#চকোলেট_ডে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
দোকানের সামনে এসে একটু আনমনা লাগে উৎসবের,খুব সুন্দর সাজানো দোকানটা।পাড়ার দোকান যে এত রূপসী হতে পারে আগে দেখেনি। হঠাৎই মনে হলো প্রেমের ঝড় উঠেছে তো এই ফেব্রুয়ারীতে।এমনিতেই শীত যাবার মুখে তারপর আকাশে লেগেছে নেশা বাতাসে বহিছে প্রেম বসন্ত আসছে,গানটা একটু কাটাকাটা মনে হলো। এই শীতের টুপি মাফলার আর জ্যাকেটের মধ্যেও ভেসে আসছে দূর থেকে বসন্তের গন্ধ। এই সপ্তাহে পরপর আসছে প্রেমের পারদ একটু একটু বাড়ানোর দিন আর তারপর বৃষ্টির মত একদম ঝেঁপে নামবে প্রেমের রঙে রাঙা হয়ে ভ্যালেনটাইন ডে।
উৎসবের নামটা উৎসব হলেও মনে মনেই মোটামুটি সব উৎসবের স্বাদ নিয়ে নিতে হয় ওকে। মানিব্যাগটা বের করে দেখে মাত্র কয়েকটা দশ টাকার নোট পড়ে আছে। ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে কয়েকটা টিউশন করে ফেরে। আর অফটাইম তেমন নেই,চাকরি বাকরির অবস্থা তেমন কিছুই ভালোনা।বিশেষতঃ ওর মত এই সাধারণ ভাবে বি.এ,এম.এ পড়া ছেলেদের।হঠাৎই বাবার চাকরির মাইনে বন্ধ,শুনছে কোম্পানিটাই উঠে যাবে তাই আগে থেকেই কিছু মানুষকে অকেজো করে বসিয়ে রাখা। বাসের জানলায় বসে মনটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় সামনে একটা ভবিষ্যৎ যা হয়ত অন্ধকার,আলো কি আছে তাতে?জানেনা কি আছে কপালে,অথচ একটা সুন্দর সংসার ওদের মা,বাবা,ভাই।সবাই হয়ত কিছু কিছু চায় ওর কাছ থেকে। বাসটা সিগন্যালে দাঁড়িয়েছে..."বাবু লজেন্স নিননা,ও দাদাভাই লজেন্স নিননা।"
আজকাল এইটুকু ছেলেগুলো কেমন চালাকের গাছ এই বয়েসে রোজগারের ধান্ধায় বেড়িয়ে গেছে।
"এই স্কুলে যাসনা কেন?লজেন্স বিক্রি করছিস? কে তোকে পাঠিয়েছে এগুলো দিয়ে শুনি?"
ছেলেটা উত্তর দেয়না তাড়াহুড়ো করে।
" বল আগে তাহলে কিনবো।"
" কিনবেন! বাবা যে হাঁটতে পারেনা।পা দুটো হঠাৎই.... চোখটা ছলছল করে ওঠে ছেলেটার।আমি স্কুলে যাই তো সকালে গেছিলাম ওখানে খাবার খেয়ে এই এখন লজেন্স নিয়ে বিক্কিরী করছি।"
নিজের সাথে কেমন যেন গুলিয়ে ফেললো ছেলেটাকে উৎসব।প্রেমের উৎসবের মাঝে পেটের আর ক্ষিদে মেটানোর উৎসব চলছে অলক্ষ্যে। ধ্যাৎ আজকালকার ছেলেমেয়েরা আবার লজেন্স খায় নাকি?যত দামী উপহার,চকোলেট যদি হয় বিদেশী তাহলে দেশী প্রেমেও লাগে রঙের ছোঁয়া।
" বাবু জ্যাম ছেড়ে গেছে,নেবেননা লজেন্স?
..." হ্যাঁ হ্যাঁ দে তো? তিরিশ টাকার।"
অবাক হয়ে যায় বাচ্চা ছেলেটা বাসে বোধহয় এত টাকার লজেন্স একসাথে বিক্রি হয়না। ওর চোখটা চকচক করে ওঠে ততক্ষণে বাসটা নড়ে উঠেছে।উৎসবের দুই হাত ভরে লেবু,আনারস,টক ঝাল লজেন্স দিয়ে টাকাটা তাড়াতাড়ি প্যান্টের পকেটে ভরে।
" এই নাম নাম বাস ছেড়ে দিয়েছে।"
হঠাৎই উৎসব অবচেতনেই বলে ওঠে.." আস্তে আস্তে দাদা বাচ্চা নামছে।"
ছেলেটা লাফ দিয়ে নেমে ভিড়ে মিশে যায়।আরেকটু বাদে উৎসবও তো ভিড়েই মিশে যাবে। একদল মানুষের ভিড়ে যাদের কারো ব্যস্ততা,কারো বা মুখে চোখে প্রেম বা উৎকন্ঠা আছে মিশে।তবুও স্বপ্ন বোধহয় সবাই দেখে একটু ভালো থাকার স্বপ্ন।
টিউশন পড়ায় বেশ কয়েক জায়গায় উৎসব..একটু নির্লজ্জ হয়েই টাকা একদম চেয়ে নেয় দুই তিন তারিখ হলেই। ওটুকুই তো ওর মত বেকারের ঘরে বাইরে সম্বল। তবে আজ রবিবারটা ও নিজের মত কাটায়।
বাস থেকে নেমে পা বাড়ায়,মানিব্যাগটা চুপসে গেছে ভেবেছিলো তিস্তার জন্য কুড়িটাকার একটা কিছু কিনবে।ওদের প্রেমের তো এটাই প্রথম বছর তাই সব স্বাদগুলো নিতে ইচ্ছে করে।মানে প্রেম সপ্তাহের যেটুকু স্বাদ ওর সাধ্যের মধ্যে তিস্তাকে দিতে পারে।
তিস্তা একগাল হাসে," লেটুরাম।"
" চোখ বন্ধ কর।"
" কেন রে? এক সপ্তাহ বাদে প্রায় দেখা হলো চোখ বুজবো কেন?
তবুও চোখ বোজে তিস্তা,ওর মুখে এখনো হাসি।ওর গালের টোলটা দোলা দেয় উৎসবকে।
দুহাতে হাতটা ধরে মুঠোটা লজেন্সে ভরে দেয়..." হ্যাপি চকোলেট ডে। শোননা একদম হাত খালি তাই লজেন্স ডে ঐটুকুই আনতে পেরেছি। কয়েকটা ভাইয়ের জন্য থাক।মাও ভালোবাসে।"
চোখটা একটু ভেজা আদরে তিস্তার.." ঐ টুকু কেন আমি তো ভীষণ ভালোবাসি লজেন্স। ছোটবেলা প্রতিদিন খেতাম লেবু লজেন্স আর ললিপপ। এতোগুলো আমি খাবো!
" আমি জানিনা,ইচ্ছে হলো দিলাম।তোর যা খুশি কর। চল এবার।"
ওরা গলিটা দিয়ে হাঁটতে থাকে তিস্তার হাতটা উৎসবের হাতে ধরা। একটু এগিয়ে হাতটা ছেড়ে দেয় ওরা ওদিক থেকে আওয়াজ আসে...
" দিদিমণি আর স্যার এসে গেছে।"
রবিবারটা তিস্তা আর উৎসব বস্তিতে পড়াতে আসে।না না এখানে পয়সা নিয়ে নয়,এটা ওদের ভালোবাসা।
"সব বসে যা দেখি এবার,বই খাতা বার করার আগে চোখ বন্ধ করে হাতটা খোল।"
ওদের বাড়ানো হাতে একটা একটা করে লজেন্স দেয় তিস্তা।"
কোথায় যেন শুনেছিলো ভালোবাসা দিলে দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে।ভাগ করে খাওয়ার মজাই আলাদা। ত্রিশ টাকায় দশটা হাসিমুখের সাথে চকোলেট ডে সেলিব্রেশন আর সেই ছেলেটা ...হ্যাঁ ভালো থাক ছেলেটা।ওর ছোট কাঁধেও অনেক দায়িত্ব।
বাতাসে তখন প্রেমের মিঠে গন্ধ ভরপুর ছড়িয়েছে।গালে লেবু লজেন্স পুরে তিস্তা নামতা শেখাচ্ছে ওদের। নিজেকে কেমন যেন হিরো হিরো লাগছে উৎসবের... তবে তিস্তার আড় চোখের চাউনি আর টোল ফেলা হাসি দেখে হোমওয়ার্ক চেক করতে করতেও কেমন যেন ফিদা হয়ে গেলো। কে জানে মন ভালোবাসায় ভরপুর থাকলে কখনো বা লেবু লজেন্স দিয়েও জীবনের প্রথম চকোলেট ডে সেলিব্রেশনটা বেশ ফাটাফাটি হয়ে যায়।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment