Skip to main content

অপয়া

#অপয়া#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

'মিতুনের বিয়েটা মনে হয় আর হবেনা রে।'

আসলে মেয়েটার কপালটাই খারাপ।জন্মের পরেই মা মরলে যা হয়,এর ওর কাছে মানুষ।অনেকেই তো বলে অপয়া।বাবাটা তো জন্ম বাউন্ডুলে।কাজকর্ম করার নাম নেই,এখন তো আবার অসুস্থ।'
     ' অপয়া বোলোনা,মামারা খুব ভালোবাসে।এখন তো ওখানেই থাকে বাপে আর মেয়ে।'
     ' হ‍্যাঁ তা বাসে একটা মাত্র বোনের ঐ তো একমাত্র স্মৃতি।'
                    আড়ালে সবাই কানাকানি করছে,কথাটা কানে আসে মিতুনেরও মনটা তো ওরও ভালো নেই। অজয়দের বাড়ি ওদের বাড়ি থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে,সে না হয় হলো। কিন্তু অজয় তো এখন ধানবাদে ওখানেই তো ওর চাকরি। বেশ কিছুদিন আগেই একবার ফোনে বলেছিলো.." মিতু জানিস চাকরির বাজার ভালোনা।জানিনা আমার চাকরির ভবিষ‍্যতও কি হবে! এমন একটা বেকার বাউন্ডুলের হাত ধরবি?"
          আর মাত্র দুমাস বাদেই ওদের বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে এমন সময় এসব কি বলছে অজয়?গলাটা বুজে এসেছিলো মিতুনের। তবুও সাহস নিয়ে বলেছিলো,"অন্ধকারে থাকতে থাকতে আমার যে অভ‍্যেস হয়ে গেছে।আর ভয় করেনা। তুমি সাথে থাকলে দুজনে যা করে হোক চালিয়ে নেবো।সেলাই শেখাবো,যদি কেউ গান শেখে আমি যতটুকু জানি শেখাবো।"
                     
           " খুব ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান করবো বুঝলি।বেশি কিছু করতে পারবোনা কিছু টাকা হাতে রাখতে হবে তাইনা।"
         মিতুনের হাসি পেয়েছিলো," আমি কিন্তু চন্দন দিয়ে সাজবো। আর একটা লাল টুকটুকে বেনারসী পরবো।আর ফটোও তুলবো কিন্তু।"
      মিতুনের সরলতায় হাসি পেয়েছিলো অজয়ের কত ছোট চাওয়া মেয়েটার।আসলে কোনদিনই তেমন কিছু পায়নি তাই আর কি চাইবে? আর চাইলেই বা পাচ্ছে কোথায়?হয়ত সেইজন‍্য কলেজের দিনগুলোতে যতটা পেরেছে ওকে সাহায্য করেছে বইপত্র দিয়ে। তারপর স্বপ্ন দেখতে গিয়ে কখন যে ডুব দিয়েছিলো সরল দুটো চোখে বুঝতেই পারেনি।নোট দেওয়া নেওয়ার মাঝেই মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিলো। ওদের কলেজের সোশ‍্যালে গান গেয়েছিলো মিতুন,গান ভীষণ ভালোবাসার অজয়ের। হয়ত একটা সময় ভেবেছিলো ও যাকে ভালোবাসবে সে গান জানবে।মিতুন প্রতিদিন যাতায়াত করতো বাড়ি থেকে আর অজয় থাকতো হস্টেলে। তার মাঝেই কখনো গঙ্গার ধারে চুপটি করে বসে মিতুনের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে হারিয়ে যাওয়া।
    " এত ভালো গান কবে শিখলি রে?কে শেখালো?"
  "বাবা মা দুজনেই গাইতো।বাবার এখনো খেয়াল হলে গায়।ঐ ধরো রক্তে মিশে আছে গান।"
               অজয়ের চাকরি পাওয়া প্রায় দুবছর হতে চললো মাঝে মিতুনের বাবার শরীর খারাপ হওয়াতে ওর মামাবাড়িতে সবাই চাইছে বিয়েটা হয়ে যাক তাড়াতাড়ি। সেভাবেই বৈশাখের প্রথমেই বিয়ে ঠিক হয়েছে।কার্ডও ছাপানো হয়েছে।ঠিক হয়েছে আশীর্বাদ বিয়ের দিনই হয়ে যাবে।
           অজয়ের চাকরির কথা শুনেই মিতুনের বুকটা কেঁপে উঠেছিলো, তবুও ভেবেছিলো দুজনে হাতে হাত রেখে ঠিক ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে যাবে সব বাধাকে পেছনে ফেলে।কিন্তু হঠাৎই ঘোষণা হলো লকডাউন এরমধ্যে অজয়
আসবে কি করে?মাঝে মাঝেই ফোনে কথা হচ্ছে.."কি হবে আর তো দিন পনেরো বাকি? তুমি কি আসতে পারবে?আর বিয়েই বা হবে কি করে?"
     " ভাবিসনা আমি ঠিক চলে যাবো,দরকার হলে অনুমতি নিয়ে যাবো।"
     " কিন্তু লকডাউনে বিয়ে হবে কি করে?"
   " নিশ্চয় হবে দেখি,কি করা যায়?"
          কিন্তু কিছুই ব‍্যবস্থা মনে হয় হবেনা সেটা জেনে খুব কেঁদেছিলো মিতুন। মনে হয়েছিলো সত‍্যি একটা রোগ ওলটপালট করে দিলো কতকিছু! পাড়ার লোকেরাও কত কি বলছে,অনেকেই ভাবছে বিয়েটা আর হবেনা হয়ত। আর হলেই বা কবে হবে?
   " ভাবিসনা মিতুন,ঠিক হবে।ভাব তো এখন হলে তুই ভালো করে সাজতে পারবিনা,ফটো তুলতে পারবিনা।"
     কান্না জড়িয়ে মিতুন বলে, " মামারা তো সবই কিনেছে।"
    " থাকনা কেনা,আমি তো কোথাও যাচ্ছিনা বিয়েটা হবেই।"
  " কবে?"
কবের উত্তরটা দিতে পারেনি অজয়।

গ্ৰামের সবাই জেনেছিলো এখন হবেনা বিয়ে হয়ত কোনদিনই হবেনা অপয়া মেয়ে হলে যা হয়।
            ছাদে দাঁড়িয়ে মিতুন,আরেকটু বাদে নিচে নামবে সন্ধ‍্যে দিতে।তারপর রাতের রুটি করবে। মনটা পড়ন্ত বেলায় উদাস হয়ে যায়।কতদিন ওর কাছে গান শিখতে আসা কচিমুখের আনাগোনা হয়না বাড়িতে। মামার বাড়ির কাজের বৌটাও আসছেনা তাই ওর একটু চাপও পড়ে গেছে কাজের। যদিও মামিমা খুবই ভালোবাসে ওকে।
            আর তিনদিন বাদেই ওর বিয়ের দিন ছিলো। হয়ত এর মধ‍্যেই ছাদে প‍্যান্ডেল বাঁধা হয়ে যেতো। হঠাৎই নিচ থেকে মামিমার গলা পায়..." মিতুন তাড়াতাড়ি আয় মা তোর বাবা পড়ে গেছে।"
             সত‍্যিই দিশাহারা লাগে সবার,এখন কোথায় ডাক্তার কোথায় কি! হসপিটালও অনেক দূরে কি হবে?"
             আচ্ছন্ন অবস্থায় বাবা বলে.." মিতুন তোর বিয়েটা বোধহয় দিয়ে যেতে পারবোনা।"
          কেঁদে ফেলে মিতুনও,পাড়ার ডাক্তারবাবু কিছু ওষুধ দেন। খুব একটা অবস্থার উন্নতি হয়না। কেঁদে ফেলে অজয়ের কাছেও মিতুন।
   " সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস বাবা ঠিক হয়ে যাবেন।"
                পরের দুদিন বাবাকে নিয়ে ওরা খুব মানসিক অস্থিরতার মধ‍্যে কাটিয়েছে। বয়স্ক মানুষ তাই ভর্তি নেওনি হসপিটালে। তবে ওষুধ খেয়ে সকাল থেকে একটু ভালো।
                             সন্ধ‍্যের পর হঠাৎই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে মামা যায় দরজা খুলতে.." এ কি তোমরা! এই সময়ে কি করে?"
       " হ‍্যাঁ মামা,দুদিনে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। বাড়ি পৌঁছেই বাবাকে নিয়ে এখানে চলে এসেছি থানা থেকে অনুমতি নিয়ে।"
    " অনুমতি মানে কি বলছো?"
  " হ‍্যাঁ বিয়েটা আজই করবো মামা কার্ডে তো তাই ছিলো।"
   " কিন্তু.."
  " আর কোনো কিন্তু নয় মামা মিতুনের বাবার কিছু হয়ে গেলে সারাজীবন ওর অপয়া নামটা রয়ে যাবে।"
        চোখটা ছলছল করে ওঠে ওর মামার,আজকের দিনে অজয়ের মত ছেলেও আছে!
     বাড়ির ভেতরে গিয়ে ডাক দেন মিতুনের মামা," কি গো শুনছো? মিতুনকে ডাকো ওর যে আজ বিয়ে এখুনি তৈরি হতে হবে। আমি দেখি পুরোহিত মশাইকে ধরে আনি।"
       অজয়কে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে মিতুনের কতদিন দেখেনি কিন্ত মামি ধমক দিয়েছে শুভদৃষ্টির আগে নয়।
                 বরপক্ষের দুজন আর কনেপক্ষের পাঁচজনের সামনে মাস্ক মুখে পরেই মালাবদল আর সিঁদুর দান হয়ে গেলো মিতুনের। শুভদৃষ্টির সময় দুজনেই হয়ত মুগ্ধ হয়ে দেখলো একে অপরকে। সত‍্যিই অনেকদিন বাদে দেখা।
    মিতুনের মামা সম্প্রদান করলেন ওকে। ওর বাবা ঠাকুরকে স্মরণ করে বললেন মেয়েটার আমার অপয়া নামটা ঘুঁচিয়ে দিয়ো ঠাকুর।
                    মিতুনের বেনারসী পরেই বিয়ে হলো সাজগোজ আর ফটো তোলা তেমন না হলেও দুদিন বাদে সবাই সংবাদপত্রে মিতুন আর অজয়ের ছবি দেখলো। ওরা ওদের বৌভাতের অনুষ্ঠানের জন‍্য জমানো খরচের টাকা দিয়ে গ্ৰামের গরীব পঞ্চাশজন লোককে সাধ‍্যমত সাহায‍্য করলো আর খাওয়ালো। গ্ৰামের গরীব মানুষজন বললো,' লক্ষ্মী এলো গাঁয়ে। বিয়ে তো অনেকেই করে উৎসব করে,এমন বিয়ে কজনের হয়?'©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
সমাপ্ত:-
          
           

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...