#আমার_সন্তান#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
জামগাছটার তলায় এসে দাঁড়ায় অতসী,ছোট ছোট জাম ধরেছে।গাছটা ঘিরে পাখির কিচিমিচি,পাশের জামরুল গাছটাতেও থোকা থোকা জামরুল ঝুলছে। হাল্কা মিঠে ফুলের সুবাসে চারিদিক ভরেছে। অতসীর একটুকরো জমিতে ছোট দুটো ভাঙাচোরা ঘর,পাশে একটুখানি ছোট রাধাগোবিন্দের মন্দির ঐ কুড়ে ঘরেই আলো করে রয়েছে রাধাগোবিন্দের যুগল মূর্তি,সেজেছে ওর তুলসীমঞ্চের কাছের টগর ফুলের গুচ্ছে।
যখন এখানে বাসা বেঁধেছিলো তখন ভাবেনি এই জায়গার পাশ দিয়েই বড় অজগরের মত পিচঢালা রাস্তা হবে আর তার ওপর দিয়ে সারা দিন রাত চলবে ভারী ভারী গাড়ি।মাঝেমধ্যে বুকটা কাঁপে অতসীর গাড়ির আওয়াজে যখন ওর নড়বড়ে বাড়িটা কাঁপে।
জামরুল গাছে কত পাখি উড়ে আসছে আর যাচ্ছে। পাশের লেবু গাছটাতে বুলবুলি পাখি বাসা বেঁধেছে মা বুলবুলি মাঝে মাঝেই ঠোঁটে করে খাবার এনে খাইয়ে দিচ্ছে বাচ্চাগুলোকে। লাল ঠোঁটের ফাঁকে যত্নে ঠোঁট ঢুকিয়ে খাইয়ে দিচ্ছে। আবার উড়ে গিয়ে খাবার আনছে। অতসীর বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে বিকাশের জন্য কোথায় যে আছে ছেলেটা কি করছে কে জানে? একটা সময় রাস্তার গাড়ির আওয়াজে বুক কাঁপতো। এখন অতসী কান পাতে গাড়ির আওয়াজ শোনার জন্য আসলে এই কয়েকবছরে শব্দটাই যে অভ্যেস হয়ে গেছে।নিঃশব্দতা ব্যথা দেয়,দূর থেকে রমেনের মা বা লতিফের মা জল নিতে যাওয়ার পথে হাঁক মারে ও দিদি কেমন আছো গো? বিকাশের কোন খবর পেলে?
" কদিন আগে বলেছিলো গো আসবে সে,গাড়ি চলতিছেনা।চললেই আসবে,ওখানে খুব কষ্ট। আমি বলেছি আয় বাবা এখানেই শাকভাত নুনভাত যা হয় খাবো।"
রাতে ঘুমের ঘোরে কান পাতে অতসী বাঁশের বেড়াটায় কেমন যেন ক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়।শুনেছে কত খেটে খাওয়া মানুষ গাড়ির অভাবে হেঁটে রওনা দিয়েছে বাড়ির রাস্তায়।তবে কি বিকাশ এলো? কাঁপা গলায় আস্তে একটা আওয়াজ করে.." এলি নাকি রে?"
তারপর আবার কান পাতে,না না হাওয়া দিতেছে তার শব্দ হবে। আজকাল যে কি হয়েছে একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম ধরেনা। ছেলেটা দুবছর বাইরে,সেই কতদূরের শহরে পাড়ি দিয়েছে কাজের আশায়। গত পুজোতে এসেছিলো,বললো.." মা,ওখানে কাজের পয়সা ভালো। ভালো করে খাটতি পারলে একেবারে টাকা জমিয়ে তোমার কাছে আসবো।এখানেই একটা ছোটমোট দোকান করবো।"
ছেলের দেওয়া ডুরে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে সামনের দুগ্গাদালানে গিয়ে ডাকের সাজের মায়ের কাছে হাতজোড় করে অঞ্জলি দিয়ে বলেছিলো," ঐ আমার একটাই শিবরাত্রির সলতে ঠাকুর,ওরে তুমি দেখো মা। আগলে রেখো বিদেশ বিভূয়ে।"
ছেলেটার হাসিমুখটা দেখে শান্তি পেয়েছিলো যাক্ দূর শহরে ভালো আছে ছেলেটা কি সুন্দর জিন্স কাপড়ের প্যান্ট আর জামা পরেছে। এর পরে এলে বলবে একটা বে কর বাবা। একা একা থাকিস দূরে।এখানে এলে যখন দোকান করবি শাউড়ি বৌয়ে থাকবো ঘরে। একলা আর ভালো লাগেনা।
কদিন গলা দিয়ে ভাত নামেনা অতসীর,র্যাশনের চাল ওভাবেই পড়ে আছে। একমুঠো চাল কোনদিন একটা আলু দিয়ে সেদ্ধ করে খায়,ওতেই জল ঢেলে রাখে রাতে খায়।কোনদিন দুপুরেও মুড়ি খেয়ে থেকে যায়। প্রায় দুমাস ছেলেটা কোন টাকাও পাঠাতে পারেনি।
অতসীর ফোন নাই,রমেনের মায়ের বাড়িতে ছেলেটা ফোন করে দরকারে।ছোঁয়াচ অসুখের জন্য রমেনের মা ফোনটা নিয়ে দাঁড়ায় মুখ ঢেকে একটু দূর থেকে কথা বলে অতসী।
সেই কবে ছেলে বলেছে," মা আমি আসতেছি। হয়ত সাতদিন বা দশদিন লাগবে। তবুও পৌঁছে যাবো।"
" কি করে আসবি বাবা? কোন গাড়িতে বাবা?"
ফোনটা কেটে যায়,আর কথা হয়না। রমেনের মা বলে টিভিতে দেখাইতেছে দিদি গাড়ি না পেয়ে সব পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফিরতিসে গো দিদি। বুকটা কেঁপে ওঠে অতসীর ও মাগো গাড়িতে দুদিনের পথ ছেলেটা কি করে আসবে হেঁটে?
তারপর থেকে অপেক্ষার শুরু,প্রতিদিন বেড়ার গেটটা পেরিয়ে টুকটুক করে হেঁটে রমেনের মায়ের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়,"হ্যাঁ গো খবরে কিছু বলতিছে গো?"
রমেনের মায়ের গলা দিয়ে বেরোয়না,রেললাইন দিয়ে হেঁটে আসার সময় ক্লান্ত শরীরে ওখানে শুয়ে থেকে মালগাড়ি চাপা পড়ে মরে গেছে কতগুলা তাজা লোক। না না ভালো থাক বিকাশ,দুঃখিনী মায়ের ঐ তো একটাই সন্তান।
শুকনো গলায় বলে," দিদি কত লোক বৌ বাচ্চা নিয়ে আসতিছে গো,এ এক মিছিল গো।কিন্তু কেউ কথা কইতেছে না। বাচ্চাগুলা রোদে পুড়ে ঘুমায়ে পড়িছে বাক্সের উপরেই গো।"
অতসীর গলাটা শুকিয়ে যায়,আগে আগে রমেনদের বাড়ি এসে মাঝে মাঝে টিভি দেখতো। এখন ছোঁয়াচ রোগ এসেছে তাই মুখে আঁচল বেঁধে লক্ষ্মণরেখার মত ওদের গেটের ওপার থেকে কথা বলে চলে আসে।
অতসীর অন্তহীন অপেক্ষা চলে দিনে তুলসীতলার পাশে জামগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে। আর রাতে বিছানায় শুয়ে কান পাতে, শুধু মনে হয় ঐ বুঝি এলো বিকাশ,মা বলে ডাকবে.." কই গো মা,চলে এয়েছি গো। একটু জল দাওনা।"
লতিফের মাকে দেখে গলা বাড়ায় অতসী.." কি গো কিছু খবর শুনেছো? আমার বিকাশটা এখনো এলোনি,সেই কবে ফোন করেছিলো।"
" আসবে দিদি,ঠিক আসবে।গাড়ি চলতেছেনা গো। সময় লাগবে, তুমি সবুর করো ঠিক আসবে ছেলে গো।"
জলের কলসি কাঁখে নিয়ে চোখটা ভিজে যায় লতিফের মায়ের।কে জানে মিছে কথা বললো কিনা মাকে। কত লোক মরতিছে কেউ গাড়ি চাপা পড়ে,কেউ বা হেঁটে হেঁটে। হায় আল্লা ঘরের ছেলে ফিরুক ঘরে।
মাঝে কেটে গেছে কয়েকদিন, সাতদিন বিকাশের কোন ফোন পায়নি অতসী। রাধাগোবিন্দের সেবা দিতে গিয়ে চোখ ছাপিয়ে জল আসে।কাল কারা যেন বলতে বলতে যাচ্ছিলো.. ঐ খেটে খাওয়া মানুষগুলাকে নাকি এখন ভদ্রভাষায় পরিযায়ী শ্রমিক বলে। কত লোক মরে গেছে,করোনা ধরার আগেই ওরা মরে যাচ্ছে বাড়ি ফিরতে গিয়ে। কই রমেনের মা তো কিছু বলেনা। তবে কি ছেলেটা আর....
হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে অতসী।তারপর নিজেই চোখের জল মোছে.. সন্তান পথে আছে মন ভাঙলে কি করে চলবে ঠাকুর ঠিক ফিরায়ে দেবে তারে।
সকাল থেকে অপেক্ষায় বসে বসে রমেনদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। " একটা কথা কইবো? একটু দেখবি বাপ রমেন,বিকাশকে ফোন করে।"
কাঁপা হাতে কাগজে লেখা ফোননম্বরটা দেয় অতসী।
"কাকি ফোনটা সুইচ অফ বলতিছে গো। আমার কাছে রইলো নম্বরটা।মনে হয় রাস্তায় আছে চার্জ নাই ফোনে। আমি পেলেই খবর দেবো।"
রমেনের মা রান্নাঘরের জানলা দিয়ে মুখ বাড়ায়," ভেবোনি দিদি। তুমি ঘরে যাও। একটু দাঁড়াওনা গো।"
অতসীর হাতে মুড়ির পোটলাটা ধরিয়ে বলে। "গরম ভাজলাম,খেয়ো। না খেয়ে থেকোনি।"
অতসী রাস্তায় চোখ রাখে..মাথায় বস্তা নিয়ে পিঠে ব্যাগ বেঁধে বাচ্চাকে পিঠে নিয়ে ফিরছে কত নোক। একটা বৌ হাঁফাতে থাকে পা দুটো ফোস্কায় ভরা। " একটু জল খাবে গো,ও বৌ।"
বৌটা মুখ তোলে অতসী জলের বোতল আর মুড়ি কিছুটা এগিয়ে দেয়। মনে মনে ভাবে কে জানে হয়ত ছেলেটাও এমন করেই হেঁটে হেঁটে আসছে।
মাঝে কেটে গেছে আরও পাঁচটা দিন,তিথির হিসেব করে অতসী। আজ তো পূর্ণিমা।কিছুই এখন খেয়াল থাকেনা। আজ যে বিকাশের জন্মদিন।
লতিফের মাকে দেখে ডাক দেয়.." ফাতিমা এক পো দুধ এনে দিতে পারিস। আজ বিকাশের জন্মতিথি। কে জানে ছেলেটা কোথায়? আঁচলের খুঁট থেকে দশটা টাকা এগিয়ে দেয়।
চোখটা ভিজে যায় ফাতিমার.." আমি দেখতেছি গো,ভেবোনি তুমি।"
দুদিন বাদে রান্নাঘরে ঢুকেছে অতসী চালে দুধে জ্বাল দিয়ে একটু পায়েস তৈরি করে রাধাগোবিন্দের সামনে দিয়ে হাতজোড় করে অতসী,ভিজে যায় চোখের কোণটা। আজ দুপুরে কোন রকমে একগ্ৰাস ভাত মুখে তুললেও রাতে ভাতের হাড়িতে জল ঢেলে শুয়ে পড়ে অতসী। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে চোখটা লেগে আসে। হঠাৎই ঘুমটা ভেঙে যায়,বাইরে ঝড় উঠেছে,কড় কড় করে বাজ পড়ছে।হঠাৎই বাইরের বাঁশের বেড়াতে আওয়াজ হয়। চোর নয়তো?একটু ভয় করে অতসীর,কান পেতে শোনে।
বারান্দায় একটা ক্ষীণ আওয়াজ শুনতে পায় কে যেন ডাকে.. মা, মাগো।
সমস্ত শরীরটা কেঁপে ওঠে অতসীর.." বিকাশ এলি বাবা? বিকাশ।"
ধড়ফড় করে উঠে হ্যারিকেনটা বাড়িয়ে দরজার খিলটা খুলে বাইরে দাঁড়ায় অতসী ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাওয়ায় বসে আছে বিকাশ,ওর পাশে বসে একটা ছোট্ট ছেলে।
জলের বোতলটা নিয়ে ছুটে আসে অতসী।ঢকঢক করে গলায় ঢালে ছেলেটা। কিছুটা জল নিয়ে চোখেমুখে ঢালে। ছোট ছেলেটার মুখে ছিটায় কিছুটা।
" এ কে রে বিকাশ?এই টুকুস বাচ্চাটারে কোথায় পেলি?"
মাকে এখন আর বলতে পারেনা বিকাশ বাবা মায়ের সাথে পথে বেড়িয়েছিলো বাচ্চাটা হয়ত ফিরছিলো নিজেদের আপনজনের কাছে। গাড়ির ধাক্কায় ওর সামনেই মা বাবা দুটো। আর ভাবতে পারেনা।বলে.." সে অনেক কথা মা, এখন তো দুটো খেতে দাও।পরে বলবো তোমায় সব।"
রাধাগোবিন্দের সামনে দেওয়া পায়েসের বাটিটা ছেলের সামনে এনে চামচে করে তুলে দেয় অভুক্ত দুই সন্তানের মুখে। মনে মনে বলে...ওদের তুমি বাঁচিয়ে রেখো ঠাকুর,দুধে ভাতে না হলেও পান্তাটুকু পেটে দিয়েও যেন ওরা ভালো থাকে।।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment