#চৈত্র_শেষের_চিঠি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
আজ চৈত্র সংক্রান্তি..চৈত্র মাস বর্ষ বিদায়ের শেষ মাস। কিন্তু সত্যিই কি চৈত্র মাস দেখালে তোমার চোখে আমাদের সবার সর্বনাশ?অন্যান্য বছর আজ ঠাকুরের আর নিজেদের নতুন জামাকাপড় গুছিয়ে রাখি।সকালে স্নান করে নতুন পোশাক পরাই ঠাকুরকে।তারপর ভাবি বিকেলে কি শাড়ি পরবো?কোথায় যাবো? বেশিরভাগ বিকেলেই আমার স্বামীর এক বন্ধুর দোকানে যেতাম একদম খাস বাঙালী সাজে পরনে ঢাকাই বা তাঁতের শাড়ি খোঁপায় বেলফুলের মালা।ওখানে হতো আমাদের বেশ জমাটি একটা আড্ডা তারপর বাড়ি ফেরা মিস্টির প্যাকেট হাতে। আমি তেমন সংসারী নই,বাড়িতে ঠাকুর আছে পুজোও করি কিন্তু বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজো বা অন্য কোন পুজো শুরু করা হয়নি সেভাবে।তাই মা নিয়ম করে দিয়েছিলো পয়লা বৈশাখে বাড়িতে একটু পুজো করার। তাই সংক্রান্তির আগের দিন থেকেই একটু করে জোগাড় শুরু করতাম। গত পয়লা বৈশাখের আগের বছরও মা ছিলো,আর মা থাকা মানেই আমি নিশ্চিন্ত। গত কয়েক বছরে হারিয়েছি অনেক কিছু,কখনো ডুবে গেছি একদম অবসাদে। আবার মনকে বুঝিয়ে যা হারিয়েছি তা ভুলতে চেষ্টা করেছি।আজ মনটা খুব নস্টালজিক হয়তো বা খারাপও বার বার মনে হচ্ছে নতুন বছর আসছে কাল। নতুন বছরে শেষ হয়ে যাবে তো মহামারী?কবিগুরুর গানের কথা মনে হচ্ছে 'মুছে যাক গ্লানি ঘুঁচে যাক জরা অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা'..আমার প্রার্থনাও তাই শুচি হোক ধরা।
নতুন প্রাণে আসুক নতুন আশা,বন্ধ হোক মৃত্যু,মানুষ শাপমুক্ত হোক। এবার পয়লাবৈশাখে সকালে ফোন করবো সবাইকে? কি বলবো?সবাইকে ঘরে থাকতে আর বাইরে বেরোলে মাস্ক পরতে? আর কি বলবো? ভালো থেকো?সাবধানে থেকো আর বারবার করে হাত ধুয়ে নিয়ো?মাঝে মাঝে মনে হয় আচ্ছা আবার সবার সাথে দেখা হবে তো?আমার ছাত্রীদের সেই দুষ্টুমি ভরা গুডমর্ণিং শুনবো তো কোন এক নতুন ভোরে? আবার টিফিন কৌটো খুলে বসবো কলিগদের মাঝে গল্প করতে করতে খাবো টিফিন। বাহ্ তোমার শাড়িটা তো খুব সুন্দর বলবো।
এবার সকালে লালপাড় শাড়ি আর ধুতি পরে হাতে ডালা নিয়ে তাতে খাতা সাজিয়ে মন্দিরে যাবেনা কেউ।হয়ত দেবতাও বলছে এই বছর না হয় থাকলে ঘরে তোমাদের সাথে দেখা হবে করোনা যাবার পরে।
সামনের বছরের জন্য কি ভাববো? এখন শুধুই একটা ভাবনা এই রোগটা বিদায় হোক।করোনা তোমাকে চাইনা..তুমি যাও,তুমি যাও.. মানুষকে মুক্তি দাও। মনটা বড্ড ভারী হয়ে যাচ্ছে তাই আজ ভাববো ছোটবেলায় কিছু ফেলে আসা দিনের কথা।
চৈত্র সংক্রান্তির দিনটা বেশিরভাগ আমার মালদাতে অথবা ভালুকাতে কাটতো।কারণ সেই সময় নীল,চৈত্রসংক্রান্তি আর পয়লাবৈশাখ পর পর বেশ কয়েকদিন ছুটি থাকতো। চৈত্র সংক্রান্তির আগে থেকেই আমাদের পাড়ায় দুপুরের দিকে বেশ হইচই শুনতাম।ঘর থেকে বাইরে দৌড়ে এসে দেখতাম শিব পার্বতী সেজে এসেছে।আর ওদের পেছন পেছন কিছু উৎসাহী ছোট ছেলেমেয়ে আর মহিলা। ওরা বলতো বহুরূপী সেজেছে, মা বলতো গাজনের সাজে এসেছে ওদের এখন সন্ন্যাস চলছে।বাবা ওদের হাতে টাকা দিতো ওরা খুব খুশি হয়ে চলে যেতো।আবার কোনদিন আসতো রাধাকৃষ্ণ সেজে। তখন তো মোবাইলের যুগ ছিলোনা,থাকলে হয়ত ছবি তুলে রাখতাম।আমার ছোট্ট ছেলেমানুষ মন মনের ক্যামেরায় যত্নে বন্দী করছিলো সেইসব স্মৃতি যা এখনো উজ্জ্বল।
ভালুকাতে আমরা থাকতাম একদম হাইস্কুলের পাশে ওখান থেকে কিছুটা সামনের দিকে এগোলেই বাজিতপুর কলোনী।ওখানে বেশিরভাগই বাংলাদেশের মানুষ থাকতো।অনেকেই ছিলো মৎস্যজীবী ওরাই মূলতঃ এই চড়কটা নিষ্ঠাভরে করতো। শুনেছি চড়কগাছ জল থেকে তুলে এনে মাটিতে বসানো হত।তারপর তার সাথে বাঁধা মোটা দড়িতে পিঠে লোহার বঁড়শি আটকে ঘোরা,আবার দেখেছি জিভে শিক ফোটানো আরো কত কি করতো ওরা।মোটামুটি দড়ি বেঁধে অনেকেই চড়কগাছে ঘুরতো। একজন আরেকজনের ঘাড়ে উঠে দাঁড়াতো এইভাবে আরো অনেকে। বেশিরভাগ বাবার সাথেই গিয়েছি দেখতে,মা ও যেতো কখনো। সে একটা উৎসব ছোটখাটো মেলা লেগে যেতো সেখানে। দেখা হত কত পরিচিত মানুষের সাথে। তারপর আবার সন্ধ্যের পর বাবার সাথে টর্চের আলোতে বাড়ি ফিরে আসা।
পরদিন পয়লাবৈশাখ মা আগের দিনই বলে রাখতো কাল সকাল সকাল উঠবি। কাল ভালো হয়ে থাকবি তাহলে সারাবছর ভালো কাটবে। সকালে উঠেই পড়তে বসবি। তাই ভালো করে থাকতে হবে এই চিন্তাতেই ভোরে উঠে পড়তাম তখন সবে রেডিও সেন্টার খুলতো প্রথমেই বন্দেমাতরম হতো। আমিও মুখ ধুয়ে বাবা মাকে প্রণাম করে পড়া শুরু করতাম। সকালের জলখাবারে সেদিন লুচিই হতো সাথে সাদা আলুর তরকারি আর মিষ্টি।তারপর একটু বেলায় আসেপাশের মাস্টারমশাইদের প্রণাম করতাম। এখনকার ছেলেমেয়েদের মত প্রণাম করার আগে কখনো ভাবতামনা।আজও গুরুজনকে প্রণাম করতে ভালো লাগে।এ ব্যাপারে আমার কোন ইগো নেই। দুপুরে মা পোলাও,ছানার ডালনা,চাটনি মুগডাল আর বেগুনি করতো।বাবার ভীষণ পছন্দ ছিলো ঘিয়ের মিষ্টি হলুদ পোলাও। তখন পয়লা বৈশাখে যে নতুন জামা হবেই এমনটা হোতনা। হলেও বেশিরভাগ দর্জিকে দিয়ে বানানো সুতির জামা যাতে কুচির পরিমাণ খুবই বেশি।জামার ডিজাইন মা পছন্দ করতো।মোটামুটি বিয়ের আগে পর্যন্ত শাড়ি গয়না কি কেনা হবে কি পরবো মা ঠিক করে দিতো।
বিকেলে সবাই নতুন না হলেও আলমারির জামাকাপড় পরে একটু ঘুরে আসতাম কাছাকাছি কারো বাড়ি থেকে। তাতেই আনন্দে ভরে উঠতো মন,ঐ সময় আমরা মোটামুটি দলবেঁধে কারো বাড়ি বেড়াতে আর সিনেমা যাত্রাতেও যেতাম,কখনো যেতাম সার্কাস দেখতে ওতেই ছিলো এক অনন্য আনন্দ। অনেক বড় মানে বিয়ের আগেও পরেও ছেলেমেয়ে বড় হবার পরেও বাবা মায়ের সাথে ঠাকুর দেখেছি একসময় ওরা আমার হাত ধরতো।আবার আমিও কখনো মায়ের হাত ধরে নিয়ে গেছি ভালো লাগতো। কখনো মনে হয়নি বড় হয়ে গেছি আর মা বাবার সাথে যাওয়া চলেনা এবার বন্ধুদের সাথে যাবার দিন।
যে বছর মালদায় থাকতাম বেশিরভাগ দিদার বাড়িতে থাকতাম। দিদাদের বাড়িতে তখন অনেক লোকজন।একটা সময় দিদারা তিন জা থাকতো ঐ বাড়িতে। আর আমিই প্রথম নাতনি বাড়িতে।কিছু মামা মাসি আমার চেয়ে একটু বড় ওদের সাথে আমিও মেতে উঠতাম। কখনো ছাদে উঠছি আবার কখনো সামনের বারান্দায় বা বাগানে যাচ্ছি।চৈত্র সংক্রান্তিতে দিদারা সাথে আমার বড় মামীমাও প্রচুর ঝাড়পোছ কাচাকাচি করতো,দিদাদের মোটামুটি নিয়ম ছিলো দরজা জানলা লন্ঠন থেকে সব ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলতে হবে। চৈত্রসংক্রান্তির আগে তাই ছিলো একপ্রস্থ খাটনি।সংক্রান্তির দিন সকালে সবাইকে দেখতাম সামনে থেকে দুই পায়ের মাঝখান দিয়ে ছাতু ওড়াচ্ছে।মাকে বলতাম ওটা কি আবার?মা বলতো ও হচ্ছে শত্রুর মুখে ছাই দেওয়া। ছাই দেওয়া?তাহলে ছাই না দিয়ে ছাতু কেনো ও তো শত্রু খেয়ে নেবে। মা হাসতো,বলতো এটাই নিয়ম।
সেদিন নিরামিষ খাওয়া হতো বাড়িতে,গঙ্গায় দেওয়া হত আম।ঠাকুরের কাছেও দেওয়া হত ছাতু আর আম।দুপুরের মেনুতে থাকতো গিমা শাক আর বেগুন দিয়ে ভাজা,আমের টক ডাল,আমের চাটনি।আর পুরোটা এখন মনে পড়ছেনা। এখন শুধুই অতীত দিনগুলো তবে মামীরা মোটামুটি সব নিয়মই করে। আমার মাও করতো।আমিও তেতো,টকডাল আর চাটনিটা করি,নিরামিষ খাই। হয়ত এটাই পরম্পরা তাই যতটা পারি।আমাদের দেশের বাড়ি মানে বাবার দিকে আমরা ঘটি আমাদের এই নিয়মগুলো নেই তবুও মা যেহেতু চাকরির জায়গায় থাকতো এইরকম রান্নাই হত আমাদের সংক্রান্তির দিন।
আমাদের দেশের বাড়িতে আরেক অদ্ভুত নিয়ম ছিলো,যেটা বাবা মেনে চলতেন..শুনলে হয়তো অনেকেই হাসবে তোমরা বাবা খেতেন পয়লা বৈশাখের ভালোমন্দ রান্না মুখে দেবার আগে একমুঠো আগের দিনের রাখা পান্তাভাত।
এর পেছনে যুক্তি ছিলো যে আমাদের জমিজমা ছিলো তাই এই বছরের ভাত আরেক বছর খাচ্ছে। আমরাও একটু খেতাম সেই ভাত। কত সংস্কার সযত্নে লালিত হয় আমাদের মনে এইভাবেই। কিছুটা আমরা মেনে চলি ছোটবেলার অভ্যেসেই।
মালদাতে থাকতে সকাল সকালই বাবার সাথে চলে যেতাম সুধীরা ড্রেসেস ওখানকার জেঠু বাবাকে খুব মানতেন।বাবা একদম ওদের গদির ওপর উঠে বসতেন।কিছুটা কেনাকাটাও হত তারপর মিস্টির বাক্স আর নতুন ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়িতে।গার্ডার আটকানো সব ক্যালেন্ডার খুলে না দেখলে আমার চলতোনা। বাবা নতুন বছরের বাংলা ক্যালেন্ডার ভীষণ ভালোবাসতেন। আজ জেঠুও নেই,বাবাও নেই,মাও নেই। আমাদের পরিবারের মহীরুহ আর অভিভাবক আমরাই। ভালো লাগছেনা,মন ভালো নেই অথবা চিন্তা হচ্ছে বা ভয় হচ্ছে বলার মত কেউ আর নেই।
অনেক দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ আর পরিশ্রম সব কিছুর মধ্যেও শুধু বলি হাসিমুখে যেন এগিয়ে যেতে পারি। বছরের শেষ দিনে আবার সেই স্বপ্ন চোখে নিয়েই তাকিয়ে থাকবো আবার একটা নতুন বছরের দিকে। সব ভালো হবে,ঠিক ভালো হবে সবাই আমরা ভালো থাকবো নিশ্চয়। কবিগুরুর কথাতেই আজ ইতি টানতে চাই সবাইকে নতুন বছরের প্রীতি জানিয়ে,দূর হোক আমাদের সবার ভীতি।
'নিশি অবসানপ্রায়,ওই পুরাতন
বর্ষ হয় গত।
আমি আজি ধুলিতলে এ জীর্ণ জীবন
করিলাম নত।
বন্ধু হও শত্রু হও যেখানে যে কেহ রও,
ক্ষমা করো আজিকার মতো
পুরাতন বরষের সাথে
পুরাতন অপরাধ যত।'
Comments
Post a Comment