Skip to main content

স্বপ্নেরা কথা বলে

#স্বপ্নেরা_কথা_বলে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"তোমাদের বৌমাকে চিকিৎসা করাচ্ছো?"
" আমি ঐসব জানিনা বাপু।এই নিয়ে কথাও বলিনা খুব একটা।তারপর বলবে শাশুড়ি নিগ্রহ করছে।"
" সেটা আবার কি গো?নির্যাতন?"
" হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ নির্যাতন।এত শুনি এই সব কথা।"
নিজের ঘরে যেতে যেতে কথাগুলো কানে আসে
তিথির। একটা বাচ্চা তো ও নিজেও খুব চায়,একদম মন থেকেই চায় কিন্তু হচ্ছেনা।সত‍্যিই হচ্ছেনা।কম ডাক্তার তো দেখানো হলোনা,গুচ্ছের টেস্ট কড়া কড়া সব ওষুধ সব খেয়ে মাঝে মাঝে সারা শরীর হঠাৎই গরম হয়ে ওঠে। মেজাজ বদলায় খুব তাড়াতাড়ি, অকারণেই রাগ হয়।আবার কখনো চোখে ঝরে জল। তবে সবটাই ওর মত সহ‍্য করে অতনুও। কখনো বলে,"চলো শাড়িটা টুক করে পরে নাও তো একটু ঘুরে আসি।"
  " তোমার রাগ হয়না,আমি মাঝে মাঝে এত পাগলামি করি,কাঁদি?"
" রাগ হবে কেন ডাক্তারবাবু তো বলেই দিয়েছেন এই সব ওষুধ খেলে মুড সুইং হয়। তাছাড়া আমি পাগলামি, চিৎকার করিনা। সবাই আমরা পাগল তিথি।এক একজন এক এক রকম।"
     হয়ত তাই সেইজন্য ওর ননদের বাচ্চা হবার আগে সাধের অনুষ্ঠানে ওকে ঘরবন্দী থাকতে হয়েছে। বা বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে একটু আদর করতে চাইলেও ননদ দেয়না। যে কোন অজুহাতে কোল থেকে নিয়ে নেয়। কখনো বলে," বৌদি ওর ঘুম পেয়েছে। খুব ক্ষিদে পেয়েছে গো ওর দাও দাও ওকে।"
     অথচ বিয়ের আগে পাড়াতে সব বাচ্চাদের ঝক্বি যেমন সামলাতো তেমন ছিলো ওর ন‍্যাওটা ভাইপো ভাইঝি গুলোও। অথচ এখন মনে হয় ও কোলে নিলেই বাচ্চাগুলোর বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
                           দেওর তো বিয়ের পর আলাদা বাড়িতেই উঠে গেলো এমনকি সাধেও ওকে ডাকলোনা।খুব কেঁদেছিলো সেদিন তিথি।সত‍্যিই কি ঠাকুর বলে কিছু আছে? মাঝে মাঝে মনে হয় নেই।তাই তো রূপ,গুণ,মাতৃত্ব কিছুই দিয়ে ভগবান ওকে পাঠাননি।অতনুর পায়ের সমস‍্যা পা টেনে হাঁটে তাই হয়ত বিয়েটা এই বাড়িতে হয়ে গিয়েছিলো। ওর ননদ আর জা দুজনেই চাকরি করে যখন যা খুশি কেনে। ওদের তাই কথা আর কাজের দাম দুটোই বেশি। অথচ সারাদিন কাজ করেও একটু ভালো কথার ছোঁয়া পায়না তিথি। শাশুড়িমা ভালো খারাপ কিছুই বলেননা। হয়ত নির্যাতনের ভয় পান।সিরিয়াল দেখেন তো তাই অনেক কিছুই জানেন।
                     অতনুর সাথে বাজারে গিয়ে একটা ভালো শাড়িতে খুব হাত দিতে ইচ্ছে করে।মনে হয় ও যদি কিছু রোজগার করতো তাহলে মা বাবা,অতনু আর বাড়ির সবাইকে কিছু দিতে পারতো।
              পাঁচবছর বাদে নতুন ডাক্তারের কাছে গিয়ে যা শুনলো তাতে আর আশা রাখতে পারলোনা ওরা। প্রায় কয়েক লাখ খরচ হবে কিন্তু সাফল‍্য খুব একটা নিশ্চিত হয়না সব সময়। সেদিন অতনুর বুকে মাথা রেখে চোখের জলে ভেসে গিয়েছিল তিথি," কোথায় পাবো অত টাকা।সত‍্যিই টাকা থাকলেই মা হওয়া যায়?আমাদের নেই তাই পারবোনা?"
  দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতনু একবার ভেবেছিলো নিজের দিকের অংশটা বিক্রী করে কোন ভাড়া বাড়িতে চলে যাবে। চিকিৎসা করাবে তিথির।কিন্তু মা?তাকে ভিটেছাড়া করবে এই বয়েসে?"
                 তিথির মনটা ভালো নেই বলে অতনুই গিয়ে কয়েক দিনের জন‍্য বাপের বাড়িতে রেখে আসে।যদিও মায়ের খুব একটা ইচ্ছে ছিলোনা.." আমি কি আর এখন এত করতে পারি? তোর অফিসের ভাত দেওয়া,টিফিন করা।"
" মা কদিন আমি ক‍্যান্টিনে খেয়ে নেবো তুমি ভেবোনা।ওর একটু পরিবর্তন জরুরী।"
          বাপের বাড়ি এসে কদিন একটু মনটা অন‍্যরকম হয় তিথির। তবুও মাঝে মাঝেই একটা চাপা দুঃখও আসে বুক থেকে। দেখতে দেখতে প্রায় দশদিন পার হয়ে গেছে।এর আগে কোনদিন বিয়ের পর এতদিন বাপের বাড়ি থাকেনি তিথি।যদিও ফোনে প্রতিদিন কথা হয় অতনুর সাথে। এবার সত‍্যি ওরও মন কেমন করছে বরের জন‍্য।
  তার মধ‍্যে সেদিন বোন মজা করে.." কি রে দি জামাইবাবু কি তোকে ভুলে গেলো নাকি?
     একটা অজানা ভয় কেমন যেন মনে জমে তিথির হয়ত বা সন্দেহও..ওর বাচ্চা হবেনা তাই কি ওকে বাপের বাড়ি রেখে চলে গেলো অতনু? আর নেবেনা ওকে?
    "তুমি কবে আসবে গো? এখানে আর কতদিন থাকবো?"
  " আরে যাওয়া তো হয়না এসেছো তো কদিন থাকো না। আমার এদিকে খুব চাপ সময় পাচ্ছিনা।পেলেই চলে যাবো।"
    খুব অভিমান হয় তিথির যে অতনু বৌ ছাড়া থাকতে পারেনা সে দিব‍্যি আছে বৌ ছাড়া।
" তুমি আমাকে ভুলে গেছো আমি বুঝতে পারছি।"
শেষের দিকে গলাটা ভারী হয়ে যায় তিথির..
" মহা জ্বালা তো বরের কাছে থাকলে বাপের বাড়ির জন‍্য কাঁদো।আবার বাপের বাড়ি এসে বরের জন‍্য কাঁদছো? আরে যাবো যাবো সময় পেলেই।"
           অভিমান হয় খুব তিথির কদিন বাদেই তো ওর বিবাহবার্ষিকী। কই কিছুই তো বলছেনা অতনু,ঠিক আছে ও কিছু বলবেনা আর।কোন অধিকারেই বা বলবে কিই বা দিতে পেরেছে ও।আবার মনটা অভিমানে ভরে যায়।
            দেখতে দেখতে দিনটা এসে যায়,কালই তো ওদের বিয়ের তারিখ। অথচ আজও অতনু কিছু বললোনা,সত‍্যি অভিমানে কান্না আসে তিথির।" দিদি আমি বলবো জামাইবাবুকে,একি কান্ড!"
" তুই কিছু বলবিনা আমার দিব‍্যি রইলো।"
রাতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো তিথির, নিজেকে নিস্ফলা বন্ধ‍্যা বলে যেন আরো বেশি মনে হলো। ভালো করে ঘুম হলোনা রাতে। ভোরের দিকে চোখটা লেগে গেলো।
     ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে তিথি অতনু এসেছে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে ওকে বলছে," এতো ভালোবাসি তবুও বোঝোনা।আমি তো আসবোই তোমার কাছে আজকে।"
     ঘুমের মধ‍্যেই কেঁদে ফেলে তিথি হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে যায়। একি স্বপ্ন না সত‍্যি?
  ওকে দুহাতে ধরে পাশে শুয়ে অতনু। ও চোখ খুলতেই আরো জড়িয়ে ধরে। অনেকদিন বাদে চেনা স্পর্শটুকু প্রাণভরে উপভোগ করে তিথি।
       বাইরে থেকে আওয়াজ দেয় ওর বোন..." এক্সকিউজ মি, মে আই কাম ইন?"
     হাসির রোল ওঠে ঘরে।
" আজ আপনি না এলে দিদি যে কি করতো কে জানে?"
  " আরে জানি তো,ঐ জন‍্যই তো চুপচাপ রাতের ট্রেনে উঠে বসেছি।আর একদম ভোর বেলায় হাজির হয়েছি। ঘুমের মধ‍্যেই যা কান্নাকাটি করছে.."
    লজ্জা পায় তিথি। এবারের বিয়ের তারিখটা খুবই আনন্দে বাপের বাড়িতেই কাটলো।রাতে বরের আদরে ভাসতে ভাসতে তিথি বললো," এবার দাও।"
  " কি?"
" প্রতি বছর যা দাও,আমার গিফ্ট।"
" ইশ্ একদম ভুলে গেছি।বাড়ি গিয়েই দেবো রাখা আছে।"
  অভিমান ভরা আদুরে গলায় তিথি বলে," তা তো হবেই আমাকেই তো ভুলে গেছিলে।"
      পরদিন ওরা রওনা দেয়,এবার বাপের বাড়ির জন‍্য মন কেমন করে তিথির।মেয়েদের ভগবান যে কি জীবন দিয়েছেন! এক সাথে বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সব থাকলে কি ভালোই না হত!
                  বাড়িতে ফিরে কেমন যেন একটু পরিবর্তন লাগে তিথির।রঙ হয়েছে নিচের তলাটা। অনেকদিনই অতনু বলছিলো ভাড়া দেবে নিচটা। কিছু টাকা হাতে আসবে তাহলে যদি চিকিৎসার খরচটা আসে।
"তুমি এখানে দাঁড়াও,তোমার গিফ্টটা দেবো। নিচের ঘরেই আছে।"
দরজাটা খুলে আলো জ্বালায় অতনু,অবাক হয়ে যায় তিথি।ঘরে কত বাচ্চাদের খেলনা,ছোট ঘোড়া,আঁকার বই।দেওয়াল জুড়ে ছবি আরো কত কি? কোণে রাখা দুটো বড় টেডি।
   হঠাৎই আবার মনটা খারাপ হয়ে যায় তিথির,এগুলো কেন করেছে অতনু? ওর তো কোনদিনই বাচ্চা হবেনা।
" এসো তিথি,এটাই তোমার বিয়ের তারিখের গিফ্ট। এই দুটো ঘর নিয়ে একটা ক্রেশ খুলবো। অনেকেই রাখবে বাচ্চা এখানে।নাইবা হলো আমাদের সন্তান,একদল কুচোকাচার মাঝেই কেটে যাবে তোমার সারাদিন। ওরা বড় হবে আবার আসবে আরেক দল ছোট ছোট কুট্টি।যাদের তুমি দেখবে,যত্ন করবে। নিজের সন্তানও তো পরিযায়ী পাখীর মতই, বড় হলে বাসা ছেড়ে উড়ে যায়।তাই ওদের মধ‍্যেই না হয় আমরা খুঁজে পাবো সন্তান পালনের আনন্দ।"
     চোখদুটো বড় ভেজা তিথির।কত অভিমান করেছে এই কদিন লোকটার ওপর।কত কি ভেবেছে। অথচ ওকে ভালো রাখার কথাই ভেবেছে মানুষটা এই কদিন ধরে।
   " এখানে লোকে বাচ্চা রাখবে?"
" রাখবে গো,আমি কথা বলেছি অনেকের সাথে। টাকা আর আনন্দ দুটোই আসবে একসাথে। আমাদের নিষ্প্রাণ বাড়িটা বাচ্চাদের কলকাকলিতে ভাসবে।
আমাদের যে ভালো থাকতেই হবে তিথি আর দুজনের দুজনকে ভালো রাখতে হবে। পাশেই যদি না থাকতে পারলাম আর তোমার মনটাই যদি না পড়তে পারলাম তাহলে কিসের ভালোবাসা?"
     অতনু কি আজ একটু বেশিই বাঁধনহারা? হয়ত বা, কিন্তু ক্ষতি কি ও যে অনেক কিছু না পাওয়া তিথিকে দেখাতে পেরেছে সব পেয়েছির দেশের স্বপ্ন।
  সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...