#ভালোবেসো_সখী#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
"এই শোন আমাকে আর শাড়ি টাড়ি দিসনা বুঝলি। খুব ভয় লাগে আজকাল।"
" সে কি মা!চিরকালই তো তোমাকে শাড়ি পরাই দেখেছি। এই বয়েসে এসে আবার হলো কি?"
মেয়ের কথা শুনে সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার দিকে তাকায় বন্দিতা।নিজেকে জরিপ করে হয়ত। এখনো হাসলে নাকি ওকে মিষ্টি লাগে তা প্রণবের অনেক বন্ধুরাই বলে। তবে পায়েলের বিয়ে হয়ে গেছে এটাও ঠিক।মানে বন্দিতা এখন শাশুড়ি।
" কি হলো মা?কিসের আবার ভয়?শাড়ি পরতে? তুমি তো ভালোই ম্যানেজ করো।"
" চিরকাল তো করে এসেছি। তবুও আজকাল মনে হয় কে জানে যদি পায়ে জড়িয়ে উল্টোই। তোর মামীকে দেখলি না কেমন শাড়ি পরে পড়ে গিয়ে কি সাঙ্ঘাতিক কান্ড।"
মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসে পায়েল
" তাহলে মাম্মীজি তুমি কি এবার নাইটি পরেই রাস্তায় নামবে? নাকি আমি রেডি টু ওয়্যার কিছু দেখবো?"
" না ভাবছিলাম যদি স্কার্ট আর টপ পরা যায়। আজকাল সবাই পরছে তো।ভালোই লাগে দেখতে।"
" ভালোই লাগে কিন্তু কোন দোকানে তোমার সাইজের স্কার্ট পাওয়া যাবেনা আমি নিশ্চিত।"
" আরে ঐ যে পেঁচিয়ে পরে মানে র্যাপার ওটা পরবো। আর তার সাথে কুর্তা।"
"মা তোমার পাছু আর ভুঁড়িটা দেখেছো।ওটা তো দিন দিন বাড়তেই আছে আর বাড়তেই আছে। আমার বাবা মানে তোমার বর তো আদর দিয়ে দিয়ে তোমাকে একদম এই রকম বানিয়েছে।"
মেয়ের কথাতে কেন যেন হঠাৎই মনটা খারাপ হয়ে যায় বন্দিতার।অথচ পায়েল মেয়ে খারাপ নয় নিজে সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও মায়ের জন্য দামী শাড়ি এনে দিচ্ছে।আবার মায়ের পছন্দের খাবার দাবার আনে।তবে এইভাবে মায়ের ভুঁড়ির দিকে আঙুল তোলাটা কেমন যেন বুকে বাজলো। সত্যিই ভীষণ মোটা হয়ে গেলো কয়েক বছরের মধ্যেই।অথচ এমন তো ছিলোনা,হ্যাঁ পেছনটা চিরকালই একটু ভারী,পায়েলেরও তো অমনটাই হয়েছে আর মায়েরও তেমন ছিলো।মানে ওদের বংশের ধারাই এটা।
" একটু বড় সাইজ নিয়ে নেবো।আজকাল অনলাইনে তো প্লাস সাইজ পাওয়া যায় শুনেছি সেখানে পাবোনা?"
"তুমি দেখতে পারো তবে মনে হয়না তোমার মাপে কিছু পাবেনা। কেন এই যে গত মাসে বুটিক থেকে শাড়িটা আনলাম তোমার পছন্দ হয়নি?হঠাৎ আবার কি হলো? তোমার যে আজকাল কি হয়েছে?"
সত্যিই কি যেন হয়েছে..মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি দিনগুলো চলে যাচ্ছে। বিয়ে করেছিলো প্রেম করে প্রণবকে,তখন এইসব ফ্যাশন কোথায় তেমন।সেই বড় টিপ,মাথায় তেল,তাঁতের চওড়া পাড় শাড়ি আর লাল ব্লাউজ।
ছেলেমেয়ে মানুষ করতে গিয়ে মধ্যবিত্ত সংসারের পরতে পরতে সুখের ছোঁয়া আনতে আনতে কখন যে বসন্ত চলে যাওয়ার মুখে বুঝতেই পারেনি। আর ইউটেরাস অপারেশন করার পর যেন খুব তাড়াতাড়ি ওজন বেড়ে গেলো। হবেই না বা কেন,বাড়িতে নিত্য ভালো মন্দ খাওয়া। প্রায়ই লোকজন আসছে সেই উপলক্ষ্যে যা আসছে তার ভাগ তো কিছুটা হলেও পেটে যায়। প্রণবকে বললেই বলে খাও,খাও।আরে জীবন তো একটাই নাকি। একটা সময় যা ভালোবাসা ছিলো এখন তা অভিশাপ মনে হয়।
ফুরফুরে চেহারা নিয়ে পাঞ্জাবী পরে যখন প্রণব বাইরে চলে যায় তখন মনে হয় ওর এই থপথপে চেহারা ছাড়া আর কেউ নেই সাথে।
অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু তেমন কিছু কই আর কমে?
আজকাল খুব ইচ্ছে করে একটু ভালো কিছু পরতে নিজেকে পরিপাটি রাখতে।দোকানে গিয়ে দোকানদারের মুখ টেপা হাসি দেখে মনটা তিক্ততায় ভরে ওঠে। দর্জিও আজকাল মাথায় হাত দিয়ে বসে মাপ নিতে।
ঘরে বাইরে বডি শেমিংয়ের শিকার বন্দিতা।
" উফ্ একটু চেপে শোও তোমার চাপে তো আমার হাড়গোড় ভাঙবে।" অথবা "তোমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া মানেই তো গাড়ি ছাড়া উপায় নেই যা বানিয়েছো বাসে উঠতেই হয়েছে।"
সিনেমায়,শপিং মলে ও যখন হাঁটে তখন মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে অনেক জোড়া চোখই তাকিয়ে থাকে। আজকাল তো মনে হয় প্রণব বা পায়েলও অস্বস্তিতে থাকে ওর জন্য। কোথাও যাওয়া মানে তুমি বোসো এখানে।
ঘরে বাইরে শুধু শরীর আর শরীর,আর শরীর মাপা।তোমার পেটটা বাজে ভাবে ঝুলছে। পেছনটা ভীষণ বড়।পা গুলো হাতির মত। কি করবে? কি করবে ও? নিজেকে সাজাতে তো ইচ্ছে করে,কত রকমের পোশাক এখন।ওর বয়েসী কত মহিলাই তো পরছে। আজকাল প্রণবও মুগ্ধ হয়ে তাকায় জিন্স পরা মহিলাদের দিকে অথচ ফাস্টফুড এটা সেটা করে খাইয়েছে একটা সময় ওকে.." আরে খাও খাও।খাওয়া বিনা জীবনের কোন মানে আছে কি?"
সেই লোকই এখন খাওয়ার খোঁটা দেয়। পায়েলও বলে সর্বস্ব দাও ঐ পেটে। বেশ বড়সড় জালা তো এটা। ঐ পেটটায় হাত দিয়ে কান্না পায়।শরীরের লজ্জা আর সেই লজ্জা মনকে ছুঁয়ে গুটিয়ে যায় বন্দিতা। সবাই ওকে মাপে চোখ দিয়ে মুখে রসাত্মক হাসি নিয়ে। এই দলে কারা আছে?মেয়েদের চোখের কাছেই বোধহয় ওর অপমান আরো বেশি। এমনকি মেয়েটাও তো ওর বডিশেমিং করে,হয়ত ভালোবেসেই বলে।তবুও তো কষ্ট হয়।
বরকে একটা সালোয়ার বানানোর কথা বলতেই বললো," তোমাকে টাকা দিচ্ছি,তুমি কাপড় কিনে বানাতে দাও। আমি দোকানে যেতে পারবোনা।"
কেন যাবেনা সেটা না বোঝার মত বোকা নয় বন্দিতা।
আচ্ছা মানসীদিকে বলবে ওর সাথে যেতে? মানসীদিও তো সব রকম পোশাক পরে। অথচ তে খুব রোগা তা নয়।পায়েলকে বলতেই বলেছিলো,"হ্যাঁ মাসি হেলদি কিন্তু কতটা লম্বা দেখেছো।তা ছাড়া ক্যারি করতে পারে।"
একটা হোয়াটস আ্যপ করে দেখবে মানসীদিকে? ইতস্ততঃ করেও করে লেখে," তুমি কোথা থেকে ড্রেস কেনো গো? কি ভালো লাগে। আচ্ছা আমার পাওয়া যাবে? একদিন যাবে আমার সাথে?"
বন্দিতার সাথে কথা বলেই বুঝতে পারে মানসী যেটা অন্য লোকের কাছে মজার খোরাক সেটা কিভাবে বডিশেমিংয়ের কুৎসিত আঘাতে পুরো ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে বন্দিতার আত্মবিশ্বাস।
"আচ্ছা সামনে সপ্তাহে একটা পুরো দিন কাটাবো তোর সাথে ঠিক আছে। খুব সুন্দর সেজে আসবি কিন্তু।"
অনেকদিন বাদে একটু মুক্তির আশ্বাসের খোলা হাওয়া লাগে বন্দিতার চোখে মুখে। মানসী বন্দিতাকে নিয়ে এসেছে একটা দোকানে ওরা পছন্দ করিয়ে নিলো ফ্যাব্রিকস আর ডিজাইন। "কতরকমের ডিজাইন গো,আমি বুঝবোনা।পায়েল থাকলে বুঝতো।তুমিই দেখো মানসীদি।"
" আমি দেখবোনা, তুইই দেখবি।নিজেকে গোছাতে একটু শেখ এবার।কে কি ভাবলো কি এসে যায় তাতে? নিজের মধ্যে থাকা মেয়েটাকে নিয়ে একটু গর্ব কর।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বন্দিতা," আমার গর্ব করার মত আর কি কিছু আছে?"
" আছে তো? কেন তোর তুই। যার যেটুকু আছে তার সেটাই সৌন্দর্য। নিজের শৈশব আর যৌবনের মত মেনোপজটাকেও উপভোগ কর।"
" কিন্তু হাসাহাসিটা,বডিশেমিং?"
" আসলে তো সরষেতেই ভূত। মেয়েরাই মেয়েদের বোধহয় সবচেয়ে বেশি সমালোচক আর পায়ের বেড়ি। কবে যে সব পাল্টাবে আমাদের মানসিকতা!"
সপ্তাহ দুয়েক বাদেই এলো সেই ভারী প্যাকেটটা।মনটা ফুরফুরে বন্দিতার।সবাই যখন হেসেছে,মানসীদি ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ড্রেসগুলো পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পায় বন্দিতা। না এবার সত্যিই সচেতন হতে হবে একটু নিজেকে ভালোবেসে। আরে ফিট তো থাকতেই হবে আর হাসতে হবে প্রাণ খুলে প্লাসেও। আরে প্লাস মানে ফিফটি প্লাস,প্লাস সাইজ,প্লাস হাসি,প্লাস খুশি,প্লাস ভালোবাসি সব নিয়েই।
ভালোবাসি সে আবার কাকে? আরে অবশ্যই নিজের শরীরটাকে যেমনই হোক ওটা একান্তই আমারই তো। অনেক দিন বাদে রবীন্দ্রসঙ্গীত আসে গলায় গাইতে থাকে বন্দিতা..'ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি নিয়ো'....
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment