Skip to main content

কলঙ্ক

#কলঙ্ক#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

আয়নার সামনে গিয়ে ব্লাউজটা পরতে গিয়ে আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে শ্রীপর্ণা,হাতটা পেছনে করে অন্তর্বাসটাকে আরেকটু টাইট করে। এবার প্রায় ছয় মাস বাদে আসছে সুনভ অনেকদিন ওর গায়ের সেই পুরুষালি গন্ধটা পায়না। সেই শেষবারের দেখা করার সময়ের স্পর্শ এখনো ছুঁয়ে আছে ওকে,চোখ বুজলেই পায় গন্ধ আর আদরের মিষ্টি ছোঁয়া। পাগল একটা,বাধা দিলে বলে,"যাকে বিয়ে করবো কিছুদিন বাদেই,তাকে একটু ছুঁয়ে দেখবোনা। আমার দ্বারা অত প্লেটোনিক কিছু হবেনা,আর তুমিও কি একটু আদরে ভিজতে চাওনা?"
       মিষ্টি হাসে শ্রীপর্ণা হয়ত তারও মন চায় সুনভকে এমনভাবেই কাছে পেতে আর আদর করতে। তবুও আবার কোথায় যেন একটা সঙ্কোচ জড়িয়ে ধরে,হয়ত সংস্কারও তাই বলে ওঠে,"আমি কি হারিয়ে যাচ্ছি নাকি?আর তো বেশিদিন নয় তারপর তো পুরোপুরি ভাবে একদম তোমার।"
          " ইশ্ একদম মায়েদের যুগের মত রয়ে গেলো বাচ্চা মেয়েটা, এখনো সাবালিকা হলোনা।"
   খুব মজা করেছিলো সুনভ। এবার বারবারই বলেছে আগে থেকে,একটু একটু ছোঁয়া না একটু বেশি কিছু....
                  এর আগে অনেকবারই দেখা করেছে ওরা। শ্রীপর্ণা প্রায়ই জিন্স আর টপ পরে বা কুর্তা। শ্রীপর্ণা শ‍্যামলা,টানা টানা চোখ আর টিকোলো নাক। মুখের আদলে অনেকটা ঠাকুর ঠাকুর ভাব আছে। সবাই শ্রীপর্ণাকে সুন্দরী না বললেও একবার দেখে চোখও ফেরানো যায়না। বন্ধুরা ডাকে আমাদের দক্ষিণী সুন্দরী। সবেই কলেজ পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছে। এক চোখ স্বপ্ন আর সুনভর প্রেমে ডুব দেওয়া শ্রীপর্ণার মুখে খেলা করে একটা অদ্ভুত সুন্দর হাসি। কফিহাউস,বইপাড়া আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে আবার কখনো বা ময়দানের সবুজে পা ডুবিয়ে আর সেল্ফি তুলে সময় কেটে যায় খুশিতে।
             সুনভর সাথে বেশিদিন প্রেম নয়,বছর দুয়েক হবে। তবুও মনে হয় কত চেনা।
  নতুন চাকরি পেয়ে ছেলেটা এখন জামসেদপুরে,ছুটি খুব একটা পায়না। তাই ঠিক হয়েছে শ্রীপর্ণার ফাইনাল ইয়ারের পরেই সোজা ছাদনাতলাতে। এইভাবে প্রেমকে কলকাতায় রেখে বাঁচা যায়না ভালোভাবে।
                    শাড়িটা মায়েরই,ওর খুব পছন্দের। মা খুব একটা শাড়ি পরতে দেয়না,যা উড়নচন্ডী মেয়ে কোথায় উল্টোবে শেষে বা হয়ত নষ্ট করবে যত্নে রাখা শাড়ি। অনেক বলে ম‍্যানেজ করে,নিজেই গিয়ে ডিজাইনার ব্লাউজ কিনে এনেছে। মহারাজের আব্দার,মেয়েদের নাকি সবচেয়ে সুন্দর লাগে শাড়িতেই। তাই এবার একদম নিউ লুকে দেখা। ফেসবুকের ছবি দেখে ভালো লাগে নাকি?
                     ব্লাউজের ফিতেটা নিজেই ঠিকঠাক করে নিয়ে কারুকাজের বন্ধনীতে আবদ্ধ করে নিজের সুডৌল সুন্দর শরীর। "উফফ্ কতরকম কায়দা কানুন এখানে ফিতে ওখানে বোতাম।"
   তবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে সত‍্যিই অন‍্যরকম লাগে। কতদিন বাদে প্রথম ডেটে যাওয়া,এখন এই ডেট কথাটা খুবই প্রচলিত। তবে বৈষ্ণব পদাবলীর শ্রী রাধিকার মত অভিসারই বোধহয় বেশি জমাটি আর মিষ্টি।
                    জায়গাটা ঠিক করাই ছিলো,ঐ তো সুনভ এসে গেছে। সত‍্যি কি সুন্দর জায়গাটা একদম ফাঁকা ফাঁকা।
   " আমি তো চোখই ফেরাতে পারছিনা,একদম সেক্সি, সুন্দরী,শ‍্যামা,তন্বী,শিখর...."
   আর বলতে পারেনা সুনভ। "ইশ্ একদম বাংলা ইংরেজীর চচ্চড়ি বানিয়ে প্রেম নিবেদন। অনেক হয়েছে এবার থাক.."
        ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে ওরা,সুনভর চোখে শুধুই মুগ্ধতা। শ্রীপর্ণার শরীরের গন্ধ ছুঁয়ে যাচ্ছে বারবার।আইলাইনারের ছোঁয়ায় ওর চোখদুটো আজ যেন বড়ই জাদুমাখা। সুনভর হাতটা জড়িয়ে ধরে শ্রীপর্ণার কোমর,কাছে টেনে নেয় ওকে। একটু লজ্জা পেলেও ভালো লাগে ওর। হয়ত ও নিজেও প্রতীক্ষায় ছিলো এই স্পর্শটার।
          " কি সুন্দর লাগছে শাড়িটাতে আর ব্লাউজটা তো.."
    "সব দিকে নজর না? মহারাজের আব্দার মেটাতে আমি তো নাকাল। উফফ্ কত বোতাম আর ফিতে। এখানে কাটা ওখানে কাটা।"
                চামচ দিয়ে কিছুটা খাবার তুলে খাইয়ে দেয় শ্রীপর্ণাকে সুনভ। প্রেমের আদরে ভেজা দুটো মন আর শরীর দীর্ঘ অপেক্ষার অবসানে।
     চাপা গলায় বলে শ্রীপর্ণা," ইস্,হাতটা কোথায়? এই যাহ্ ব্লাউজের ফিতেটা মনে হচ্ছে ঢিলে হয়ে গেলো। এখন কি করবো?"
       ওর কানের কাছে মুখটা নিয়ে সুনভ বলে," আছি তো,ঠিক করে দেবো।"
                    হোটেলের লনটা তখন বেশ ফাঁকা ওদিকে সুইমিংপুলের কাছে দুএকজন আছে। সুনভ আদরে হাত রাখে শ্রীপর্ণার পিঠে,ওর হাতের উষ্ণতা ছুঁয়ে যায় পর্ণাকে। "উঃ তখন থেকে জ্বালাচ্ছো,ফিতে আলগা হয়ে গেলো এই করে। এসো আমি ঠিক করে দিচ্ছি।"
        শ্রীপর্ণার পিঠটা এখন খোলা সুনভর আঙুলগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছে। হঠাৎই থেমে যায় সুনভ," তোমার পিঠের বাঁদিকে এটা কি,দেখি ওর হাতটা নিচে নামে এখানেও একটা ছোট স্পট। পুড়ে গেছিলো নাকি?"
  অবাক হয়ে যায় শ্রীপর্ণা," কই না তো,আমি তো দেখিনি।"
   "দেখা সম্ভবও নয়,একদম পিঠের নিচের দিকটা। শ্বেতী নয়তো?আর কোথাও এরকম সাদা দাগ হয়েছে দেখেছো?"
             শ্রীপর্ণার ইচ্ছে করে পিঠটা দেখতে কিন্তু পারেনা,মোবাইলে একটা ছবি তুলে দেখায় সুনভ।
  এরপর দুজনের কেন যেন আর মনটা ভালো লাগেনা। হঠাৎই  সুনভ বলে,"চলো এবার যাওয়া যাক,তুমি কিন্তু আন্টিকে বলে মাস্ট একটা স্কিন স্পেশালিস্ট দেখিয়ে নিয়ো কিন্তু।"
            ডাক্তার দেখায় শ্রীপর্ণা হ‍্যাঁ ওটা শ্বেতীই তবে কোন ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয় বললেন ডাক্তারবাবু। খুব ভালো করে বোঝালেন সবটা। ওষুধ নিচ্ছে শ্রীপর্ণা তবুও এখন ওর অনেকগুলো জায়গায় সাদা ছোপছোপ। একটু সময় লাগবে ডাক্তারবাবু বলেছেন। আরও দুএকজনের সাথেও পরামর্শ করা হয়েছে।
                  শ্রীপর্ণা এখনো টানটান,সুডৌল,পানপাতার মত মুখ ওর। এখনকার ছেলেদের চোখে সেক্সিও। তবুও শ্রীপর্ণার ব্রেকআপ হয়ে গেলো সুনভর সাথে।
       " শোন,সত‍্যি বলছি বিশ্বাস করো মা কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা।"
   চোখটা মুছে শ্রীপর্ণা বলেছিলো," আর তুমি?"
  "মা তো আন্টির সাথে কথা বলেছে,তোমাকে কিছু বলেনি? এত মন খারাপের কি আছে,তোমার দাগগুলো নিশ্চয় মুছে যাবে। তারপর বিয়েটা হয়ে যাবে। আরে আমি তো আছিই।"
       "আর যদি দাগ না মোছে,আরো বাড়ে তাহলে? তাহলে কি আমাদের ভালোবাসায় দাগ লাগবে?"
          সুনভর চুপকথা মনখারাপের মেঘে ভিজিয়েছিলো শ্রীপর্ণাকে। সবসময় বোধহয় আঘাত দিতে কথা বলতে হয়না,নির্বাক অবহেলা হয়ত আরো বেশি মনকে বোবা করে দেয় বুকচাপা কষ্টে। শ্রীপর্ণা শুধু বললো," আচ্ছা যদি এটা বিয়ের পরে হত,তাহলে তোমরা কি আমাকে ঘরে রাখতে না?"
     "অবুঝ হয়োনা শ্রী,একটু বোঝো। বলছি তো সব ঠিক হয়ে যাবে।"
  "কিছু ঠিক হবেনা আমি জানি,কিন্তু তোমার যদি এমন হত তাহলে আমি কিন্তু তোমার সাথে থাকতাম। যেমন সুচেতা মাসি ছিলো মেসোর সাথে। ফুলশয‍্যার রাত্রে দেখেছিলো গোপন জায়গায়,থাইয়ে দাগ। ওরা গোপন করে বিয়ে দিয়েছিলো। মাসি মেনে নিয়েছিলো,শুধু খারাপ লেগেছিলো ওরা ঠকিয়েছে বলে। এখন তো সারা গায়েই আছে মেসোর দাগ। আমি তো তোমাকে ঠকাইনি।"
       " মেনে নিয়ে টেনেটেনে চলা জীবনের থেকে বোধহয় সময় নেওয়াটাই ভালো শ্রী।"
          সুনভ সময় নিয়েছিলো,শ্রীপর্ণার সাদা দাগটা আরো বেড়েছিলো। আর মনের কালো দাগটা কাঁদিয়েছিলো অনেকদিন,জোর করে ভুলতে চেয়েছিলো সুনভকে আর ওর সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে।
                        মাঝে কেটে গেছে আরো দুটো বছর শ্রীপর্ণার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হয়েছে আগেই। সুনভকে মনে পড়ে মাঝে মাঝে তবে এখন আর তেমন কষ্ট হয়না,ক্ষতটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে। একটা বছর দেহের,মুখের দাগ আর মনের লাল কালো দাগ নিয়ে সত‍্যিই দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলো। সুনভ এখন শ্রীপর্ণার এক্স। যদিও বেশ অনেক আগেই হঠাৎই একদিন সুনভকে আর খুঁজে পায়নি ফেসবুকে। বুঝেছিলো,ব্লক তালিকায় এখন শ্রী ওর এক্সের কাছে।
          শ্রীপর্ণা এখন একটা চাকরি করে,মাইনে যদিও খুব একটা বেশি নয়,তবুও ওর অনেকটা সময় কেটে যায় এখানে। মনটাও ভালো থাকে।
  " মা তুমি আজ একটু গড়িয়াহাটে দাঁড়াবে তো।"
  " কেন রে?তুই তো কিছুই কিনিসনা। তাহলে আবার কি হবে?"
  " কিনবো এবার। আমি এখন রোজগার করি মামণি সোনা।"
      মাকে আদর বেশি করলে এমন কত নামেই ডাকে।
             হাসে শ্রী,ওর নিয়মানুবর্তিতার চূড়ান্ত রূপ মাম্মিজী হাজির। এই মানুষটা তো এখনও ঠ‍্যালা মেরে উঠিয়ে,খাইয়ে অফিসে পাঠায় আবার মন খারাপেও আশ্রয় পায় মায়ের কাছেই। আগে হয়ত বুঝতোনা,এখন খুব খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে ঐ খিটখিটে, হাঁটু ব‍্যথার রোগী,মোটু মা টাকে। ওকে আগলে রেখেছে যে জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপে।
            দোকানে ঢোকার মুখে একটু থমকে যায় রীতা,শ্রীপর্ণার মা। বছর তিনেক আগে শেষ এসেছিলো এখানে। তার আগে তো কতই আসতো যে কোন অনুষ্ঠান হলেই। ওর বেশিরভাগ গয়নাই এখান থেকে করানো। শেষ কিনেছিলো একটা নেকলেস আর দুলের সেট,নিজের পুরোনো নেকলেস এক্সচেঞ্জ করে। যদিও খুব মন খারাপ করেছিলো শ্রীপর্ণা মায়ের গয়না ভাঙতে হচ্ছে বলে।" আরে আমার কি এখন ঐরকম জমকালো হার পরার বয়েস আছে নাকি?"
        শ্রীপর্ণা বুঝেছিলো,মা নিজের গয়না দিয়ে বাবার খরচের চাপ কিছুটা হাল্কা করতে চায়। সেই সময় খুবই খারাপ লাগলেও কিছু বলতে পারেনি। সামনেই তো মায়ের জন্মদিন, তাই জন্মদিন পুজো মিলিয়ে ইচ্ছে মাকে একটা সুন্দর লকেট আর কানের দুলের সেট কিনে দেবার।
                  এই দোকানের সবাই মোটামুটি ওদের চেনা। দোকানের কর্ণধার শ্রীনন্দা,ওর বুদ্ধিতে আর প্ল‍্যানে বাবার মৃত‍্যুর পরও ব‍্যবসাটাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। ছোটবড় প্রত‍্যেক ক্রেতাকে একদম নিজের মত করে ওদের পছন্দ অনুযায়ী গয়না দেখায়। শ্রী ঢুকেই একবার দেখে নেয়,আজ মনে হয় নেই। ওদের দুজনের নামের বড্ড মিল এই নিয়ে এর আগে শ্রীনন্দা মজাও করেছে। " দিদি নেই?"
         "না ম‍্যাডাম একটু বেড়িয়েছেন। কি লাগবে বলুন আমি দেখাচ্ছি।"
             মায়ের গলায় একটা করে লকেট দিয়ে সাজাচ্ছে আর দেখছে আয়নায়। এ যেন মা দুর্গাকে গয়না পরানো। মায়েরা বোধহয় কোনকিছু ছাড়াই শুধুমাত্র মাতৃত্বেই অনন‍্যা। যতই মা বলে," এটা তো সুন্দর দেখতে,এটা নিয়ে নে।"
"মা এটা খুবই হাল্কা,তুমি সবসময় কোনটার কম দাম সেটাই দেখো আর বলো এটা বেশ ভালো। আমার যেটা পছন্দ সেটাই নেবো।"
               পেছন থেকে হঠাৎই শুনতে পায়," অনেকদিন বাদে শ্রী..আমি তো ভাবলাম এতদিনে.."
    বাকি কথাটা মুখেই থেকে যায় শ্রীনন্দার সামনে আসতেই দেখে শ্রীপর্ণার, ঠোঁটের কাছে,চোখের পাশের দাগগুলো। হাসিখুশি উচ্ছ্বল ঝর্ণার মত মেয়েটার ক্লান্ত মুখের হাসিটা বলে দেয় অনেক কিছুই। নিজেকে সামলে নেয় শ্রীনন্দা একমুখ হাসি নিয়ে বলে.." শ্রী তো?দেখেছো বন্ধুর নামটা কেমন মনে রেখেছি। অনেকদিন বাদে আসা হলো মা আর মেয়ের।"
  ..." একটা ভালো লকেট দেখাওনা দিদি মায়ের জন‍্য,এগুলো ঠিক.."
  " আচ্ছা আমি দেখছি দাঁড়াও,পছন্দ তো করাতেই হবে আমাকে।"
           শ্রীনন্দা নিজে দায়িত্ব নিয়ে ঠিক পছন্দমত জিনিস দিলো ওদের। খুব পছন্দ হয়েছে গয়নাটা দুজনেরই। এইজন‍্যই দোকানে এলে আগেই দিদির খোঁজ করে।
                     " থ‍্যাঙ্ক ইউ দিদি,তুমি না এলে আমি তো পছন্দই করতে পারতাম না।"
    মিষ্টি হাসে শ্রীনন্দা.."থ‍্যাঙ্ক ইউ তো আমার বলা উচিত আমার নতুন কাস্টমারকে। এতদিন মা ছিলেন,এখন থেকে তুমি হলে।"
          হয়ত এই ব‍্যবহারটাই শ্রীনন্দাকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে ভালো ব‍্যবসায়ী হিসেবে।
  .." কি করছো এখন?"
শ্রী উত্তর দেওয়ার আগেই ওর মা বলে ওঠে.." আসলে ওর বিয়েটা তো ভেঙে.."
   সামলে নেয় শ্রীনন্দা ," তাতে কি? শিরদাঁড়া তো ভাঙেনি। তাহলে মুশকিল ছিলো।"
                শ্রীর অন্ধকার মুখটা দেখে খুব খারাপ লাগে তাই মুড ফেরাতে বলে," আচ্ছা দেখো তো এই হারটা কেমন? একদম নতুন এসেছে। তোমাকে খুব সুন্দর মানাবে। দেখি দেখি হারটা এদিকে দাও তো।"
        শ্রীকে কিছু বলতে না দিয়েই শ্রীনন্দা ওকে হারটা পরিয়ে দেয়। চোখের কোলটা একটু ভিজে ওঠে শ্রীপর্ণার ওর মা তখন কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতিতে ওর দিকে তাকিয়ে। হঠাৎই ঘোরটা কেটে যায় ওর,মোবাইলের ক্লিকটা কানে শুনে।
      " এই দেখো আমি ছবিও তুলে নিয়েছি তোমার, কি সুন্দর মানিয়েছে দেখো। তোমার নম্বর তো পেয়েই গেছি ফর্মে আমি পাঠিয়ে দেবো হোয়াটস আ্যপে। সত‍্যিই খুব মিষ্টি তুমি।"
                     শ্রীনন্দা জানে,হয়ত বা বোঝেও মেয়েটার কষ্ট তাই একটু ছুঁয়ে দিলো ওর মনটাকে ভালোবাসার ছোঁয়ায়। নতুন বিয়ের পর যখন ক‍্যানসারে ওর ব্রেস্টটা... না থাক আর মনে করতে চায়না সেই কুৎসিত কথাগুলো। সবাই তখন জানতে চেয়েছে দুটোই কি বাদ গেছে? নাকি একটা? কতটা বাদ গেছে?
                ওর ধনী শ্বশুরবাড়ির আধুনিক বর উপাধি দিয়েছিলো ওম‍্যান উইদাউট বুবস্। নতুন বৌয়ের তো ক্লিভেজই দেখা যাবেনা,তাহলে আর হট সেক্সি লুক আসবে কোথা থেকে! ধুসস্ কত প্ল‍্যানিং ছিলো। তারপর কথা হয়েছে আরো,বংশে কারো ছিলো নিশ্চয় ইত‍্যাদি। মাথা উঁচু করে ফিরে এসেছিলো শ্রীনন্দা...সময় লেগেছিলো অনেকটাই ক্ষত শুকোতে। তবুও এখনো স্বপ্ন দেখে শ্রীনন্দা,ভালোবাসে নিজেকে। খুশি করার লোক লাগবে কেন?নিজেই তো নিজেকে খুশি রাখা যায় সবচেয়ে বেশি। শ্রীনন্দাকে বাবা বুঝতে দেননি কিছুই,তবে সবার বাবার অবস্থা তো ওর বাবার মত নয়।
          ...........................................
            সুনভর মা অনেকদিন ধরেই খোঁজখবর করছিলেন ছেলের বিয়ে দেবার জন‍্য।বাবা! ভাগ‍্যিস বিয়েটা হয়নি ঐ মেয়েটার সাথে,না হলে কি যে হত! শুনেছে ঐ মেয়ের দাগ তো মোছেইনি উল্টে আরো ছড়িয়েছে।
     এবার আর ভালোবাসার বিয়ে নয়,একদম ঘষে মেজে আর দেখে শুনে পাত্রী যাচাই। মায়ের বাড়ি থেকে বাবার বংশ সবটা যাচাই করে মেয়ে ঠিক করা। এই মেয়ের গায়ের রঙটাও ভালো। আসল তো বাপু ঐ রঙটাই,ওতেই নব্বইভাগ সুন্দরী। ওটি না থাকলেই তখন বলা হয়,মুখটা কিন্তু মিষ্টি অথবা চোখটা টানা বা নাকটা চোখা ঐ মানে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা।
                          বিয়ের কেনাকাটা শুরু হয়েছে আজই সুনভ এলো। ছেলে আর হবু বৌমা দুজনকেই লাগবে অন্ততঃ শাড়ি আর গয়না কেনার সময়। ওদের বাড়ির কাছেই নতুন গয়নার দোকানের উদ্বোধন হবে আজই তাই সুনভর মায়ের ইচ্ছে প্রথম কাস্টমার হিসেবে কেনাকাটা করা ওখান থেকেই কারণ আজ অনেক অফার,উপহার সব আছে।
                     ওরা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পিউ মানে হবু বৌমাকে আগে তুলে নেয় গাড়িতে। পিউ ফর্সা তাই সব রঙই ওকে মানায়। গাঢ় সবুজ কুর্তি আর লাল ওড়নায় ভালো লাগছে ওকে তবুও সুনভ বলে," শাড়ি পরলে পারতে আজকে,আই লাভ শাড়ি।"
              ওরা দোকানের সামনে আসতেই অভ‍্যর্থনা পায় খুব সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো দোকানটা। ভেতরটা ঝকঝক করছে,সুনভর মা নেকলেশ দেখতে চান,ওরা বলে দেয় দোতলায় যেতে। দোতলায় গিয়ে অদ্ভুতভাবে সুনভর পা আটকে যায় মাটিতে। " কি হলো,আয় এদিকে?"
  ওর দিকে তাকাতে গিয়ে একটু থমকে যান ওর মাও।বিরাট শোরুমের দুপাশের দেওয়ালে আটকানো দুটো ছবি..ব্লক করলেও মুখটা আজও ভোলেনি সুনভ ঐ তো শ্রীপর্ণা। প্রথম ছবিতে গলা জুড়ে সুন্দর নেকলেশ আর কানে দুল। পরের ছবিতে পেছন ফেরা শ্রী,পিঠের অনেকটা দেখা যাচ্ছে হাত দিয়ে চুলটা সরাচ্ছে সামনে হাতে চকচক করছে আঙটি আর গলার হারের বড় লকেটটা ঝুলছে পিঠের ওপর।
            শ্রীপর্ণার টানটান পিঠ,পানপাতার মত মুখটা যেন আরো বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে গয়নার সাজে। দাগগুলো আছে বলেই হয়ত চোখটা ফেরানো যাচ্ছেনা।
                         কাউন্টারে দাঁড়িয়ে শ্রীনন্দা.." ওয়েডিং কালেকশন তো।"ইশারায় বাক্সগুলো দিতে বলে।
       " আচ্ছা আপনাদের মডেল যে সেটদুটো পরেছে সেগুলো আছে?"পিউ বলে।
       "নিশ্চয় আছে,তবে একটু এক্সপেন্সিভ। আজ সকালে প্রথম আ্যডটা বেড়িয়েছে ম‍্যাগাজিনে তারপর থেকে সবাই ওটাই চাইছে। কত ফোন যে আসছে।"
                           সুনভ আর ওর মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। পিউ একটা করে নেকলেশ গলায় দিচ্ছে আর ওর দিকে তাকাচ্ছে। কেন যেন মনে হলো অনেক দাগ নিয়েও যে মণিহার শ্রীর গলা আলো করে আছে তা পিউর গলায় মানাচ্ছেনা।
                বেরোনোর সময় সুনভ দেখলো সারা দোকান জুড়েই আজ নানা সাজে শুধুই শ্রীপর্ণা।
এসিতেও কেমন যেন দমবন্ধ লাগছিলো সুনভর।
          গাড়িতে বসে একটু ভালো লাগলো। এক্সাইডের সিগন‍্যালের কাছে গাড়ি দাঁড়িয়ে, বাইরে চোখ চলে যায় সুনভর। অনেক অনেক বড় একটা হোর্ডিংয়ে শ্রীপর্ণা, হয়ত বা আগের চেয়েও অনেক বেশি পরিণত আর ব‍্যক্তিত্বে ঝলমল করছে।
                      ...অফিস থেকে ফিরেছে শ্রীপর্ণা,বিছানার পাশে সেলফোনটা বাজছে।
   "হ‍্যালো"..
  " আমি বলছিলাম শ্রী,আমি কলকাতায়.. যদি একবার।"
"শরীরের দাগগুলো মুছতে না পারলেও মনের দাগগুলো আমি মুছে ফেলেছি সুনভ। আমার জীবনে তুমি একটা ছেঁড়া খাতা যাতে আর নতুন কোন গল্প লেখা যায়না।"
      ফোনটা রেখে দেয় শ্রীপর্ণা, চোখটা কি একটু ভিজলো? হতে পারে,তবে কষ্টে নয় নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে। থ‍্যাঙ্কস শ্রীনন্দাদি, তুমি বলেছিলে মডেলিং করতে,একবার ফিরে দেখতে আর ঘুরে দাঁড়াতে। আমি পেরেছি,সত‍্যিই আমি পেরেছি।"
       হোয়াটস আ্যপটা খুলে শ্রীনন্দার পাঠানো প্রথম দিনের ছবিগুলো আবার দেখে শ্রী,সাথে ক‍্যাপশনটাও..."চাঁদে কলঙ্ক আছে বলেই তো চাঁদ এত সুন্দর।"

                       

         
   

  
                    

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...