#হরিপদ_ভার্সেস_পাঁঠা#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
ভোরের দিকে ঘুম ভাঙলেও আজ তো রবিবার মনে করে আবার কোলবালিশকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে একবার সৌদামিনীর দিকে তাকান আবছা অন্ধকারে দেখেন অঘোরে ঘুমোচ্ছে তাই অগত্যা তিনিও চোখ বোজেন নিশ্চিন্তে।
ঘুমের মধ্যেই অদ্ভুত সুঘ্রাণ এসে নাকে লাগে মনটা আনচান করে ওঠে।আহা একদম পাগল করা গন্ধ!চোখ বুজেই হাতড়ান বিছানা সদু তাহলে উঠে গেছে। এত সকাল সকাল মাংসও রান্না বসিয়ে দিয়েছে! আহা সদুর হাতের পাঁঠার ঝোল আর বড় একখানা পিস আলু গরম সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাতে খেতে যা লাগেনা আহা একেবারে স্বর্গ সুখ আর তারপরে যদি বর্ষা বা শীতের দিন হয় তাহলে তো একদম জমে ক্ষীর।
আধখোলা চোখে আড়মোড়া ভাঙেন হরিপদ।হরিপদ পেশায় কেরানী বটে তবে কিনু গোয়ালার গলির সেই হরিপদ নয় যে শুধুই পরনে ঢাকাই শাড়ি আর কপালে সিঁদুর কবে পরবে তার কল্পনার বৌ এই হাহুতাশ করেই দিন কাটিয়েছিলো। হরিপদ কবেই পছন্দের পাত্রীকে ঢাকাই শাড়ি আর সিঁদুর পরিয়ে এই বাড়িতে এনেছেন।বৌ হিসেবে সদু চলনসই তবে রান্নার হাতটা একদম জম্পেশ আহা এতদিন বোধহয় সেই প্রেমেই বুঁদ হয়ে আছেন। আসলে দাম্পত্য সম্পর্কই বোধহয় মোহমায়া হরিপদর মত অনেকেরই কাছে। প্রথমে থাকে মোহ তারপর শুধুই মায়া। আর এইজন্যই সদু যখন রণচন্ডী মূর্তি ধারণ করেন তখন রাগ হলেও মায়াতেই বাড়ি ছাড়তে পারেননা হরিপদ।
জড়ানো আদুরে গলায় ডাক দেন ওগো শুনছো...ওদিক থেকে কোন উত্তর না দেখে গলা চড়ান হ্যাঁ গো শুনছো..এই সদু।
হরিপদর মিঠে সম্ভাষণে সদু কোকিলকন্ঠী হয়ে বিগলিত ভাবে এসে দাঁড়ান দরজায়। " কি বলছো বলো,আমার ওদিকে ঢের কাজ।"
" বলছিলাম কি বাবু বাজারে গেছে?"
" তাই কি মাংস রান্নার গন্ধ ভেসে ভেসে আসছে?"
কোকিলকন্ঠী থেকে কাক কন্ঠী হয়ে ওঠেন সদু," আমাকে কি যন্তর্ পেয়েছো নাকি গা..নিজে এখনো গড়াচ্ছো আর মাংস রান্নার স্বপ্ন দেখছো!"
" তা কি করি আমাকে তো লকডাউনে বের হতে দেবেনা তোমরা মা আর ছা।"
" তো কি করবে শুনি তুমি কি এই লকডাউনে বাইরে যাবে নেত্য করতে বাইরে আর রোগ নিয়ে আসবে।"
" তা মাংস আনতে বলেছো তো?"
" হ্যাঁ বলেছি,এবার উঠে মুখ ধুয়ে চা খাও।"
মুখে একটা বেশ পেটুক পেটুক হাসি খেলে গেলো হরিপদর।আরেকটু গড়াগড়ি করে চায়ের সাথে পেপারে মন দেন। সারাদিন তো এই হয়েছে এক কাজ,পেপার চিবুনো।
ছেলে বাজার থেকে এসে টু কি করার ভঙ্গীতে বাজারের ব্যাগটা বাড়িয়ে দেয়।সদু জীবাণুমুক্তির কাজে লেগে পড়েন। ওদিকে কড়া হুকুম দেন ছেলেকে," যা শিগ্গিরি এক্বেবারে কনুই পর্যন্ত ধুয়ে,পা ভালো করে ধুয়ে জামাকাপড় সাবান জলে ডোবা।"
হরতাল পদ মিউমিউ করে বলেন " হ্যাঁ রে পাঁঠা এনেছিস তো? রোববার হলেই মনটা পাঁঠা পাঁঠা করে।"
" পাঁঠার সাপ্লাই নেই,দোকান বন্ধ। আজ মুরগি এনেছি।মা তো তাই আনতে বললো।"
ও তাহলে ইনিই নাটের গুরুমা।ছেলেকে উস্কানি দিয়েছেন পাঁঠা না আনতে। রাগে মাথাটা গরম হয়ে যায়.." ও মুরগি রেখে দাও।আমি চললুম বাজারে পাঁঠা আনতে।রামপাঁঠার দোকানে নিশ্চয় পাবো।"
" বাবা তুমি থামবে..এতো কি আছে?তোমার কোলেস্টেরল বেশি,বয়েস হয়েছে গতসপ্তাহেই তো খেয়েছো আজ খাওনা।মা কষা করেই নাহয় করে দেবে।"
" শোনো মাছ নেই ঘরে? আমি মাছ খাবো।..আমার পাতের চারপাশে যেন মুরগির বাটি না দেখি।"
" বাবা এই লকডাউনে এত রাগ করেনা,সামনে সপ্তাহেই আমি রামপাঁঠা হোক বাংলা পাঁঠা হোক এনে দেবো।"
তবুও টলানো গেলোনা হরিপদকে আরে মরদ কা বাত হাতত্তি কি দাঁত তাই পৃথিবী নড়লেও নড়বেনা।
" আমি খাবোনা,আমাকে কিন্তু খাওয়ার সময় সাধতে আসবেনা একটু খাও করে।"
" আমার বয়ে গেছে,খেয়োনা।আমি মাছ করে দিচ্ছি তাই খাও।"খুব রাগ হয় সদুর এত রাগ কিসের শুনি।আজ আর পাত্তা দেওয়া হবেনা। সারা জীবন জেদ নিয়ে থেকেছে।
রাগ করে পেপারেও মন দিতে পারেননা হরিপদ।এদিকে থালাভর্তি পেঁয়াজ রসুন কেটে সদু আয়োজন করেছে রান্নার। আজ বোধহয় একটু বেশিই যত্ন করে রান্না করছে সদু। মাংস রান্নার খুশবুতে সারা বাড়ি ম ম করছে।অন্যসময় হলে রান্নাঘরে উঁকি মারতো দুএকবার কিন্তু আজ রাগ হয়েছে তাই আগে জেদ তারপর খাওয়া।
দুপুরে হতভাগা ছেলেটা চেটেপুটে দুবার করে ভাত নিয়ে মুরগি সাটালো এমনকি সদুও বাটি করে মাংস নিয়ে খেলো অথচ তার বেলায় উচ্ছে চচ্চড়ি,সজনের তরকারি আর ঠক করে একপিস পোনামাছ নামিয়ে চলে গেলো বাটি করে। একবার সাধলোও না,বলতেই পারতো এক পিস খাও অন্ততঃ না হলে আমি কেমন করে খাই,পতিদেবতা বলে কথা। তা না বলতে লাগলো আজ চিকেনটা বেশ ভালো হয়েছে তাইনা বাবু।যেমন মা তেমন ছা।সেও দাঁত বার করে বললো হ্যাঁ মা ফাটাফাটি করেছো,একদম ধাবার মত হয়েছে। রাতে রুটি আর চিকেন খাবো বুঝলে।
হরিপদ দুপুরে ঝোলভাত খেয়ে ল্যাজগুটিয়ে শুয়ে রইলো আজ ভাতঘুমটা ভালো হলোনা অন্য রবিবারের মত।মাঝে মাঝেই একটা দুঃখ দুঃখ হলো।
রাতে হরিপদর খুব আশা ছিলো অন্ততঃ সদু বা ছেলে একবার বলবে রুটি মাংস খাও। তা নয় সদু আলুপটল সেদ্ধ আর মাছের ঝোলের বাটি ঠক করে নামিয়ে দিয়ে মাংস রুটি খেতে বসলো।
ছেলেটা আবার শুরু করলো.." মা মনে হচ্ছে পাঞ্জাবি ধাবাতে খাচ্ছি,আহা লকডাউনে ভালোই খেলাম গো। সব এনে দিয়েছি,এক সপ্তাহ চালিয়ে নিয়ো। আর কিন্তু বেরোবোনা।"
এখন রাগ করে কি হবে নিজেই তো সকালে বড় মুখ করে বলেছেন আমাকে সাধবেও না কিন্তু এক পিস খাও বলে।তাই সদুও বাধ্য স্ত্রীর মত নিয়ম মানছে।
এদিকে সদু হরিপদর মুখের দিকে তাকায় আর মুচকি হাসে।কেমন জব্দ আজ,শুধু ঘ্রাণেই অর্ধভোজন করো আজ।
ছেলে ঢেকুর তুলে বলে," মা থাকলো নাকি?থাকলে রেখো দিয়ো কাল খাবো।"
" থাকলো তো।"
" ক পিস্?"
" অত হিসেব করিনি বাপু।আছে খাস কাল।"
হরিপদ মন দিয়ে শোনে।কত ফূর্তি, আজ দুবেলা হাত চাটলো আবার কালও খাবে,আর ওনাকে ডাটা চিবোতে হবে!
রাতে শুয়ে ঘুম আসেনা,এপাশ ওপাশ করেন হরিপদ। কিছুক্ষণ মটকা মেরে থাকেন।ছেলেটা পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে,সদুও হাল্কা নাক ডাকছে।গুটি গুটি পায়ে টর্চ হাতে রান্নাঘরে গিয়ে, ফ্রীজ খোলে।ও মা এখানে তো নেই।তাহলে কি ভাওতা দিলো!
হঠাৎই নজর পড়ে গ্যাসের ওপর কড়াইয়ে কি চাপা দেওয়া? উৎসাহের চোটে ঢাকা খুলে ফেলেন এই তো কোকোর কোঁ। তাই বলি বাছা যাবে কোথায়?এখনো তো বেশ হাল্কা গরম। টর্চের আলোতেই এক পিস্ তুলে মুখে দেন।নাহ্ ছেলেটা মিথ্যে বলেনি সত্যিই ধাবার মত হয়েছে। আরেকটা পিস্ খেতেই হবে।হিসেব তো করা নেই। আরেক টুকরো সবে মুখে তুলবেন হঠাৎই রান্নাঘরের আলোটা জ্বলে ওঠে।
সদুর গুরুগম্ভীর গলা শোনা যায়..."সাবান দিয়ে হাত ধোয়া হয়েছে নাকি না ধুয়েই খাচ্ছো?"
হরিপদর হাতে মুরগির ঠ্যাংটা ঝুলছে।ঝোল কিছুটা গোঁফের আদরে মাখামাখি করেছে। চিকেনপ্রেমের কিছুটা ঝোল তখনও লিপস্টিকের মত ঠোঁটে লেগে। কি করবেন ভেবে পাননা।
হাসে সদু পেছনে ছেলেটাও খ্যা খ্যা করে হাসে শেয়ালের মত।
" ঐ জন্যই তো রাতে ফুটিয়ে আর ফ্রীজে ঢোকাইনি।তোমার তো আবার ঠান্ডার ধাত। এইসময় কাশি হলে আবার চোদ্দদিনের কোয়ারেন্টাইনে যেতে হবে তাইনা?"
বেচারা হরিপদ আজ যে নিজেরই রামপাঁঠার হাল একদম হাড়িকাঠে গলাটা আটকে গেছে।নিজের অজান্তেই কেমন যেন একটা ব্যা ব্যা আওয়াজ মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে। হলো টা কি!
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment