#সহযোদ্ধা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে লাগাতে আরতীকে ডাকে সোনালী।
" আমার শাড়িটা একটু ধরতো দেখি একবার এদিকে এসে। কি রে তাড়াতাড়ি আয়।"
ওদিক থেকে সাড়া আসে," আসছি গো একটু দেরি হবে।একটা তো হাত কোনদিকে যাবো বলতো। সকাল থেকে এসে তো ছুটছি।"
" কি এমন কাজ রে আমাদের এত গজগজ করিস সবসময়? ডাকলে সাথে সাথেই আসবি,এত কথা ভালো লাগেনা।"
বেশিদিন থাকলে এই কাজের লোকগুলো একদম মাথায় উঠে যায়।প্রথমেই বাড়িতে এসে বুঝে নেয় বাড়িতে ওর কতটা গুরুত্ব আর তারপরেই সূঁচ হয়ে ঢুকে একদম ফাল হয়ে বেরোয়।যে আরতী একটা সময় একদম মিনমিন করতো আজ দিব্যি মুখে মুখে কথা বলে। যত দিন যাচ্ছে তত সাহস বাড়ছে।তারপর তো বায়নার শেষ নেই আজ এটা দাও তো কাল সেটা।আর কামাই,কামাইয়ের তো অন্ত নাই।আজ বিপত্তারিণী,কাল ষষ্ঠী,পরশু শেতলা পুজো লেগেই আছে। অসহ্য একেবারে জীবন অথচ উপায়ও নেই কোন।তাই দাঁতে দাঁত চেপে থাকো।
প্রায় পাঁচ মিনিট বাদে মহারানী এলেন হেলেদুলে ততক্ষণে আরো পাঁচ বার ডেকেছে সোনালী। এসেই ও কিছু বলার আগেই বলে," দু মিনিট দেরি হয়েছে কি হয়নি ডেকেই যাচ্ছো আর ডেকেই যাচ্ছো। আরে ভাতটা হয়ে এসছে তরকারি শুকুচ্ছে।উপুড় দিয়ে তবে তো আসবো।"
" নে নে বকবক করিসনা বেশি,সারাদিন শুধু কথা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
কোমরের জন্য ঝুঁকতে পারেনা সোনালী।মাটিতে থেবড়ে বসে আরতী পাট পাট করে শাড়ির কুঁচি ফেলতে থাকে।
" শাড়িটা কি সুন্দর গো?তোমাকেও খুব ভালো লাগছে দেখতে। অবশ্য তোমাকে সবেই মানায়।"
সোনালী বুঝতে পারে আরতী তেল মারছে এরপর কিছু একটা বলবে তাই আবার তাড়া লাগায়।
" আমার পুজোর পর বোনঝির বিয়ে।এবার একটা ভালো শাড়ি দিয়োনা গো পুজোতে।এই রকম নীল রঙের।নাহলে তোমার যদি কোন ভালো পুরনো শাড়ি থাকে।"
এতক্ষণে বোঝা গেলো কি চাইছে।ওর কথা শুনেই মাথাটা গরম হয়ে যায়।
" তুই তো বোনাস নিস একদম হিসেব করে। তারপর শাড়ির কথা আসে কোথা থেকে শুনি?"
" বোনাস নাহয় কিছু কম দিয়ে যদি একটা ভালো শাড়ি দাও।তিনবছর তো কাজ করছি গো।"
ভালো শাড়ির দাম কত হতে পারে ওর আন্দাজই নেই। আজ বন্ধুদের সাথে ওদের গেট টুগেদার সবাই শাড়ি পরবে তাই সরু জরির পাড়ের মাইশোর সিল্কটা পরেছে সোনালী।
পরিপাটি করে শাড়ি ঠিক করে দেওয়ায় এখন বেশ ভালো লাগছে ওকে দেখতে।
কাজের লোক হলেও এই কোয়ালিটিটা কিন্তু আরতীর দারুণ। তবে ঐ যে নজর দিলো,কে জানে এই শাড়িটা কদিন টিকবে।
"যা যা এবার তাড়াতাড়ি হাত চালা আমি ড্রাইভার এলেই বেরোবো।"
অনেকদিন বাদে সবার সাথে দেখা,উফ্ কি আনন্দ আর ছবি তোলা। একদম সেল্ফি,গ্ৰুফির ছড়াছড়ি সাথে সাথে ফেসবুকে। আর বন্ধুদের কমেন্ট,এই মাঝবয়েসেও মনে হচ্ছে আবার ফিরে গেছে কলেজের দিনে। অনেক কথার মধ্যে ঘুরে ফিরেই এলো একটা কথা..."আর বলিসনা,কাজের লোকগুলো জ্বালিয়ে খেলো।"
একবাক্যে সবাই যোগ দিলো ঐ আলোচনায়।কারো লোক তর্ক করে,কেউ কামাইয়ের মাস্টার আবার কারো আছে হাতটান।কেউ বা শুধু টাকা বাড়াতে বলে।অথবা এটা দাও সেটা দাও লেগে আছে। কিছুতেই এদের মন পাওয়া যায়না।
" তোদের সমস্যা লোক থেকে।আর আমার সমস্যা আমাদের শোভাদি হঠাৎই মারা যাওয়াতে। আমার সবটা সামলাতো। আমার মেয়ে তো ওর কাছেই মানুষ। এখন তো শোভাদি ছাড়া যে কি খারাপ লাগে।"
'' তোর চাকরি?অসুবিধা হয়না?"
" হয় রে,খুবই হয়।আর মনটাও খারাপ করে খুব।আসলে শোভাদি আমার ঘরের লোকের মতই ছিলো।"
হ্যাঁ শুনেছে সোনালী শোভাদিকে নাকি মেডিক্লেমও করে দিয়েছিলো সুনন্দা।এমনকি বলতো পেনশনও দেবে কিছু,এত বছর আছে। কাজের সাথে সাথে ওর সেভিংসের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলো।
সুনন্দা বলতে থাকে,"তবে শোভাদির বরটা ভীষণ খারাপ ওর অত্যাচারে তো মেয়েকে রেখে বাইরে কাজ করতো। দেশে গেলো,কি জানি কি হলো।হঠাৎই খারাপ খবরটা এলো।"
"তারপর আর খোঁজ নিসনি?"
" মেয়েকে ফোন করেছিলাম। কিছু সাহায্যও করেছিলাম।"
" শোন আর বেশি কিছু করতে যাসনা। এরা বসতে পেলে শুতে চায়। আমার আরতীকে দেখছিনা লেগেই রয়েছে পেছনে। খুব খাই ওর।"
সবার একটাই সমস্যা শুধু চেহারাটা অন্যরকম। যাক ওদের আড্ডার শেষে সবার বাড়ি ফেরার পালা। সবাই সবাইকে বাড়িতে যেতে বললো। সুনন্দা ওকে জড়িয়ে বললো," এই যে সুন্দরী,তুই সবচেয়ে কাছে থাকিস আমার বাড়ির আসবি একদিন বাড়িতে একদম কর্তা আর ছেলে নিয়ে।"
" ওদের কথা বলতে পারছিনা ভাই।আমি ঠিক যাবো একদিন,একদম সারপ্রাইজ দেবো।"
মাঝে কেটে গেছে কয়েকটা মাস। সোনালীর সংসারেরও টালমাটাল অবস্থা। পুজোর সময় বোনাস,শাড়ি,মাইনে বাড়ানো এই সব ছুতোয় আরতী কাজ ছাড়লো। অনেক বুঝিয়েও হলোনা।বললো," কি এমন চেয়েছি বলো? এত করেছি এতদিন।একটা নাহয় শাড়িই চেয়েছিলাম তাও দিতে পারলেনা মন খুলে!"
মাথা গরম হয়ে গিয়েছিলো সোনালীরও এমন কাজের লোক থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। তাই বলেছিলো," এর থেকে বেশি পারবোনা রে পোষালে কর না পোষালে করিসনা।"
" আমার দরকার নেই।বাবা রক্ষে করো রইলো তোমার কাজ।কাজের লোককে মানুষ বলে মনে করোনা তোমরা। ছুটি ছাটা শখ সব তোমাদের,আমাদের শুধুই খেটে মরা।"
কথাগুলো বলে চলে গিয়েছিল আরতী।অনেকক্ষণ মাথায় ঘুরেছিলো কথাগুলো সোনালীর আর রাগে গা জ্বলছিলো।
এর মাঝে দু তিনটে লোক এলো গেলো। এখন যেটাকে পেয়েছে কদিন ধরে আছে,কে জানে কেমন হবে?
বিস্বাদ হয়ে গেছে জীবনটা একদম।সুনন্দাকে ফোন করেছিলো,খুব আসতে বলছিলো তাই ঠিক করেছে ওর বাড়ি যাবে।
সুন্দর সাজানো গোছানো বাগান লাগোয়া বাড়ি। " বাবা কত গাছ লাগিয়েছিস! এত সময় পাস কখন?"
" আয় আয় ভেতরে আয়।"
এই প্রথম ওর বাড়িতে আসা তাই চারদিক ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলো সুনন্দা।
" খুব সুন্দর সাজিয়ে রেখেছিস সব। আমি আগে যাও বা করতাম এখন আর এনার্জী পাইনা।তা মেয়ে কোথায়?"
" ও ফিরবে একটু রাত হবে।ওর একটা ট্রেনিং চলছে।"
কাপে কফি ঢালে সুনন্দা,দুজনে বসে কত গল্প হয়। সংসারের গল্পের মাঝেও মনটা কেন যেন সেই ছোটবেলায় ডুব দেয় ফিরে ফিরে।
হঠাৎই বেলটা বাজে.." ঐ বোধহয় বিন্নী এলো,তুই একটু বোস আমি আসছি।"
কিছুক্ষণ বাদেই ফিরে আসে সুনন্দা সাথে দুই দিকে বেণী বাঁধা স্কুলের পোশাকে একটা মেয়ে। অবাক চোখে তাকায় সোনালী।মেয়েটা এসে ওকে প্রণাম করে।
"এ হচ্ছে বিন্নী,আমার ছোট মেয়ে।এবার টুয়েলভ দেবে। খুব মিষ্টি আর পড়াশোনাতে খুব ভালো। খুব সুন্দর বাগান করতে পারে।গাছরা ওর সাথে কথা বলে রীতিমতো। যা জামাকাপড় ছেড়ে খেয়ে নে।"
" তোমরা খাবেনা?আমি কিছু বানিয়ে দেবো?"
" তুই আগে ফ্রেশ হয়ে নে।"
বিন্নী চলে যেতে অবাক হয়ে তাকায় সোনালী সুনন্দার দিকে।
" তোদের আত্মীয়?খুব কাজের মেয়ে তো।এখানেই থাকে? তোর তাহলে ভালোই হয়েছে।"
" ও শোভাদির মেয়ে রে। ওর মা চলে যাওয়ার পর বাবা পড়া ছাড়িয়ে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছিলো। বিয়ের পাত্রও জোগাড় করে ফেলেছিলো এক মদমাতালকে। কান্নাকাটি ঐ মেয়ের,আঠেরো বছর বয়েস হতেই ওর মামারা দিয়ে যায় এখানে।
একটু কিন্তু যে করিনি তা নয়।ঝিলিকই বললো আমার ছোটবোনের মত একটা মেয়ের জীবনটা নষ্ট হবে।"
" যাক ভালোই করেছিস,এখন যা কাজের লোক পাওয়া সমস্যা।ওর বয়েসটা কম অনেক কাজ করে দিতে পারবে।আর মেয়েটা সরল সাধাসিধে অত ঘাঘু হবেনা।"
মুখটা একটু কেমন যেন হয়ে যায় সুনন্দার তবুও হাসি এনে বলে," শোভাদিকে দিদিই বলতাম সবার কাছে।আর ওকে বোনঝিই বলি। কখনো কাজের মেয়ে বা কাজের দিদির মেয়ে বলিনা। এই ছোট্ট ভালোবাসায় ভরা নামটা নিয়েই মেয়েটা হাত বাড়িয়ে কত কি যে করে বলার নয়। মেয়েটা পড়াশোনাতে ভালো খুব চেষ্টা করছি ওটা যেন বজায় থাকে।"
ওদের কথার মাঝে শোনে," মাসিমণি এই আলু পরোটা খেয়ে দেখো আমি খুব ভালো বানাই।"
" আমি বানাতাম তো,ময়দা তো মাখাই ছিলো।পাকাবুড়ি একটা।"
সুনন্দার প্রশ্রয় আর প্রশংসার সাথে সাথে সোনালীও যোগ দিলো," সত্যি কি সুন্দর বানিয়েছিস রে! আর বাগানের গাছগুলো তো খুব ভালো করেছিস!"
" এদিকে এসো,ঐ টগর আর শিউলি গাছটা মা লাগিয়েছিলো। আর এই যে স্থলপদ্মটাও। এখনও কত ফুল হয়,তলাটা ভরে যায় ভোরবেলায়।"
বিন্নীর কথায় কিছুক্ষণের জন্য ওরা সবাই হারিয়ে গিয়েছিলো।
মনটা শিউলির গন্ধমাখা হয়ে ফিরলো সোনালী।রাস্তায় গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সুনন্দা বিন্নীর কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে। এ যেন এক নির্ভরতার হাত যা বলছে আছি সাথে হারিয়ে যেতে দেবোনা তোকে।
নতুন মেয়েটা খুব জিনিসপত্র এদিক ওদিক করছে। কাল আরতীকে একটা খবর দেবে ভাবে সোনালী। যতই বকবক করুক বড়দিদির মত যত্ন করতো ওকে।আবার ছোটবোনের মত আব্দারও করতো। একটা নীল রঙের ভালো শাড়ি দিতে হবে ওকে যদি রাজী হয় আবার আসতে। সত্যিই তো আমাদের প্রতিদিনে নিশ্চিন্তের আশ্বাস দেয় যারা,একটু ভালোবাসার হাত তাদের দিকে বাড়িয়ে দিলে ক্ষতি কি? ভালো রাখে যারা একটু নাহয় ভালো থাকলো তারা।
#ছয়_দিনের_ছয়_ভাবনা#
#সকলের_জন্য_সাম্য#
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment