। হয়ত মনে একটা তৃপ্তির আনন্দ জাগলো,একটা বড় কিছু করার আনন্দ।
তবে কলকাতায় বেশিদিন থাকতে পারলোনা পূরবী, কারণ অনেক কিছুই ভাবতে হলো। সবাই জানলো রুম মা হতে চলেছে তাই পূরবী কিছুদিন মেয়ের কাছেই থাকবে। অতনু যাতায়াত করবে। কারণ রুমের শাশুড়ি নেই আর শ্বশুরমশাই কলকাতায় থাকেন দেওরের সাথে।
পূরবীর পেটটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে,মায়ের পেটে কান পাতে রুম। " মা ধক ধক আওয়াজ হচ্ছে। আচ্ছা মা ওকি খুব নড়াচড়া করে গো?"..." করবেনা আবার হয়েছে তোর মতই দুষ্টু। ছোটবেলায় কি দুষ্টু ছিলি তুই।".
পূরবী থাকে একটা আলাদা ফ্ল্যাটে,আয়া রেখে দিয়েছে রুম। প্রতিদিনই ওরা যায়। তীর্থর আরো উৎসাহ,কত কি যে কিনে আনছে খাবার দাবার ফলমূল। অতনু মাসে দুবার আসে। রুমের আসেপাশের সবাই জানে ওর বেবি হবে। বেবিশাওয়ার হয়ে গেলো রুমের। আর পূরবী খেলো মেয়ের বানানো পায়েশ,ওদের চারজনের মাঝেই থাকলো সবটা।
অতনু থেকে গেছে এবার কারণ সময় এগিয়ে আসছে ডেলিভারীর। পূরবীর শরীরটা খুব ভারী হয়ে গেছে হাঁটা চলা করতে বেশ কষ্ট হয় এখন। মা মেয়ে দুজনেই ভর্তি হয় হসপিটালে,শুধু পূরবী ভর্তি হয় গোপনে। ওর কোল জুড়ে হয় ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়ে একদম রুমের মত সুন্দর। রুম গোলাপী তোয়ালে মুড়িয়ে বাড়ি আসে ওর ছোট্ট বোনকে যাকে সবাই জানলো ওর মেয়ে বলে। মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওদের দুজনের। ফ্ল্যাটে আসে ফিরে পূরবীও এখানে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর রুমের ফ্ল্যাটে যাবে তেমনি কথা হয়েছে। অনেকদিন বাদে শরীরটা বড় হাল্কা। হয়ত হাল্কা লাগছে মনটাও,আজ যে বড় আনন্দের দিন রুমের হাতে তুলে দিতে পেরেছে ওর জীবনের সবচেয়ে কষ্টের সেরা সম্পদটা। বড় খুশি দেখেছিলো রুম আর তীর্থকে। বুকের ভেতরটা একটু চিনচিন করে ওঠে ওর,কয়েক ফোঁটা অমৃতরস গড়িয়ে পড়ে। ইশ্ ব্লাউজটা ভিজে গেছে কখন খেয়ালই করেনি। অতনু খুব কাছে এসে বসেছে ওর বড় কাছে আগলে রাখতে ইচ্ছে করছে আজ পূরবীকে। এমন বড় মনের মানুষ ও হয়! মা আর মাসির মতই হয়েছে রুমটাও।
হঠাৎই বেলটা বেজে ওঠে,দরজা খোলে অতনু," তোরা!".." হ্যাঁ বাবা চলে এলাম,এইটুকু তো পথ। তীর্থই ড্রাইভ করে এলো। ও কিছুতেই ঘুমোচ্ছেনা মা,খুব কাঁদছে। তুমি একটু দেখোনা। বাবা তোমরা গল্প করো আমি আসছি।"...মায়ের কোলের কাছে শুইয়ে দেয় ওকে রুম। আঁচল চাপা দিয়ে প্রাণভরে অমৃত ধারায় শান্ত করে ওর আত্মজাকে পূরবী। হাল্কা লাগে বুকটা। ওর বুকের ওমে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। ওর মাথায় স্নেহের পরশ বোলাতে বোলাতে রুমের দিকে তাকায় পূরবী। একমুঠো মিঠে হাসিতে ভরে গেছে ওর মুখটা। সত্যি রুমটা যে কখন মেয়ে থেকে ওর মা হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি পূরবী।©ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment