Skip to main content

আমার দেখা ভূস্বর্গ

কাশ্মীরে সব মিলিয়ে আমার যাওয়া তিনবার হয়েছে।প্রথমবার তখন ক্লাশ সিক্সে পড়ি,কাশ্মীর তখন আরো অনেক পবিত্র সুন্দর,ছিলোনা নিয়মের কড়াকড়ি নিরাপত্তার বেড়াজাল।সুন্দরী কাশ্মীরী কন‍্যাদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম।ডাল লেক স্বপ্নের মত লেগেছিলো। শিকারাতে উঠে নিজেকে মনে হয়েছিলো রাজকুমারীর মত আর বাবা মাকে বাদশা বেগম। ওখানকার স্টুডিওতে কাশ্মীরী পোশাক পরে আমার আর বাবা মায়ের ছবিও ছিলো এত বছর বাদে ছবিটা দেখে আবার হারিয়ে যাই অতীতে। আপেল বাগানের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা অনেকগুলো আপেল হাতে নিয়ে এসে দাঁড়াতো।নিষ্পাপ সুন্দর চেহারা। মনে হয়েছিলো এসে পড়েছি স্বর্গে।
       বিয়ের পর শুনলাম বরের যাওয়া হয়নি কাশ্মীরে তার বহুদিনের ইচ্ছে কিন্তু যাওয়া হচ্ছেনা। যাবার প্রস্তুতি যতবারই নিয়েছি কোন না কোন বাধা এসে গেছে সামনে। ততদিনে কাশ্মীর কিছুটা উত্তপ্ত মাঝে মাঝেই চলছে মাটি অধিকারের লড়াই,তোমার মাটিতে আমি আঁচড় বসাবো বা প্রাণ নেবো।
     সুযোগের অপেক্ষায় সবার মত আমরাও ছিলাম। আর তা মিলে গেলো। এবার গন্তব‍্য শুধু কাশ্মীর আর তার কাছাকাছি গুলমার্গ,শোনমার্গ আর পহেলগাও। বিলাসবহুল হাউসবোটে তিনরাত্রি এবং হোটেলে তিনরাত্রি। তারপর গুলমার্গ সোনমার্গ হয়ে পহেলগাও এবং সবশেষে বৈষ্ণোদেবী। খুব ভালো ভ্রমণ হয়েছিলো,মুঘল গার্ডেনে গিয়ে আর কাশ্মিরী পোশাকে শিকারায় উঠে নিজেকে বেশ সুন্দরী সুন্দরী মনে হচ্ছিলো।তবে চারধারে নিরাপত্তা দেখেছি। রাতের দিকে একটু ফাঁকা রাস্তাঘাট,মুঘল দরবারে খেতে গিয়ে যখন আমাদের হোটেল শাহেনশাহ প‍্যালেসে ফিরলাম তখন লালচক বেশ ফাঁকা ফাঁকা।অথচ একসময় ছোটবেলা যখন এসেছি লালচকে কত ঘুরেছি। তবুও সব মিলিয়ে খুব ভালো ঘুরে ফিরেছিলাম ভূস্বর্গ দেখে পরিতৃপ্ত হয়ে।
          তবে বছর চারেক আগের ভূস্বর্গ কেমন যেন অচেনা আমার। ছেলেমেয়েদের বাড়িতে রেখে অমরনাথ যাত্রার উদ্দেশ্যে সেবার যাওয়া সঙ্গে পতিদেব। ট্র‍্যাভেলিং এজেন্ট কাশ্মীরি,এয়ারপোর্ট থেকে আসার সময় প্রত‍্যেক রাস্তায় রাইফেল উচিয়ে সেনাদের দেখে মনে হয়েছিলো প্রতি মুহূর্তের লড়াইয়ের জন‍্য প্রস্তুত হয়ে আছে এরা। আমাদের এজেন্ট ডাললেকের পেছন দিকটা অদ্ভুত কেমন যেন রাস্তাঘাট গুলো সেখানে থাকার ব‍্যবস্থা করে। চারিদিকে স্থানীয় লোকজন কেমন যেন লাগে ট‍্যুরিস্ট না দেখে। পরের দিন অদ্ভুত যেন চারিদিকে একটা নিরাপত্তার ঘেরাটোপ ঘুরলাম,সন্ধ‍্যে লাগতে না লাগতেই চলে এলাম হোটেলে আর সেখানেও ঘরবন্দী।অথচ আগের বার ডাললেকের ধারে রাতেও ঘুরেছি।
          পরের দিন ভোর রাতে বেরোলাম অমরনাথের উদ্দেশ্যে, একটা বড় গাড়িতে শুধু আমরা দুটো প্রাণী। সেনাদের পাহারা মাঝেমধ্যে তারমধ‍্যে দিয়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে এগিয়ে চললাম।
     অমরনাথ যাত্রার শেষে ওখান থেকে গিয়েছিলাম লাডাক।কাশ্মীর থেকে বরং লাডাকে এসে মানসিক শান্তি আর চোখের আরাম দুইই হলো তবে ফেরার পথের অভিজ্ঞতা সাঙ্ঘাতিক। আমাদের ফেরা ছিলো শ্রীনগর হয়েই কিন্তু কারগিলে এসে গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে ক্লাউড বাস্ট রাস্তা বন্ধ।অগত‍্যা সারারাত চরম উৎকণ্ঠায় প্রায় জেগে থেকে কাটানো।সে এক দুঃস্বপ্নের রাত,তার আগেই ঈদ হয়ে গেছে তাই ওদের হুল্লোড়, সেনার গাড়ির শব্দ,কখনো বুটের আওয়াজ সব কিছুর মধ‍্যে আতঙ্কে কাটানো এক রাত্রি। ভোর তিনটেয় উঠে আবার গাড়ির লাইনে দাঁড়াই,সেদিনই বিকেল চারটেয় ফ্লাইট বাড়িতে দুই ছেলে মেয়ে। অনেক করে সকাল ছটায় গাড়ি যাবার অনুমতি পায়। কিন্তু আবার আটকায় গাড়ি কাদার স্তূপের আগে।সারি দিয়ে গাড়ি,মিলিটারি এসে পথ আটকায়।অগত‍্যা কিছুটা হেঁটে লোকাল গাড়ি ধরে আবার রওনা দিই বহু বাধা অতিক্রম করে যখন শ্রীনগর থেকে একঘন্টা দূরে তখনই চারটে বেজে গেছে। মিস্ করলাম ফ্লাইট,ফোনে চার্জ নেই বাড়ির সাথে যোগাযোগ বন্ধ। অপরিচিত কিছু কাশ্মীরি ছেলে আমাদের নিয়ে চলেছে। সারাদিন খাওয়া নেই গলা শুকিয়ে কাঠ উৎকন্ঠাতে। হঠাৎই বুদ্ধি এলো মাথায় ওদের বললাম আমাদের ফ্লাইট চলে গেছে জানি কিন্তু একটু দয়া করে আমাদের এয়ারপোর্ট ছেড়ে দাও।ওরা বললো কিন্তু আপনাদের এজেন্ট তো আপনাদের হোটেলে নিতে বলেছে,আজ নাকি আর কোন ফ্লাইট নেই আগামী দুদিনও টিকিট নেই। আমি খুব অনুরোধ করলাম ওদের এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবার জন‍্য।বুঝলাম আমরা কোন জালে জড়িয়ে যেতে চলেছি। ছেলেগুলোর মায়া হলো আমার মুখ দেখে বারবার বললাম ছেলেমেয়ে রেখে এসেছি।
       ওরা আমাদের এয়ারপোর্ট নিয়ে এলো,আমাকে গাড়িতে রেখেই আমার স্বামী ভেতরে গেলো একটু বাদেই ছুটে এসে বললো তাড়াতাড়ি আসতে। দেখলাম এয়ারপোর্টের লোকরাই খুব সাহায‍্য করলো খুব।অনেক কৃতজ্ঞতায় ছেলেগুলোর হাতে সামান‍্য টাকা দিলাম ওদের মুখেও তখন শান্তির হাসি আমরা চলে যাবো এই আনন্দে।
      খুব তাড়াতাড়ি কার্ডে টিকিট কেটে দিল্লীর ফ্লাইটে উঠে বসলাম।কোনরকমে ফোনটাতে একটু চার্জ দিয়ে ছেলেমেয়েকে বললাম আমরা আসছি ভাবিসনা,দিল্লী গিয়ে ফোন করবো। ফ্লাইটে বসার আগে ট্র‍্যাভেলিং এজেন্টকে ফোন করলাম, আমরা ফ্লাইট পেয়েছি চলে যাচ্ছি।কারণ জানি ও আর আমাদের আটকাতে পারবেনা। দিল্লী পৌঁছে প্রায় সতেরো আঠেরো ঘন্টা বাদে খেলাম।অনেক টেনশন তিক্ততা আর পরিশ্রমের মাঝেও মনে হলো মাঝ রাতে বাড়ি পৌঁছবো। অবশেষে নির্ধারিত দিনেই বাড়ি আসতে পারছি একটু দেরি হলো,তবুও তো পৌঁছবো শান্তির নীরে। সেই ঘটনার পর কাশ্মীর কেন যেন আর টানেনা।

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...