Skip to main content

চোখ

#চোখ#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"আচ্ছা পাশের ফ্ল্যাটটা দেখেছো রঙ হচ্ছে,অনেকদিন ফাঁকা পড়েছিলো। আমি তো ভেবেছিলাম ওটা বিক্রিই হয়নি। তার মানে কেউ কিনেছে ওটা।"..."আচ্ছা আমাদের এত কি দরকার কে এলো কে গেলো তাতে। সত‍্যি মৌ তোমার এই এত খোঁজখবর রাখাটা আমার একদম ভালো লাগেনা।"
          রৌম‍্যর বিরক্তি দেখে আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পায়না মৌ,যা রাগী মানুষ এখনই হয়ত চিৎকার চ‍্যাঁচামেচি শুরু করবে। মৌ যেন একটা মাটির দলা ওর কাছে,তাই ওকে নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। দুম্ করে হঠাৎই ওদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিলো,মৌ বিহারের বাসিন্দা,এখনো ওর কথায় বেশ হিন্দীর টান আছে। ওদের বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকতো রৌম‍্য কাজের প্রয়োজনে, বেশিদিন নয় বছর খানেক ধরে। মৌ সবচেয়ে বড় ও ওর বাবার আগের পক্ষের সন্তান,পরে ওর আরো সৎ দুইবোন আছে,বাবার অবস্থা খুব একটা ভালো নয় চলে বাড়িভাড়া আর টুকটাক কাজ করে। মৌয়ের পড়াশোনা তেমন হয়নি,টেনেটুনে বারোক্লাশ। বাড়ির রান্না ওকেই করতে হয়,অবশ‍্য মা হাতে হাতে কিছু কাজ করে দেয়। মনে যা থাকুক,মুখে মা গলে পড়ে সবার কাছে ওর প্রশংসায়। হয়ত এইটুকুর জন‍্যই মায়ের বলা কোন কাজেই না করতে পারেনা ও। বেশি কিছু না শুধু তো একটু ভালোবাসাই চায় ও।
     মাঝেমাঝেই মা ওকে দিয়ে রুটি করিয়ে পাঠিয়ে দিত রৌম‍্যর জন‍্য। রৌম‍্য সেভাবেই বলেছিলো রাতের খাওয়ারটা টাকার বিনিময়ে ওদের কাছেই নেবে,সকালে বেড়িয়ে যেতো ফিরতো রাতে।
            ঘরে না ঢুকে বাইরে থেকেই খাবার দিয়ে যেত মৌ তবে রৌম‍্যর হাসি ওকে টানতো। মনে জাগাতো ভালোলাগা। কখনো রৌম‍্য বলতো ভেতরে খাওয়ার রাখতে,মৌ হাসতো "এহি সে লিজিয়ে।" "কেন আমি কি বাঘ যে তুমি ভয় পাও?"...রঙিন হয়ে উঠতো মৌয়ের মনটা,হয়ত স্বপ্ন দেখতো কোনদিন মেহেন্দীতে হাত সাজিয়ে ঘোমটা টেনে বৌ সেজে ঢুকবে ঐ ঘরে।
          খাবার দিতে,কখনো কোন জিনিস দিতে প্রায়ই পায়ের মল ঝমঝম করতে করতে মৌ নামতো নিচে হাসতো রৌম‍্য," কালকে চিকেনটা দারুণ ছিলো,কে রান্না করেছিলো তুমি?"..লজ্জা মাখিয়ে মুখে ঘাড় নাড়তো মৌ," আচ্ছা ছিলো তো, সত‍্যি বলছেন?"..."একদম পাক্কা বলছি,টিফিন কৌটোতে জবাব আছে।"..আর দাঁড়ায়নি মৌ ওড়নায় ঢেকে টিফিনকৌটো নিয়ে ছাদে উঠে কিছুক্ষণ হাঁপিয়েছিলো উত্তেজনায়,তারপর খুলে দেখেছিলো একজোড়া ঝুমকো। কি সুন্দর দেখতে! আর তার সাথে একটা চিঠি,যদি কাল এটা পরে খাবার দিতে আসো তাহলে বুঝবো তোমার পছন্দ হয়েছে।
               পরের দিন ওর আর সময় কাটছিলোনা,বোনেরাও বলছিলো এত সেজেছে কেন? দিদিকে খুবসুরত লাগছে দেখতে।
চোখে কাজল টেনেছিলো মৌ,রাতের খাবার যত্নে সাজিয়ে নিচে নেমেছিলো। শান্ত হরিণীর মত বধ হয়েছিলো রৌম‍্যর চোখের ইশারায়,হাতটা ধরে ভেতরে নেওয়ার জন‍্য টেনেছিলো রৌম‍্য। একদম চলে এসেছিলো ওর চওড়া বুকের কাছে মৌ,কেঁপেছিলো খানিকটা উত্তেজনায় তবে হঠাৎই ছিটকে এসেছিলো বাবার গলার আওয়াজে পেছনে ছিলো মাও। তারপর যা হবার তাই হয়েছিলো ওরা কেউ বিশ্বাস করেনি মৌকে সবাই বলেছিলো কতদিন ধরে চলছিলো এইসব রাসলীলা? রৌম‍্যও চেষ্টা করেছিলো বিয়েটা আটকাতে,অবাক হয়েছিলো মৌ,ওকে বিয়ে করতে চায়না তবে কেন ওকে এভাবে ইশারা করত? কেনই বা দিয়েছিলো সুন্দর ঝুমকা? তবে কি শুধু মজা লুটতে চেয়েছিলো বাবুজী? বাধ‍্য করেছিলো জ্ঞাতিদের বলে রৌম‍্যকে বিয়ে করতে মৌকে ওর বাবা মা। রৌম‍্য বলেছিলো কিছু দহেজ চাই ওর, কিন্তু মৌকে সাজিয়ে দেওয়া ছাড়া কোন টাকাই দেয়নি ওরা। রুখে দাঁড়িয়েছিলো ওর মা,বলেছিলো রৌম‍্য ওদের মেয়ের ইজ্জত নিয়ে খেলছে তাই শাস্তি ওকে পেতেই হবে।তখনই পাড়া প্রতিবেশী ডেকে পরেরদিনই সব ব‍্যবস্থা করে দেয় ওরা। পরে মনে হয়েছিলো মৌয়ের পুরোটাই কি তাহলে ওর মায়ের প্ল্যান ছিলো,নিখরচায় ওর বিয়েটা দিয়ে দেবার জন‍্য? তাই রাত্রি হলেই বলত,"আচ্ছা খানা বানাবি বাবুজী খাবে। একদম গরমাগরম দিয়ে আয় তো।" টুকটাক পুরোনো  গয়নায় ওরা সাজিয়ে দেয় মৌকে। রৌম‍্য আগেই বলেছিলো ওর কোন আত্মীয় নেই,মা বাবা মারা গেছে আ্যক্সিডেন্টে। শুধু এক অসুস্থ বৃদ্ধা পিসি আছে। তাই বিয়েটা কোনমতে হয়ে যায়,শুভদৃষ্টির সময় রৌম‍্যর চোখে একপলকের জন‍্য চোখ রেখে কেমন যেন অবাক হয়ে গিয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলো মৌ,কি দেখেছিলো সেই চোখে ভরা ফাগুনমাসে তা আর কাউকে বলতে পারেনি।
            সেদিন ওদের সুহাগরাত,এই দুদিন মোটামুটি রৌম‍্যকে ওদের বাড়ির লোকেরা নজরবন্দী করে রেখেছে। বেশ কয়েকবার বাইরে যেতে চেয়েছিলো অফিসের কাজ আছে বলে,তা আর হয়নি। একবার বিরক্ত হয়ে মৌকে বলেছিলো," তুমি কিছু বলো ওদের,জোর করে বিয়ে দিলো এখন আটকে রাখছে কেন? বিয়ে তো হয়েই গেছে।"..রৌম‍্যকে ঘাড়ে হাত দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায় ওর চাচা," আরে বেটা আর তো দুটো একটা দিন,আমরা বিহারে থাকলেও বাঙ্গালী সব নিয়ম মানি,এখনো বৌভাত হলোনা,সুহাগরাত হলোনা। মেয়েটা আমাদের হাতে মেহেন্দীর রঙ নিয়ে বসে আছে তোমার জন‍্য।"...এক গ্লাস দুধ ওর হাতে ধরিয়ে দেয় মা,সেজে দেয় দুটো মিঠা পানও। কি করতে হবে বলে দেয় ওর এক দাদিমা," আরে শরম দেখ ছোড়ির,যখন প‍্যায়ারের রঙ মেখেছিলি তখন শরম হয়নি। মরদ হলো বড় অস্থির,সবসময় ওদের মন আনচান করে,ওকে বাঁধবি শক্ত করে তোর এই বুকের মাঝে।"..হেসেছিলো দাদিমা,লজ্জা পেয়েছিলো মৌ।
    ফুল দিয়ে ওরা ভালোই সাজিয়েছিলো ঘরটা,লাল লেহেঙ্গা আর হাতভর্তি চুড়িতে খুব সুন্দর লাগছিলো মৌকে। ওরা ওকে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়ে দেয়,বাইরে থেকে পাওয়া যায় দরজা বন্ধ করার আওয়াজ। " দাঁড়িয়ে থেকোনা পুতুলের মত,তোমাকে তো স্মার্ট ভেবেছিলাম। তুমি স্মার্ট না হলেও চালাক তো বটেই তাই মা বাবাকে এনেছিলে সাথে। আমাকে ভালো পেয়ে কেমন ফাঁসিয়ে দিলো,একটা এম বিএ করা ছেলের ঘাড়ে চাপালো টুয়েলভ পাশ মেয়ে। খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো মৌয়ের ও পড়তে চেয়েছিলো আরও কিন্তু সুযোগ পায়নি। হঠাৎই চোখ পড়ে যায় রৌম‍্যর চোখে আর কিছু বলতে পারেনা।
             মৌয়ের ওড়নাটা খুলে দেয় রৌম‍্য,লাল রাঙা সিঁথিটা খুলে যায়,উন্মুক্ত হয়ে যায় বক্ষদেশের কিছুটা। রৌম‍্য আঁকড়ে ধরে ওকে, একঝটকায় কানের দুল আর হারটা খুলে হাত দিয়ে মেপে বলে," যত সব ঠুনকো মাল দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো মেয়েকে আমার গলায়। কি মরতে যে এই বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলাম!"
      প্রেমহীন শরীরের খিদের খোরাক হয়েছিলো মৌ,একটু করে ভেঙেছিলো লজ্জার সমস্ত আগল,সময় পেয়েছিলো খুবই কম আড়ষ্টতা কাটাতে। পণের বদলে নিজের নরম শরীরটা দিয়েছিলো রৌম‍্যর কামনার কাছে। শরীরের সাথে পিষ্ট হয়েছিলো ওর ভালোবাসায় রাঙানো মনটা। মেহেন্দী পরে লজ্জা পেয়ে ঘরে ঢুকেছিলো অনেক স্বপ্ন নিয়ে,কিন্তু সব স্বপ্ন কি পূরণ হয়? মা বাবাই বা কি করবে আরো দুটো বোন আছে তাই দাদিমার কথা মত নিজের উন্মুক্ত বক্ষে বাঁধতে চাইলো রৌম‍্যকে।
                 নিজেদের বাড়ির একতলাতেই সংসার সাজালো মৌ,তবে সেই সংসার যে শুধুই একটা মোড়ক বুঝতে পারলো কদিন বাদেই। রৌম‍্যর আয় তেমন নেই,অনেকদিন দুপুরে ওর খাওয়া হয়না,রাতে ফেরার পথে কিছু খাবার কিনে আনে রৌম‍্য তবে বেশিরভাগটাই যায় ওর পেটে। অনেকদিনই কটু গন্ধ পায় ওর মুখ থেকে বললে বলে," কি করবো সংসারে সুখ না থাকলে যা হয়।"..বিয়ের পর মা আর তেমনভাবে ওকে পাত্তা দেয়না,এছাড়া বাবাও রৌম‍্যকে বলেছে একটা অন‍্য বাড়ি খুঁজে চলে যেতে। কারণ এইভাবে এক বাড়িতে থাকা ভালো দেখায়না,তাছাড়া প্রায় ছয়মাস রৌম‍্য কোন ভাড়া দেয়নি। বাড়ি ভাড়াটাই বাবার আয়ের পথ।তাছাড়া বাবাকে মৌ কিছু বলতে পারেনা,কারণ জবাব পায় নিজেই নিজের কপাল পুড়িয়েছে ও,ভাগ‍্যিস বাবা মা খেয়াল করেছে নাহলে ওর কলঙ্কে সারাজীবন ওদের পুড়তে হত। তাই নিজের জীবন ওকে বুঝে নিতে হবে,থাকতে হবে যার হাত ধরেছে তার সাথে। মৌ বোঝে কথাগুলো ওর মায়ের শেখানো।
               রৌম‍্যকে এক একদিন বলে বাজার করে দিতে ও রান্না করবে। উত্তর পায়," ফিগারটা ঠিক রাখো,ডায়েটে আছো বলে কত সেক্সি হয়েছো এখন। আগে তো ময়দা খেয়ে খেয়ে গলুমলু মার্কা ছিলে‌। আমার বন্ধুর বৌদের কত সুন্দর ফিগার।" নিঃশ্বাস ফেলে দুচামচ ছাতু মুখে দিয়ে জল খায় মৌ। রৌম‍্য রোজ জোর করে ওষুধ খাওয়ায়," এই শোন এখন আমার আস্তানার কোন ঠিক নেই,কোথায় থাকবো কে জানে। তাই বাচ্চাকাচ্চার নামও করবেনা একদম। বাজারে আমার কত ডিমান্ড ছিলো,তা কিছুই পেলামনা.. হয়েছে এক ঠনঠনে শ্বশুরবাড়ি।"
                সত‍্যি সত‍্যি বাবা আর কাকাদের কথায় বাড়ি ছাড়তে হয় রৌম‍্যকে। সবাই চাইছিলো এবার ও নিজের পরিবারের দায়িত্ব নিজে বুঝে নিক। শুরু হলো মৌয়ের এক অন‍্য যাত্রা,সামান‍্য যা মালপত্র ছিলো তা গুছিয়ে ট্রেনে উঠে বসে ওরা। বাবাকে একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছিলো,"মেয়েরা কি বিয়ের পর এতটাই পর হয়ে যায়?"
         স্টেশনে রৌম‍্যকে কাছ ছাড়া করতে চাইছিলোনা মৌ,মনে হচ্ছিলো যদি ওকে ফেলে কোথাও চলে যায়। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে ওরা?
            মৌ সাহস পায়না রৌম‍্যকে জিজ্ঞেস করতে,বাড়িতে একবার জিজ্ঞেস করেছিলো আগের রাতে তবে এত নেশা করেছিলো রৌম‍্য যে চেঁচিয়ে আর গালাগাল দিয়ে উঠেছিলো। ঘাড়ে আর গলায় এখনো জ্বালা করছে মৌয়ের। ওর রাগের পুরোটাই উশুল করে মৌকে ক্ষতবিক্ষত করে। একদিন ওর পাড়ার দাদিমাকে বলেছিলো,উত্তর পেয়েছিলো," আরে মরদ ভালোবাসছে,দাঁতে কাটছে এ তো ভালো বাত আছে। কত ছোড়ি এই সোহাগটুকু পায়না জানিস। হায় হায় ইস ছোড়ির যে কি হবে,এত নাজুক বদন।"
               মৌকে নিয়ে তুললো পিশির বাড়িতে রৌম‍্য। " আরে পিশি বরণডালা নিয়ে এসো,তোমার নতুন বৌমা নিয়ে এসেছি। ও বেচারা তো শ্বশুরবাড়ির আদরই পেলোনা।"..দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে পিশি দেখে অবাক হয় মৌ," এবার কতদিনের জন‍্য শুনি?তুই আবার বিয়ে করেছিস? এতদিন কোথায় ছিলি? শোন আমি আর কোন ঝামেলা নিতে পারবোনা। বিদায় হ এখান থেকে এখুনি।" মৌয়ের কানে একটা কথা বাজে,আবার বিয়ে করেছিস। তাহলে কি রৌম‍্য এর আগেও বিয়ে করেছে,সেই বৌও কি আছে? পরদেশে এসে খুব কান্না পায় মৌয়ের। সত‍্যি বোধহয় ও বাঘের গুহায় ঢুকে পড়েছে। মা বাবাও ওকে সাহারা দিলোনা,হায় রাম কি করবে ও?
          পিশিকে আড়ালে গিয়ে বোঝায় রৌম‍্য,কিছু কথা কানে আসে মৌয়ের। বুঝতে পারে পিশি টাকা ছাড়া রাখতে নারাজ তাও বড়জোর একমাস,তারপর খুঁজতে হবে অন‍্য আশ্রয়। কারণ এখানে খুব উৎপাত,কিসের উৎপাত মৌ বুঝলোনা। ও তখনো ঘোমটা টেনে দাঁড়িয়ে,শ্বশুরবাড়ি বলে কথা,ওদের বিহারে এমনি নিয়ম। কিছুক্ষণ বাদে দু তিনজন মহিলা এসে ওকে প্রদীপ জ্বালিয়ে আর শঙ্খ বাজিয়ে ঘরে এনে তুললো। পিশি ঘোমটা তুলতে বললেন," কি সুন্দর সহজ সরল মুখটা! কি যে হয় ছেলেটার কে জানে। কবে যে এইসব বাউন্ডুলেপনা ছেড়ে মন দিয়ে সংসার করবে?"
               সত‍্যি সংসারী ছিলোনা রৌম‍্য,পিশি টিকটিক করলেও ঘরের তলায় মন টিকতোনা। ফিরত অনেক রাতে। পিশি মৌকেও ঘরের বাইরে বের হতে দিতোনা। তবে ভালোবাসতো খুব ওকে,কারণ মৌ সব কাজ করত হাসিমুখে। পিশিকে যত্নও করত খুব। মাঝে মাঝেই বাইরে শুনতো কারা যেন রৌম‍্যর খোঁজ করতে আসে। রুখে দাঁড়াতো পিশি,কখনো কান্নাকাটি করতো। রৌম‍্য সকালে গিয়ে ফিরতো অন্ধকার গভীর রাতে।
          তবুও ওখানে আর বেশিদিন থাকা হলোনা,মৌ কেমন যেন ভয়ে ভয়ে থাকত রৌম‍্য ওকে ছেড়ে পালাবে তবে দেখলো তা হলোনা। একদিন বেশ অনেক রাতে একটা ট‍্যাক্সি করে মৌকে নিয়ে রৌম‍্য পিশির বাড়ি ছাড়লো। পিশি বললেন," আবার যখন বিয়ে করেছিস,তখন এবার কাজকর্ম কর আর সংসারী হ। ছেলেপুলে হোক তাড়াতাড়ি এবার।"
...." হ‍্যাঁ পিশি একটা ফ্ল্যাট পেয়েছি,সেখানেই চলে যাচ্ছি। আমার জন‍্য তোমাকেও অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।"
                   মৌয়ের আশ্চর্য লাগে ওর বাপের বাড়ির কথা ভেবে। ওকে পাঠিয়ে ওরাও কি সব দায়িত্ব থেকে বেঁচেছে? মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে ও ফোন করে,যদিও রৌম‍্যর খুব রাগ শ্বশুরবাড়ির ওপর। ও চায়না মৌ কোন যোগাযোগ রাখুক।
                        একটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন ফ্ল্যাটে ওরা এসে উঠলো। রৌম‍্যর এক প্রোমোটার বন্ধুর ফ্ল্যাট এখনো কাজ চলছে। খুব ছোট ঘর তবুও তাতে সংসার সাজালো মৌ,মাঝে মাঝেই কিছু বন্ধু বান্ধব নিয়ে আসে রৌম‍্য,যদিও মৌ খুব একটা ওদের সামনে আসেনা তবুও চা দিতে এলে ওদের চাউনিগুলো ভালো লাগেনা ওর। রৌম‍্যকে বললে ও বলে," শোন ওদের জন‍্যই এই আস্তানাটা পেয়েছি,তাই এটুকু হাসি মজা ওরা করবেই,অতো সতীপনা করলে হবেনা। ওরা এলে চা তোমাকেই দিতে হবে।"..কেমন যেন ভয় হয় মৌয়ের একা ফ্ল্যাটে সারাদিন থাকে যদিও ও দরজা খোলেনা কাউকেই,রৌম‍্যকে বলে বাইরে থেকে তালা দিয়ে চাবি রেখে যেতে।
               সামনের ফ্ল্যাটটা রঙ হতে দেখে একটু ভালো লাগে মৌয়ের,যাক তবুও প্রাচীরের ওপারেই তো ওদের বারান্দাটা। এই তল্লাটে শুধুই ফ্ল্যাট আর সবই তৈরী হচ্ছে এখন,চারদিকে মিস্ত্রীদের ছড়াছড়ি,কখনো বেরোতে পারেনা বাইরে। তবু যদি একটু মানুষের দেখা পায়। তাই রৌম‍্যকে জিজ্ঞেস করছিলো।...তাতেই গজগজ করতে থাকে রৌম‍্য," যেখানে যাই অশান্তি লেগেই থাকে,নিরিবিলি জায়গা দেখে এলাম। তো এখানেও লোক এসে জুটবে। বেশি ভিড় হওয়ার আগে আমাকে একটা ব‍্যবস্থা করতে হবে। দেখি গুপ্তাকে বলে।"..এই গুপ্তা মানুষটার কথা শুনলে কেমন যেন ভেতরটা চমকে ওঠে মৌয়ের। ও বিহারের মেয়ে বলে ইচ্ছে করেই ঘোমটা টানে বাইরের লোকের কাছে। তাই বলে," ওহ্ দোস্ত আরে ভাবী কো বোলো ঘুঙ্গট হঠাতে,আরে এখনো মুখই দেখলামনা ভালো করে।"..ও গ্লাস দিতে যেতেই ওর হাতটা চেপে ধরেছিলো,মৌ তাড়াতাড়ি করে ছাড়িয়ে ভেতরে চলে যায়। " আরে আরে সব হবে এত জলদি কিসের,আমার দিকটা একটু দেখো,আমি তোমাকে খুশি করে দেবো।"..রৌম‍্যর কথাগুলো শুনে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে মৌয়ের। কি ভাবছে রৌম‍্য,এমন কথা বলছে কেন?
                কদিন বাদে একদিন মৌ রাত্রিবেলায় উল্টোদিকের ফ্ল্যাটটাতে আলো জ্বলতে দেখে,বাহারি পর্দা ঝুলছে। তবে কি লোক এলো ওখানে সত‍্যি। কে জানে কেমন মানুষ এসেছে ওখানে! কতদিন মানুষের সাথে ভালো করে কথা হয়না ওর। বাপের বাড়ি যেতে চেয়েছিলো,বাবাকে বলেছিলো নিয়ে যেতে ওকে। বাবা গাড়িভাড়ার দোহাই দেয়,রৌম‍্য শুনে রেগে যায় বলে ওখানে গেলে কুড়িহাজার টাকা নিয়ে আসতে হবে। নাহলে যেন আর না ফেরে। চুপ করে যায় মৌ,রৌম‍্যকে বলে," একটা কাম দাও তবে আমাকে ছোটামোটা আমি করবো। সারাদিন এভাবে আমি বন্দী থাকতে পারছিনা।"...হেসে ওঠে রৌম‍্য," তোমার কামেরই বন্দোবস্ত করছি আমি,আর কিছুদিন থামো,কথা হচ্ছে।"
               বারান্দায় কাপড় মেলতে বেড়িয়েছে মৌ,উল্টোদিকের বারান্দায় একটা মুখ দেখতে পায়। লেড়কি,কিন্তু বহুত মজবুত,বাপরে এ তো বিলকুল আদমিদের মত পোশাক পরে। মুখটা সরিয়ে নিতে চায় মৌ। ওদিক থেকে একটা হাসি দেখতে পায়,হাত নাড়ে মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে। তাজ্জব তো,ওকে না চিনেই হাত নাড়ছে। একটু হাসে মৌ,তারপর ঘরে চলে আসে।
                  রাতে রৌম‍্যকে কিছু বলার মত অবস্থা থাকেনা,নিজের জীবন নিয়ে নিজের মাঝে মাঝেই অসহ‍্য লাগে। হয়ত এর জন‍্য ও নিজেই দায়ী অন্ততঃ বাবা তাই বলে। টাকা পয়সা খরচের ভয়ে বাবা মাও ওকে পাত্তা দেয়না,দুটো বোন এখনো আছে বিয়ে দিতে। সকালে একবার ভাবে বলবে,তারপর সেদিনের চিৎকারের কথা মনে করে চুপ করে যায়। রৌম‍্য নিজেই বলে," গুপ্তার কাছে শুনলাম,পাশের ফ্ল্যাটে জবরদস্ত এক মেয়ে এসেছে,ওদের প্রোমোটারের সাথে ঝামেলা করে এখানে থাকার আস্তানা নাই বলে ফ্ল্যাট কমপ্লিট না হতেই ঢুকে পড়েছে। বাইক গাড়ি সব চালায়,একদম ব‍্যাটাছেলে একটা। শুনলাম তো একা থাকে।"
         মৌয়ের আর কিছুই জিজ্ঞেস করতে হয়না অনেক খবরই পেয়ে যায়। ঘরে একটা টিভিও নেই,সারাদিন একা একা দম আটকে আসে। ইচ্ছে করেই বাচ্চা বন্ধ হওয়ার ওষুধটা কয়েকদিন ধরে খাচ্ছেনা,রৌম‍্যকে বলে খাচ্ছি। একটা ছোট বাচ্চা এলে হয়ত সব ঠিক হয়ে যাবে,রৌম‍্যরও ঘরে মন বসবে। ভগবান ঠিক খাওয়া জুটিয়ে দেবে। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চোখাচোখি হয়ে যায় মেয়েটার দিকে,ওদের ঘরের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। অদ্ভুত তো,ভাগ‍্যিস ও বাইরে এলো তাই দেখলো। কে জানে কেমন মেয়েমানুষ আছে ওর ঘরের মরদটাও তো ভালোনা,ওর দিকে নজর নেই তো মেয়েটার? মৌ একটু বিরক্ত হয়,মেয়েটা ওদিক থেকে জিজ্ঞেস করে," তুমি নতুন বৌ? খুব সুন্দর তো তুমি দেখতে। কি নাম তোমার?"..ওকে সুন্দর বলাতে মৌ খুশি হয়,সত‍্যি কেউ তো বলেনা এমন কথা,বিয়ের পর। তাই একটু হেসে বলে মৌ। চারিদিকটা ফাঁকা,একটু দূরে কয়েকটা মিস্ত্রী কাজ করছে ওরা তাকায়। মৌ ঘরে ঢুকে যায়। মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন,এর মধ‍্যে অনেকবারই হাসি বিনিময় বা টুকরো কথা হয় মেয়েটার সাথে,ওর নাম নাকি তৃষা। যদিও রৌম‍্যকে আর কিছু বলেনি মৌ।
            হঠাৎই একদিন রাতে রৌম‍্য মৌয়ের গলাটা চেপে ধরে বাড়ি থেকে ফিরে,এর আগেও বেশ কয়েকবার হাত দিয়েছে গায়ে। তবে সেদিন খুব হিংস্র লাগে ওকে দেখতে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে মৌ,পারেনা।" খুব আড্ডা মারছিস ঐ মদ্দা মেয়েটার সাথে তাইনা? কি বলিস ওকে বল,আমি শুনেছি তুই ওর সাথে কথা বলিস।"..." ইশ্ লাগছে ছাড়ো আমাকে,বিশ্বাস যাও আমি বাতচিত করিনা ওর সাথে। শুধু হেসেছি আর কিছুনা।".." হেসেছিস,কেন ওর মাথা খাচ্ছিস? রাজ‍্যের ছেলের আস্তানা ওর বাড়িতে। আমার বন্ধুর সামনে একহাত ঘোমটা টানিস। বেহায়া মেয়েমানুষ একটা। আর যদি বাইরের লোকের সাথে কথা বলেছিস,একদম শেষ করে দেবো।"..রৌম‍্যর চিৎকার আর মৌয়ের চাপা কান্নায় খান খান হয়ে যায় ফ্ল্যাটের নিস্তব্ধতা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিছুটা বুঝতে পারে তৃষা কিন্তু কিছু করতে পারেনা,খুবই খারাপ লাগে। চোখে ভাসে মৌয়ের লাজুক মিষ্টি মুখখানা। এখনো অনেক মেয়ের ভবিতব‍্যই বোধহয় এমন,যাদের বরেরা রাতে নেশা করে ওদের শরীরটাকে নিজেদের সম্পত্তি মনে করে ইচ্ছেমত কাটাছেঁড়া করে। এই জন‍্যই বোধহয় এই পোড়া দেশটার কোন উন্নতি হলোনা। যেখানে অর্ধাঙ্গিনীরই কোন সম্মান নেই,শুধু বড় বড় গাল ভরা নাম আর কথা। রাগে ভেতরটা জ্বলে গেলো ওর।
            রাতের গভীরতায় আস্তে আস্তে চাপা পড়লো কান্না,দুতিনদিন ধরে তৃষা বারান্দায় বেড়িয়ে মৌকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু মেয়েটাকে বাইরে দেখেনি,তবে কি মেয়েটার কিছু হয়েছে? আজ অফিসে একটু দেরিতে বেরোবে ঠিক করে। সকাল থেকেই বাইরে নজর রেখেছে তৃষা,শয়তান লোকটা বেড়িয়েছে বেশ আগে,চারিদিকটা বেশ ফাঁকা। দুদিন ধরে মৌয়ের ভালো করে খাওয়া হয়নি,ওটাই নাকি ওর শাস্তি। রৌম‍্য চলে যাওয়ার পর শুয়ে আছে,এখন ঘরেই কাপড় মেলে। হঠাৎই দরজায় নক শুনতে পায়,কে এলো এখন? বাইরে থেকে তো চাবি দেওয়া। সাবধানে দরজায় চোখ রাখে,তৃষাকে দেখতে পায়। দরজা খোলেনা তবুও। ওদিক থেকে ফিসফিস করে বলে তৃষা,"একটু খোলো আমি জানি তুমি ভেতরে আছো,প্লিজ। তোমার জন‍্যই আমি এসেছি,বিশ্বাস করো।"..দরজাটা একটু ফাঁক করে মৌ,ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়।" কেউ নেই আমি দেখেছি,আমি দুএকটা কথা বলেই চলে যাবো,প্লিজ মৌ এত ভ‍য় পেয়োনা। কোথায় ছিলে এই দুদিন? তোমার ভালোর জন‍্যই এসেছি আমি। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।"
               আশ্চর্য হয়ে যায় মৌ,বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে তৃষাকে,কিন্তু রৌম‍্য যে বলেছে তৃষা খারাপ ওর সাথে কথা বলতে দেখলে আবার মারবে। কিন্তু কি বলতে এসেছে তৃষা? কি ভালো করতে চায় ওর?
    শেষটুকু কাল:-
     তৃষাকে এড়াতে পারলোনা মৌ,ওর তো সবদিকেই বিপদ,তাই কেন যেন আরেকবার ঝুঁকি নিয়েই ফেললো। পাশে থাকে মেয়েটা হয়ত বিপদে পড়লে সাহায‍্য করতে পারে।
          তৃষা ঘরে ঢুকে আসে,মৌয়ের কাছে জানতে চায় কি হয়েছিলো, হাতে বেশি সময় নেই তাই তাড়াতাড়ি কথা বলতে থাকে তৃষা হঠাৎই ওর কাশি ওঠে,জল চায় মৌয়ের কাছে। আর একটু আদার টুকরো মৌ রান্নাঘরে যায়,ওদের ঘর একটাই মানে পুরোটাই খোলা,। শুধু রান্নাঘরটা আলাদা,আর বারান্দাটা। জল এনে তৃষাকে দিতে ও তাড়াতাড়ি খেয়ে আরো কিছু কথা জানতে চায় ওর কাছে মানে ওদের বিয়েটা কিভাবে হলো। রৌম‍্যর ব‍্যাপারে কোন খোঁজ নেয়নি কেন,রৌম‍্য কি কাজ করে এইসব। অনেক কিছুর উত্তরই জানেনা অবশ‍্য মৌ। তারপর ও চলে যায় খুব সাবধানে। ভয়ে ভয়ে কাটে মৌয়ের সন্ধ‍্যেটা,কে জানে কপালে আজ কি আছে? তবে রৌম‍্যকে খুশিই মনে হয়,জানায় মৌয়ের জন‍্য একটা কাজের খোঁজ করছে। কারণ বড় শহরে দুজনের ইনকাম ছাড়া চলেনা। খুব শিগগিরি কাজটা হয়ত হয়ে যাবে,তাহলে হাতে পয়সাও আসবে আর মৌয়ের বাইরে বেরোনোও হবে। মৌ যেন নিজের খেয়াল রাখে,আর ওষুধগুলো খায়। এখন একদম বাচ্চাকাচ্চা নয় ফিগারটা ঠিক রাখতে হবে। সপ্তাহখানেক বাদে মৌয়ের জন‍্য অনেক জামাকাপড় কিনে আনে রৌম‍্য,আশ্চর্য লাগে ওর আজ পর্যন্ত যে কিছু দেয়নি,সে হঠাৎ এতো কিছু! তবুও মনটা খুশিতে ভরে ওঠে ওর। রৌম‍্য বলে এই সপ্তাহের শেষে ওর কিছু বন্ধু আসবে এখানে মৌ যেন জবরদস্ত করে মাংস আর রুটি বানিয়ে রাখে।
     মনটা কেমন যেন লাগে মৌয়ের,তবুও বেসিনের আয়নায় গায়ে গোলাপী কুর্তাটা আর লাল রঙের শাড়িটা ফেলে দেখে। ইচ্ছে করে তৃষাকেও দেখাতে,ওদের বাপের বাড়িতে কত মজা ছিলো কিছু একটা কিনলে সারা পাড়া ভেঙে আসতো দেখতে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে মৌয়ের এই নিঃসঙ্গ পুরীতে শুধু একা থাকা। ছয়মাস হয়ে গেলো বাবার কাছ থেকে এসেছে। দহেজ দেওয়ার ভয়ে বাবাও হাত গুটিয়ে নিয়েছে,আজকাল রৌম‍্য ওর ফোনে টাকাও ভরে দেয়না যে ফোন করতে পারবে।
                     কদিন ধরেই রৌম‍্যর খুব ফুরফুরে মেজাজ,মাঝে মাঝেই হোটেল থেকে ভালো মন্দ আনছে। পরশু ওর বন্ধুদের পার্টি দিতে হবে কারণ ওরাই তো ওদের দুজনের জন‍্য খুঁজেপেতে কাজ জোগাড় করে দিয়েছে। মৌ যেন বলে দেয় কি কি লাগবে। তৃষাকে কদিন দেখেনি মৌ,তবে লাইট জ্বলতে দেখেছে রাতে জানলার ফাঁক দিয়ে। ওর নাকি ভালো করবে,কোন খোঁজই নেয়না। অবশ‍্য না নেওয়াই ভালো, এই কদিন রৌম‍্য ওকে আদর করছে,ভালো খাওয়াচ্ছে,জামাকাপড় এনে দিচ্ছে। ওর মেজাজ ভালো আছে,তবে ওর ঐ নেশা করাটাই ভালো লাগেনা মৌয়ের। যাক আর কটা দিন বাদেই তো কাজে বেরোবে,তখন হয়ত সুখের মুখ দেখবে। শুনেছে বাচ্চাদের স্কুলে বাচ্চাদের দেখাশোনার কাজ। ভালোই হবে,ছোট বাচ্চাদের মন ও খুব বোঝে। নিজের পেটটাতেও হাত রাখে মৌ,মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে ওর কোলেও আসবে সন্তান ডাকবে মা বলে।
            দেখতে দেখতে সপ্তাহের শেষদিন এলো,মৌ সকাল থেকেই রান্না করছে। বেশ অনেকটা মাংস,ছোলে,আর ডিম তরকা। বাপরে কত খাবে এরা! একা হাতে সব কিছু রান্না শেষ করে শরীরটা কেমন যেন অস্থির করে মৌয়ের। গা টা গুলিয়ে আসে,ওদিকে আবার রৌম‍্য ফোন করে সব ঠিকমত হচ্ছে কিনা,ও বাড়ি এসে একবার দেখে যাবে একটু বাদেই। বাথরুমে গিয়ে একটু বমি করে মৌ,সকাল থেকে তেমন কিছুই খাওয়া হয়নি। কিন্তু শরীরটা এমন আনচান করছে কেন,উপোস তো ও অনেকদিনই করে। তবে কি?

                 আবার চোখেমুখে জল ছিটোয় মৌ,এবার এসে শুয়ে পরে। দরজায় শব্দ শুনতে পায়,তার সাথে ফোনে রৌম‍্যর রিং বুঝতে পারে রৌম‍্য এসেছে। তবে কি ও ঘুমিয়ে পড়েছিলো তাই রৌম‍্য ফোন করেছে? তাড়াতাড়ি উঠে ভয়ে দরজাটা খোলে। রৌম‍্য একটু বিরক্তি নিয়ে তাকায় ওর দিকে কিন্তু কিছু বলেনা। " এই সময় ঘুমাচ্ছো কেন,খুব খাটনি হয়েছে তাইনা? দেখি কেমন সব রান্না হয়েছে,আরে সব বড়লোক বন্ধু আমার তাছাড়া গুপ্তা তো আছেই ভালো না হলে তো বদনাম হয়ে যাবে। বলেছিলাম হোটেল থেকে এনে খাওয়াবো। তা ওদের আবদার ভাবীর হাতে খাবো।"...রান্নাগুলো দেখে আর চেখে খুশি হয়ে যায় রৌম‍্য," ইশ্ আমার ছোট্ট বউটা কত কাজ করেছে আজ,দেখি একটু আদর করে দিই।"...আদরের মানে বোঝে মৌ,ও একটু বিরক্ত প্রকাশ করে বললো," ছাড়ো আমার তবিয়ত কুছ ভালো নাই,কেমন মাথা ঘুরছে।".." ও আমি আদর করতে চাইলেই মাথা ঘুরে তাইনা? কি হয়েছে শুনি?"..রৌম‍্যর বাধা পেয়ে জেদ চেপে যায়,মৌ জানে কোন লাভ হবেনা,পারবেনা রুখতে ওর জান্তব ভালোবাসাকে। " নাও এবার ঘুমাও যত খুশি,আমি একেবারে সন্ধ‍্যায় ফিরবো। তার আগে সেজেগুজে থাকবে ভালো করে,আমার বদনাম হলে কিন্তু ছাড়বোনা।"
        শরীরটা ভালো না লাগলেও রৌম‍্যর কথায় বিকেল বিকেল গা ধুয়ে লাল শাড়িটা যত্নে গায়ে জড়ায় মৌ,কপালে পরে চুমকি দেওয়া লাল টিপ। বিয়ের সময় দিয়েছিলো বাপের বাড়ি থেকে। চুল বেঁধে,কানে আর গলায় পরে নেয় ওর সাজের বাক্স থেকে দুল আর হার। সোনার টুকটাক যা গয়না দিয়েছিলো তা এখন আর কিছুই নেই। যদিও রৌম‍্য বলে পিশির কাছে রাখা আছে কিন্তু মৌ জানে নেই।
                 প্রথমে রৌম‍্য আসে দেখে মুগ্ধ হয় মৌকে," শাড়িটা তো বেশ মানিয়েছে,একদম চুমু লাগছে দেখতে।"..মৌয়ের আজকাল আর লজ্জায় গাল লাল হয়না তবুও ভালো লাগে। বেশ কিছুক্ষণ বাদে আসে ওর চারজন বন্ধু,আর সাথে গুপ্তা। কেমন যেন একটু ভয় লাগে মৌয়ের,এতগুলো পুরুষমানুষ আর ও একা মেয়ে,নেশা করলে তো রৌম‍্যর কিছু খেয়াল থাকেনা। ফ্ল্যাটের সবটাই তো খোলা এখনো ঘরের ভাগ হয়নি তেমন করে দরজাও বসেনি বাইরের দরজা ছাড়া। তারমধ‍্যেই পরদা টাঙিয়ে ওদের শোবার ঘর। নেশা করতে বসে যায় ওরা,ওদের পার্টি মানেই এটা। এটা ওটা দিতে রৌম‍্য ডাকে মৌকে ,ওর কেমন যেন লাগে ওদের লোলুপ দৃষ্টির সামনে দাঁড়াতে। ওকে দেখেই সবকটা চোখ যেন লোভী হয়ে ওঠে। ওদের হৈ হৈ বেশ তুঙ্গে তখন বেশ রাত হয়েছে মৌয়ের শরীরটা ভালো লাগেনা,দরজার পরদা টেনে শোয়,হঠাৎই রৌম‍্য এসে টান মারে হাত ধরে," একি শুয়ে আছো কেন,খাবার কে দেবে শুনি?".." ঝাঁঝিয়ে ওঠে মৌ," মদ আর কষা মাংস খেয়ে তো পেট ভরালে,আরো খাবে ?".." বুলি বন্ধ কর,খাবার দে চল।"..উঠে আসে মৌ রুটি,তরকা,চানা সব সাজাতে থাকে প্লেটে,নিয়ে যায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে। গুপ্তা বলে," আরে এতদিন আসছি মুখ দেখাই হলোনা ,বুঝেছি মুখ দেখানি লাগবে। আরে সেও আছে। পকেট থেকে সোনার চেনটা এনে,ওর সামনে দুলিয়ে ঘোমটা খুলতে যায়। রুখে দাঁড়ায় মৌ," তফাতে থাকুন,গায়ে হাত দেবেননা।".." আরে রৌম‍্য,এ বলে কি,গায়ে হাত আবার দিলাম কোথায়? তবে এবার দিব,তোমার বর তো মোটা টাকা নিয়ে তোমাকে বিক্রি করে দিয়েছে। আরে স্কুলে চাকরি করবে তো আগে মাস্টারদের খুশ করো।"..পাঁচজন পুরুষ আর একজন নারী,ক্লীব পাষন্ড ওর স্বামী। ঝাঁপিয়ে পরে ওরা মৌয়ের ওপর। মৌ বুঝতে পারে ওকে বাঁচানোর জন‍্য কেউ নেই,এ যুগে কিষণ ভগবান আসেনা। তাই নিজেই চেষ্টা করে নিজেকে বাঁচাতে,ওর বাবা কাকাকে দেখেছে কুস্তি লড়তে। কিছু কসরৎ ও জানে,তাই দিয়ে কাত করে দুটোকে,কিন্তু ততক্ষণে ওর পেটে চেপে বসেছে আরোও দুজন। একজন লাথি মারে, মৌ আর্তনাদ করে ওঠে হায় ভগবান।"শুনতে পায় দরজায় জোরে ধাক্কা অনেকগুলো পায়ের শব্দ। ওরা মৌকে ছেড়ে পালাতে চায় পারেনা। ততক্ষণে বাড়িতে ঢুকে পড়েছে পুলিশ আর সাথে তৃষাও।" আ্যরেস্ট করুন ওটাকে স‍্যার আমি বলেছিলামনা সব প্রমাণ হাতে নাতে দেবো,তাই তো কিছুটা রেকর্ডিং আছে এই ফুটেজে,যদিও সেদিন ক‍্যামেরাটা ঠিকমত।" ....রৌম‍্য হিংস্র চোখে তাকায় মৌয়ের আর তৃষার দিকে। ততক্ষণে প্রায় অচৈতন‍্য মৌ।মৌকে জড়িয়ে ধরে তৃষা,এলিয়ে পরে ওর শরীরটা নিশ্চিন্ত হয়ে পরম নির্ভরতায়।
       হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে মৌ,চোখটা খুলতে ইচ্ছে করছেনা। এখনো পেটে খুব ব‍্যাথা,ওর বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ভালোই হয়েছে হয়ত,তবুও কষ্ট হয় মৌয়ের রৌম‍্যকে যে ও ভালোবেসেছিলো।
           কে যেন ওর মাথায় হাত রাখে,ঠিক যেন ওর মায়ের হাত। শুনতে পায় তৃষার গলা মাসিমণি দেখোতো অনেকটা দিভাইয়ের মত না ও? আমি শাস্তি দিতে পেরেছি দিভাইয়ের খুনিকে।আর কোনদিন মাথা তুলে তাকাতে পারবেনা আর অত‍্যাচার করতে পারবেনা কোন মেয়েকে। ওদের গ‍্যাঙটা আমাদের হাতে ধরা পড়েছে। তাই তো ছায়ার মত অনুসরণ করেছি বদমাশটাকে। বেশ কয়েক বছর আগে একই ভাবে প্রেমের জালে জড়িয়ে মোটা পণ নিয়ে অত‍্যাচার করেছিলো তৃষার মাসতুতো দিদি পরমাকে রৌম‍্য। ওকে জব্দ করতে না পেরে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে সুইসাইড বলে চালিয়ে দিয়েছিলো। ওরা কিছু করতে পারেনি শুধু থানায় ঘোরাঘুরি করা ছাড়া,আসলে একটা বড় মেয়ে পাচারকারী দলের লোক এরা। পরমার বিধবা মা শোকে পাগল হয়ে গিয়েছিলো। আজ হয়ত মৌকে দেখে কিছুটা শান্তি পেলেন স্পর্শ করলেন সন্তানস্নেহে।
                  হয়ত বা আজও অন‍্যায়কারী সাজা পায় কখনো তৃষা কখনো কৃষ্ণ কখনো বা সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়ায়,নিজের জীবনে এটাই বিশ্বাস করে মৌ। আর তাইতো তৃষার মত নিজেকেও শক্ত করে গড়ে নিতে চায় আর সমাজকে দেখিয়ে দিতে চায় নারী মানেই প্রেমিকা বা স্ত্রী নয়,নারী মানেই অসহায় অবলা জীব নয় প্রয়োজনে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে পারে ওরা। ঘাত প্রতিঘাতে পাল্টে যাওয়া মৌ আবার লড়াই করছে প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন‍্য। নিজের জীবনের স্বপ্নগুলো ওকে সাজাতে শিখিয়েছে তৃষা,পরমার মাসতুতো বোন গোয়েন্দা অফিসার তৃষা মিত্র।ভাগ‍্যিস পরমার বিয়ের সময় ওকে দেখেনি রৌম‍্য তবে দেখলেও কি চিনতে পারত আজকের আত্মপ্রত‍্যয়ী তৃষাকে যে অনায়াসে অন্ধ করে দিতে পারে এমন অনেক লালসার চোখকে।
সমাপ্ত:-
           
         

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...