পরকীয়া_নাকি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চোধুরী#
বোল্ড,ডার্ক,টল এন্ড সেক্সি উইথ ডিপ এন্ড ডার্ক আইজ এখনকার দিন হলে হয়ত ছেলেরা এইভাবেই ফেসবুক বা হোয়াটসআ্যপে টেক্সট করতো চিরশ্রীকে হয়ত বা রেড গাউন বা স্লিভলেস টপে দোলা দিত অনেক ছেলেরই মনের দোলনায়। তবে তখনকার দিনে তো এইসব ছিলোনা তাই বেশ কয়েকবার কাজলনয়না হরিণী বা গভীর কালো চোখের দক্ষিণী নায়িকা ছাড়া আর বিশেষ কিছু শোনা হয়নি সদ্য যৌবনে পা রাখা চিরশ্রীর। আর তারপর যৌবনের রূপ,রস আর গন্ধ পুরোটাই একসময় সাতপাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে গিয়েছিলো ছাদনাতলাতে। যদিদং হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম। তোমার হৃদয়ের সমস্ত বাসনা আর খবরাখবর আমার হয়ে থাক আর আমার সব ইচ্ছেগুলো আর মনের খবর তোমার মনের গভীরে থাক।
নরম হাল্কা শোলার মুকুটটা পরে পায়ে আলতা আর গাছকৌটো হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলো চিরশ্রী বরের কড়ে আঙুলটা শক্ত করে ধরে। বাবা যে তুলে দিয়েছিলেন কিছু মন্ত্র পড়ে নিজের আদুরে দুচোখে স্বপ্নভরা শ্যামলা ঢ্যাঙা মেয়েটাকে অন্যের হাতে। কম বয়েসে বিয়ে দিয়ে সেরেছিলেন কর্তব্য বলেছিলেন সুখী হও। আশীর্বাদটুকু বাবার দেওয়া ছিলো আর লড়াইটা ছিলো চিরশ্রীর,ভালো সন্তান হওয়ার প্রমিস নিয়ে শুরু হওয়া জীবনে এবার ধীরে ধীরে অনেক প্রমিসের পালা সত্যিই প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারেনি বিয়ের ঘোরে।
ফুলশয্যার আর বাসরের রাতে অভিমন্যুর সাথে গল্পই হয়েছিলো বেশি। হাসতে হাসতে অভিমন্যু দিয়েছিলো সংসারে ভালো বৌ হওয়ার পাঠগুলো মানে এখন যেগুলো বলে ডুজ এন্ড ডোন্ট। " শোনো বাড়িতে প্রথমেই শুনবে কে কি বলছে। যা খারাপ লাগবে উত্তর দিয়োনা। আমায় বোলো। আর শোনো আমি কিন্তু সেই পুরুষদের মত নই যারা বৌয়ের সায়া ব্লাউজ কেনে,রোদে শুকোতে দেয়।ওসব আমার দ্বারা হবেনা কোনদিনই।"
..তারপর থেকে অনেকদিন শুধুই শুনে গেছে চিরশ্রী। সেই শোনার মধ্যে ছিলো অনেক কিছুই,এই যেমন 'মা বাবা কিছুই শেখায়নি, চিরশ্রীর জন্য ওর বর পাল্টে যাচ্ছে। এমনটা ছিলোনা। ছেলের বিয়ে দিয়ে ভীষণ ঠকে গেছেন ওনারা। একটা অকর্মা, কুরূপা,মুখরা মেয়েকে বাধ্য হয়েই বৌ করতে হয়েছে।যখন মেয়ে দেখেছিলেন তখন এই সমস্ত গুণাবলী বোঝেননি তারা এই সব।
অভিমন্যুর কাছে শুয়ে রাতে ওকে বলতো চিরশ্রী কখনো বা কাঁদতো," শোনো ওরা না আমাকে এইসব কথা বলছিলো। আচ্ছা আমি কি সত্যিই এমন? সত্যিই আমি তোমাদের মনের মত হইনি।"
"ওহ্ এই শুরু হলো তোমার! সারাদিন কাজের পর বাড়ি এসে এইসব শুনতে কার ভালো লাগে? বাদ দাওনা এই সব। সব মাথায় ঢোকাও কেন?"
অভিমানে মনটা কানায় কানায় ভরে যেত চিরশ্রীর। সব কথা বাবা মাকেও বলা যায়না,ওরা মন খারাপ করবে। তাই বলে আবার "তুমি তো ভালো করে শুনলেই না কিছু। কিছু বলবেনা তুমি।"
" প্লিজ চুপ করো এবার,আর ভালো লাগছেনা। তুমি কি চাও আমি বাড়ির লোকেদের কাছে খারাপ হই? সম্পর্কগুলো ভেঙে যাক আমার তোমার জন্য?"
না না সম্পর্ক নিজেও ভাঙতে চায়না চিরশ্রী। অভিমন্যু যখন ওকে কাছে টেনে ওর ভাঙা মন আর ক্লান্ত শরীরটাকে আদর করতো তখন কাছে এসে আস্তে আস্তে বলতো "সংসারটা তোমার চিরশ্রী,আমিও তোমার।তোমাকেই বুঝে নিতে হবে তোমার অধিকার।"
সংসারটা নিজের ভেবেই সাজানো শুরু করেছিলো একটু একটু করে চিরশ্রী। কখনো ছোট ছোট পুতুল কিনে,কখনো বা নিজের আঁকা ওয়াল হ্যাংঙ্গিং দিয়ে আবার কখনো সাধ্যের অতিরিক্ত পরিশ্রম করে সবার মুখে দেখতে চাইতো আত্মতৃপ্তির আনন্দ। তবুও অনেক কিছুর বিনিময়ে ভালো শব্দটা শুনতে পাওয়াটাই বোধহয় দুষ্কর অনেকেরই জীবনে। মেয়েমানুষকে ভালো বলা মানেই হয়ত তাকে তোল্লাই দেওয়া হয়। ফলের আশা নাকি করতে নেই,সত্যিই তো হাত বাড়িয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ফল পাড়া তো মুখের কথা নয় তাই আশা না করাই ভালো।তবুও সবারই তো ইচ্ছে করে ফল পেতে,তাই ফল পেতে চাইলে দোকান থেকে কিনে নাও। কোথায় যেন একটা পড়েছিলো ভেবেই হাসি পেলো কথাটা।
বিয়ের পর থেকেই সংসারের পরীক্ষায় পাশ করতে চেয়েছিলো চিরশ্রী কিন্তু নাহ্ সংসার স্কুলে পড়াশোনা করতে করতে চিরশ্রী পার করেছে অনেকগুলো বছর। ছেলেমেয়ে হয়েছে তাদের বড় করেছে। নিজের অর্থ,শ্রম,দেহ আর যৌবন সবটাই উজাড় করে দিয়েছে সংসারে। একটু একটু করে পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় আর ধৈর্য্য সবই বেড়েছে কিন্তু তবুও ফল শূন্য। সত্যিই বোধহয় ছোট থেকে খেলনা বাটি আর পুতুলের বিয়ের মতই একটা মিথ্যে ঘরের আশাতেই সংসার সাজায় মেয়েরা। নিজের বলে কিছুই হয়না শেষবেলায়।
অনেক পরিশ্রম আর রান্নাঘরে ঘাম ঝরিয়ে গরমের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর পর আজও মধ্যবয়স্কা চিরশ্রী অপেক্ষা করে একটু ভালো শোনার জন্য। আচ্ছা দুটো বর্ণের সমষ্টিতে বানানো যুক্তাক্ষর রহিত শব্দটা উচ্চারণ করতে কতই যে কষ্ট হয় মানুষের কে জানে। আজকাল সমালোচনা বিদ্ধ হতে কেন যেন আর ভালো লাগেনা ওর। মাঝবয়েসী চিরশ্রী আর কেন যেন পজেটিভ হতে পারেনা,মাঝে মাঝেই ডিপ্রেশনে ভোগে মনে হয় যদি আরেকবার নিজের পছন্দের কাজগুলো করতে পারতো। সত্যিই তো কিভাবে দিনগুলো চলে গেলো,কত পছন্দের শাড়ি,কুর্তা,গয়না পরে পরবে বলে রেখে দিয়েছিলো। এখন শরীরের খাঁজে খাঁজে মেদ,শিথিলতা আসছে চামড়ায়,গলায় আসছে ভাজ সব শাড়ি গয়না এখন আর মানায়ও না।হয়ত মশলার শিশি গোছানো,রান্নাবান্না, ঘরকন্না আর ঝিঙে,বেগুন ফ্রিজে গুছিয়ে তোলার ফাঁকে সেগুলোর ভাজ খুলে পরাই হবেনা। বাড়ির কেউ খারাপ ব্যবহার করলে আজকাল চিৎকার করে কথা বলার চেয়ে চুপ করে থাকতেই বেশি ভালো লাগে।
সেদিনই পাশের বাড়ির মাসিমা বলছিলেন,"তোমার কি মন খারাপ বৌমা?আগে তো বেশ হাসিখুশি থাকতে। এখন তো বাপু সুখের সংসার। মন দিয়ে সংসার করো,ছেলেপুলে তো বড় হয়ে গেছে।" হয়ত সেখানেই একটা শূন্যতা চিরশ্রীর। অভিমন্যু যেন আজকাল আর ভালো করে খেয়াল রাখেনা ওর।অথচ হরমোনের থাবায় চিরশ্রীর মনের দেওয়ালে এখন কত ফ্যাকাশে রঙের আনাগোনা,কে তার খবর রাখে।
এক এক দিন রাতে জোরে চেপে ধরে অভিমন্যু তেমন সাড়া দিতে পারেনা চিরশ্রী। "সত্যিই তুমি বুড়ি হয়ে গেছো। নাহ্ আর চলবেনা।"..অভিমান হয় ওর," সারাদিন কত কাজ থাকে বলতো,পায়ে ব্যথাটাও খুব বেড়েছে।"
"হাঁটবেনা,চলবেনা তো হবেনা একদম ঘরে বসে থেকে বুড়ি হয়ে যাচ্ছো।"
বুড়ি শব্দটা কানের মধ্যে বড় কর্কশভাবে বাজে চিরশ্রীর। আচ্ছা অভিমন্যু কি বুড়ো হয়নি?হয়ত একটু বেশি জোরেই হাঁটতে পারে। কিন্তু পাকা চুল,দাড়ি চামড়া সবই তো বলে যায় বসন্ত চলে যাবার বার্তা। নাকি পুরুষদের জীবনে সত্যিই চিরবসন্ত থাকে! অবাক হয়ে যায় চিরশ্রী,যার কড়ে আঙুল ধরে একদিন আপনজনদের ছেড়ে চলে এসেছিলো তার ব্যবহারে। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা যেন কেমন ব্যবহার করা ন্যাপকিনের মত লাগে মানে মুখ মোছা হয়ে গেছে ফেলে দাও এবার অযত্নে ডাস্টবিনে।
রঙচটা নাইটিতে ঘাম মুছতে মুছতে সকালের অভিমন্যুর অফিসের খাবার বাড়তে বাড়তে নাকে আসে ঝাঁঝালো পারফিউমের গন্ধ,অভিমন্যু আজকাল একটু বেশিই গায়ে গন্ধ ছড়ায়। কই আগে দেখেনি এমন,কিছুদিনই দেখছে। বন্ধুদের সাথে যখন খুশি বেরোচ্ছে,আজকাল জিজ্ঞেস করলেও অসন্তুষ্ট হয়। বলে," কাজ আছে তাই বেরোচ্ছি,তোমার কৌতূহল যেন আজকাল খুব বেশি বাড়ছে।"
নিজেকে খুব ছোট লাগে চিরশ্রীর,ওর একান্ত কাছের মানুষটা কোথায় যাচ্ছে কখন ফিরবে সেটা জানা কত নম্বর ক্রাইমের অন্তর্ভুক্ত মাথায় ঢোকেনা চিরশ্রীর। অভিমন্যুর হার্টের সমস্যা ধরা পড়ার পর থেকেই খুব কম তেলে নিজে রান্না করে চিরশ্রী ওর পছন্দমত। প্রথম যেদিন ওর বুকে ব্যথা হয় পাগলের মত ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি করেছে। আজকাল অভিমন্যু প্রায়ই সিগারেট খায়,বন্ধুদের আসরে ড্রিঙ্ক নিয়ে বসে। ছেলেমেয়েদেরও নিজেদের জগত হয়ে গেছে। একরাশ শূন্যতা মাঝে মাঝেই হাজার কাজের মাঝে ঘিরে ধরে চিরশ্রীকে। শুধু মনে হয় খুটিনাটি দিয়ে তিলতিল করে গড়ে তোলা সংসারটা কেমন যেন বেসুরো সুরে বাজে আজকাল।
চিরশ্রীর সারাদিনের সঙ্গী আজকাল স্মার্টফোন, আবার কখনো কিছুই ভালো লাগেনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। অনেকগুলো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসে পড়েছিলো অনেকদিনই,আজ একটু সময় পেয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎই পছন্দ হয় একটা প্রোফাইল। খুব সুন্দর সুন্দর ছবি আর কবিতা দিয়ে ভরানো একদম রঙচঙে প্রোফাইল। একসময় কলেজের খাতাতে কত কবিতা লিখতো ,আবৃত্তি করতো,টুকটাক গানও গাইতো,আরও অনেক কিছুই করতো। ছবিও আঁকতো,সুন্দর আলপনা দিতো,সেলাই করতো। একটু একটু করে সেগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে! অথচ ভেবেছিলো বিয়ের পর কিছু একটা শিখবেই শিখবে। কিন্তু হয়নি,যেটুকু জানতো সেটুকুও হারিয়ে গিয়েছিলো অনভ্যাসে।আজকাল তো ইচ্ছেগুলোও মরে গেছে। সারাদিনের কাজের ফাঁকে সময় পেলে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে ফোনটা হাতে অথবা চোখ বুজে। বন্ধুত্বটা নিয়েই নিলো চিরশ্রী,সবুজ নামটা। মনে হয় কোন ছেলেই হয়ত হবে,তবে সত্যিই খুব সুন্দর রুচি। যাক ভালো ভালো ছবি দেখা যাবে,কবিতা পড়া যাবে,আঁকাগুলোও দেখবে মাঝে মাঝে।
মাঝে গড়িয়ে গেছে একটা মাস।" তোমার হলো?আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরোবো।খেতে দাও।"অবাক হয়ে যায় চিরশ্রী,"কই আগে তো কিছু বলোনি,কেন তাড়াতাড়ি বেরোবে?"
"আজকাল যেন কেমন হয়ে যাচ্ছো! সব জিজ্ঞেস করো,কবে,কোথায়,কেন?আমার কি কোন স্বাধীনতা নেই নাকি?ফোন এলে জিজ্ঞেস করো কার ফোন।"
হঠাৎই চিৎকার করতে ইচ্ছে করলো চিরশ্রীর নাহ্ পারলোনা,রান্নার ফাঁকে দুফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে এলো গাল বেয়ে। আত্মসম্মানে লাগলো খুব।শুধু বললো আস্তে আস্তে," আমি তো আগেও জিজ্ঞেস করতাম তোমায়। বাড়ির লোকের তো জানা দরকার তুমি কোথায় যাচ্ছো। যদি কোন বিপ..." বাদবাকি কথাটা জিভে আটকে যায় চিরশ্রীর কপালে হাত ঠেকায়।
" আমার নিজেকে বন্দী মনে হচ্ছে। উফ্ কি যে পরাধীনতা এই বিয়ের শিকল!সব বৌকে কৈফিয়ৎ দিতে হবে। হাঁচো,কাশো সব।"
হয়ত এমনি হয়,অথচ নিজের হসপিটালে ভর্তির দিনগুলো, ডাক্তার দেখানোর দিনগুলো কেমন যেন আবছা হয়ে গেছে অভিমন্যুর স্মৃতি থেকে। হয়ত ছেড়েছে অনেক কিছু অভিও,তবুও চিরশ্রী কি কিছুই দিতে পারেনি সংসারে!কিছুই কি ছাড়েনি?
অভিমানে অনেক অভিযোগই আজকাল ট্যাবলেটের মত চোখের জলে গিলে নেয় চিরশ্রী।
বেশ কয়েকদিনই চিরশ্রীকে একটু বেশিই মোবাইলে থাকতে দেখে অভিমন্যু। অফিস থেকে ফিরে চা পেতে একটু দেরিই হয় আজকাল। চিরশ্রী যেন কেমন বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। এই তো সেদিন অফিস থেকে এসে দেখলো বাড়িতে নেই,মেয়ে কলেজ থেকে ফিরেছে জিজ্ঞেস করে জানলো বেড়িয়েছে কোথাও। অগত্যা চা বানিয়েই খেতে হলো,চিরশ্রী জানে বিয়ের পর থেকেই অফিস থেকে এসে বৌকে বাড়িতে না দেখলে ওর মাথা গরম হয়ে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে আসে চিরশ্রী এই রকম ছোট কুর্তি ও খুব একটা পরেনা। কুচিওয়ালা পাতিওয়ালা প্যান্ট আর শর্ট লাল কুর্তিতে চিরশ্রীর বয়েস যেন দশ বছর কমে গেছে। চিরশ্রীও হয়ত তাকিয়েছিলো মুগ্ধতা দেখবে বলে অভিমন্যুর চোখে,তবে সেখানে দেখলো শুধুই বিরক্তি আর রাগ।
"সারাদিন বাদে অফিস থেকে আসি ঐ সময়টা বাড়িতে থাকতে পারোনা।চা টুকুও করে খেতে হলো।"
"তাতে কি হয়েছে,আমি তো রোজই নিজের বানানো চা খাই,সবাইকে খাওয়াই।"
আজ চিরশ্রীর কথাতে এমন কিছু ছিলো অভির আর বেশি ঘাটাতে ইচ্ছে করেনা।
চিরশ্রী আজকাল শরীরচর্চা করে। পার্লারেও যায় নিয়মিত। একটু ব্যাঙ্গ করে অভিমন্যু," যাক ভালো প্রদীপ জ্বলে ওঠে নতুন করে নিভে যাওয়ার আগে বেশ বেশ করো।"
"করতেই তো হবে বলো,তোমাকে আর সবাইকে যখন আমিই সাজাই নিজেই বা বাদ যাই কেন?"
ফেসবুকে নিত্যনতুন ডিপি পাল্টায় চিরশ্রী,কমেন্টে অনেকেই বলে অনেক কিছু। আড়ালে ফেসবুকের দেওয়ালে আড়ি পাতে অভিমন্যু। মনের কোণে জমা হয় সন্দেহের মেঘও কিন্তু মুখে বলতে পারেনা। আড়ালে চিরশ্রীর ফোনটা দেখতেও আত্মসম্মানে লাগে। মনে মনে ভাবে উড়ুক উড়ুক,যখন মুখ থুবড়ে পড়বে বুঝবে। যদি একদিন কোন বেচাল দেখে তখন ধরবে।
আজকাল অফিস থেকে এসে চিরশ্রীকে ফেসবুকে থাকতে দেখলেই মুখটা কালো হয়ে যায় অভির। খুব খারাপ লাগে চিরশ্রীরও মনে হয় যেন মস্ত অপরাধ করছে ও বাড়িতে বসে বসে।
" শোনো তুমি এই সারাদিন ফেসবুকে আর হোয়াটসআ্যপে থাকতে থাকতে যদি কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ো সেদিন বুঝবে। আমি কিন্তু সেদিন ছাড়বোনা।"
" তোমাকে অত ভাবতে হবেনা,কেন তুমি ফেসবুক করোনা?"
" করি,কিন্তু আমি আ্যডিক্টেড নই। সস্তার ছবি পোস্ট করে পাবলিসিটি পাওয়া। হুঁ পুরোনো গাড়ি রঙ করে বাহবা নেওয়া।"
হঠাৎই মাথাটা গরম হয়ে যায় চিরশ্রীর," বেশ করি।"
" মা তোমরা চুপ করো প্লিজ। আর বাবা সবাই ফেসবুক করে এখন মাও করবে।"
গজগজ করতে থাকে অভিমন্যু,গজগজ করে চিরশ্রীও।
আজকাল সন্ধ্যেবেলা চিরশ্রীকে বাড়িতে না দেখলে বা মোবাইলে দেখলে মনের আকাশে ঘোর মেঘের আনাগোনা হয় অভির কখনো বাজও পড়ে।
" বৌদি কি চাকরি নিয়েছে অভিদা? দুপুরের দিকে প্রায়দিনই দেখি বাইরে বেরোয়। ভালো ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেছে করবেই বা কি সারাদিন?"
মনুষ্যের দুরারোগ্য ব্যাধি পি এন পিসি,মানে হিংসে রোগ আরকি। কারো দূর্বলতার সুযোগে দাও একটু উস্কানি দিয়ে।
বিরক্তিটা আরো বাড়ে অভিমন্যুর, সন্দেহও। আজকাল চিরশ্রী জ্বর বা পেটব্যথাতে কাতরালেও ওর কোন যায় আসেনা। কষ্ট পায় চিরশ্রী,একা হয়ে যায় আরো। তবুও সবুজের সাথে কথা বলে কিছুটা সময় কেটে যায়।
" কি মন খারাপ? কাল তোমাকে অনলাইনে দেখিনি সারাদিন।"
'' কাল রবিবার ছিলো,সবাই বাড়িতে তাই আর কথা হয়নি। আজ আবার শরীর মনটা ভালো নেই তাই চুপ করে শুয়ে ছিলাম।"
" হুম্ বুঝেছি,মিডএজ ক্রাইসিস।"
" তুমিও এই কথা বলছো?চিরসবুজ কি করে বুঝবে আমাদের সমস্যা।"
" কেন ডিপ্রেশন হয় শুনি?নিজের হাতে সাজানো সংসার তোমার?"
"কেন তুমি ডাক্তার নাকি? কি দরকার এত খবরের?তোমার গার্লফ্রেন্ড কেমন আছে?আর আঁকার স্কুল কেমন চলছে?"
" একদিন এসে দেখে যাও। তাহলে বুঝবে। আর আমার তো একটা নয় অনেক গার্লফ্রেন্ড, যেমন তুমিও।"
মাঝবয়েসের গালেও কি একটু ব্লাশ হয় চিরশ্রীর,হতেও পারে। এত আ্যডমায়ার করে ইন্সপায়ার করে ছেলেটা আবার মজাও করে।
এমনি কত এলোমেলো কথা হয় ওদের সারাদিনে সময় পেলেই। অনেকটা বন্ধুত্ব হয়ে গেছে সবুজের সাথে। একটা অসমবয়েসী বন্ধুত্ব কিন্তু ভালোলাগা। কি নাম এই সম্পর্কের?পরকীয়া?
" তুমি কি আজকাল দুপুরে বাইরে বেরোও নাকি?অসীমরা বলছিলো।কোথায় যাও?"
হাসতে হাসতে চিরশ্রী বলেছিলো," হাওয়া খেতে,কেন যাবোনা? জবাবদিহি করতে তোমার যেমন ভালো লাগেনা আমারও লাগেনা।"
মাঝে কেটে গেছে আরো কিছুদিন, সেদিন অফিসের পথে রওনা দিয়েও যেতে পারেনা অভিমন্যু। গতকাল বেশ রাতে চিরশ্রীর একটা কবিতা দেখতে পেয়েছে ফেসবুকে। বিয়ের পর একটা কবিতার খাতা নিয়ে এসেছিলো চিরশ্রী চূড়ান্ত রোমান্টিক মুডে দুএকটা কবিতা শুনিয়েছেও ওকে। চিরশ্রীর নরম শরীরের গন্ধে ডুবতে ডুবতে খারাপ লাগতোনা তখন। কিন্তু তারপরে কোনদিনই শুনতে চায়নি,খোঁজও নেয়নি আর উৎসাহও দেয়নি। অভিমন্যু যথেষ্ট সংস্কৃতিমনস্ক তবে ঘরের বৌয়ের মধ্যে ট্যালেন্ট না খোঁজাই ভালো। ভালোমন্দ রাঁধবে,সুন্দর পরিবেশন করবে,নিত্যনতুন মেনু হবে,বন্ধুরা খাবে,আত্মীয়স্বজন খেয়ে মন্দ হয়নি বলবে ব্যাস আবার কি? নেহাৎপক্ষে রোজগার কিছু করে আনো তাহলেই হবে। কবিতাটা প্রেমের কবিতা,ইচ্ছে না করলেও পড়েছিলো। কমেন্টগুলো দেখেছিলো। সব ত্যালানো বুলি যত্তসব, বাহ্,অপূর্ব,খুব ভালো। হয়েছে একটা ফেসবুক।
মোড়ের মাথার ক্যাফেতে বসে,এই সময়টা ফাঁকাই থাকে। রাস্তাটাও বেশ দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। কফিতে আস্তে আস্তে চুমুক দেয়...ঐ তো চিরশ্রী,কাঁধে শান্তিনিকেতনের ব্যাগ,খোঁপাটা উঁচু করে বাঁধা পরনে দুর্গা মোটিফের বাটিক। ওহ্ তাহলে দুপুরের অভিসার নিত্যদিনই চলে! আজ একটু দেখতে হচ্ছে কি চলছে ভেতরে ভেতরে এত প্রেমের কবিতা আসছে কোথা থেকে?
দূর থেকে বাড়িটা লক্ষ্য করে অভিমন্যু,চিরশ্রী ঢুকে গেলো। কাছে গিয়ে দেখে নেমপ্লেট লেখা ডাক্তারের বাড়ি। কই তবে কোন পেশেন্টের ভীড় তো নেই,ভালোই বন্ধু জোগাড় করেছে তাহলে বেশ বেশ। আসেপাশে জিজ্ঞেস করার মত কাউকে পায়না। তাই পা বাড়ায়,সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে,ঢোকার মুখে দরোয়ান আটকায়।"কুথায় যাবেন?আনজান আদমির ঢোকা বারণ আছে।"
"আমি ডাক্তারের কাছে যাবো।"
"সাব এখানে থাকেননা,বাইরে থাকেন। ওনার লেড়কা থাকেন এখানে। বারণ আছে বাইরের আদমিকে ঢোকানোর।"
মনটা বিশ্রী সন্দেহে ভরে যায় অভিমন্যুর.." ছিঃ ছিঃ ছিঃ এতটা নীচে নেমে গেছে চিরশ্রী,ফাঁকা বাড়ির সুযোগ নিয়ে পরকীয়া! শেষ পর্যন্ত কতটা এগিয়েছে কে জানে।যখন বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া শুরু করেছে!"
রাগে আজ দিশাহারা লাগে ওর। গলা চড়িয়ে বলে," আপনি সাহেবকে বলুন এখানে একটু আগে একজন দিদিমণি এসেছেন নাম চিরশ্রী তার হাজব্যান্ড আমি। খুব দরকার আছে।"
অভিমন্যুর রাগী চেহারাটা দেখে ওপরে উঠে যায় লোকটা কয়েক মিনিট বাদে ফিরে এসে বলে," যান,সিধা উঠে ডানদিকে।"
সিঁড়িটা পার হয়ে ডানদিকের ঘরে ঢোকার আগেই চোখে পড়ে যায় চিরশ্রীকে।বিশাল হলঘর,অনেকেই বসে ছবি আঁকছে সেখানে। চিরশ্রী এক কোণে দাঁড়িয়ে কবিতা বলছে,সামনে রেকর্ডিং করছে একজন। শুনতে পায়..."এবার আরেকবার ভালো করে পড়ো,এবার থেকে সবগুলোই ইউটিউবে দেবো। আগের গুলো তো বেশ ভালো সাড়া পেয়েছে।"
মুখটা আনন্দে ঝলমল করছে চিরশ্রীর।
" এক মিনিট,তুমি প্র্যাকটিস করো আমি আসছি।"
অভিমন্যু তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে,ভেতরে ঢুকতে পারেনা। হঠাৎই শুনতে পায়.." নমস্কার আমি সবুজ,আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হলো। এখানে তো ক্লাশ চলছে আমরা পাশের ঘরে বসি।"
কথা হারিয়ে যায় অভিমন্যুর কি দিয়ে শুরু করবে," মানে চিরশ্রী আমার.."
" হ্যাঁ আমি জানি আপনার স্ত্রী,আর আমার গার্লফ্রেন্ড। না না প্লিজ জেলাস হবেননা,এখানে যারা আসেন তাদের বেশিরভাগই মহিলা। অনেকেই আমার মা,মাসিমা বা কাকিমার মত আবার কেউ দিদির মত তবুও আমি ওদের এই নামেই ডাকি মজা করে।"
ভালো করে সবুজের দিকে তাকায় অভিমন্যু,আত্মবিশ্বাসী একটা ছেলে বয়েস কত হবে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ নাকি আরেকটু বেশি?
" কিন্তু চিরশ্রী তো কোনদিন বলেনি..ও এখানে কেন আসে।"
হাসে সবুজ,"আসলে সুখের পরেই অসুখ আসে,আর অসুখের পর সুখ। একটা সময় মনের কষ্টে বা মনের অসুখে অনেক কিছুই হয়ত বলতে আর করতে চেয়েছিলেন উনি। আপনি শোনেননি,তাই বাধ্য স্ত্রীর মত একটু একটু করে সংসারের রান্নাবাটি খেলায় নিজেকে ব্যস্ত করে রেখেছিলেন। তাতে হয়ত সাময়িক সুখ এসেছিলো কিন্তু আবার সবার ব্যবহারে শুরু হয়েছে অসুখ,একলা হয়ে যাবার অসুখ।"
"কিন্তু ও তো বলেনি তেমনভাবে,আর সবাই তো আছি আমরা।"
"সবাই আমরা আছি কিন্তু নিজের নিজের বৃত্তে আর আনন্দ নিয়ে। সুখের ঘরে একলা অসুখী মন এখন ঘরে ঘরে। তাই একটু আনন্দ দিতে চাই ওদের ভালোলাগা গুলোকে শান দিয়ে।"
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি খেলে যায় অভিমন্যুর মুখে," ফেসবুকে আজকাল কত কি দেখি,ও অসুখী একলা মানুষকে সুখী করাটা আপনার ব্যবসা তাহলে?মানে বাবা ডাক্তার আর আপনি তা হতে পারেননি তাই এভাবে মহিলা ধরেন ফেসবুকে?"
মুখটা শক্ত হয়ে যায় সবুজের অপমানে তবুও হাসি এনে বলে," বলতে পারেন,আসলে সুখের অসুখে নিজের ঘরটা ভাঙতে দেখেছি তো তাই চেষ্টা করি আগলাতে ভাঙনগুলো।একটা সময় আমাদের যখন ছোট বাড়ি ছিলো,গাড়ি ছিলোনা বাবার বেশি টাকা ছিলোনা কি হাসিখুশি পরিবার ছিলো আমাদের। তারপর একটা সময় বাবার হাতে টাকা এলো প্রচুর,বন্ধুবান্ধব, ক্লাব, বেড়াতে যাওয়া। আমার পড়াশোনা বন্ধুবান্ধব এই করে কখন যে সুখের সংসারে অসুখ ঢুকেছিলো বুঝতেই পারিনি। মা বাবার শোয়ার ঘর আলাদা হয়েছিলো,ঝগড়া হত,ইগো,মদ আরো অনেক কিছু। মা যে কখন একা হয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারিনি।শুধু বলতে শুনতাম,তোদের এখন আর আমাকে লাগেনা,আমি মরে গেলেই ভালো। সুইসাইড করেছিলো মা আমার সুখের অসুখে।"
কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো অভিমন্যু কিছুক্ষণ। কি বলবে বুঝতে পারছিলোনা।
" চলুন,দেখি আমার গার্লফ্রেন্ডরা কি করছে,ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারছে বোধহয় হাসি শুনছি।"
সত্যিই এগোতেই হাসি শুনতে পায় অভিমন্যু,চিরশ্রীকে কতদিন এভাবে হাসতে দেখেনি।
ওর কাঁধে হাল্কা হাত রাখে অভিমন্যু," অন্যের বাড়ি থেকে মা বাবা ছেড়ে এসে যারা একটু একটু করে আমাদের সংসারটা গোছায়। বিপদে,সম্পদে পাশে থাকে,ছেলেমেয়েদের জন্ম দেয়,মানুষ করে আগলে রাখে পরিবারকে। হরমোনের আঁচড়ে বা একলা মনের অসুখে হোমিওপ্যাথি আর আ্যলোপাথির পাশাপাশি যদি এইটুকুনি সিমপ্যাথি তাদের দিই তাহলে কি খুব একটা ইগোতে হাতুড়ি মারে?"
সবুজের কথাটা হয়ত একটু হাতুড়ির ঘা মারলো অভিমন্যুর বুকেও। ততক্ষণে ওদের হাসির মাঝেই সবুজ ঢুকলো..'আজি এসেছি,আজি এসেছি,এসেছিই বধূ হে নিয়ে এই হাসি..'
হাসির হুল্লোড়টা আরো জোরালো হয়।
"সবাই চুপ,আমাদের সুন্দরী টল,ডার্ক,বোল্ড গার্লফ্রেন্ডের হাবি যে তাকে কত ভালোবাসে তা নিশ্চয় সবাই বুঝতে পারছো। ফলো করে একদম এখানে।"সত্যি লজ্জা পায় চিরশ্রী অভির কান্ড দেখে।
" নাও,এবার হয়ে যাক প্রেমের কবিতা,রিয়েল প্রেমিকের সামনে। রেকর্ডিং শুরু করবো।"
আজ একটা অন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে অভিমন্যু ফিরবে বাড়িতে,স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি জীবন এমন হতে পারে।
" আজ আসি।"
" আমি যদিও গার্লফ্রেন্ডদের প্রতিই একটু বেশি দূর্বল। তবুও আসুননা উইকএন্ডে,আমাদের একটা গীটারের ক্লাশ হয়। ম্যাডাম বলেছেন আপনি নাকি এককালে বাজাতেন।"
একটু ভালোলাগার লজ্জার হাসি অভিমন্যুর মুখে," ঐ একটু আধটু।"
" আবার হবে,কুছ না কহো,কুছ ভি না কহো। সুখের খোঁজে মাঝবয়েসী ক্লান্ত মনগুলো এই ভাবেই ভালো রাখুক আর ভালো থাকুক।"
সিঁড়ি দিয়ে নেমে চিরশ্রীর হাতটায় একটু চাপ দেয় অভিমন্যু," অফিস যখন হলোই না চলো আজ একটা মুভি দেখে আমাদের ঐ পুরোনো রেষ্টুরেন্টে খেয়ে ফিরবো।"
মিষ্টি হাসে চিরশ্রী মনে মনে ভাবে বসন্ত আসার বোধহয় কোন সময় নেই,শুধু ভালোবেসে হাত বাড়ালেই সে আসে।
ভালো লাগলে লেখিকার নামসহ শেয়ার করুন
Copyright protected ইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment