#পাগলা_হাওয়ার_বাদল_দিনে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
কুর্তা আর প্যান্ট পরে আয়নার সামনে গিয়ে চুলটা ভালো করে আটকে নেয় রাকা। তারপর স্কার্ফ দিয়ে চুলটা ভালো করে পেঁচিয়ে মাথাটা ঢেকে গলা দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়। ততক্ষণে মা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে.." হ্যাঁরে মুখে মাস্ক পরবি না?
তাহলে কিন্তু আমি যেতে দেবোনা একদম।"
" মা আমি কি বাচ্চা নাকি? মাস্ক না পরে বেরোবো? আর রাস্তাতে আমাকে আ্যলাউ করবে নাকি এভাবে?"
" মনে থাকলেই ভালো, আমার হয়েছে যত জ্বালা। ঘরে থাকবে তা নয় উনি চললেন বনের মোষ তাড়াতে।"
" এখন ঐ বনের মোষ তাড়ানোটাই আমার ধর্ম কর্ম হয়ে গেছে মা। এটাতেই আমি ভালো থাকি মা।"
ফোনটা বেজে ওঠে মিঠে সুরে ওদিক থেকে সুগত বলে.." তুই একদম রেডি তো? আমরা একটু বাদেই কিন্তু বেরোবো। জানিনা রাস্তায় কতটা সময় লাগবে ঠিকঠাক মত যেতে।"
" আমি একদম রেডি,সব জিনিস ঠিকঠাক মত গাড়িতে তুলেছিস তো?"
" ভাবিসনা,সব ঠিক আছে। আমরা আসছি কিছুক্ষণের মধ্যেই।"
গাড়ি ভর্তি ত্রাণের জিনিস নিয়ে হাইওয়ে দিয়ে ছুটছে ওরা কজন। ঝড়ে গ্ৰামগুলো ভেসে গেছে একদম,মানুষগুলো বিপর্যস্ত। তাই ওদের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা থেকে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস তুলে দেওয়া হবে মানুষের হাতে।
"চোখে সানগ্লাস,মুখে মাস্ক আর মাথায় স্কার্ফ তোকে তো একদম চেনাই যাচ্ছেনা রে পুরো ডাকু রানী লাগছে।"
" ইশ্ এভাবে বলিসনা! তবে এই সাজটাই ভালো রে।নিজেকে নিয়ে বেশি কিছু ভাবতে হয়না একদম। কোন মেকআপ দরকার হয়না।"
সুগতর চোখের মুগ্ধতা রাকার চোখ এড়ায়না। সুগত মনে মনে ভাবে তবুও ঐ সাহসী চোখটাতেই যে আজ চোখ রাখা যাচ্ছেনা। এই কথাটা অবশ্য এখন বলাও যাবেনা। বললেই একদম ক্ষেপে গিয়ে যা তা বলবে। ছমাস ধরে একসাথে কাজ করছে তবুও বলি বলি করে বলাই হয়নি কোনদিন।
কেন যেন মেয়েটা বিয়ের কথা শুনলেই চটে ঘটে লাল হয়ে যায়।
"মেয়ে মানেই কি বিয়ের জন্য জন্মেছে নাকি রে? তাছাড়া আমার বিয়ের আশা বা স্বপ্ন কোনটাই নেই।"
" নাহ্ চোখটা খোলা রাখলে পারতিস,চারদিকে কত কিছু দেখার সব কি চশমায় দেখা যায়?"
কোন পাত্তা না দিয়েই রাকা বলে," আমার কিন্তু খুব চিন্তা হচ্ছে রে,সব ঠিক ঠাক মত দিয়ে আবার ফেরত আসতে হবে। পারবো তো?"
" চাপ নিসনা,আছি তো আমরা সবাই ঠিক হয়ে যাবে সব।"
প্যাকেট ভর্তি আলু,চাল,ডাল,সোয়াবিন,তেলের প্যাকেট। এই ভাবেই সব প্যাকেট করা আছে। এছাড়া আলাদা করে নেওয়া হয়েছে মাস্ক আর স্যানেটারি ন্যাপকিন।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ওদেরকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে কত কষ্ট করে একেক জন এসেছে এ যেন মরার ওপর খাড়ার ঘা। চারিদিকে জলে জলময়। উপড়ে গেছে কত গাছ,ভেসে গেছে ধানজমি আর সব্জিরক্ষেত। ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বাড়িঘর গুলো।
সুগত,রাকা,মৈনাক,মধু আরো অনেকে এসেছে ওদের সাহায্য করতে। পর পর প্যাকেট গুলো তুলে দিচ্ছে ওদের হাতে সুগত আর রাকা। হঠাৎই রাকার চোখ পড়ে যায় সেই লোকটার দিকে। ঐ মুখটা আজও ভুলতে পারেনি।
একবার এক নাবালিকা মেয়ের বিয়েতে বাধা দিতে গিয়ে চরম হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিলো ওকে। তারপর আরো অনেকগুলো মেয়েকেই এইভাবে বাঁচিয়েছে ওরা। তখন ওর সবেই নতুন চাকরি পেয়েছে। চাকরির বাইরে সমাজসেবা মানে বনের মোষ তাড়ানোটা একটা নেশা। একদিন ফেরার পথে এই লোকটাই চড়াও হয়েছিলো ওর ওপর পাশ থেকে অ্যাসিড ঢালতে গেছিলো। সরে গেলেও কিছুটা ছিটকে পড়েছিলো ঘাড়ে গলায় অসহ্য যন্ত্রণায় কাঁতরে উঠেও ছুটেছিলো লোকটার পেছনে। তারপর কয়েকদিন চলেছিলো হসপিটালে যন্ত্রণা জ্বালা সঙ্গী করে বেঁচে থাকা।
ধরা পড়েছিলো লোকটা,সাজাও হয়েছিলো।
এখনো একটা গভীর দাগ রয়ে গেছে শরীরে,গলায় নেকলেস পরতে গেলে খুব লাগে।
একদিন মা চেষ্টা করেছিলো পরাতে।
" উঃ মা খোঁচা লাগে আমার! আমার গলাতে ওড়নাই এখন সাজে,মণিহার নাহি সাজে।"
লোকটাকে দেখে হঠাৎই সুগতর হাতটা চেপে ধরে রাকা..লোকটা ছাড়া পেয়ে গেছে তাহলে? আর এসেই হাত পেতেছে ওদেরই কাছে!
রাকার ইচ্ছে হলো মুখের ওড়নাটা খুলে ওর সামনাসামনি দাঁড়াতে। লোকটা বলেছিলো.. মুখটা পুড়িয়ে দেবো ভেবেছিলাম শুনেছিলো রাকা।
লোকটা ততক্ষণে হাত পেতেছে ওদের সামনে হঠাৎই চোখ পড়ে যায় রাকার লোকটার ডান আর বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো কাটা।
ওড়না আর চশমার ভেতর দিয়েই ভগবানের দেওয়া শাস্তি দেখলো রাকা। একটা অ্যাক্সিডেন্টে নাকি কাটা গেছে। অপরাধের শাস্তি দিয়েছেন ভগবানই।
অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দেয় রাকা সত্যিই বোধহয় পৃথিবীটা গোল তাই আবার দেখলো লোকটাকে । মনটা কেমন যেন তেঁতো হয়ে যায়।
*******************
রাকাকে মুড অফ করে থাকতে দেখে সুগত বললো.." কি হয়েছে রে?"
"পরে বলবো যেতে যেতে। শুধু এই লোকটাকে দেখে রাখ ভালো করে।"
ফেরার পথে গাড়ির পেছনে শুধুই রাকা আর সুগত।
" এবার তো মুখটা খোল,এত গরমে আছিস কি করে এমন ভাবে? আর ঐ লোকটা কে? কিছু বললিনা তো?"
মুখটা খুলে দেয় রাকা,ওর গোল গলা কুর্তার বাইরে দেখা যায় গলার কুচকোনো চামড়া।
বেশ কিছুদিন দেখছে রাকাকে তবে ওর গলা সবসময় জড়ানো থাকে স্কার্ফ দিয়ে।রঙ বেরঙের স্কার্ফ যত্নে জড়িয়ে নেয় রাকা ভুলে যেতে চায় ক্ষতটাকে অথবা ভাবে সত্যির পথে থাকবে আর অন্যায়ের বিরোধিতা করবে সারা জীবন।
রাকা ভেবেছিলো সুগত হয়তো চমকে যাবে বা মুখ ফিরিয়ে নেবে। কিন্তু দেখলো তখনো ওর মুখে মিষ্টি হাসিটা মাখানো।
আকাশ জুড়ে তখন মেঘের ঘনঘটা বেশ একটা ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে হয়তো বৃষ্টি নামবে একটু বাদেই।
" কি রে কি হলো? হাসছিস যে আমাকে দেখে?"
" হাসবো কেন,আমি তো সবটা গল্পটাই জানি আমার সাহসী ডাকুরানী বন্ধুর। আজ ঐ লোকটাকে দেখলাম তুই না বললেও বুঝতে পেরেছি এখন।ভগবান ওকে শাস্তি দিয়ে ভিখারির বেশে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তোরই সামনে। আজও কখনো কখনো বোধহয় ধর্মের অকেজো কলটা হঠাৎই হাওয়াতে নড়ে ওঠে।"
মুখের বাঁধনটা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মুক্তির শ্বাস নিচ্ছিলো রাকা। সুগত ওর দিকে তাকিয়ে আছে,বারবার প্রেমে পড়েছে আগে। আজ জাস্ট গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর সাহসী চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে।
পাগল পাগল মনে আজ প্রেমের হাওয়া বাইরেও তখন জোরে হাওয়া উঠেছে বাদলা মেঘকে উড়িয়ে নিতে। সুগত গাইছে.....' পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে,পাগল আমার মন মেতে ওঠে।'
চোখে দুষ্টুমি মাখিয়ে রাকা বলে.." তুই একটা সত্যিই পাগল। নাহলে এমন করে গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে কেউ গান গায়!"
" একদম ঠিক ডাকুরানী, আমি পাগল বাট তোর প্রেমে।"
পাগলা হাওয়া আর সবুজ প্রকৃতি কখন যে মনকে এতো সাহসী করে দিয়েছে ভাবতেই পারেনি সুগত।
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment