Skip to main content

প্রথম প্রেম

#প্রথম_প্রেম#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"খুকু এবারের পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাবো ভেবেছি। আমাদের তো সেরকম ভাবে এতোদিন দূরে কোথাও যাওয়া হয়নি। বাবা মা দুজনেই বয়স্ক বাড়িতে ছিলেন। ঐ পুরী,দার্জিলিং, দীঘা,তারাপীঠ,বক্রেশ্বর।"
  কথাগুলো বলে একটু নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন বাবা। সত‍্যিই তো তখনকার দিনের যৌথ পরিবার ওদের তাই সবসময় বেরোবো বললেই বেড়াতে যাওয়া হয়নি।তারপর ওর আর ভাইয়ের পড়াশোনা পরীক্ষাও ছিলো।
        " তা হ‍্যাঁ গো আমরা একলা যাবো নাকি আর কেউ যাবে আমাদের সাথে? মেয়ে তো বড় হয়েছে কলেজে পড়ছে।অত বড় মেয়ে নিয়ে ভয় ভয় লাগে একলা যেতে।"
        মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখটা একটু বড় বড় করি আমি।আমাকে নিয়েও ভয়! কেন আমি কি গয়না গাটি যে ছিনতাই হয়ে যাবো!
         " হ‍্যাঁ আমিও তাই ভাবছিলাম গো। রায়ের সাথে কথা হলো,ওরাও যাবে এক পরিচিত ট‍্যুর কোম্পানির সাথে তাই ভেবেছি ওদের সাথেই যাবো।বললো খরচও বেশি হবেনা।"
         আমি আর ভাই লাফিয়ে উঠি..কোথায় কোথায় যাবো গো বাবা আমরা?
      ঐ হরিদ্বার, মথুরা,বৃন্দাবন, দেরাদুন আর মুসৌরী। নামগুলো শুনেই আমরা হৈ হৈ করে উঠেছিলাম। আসলে তখন ওটাই বিরাট প্রাপ্তি আমাদের কাছে। উফ্ ট্রেনে করে ঘুরে বেড়ানো প্রায় পনেরো দিন ধরে ভেবেই রাত্রে কেমন যেন ছুটে চলে গেলো মন। পরেরদিন বাবা কতগুলো বই এনে বললেন," খুকু কোথায় যাচ্ছিস একটু জেনে নে।তাহলে তো ভালো লাগবে। আর একটা ডায়েরি সাথে নিবি যাতে সব লিখে নিবি। আর ওখানে গিয়েও লিখবি রোজ রাতে।"
       এত লেখালেখি করবো তো দেখবো কখন বাবা?
    " আরে রাতে লিখবি,তখন আর কি করার থাকবে শুনি। একটা সময় তোরই ভালো লাগবে দেখবি।"
          দিন যেন আর কাটতে চায়না কবে পুজো আসবে আর কবে আমরা বেরোবো। বেশ কয়েকটা পাতলা গল্পের বই সাথে নিয়েছি ট্রেনে পড়বো বলে।বাবার কাছে ভাই আব্দার করলো একটা ক‍্যামেরা কেনার। সেটাও হলো। বাবাই হাতে করে নিয়ে এলেন একদিন আমাদের কিছু জামাকাপড়,শীতের পোশাক আর মায়ের জন‍্য শাড়ি।
    " খুকু মা দেখতো,পছন্দ হয় কিনা? না হলে তোর আশু জেঠুর দোকান থেকে বদলে নিস। বললাম দুই ভাগে টাকাটা দিয়ে দেবো।"
       খুব ভালো হয়েছে বাবা।মনে হচ্ছে সব ঠিকঠাক হবে।বাহ্ কোটটা তো খুব সুন্দর।
" হ‍্যাঁ বললো কাশ্মীরী কোট, গতবারের মাল একটু সস্তায় পেয়ে গেলাম। আমি একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গায়ে ফেলে দেখলাম।
        দেখতে দেখতে আমাদের যাওয়ার দিন চলে এলো। সব গুছিয়ে আমরা তৈরী হয়ে রওনা দিলাম স্টেশনের পথে। মাকে কি সুন্দর লাগছে নতুন শাড়ি কুচি দিয়ে পরে। মাথায় বেশ সুন্দর খোঁপা করেছে। আমি পরেছি পছন্দের লাল সবুজের বাঁধনী চুড়িদার সাথে লাল ওড়না।বাবা ভাই সবাইকে যেন আজ ভালো লাগছে।আসলে মনে সবার খুশির হাওয়া লেগেছে তাই হয়ত।
            রায় কাকুরাও এসে গেছেন,ভাই ওনার ছেলের সাথে মেতে উঠলো।মা আর কাকিমা গল্প শুরু করলেন। ট্রেন আসতেই আমরা উঠে পড়লাম।দেখলাম পুরো কোচটা জুড়েই আমাদের দলের লোকজন। আমাদের ট‍্যুর ম‍্যানেজার এসে সবাইকে দেখে গেলেন সবাই এসেছে কিনা। ট্রেন ছেড়ে দিলো, আমি জানলার ধারে বসে বই খুললাম।তবে মন দিতে পারলাম না।মন উড়ে যাচ্ছিলো গাছপালার সাথে কত দূরে।মাঠের পর মাঠ সবুজের চাদর বিছিয়ে আছে।মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি।
                      এইভাবে কেটে গেছে কিছুটা সময়।বাবা মা গল্পে ব‍্যস্ত। ভাই বাঙ্কে উঠে লুডো খেলছে রায় কাকুর ছেলে বুল্টুর সাথে।
         
        " আপনারা এখানে সাত জন তো? আপনাদের খাবার গুলো দিয়ে যাচ্ছি। সবাই ননভেজ তো?"
         গলাটা শুনে মুখ তুলে তাকাই শ‍্যামলা লম্বা একটা ছেলে। লোক বলা যায়না। খাবারের কথা জিজ্ঞেসা করতে এসেছে। আমার সঙ্গেও চোখাচোখি হলো,হাসলো বললো.." আমি সুমন্ত,আপনাদের গাইড। আবার মুশকিল আসানও বলতে পারেন।কিছু প্রয়োজন হলেই বলবেন এসে যাবো।"
              মনে মনে ভাবলাম আমাকে দেখে আবার হাসির কি হলো? ট‍্যুর কোম্পানির লোকজন বোধহয় এমন হয় সবসময় মূলোর দোকান খুলেই রেখেছে।
                 সেই শুরু,তারপর ট্রেনে যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ ঐ মুশকিল আসান সুমন্ত যতবারই এসেছে একদম হাসি মাখিয়ে সেবা দিয়ে গেছে। বাথরুমে যাবার পথেও দেখলাম একই ভাবে পাশের সীটের যাত্রীদের সাথেও কথা বলছে।
          প্রথমে মথুরাতে নামলাম আমরা,ওখান থেকে বৃন্দাবন হয়ে যাবো হরিদ্বার তারপর দেরাদুন আর মুসৌরী।
             মথুরাতে আর বৃন্দাবনে শুধুই কৃষ্ণের স্মৃতিমাখা সব দেখার জায়গা। সুমন্ত সব জায়গাতে নিয়ে গিয়েই আমাদের একদম পারফেক্ট গাইডের মতো রানিং কমেন্ট্রি দিয়ে যাচ্ছিলো। আমি নোটবুক হাতে নিয়ে নোট নিচ্ছি। মাঝে মাঝে ছবি তুলছি। ভাই অবশ‍্য ক‍্যামেরা ছাড়তে একদমই নারাজ।
হঠাৎই শুনি..." কি হয়েছে? ওহ্ ফটো তোলা নিয়ে সমস‍্যা? আচ্ছা দুজনেই দাঁড়ান আপনারা আমি তুলে দিচ্ছি। ও মাসিমা মেসোমশাইকেও ডেকে নিন ফ‍্যামেলি পিকচার হয়ে যাবে।"
            বাবা! এতো একেবারে জবরদস্ত গাইড কাম ফটোগ্ৰাফার। দলের অনেকেরই ছবি তুলে দিচ্ছে। রায়কাকু তো বলেই ফেললেন," সুমন্ত ছেলেটা কিন্তু অলরাউন্ডার।কেমন হাসিমুখে সবার সব আব্দার রাখছে। কোন বিরক্ত নেই।"
                 লছমনঝুলার ব্রীজের কাছে আমি দাঁড়িয়ে গঙ্গার একটা ছবি তোলার চেষ্টা করছি তারপর মন্দিরগুলো নেবো। এমন সময় শুনলাম," আপনি দাঁড়িয়ে পড়ুননা এখানে হ‍্যাঁ ওড়নাটা একটু ভাসিয়ে দিন। খুব সুন্দর ছবি আসবে। ফিরে গিয়ে দেখবেন সবাই বলবে কে ছবি তুলে দিয়েছে।"
              ও যখন বলতো তখন ওর কাছে আমি দাঁড়াতাম ভালো করে শুনতে পাবো বলে। ওর গায়ের পুরুষালি গন্ধটা এই কদিনে আমার চেনা হয়ে গিয়েছিল।
       " খুকু ডায়রিতে সব লিখে রাখছিস তো মা?"
   হ‍্যাঁ বাবা সব লিখছি। জায়গার সাথে সাথেও ডায়েরিতে অনেক জায়গাতেই লেখা থাকতো সুমন্তর কথা। ওর জন‍্যই আমার অনেক ছবি উঠে গেলো।কখনো গঙ্গার ধারে সিঁড়িতে বসে। কখনো মন্দিরের হাতির পাশে দাঁড়িয়ে আবার কখনো সূর্যোদয়ের ছবিতে আমি।
           ভোরবেলা উঠে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতাম তদারকি করছে কখনো খাবারের, কখনো বা গাড়ির আবার কখনো কারো ওষুধ এনে দিচ্ছে। ম‍্যানেজার হরিপদ বাবুর থেকেও সবার মুখে এক নাম সুমন্ত।
                 এক একটা জায়গা ঘুরতাম আর দিন গুনতাম কটা দিন হাতে আছে আর। কেন যেন মনটা খারাপ হয়ে যেতো।মনে হত এই তো বেশ ভালো আছি,কত জায়গা ঘুরছি,ছবি তুলছি আর সুমন্তকে দেখতে পাচ্ছি।
                   চন্ডীপাহাড় থেকে নামতে গিয়ে আমার পা হড়কালো।
  " সুমন্ত দেখো তো একটু,আছে কোন ব‍্যথার ওষুধ? মেয়ে তো পা ফেলতেই পারছেনা। আমি এনেছি কিন্তু সেতো হোটেলে।"
     সবাইকে এগোতে বলে এগিয়ে আসে ও.." দেখি,দেখি।ওহ্ আচ্ছা আগে এটা একটু মুখে দিয়ে নিন। আসলে আর্ণিকা আর নাক্স আমার  পকেটেই থাকে।"
        ও খুব কাছে এসে আমার মুখে ওষুধ ঢেলে দিলো।
   " আমি একটু পায়ে হাত দিচ্ছি।"
  আমার শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে গেলো।দেখলাম কি অদ্ভুতভাবে পা টা একটু নাড়িয়ে স্প্রে করে দিতেই অনেকটা হাল্কা লাগলো।
     " চলুন আমাকে সাপোর্ট করে আস্তে আস্ত নামুন।গাড়ি নিচেই আছে।"
      সেদিন রাতে সুমন্তর স্পর্শ আমাকে ঘুমোতে দিলোনা।আমার ডায়েরিতে সবটুকু লিখতে পারলাম না।মনেই রয়ে গেলো অনেক কথা। কেমন যেন মনে হয়েছিলো ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে যদি আরেকটু পথ হাঁটতে পারতো!
                       মা বললো," আজ কি তুই বেরোতে পারবি? নাকি আমরা দুজনেই রয়ে যাবো ঘরে?"
  না মা পারবো যেতে না গেলে তো কিছু দেখাই হবেনা।
               অনেকগুলো জায়গা ঘুরে আমরা মুসৌরীতে এসেছি। কুয়াশার লুকোচুরিতে শহর জুড়ে যেন ভালোবাসার লুটোপুটি। কোথাও পাহাড়,কোথাও ঝরনা।খুব মিষ্টি পাহাড়ি শহর।
           ভাই আমি ওখানে দাঁড়াচ্ছি,একটা ছবি তুলে দে। ঠিক করে তুলবি কিন্তু।
             হঠাৎই দেখি ক‍্যামেরা হাতে সুমন্ত দাঁড়িয়ে.." হ‍্যাঁ হাসুন এবার।ঐ পাথরটাতে একটু গিয়ে বসুন তো। বাহ্ খুব সুন্দর পোজ হয়েছে।"
                 আমি বললাম থ‍্যাঙ্ক ইউ ছবি তুলে দেবার জন‍্য।
    " আসলে ফটোগ্ৰাফিটাও আমার শখ।মানে শিখেছি আর কি।চাকরিতে উন্নতি করতে তো হবে। জানিনা কেমন হলো? বাড়ি গিয়ে ওয়াশ করে আমাকে গালাগালি করবেননা যেন।"
          এবার আমি সত‍্যিই লজ্জা পাই। ইচ্ছে হলো বলি ঠিকানাটা দিন তাহলে জানিয়ে দেবো কেমন হয়েছে। বলতে পারলাম না।
              আমাদের ফেরার দিন এসে গেলো।আমার যেন কেমন মন খারাপ হলো।মন খারাপের ছোঁয়া লাগলো আমার ব‍্যক্তিগত ডায়েরির সাথে সাথে মনের পাতাতেও। এই কদিন যেন ছিলো স্বপ্নের মতো আমার কাছে। মন হারিয়ে ফেললাম মুসৌরীতে পাহাড়ের মেঘ কুয়াশায়। আমার প্রথম প্রেমকে হঠাৎই যেন খুঁজে পেলাম পাহাড়ে আর উপত‍্যকায় অথবা বৃন্দাবনের বাঁকে বিহারী মন্দিরের আরতিতে।
      " তোর কি মনটা খারাপ খুকু?"

হ‍্যাঁ মা কি তাড়াতাড়ি দিনগুলো চলে গেলো বলতো? কি আনন্দই না করলাম এই কটা দিন।আবার কবে আসবো মা বেড়াতে?
        " আর কবে হবে কে জানে রে?"
আর আমার মনে হলো বাড়ি ফিরে হারিয়ে যাবে অনেক কিছুই,হারিয়ে যাবে গাইড সুমন্তও।

               সত‍্যিই কিছুই রইলোনা স্মৃতিটুকু ছাড়া।
সবাই এক বাক‍্যে সুমন্তর নামে জয়ধ্বনি দিলো।
   " থ‍্যাঙ্ক ইউ অল। আবার পরিযায়ী ট্র‍্যাভেলসের সাথে চলে আসবেন। আমি থাকবো আবার আপনাদের সাথে।"

         বাড়ি ফিরে এসে ছবিগুলো আর তার সাথে টুকরো টুকরো রোদেলা মনের কথা রয়ে গেলো স্মৃতিতে। সত‍্যিই ছবিগুলো খুব ভালো তুলেছে সুমন্ত কিন্তু ধন‍্যবাদ দেওয়ার কোন উপায় নেই। সবাইকেই বলে দিয়েছে অফিসের ফোনে যোগাযোগ করতে।
           " আরে তোকে তো পুরো হিরোইন লাগছে রে! তা এতদিন ঘুরলি কোন হিরো জোগাড় হলোনা। বলনা রে তোদের টিমে কোন হ‍্যান্ডসাম ছেলে টেলে ছিলোনা?"
         মনের কথাগুলো মনেই রেখে দিলাম আমি খুকু মানে খেয়ালী।
        আরো একটা বছর কেটে গেলো, ভাই আর আমি দুজনেই বললাম..বাবা আমরা এবার কোথাও যাবোনা গো বেড়াতে?
            " যাবো রে এবার হবেনা,সামনের গরমে যাবো সিমলা।রায় বলছিলো পরিযায়ীদের একটা ট‍্যুর আছে তখন।"
         মনটা আমার নেচে উঠলো,একটা গ্ৰুপ ছবিতে সুমন্ত ছিলো সেটা বার করে দেখলাম।মনে মনে বললাম এবার বলবো মনের কথাটা পাহাড়ের নিরিবিলিতে।
                    যাওয়ার আগে পছন্দ করে টিউশনের টাকা থেকে কতগুলো শালোয়ার কিনলাম। পছন্দের চুড়ি আর দুলও কিনলাম ম‍্যাচিং করে।
                  ট্রেনে উঠে বসে আছি দুরুদুরু বুকে বইয়ে আর মন দিতে পারিনি। একটু বাদেই তো আসবে ও।কতদিন বাদে দেখবো প্রায় দেড়বছর।আমাকে চিনতে পারবে কি?
        " আপনাদের এখানে সাতজন তো?"
এক ঝলক খুশি ছুঁয়ে গেলো কিন্তু এ তো সুমন্ত নয় অন‍্য কেউ। কাকে জিজ্ঞেস করবো সুমন্ত কোথায়?ট্রেনের জানলা দিয়ে তখন মন খারাপের মেঘলা হাওয়া ঢুকছে হু হু করে। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দটা যেন নিভে গেলো হঠাৎই। সিমলার ম‍্যালে গাইড প্রকাশকে জিজ্ঞেস করেছিলো..সুমন্তবাবু আসেননি এবার?
      " সুমন্তদা বেটার চান্স পেয়ে জব ছেড়েছেন ঐ জায়গাতেই তো আমি এসেছি। আমাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন যাবার আগে। কোন অসুবিধা হচ্ছেনা তো ম‍্যাম?"
       শুকনো হেসে বললাম, কোথায় গেছেন নতুন জব পেয়ে?যদিও জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়।তবুও যেন কান্ডজ্ঞান হারালাম।
     " একটা ফরেন ট‍্যুর কোম্পানীতে।"

      হারিয়ে গিয়েছিলো সুমন্ত হয়ত মানুষের ভিড়ে এই পৃথিবীর কোন এক নির্জন কোণে। হারিয়েছিলাম আমার প্রথম প্রেম যা অব‍্যক্তই রয়ে গেলো।
        আমি খুকু মানে খেয়ালী যার জীবনে প্রেম একবারই এসেছিলো গোপনে তবে তা ছিলো শুধুই একতরফা যা সুমন্তকে ছুঁয়ে যায়নি। আমিও কোনদিন বলতে পারিনি।হয়ত সেই পনেরো দিনের স্মৃতিটুকু ছিলো আমার জীবনে একটুকরো মিঠে পরশ।
                  আমি তখন একটা চাকরি করছি বাড়ি থেকে বাবা মা বিয়ের জন‍্য চেষ্টা করছেন।দু একটা ইন্টারভিউ দেওয়া হয়ে গেছে অলরেডি তবুও ঠিকঠাক কিছু হয়নি। হঠাৎই রুবি মানে আমার কোলিগ বললো.." খেয়ালী ধানবাদে যাবি আমার মাসির বাড়ি?মাসতুতো বোনের বিয়ে। মাসি বারবার বলেছে যেতে।"
       মা বাবাকে বলে যাবো বলে ঠিক করলাম। অনেকদিন বাদে বাইরের হাওয়া।এখন চাকরি করি তাই একটু স্বাধীন।ওর মাসির বাড়ি গিয়ে সত‍্যিই ভীষণ ভালো লাগলো একদম অন‍্য স্বাদের বিয়েবাড়ি ব‍্যান্ডপার্টি বাজনা বাজছে। গায়ে হলুদে আমাদের সবাইকে মাখালো হলুদ।তারপর নানা অনুষ্ঠান বেশ ভালো লাগছে।
         সন্ধ‍্যের পর বাজি পটকা ফাটছে ভীষণ শুনলাম বর আসছে।সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে।
     রুবি ডাকলো "বর দেখবিনা?"
দাঁড়া সবাই যা ঘেরাও করেছে বরকে ফাঁকা হোক দেখবো।
             দেখেছিলাম বরকে, যদিও চারবছর আগের কথা তবুও চিনতে ভুল হয়নি সুমন্তকে।
কান্না? না না কান্না পায়নি তবে বুঝতে পেরেছিলাম পৃথিবী গোল।আগে থেকে যদি পাত্রের নামটা জানতাম তাহলে হয়ত আসতাম না। শুনলাম রুবির মাসতুতো দাদাও ট‍্যুরিজমে চাকরি করে ওরই বন্ধু সুমন্ত।
        সুমন্ত আমাকে চিনতে পারেনি,সেটাই স্বাভাবিক। আমিই তো প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছিলাম।ওর তো কোন দোষ নেই।
        তবে আমার মন থেকে একটু করে মুছেছিলাম সুমন্তকে কারণ সুমন্ত এখন অন‍্য কারো বর,অন‍্য কারো ঘর।হয়ত এই জানাটাও আমার জরুরী ছিলো।

  মাঝে কেটে গেছে পঁচিশ বছর আমারও হয়েছে শ্বশুরঘর আর বর। কেমন? হয়ত সুমন্তর চেয়েও ভালো। আর সুমন্ত কেমন আমি জানলামই বা কখন। আমার বর অপূর্ব এখন প্রমোশন পেয়ে অনেক উঁচু পদে চাকরি করে। বাড়ি,গাড়ি আর সুখ স্বাচ্ছন্দ‍্যে সাজানো সংসার আমার। টিয়া আমার একমাত্র মেয়ে,ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।খুব আদুরে,সুন্দরী আর আমাদের নয়নের মণি।
                    ভারতের মোটামুটি অনেক জায়গা আমাদের ঘোরা। গত দুবছর আগে ইউরোপ ঘুরে এসেছি এবার যাচ্ছি অষ্ট্রেলিয়া। আমাদের সাথে আছে আমাদের ট‍্যুর গাইড অনিন্দ‍্য।একদম ঝকঝকে স্মার্ট ছেলে,অনেকগুলো ভাষাতে কথা বলতে পারে। দেখতেও খুব সুন্দর আর হাসিখুশি।
  মাঝে মাঝেই টিয়ার সিঙ্গেল ছবি তুলে দিচ্ছে।
  টিয়া হাসছে ওর চোখে ঝলমল করছে সেই খুশি যা প্রায় তিরিশ বছর আগে আমার চোখে ছিলো।
             সেদিন রাতে ডিনারের শেষে ঘরে শুয়ে শুয়ে টিয়া আইপ‍্যাডে আমাকে ছবিগুলো দেখাচ্ছে..." মা এই দেখো ছবিগুলো।বলো আমাকে কেমন লাগছে?"
     আমার টিয়া তো সবসময় সুন্দর একদম প্রজাপতির মতো।
  " অনিন্দ‍্য খুব ভালো ছবি তোলে কিন্তু।"
ওকে দাদা বলো অনেকটা বড় কিন্তু তোমার থেকে।
" হম্, বাট স্টিল আনম‍্যারেড। কি মজা ওদের! সারা পৃথিবী ট‍্যুর করে। আমি জাস্ট ফিলিং ক্রাশ।"
           হাসি আমি বলি ওরা পরিযায়ী পাখির মত টিয়া। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা ঘুরে বেড়ায়। ওদের বাঁধা মুশকিল।ওরা বড় চঞ্চল,একদিন হয়ত কোথাও হারিয়ে যাবে।
            কথাগুলো বলতে বলতে মেয়েটার দিকে তাকাই,কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে। হয়ত স্বপ্ন দেখছে আমার মতই।©রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
ভালো লাগলে লেখিকার নামসহ শেয়ার করুন।
সমাপ্ত:-

               
     
      
        
        

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...