#প্রয়োজন#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ পড়ে নীলিমার মেয়াদের সময় শেষ হয়ে গেছে কতদিন আগেই তবুও ইচ্ছে অনিচ্ছার গন্ডীতে আবদ্ধ হয়েই আটকে গেছেন সোমকের এখানে। অথচ এখন তার থাকা উচিত সায়কের কাছে।মানে চুক্তি অনুযায়ী তেমনি কথা।তিনমাসের চুক্তি,আবার তিনমাস বাদে ঠিকানা বদল করে পরিযায়ী পাখির মত অন্য জায়গায় পাড়ি দেওয়া।হাতের ব্যাগটা সেখানে রেখে তাদের মন মত চলা আবার মেয়াদের শেষে ঠাঁই বদল।
এপ্রিলের প্রথমেই কথা ছিলো সায়কের কাছে চলে যাবেন, কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আর যাওয়া হয়নি। লকডাউন ঘোষণা হতেই প্রথমেই বড় বৌমা বলেছিলো.." আর কি হয়ে গেলো,এখন টানা ছয়মাস না একবছর কতদিন চলবে কে জানে? আমরাই কি খাবো,কি করবো তার ঠিক নেই তার মধ্যে আমিষ নিরামিষের ঝামেলা।"
কথাগুলো কানে এসেছিলো নীলিমার বুঝতে পেরেছিলেন মেয়াদ শেষের পরেও তার থেকে যাওয়া নিয়ে খুবই অসন্তুষ্ট বৌমা। যদিও কানে এসেছিলো ছেলের কথা.." মা শুনতে পাবে,একই তো ব্যাপার পরে আ্যডজাস্ট করে নেবো সায়কের সাথে।এত ভাবছো কেন?"
ভাবনা বেড়েছিলো নীলিমারও বড় বৌমার অসন্তুষ্ট আচরণে। সত্যিই তো কি সমস্যা!সব গাড়ি,ট্রেন সবই বন্ধ তাই কোথাও যাবারই উপায় নেই এখন।
সায়ক ফোন করলো," মা কিছু করার নেই।দাদাকে সব বলেছি কয়েকদিন একটু আ্যডজাস্ট করো। ট্রেন চালু হলেই আমি চলে যাবো। রুম্পাও বলছিলো তোমার কথা। অন্য সময় ও অফিসে চলে গেলে তুমি একা হয়ে যাও এখন কম্পানি দিতে পারতো।"
ছেলেদের কথা শুনে হ্যাঁ না করে উত্তর দেন নীলিমা। রুম্পা সায়ক বাড়িতে না থাকলে বাইরে থেকে তালা দেওয়া থাকে নিরাপত্তার খাতিরেই কারণ অজানা কাউকে দরজা খুলে দিলে বিপদ হতে পারে। তাই সারাদিন হয় শুয়ে থেকে নাহলে বারান্দায় বসে দাঁড়িয়ে সময় কেটে যায় নীলিমার।মাঝে মাঝে খবরের কাগজ আর বই পড়েন। আর রুম্পা ফিরে হয় ফোনে থাকে না হলে বন্ধুদের সাথে গল্প করে।
রুম্পা সায়কের বছর চারেক বিয়ে হয়েছে ওদের বিয়ের এক বছর বাদেই হঠাৎই অংশু চলে গেলো।তারপর একটা বছর বর্ধমানের বাড়িতেই একা ছিলেন,যদিও চারিদিকে অনেক শূন্যতা তবুও তারমধ্যে নিজের মত থাকা। আসেপাশের লোকেরা অবশ্য খবর নিতো সবসময়ই।মণির মা,সরলা ওরা তো প্রায় প্রত্যেকদিন এসে গল্প করতো।
তার মধ্যেই হঠাৎই শরীর খারাপ হলো।দুই ছেলেই এলো ছুটে।ওখানকার সবাই বললো 'এবার মাকে নিয়ে তোমাদের কাছে রাখো।একা থাকা আর ঠিক হবেনা।'
তারপর থেকেই এই ব্যবস্থা চলছে গত একবছর।নীলিমা বুঝতে পারেন হঠাৎই এসে ঢুকে পড়েছেন ওদের নিজের নিজের সুখী গৃহকোণে আগন্তুকের মত। শুধু নাতনি ঝিনুকের মুখে হাসি দেখা যায়," ও ঠাম্মি বাবাকে বলবো কুল আনতে।তুমি কুলের আচার বানাবে তো? আর সাবুর পাপড়?"
ওর কচিমুখের কথাগুলো শুনে কেমন যেন অসহায় লাগের নীলিমার। রান্নাঘরে কোন কাজ করলেই বৌমা বিরক্ত হয়,কাজের লোকও বিরক্ত হয়। " মাসিমা কি পুড়িয়েছে গো কড়াটা,বাবা মাজতে হাত ব্যথা হয়ে গেলো।"
" আর বলিসনা রান্নাঘরে খুটুর খুটুর করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। পারেও বটে এই বয়েসে শুধুই খাওয়ার চিন্তা।"
খুব খারাপ লাগে কথাগুলো শুনে।খাওয়ার চিন্তা আর কবে করেছেন তেমন ভাবে? সারা জীবন খাওয়ানোর চিন্তা করেই হয়ত গেলো।ওটাতেই যেন পরম সুখ।
নাতনিকে কথা দিলেও একটু চিন্তা লাগে। অথচ বর্ধমানের বাড়িতে থাকতে শিশি ভর্তি করে আমের আচার কুলের আচার সাবুর পাপড় সবই পাঠিয়ে দিতেন ওরা গেলেই।
সায়কের আবার পছন্দ বড়ি আর আলুর পাপড়।সত্যিই কত কি বানাতেন! অংশুও সব জোগাড় করে এনে দিয়ে বলতেন," বানাও ওরা পছন্দ করে তোমার বানানো জিনিস। মায়ের হাতের জিনিসের স্বাদ কেনা জিনিসে কোথায়?"
অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে ডুবে গিয়েছিলেন কোথায়। সারা দেশ জুড়ে লকডাউন তবুও কদিন রান্নার মেয়েটা আর কাজের বৌটা আসছিলো। দুদিন আগে দুজনেই না করে দিয়েছে আর আসবেনা।
কাল থেকে আরো ঝড় ঘনিয়েছে বাড়িতে,যদিও নীলিমা নিজের থালা বাটি সবই ধুয়ে রাখেন।কাপড়চোপড় ধুয়ে নেওয়াটাও বরাবরের অভ্যেস।অংশু রাগ করতেন মাঝে মাঝে। নীলিমা বলতেন," বেশি আরাম ভালো নয়।কাজের অভ্যেস থাকা ভালো।"
গতকালই বৌমাকে বলতে শুনেছেন," শোনো এত কাজ আমাকে করতে হলে আমাকে বিছানা নিতে হবে।তারপর আবার আমিষ নিরামিষের ঝামেলা।"
" মাকে বোলো নিরামিষের দিকটা দেখতে।মা তো করতে চায়।তোমরাই তো দাওনা।"
'' তাহলেই হয়েছে একগাদা তেলমশলার রান্না।তারপর বাসন বেরোবে একগাদা। জানো তো গ্যাসের ক্রাইসিস চলছে।"
" বলে দিয়ো কি করবে সেটুকুই করবে।"
" হ্যাঁ কাজ করাই তারপর সবাইকে বলে বেড়াবে ওখানে গিয়ে সব করতে হত।"
আর কথা না বলে পারেননা নীলিমা," সত্যিই তো বৌমা একলা অত কাজ তুমি করতে পারো নাকি?
কি করতে হবে বোলো আমি করে দেবো।
যেটুকু বলবে সেটুকুই করবো।"
" আমি তো তাই বলছিলাম আমাকে তো ব্যাঙ্কে বেরোতেই হবে।
তবুও যদি ভাগ করে সবাই করি তাহলে ওর চাপটা কম হবে।
তাইনা মা?"
বুদ্ধিমতী নীলিমার বুঝতে কষ্ট হয়নি মেয়াদের বাড়তি সময়টুকু কিছু বাড়তি কাজ না করলে হয়ত বাড়তি কিছু অশান্তি আর কথা সহ্য করতে হবে। বরাবরই ওনার ভোরে ওঠার অভ্যেস তাই সকালে উঠেই ঘর দোর ঝাড় দিয়ে ফেলেন। তারপর লাঠি দিয়ে মুছে নেন। সোমককে দেখেছেন প্রথম দিন মুছতে। পরের দিন কেন যেন মনে হলো ছেলেটা অফিসে যায় তাই একটু ঘুমোয় ঘুমোক ওরা। বৌমারও তো কাজ করতে হয়,আমিষ রান্না ওদিকের বাসন মাজা। তাই এটুকু করলে ক্ষতি কি?
নীলিমার কাজটা এখন অভ্যেস হয়ে গেছে আর ওরাও অভ্যস্ত হয়ে গেছে।বড় বৌমা একটু চুপচাপ এখন।তবে মন খুলে বলতে পারেনা," মা আপনি আছেন বলে অনেকটা সুবিধা হলো।"
দুদিন হাতটাতে বেশ ব্যথা হয়েছে নীলিমার। " দিদিভাই মায়ের কাছ থেকে একটু ব্যথার মলমটা এনে দেনা।"
" মা আপনার কি হাতে ব্যথা হয়েছে? আপনার ছেলে শুনলে বলবে ঘর মুছে হয়েছে। আমি পারিনা তাই ও মুছছিলো আপনি অযথা লেগে পড়লেন। এই নিয়ে কথা হবে।"
" কিছু কথা হবেনা,কোন কারণে ব্যথা হয়েছে ভালো হয়ে যাবে। সোমককে কিছু বোলোনা।"
মাঝে কেটে গেছে দিন দশেক সেদিন অফিস থেকে এসে সোমক বললো..." বুঝলে সায়ক ফোন করেছিলো বলছিলো ওদের অফিসের গাড়ি হয়ত আসবে রুম্পাও খুব বোর হয়ে যাচ্ছে একা একা। তাহলে ও মাকে নিয়ে যেতে পারে।"
" না না এখন মা এখানেই থাক লকডাউনের মধ্যে আর গিয়ে কাজ নেই। কোথা দিয়ে রোগ ঢুকবে কে বলতে পারে!এতটা গাড়িতে যাবে বয়স্ক মানুষ। তুমি বারণ করে দাও।"
অবাক লাগে নীলিমার যে বৌমা কদিন আগে মেয়াদ বৃদ্ধিতে বিরক্ত হয়েছিলো আজ তারই তাকে বড় প্রয়োজন। ওদিকে হয়ত রুম্পারও এই লকডাউনের অসময়ে তাকে খুব প্রয়োজন তাই ছেলে নিতে আসতে চাইছে তাকে।
কিন্তু তিনি কি চান তা সেদিন যেমন কেউ জানতে চায়নি। আজও কেউ চাইলোনা। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন নীলিমা," সায়ককে বলে দে এখন আমি যাবোনা।
জায়গা বদল করাটা এই সময়ে ঠিক হবেনা।
ওরও এখানে এখন আসা ঠিক নয়। লকডাউনের পরে গাড়ি চললে আমাকে বর্ধমানে রেখে আসিস
আমার বোধহয় কিছুদিন হোম আইসোলেশনে থাকা দরকার। অনেকদিন যাওয়া হয়না বাড়িতে।"
" ঠাম্মি তুমি হোম আইসোলেশনও জানো?"
হাসেন নীলিমা, মনে মনে ভাবেন......
এবার কি দুর্গা আসবে?শিউলির গন্ধে ভাসবে উঠোনটা?বারান্দায় দাঁড়ালে শোনা যাবে ঢাকের বাদ্যি?হয়ত যাবে,তবে কেন যেন কদিন এই বন্দিজীবনে বার বারই মনে হচ্ছে দেশের বাড়ির কথা। ফিরতে পারবেন তো সেখানে? বড় ডাকছে মাটির গন্ধ আর শিউলির সুবাস।মন চাইছে এক ঝলক মুক্তির শ্বাস।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
Comments
Post a Comment