#মায়েরা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
কটা বাজে এখন? এতো রাতেও মা অনলাইনে!
সময়টা মনে হতেই অবাক হয় রনি। মাকে একটা টেক্সট করে মা কি করছে জানার জন্য। কোন উত্তর পায়না। তাহলে হয়ত অনলাইনে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে গেছে। সত্যিই তো ইন্ডিয়াতে এখন বেশ গভীর রাত।ও যখন দেশে ছিলো তখন বরাবরই দেখেছে এগারোটা সাড়ে এগারোটার মধ্যে মা বাবা গুডনাইট বলে ঘুমিয়ে যায়।
মায়ের অবশ্য ফেসবুক করার নেশা আছে,অনেক সময় বিছানায় শুয়েও মোবাইল খুলে খুটুর খুটুর করে। এই নিয়ে বাবা বকুনিও দিয়েছে দুএকদিন। " কি যে তোমাদের এত হোয়াটস আ্যপের নেশা বুঝিনা।কারো কি চোখে ঘুম নেই?"
" আরে গ্ৰুপে গল্প হয়,এই সময়টাতেই তো একটু ফ্রী হই আমরা। "
" হ্যাঁ চলুক আড্ডা রাত একটা পর্যন্ত যত্তসব। এই যত নষ্টের গোড়া এই ছেলেটা।নিজেও সারাদিন ফোনে মুখ গুজে আছে আর মাকেও তাই করেছে।"
" আচ্ছা বেশ আমি তাহলে আজ থেকে আলাদা শোবো।"
মায়ের আলাদা শোয়ার হুমকিতে বাবা নেতিয়ে যায়।ছোট থেকেই রনি দেখেছে বাবা যত হম্বিতম্বি করুক মাকে ছাড়া ঘুমোতে পারেনা। শেষে মায়েরই জয় হয়। তবুও শান্তি আনার জন্য রনি বলে," মা তুমি এখনো কি সুন্দর দেখতে একদম আমার বড়দিদি বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। আবার কেউ কেউ তো ভুলই করেছে গার্লফ্রেন্ড বলে।" মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে মায়ের মুখটা খুশি খুশি একদম,আর বেশ ব্লাশ করছে.." হ্যাঁ তাই বলি রাত জেগোনা,গ্ল্যামার কমে যাবে।চোখে ডার্ক সার্কেল পড়বে।"
ঝগড়াটা একটু বাদেই গলে জল হয়ে গেলো আর সেই সুযোগে আরো একটা এক্সট্রা বাটারফ্রাই পেয়ে গেলো রনি। সত্যিই বাটারফ্রাইটা মা দারুণ বানায়,একদম সেরা।
বাটারফ্রাইয়ের কথাটা মনে হওয়াতে কেমন যেন মনটা এক নিমেষে দেশে উড়ে গেলো রনির। এক বছর প্রায় হতে চললো দেশ ছেড়ে পা রেখেছে বিদেশের মাটিতে।কতদিন মায়ের বানানো বাটারফ্রাই খায়না। আর বিরিয়ানি..ওহ্ ওটাও দারুণ বানাতো মা।যখন আদর করে বলতো "আরেকটু নিবি বাবা? দিই আরেকটু?"
উচ্ছ্বাসে বলে উঠতো.."ওহ্ দাও দাও আরেকটু কেন,গিভ মি মোর। কলকাতার তাবড় তাবড় দোকান ফেল হয়ে যাবে তোমার কাছে।সত্যিই মা ইউ আর জিনিয়াস।"
বুঝতে পারতো মুখটা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠতো মায়ের ভালোলাগায়। আসলে বাবা তো তেমনভাবে কোনদিনই প্রশংসা করেনা।মা আগ্ৰহ করে জিজ্ঞেস করে.." কি গো কেমন? সব ঠিক তো।"
সংক্ষিপ্ত উত্তর," বেঠিক কোনদিন হয় তোমার।ঠিক আছে সব।"
বাবা যেন কেমন জল ঢেলে দেয় সবসময় মায়ের উত্তেজনাতে। আসলে মা একটু বেশি আদুরে এখনো,বেশি কথা বলে,রাগ করে,অভিমান করে আবার মায়ের ভালোবাসা ইমোশন সবই বেশি বেশি। মাঝে মাঝে ওরও একটু বাড়াবাড়ি লাগে একদিন তো বলেই ফেলেছিলো.." মা তুমি কি টিনেজ হয়ে যাচ্ছো নাকি আজকাল!"
খুব অভিমান হয়েছিলো মায়ের দুদিন চুপ করে ছিলো। তারই মাঝে মাঝে দুএকবার বলেছে.." সবই কমিয়ে ফেলেছি বৌ হয়ে।জোরে কথা নয়,হাসি নয়,রাগ নয়,আস্তে হাঁটা,বাড়িতে শাড়ি পরা। এবার কি আমার আমিটাকেও মেরে ফেলবো আমি?"
সত্যিই এদেশে এসে নিজের বিছানা,ঘর,মা,বাবা,বন্ধুদের আর ওর একান্ত প্রিয় ছাদ সব কিছুকেই খুব খুব মিস্ করছে এখন এই সময়।
ডিপার্টমেন্ট যাওয়া নেই,ঘরেতেই ক্লাস করছে তবে জানেওনা এরপর ইন্টারনেটের বিল দেবার টাকা থাকবে কিনা? প্রতিদিন খবরের শিরোনামে মৃত্যুমিছিল,একাকীত্ব সব মিলিয়ে অদ্ভুত দমবন্ধ অবস্থা। আগে আগে এখানে আসার পর মাকে জিজ্ঞেস করে কখনো ইউটিউব দেখে রান্নাও করেছে।মাকে বলেছে," এই দেখো কত কি আমি পারছি।আর চাপ নিয়োনা।"
এখন যেন আর রাঁধতেও ইচ্ছে করেনা।কখনো নুডলস কখনো সেদ্ধভাত অথবা ব্রেড আর বয়েলড এগ খেয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে। কতদিন এদেশের আকাশ আর গাছপালা গুলোও ভালো করে দেখেনি।ও যে আ্যপার্টমেন্টে থাকে সেখানে চারিদিকে এখন নিস্তব্ধ।বুড়োবুড়িদের হাঁটতে যাওয়া নেই,বাচ্চাদেরকে প্র্যামে বসিয়ে অথবা বাড়ির পোষ্যদের নিয়ে হাঁটতে বেরোনো নেই।উইকএন্ডে ও নিজেও যায়না শপিংয়ে। মাঝে মাঝে ঘরের আলো জ্বালিয়ে ভিডিও কলে কথা আর কথা বলতে বলতে মন হারিয়ে যাওয়া আপনজনের কাছে এটুকুই মনের আরাম।
ফোনটাতে হঠাৎই পিং আওয়াজ হয় মা মেসেজ করছে ভারতীয় সময়ে তখন রাত তিনটে মোবাইলে চোখ রাখে রনি।
"বাবা কিছু বলবি?
কি করছিস এখন?
তোর খাওয়া হলো?
আজ কি খেলি?"
"মা,তুমি এখনো ঘুমোওনি?
আমি তোমাকে অন দেখে পিং করেছিলাম।
তুমি রিপ্লাই না দেওয়াতে ভাবলাম ঘুমিয়ে গেছো।
এখন তো অনেক রাত!
এখনি উঠলে কেন?
ঘুমোও।
আমি খেয়েছি।"
ওদিক থেকে মা বলে..
" কি খেলি বললিনা তো?"
"আজ একটু চিকেন করেছি।"
" ছবি দে দেখি।"
"শেষ হয়ে গেছে,তোলা হয়নি। আচ্ছা আরেকদিন পাঠাবো।
তুমি কি করেছিলে আজ বলোনি তো?"
মাঝে মাঝেই মাকে জিজ্ঞেস করে ফেলে রনি ওর মা তিস্তা ওদিকে চুপ করে থাকে।
" ও বুঝেছি বাবা আজও তোমাকে জ্বালিয়েছে ভালোমন্দ খাবে বলে তাইনা?
আজ কি বাবাও চিকেন এনেছিলো?"
ফোনের ওপারে একটু সময় নিয়ে মা টাইপ করে
"আজ সেদ্ধ আর ভাজা দিয়ে অনেকদিন বাদে খেলাম।খুব ভালো লাগলো।"
"কি ভাজা গো? বেগুনি?"
" ঐ একটা নতুন ট্রাই করলাম পটলের খোসাভাজা একটু আলু ঝুরি করে কেটে।"
আবেগ অতটা নেই রনির ছোট থেকেই শুনেছে এমা ছেলেরা কাঁদে নাকি?
তবু গলাটা বুজে আসে স্নেহ নাকি ব্যায়সঙ্কোচ কি জন্য মা এত কম রান্না করছে?
" বাবা ঐসব খেলো?"
" হ্যাঁ এখন আর কিছু বলেনা।"
শেষের দিকে গলাটা বুজে আসে মায়ের বুঝতে পারে।
"তুমি এবার ঘুমোও।"
" ঘুম আসছেনা রে তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার আগে কালকের রান্নার আনাজটা কাটছিলাম।"
" কি শুরু করেছো! অসুস্থ হয়ে পড়বে তো?"
" আচ্ছা বলতে পারিস বাবা পৃথিবী থেকে অসুখটা কবে যাবে? মনামির সাথে কথা হচ্ছিলো ওর ছেলেটা আটচল্লিশ ঘন্টার ডিউটি করছে এমার্জেন্সীতে।ওদের কয়েকজন বন্ধুর পজেটিভ এসেছে। ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে ওরা।"
" সব ঠিক হয়ে যাবে মা,তুমিই তো বলেছো আশা কখনো হারাতে নেই। ভালো চিন্তা পজেটিভ ভাইব বাড়ায়। আমার বন্ধু তিতাসের কথা মনে আছে তো ও হসপিটালে ডিউটি করছে। ওদের একবার যে পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয় তা একনাগাড়ে প্রায় বারোঘন্টা পরে থাকে। বুঝতে পারছো তো কত সমস্যাতে আছে সবাই। তবুও সবাই লড়াই করছে আর মানুষের পাশে আছে।"
" হ্যাঁ রে মনামির সাথে কথা বলার পর মনটা বড় অস্থির লাগছিলো তোর কথা ভেবে খুব কান্না পাচ্ছিলো।"
" আমি ভালো আছি মা,ভালো আমাদের থাকতেই হবে আর তাইতো নিজেকে একদম ঘরবন্দী রেখেছি। একটু বাদেই তো ওখানে ভোর হবে। বারান্দায় গিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে একবার তাকিয়ে বলো মা পৃথিবী আবার খুলে দেবে দোর, নিশ্চয় আসবে এক নতুন ভোর। তুমিই তো বলতে মায়েরা সব সময় ঠিক বলে।"
চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে তিস্তার আবছা অন্ধকারে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে তাকায়। সত্যিই ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে।
ওদিক থেকে স্ক্রীনে কয়েকটা কথা ভেসে ওঠে."কাল এগ বিরিয়ানি করবো,তুমিও কোরো।
দুজনেই স্ট্যাটাসে দেবো।
দেখবো কারটা দেখতে ভালো হয়েছে।
গুডমর্ণিং মাম্মা,এবার ঘুমোও।"
ভোরের ঠান্ডা হাওয়া জানলা দিয়ে চোখে মুখে লাগছে চোখটা জড়িয়ে আসে তিস্তার হয়ত মনামি বা তিয়াসের মাও এখন ঘুমিয়েছে রাতটা আতঙ্কে কাটিয়ে এক নতুন সকালের অপেক্ষায়।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment