"ছি ছি এই বয়েসে শেষে ভীমরতি হলো! একবারও সংসারের কথা ভাবলোনা! আর ভাববেই বা কেন চিরকালই তো এমনি স্বার্থপর ছিলো। নিজে সেজেছে গুজেছে ভালো ভালো শাড়ি পরেছে,গয়না পরেছে। বাবা কি দাপট আমার দাদাকে তো একেবারে পায়ের তলায় রেখেছিলো। বিয়ের পরই বলেছিলাম এতো মাথায় তুলিসনা পরে সামলাতে পারবিনা। তো কে কার কথা শোনে একেবারে বৌয়ের কথায় উঠতো বসতো। এমনটাই তো হবার ছিলো,আরে কতদিন সবাই অন্ধ হয়ে থাকবে। এখন দিন বদলেছে,তাই বর ছেলে মেয়ে কারো কাছে আর পাত্তা না পেয়ে শেষে এই কান্ড।"
" কান্ড বলে কান্ড যে গেলো তো গেলোই তারপর এরা বুঝছে এখন,থানা পুলিশ আরও কত ঝামেলা। অত দেমাক সব মাটিতে মিশলো। যত ভোগান্তি সব সামলাচ্ছে এখন দাদা। মরেও শান্তি দিলোনা এমন মহিলা! তবে বাঁচবে এবার ছেলেমেয়ে আর দাদা। সারাদিন তো ছড়ি ঘোরাতো ওদের ওপর।"
অঞ্জনা মানে যাকে নিয়ে এত কথা কাল ঘুমোতে চেয়েছিলো,অনেকটা শান্তির ঘুম। কতদিন ভালো করে ঘুমোয়না,সারাদিন কত কাজ আর কাজ। একদম ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা দমবন্ধ জীবনের ফাঁকে একটু ছুটি চেয়েছিলো অঞ্জনা। তাই অন্ধকারেই হাত বাড়িয়ে শিশিটা নিয়ে ওষুধ খেয়ে ডুবে গিয়েছিলো একদম অন্ধকারে।
এক সময় কোন বাড়ির মেয়ে ছিলো অঞ্জনা,ছিলো চোখভরা স্বপ্ন,দুহাতে ঠুনঠুন করে বাজতো রেশমী চুড়ি। ওর ভরাট গলায় আবৃত্তি করতো.. বল বীর -
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!
পড়াশোনায় ভালো,খেলাধূলায় জিরো,আবৃত্তি আর ডিবেটে হিরো অঞ্জনার জীবনে হাজার স্বপ্ন থাকলেও প্রেমিক ছিলোনা। মানে প্রেম ট্রেম করার তেমন সুযোগ হয়নি। ঐ সময়টা গল্পের বই পড়ে,গান শুনে আর গুন গুন করে দিব্যি কেটে গেছে। ভালোলাগা হয়ত দু একটা ছিলো তবে ভালোবাসা পর্যন্ত যায়নি সেগুলো। আরে সাহস করে বলাই হয়নি কাউকে ভালোবাসি বা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। তাই সাত তাড়াতাড়ি বাবাই অঞ্জনার উঁচু মাথা একদম মুড়িয়ে দিয়ে বিয়ের টোপর না না মুকুট পরিয়ে দিলেন। অঞ্জনা পড়াশোনার পাট চোকানোর আগেই একেবারে সিঁথি রাঙিয়ে অন্যের সম্পত্তি হয়ে গেলো।
তবে ওর উন্নত শির উঁচু রাখতে আর পারলোনা এখনও কানে বাজে কথাগুলো," মাথাটা নিচু করে দাঁড়াও,একেই তো ঢ্যাঙা লম্বা তার ওপর মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে ধান দুব্বোটা কোথায় দেবো শুনি?"তারপর থেকে মাথা নিচু করে সবার আশীর্বাদ নিতে শুরু করলো অঞ্জনা। " শোনো আমাদের বাড়ির ছেলে খুবই ভালো অনেক শিবপুজো করেছিলে বলে এমন বর পেয়েছো। নাহলে এমন বর পায় কজন মেয়ে?"
পতি পরম গুরু,অনেক জন্মের কর্মফলে পাওয়া মানুষটা আর তার পরিবারের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে দিতে টেনেটুনে প্রায় শেষ হয়ে আসা পড়াশোনাটা শেষ করলেও বন্ধ হয়ে গেলো অঞ্জনার আবৃত্তি,ডিবেট আর বেসুরো গান। ধুসস্ কোথায় ভেবেছিলো একটু বেশি শিখবে,বর হয়ত প্রশংসা করে শেখাবে তা নয়কো সবই নাকি অচল পয়সা আর অঞ্জনা বেগুনের মতই নির্গুণ। খেলায় জিরো হয়েও ফ্যামিলি স্পোর্টসে বেশ প্র্যাকটিস করে একটু একটু করে হার্ডল রেসটা ভালোই দৌড়তো শিখলো। মানে সকালে উঠে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেশ তাড়াহুড়ো করে পরিপাটি রান্না,টুকটাক ঘর গোছানো,জামাকাপড় কাচা,ভাজ করা,মিহি করে আনাজ কাটা সবই। নাহ্ তবুও খুব একটা ভালো কিছু হলোনা। শ্বশুরবাড়িতে শুনলো," আমাদের বাড়ির মেয়েদের মত নয়,দেখো গিয়ে কি সুন্দর গুছিয়ে সংসার করছে শ্বশুরবাড়ির লোক তো প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর এ বাড়ির বৌ এতদিনেও কিছু শিখলোনা,আরে শেখার ইচ্ছে না থাকলে যা হয়।"
আসলে শেখার খুবই ইচ্ছে ছিলো ওর ইচ্ছে ছিলো দেখারও। কিন্তু সমালোচনা শুনতে শুনতে ইচ্ছেগুলো কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছিলো। খুব উৎসাহ নিয়ে কোন একটা রান্না করে বরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো যদি শুনতে পায় একটু প্রশংসা,কারণ জানতো অন্যেরা করবেনা
বর গম্ভীর মুখে খেয়ে উঠবে এমন সময় ছেলেমানুষী করে জিজ্ঞেস করেই ফেলতো," কি গো কিছু তো বললেনা? কেমন হয়েছে?"
" কি বলবো আর,রান্নাটা এখন মোটামুটি পারো তো করতে।তবে সেদিন অফিসে দারুণ একটা জিনিস খেলাম।"
ওদের খাওয়ার টেবিলের আলোচনার মাঝে ওখান থেকে সরে যেত অঞ্জনা।
অন্য গুণগুলো জলে গেলেও পড়াশোনার সার্টিফিকেটের জোরে একটা চাকরি হয়ে গেলো অঞ্জনার। ঘরের সাদামাটা বউ পা রাখলো বাইরের জগতে। "তবে বাপু চাকরি করছো বলে মাথা কেনোনি কারও,তাই ঘরটাও দেখতে হবে। নাহলে কে মাথার দিব্বি দিয়েছিলো চাকরি করার। এই বাড়ির অন্য বৌয়েরা তো দিব্যি আছে।"
অঞ্জনা হার মানেনি বুঝেছিলো দিব্যি থাকাটা ওর দেখা হয়ে গেছে। সকাল থেকে রান্নাঘরে বসে থোড় মোচা আর কলমিশাক বেছে কুটে রান্না করে অবেলায় খাওয়া,আর তারপর পাড়ার বৌদের সাথে তুলনায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট শ্রেণীতে বিরাজ করা। ধ্যাৎ এ আবার একটা জীবন হলো নাকি? তাই সাত ভোরে উঠে রান্না করে ঘামতে ঘামতে একদম ছুটে ছুটে অফিসে যাওয়া তাতে দৌড় থাকলেও ঢের ভালো কারণ তার পরের সময়টুকু তো ওর নিজস্ব।
"তবে ভাই মেয়ে হয়েছো তাই রোজগার করে মাথা কিনে নাওনি,যখন তোমাকে বিয়ে করেছিলাম তখন কিছু করোনা সেটা জেনেই করেছিলাম। তাই চাকরির অজুহাত সংসারে দিয়োনা।" না চাকরি নিয়ে আর মুখ খোলেনি,একদিকে গৃহবধূ আরেক দিকে চাকরি দুই পার্ট বেশ জমিয়ে করার চেষ্টা করেছে প্রাণপণে।
নাহ্ ও কোনদিন বলতে পারেনি," আমিও তো চাকরি করেই আসি তোমার মত,এক গ্নাস জলও কেউ দেয়না আমায়।"..উল্টে বাড়িতে ঠিকমত শ্রম দিতে না পেরে অপরাধবোধে ভুগেছে। শুধু একদিন বলেছিলো," এত কিছু করে কোনদিনও তো কোন সুনাম পেলামনা।"
" ওহ্ তুমি প্রশংসা পাবার জন্য কাজ করো? মন থেকে করোনা। আমি মুখের সামনে এত কিছু বলতে পারিনা। অফিসের লোকজনকে জিজ্ঞেস কোরো কি বলি তোমার কথা জানতে পারবে।"
" আমার সামনে যদি একটু ছোট্ট করেও ভালো না বলতে পারো তাহলে আড়ালে কি বললে তাতে কি এসে যায়?আমি তো আর শুনতে যাচ্ছিনা।"
শ্বশুরবাড়ির মানুষের কাছে ভালো হতে পারবেনা জানতো। তবে স্বামী স্ত্রীর মাঝেও একটা ছোট্ট শব্দ অনেক সময়েই অনেক মুহূর্তকে নষ্ট করে দেয় সেটা ইগো। হয়ত বৌ চাকরি করলে সেটা আরও বেশি হয়। খুব সামান্য কথাতেও শুনতে হয়েছে," ওহ্ চাকরি করো বলে কি তোমার কথায় উঠবো বসবো নাকি?"
নিজের ঘামটা মুছে অঞ্জনা বলে," এখন চা খাবে? না সরবত দেবো?"
ওর কর্তার টিভি দেখার মাঝে ছুটোছুটি করে সামলানো পরের দিনের রান্নার জোগাড় আর টিফিন। তবে ক্লান্ত হলে অভিযোগ করলেই শুনতে হত," এত করো কেন? কে বলেছে করতে?"
" করি কি আর সাধে? না করলে চলবে কি করে?"
"করো যখন তখন আর বলতে এসোনা।"
কে যেন একদিন ওর বুড়ো আঙুল দেখে বলেছিলো কপালে যশ নেই। হাসি পেয়েছিলো ওর,ধুস্ এমন আবার হয় নাকি? নাম যশ নিজেই অর্জন করা যায়।
সাংসারিক অভিজ্ঞতা বুঝিয়েছিলো ভাগ্য বলেও কিছু আছে তাইতো ওর অন্য জায়েরা পারেনা বলেও প্রশংসা পায় আর ও সব করেও শোনে.." এই বাড়িতে এসেছিলে,মানে আমরা বৌয়ের তকমা দিয়েছিলাম বলে তোমার জীবন ধন্য হয়েছে,নাহলে কি যে হত!
ছোটবেলায় যেই কবিতাটা ভালো লাগতো বার বার ঘুরিয়ে শুনতো। এখন বৌবেলায় শোনা কথাগুলো মা বেলাতেও শোনে অঞ্জনা। খারাপ কথা আর খারাপ ব্যবহার কেন যেন ঘুরে ফিরে আসে ছোটবেলায় শোনা প্রিয় গানের মত। ছেলে মেয়েরা দেখতে দেখতে বড় হয়ে গেছে অঞ্জনার। চাকরির ফাঁকে ওদের বড় করতে কতই না চাপ নিয়েছে,কখনো ঝরেছে চোখের জল। কখনো বা ওদেরকে বাড়তি আনন্দ দিতে সাধ্যের বাইরে গিয়ে সুপারমম সেজেছে নিজের একশোভাগ দিয়ে।
কি চেয়েছিলো হয়ত একটু সহানুভূতি বা ভালোবাসা? না পায়নি,বরং মন ভেঙে গিয়েছিলো ওদের খারাপ ব্যবহারে। সবাই বোধহয় নিজের হিসেবটুকুই বোঝে এই জগতে। তাই সন্তানের প্রত্যাখ্যান আর খারাপ ব্যবহার নিতে পারেনি অঞ্জনা। কাল রাতে খুব কেঁদেছিলো মন খারাপে একা,কিছুতেই ঘুম আসছিলোনা। গান শুনছিলো কানে কর্ডটা দিয়ে,'শিল্পী:মান্না দে
শুধু একদিন ভালবাসা
মৃত্যু যে তার পর
তাও যদি পাই
আমি তাই চাই,তাও যদি পাই
চাইনা বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর
চাইনা বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।
সবার মনে খুশির আলো জ্বালাতে গিয়ে কখন যেন নিজের মনটাই অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো বড় প্রেমহীন মনে হয়েছিলো জীবনটা। কি হবে ধুকতে ধুকতে এমন জীবন বেঁচে? তাই ঘুমোতে চেয়েছিলো তাই ওষুধ খেয়ে। কিন্তু একি! ওর মৃত্যুতেও তো কেউ খুশি হয়নি। সবাই ওকে গালমন্দ করছে,বাড়িতে বেশ গুছিয়ে নিন্দার আসর বসেছে। অনেকেই আবার ফিসফিস করছে ওর চরিত্র নিয়ে।" আর বোলনা,ভরা সংসারে তোর আবার দুঃখ কি? দেখো গিয়ে কারও সাথে হয়ত কিছু ছিলো। দিনরাত তো মোবাইল নিয়ে থাকতো।"
কিছু উত্তর দেওয়ার জন্য চিৎকার করে ওঠে অঞ্জনা গলাটা শুকনো,জিভটা ভেতরে ঢুকে গেছে মনে হয়। আওয়াজ বেরোচ্ছেনা একদম। কিন্তু এ কি? এই তো চোখ খুলতে পারছে। তাহলে কি?
ইশ্ কাল দুটো ঘুমের ওষুধ মনে হয় খেয়ে ফেলেছিলো। এই তো দিব্যি বেঁচে আছে ও। চারিদিকে চোখ মেলে তাকায়,মনে পড়ে আজ রবিবার সবাই তাই ঘুমোচ্ছে।
বিছানা ছেড়ে উঠে চোখেমুখে জল দেয় অঞ্জনা। এক কাপ চা করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, কাল রাতে ভালো করে খাওয়াও হয়নি। আজ বিকেলে তো বন্ধুদের সাথে দেখা করার কথা। অনেকবারই ওরা দেখা করেছে শুধু ওরই যাওয়া হয়নি। প্রতিবারই এসেছে সমস্যা একেক রূপে। তবে আজ যাবেই,যে যা বলুক। স্বপ্ন হলেও মৃত্যুকে যেন খুব কাছ থেকে দেখেছে কাল রাতে।
" আরে এই তো অঞ্জনা,ইশ্ কতদিন বাদে তোর সময় হলো। অঞ্জনা,আমাদের সেই আবৃত্তিপাগল ডিবেটে এক নম্বর লম্বু মনিট্রেস। আয় আয় বুকে আয় কত্তদিন তোকে চুমু খাইনি।"..ওহ্ সায়নীটা সেই আগের মতই অসভ্য আছে। গল্পে আড্ডায় কখন যে তিন ঘন্টা কেটে গেলো বুঝতেই পারেনি। হয়ত এই তিনঘন্টায় বয়েসটাও একলাফে পৌঁছে গেছিলো সেই স্কুলের ইলেভেন টুয়েলভের দিনগুলোতে।
" আরে আমরা চাকরি করি ভাই,কেন অত তোয়াক্কা করবো শুনি? অনেক দেখেছি,করেছি সয়েছি সংসারে। আমি তো ভাই বরকে বলে দিয়েছি ছেলে বড় হয়ে গেছে ব্যাস আবার কি এখন নিজের জন্য তো বাঁচবো অন্ততঃ দশটা বছর। তারপর বুড়ি হলে কি হাল হবে কে জানে?তাই আর সময় নষ্ট নয়,এবার ফু দিয়ে চাপ টাপ সরিয়ে শুধু নিজে ভালো করে শ্বাস নেবো। কে কি ভাবলো আর তোয়াক্কা করবোনা।"
"কি বলিস তাহলে ইচ্ছেগুলো মিটিয়ে নিই বল। পরে যেন কোন আফশোষ না থাকে।"
সেদিন অঞ্জনা শিখেছিলো সায়নী,শ্রীলার কাছে আবার প্রেমে পড়া যায়। না না কিছু দেরি হয়নি। নিজের মরচে ধরা অবসাদে ভোগা মনটাকে ও শেখালো, এত অল্পে কষ্ট পেতে নেই, আরে সব কথা অত মাথায় ঢোকালে হয় নাকি? আচ্ছা একটু নিজের মত চললে কেমন হয় মানে বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙো দাও এমন কিছু। কি ভাবছেন আপনারা সংসারে সুখের খোঁজ করতে গিয়ে দুঃখ পাওয়া অঞ্জনা কি প্রেম ট্রেম শুরু করলো না কি এই কোন কমবয়সী ছেলে টেলে খুঁজে।
Comments
Post a Comment