#এক_দুঃস্বপ্নের_রাত#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
রান্না করতে করতে রেডিও টিভির কথা কানে আসে বুলবুলের।গানের মাঝে মাঝে শুনেছে সতর্কবার্তা আম্ফান আসছে,কেউ কেউ আবার বলছে আম্পুন। আবহাওয়া দফতরের সতর্কতায় আজকাল তবুও মানুষ কিছুটা জানতে পারে বিপর্যয়ের কথা আগেভাগেই। মনে মনে একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিলো বুলবুল।
এর আগে ওর বর মজা করেছিলো,"আমার বাড়িতেই যা বুলবুলের তান্ডব তারপর আসছে আবার ঝড় বুলবুল।দুই বুলবুল মিলে তো এবার ভিটেছাড়া করে দেবে।"
"আমি তান্ডব করি বুঝি? আচ্ছা বেশ আমি এবার গিয়ে বাপের বাড়ি থেকে আসবো পনেরো দিন।ওর রসিক বর মজা করে তখন গেয়েছিলো..'বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে'
হেসে ফেললেও একটা নিঃশ্বাস ফেলেছিলো বুলবুল কে জানে কত মানুষের সর্বনাশ হবে এই ঝড়ে। ঝড় যে কি হতে পারে সমুদ্রের কাছে বাপের বাড়ি হওয়াতে খুব ভালো জানে বুলবুল। পারাদ্বীপে যখন ঝড় হয় তখন ঘরে বসে ওরা থরথর করে কেঁপেছিলো।
রান্না করতে করতে মন দিতে পারেনা রান্নায়।আকাশে মেঘের ঘনঘটা বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ করে।বারবার রান্নাঘর লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়। বাগানের নারকেল আর সুপারী গাছগুলো হাওয়ায় নড়ছে। আকাশের মেঘের ঘনঘটায় হয়ত ওরাও চিন্তায় আর ভয়ে কাঁপছে।
শাশুড়িমা ডাক দেন.."বৌমা,ডালটা মনে হয় সেদ্ধ হয়ে গেছে গ্যাসটা কি বন্ধ করে দেবো?"
" হ্যাঁ মা আসছি আমি,আকাশটা দেখেছেন?কেমন গুরুগম্ভীর। যেন রাগ বাড়ছেই।"
" ও কিছু হবেনা বৌমা,শেষে ঝড় বাংলাদেশের দিকেই চলে যাবে দেখো।"
" মা কারো যেন কোন ক্ষতি না হয়।ভালো থাক সব দেশের মানুষ। জানিনা আমার ছেলেটা কেমন আছে?"
নিঃশ্বাস ফেলে বুলবুল।
ওর শাশুড়িমা ও নিঃশ্বাস ফেলেন," সত্যি বৌমা দাদুভাই ছাড়া বাড়িটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। বড় অস্থির লাগছে মনটা। কে জানে কি খাচ্ছে কি করছে ছেলেটা?"
চোখের কোণটা চিকচিক করে বুলবুলের, মারণরোগের চিকিৎসা করে ছেলেটা একা একা হোটেলে আছে নিজেকে চার দেওয়ালের মাঝে বন্দী করে।
" হ্যাঁ মা সবাই ভালো থাক,আমরাও ভালো থাকি যেন।"
রান্না করে খেয়ে ফোনগুলো করে নেয় মাকে আর ছেলেকে। তবুও ভালো যে মা কদিন আগে ভাইয়ের কাছে এসেছে,দীঘার কাছে ওদের বাড়িতে থাকলে হয়ত চিন্তা আরো বাড়তো। তবুও আত্মীয়স্বজনের জন্য চিন্তা হয়,ওর ছোটবেলার বাড়িটা ঠিক থাকবে তো?
দুপুর থেকেই আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টি,আছড়ে পড়ছে ছাদে আর জানলার কাঁচে। বিকেল হবার আগেই শুরু হয় প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডব।
কাঁঠাল গাছটা ঝড়ে নড়তে থাকে।আমগাছের আমগুলো ধুপধাপ করে পড়ছে।অন্য সময় হলে বুলবুল দৌড়ে আসতো বাগানে কুড়িয়ে নিয়ে যেতো আম তবে আজ আর সে সাহস নেই। টিভির কানেকশন মাঝে মাঝেই কেটে গিয়ে অন্ধকার নামছে।টর্চ, মোমবাতি সব হাতের কাছে গুছিয়ে রাখে। আবার ছেলেকে ফোন করে," আমি ঠিক আছি মা,ভেবোনা। একটা ভিডিও তুলে দাওনা মা ঝড়ের। কতদিন গাছগুলো দেখিনা।"
বৃষ্টির ছাটে মোবাইল ভিজে যাচ্ছে তারমধ্যেই রেকর্ড করে বুলবুল। সকালে আমের পাশে ফান লিখে কত ছবি পোস্ট করেছে লোকে। তারা হয়ত এখন বুঝতে পারছে আমফান কি?
একটু বাদে অন্ধকার নেমে আসে চারদিকে তারমধ্যে চলছে ঝড়ের তান্ডব। আশীষ ডাকে," বুলবুল সব বন্ধ করে দাও।মনে হচ্ছে বাড়িঘর ভেঙে যাবে।"
শাশুড়িমা শঙ্খ বাজান জোরে জোরে।কড়কড় করে বিরাট আওয়াজ করে রাস্তার ওপারের রাধাচূড়া গাছটা মুচড়ে পড়লো। হলুদ ফুলে ভরা ছিলো গাছটা। একসময় ঐ গাছটার দিকে তাকিয়ে কত বসন্ত কেটে গেছে বুলবুলের।ঐ হলুদ ফুলগুলো যেন আনতো বসন্তের জয়রথ। কান্না পেলো বুলবুলের,গাছগুলো যেন বুক পেতে ঝড়ের ধাক্কা নিচ্ছে।
ওদিক থেকে একটা চিৎকার কানে এলো তখন ঝড়ের দাপটে কাঁপছে সারা বাড়ি। রাস্তার মোড়ের বুড়ো বট গাছটা উপড়ে পড়েছে।ইশ্ কত পুরোনো গাছটা! কত পাখি কিচমিচ করতো গাছটার চারপাশে,বাসা বেঁধেছে কত পাখি। আচ্ছা ওরা কোথায় গেলো? খোলা প্রকৃতির মাঝে বাসা বেঁধে বাঁচে ওরা।
" ওরা সব বুঝতে পারে দেখবে কোথাও একটা গিয়ে বেঁচে যাবে ওরা।" ওর বর বলে।
পাখির বাচ্চাদের সাথে সাথে নিজের ছেলেটার কথাও মনে হলো খুব। ফোনে টাওয়ার নেই। তাই আর কথা বলতে পারছেনা।
দরজার ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়ার তান্ডবে জল ঢুকছে।জানলা দিয়েও হু হু করে জল ঢুকছে।পুরোনো শাড়ি দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। ছাদে আর বাগানে তান্ডব চলছে।বারান্দায় গ্ৰীলের মাথার শেডটা উড়িয়ে নিয়ে গেলো ঝড়ে। চুপ করে বসে থাকে বুলবুল।অন্ধকারে কান পেতে শোনে কালভৈরবের প্রলয় নৃত্যের দাপট। হঠাৎই হৈ হৈ আওয়াজে জানলা ফাঁক করতে গিয়ে ভিজে যায়।বারান্দায় এসে দাঁড়ায় হাওয়ার মধ্যেই,বাড়ির সামনে জলে জল। তারমধ্যেই দৌড়চ্ছে কিছু লোক,ওদের বাড়ির সামনে কারেন্ট মেরেছে একটা ছেলেকে,কোথায় জলের ভেতরে তার ছিলো। একটু আগে একবার আলো এসেছিলো তখনই হয়েছে। বাঁচবে তো ছেলেটা?
এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর মনে হয় একটু শান্ত হলো প্রকৃতি।
" বৌমা,মনে হয় থামছে এবার। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবে কি ঐ দুপুরে যা আছে তা দিয়ে?"
" এখন খাওয়া গলা দিয়ে নামবেনা মা,কে জানে ছেলেটা খাবার পেলো কিনা?"
সমানে ফোনে চেষ্টা করে লাইন পায়..শোনে খাবারের দোকান বন্ধ। হোটেলের লোকেরা বলেছে রুটি তরকারি দিতে পারবে। একটু স্বস্তি হয় বুলবুলের।
ঝড় থামলো প্রায় চারঘন্টা তান্ডবের পর। আর যোগাযোগ করতে পারেনি কারো সাথে বুলবুল।মাকেও বলেছে না ভাবতে,সব ঠিক হয়ে যাবে নিশ্চয়,পৃথিবী শান্ত হবে।
সারারাত আধোঘুমে কেটে যায় বুলবুলের আকাশে তখন নতুন ভোরের আলোর ঝিকিমিকি। পৃথিবী শান্ত শুধু রয়ে গেছে ঝড়ের তান্ডবের চিহ্ন। আস্তে আস্তে বাগানে যায় বুলবুল গাছের ফুলগুলো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আমগুলো সব ঝড়ে পড়ে গেছে। হঠাৎই কানে আসে শব্দটা কিচিরমিচির.. তাকিয়ে দেখে দুটো শালিকের বাচ্চা হলুদ মুখ বার করে ডানা ঝাপটাচ্ছে..ওর মা ভয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চেঁচাচ্ছে করুণ স্বরে। একটা কার্টুনে আস্তে আস্তে রাখে ওদের ভাঙা বাসা সমেত।
সকাল থেকে জল,আলো কিছু নেই কোনরকমে একটা সেদ্ধভাত নামায়।সকাল থেকে ফোনে টাওয়ার নেই ছেলেটার খবর পায়নি। অপেক্ষায় অপেক্ষায় প্রায় আড়াইটে বেজেছে।কোন ফোন থেকেই ওকে পাওয়া যাচ্ছেনা। তিনটের সময় আর ধৈর্য্য রাখতে পারেনা বুলবুল, ভয় পায় আশীষও।ঠিক আছে তো ছেলেটা হোটেলের ঐ একলা ঘরে?
" তোরা যা করে হোক চলে যা,আমি ঠিক থাকবো। আর চিন্তা করতে পারছিনা।"
শাশুড়ির কথাটা বুকের ভেতর তোলপাড় করছে অনেকক্ষণ ধরে বুলবুলের মনে। শুধু বলতে পারছিলোনা।
গ্যারেজ থেকে গাড়িটা বের করে লম্বা পথ পাড়ি দেবার প্রস্তুতি নেয় আশীষ বুলবুল কে সাথে নিয়ে। মাস্কবন্দী দুই মা বাবা বুকভরা উৎকন্ঠা নিয়ে দেখতে দেখতে চললো এক বিধ্বংসী শহরের চিত্র মনকেমন নিয়ে।
এ যে বড় অচেনা শহর শুনেছে সতেরেশো সালের পর আঠেরোশো সালের মাঝামাঝি উঠেছিলো এমন বিধ্বংসী সাইক্লোন মারা গেছিলো বহু লোক,ভেসে গিয়েছিল জাহাজ,উড়ে গিয়েছিলো চার্চের ওপরের অংশ।
তাকিয়ে দেখে কোথাও গাছ নিজে মরে বাঁচিয়েছে মানুষের ঘর বাড়িকে আড়াল করে ঝড়কে, আবার কোথাও বা গাছ ভেঙে মরেছে লোক। কোথাও জল,কোথাও উপড়ে পড়া গাছের দল পার্কের লোহার প্রাচীর মুচড়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে।অনেক রাস্তা বন্ধ।যে বই মানুষকে আবেগে ভাসায় তা ভেসেছে রাস্তায় ঝড় জলের তোড়ে।
বৃষ্টি মাথায় করে গাড়ি এসে পৌঁছেছে প্রায় দেড়ঘন্টা বাদে ছেলের আস্তানার কাছে। ভয়ে ভয়ে এসে দাঁড়ায় বুলবুল, কি জানি ছেলেটা কেমন আছে? কি শুনবে?
কাউকে দেখেনা সামনে লকডাউনে আর ঝড়ে নিস্তব্ধতা,অবশেষে একজনকে দেখে জানতে চায় ছেলের খোঁজ। দশমিনিট বাদে ছেলেটা এসে সামনে দাঁড়ায়, বুক থেকে যেন পাথর নামে।
" বাড়ি ফিরে চল,বড় মন খারাপ কাল থেকে। জিনিস গুছিয়ে নে।"
কিছুক্ষণের অপেক্ষার পর সন্তানকে সাথে নিয়ে,একটু নিশ্চিন্তে ফিরে আসা ক্ষতবিক্ষত তিলোত্তমাকে দেখতে দেখতে একই পথ ধরে। শুধু মনে হলো অপরিচিত রোগের হানা,বিধ্বংসী ঝড়ের ছোবল আর কতদিন বাঁচবে মানুষ? থাকবে কি তাদের মনোবল?
আর গ্ৰামের দিকে যাদের ছিলো খড়ের চালটুকু সম্বল।তাদের পেটের ভাতের সাথে সাথে আশ্রয়টুকুও গেলো। ধ্বংসস্তূপে বসে শুধুই দীর্ঘশ্বাস ফেলা।
আসলে ঝড়ে গাছপালা আর বাড়িঘর ভাঙার সাথে সাথে বোধহয় ভাঙে মনও। অনেকদিন সেই ভাঙা মন বয়ে বেড়ায় এক দুঃসহ অভিজ্ঞতার স্মৃতি।
কথাটা মনে হলেও বাড়িতে এসে যখন টিভিতে দেখলো ঝড়খালির মানুষেরা নিজেরাই বাঁধের ভাঙন আটকাতে নেমে পড়েছে কোদাল হাতে তখন মনে হলো আমরা করবো জয় একদিন নিশ্চয়।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment