#কথা_দিলাম#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
বিয়েবাড়িতে এক কোণে মুখটা কাচুমাচু করে বসে আছে গুঞ্জন। একটু ফিসফিস কথা,চোরা চাউনি মাঝে মাঝেই এদিকে ওদিকে। খুব অস্বস্তি হয় মুখ বাড়িয়ে খোঁজে রাণাকে। কানে আসে.....'দেখেছো একা বসে আছে শাশুড়ি আসেনি মনে হচ্ছে। রাণাটাও পারে একেবারে যাতা করলো।'
রাণা যে কি যা তা করেছে মাঝে মধ্যে মাথায় ঢোকেনা গুঞ্জনের। ভালোবাসা কি যাতা কাজ! হয়ত তাই গুঞ্জনের মত একটা মেয়েকে ভালোবাসা হয়ত একটা সত্যিই বাজে কাজ।
হঠাৎই কানে আসে," ও মা বৌদি তুমি এখানে একা কেন?কাকিমা আসেনি?আর রাণাদাই বা কোথায়?"
তুঁতে সরু জড়ির পাড়ের শাড়ি আর কপালে ছোট্ট লাল টিপে সত্যিই অনন্যা গুঞ্জন।সাজতে চাইলেও বেশি সাজতে পারেনা কেন যেন হাতটা আটকে আসে। " ও একটু ওদিকে গেলো, একটু বাদেই আসবে।মা বোধহয় ফোন করেছিলো বাড়ি থেকে।"
মিঠাই গুঞ্জনের হাতটা ধরে এনে বসিয়ে দেয় ওর নতুন বৌদি যেখানে সেজেগুজে বসে আছে ঠিক সেখানেই একটা পাশে।
" তুমি বসে বসে গল্প করো বৌদির সাথে।মানে দুই বন্ধুতে গল্প করো।একা বসে থাকবে কেন শুনি?"
মিঠাইয়ের নতুন বৌদি কলি গুঞ্জনের খুব বন্ধু আর হয়ত ওর জন্যই রাণা এসেছে ওর জীবনে।
" আচ্ছা মিঠাই ওকে একদম নতুন বৌমার পাশে না এনে বসালে চলছিলো না! উঃ সংস্কার বলে তো একটা কথা আছে।"
মিঠাইয়ের মুখে একটু বিরক্তি ফুটে আসে কেন বলতো মাসি?কি সুন্দর লাগছে বলতো দুই বন্ধুকে পাশাপাশি আর গুঞ্জনবৌদিরই বা কদিন বিয়ে হয়েছে? দুজনেই তো নতুন বৌ।আমার তো মনে হয় রাণাদাই লাকি বেশি দাদার চেয়ে..কে বেশি সুন্দর বলতো?
মজা করলেও মিঠাই জানে সৌন্দর্যের মাপকাঠি বোধহয় মন দিয়েই হয়।যদিও সেটা চট করে বোঝা যায়না।তবে যার সত্যিকারের দেখার মন আর অনুভূতি আছে সে বুঝতে পারে।
মুখটা বেকিয়ে মাসিমণি বলে ওঠে.." লাকি তো বটেই তাই বাছুর সমেত ঐ...।"
" থাক মাসিমণি সবাই তো জানে সেটা।গুঞ্জনবৌদি শুনলে ওর খারাপ লাগবে।একদম মুখটা শুকিয়ে বসেছিলো এক পাশে।"
গুঞ্জনের বিয়ের পর পাড়াতে এই প্রথম বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন।আর কলি ওদের দুজনেরই বন্ধু তাই না এসে উপায় নেই। আসার সময়েই ওর শাশুড়িমা বলেছেন.." তোরা যা ও থাক আমার কাছে।তোরা এলে আমি আর তোর বাবা যাবো। পিকলুকে ঠাম্মুর আঁচলটা মুঠো করে ধরে ঘুমোতে দেখে এসেছে গুঞ্জন।"
রাণা যখন গুঞ্জনকে বিয়ে করতে চায় একদম কি মেনে নিয়েছেন ওর মা?হয়ত মানেন নি মন থেকে মনে হয়েছিল রাণার.." মা যদি তোমার কোন আপত্তি থাকে গুঞ্জনের ব্যাপারে আমি চলে যাবো।তবে আমার খুব কষ্ট হবে কারণ আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই।"
আর কোন কথা হয়নি চাঁপা রঙের বেনারসীতে তুঁতে পাড় দেওয়া শাড়ি পরে গুঞ্জন পা রেখেছিলো রাণাদের বাড়িতে।
জোর পি এন পিসি হয়েছিল পাড়াতে। " বিধবা হতে না হতেই একদম একটা ভালো ছেলে পেয়ে গেলো।আর কত কুমারী মেয়ে রয়ে গেলো।আচ্ছা শোকের মধ্যে প্রেম এলো কি করে বলতো?"
ভাগ্য ভাই ভাগ্য।
সত্যিই বোধহয় গুঞ্জনের ভাগ্য তাই দুহাত উজাড় করে ভালোবাসা দিয়েছে রাণা। গুঞ্জন যখন কিছুতেই রাজি হচ্ছিলোনা তখন রাণাই বলেছিলো.." আমি তোমাকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু দিতে পারবোনা..তুমি আমাকে পিকলুর বাবা হতে দাও।"
যে কথা ওর মা বাবা ছাড়া আর কেউ জানতোনা তা বলে হাল্কা হয়েছিলো গুঞ্জনকে। গুঞ্জন আর ফেরাতে পারেনি রাণাকে। অপয়া,বিধবা নামটা মুছে দিয়ে পিকলুর বাবা হয়ে গিয়েছিলো রাণা।
কলির সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে বারবারই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলো গুঞ্জন।রাণা এলেই বাড়ি যাবে। মাও আটকে আছেন নিশ্চয় এতক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেছে ছেলে।
কলিই ওকে দেখায়.." ঐ দ্যাখ।"
ইশ্ একদম ছেলেকে কোলে নিয়ে চলে এসেছে রাণা!এমনিতেই সবাই কেমন করে ওকে দেখছে।
ছেলেকে নিতে হাত বাড়ায় গুঞ্জন,হাত ঘুরিয়ে নেয় দুষ্টুটা। " থাক ও আমার কাছে, তুমি বরং আগে খেয়ে নাও মা এসেছে মায়ের সাথে।"
হঠাৎই গুঞ্জনের কানে আসে.." রাণা বিয়ে করেছো শুনলাম দুমাস আগেই। বাচ্চাটা কিন্তু খুব মিষ্টি,কার মত দেখতে আগের বাবার মত?"
বুকটা কেমন যেন কেঁপে ওঠে গুঞ্জনের কি বলবে রাণা কে জানে!
" বাবা তো বাবাই হয় মাসিমা আগের আর পরের কি আছে? ও আমার ছেলে আমিই ওর বাবা। "
ভদ্রমহিলার মুখটা কেমন যেন হয়ে যায়.." ও হ্যাঁ তাইতো। তা হলেই ভালো।"
গুঞ্জনের মনটা ভারী হয়ে যায় এই কথাগুলো কবে শেষ হবে কেজানে? হয়ত পিকলুকেও কেউ ছাড়বেনা।কি পায় মানুষ এভাবে অন্যের ব্যাপারে এত খোঁজ নিয়ে?
পিকলুকে জড়িয়ে শুয়ে গুঞ্জন মনটা ভালো নেই। পাশবালিস দিয়ে যত্নে ছেলেকে রেখে গুঞ্জনকে কাছে টানে রাণা,আদরে ভরিয়ে ভরিয়ে দিতে বলে সাতপাকে বেঁধেছি,আদরে বাঁধলাম একদম দুই হাত দিয়ে শক্ত করে। আর চলো তো বাইরের লোকের কথায় একদম কান না দিয়ে প্রপোজ করি আরেকবার..ভালো বাবা হতে চাই আমি,পিকলুর ভালো বাবা।আগের বা পরের নয় শুধুই বাবা।"
গুঞ্জনের কাজলমাখা চোখদুটো দিয়ে জল গড়িয়ে পরে," আস্তে আস্তে বলে এতো ভালোবাসা আমি ধরে রাখতে পারবো তো।"
" আমার ঐ আ্যক্সিডেন্টটার পর আমি যে বাবা হতে পারবোনা তা তো তোমাকে বলেছি গুঞ্জন তাও তুমি আমাকে ভরে দিয়েছো। আমিও তোমাকে আর আমাদের ছেলেকে যত্নে আগলে ধরে রাখবো সারাজীবন।"
কথা দেওয়া,পাশে থাকা,প্রপোজ আর প্রমিস হয়ত সবটাই কথার কথা তবুও কথাই তো কখনো ভরে রাখে আবার কখনো মন খালি করে দেয়। আজ রাণার কথায় কানায় কানায় ভরে গেলো গুঞ্জনের আহত মনটা এই ভরসাটুকুতেই হয়ত ছোট্ট ঘরের কোণে স্বপ্ন সাজিয়ে বাঁচবে আর বাঁধবে সুখের বাসা।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment