#মিঠে_প্রেমে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
বইয়ের ভাজে একটা ছোট্ট চিঠি পেয়েছিলো রিমলি..আজ বিকেলে আমি ভারতীর সামনে থাকবো চলে আসিস..কুছ কুছ হোতা হ্যায়।
চিঠিটা পড়েই ছিঁড়ে ফেলেছিলো রিমলি বাবা জানতে পারলেই মুস্কিল।পরের দিনই মাস্টারমশাই আপদটাকে বিদায় করবে। চোখ পাকিয়ে বলবে.."গরীবের ঘোড়া রোগ মানে প্রেম রোগ হয়েছে? শেষে আমার ঐ টুয়েলভে পড়া বাচ্চা মেয়েটাকে! দেখাচ্ছি মজা।"
রিমলির তখন ক্লাশ টুয়েলভ,বায়োলজি মোটেই ভালো লাগেনা।এক গাদা নাম মুখস্থ করা একদম যাচ্ছেতাই ব্যাপার তারপর যে দিদিমণির কাছে পড়তো তার বিয়ে হয়ে গেছে এই সদ্যই।দিদির শ্বশুরবাড়ি অনেক দূরে তাই আর পড়াতে পারবেনা।
ইলেভেন থেকে টুয়েলভে উঠতে তো যাচ্ছেতাই খারাপ নম্বর পেলো। শুরু হলো বাবার হুমকি,
" গেছে একদম উচ্ছন্নে গেছে,সারাদিন রেডিও শোনা নাহলে টিভি দেখা। "
তবুও ভাগ্যিস তখন মুঠোফোন ছিলোনা।
"নাহ্ এর আর পড়াশোনা হবেনা।"
" আমার বায়োলজি মাথায় ঢুকছেনা বাবা।সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিনা।"
" আরে স্রেফ নামগুলো মুখস্থ কর।"
" থাকছেনা তো কিছুই।"
তারপর শুরু বাবার টিচার খোঁজা অবশেষে বিমান কাকু দিলেন সৃজিতদাকে। বাবা ডেকে একদিন গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলো..." শোনো বিমান ফালতু কিছু দেবেনা বললো একটু দুঃস্থ পরিবারের মেধাবী ছেলে ডাক্তারি পড়ে।সেকেন্ড ইয়ার সবে। মনে হয় ভালো পড়াবে।"
পড়া শুরু হয়ে গিয়েছিলো দুদিন পর থেকেই কিন্তু প্রেমটা অবশ্য প্রথমে রিমলির দিক থেকেই হয়। কেমন যেন মনে হত কলেজ করে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে পড়ায়।টাকার অভাবে হয়ত খায়ও না ঠিকমত।নিজেই একদিন মাকে বললো," মা কাল থেকে বিকেলে টিফিনটা একটু বেশি করে কোরো। কেমন যেন ধুকতে ধুকতে পড়ায়। না পেটে কিছু থাকলে পড়াবে কি করে?"
খাওয়াটা অবশ্য মা আর মেয়ের প্রাইভেট ব্যাপার,বাবা এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলেনি কোনদিন। শুধু একদিন বলেছিলো...
" ছেলেটাকে বরং রোজ রোজ ঐ তেলেভাজা গুলো না দিয়ে একটু দুধ বিস্কুট দিতে পারো। হস্টেলে মনে হয় ওসব কিছুই জোটেনা।এই বয়েসেই চোখে হাইপাওয়ার হয়েছে।"
সেদিন মনে হয়েছিলো বাবা মানুষটাকে যতটা হিটলার ভাবে মানুষটা তেমন নয়।
তারপর,তারপর আর কি ঐ একটু একটু করে বায়োলজির প্রতি ভালোবাসা বাড়ে মানে হাফ ইয়ারলিতে একদম এইটি ফাইভ পার্সেন্ট আর তার সাথে হানড্রেড পারসেন্ট লাভ ঐ রোগা পটকা হাইপাওয়ার স্যারটাকে।
রিমলি কেমন? হঠাৎই রিমলি কেন? এই কথা যদি কেউ সৃজিতকে জিজ্ঞেস করে তবে ও বলবে রিমলি অনেকটা ওর মায়ের মত। খুব কেয়ারিং আর একটু বেশি বস বস ভাব।তবে মনটা খুব ভালো যেমন যেদিন বৃষ্টি ভিজে পড়াতে এসেছে মাথা মোছার তোয়ালে দিয়ে গরম চা খাইয়ে একদম পাঠিয়ে দিয়েছে আজ আর পড়বোনা বলে। অথবা সরস্বতী পুজোতে হলুদ শাড়ি আর ছোট টিপে আর কোকড়া চুলে কেমন যেন মমতা মাখা। একদিন বলে ফেলেছিলো,"তুই আমার মায়ের মত।"
খুশি হয়েছিলো রিমলি মনে মনে তবে চোখ পাকিয়েছিলো,"মায়ের মত কেউ হয়না,কারণ মায়েরা সিঙ্গেল পিস্ একদম।ওরকম আর কেউ হয়না।"
আসলে সব ছেলেরাই বোধহয় প্রেমিকার মাঝে মাকে খোঁজে আর মেয়েরা বাবার মত কেয়ারিং স্বামী।
তারপর অনেক জল গড়িয়েছে ডাক্তারবাবু টেস্ট ক্রিকেটের মত একটু একটু করে ব্যাটিং করে করে বহুদিন সময় কাটালেন ভালো ডাক্তার হতে। ততদিনে বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠেছে রিমলি।বাবা একটু আধটু খোঁজাখুঁজি করছে,রিমলি ভাবছে এই কেলো করছে শেষে বাবা কোন বর্বরের সাথেই হয়ত বিয়ে দিয়ে দেবে কারণ ডাক্তারদের তো আঠেরো মাসে বছর।কবে প্রতিষ্ঠিত হবে কে জানে?ততদিনে তো বাবা হিড়হিড় করে ওকে টানতে টানতে ছাদনাতলায় এনে বিয়ে দিয়ে দেবে।
তাই একদিন রেগেমেগে গিয়ে বলেছিলো," কি ব্যাপারটা শুনি? এবার যে বাবা আমার বিয়ে দিয়ে দেবে। তোমার কিছু হচ্ছেনা?"
" হচ্ছে তো,খুব হচ্ছে।"
" কি হচ্ছে রাগ না দুঃখ?"
মহা পাজি ছেলেটা মুচকি হেসে বলেছিলো," কুছ কুছ হোতা হ্যায়।"
" মানে?"
ওর পছন্দের কুছ কুছ হোতা হ্যায় সিনেমার গানটার প্রথম চারলাইন শুনিয়ে দিলো।
" গলাটা কিন্তু মন্দ নয় ডাক্তারবাবুর তাই কিছু বললামনা।"
" হাসিটা কিন্তু খুব মিষ্টি আমার ক্রাশের তাই আজ আমাকে কেউ আটকাতে পারবেনা।"
একদম মাথা উঁচু করে ওর বাবার কাছে এসে বলেছিলো," রিমলিকে আমি বিয়ে করতে চাই শুধু একটা বছর সময় দিতে হবে।"
বাবা এতো সাহস একদম মেয়াদের সাথে কনে বুকিং পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সত্যিই খুব হাসি পেলো রিমলির।
তারপর কোন এক মন কেমন করা ফাগুনে একদম বুক করা কনেকে নিজের একান্ত ঘরের কোণে আপন করে নিলো সৃজিত।
" কি মনে হচ্ছে এখন স্যার?প্রথম দিনের কথা মনে পড়ছে?"
হাসে রিমলি ফিদা হয়ে যায় সৃজিত বলে," কুছ কুছ হোতা হ্যায়।"
" মানে!"
" ঐ আরকি বঙ্গনারী পরনে শাড়ি আর ঠোঁটে খুনখারাপি হাসি একদম বানভাসি।"
মাঝে কেটে গেছে বেশ অনেকগুলো বছর।ক্লাশ টুয়েলভের রিমলি এখন পাকা গিন্নী আর তার সাথে সাথে ছয়বছরের টুবলুর মা। ছেলে বর নিয়ে একদম গুছনো সংসার তবে বেশ অনেকটা দূরে চলে এসেছে বাড়ি থেকে সৃজিতের কাজের জায়গায়। শহর থেকে একটু বাইরে নিরিবিলিতে রিমলির সুখী গৃহকোণ।ছোট্ট বাড়ি সামনে একফালি সবুজ রুমালের মত বাগান আর তাতে লাল হলুদ আর নীলের ছোঁওয়া।
শুধু মাঝে মাঝে হসপিটাল থেকে আসতে বেশি দেরি হলে তখন ঐ কুছকুছ হোতা হ্যায় আর কোন কাজ দেয়না। ওদের টকমিস্টি জীবনের মধ্যে হঠাৎই ছন্দপতন। ঘোর সমস্যা শুরু হয়েছে সারা বিশ্ব জুড়ে আর এই যুদ্ধে শত্রুদের শায়েস্তা করতে খালি হাতে লড়াই করছে সৃজিতের মত অনেক সৈনিক। খুব চিন্তা লাগে রিমলির প্রতিদিন একটা অদ্ভুত শঙ্কায় কাটে,সব ঠিক থাকবে তো?
হঠাৎই সেদিন ফোনটা পায়..." শোনো আমাদের একজন কোলিগের পজেটিভ আমাদের চোদ্দদিনের কোয়ারেন্টাইনে পাঠাচ্ছে যদি পজেটিভ হয় তাহলে...তুমি টুবলুকে নিয়ে সাবধানে থেকো।কিষণকে বলা আছে ও যা লাগে এনে দেবে।"
গলাটা বুজে আসে রিমলির " আমি কি একবার যাবো? আমার কিছু ভালো লাগছেনা।"
" তোমাদের যেন কোন রিস্ক না হয় তাই সাবধানে থাকতে হবে। এখানে আ্যলাউ করবেনা এসোনা।"
চোদ্দদিন যে এতটা লম্বা হয় জানা ছিলোনা রিমলির। মনে হচ্ছিলো চোদ্দবছরের বনবাসে এসে পড়েছে। তার মাঝে মাঝে সবার ফোন একটা সময় ফোন ধরতেও ভালো লাগতোনা রিমলির। টুবলুকে সামলানো,ওকে বোঝানো,খাওয়ানো,সৃজিতের ভাবনা সব মিলিয়ে কেমন যেন একটা সময়।ওদিকে বাবা মায়েরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় তাদের বোঝানো। ক্লান্ত রিমলি কতদিন চুল আঁচড়ায়না,আয়নায় মুখটাও দেখেনি কতদিন। নিজেকে বড় অচেনা লাগে।
সব ঠিক হবে তো? কবে ফিরবে সৃজিত?
অন্ধকার সরিয়ে অবশেষে এলো সেই আলোর দিন। নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরছে সৃজিত। পজেটিভ আর নেগেটিভ.. যখন টুবলু আসবে পৃথিবীতে তখন পজেটিভ রেজাল্ট একঝলক খুশির হাওয়া এনেছিলো জীবনে। আজ সেই পজেটিভ রেজাল্ট বিভীষিকা।
বাইরের ঘরটা সুন্দর করে তৈরি করে রেখেছে সৃজিতের জন্য রিমলি।হঠাৎই নিজেকে আয়নায় দেখে মনে হয় সৃজিত এসে কি বলবে?
স্নান করে সৃজিতের পছন্দের লাল আর চন্দন রঙের ঢাকাইটা পরে কপালে টিপ পরে ওর একঢাল এলো কোঁকড়া চুল আঁচড়ে ধূপকাঠি ধরায় রিমলি।
" মা তোমাকে কি সুন্দর লাগছে!"টুবলু এসে জড়িয়ে ধরে ওকে।
বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা যায় সৃজিত নামছে। আজ দুজনের মাঝে একটা অদৃশ্য গন্ডী যা হয়ত মুছে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। গন্ডীর ভেতর থেকেই দুজনে দুজনকে দেখে। কত রোগা হয়ে গেছে রিমলি চোখের তলায় কালি।তবুও ওর সেই বিখ্যাত হাসিটা আজ ছুঁয়ে আছে ওর চোখেমুখে।
ইশারায় দেখায় সৃজিত কুছকুছ হোতা হ্যায়। খুশির লজ্জার লালচে রঙে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রিমলি সেই প্রথম ভালোবাসার কথা বলার দিনের মতো।
আকাশের দিকে মুখ তুলে অদৃশ্য কোন শক্তিকে বলে সৃজিত জয় হোক বিজ্ঞানের রোগের ভয়াবহতা পরাজিত হোক সচেতনতার কাছে। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ভালো থাক মানুষ। সবাই যেন ফিরতে পারে সুস্থ হয়ে নিজের ঘরে।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment