#নির্বীজকরণ_মহাধৌতি#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
জয় বাবা লোকনাথ,জয় মা মঙ্গলচন্ডী,জয় মা কালী,জয় সঙ্কটমোচন আজ তোমাদের হক্কলেরে স্মরণ কইর্যা বারাইয়া পড়সি যা করার করো তোমরা,শুধু করোনা কইরোনা। বিড় বিড় করতে করতে মোড়ের মাথায় আসতেই বঙ্কু রিকসাওয়ালাকে দেখেন পার্বতী মাসিমা..." ওরে ও বঙ্কু একটু লইয়্যা চলনা বাবা বড় বিপদে পড়সি বাপ।"
" মাসিমা আপনি আবার এই ভরদুপুরে কোথায় চললেন?"
" দরকার আছে যামু,গঙ্গার ঘাটের দিকে।যাবি কিনা ক।অত কৈফিয়ত দিমুনা,হকলেই দেহি বড্ড বাড়ান বাড়ছে এই লকআউটের বাজারে।"
" লকআউট না মাসিমা লকডাউন চলছে।"
"চুপ যা বেশি শিখাসনা আমারে সব বুঝি।লক আউট মানে হলো গিয়া কোম্পানি বন্ধ কইর্যা তোমাকে বার কইর্যা দেওয়া রাস্তায়।আর এ হইল্যো গিয়া রাস্তা থনে তাড়াইয়া ঘরে বন্দি কইর্যা রাখা।"
বঙ্কু জানে মাসিমাকে নিলে লাভই আছে।যদিও পুলিশের ভয়ও আছে।তবে মাসিমা যা জিনিস নিজেই সামলে নেবে।
সুতরাং লকডাউনের বাজারে যা বাড়তি পাওয়া যায়।একেই একদম ভাড়া টাড়া পাচ্ছেনা। তবুও দাম বাড়িয়ে বলে," মাসিমা আপডাউন পঞ্চাশ টাকা করে একশো টাকা লাগবে কিন্তু।"
" সে কি রে!দিনে দুপুরে ডাকাতি করতেছস নাকি? এই না শুনলাম সরকার ছয়মাসের র্যাশন ফ্রী দিতেসে তবুও এর মধ্যেই ডাকাতি শুরু?"
" আচ্ছা চল,হাতি গর্তে পড়লে মশাতেও লাথি মারে। আচ্ছা তাই দিমুনে,করোনাতে আর দাম করুমনা,লকডাউনে হকলেই ডাউন এখন। শুধু জিনিসপত্র লাফাইয়া লাফাইয়া আপে উঠত্যাসে।"
খুশি মনে রিক্সা স্টার্ট দেয় বঙ্কু মোটামুটি মাসিমার জয় বলেই কারণ ডবল ভাড়াতেই রাজী মাসিমা। তবে হেব্বি ভারী হয়ে গেছে কিন্তু মাসিমা এই কদিনেই। লকডাউনে একদম পুরো লোহার গোডাউন হয়ে গেছে। হেইয়ো হেইয়ো করে টানতে থাকে বঙ্কু রিক্সা। মুখে হাসি ফোটে পার্বতী মাসিমার,"এই একটু খাড়া দেখি এহেনে। নমস্কার কইর্যা লই।কতদিন মায়ের মুখখানা দেহিনা।"
"মন্দির বন্ধ মাসিমা,দেবতাদেরও লকডাউন।"
" ফালতু কথা কওয়া ছাড় তো,যা কইতাসি কর।"..মাস্ক নামিয়ে ভক্তিভরে কপালে হাত ঠেকান মাসিমা," মা মাগো করোনার কারণে আর একমিটারের গন্ডী পার হমু না মা। পয়সা নমস্কার কইর্যা রাইখ্যা দিলাম।করোনার পর স্যানিটাইজারে ধুইয়া দিমু।"
বঙ্কু মুখে কুলুপ দিয়ে রয়েছে,কথা বললেই বকুনি খাচ্ছে..." আ্যই ফক ফক কইর্যা কথা কইবিনা ভাইরাস আসবো।" যাক আবার রিক্সা চলতে থাকে। বাজারের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে কতদিন সুবলের দোকানের জিলিপি খাওয়া হয়না আগে মর্ণিং ওয়ার্কের পরে মাঝে মাঝেই জিলিপি লইয়্যা ফিরতেন। মর্ণিং ওয়ার্ক কইলেই বিষম রাইগ্যা যান কর্তা আরে ওটা নাকি ওয়াক মানে হইলো গিয়া হাঁটা আরে যাই হোউক গিয়া ওটাও তো একটা কামই বটে মানে ওয়ার্ক।
এর মধ্যেই পুলিশ এসে দাঁড়ায় সামনে," এই রিকসাওয়ালা তুমি রাস্তায় কেন? যাও সাইড করো। না হলে হাওয়া খুলে দেবো।"
পুলিশের দাবড়ানিতে বঙ্কুর হাওয়া এমনিতেই বেরিয়ে গেছে।
হঠাৎই আর্তনাদ করে ওঠেন মাসিমা," ওরে কিসু কইয়োনা বাপ,আমিই জোর করসি আমার মাইয়ার ভরা মাসের পোয়াতি তো তাই যাইতাছি দেখতে। হাঁটতে পারিনা বাপ তাই ওরে লইয়্যা বারাইছি,একলাই যাইতাছি গ্যাদারিং করি নাই।"
একদম যুক্তিযুক্ত কথা,পুলিশের কিছু বলার নেই তাই বলে.."আপনার মাস্কটা গলায়,ওটা মুখে বাঁধুন।"
লজ্জায় জিভ কাটেন মাসিমা," এক্ষুনি দিতাসি আসলে মন্দিরে ঠাকুরের সাথে কথা কওনের লাইগ্যা খুলছিলাম।"
" মাসিমা গঙ্গার ধারে প্রায় এসে যাচ্ছি কিন্তু।"
" চুপ যা মেলা বকতাছিস তহন থনে। আমি কমু ঠিক। এই এই খাড়া এহেনে তো,আমি হাত পা গঙ্গাজলে আগে স্যানিটাইজ কইর্যা লই। আর তুই এহেনেই কোথাও খাড়া আমি পনেরো মিনিটের মধ্যেই আসতাছি।"
থপথপ করতে করতে মাসিমা একটু হেঁটে একটা সরু গলিতে ঢুকে যান। আরেকটু গেলেই পৌঁছে যাবেন।
উঠোনে পা দিতেই গম্ভীর গলায় আওয়াজ পান.."স্যানিটাইজ করে ভেতরে এসো।"
" স্যানিটাইজ করসি বাবা গঙ্গাজলে, আর আমার ব্যাগেও আছে স্যানিটাইজার।"
" না না ওতে হবেনা বারান্দায় #করোনা_নির্বীজকরণ_মহাধৌতি# বিশুদ্ধ কারন,গঙ্গাজল,গোমূত্র গোচনা আর রিঠা মিশ্রিত স্যানিটাইজার আছে ওতে হাত ধুয়ে নাও। বাড়ি যাওয়ার সময় একটা নিয়েও যেতে পারো মূল্য মাত্র পাঁচশো এক টাকা।
পার্বতী মাসিমা অতি যত্নে কয়েক ফোঁটা করোনা নির্বীজকরণ হাতে ঢেলে হাত ধুয়ে নিলেন গঙ্গাজলে। মনে মনে ভাবলেন এর যা গন্ধ করোনা ভাইরাস জম্মেও পা রাখবেনা শরীরের চারপাশে।
ঘরের ভেতর তখন গোল গোল গন্ডীতে পাঁচজন বসে।মাসিমাকে নিয়ে ছজন হলো আর #ত্রিনয়ন_আ্যন্টেনা_বাবা# মানে সব মিলে সাতজন। এক একজন এক এক রকম জিজ্ঞাসা নিয়ে এসেছে এই যেমন..." বাবা লকডাউনে ভেবেছিলাম বরকে কাছে পাবো সেই মেয়েমানুষের নেশা কাটবে।তা আমাকে রান্নাঘরে রেখে সে সারাক্ষণ ম্যাসেজ করতেছে।"
ঢুলু ঢুলু চোখে বাবা ওপরের দিকে তাকিয়ে বলেন," তোমার বাড়িতে এসেই কি তোমার স্বামীকে ম্যাসেজ করছে ঐ মেয়েমানুষ?
বৌটা একটু শুধরে দেয়," না না বাবা ঐ ফোনে চ্যাট করতেছে সারাদিন।"
" সে কি এত অধঃপতন! শুনেছি এখন ফোনে সেক্স করা যায়।তবে ম্যাসেজ, আরেকটা যেন কি বললে চাট মানে চাটাচাটি এতো ঠিক নয়। ঘোর অন্যায়।"
" আচ্ছা বাবা,ঐ মেয়েমানুষের করোনা করে দেওয়া যায়না?"
বাবা একটু চমকে উঠে বললেন...
"আর হবেনা আমি মোহভঙ্গ তাবিজ দিয়ে দিচ্ছি আর ম্যাসেজ নিরোধক চূর্ণ।তাবিজটা বালিশের তলায় রেখে দিয়ো আর চূর্ণটা খাবারের সাথে খাইয়ে দিয়ো।"
চওড়া সিঁদুর পরা একটা কমবয়েসী মেয়ে বললো.." শাশুড়ি দেখতে পারেনি পেথ্থম দিন থেকেই,সবেই কদিন বিয়ে হয়েছে বাবা, করোনা কালরাত্তির চলছে বলে নিজের কাছে নিয়ে শোয়। বরের কাছে ভিড়তে দেয়না।"
চোখটা চকচক করে একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েন বাবা। "শাশুড়ি কি বেধবা নাকি?"
" হ্যাঁ বাবা,তাইতো আমারেও করোনা কাল রাত্তির বলে সোয়ামী সুখ পেতে দিচ্ছেনা।"
" ভয় নেই,সোয়ামী সুখ পাবি শাশুড়ি বশীকরণ চরণামিত্ত প্রতিদিন ওনার জলের গেলাসে মিশিয়ে দিবি সব ঠিক হয়ে যাবে।করোনা কালো রাতি মুছে গিয়ে একদম আলো পেয়ে যাবি।"
এবার তুই বল,তাড়াতাড়ি বেশি সময় নেই গোপনে খুলতে হয়েছে মন্দির জানিস তো পরিস্থিতি..
" বাবা বৌটা শুধু কাশছে,কিন্তু ডাক্তারের কাছে যাবেনা। সেদিন জোর করে নিয়ে গেলুম ভাবলুম করোনা হলে কদিন হসপিটালে থেকে আসবে আমি ইয়ে সেই কদিন একটু ফিরি টাইম কাটাবো। এখন তো লকডাউনে সবাই ঘরে তাই ঘরের মধ্যে কি করতিছি কে দেখছে!"
" তা ডাক্তার কি বললো?"
" সারাদিন করোনা এসো করে হেঁদিয়ে মরলুম।টেস্টে নেগেটিভ এলো।"
বাবার ত্রিনয়ন আবার জ্বলে উঠলো.." ওরে হতভাগা, ওর রোগ হলে যে তোকেও ধরবে সে খেয়াল আছে? ওর সাথে শোয়া বসা করিসনে বুঝি? আর তোর পীরিতের মেয়েমানুষেরও হবে। পুলিশ ঠিক খুঁজে বার করবে।"
" এই কদিন পৌরুষবর্ধক গুলি খা,করোনা বিদায় হলে অনায়াসে ইনডোর আউটডোর গেম খেলতে পারবি।"
পার্বতী মাসিমা হাঁফিয়ে উঠেছেন ভেতরে ভেতরে। সমাজের ভেতরে কত ফুটো যে হয়েছে কে জানে? যাক একটা একটা করে অনেকেই বিদায় হচ্ছে করোনা নির্বীজকরণ মহাধৌতি নিয়ে। এবার ওনার পালা আসছে,বঙ্কুটা না জানি অপেক্ষা করে করে দুশো টাকা চেয়ে বসে।
"বল এবার তোর কথা" ত্রিনয়ন আ্যন্টেনা বাবা বলেন।
" বাবা আমাগো একখান কাপড়ের দোকান আছে গন্ধেশ্বরী বস্ত্রালয়। আর ছেলের বইখাতার দোকান পুঁথিপত্র। সরকার বাজার র্যাশন,ওষুধ মুদির দোকান খোলা রাখসেন কিন্তু পরা আর পড়া দুইই বন্ধ করসেন। কি কইর্যা সংসার চলবো কন তো?"
" আ্যন্টেনা বাবা কারনের নেশায় ঢুলতে ঢুলতে বললেন পরা আর পড়া মানে?"
" ঐ গিয়া জামাকাপড় পরা আর পড়া মানে বইপুঁথির ব্যবসা এখন তো বন্ধ রেখেছেন তাই আমাগো চলবো কি কইর্যা?"
" শোন অর্থনীতিতে মন্দা তাই পরা আর পড়া যত কম হবে ততই ভালো।"
বাবার কথায় কোন আশা দেখতে পাননা মাসিমা তাই বলেন," বাবা আপনার ঐ গিয়া তো আ্যন্টিনা আর ত্রিনয়ন দুইই আছে একটু কননা আমারে এই করোনা কবে যাইবো? সেলের বাজারে ভরাডুবি, পয়লাবৈশাখে কয়লা। দুগ্গা পুজাটা পামু তো?"
চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভেবে বাবা বলেন," শোন দ্যাবতারা সবাই সিগন্যাল অফ করেছে করোনাতে স্বগ্গেও লকডাউন কারেন্ট পঞ্জিকাও বেরোয়নি। দেবতারা সবাই কোয়ারেন্টাইনে।তাই কারেন্ট নিউজ দিতে পারছিনা।"
কাঁদো কাঁদো গলায় পার্বতী মাসিমা বললেন," ভাইরাসটাকে দেখে যদি বলেন কবে যাবে। বা কোন তাবিজ?"
একটু বিপাকে পড়েন বাবা ম্যানেজ করতে বলেন..." আমার ত্রিনয়নের তেজে আর করোনা নির্বীজকরণ মহাধৌতির গন্ধে আসেপাশে নেই ভাইরাস তাই ঠিক দেখতে পারছিনা। সামনের অমাবস্যায় করোনা বিনাশিনী যজ্ঞ করে বলতে পারবো।তবে খরচ আছে। দুইহাজার লাগবে পরার দোকান খোলাতে আর পড়ার দোকানের জন্য দুই।"
" ওনারে জিজ্ঞাসা কইর্যা একদম পোলারে লইয়্যাই আসুম বাবা।" বলে পার্বতী মাসিমা পা বাড়ান রাস্তার দিকে কিন্তু ছাড়া পেলেননা করোনা নির্বীজকরণ মহাধৌতি কিনতেই হলো।"
গঙ্গার পাড়ে এসে দেখেন বঙ্কু ঘুমিয়ে পড়েছে..
আস্তে আস্তে গঙ্গার ঘাটে নেমে করোনা নির্বীজকরণের শিশিটা মুখ খুলে ভাসিয়ে দেন পার্বতী মাসিমা।
ফেরার সময় আর কথা বলতে ইচ্ছে করেনা,কেমন যেন নিজেকে খুব অসহায় আর বোকা বলে মনে হয়।বঙ্কু একদম বাড়ির সামনে এনে নামিয়ে দেয়," নিন সাবধানে নামুন।" ওকে বাড়তি পাঁচশো টাকা হাতে দিয়ে বলেন চাল আর আলু,তেল কিইন্যা বাড়ি লইয়্যা যাস আর একটা সোয়াবিনের প্যাকেট। বিপদে আপদে ছেলেটা খুব করে। করোনা বিনাশিনী যজ্ঞ করার থেকে কুসংস্কার বিনাশ করাটাই জরুরী মনে হলো তাই ব্যাগ থেকে স্যানিটাইজার বের করে ভালো করে হাত ধুয়ে বাথরুমে গিয়ে জামাকাপড় ধুয়ে নিলেন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment