Skip to main content

অক্ষয় সীমন্ত

#অক্ষয়_সীমন্ত#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

গয়নাগুলো ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে রাখে তোতা। কতটুকুই আর গয়না ঠেকাতো অঙ্গে! সেটুকুও আজ খুলে ফেলে রেখে যায়। যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে কি প্রয়োজন আর থেকে? তাছাড়া অমিতও তো সেই পরশু রাতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আর ফেরেনি। ক্লান্ত দাম্পত‍্যের চাইতে মুক্তি বোধহয় অনেক ভালো। পাশাপাশি বালিশে শুতো ওরা দুজনে দুজনের থেকে পাশ ফিরে।অমিত ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলত যেন ওর। কিন্তু একটা সময় ওকে জড়িয়ে না ধরলে অমিতের ঘুম আসতোনা। ইউনিভার্সিটিতে টানা দুবছর তোতার পেছনে পড়ে ছিলো অমিত। কখনও পাত্তা না পেলে বলত," আমি বলেই তোর পেছনে এতদিন তপস‍্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আসলে আমার ঠাকুমাকে দেখতে তোর মত ছিলো। ঠাকুমাকে বলেছিলাম তোমাকেই বিয়ে করবো। কিন্তু ফাঁকি দিলো ঠিক বুড়িটা,ড‍্যাং ড‍্যাং করে স্বর্গে গেলো দাদুর পেছন পেছন।"
মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে বলত তোতা," বেড়ে পাকা ছেলে একটা! ছোট থেকেই বিয়ের শখ!"
       ভালোবাসা,প্রেম,বিয়ে সবই ছিলো ওদের মধ‍্যে তবুও একটুকরো কালো মেঘ যেন উড়ে আসে কোথা থেকে ওদের সংসারে যেদিন তোতা ঝড় বৃষ্টির মধ‍্যে হাত ধরে নিয়ে ফিরলো তাতানকে।দিদি জামাইবাবু দুজনেই হঠাৎ আ্যক্সিডেন্টে মারা যাওয়াতে অনাথ ছেলেটার হয়ত একমাত্র অবলম্বন ছিলো মাসি,তাই ফেলতে পারেনা ওকে। গত আট বছরে নিজেও কোন সন্তান দিতে পারেনি অমিতকে। যদিও আজকাল আর অমিতও কোন আগ্ৰহ দেখায়না বাবা হওয়ার।না পাওয়াতেই অভ‍্যস্ত অমিতের বেশিরভাগ দিনই কেটে যায় ট‍্যুরে।
               অদ্ভুত এক বিরক্তি দেখতে পায় অমিতের মধ‍্যে তোতা। ছেলেটা রাতে ভয়ে কেঁদে ওঠে তাই ওকে কাছে রাখতে চায় তোতা।
" শোনো ওর কেউ যখন নেই ওকে হস্টেলে দিয়ে দাও। অথবা কোন অনাথআশ্রমে। অন‍্যের ছেলে দিয়ে আমাকে ভোলাতে এসেছো? হুঁ দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে চায়।"...মেসোর রাগ দেখে ভয়ে একদিকে দাঁড়িয়ে থাকে তাতান।
" একটু সময় দাও আমাকে,ছেলেটা একটু সামলে নিক। আমি ঠিক একটা ব‍্যবস্থা করে নেবো ওর দেখো।"..
নাহ্ সেই সময় পায়নি তোতা। তাতানকে মাথায় হাত দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে যখন একটু বেশি রাতে এসে ঘরে ঢুকতো দেখতো পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছে অথবা ঘুমের ভান করে আছে অমিত গায়ে হাত দিলে বিরক্ত হয়ে হাতটা সরিয়ে দিতো।
            বড় অচেনা লাগতো অমিতকে তোতার। তাহলে কি ও সন্তান দিতে পারেনি বলেই এত হিংস্র অমিত। দুদিন আগে বলে গেছে এই ছেলে যদি এই বাড়িতে থাকে তাহলে ও আর ফিরবেনা বাড়িতে। হয়ত সেটা সম্ভব নয় আর মেনে মানিয়ে নিতে নিতে বড় ক্লান্ত তোতা নিজেও। তাই তাতানকে নিয়ে তোতা চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে।
                    হাতের চুড়িগুলো খুলতেই চোখ পড়লো শাঁখার দিকে। পলা বাঁধানোটা খুলে রাখে যত্নে। হঠাৎই মনে পড়ে যায় সেদিন অক্ষয় তৃতীয়া। নাহ্ থাক এইটুকু, কে জানে বাঙালী মেয়েদের হয়ত সংস্কার জড়িয়ে থাকে ঐ ছোট্ট লালগুড়ো ভরা কৌটো আর হাতের শাঁখাপলায়।
                 মাঝে কেটে গিয়েছে পাঁচটা বছর। তোতা চলে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছে বহুদিন না ছোঁয়া তোতার শরীরের গন্ধ কখনও রাতের অন্ধকারে ঘোরাঘুরি করে ওদের শোওয়ার ঘরে কখনও বা বারান্দায়। নতুন করে কাউকে ঘরে আনা হয়নি অমিতের হয়ত বা তোতাই ছাড়পত্র দিয়ে যায়নি মুক্তির তাই। প্রথমদিকে রাগে অন্ধ হয়ে খোঁজ নেয়নি তোতার তারপরে খুঁজেছিলো কিন্তু পায়নি। কে জানে এই বিরাট পৃথিবীর হাজার লোকের মাঝে কোথায় হারিয়ে গেছে ওর ঠাকুমার মত দেখতে কালো টানা টানা কাজল চোখের মেয়েটা।
               বেশ কয়েকদিন আগেই বেড়িয়ে পড়েছে অমিত হরিদ্বারের উদ্দেশ‍্যে সেখান থেকে ঋষিকেশ হয়ে রুদ্রপ্রয়াগের পথে আরো এগিয়ে এবার গন্তব‍্য কেদার বদ্রী। অক্ষয়তৃতীয়ার দিন মন্দির খুলবে সেদিনই দর্শন করবে কেদার। ভোরের আলো ফুটবার আগেই বেড়িয়ে পড়েছে হাতে লাঠি পিঠের ব‍্যাগে টুকটাক জিনিসপত্র। বিশ্রাম নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় বেলা পড়ে আসছে। অপরূপ শোভা প্রকৃতির পথে ঝর্ণার ধারা বরফের পাহাড় আর কত নাম না জানা ফুল। হঠাৎই খুব আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়,নেমে যায় বৃষ্টি পথ তখনও অনেকটা বাকি। ঠান্ডায় জমে আসছে হাত পা । তবুও পা কে টেনে নিয়ে যায় অমিত। পথে তেমন কেউ নেই বড় ফাঁকা পথ। এবার একটু চিন্তা হয় অমিতের ততক্ষণে গা গুলিয়ে শরীরটা খারাপ হচ্ছে। হঠাৎই বেশ কিছুটা দূরে দেখা যায় একটা ঘোড়া। গতি বাড়ায় অমিত,গল্প শুনেছে অনেক সময় স্বয়ং মহাদেবও সাহায‍্য করেন ভক্তদের। তাই পৌঁছতেই হবে ওখানে।কিছুটা সময় কিছু মনে ছিলোনা। হঠাৎই শুনতে পায় " অব তবিয়ৎ আচ্ছা তো বাবুজী?" জানতে পারে ঘোড়াওয়ালাকে একজন ওষুধ দিয়েছে ওকে খাওয়াবার জন‍্য। কিন্তু কেউ তো নেই কোথাও। জানতে পারে অমিতকে ঘোড়ায় তুলে নিতে বলে ওরা এগিয়ে গেছে।
               সারা শরীরে শিহরণ জাগে অমিতের তাহলে সত‍্যিই বোধহয় বাবা কেদারনাথই ভক্তদের পাশে দাঁড়ান বিপদে‌।হোমিওপ‍্যাথি ওষুধটা খেয়ে অনেকটা সুস্থ লাগে অমিতের। আস্তে আস্তে ঘোড়ার পিঠে বসে এগোতে থাকে ওরা। ঐ তো এসে পড়েছে ওরা প্রায় দেখা যাচ্ছে মন্দিরের চূড়া পেছনে শ্বেতশুভ্র পাহাড়। অদ্ভুত এক শিহরণ জাগে অমিতের নিজের অজান্তেই হাতটা উঠে যায় ওপরে। হঠাৎই ঘোড়াওয়ালার ডাকে চমক ভাঙে.. "আইয়ে বাবুজী"। পকেট থেকে টাকা বার করতে যায় অমিত কিন্তু চোখদুটো আটকে যায়..তোতা! এগিয়ে এসে ঘোড়াওয়ালাকে টাকা দিয়ে অমিতকে পাশে রেখে এগিয়ে যায় ভিড়ের মধ‍্যে মন্দিরের দিকে। কিন্তু তোতা একা কেন? তাতান কোথায়?হাজার প্রশ্ন নিয়ে অমিত আজ দ্রুতপায়ে ছুটে চলেছে মন্দিরের দিকে,তখনও মাথাটা ঝিমঝিম করছে ওর। তোতাকে আজ কিছুতেই যেতে দেবেনা ও এইভাবে। মন্দির চত্বরে তখন শুধুই ওঁ নমঃ শিবায় ডাক তারই মাঝে খুঁজে পায় তোতাকে অমিত। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন সবাই একবার জ‍্যোর্তিলিঙ্গ দর্শন করতে চায় তখন অমিত আবার একবার খুঁজে পেলো ওর ঠাকুমার মত দেখতে বড় অভিমানী মেয়েটাকে যে আজও তাকে পাত্তা দিচ্ছেনা সেই ইউনিভার্সিটির মত।
               মরিয়া হয়ে আজ তোতার হাতদুটো ধরে ফেলে অমিত এক পরম নির্ভরতায় কিছুই না জেনে যে এতদিন বাদেও কি তোতা ওর আছে কিনা?
  "তোতা,তাতান কোথায়?তুমি একা কেন?"
..."আজ হঠাৎ তাতানের খোঁজ কেন?ঐ ছেলেটার জন‍্য তো একদিন তোমার চোখে অসহ‍্য হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তুমি চলে যাও এখান থেকে। আমার সঙ্গের লোকেরা খারাপ ভাববে।"
..."তুমি বলো তাতান কোথায়? ওর কাছে আমি খুব অপরাধী।"
          বিষন্ন হাসে তোতা," তাতান এখন বড় হয়েছে,একই অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায় ওকে। ওর জন‍্যই ওর মণি সংসার করতে পারেনি।ও এখন হোস্টেলে, আমি যেখানে থাকি সেখানে বড় স্কুল নেই তাই একটু দূরে দিয়েছি। এখান থেকে ফিরেই গরমের ছুটিতে ওকে নিয়ে আসবো।"
          " আমি তোমাদের দুজনের সাথে থাকতে চাই তোতা বড় একা হয়ে গেছি। এখন বুঝতে পারি বড় বেশি করে।"
              আজ অক্ষয়তৃতীয়া,তোতার সিঁথিতে ম্লান হয়ে যাওয়া সরু সিঁদুরের রেখা আবার রাঙা হলো মন্দিরের আশীর্বাদের সিঁদুরের
রেখায়। ভুল স্বীকার করে যে ভালোবাসা আবার ফিরিয়ে দিয়েছে কোন প্রাকৃতিক শক্তি অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ‍্য তিথিতে তা আর ফেরাতে পারলোনা তোতা।  অমিতের থেকে অনেক অনেক দূরে এসে ওর এক পুরোনো বান্ধবীর সহযোগিতায় একটা স্কুলে পড়ায়। ওদের সাথেই বেড়িয়ে পড়েছিলো কেদারের পথে। কিন্তু ভাবলেই অবাক লাগে পাঁচবছর বাদে সেই একই দিনে মুখোমুখি কেন যে এসে দাঁড়ালো ফেলে আসা অতীত যাকে সে ভুলতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি।
              তুষারশুভ্র পাহাড়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে কেদারনাথের মন্দির তখন। মন্দিরের পাশেই হোটেলে তখন রাত জেগে আছে বহুদিন বাদে মিলে যাওয়া দুটো মন। অভিমানে তোতার চোখ দুটো বড় ভেজা আজ,অমিত আস্তে আস্তে কাছে টেনে নেয় ওকে কথা দেয় তাতানকে দেবে নিজের সন্তানের স্নেহ ভালোবাসা আর স্বীকৃতি।যদিও মাঝের পাঁচটা বছর কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু তবুও  হারানো অনুরাগের স্পর্শে তখন বড় রঙিন ওর সীমন্ত। কানে আসে ভোর রাতে মন্দিরের ঘন্টার আওয়াজ,বারান্দায় এসে দাঁড়ায় ওরা। অমিতের হাতে তখন তোতার হাতদুটো ধরা পরম যত্নে। copyright protectedইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
Image source google
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...