Skip to main content

ফাটল

#ফাটল#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"শান্তনুদা না? হ‍্যাঁ তাই তো! মৌলি ঐ দেখো শান্তনুদা। অনেকদিন দেখা হয়না বলছিলে।"
  আমি এতক্ষণ একদৃষ্টে একজনের শাড়ি দেখছিলাম।আমার আবার একটু সাজুগুজু দেখা রোগ আছে।নিজেও সাজতে ভালোবাসি আসলে। বিকাশের ডাকে এবার সামনে তাকাই হ‍্যাঁ শান্তনুদাই তো আমাদের সীটের থেকে বোধহয় আগে কোথাও বসেছে,ইন্টারভ‍্যালে বাইরে গেছিলো ফিরছে। আমি হাত তুলে ইশারা করতে যাই।ধ‍্যাৎ দেখতেই পেলোনা,আর তারমধ্যেই আবার আলো নিভলো শো শুরু হবে। থাক বেরোনোর পর ঠিক ধরবো। নিশ্চয় বৌদিও এসেছে সাথে। আমাদের বৌদিটিও খুব মিষ্টি আর  মিশুকে। অনেকদিনই মুখোমুখি দেখা হয়না।যদিও দুজনেরই হোয়াটস আ্যপ নম্বর আছে আমার কাছে তবুও আমার মেয়ে তিতাসের বন্ধুদের মায়েদের সাথেই বেশি যোগাযোগ হয়।
             ভালোই হলো আজ একটু আড্ডা মারা যাবে শেষে।
   " দেখো আবার ধরতে পারো কি না তার আগেই চলে যায়।"
  " আরে বাবা আমি দেখতে না পেলে বৌদিকে একটা কল করে নেবো।"
       শো শেষ হতেই আমি এদিক ওদিক তাকালাম,কিন্তু যাহ্ ওদের দেখছিনা কেন! একটু কথা বলার ইচ্ছে ছিলো। শেষে বৌদিকে কল করি," হ‍্যালো বৌদি তোমরা কোথায়?"
   " ওহ্ আমার ননদিনী,এতদিনে মনে পড়েছে বৌদিকে?আমি তো বাড়িতে,মুনুর পরীক্ষা চলছে তো।"
     " প্রশ্নটা না করলেই হত,তবুও বললাম আর শান্তনুদা ফেরেনি এখনো?"
" না রে ওর প্রচুর কাজের চাপ এখন,আজও একটা মিটিং আছে ফিরতে রাত হবে বললো। তা আয় না একদিন, একদম তো আসিস না। এখন আর বৌদিকে কি দরকার তাই না?"
           আসলে আমার যখন একদম প্রথম বিয়ের আগে ডেটে যাওয়া তখন বৌদিই তো শাড়ি পরিয়ে দেওয়া,সাজানো সব করে দিয়েছিলো। তাই মজা করে বললো কথাগুলো, সবটাই বুঝলাম কিন্তু আজ আর মজা করতে ইচ্ছে করলোনা তাই বললাম," যাবো গো বৌদি তোমাকে কি ভুলতে পারি?এরপর মায়ের কাছে গেলেই দেখা করে আসবো।
    " কি গো ওরা কোথায় কি বললো? আমার কিন্তু খুব আইসক্রীম খেতে ইচ্ছে করছে। তুমিও খাবে তো?"
  " দাদা বোধহয় চলে গেছে,বৌদি আসেনি.. বললো মুনুর পরীক্ষা চলছে।"
আমার মনের মধ‍্যে কেমন যেন একটা কাঁটা বিঁধলো।আসলে ভয় আর অপরাধবোধ থেকেই মিথ‍্যের জন্ম হয় নাহলে বাইশ বছর বিবাহিত জীবন পার করে হঠাৎ শান্তনুদাই বা বৌদিকে মিটিংয়ের অজুহাত দিয়ে সিনেমা দেখতে আসবে কেন? সব কথা বোধহয় বরের কাছেও বলা যায়না তাই মনের কাঁটার খোঁচা খেতে খেতেও সোজা পৌঁছলাম আইসক্রীম পার্লারে। বেশ বড় দোকানটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েগুছিয়ে দেয়।কত রকমারি আইসক্রীম যে রাখে ওরা!
       " তুমি কি খাবে?ফ্রুটস না চকোলেট?"
" তুমি যা নেবে তাই নিয়ে নাও না।"
" আচ্ছা এক কাজ করি,ডিফারেন্ট নিই শেয়ার করে খাবো দুজনে।"
   আমি মাথা নাড়লাম। আইসক্রীম হাতে নিয়ে একটা টেবিলে এসে বসলাম। চারদিকে কমবয়েসী ছেলেমেয়ের ভীড়,আইসক্রীম খেতে খেতে প্রেমও জমেছে হিমেল মিষ্টতায়। আমি একটু এদিক ওদিক দেখছি।বিকাশ আবার বলে," আমারটা একটু টেস্ট করো,তোমারটা আমি খাই। মনে পড়ে আগে তো একটা থেকেই দুজনে কত ভাগ করে খেয়েছি,খাইয়ে দিয়েছি।"
  আমি হাসি," মনে আছে তোমার?আমার তো মেয়েটার কথাই মনে হচ্ছে ওর জন‍্য কিন্তু চকোলেট নিয়ে নিয়ো।"
  ' ব‍্যাস্ আবার মন ফিরলো সেই বাড়িতেই ঘুরে ফিরে।দেখো দেখো প্রেমকে কিভাবে রাখতে হয়। "
     বিকাশের ইশারায় কোনের দিকে চোখটা চলে যায়,খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে দুজন বসে,সাইড থেকেই দেখা যাচ্ছে।ভদ্রমহিলার ব্লাউজের পিঠটা বেশ কাটা,আর ডিজাইন করে বানানো।পিঠে একটা ট‍্যাটুও আছে,তাই বোধহয় এত আয়োজন। ভদ্রলোক মাঝে মাঝে চামচে করে খাইয়ে দিচ্ছেন স্ত্রীকে কখনো বা মহিলা স্বামীকে। তার মধ‍্যেই একবার টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মোছাচ্ছেন তাও বুঝলো মৌলি। নাহ্ এত প্রাইভেট সীন না দেখাই ভালো তাই চোখটা ফেরালাম।
                   বিকাশ উৎসাহিত হয়ে ওর অন‍্যমনস্কতার মুহূর্তে চামচে করে কিছুটা আইসক্রীম ঠোঁটে ছোঁয়ায়। মিষ্টি হেসে ওর দিকে তাকাই বিভাসও হয়ত খুঁজতে চায় পাঁচবছর আগের সেই আমিকে। ওদের খোঁজার মাঝেই আমার অবাধ‍্য চোখটা আবার কোণের টেবিলে চলে যায় আর হঠাৎই আইসক্রীমটা বড় তেতো আর বিস্বাদ লাগে। শান্তনুদা!সঙ্গে একজন মহিলা দুজনেই খুশিতে মগ্ন হয়ে উঠে যাচ্ছে। আশ্চর্য লাগে,বন্ধু কেউ হতেই পারে তা বলে অমনভাবে খাইয়ে দেওয়া,ঠোঁট মোছানো!কেমন যেন অসহ‍্য লাগলো দৃশ্যটা মনে করতেই।
    খুব তাড়াতাড়ি বিকাশের চোখের দিকে তাকাই আমি ও দেখে ফেলেনি তো ওদের? নাহ্ যাক বিকাশ তখন মাথা নিচু করে স্ট্রবেরী তুলছে হয়ত আমাকে খাওয়াবে বলে। কিছু খারাপ লাগা দৃশ‍্য আপনজনের কাছেও লুকোনো থাকলেই ভালো,বিশেষ করে যদি তা বাপের বাড়ির দিকের হয়, আজ  সেটাই মনে হলো।
          এতক্ষণ শান্তনুদাকে খুঁজেছে কথা বলবে বলে এখন মনে হলো সে চোখের আড়ালে চলে গেলেই বাঁচে। আমার মন কেমন করলো খুব চিন্তা হলো রুমকি বৌদির জন‍্য। কি সুন্দর সাজানো হাসিখুশি সংসার ওদের,ছেলেমেয়েরাও মোটামুটি বড় হয়েছে। এখন বেশ স্বচ্ছলতা সংসারে,একটা সময় রুমকি বৌদিই খুব কষ্ট করে সংসারটা গুছিয়েছিলো। ছেলেমেয়ে দুটোও পড়াশোনায় ভালো। মোটামুটি একটা হ‍্যাপি আর আইডিয়াল ফ‍্যামেলি শান্তনুদার,যদিও শ্বশুরবাড়িতে নিজের পায়ের মাটিটা পেতে এক সময় অনেক কাঠ খড় পুড়িয়েছে বৌদি তবুও শেষে তো জয়ীও হয়েছে।চিরকালই শান্তনুদার মুখে শুনে এসেছে রুমকি এই পারে ঐ পারে।
                         রাতে অনেকক্ষণ ছটফট করলাম ,ঘুম আসেনা কিছুতেই। কি আশ্চর্য ব‍্যাপার,কি দরকার ছিলো শান্তনুদার রুমকি বৌদিকে মিথ‍্যে বলে অন‍্য মহিলার সাথে সিনেমায় আসার। মিথ‍্যের থেকে বোধহয় অপকট সত‍্যি অনেক ভালো।পুরোনো কত কথা মনে পড়ে গেলো,রুমকি বৌদির কাছে শোনা ওদের হানিমুনের গল্প।শান্তনুদার ছোটছোট উপহার দেওয়ার ছলে ভালোবাসার গল্প আবার একসাথে হাতে হাত রেখে সংসার গুছোনোর গল্প সবটাই শুনেছি টুকটুক করে অবসরে। নিজেও স্বপ্ন দেখতাম রুমকি বৌদির মত একটা সাজানো সংসার হবে । সত‍্যি জীবনের নদী বোধহয় সত‍্যিকারের নদীর মত কখন যে বাঁক নেয় কেউ জানেনা। আবার হয়ত অবজ্ঞার পলি জমে মজে যায় অবহেলায়। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতেই পারিনি।
                            মাঝে কেটে গেছে দুতিনটে মাস এরমধ‍্যে কখনো দু একবার বৌদির সাথে কথা হয়েছে। আজকাল বৌদিকে ফোন করলে সেই উচ্ছ্বাসটা আর শুনতে পাইনা। সব সময় শুনি শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা রে। " অনেকদিন ডিপি পাল্টাচ্ছোনা,কি শাড়ি কিনলে এর মধ‍্যে?"
  "গাদা গাদা শাড়ি জমেছে আলমারিতে আর কত কিনবো রে?ওগুলোই পরা হচ্ছেনা ঠিকমত।"
    " আমাদের এখানে একটা হ‍্যান্ডিক্র‍্যাফট মেলা হচ্ছে,এসোনা একদিন মুনুকে নিয়ে। কতদিন আসোনা।"
           নাহ্ রুমকি বৌদি আসেনি মানে জানিয়েছিলো আসা হবেনা। মাস ছয়েক বাদে ভাইবৌয়ের সাধে বাপের বাড়ি যাওয়া অনেকদিন বাদে ওখানে দেখলাম বৌদিকে। কত রোগা হয়ে গেছে,সেই প্রাণচ্ছ্বোল হাসিটা আর নেই। মুনুটাও কেমন যেন চুপচাপ, মাকে আগলে আগলে রাখছে সারাক্ষণ।
  "বৌদি,কতদিন বাদে আবার দেখা হলো।আজকাল তো কোন ছবিও পোস্ট করোনা,দেখতেই পাইনা তোমাকে ফেসবুকে।"
  "খুব চাপ বেড়েছে রে,মুনুটাও বড় হচ্ছে।সময় পাইনা একদম,ফেসবুক ঐ একটু খুলি। বাহ্ তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে। শাড়িটাও দারুণ পরেছিস।"
     " তুমি কিন্তু আজকে তেমন সাজোনি,আমি তো তোমার ফিদা তুমি তো জানোই। তবে একদম রোগা হয়ে গেছো। অবশ‍্য ভালো লাগছে তাতে।"
  "হ‍্যাঁ রে একটু যোগা ক্লাশে যাচ্ছি,ছেলেই ফর্ম এনে জোর করে পাঠালো।ব‍্যথাতে কষ্ট পাচ্ছিলাম।"
"ও বাবা! তোমার ছেলেমেয়ে তো অনেক বড় হয়ে গেছে একদম তোমার দুই শক্তপোক্ত গার্জেন। ইউ আর দ‍্য হ‍্যাপিয়েষ্ট মম বৌদি।তা শান্তনুদার কি খবর গো?কেমন আছে?"
     মুখটা যেন কেমন ফ‍্যাকাশে হয়ে গেলো বৌদির," আছেরে ভালোই আছে,খুব ব‍্যস্ত থাকে।ঐ সারাদিনে দুএকটা কথা হয় আরকি।"
      " তা হবে কেন? আমরা দেখেছি দাদা কিন্তু খুব রোমান্টিক। তোমাকে তো চোখে হারায়।"
      " একটা সময়ের পর বোধহয় প্রেমেও মরচে পড়ে রে।সম্পর্কগুলোও একঘেয়েমিতে ফ‍্যাকাশে হয়ে যায়।"
       " তা হবে কেন?সেকেন্ড ইনিংসটা ভালো করে খেলো।তুমি তো রঙ ভরতে পারো। আমাকে কত কি শেখাতে তা ফ‍্যাকাশে হতে দিচ্ছো কেন?"
       আলতো ছোঁয়ায় বৌদি ছুঁয়ে যায়," পাকা বুড়ি হয়ে গেছিস এই কয় বছরে দেখছি। প্রেমটাকে হারিয়ে ফেলিসনা সংসারের ঘুলঘুলিতে।একটু ঝেড়েপুছে রাখিস নাহলে চড়াই বাসা বাঁধবে।"
     " কি মিষ্টি কথা বলো গো তুমি!শুধু মনে হয় সেই আগের মত দুকাপ কফিকে সাক্ষী রেখে দুজনে ডুবে যাবো কথার রূপকথাতে।"
    হাসলে যে আজও চোখ ফেরানো যায়না বৌদির থেকে। এত হাসিখুশি মানুষটার হাসিটুকু কেড়ে নিয়ে শান্তনুদা কি পাচ্ছে কে জানে। না না কিছুতেই ভালো থাকবেনা শান্তনুদা,রুমকি বৌদি যে ঘরের লক্ষ্মী।তাকে কাঁদিয়ে,সেই পিছল পথে এক পাও চলতে পারবেনা শান্তনুদা।
            মাঝে কেটে গেছে বেশ দুটো মাস। মায়ের কাছ থেকে শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো  কি করছে এটা শান্তনুদা,ভীমরতি হলো নাকি! শুনলাম অফিসের এক ডিভোর্সি মহিলার প্রেমে নাকি হাবুডুবু খাচ্ছে শান্তনুদা।রুমকিবৌদি সংসারে এমন কি ছেলেমেয়েতেও তার মন নেই। সারাক্ষণ ফুরফুর করে উড়ে বেড়াচ্ছে।যে শান্তনুদা ছুটির দিন পেলেই বৌদি ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে যেতো সে আজকাল বেশি একা থাকতেই নাকি ভালোবাসে আর সঙ্গী ঐ সেলফোন।
       " কি বলছো মা এইসব! তোমরা কি দেখেছো বাড়িতে আসে?"
  " বাড়িতে আসবে কেন বাপু? অফিসেই তো সারাদিন পাচ্ছে।আর ছুটির দিন হলেই ছেলেটা বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় ফোন করে।"
     " ছিঃ! কাকে বিশ্বাস করবে বলো? দাদাকে তো আজ দেখছি না বলো। খুব ভালো ছেলে,ভালো স্বামী। তার হঠাৎ কি হলো?"
  " কি আবার হবে,ভীমরতি।ঐ জন‍্যই বলি ঐসব ফেসবুকে টুকে বেশি ছবি দিসনা। বৌমা সব সময় ছবি দিতো।নজর লেগেছে রে মানুষের।থাবা বসাচ্ছে বাইরের মানুষ ওর সুখের সংসারে।"
  " তোমার যতসব সংস্কার মা।"

নাহ্ দুপুরের দিকে একদিন চলেই আসি,খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে একা মানুষটার সাথে।হয়ত মনের গভীরে জমে থাকা মেঘ নিয়ে বৃষ্টির স্রোতে ভেসে যাওয়া মনটা নিয়ে বানভাসি রুমকিবৌদি।
         কয়েকটা কথা বলতেই বৌদি কেঁদে ফেললো," আর সামলাতে পারলাম নারে,আসলে বাইরের লোককে কি বলবো বল। আমার ঘরের মানুষেরই যে মন উঠে গেছে আমার ওপর থেকে। জোর করে তো কিছু পাওয়া যায়না।চেষ্টা করেছিলাম রে খুব চেষ্টা করেছিলাম।মুনুটার জন‍্য খুব খারাপ লাগে,এত কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা!ওকেও আজকাল আর দেখতে পারেনা,চিৎকারের জন‍্য ভয়ে কিছু বলিনা।এমনিতেই লোক জানাজানি হয়েছে রে।"
      " তুমি কিছুতেই যেতে দেবেনা বৌদি দাদাকে,জোর করো।মুনু বাবানের মা তুমি,সেইজন‍্যই জোর করবে।"
        চোখে জল নিয়েও হেসে ফেলে রুমকিবৌদি,"ধ‍্যুৎ পাগলি আমাদের বিয়েটা নাকি বিয়েই নয় তাই যে বিয়েটা কোনদিন আইনের পাল্লায় মাপাই হয়নি তার আবার ভাঙা গড়া কিসের! "
    " মানে? কি বলছো তুমি?"
  "সেই কোন ছেলেবেলায় ওর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে রেজেষ্ট্রী ছাড়াই বিয়ে করেছিলাম পালিয়ে।মন্দিরে গিয়ে মাথায় সিঁদুর ঠেকিয়ে। আজ তো বলে ওটা নাকি বিয়েই নয়।"
       মনটা খুব ভারী নিয়ে সেদিন ফিরেছিলাম ছিঃ এমনও হয়! এতদিন মানুষটাকে ব‍্যবহার করে আজ বৈধতার প্রশ্ন তোলে শান্তনুদা।তাহলে তো ছেলেমেয়ে গুলোও অবৈধ।আর ভাবতে ভালো লাগেনা কিছুই।
                    মাঝে কেটে গেছে দু তিনটে মাস। বৌদিকে আর ফোন করে ভাঙনের শব্দ শুনতে ইচ্ছে করেনি ।
            রবিবার এমনিতেই সময় থাকেনা কাজ করতে করতে সকালটা কোন দিক দিয়ে কেটে যায়। " তোমার ফোন মৌলি।".." রান্না করছি তো, তুমি ধরোনা,কে করেছে?"
   বিকাশ ফোনটা হাতে ধরিয়ে দেয়। ওহ্ ও তার মানে আগেই কথা বলেছে,শান্তনুদার ফোন।নামটা দেখে খুব অবাক লাগে,হঠাৎ কেন আবার!
                 " হ‍্যালো,মৌলি কেমন আছিস?"
      " এই চলছে,একটু ব‍্যস্ত আছি।কাজ করছি।কিছু বলবে?"
   " হ‍্যাঁ, ঐ জন‍্যই তো ফোন করলাম। শোন সামনের পনেরো তারিখে সন্ধ‍্যেবেলা চলে আসিস অবশ‍্যই, আমি হোয়াটস আ্যপ করে দেবো ঠিকানাটা।"
     " কিসের ঠিকানা?কোথায় আসবো?"
"মানে,আবার বিয়ে করছি। একটা সময় খুব বলতিস,আমার বিয়েতে ছোট ছিলি আনন্দ করতে পারিসনি।"
          প্রচন্ড রাগ হচ্ছিলো আমার একটা মাঝবয়েসী লোক তার ভরা সংসার রেখে আবার বিয়ে তাও আবার ঢাক পিটিয়ে। তবুও মাথা ঠান্ডা রেখে বললো," হবেনা শান্তনুদা কাজ আছে।"
            " প্লিজ আসিস,আমি বিকাশকেও বলেছি।"
                বিকাশের সঙ্গে কথা বলাতেই ও বললো ,"যাওয়াটা উচিত,অন্ততঃ দেখে এসো সামনে থেকে কে এত বয়েসে তোমার দাদার মতিভ্রম ঘটালো।"
  মাঝে মাঝে বিকাশের উৎসাহটা খুব খারাপ লাগে আমার। একবার ফোন করবো নাকি রুমকি বৌদিকে? নাহ্ থাক আর ভালো লাগেনা ।
                         "বাবা,তোমার দাদা তো বেশ ভালো ব‍্যবস্থা করেছে দেখছি।এত বড় হোটেলে রিসেপশন! যাক্ খাওয়াটা ভালো হবে।" বিকাশের দিকে কটমট করে তাকায় মৌলি। তেমন চেনা কাউকে দেখছেনা সামনে..আরে ঐ তো শান্তনুদা। শান্তনুদা বেশ সেজেছে,বয়েসটাও যেন কমে গেছে।আজকাল অবশ‍্য মাঝবয়েসী বা বুড়োদের পরকীয়া বা বিয়ে করার ক্রেজ এসেছে।অনেকক্ষেত্রেই স্ত্রী বা প্রেমিকা অনেকটাই ছোট বয়েসে।
            কয়েকজন পরিচিতকে দেখতে পাচ্ছি, সবাই তখন ফিসফিস করছে। বাকিরা অফিসের লোকজন। শুনলাম এই বয়েসে আর কতবার শোলার মুকুট পরবে তাই শুধু রেজিস্ট্রী করে বিয়ে। রুমকি বৌদির মুখটা আর ছেলেমেয়েগুলোর কথা আবার মনে হলো মৌলির। ওরা তো কেউ আসেনি, মানে ছেলেমেয়ে দুটো।আর আসবেই বা কোন মুখে! শুনলো বৌ এখনো আসেনি পার্লারে গেছে সাজতে। ন‍্যাকামির এক শেষ লাগছে আমার।
               কফি,স্ন‍্যাকস খেতে তখন সবাই ব‍্যস্ত। শান্তনুদাই পুরোটা ম‍্যানেজ করছে ফুল এনার্জী নিয়ে। হঠাৎই একটু সোরগোল ওঠে,শান্তনুদার বন্ধুরা এগিয়ে যায়,উলুর আওয়াজও শোনা যায় ।বিকাশ ওকে ইশারা করে বলে," বুঝেছো বৌ বোধহয় ঢুকছে।"
                      দেখতে ইচ্ছে না করলেও আমারও চোখটা চলে যায় দেখার জন‍্য সেই মহিলাকে যে এত কিছু করলো,যার জন‍্য বৌদির ঘর ভাঙলো। হঠাৎই কিছুক্ষণ আর কথা বলতে ইচ্ছে করলোনা আমার, আমি তখন বিকাশের হাতটা চেপে ধরেছি।বিকাশও আগলে রেখেছে আমার হাতদুটোকে যত্নে।শান্তনুদার হাতটা ধরে লালটুকটুকে বেনারসী আর খোঁপায় লাল গোলাপ জড়িয়ে অষ্টাদশীর মত লজ্জায় রাঙাগালে মিলিয়ন ডলারের হাসিতে রুমকি বৌদি! মায়ের পাশে বাবান আর বাবার পাশে মুনু। চোখটা ভিজে গেলো আমার কেন যেন নিজের অজান্তেই দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
                  ওদেরকে তখন ঘিরে রেখেছে অনেকে,সবাই যে যার মত করে ফটো তুলছে। আমাকে দেখেই হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকে রুমকি বৌদি। জড়িয়ে ধরি বৌদিকে," কি যে সুন্দর লাগছে তোমায়! এমনি মিষ্টি হাসি নিয়ে ভালো থেকো।"
  "কেমন,সারপ্রাইজ দিলাম বলতো! এবার বিবাহবার্ষিকীতে একদম কাগজে কলমে পাকাপোক্ত করে বিয়েটা করে নেবো বুঝলি। তোর বৌদি যা সুন্দরী,কখন যে ফাঁকি দিয়ে পালাবে।"
          জিভ কাটি আমিও,সত‍্যিই তো আজ ওদের আ্যনিভার্সারি।আমারও মাথাটা গেছে একদম।
     শান্তনুদার আড়ালে বৌদির হাতটা ধরি,"আবার খুশি উপচে পড়ুক তোমার সংসারে,সমস্ত অন্ধকার মুছে আলো ফুটুক। বৌদি আস্তে আস্তে বলে," একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে মানুষটা বুঝলি।আসলে মেয়েটা ওকে কাজে লাগিয়ে নিজের আখের গোছাতে চেয়েছিলো। তারপর একদিন বলেছিলো ওর প্রেমিক আছে,ও তখন অফিসেরই আরেকজনকে ধরেছে তোর দাদার থেকে সিনিয়র।তোর দাদা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলো একদম পাগলের মত। বলেছিলো,' ফালতু আমার সংসারে ফাটল ধরালো। আর আমি এত বোকা যে তোমাদেরকেই দূরে সরিয়ে দিয়েছি।'
                "এই শাস্তিটা বোধহয় দরকার ছিলো রে ঘুরে দাঁড়ানোর জন‍্য। শুধু আমারই নিজেকে বোঝাতে যে  কতরাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি তার ঠিক নেই। তবুও নিজের সাথে আপোষ করে আবার কাছে টেনেছি দূরে চলে যাওয়া মানুষটাকে।"
      সেদিনে শান্তনুদার রসিকতাটা মন্দ লাগেনি একদম, ছেলেমেয়েকে পাশে নিয়ে বৌদিকে সই করতে দেখে খুব খুব ভালো লাগছিল ।
                                ভালো থাকুক ওরা এইভাবেই।রুমকি বৌদি নিশ্চয় পারবে সম্পর্কের মাঝখানের ফাটলটাকে আর মনের ক্ষতকে একটু একটু করে সারিয়ে নিতে। হয়ত মেয়েরা মাতৃত্বের গর্বে গর্বিত হয়েই অনেক ঝড় সয়েও জাহাজটাকে মাস্তুলের মতোই শক্ত হাতে ঝড়ঝাপটা থেকে বাঁচায়।
                       "পিমি,আমরা না বেড়াতে যাচ্ছি অনেকদিন পরে। আবার সবাই মিলে,তোমাকে ছবি পাঠাবো।"
       " তাই নাকি মুনু সোনা! আজ কিন্তু মাকে খুব মিষ্টি লাগছে দেখতে একদম সুইট সুইট সুইট।"
             আপাততঃ আজকের ছবিগুলোই মনের আ্যলবামে সাজিয়ে রাখবো যত্নে।সত‍্যিই না এলে খুব মিস্ করতাম।copyright protectedইচ্ছেখেয়ালে শ্রী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
ছবি গুগল থেকে নেওয়া
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...