" কিন্তু ঠাম্মু এটা তো এই বাড়ির মেয়েদের জন্য,আমি এটা নিতে পারবোনা প্লিজ।
তাছাড়া আমার বন্ধুও এসেছে সাথে ও জানলে কি ভাববে?"
"কিচ্ছু হবেনা নতুন দিদিভাই।
বড়রা দিলে না করতে নেই।
হয়ত সবই মা দুগ্গার ইচ্ছে নাহলে আজ দশমীর দিনে তুমি এলে আমাদের কত আনন্দ দিলে।তুমিও তো আমার নতুন দিদিভাই তাইনা?
আমার দাদুভাইয়ের ভালো বন্ধু।
কাল যাবার আগে দেখা করে যেয়ো দিদি।
এখন যাও সবাই আনন্দ করো।"
ঠাম্মা বললেও মনটা কেমন যেন লাগে মুনিয়ার। কিছু কথার মানে বোঝার মত বয়েস ওরও হয়েছে। হয়ত ঠাম্মা মনে মনে স্বপ্ন সাজিয়ে ফেলেছেন যে ও ভবিষ্যতে হয়ত এই বাড়িতেই... না না আর ভাবতে পারেনা মুনিয়া। এখানে আসার আগেই প্রমোদের সাথে কথা হয়েছে,ও হয়তো সাত আটমাস বাদে ব্যাঙ্গালোরে আসতে পারে ট্রান্সফার নিয়ে।তখন তো ওর সাথেই হয়ত থাকতে হবে মুনিয়াকে। প্রমোদের ইচ্ছে আগে কিছুদিন একসাথে থাকবে মানে লিভ ইন তারপর বিয়ে।দুজনের দুজনকে জানা দরকার।
" পহেলে শাদী করলো ইয়ার,মুঝে লিভ ইন পসন্দ নেহি" মুনিয়া বলে।
প্রমোদ বলে" মুঝে বহত পসন্দ,একেলে হম একেলে তুম।''
ব্যাপারটা রোমান্টিক হলেও একটু যেন ভাবিয়েছে মুনিয়াকে। ওরা মানে বাড়িতে মা বাবা তেমন মানসিকতার কেউ নয়। রাণার কথাই তো বলতে পারেনি বাড়িতে। মা যা রাগী ছেলেদের সাথে আছে শুনলেই চ্যাঁচামেচি করবে।
তা ছাড়া রাণা তো মাত্র কিছুদিনের চেনা তাও আলাদা অফিস ওদের। জুনির বন্ধু ছিলো রাণা আর জুনি সার্টিফিকেট দেওয়ায় ওকে রেখেছে মানে একসাথে আছে ওরা। তবে ছেলেটা খারাপ নয় শুধু একটু গম্ভীর আর মিচকে পাজি। কথা কম বললে কি হবে মাথায় ভালো বুদ্ধি রাখে,মোটেও বোকা নয়। তবে বাড়ির লোকগুলো ভালো, হয়ত একটু বেশিই ভালো।
রাণার সত্যিই খুব অস্বস্তি হয় বাড়ির লোকজনের কাজকর্ম দেখে।ঠাম্মু কাউকে না বলে নিজের খেয়ালে যা করলো তা সত্যি বেশ লজ্জার।কে জানে মেয়েটা কি ভাবলো?
যাক রাত্রিটা ভালোই কাটলো ছাদে বসে গানের লড়াই করে। মুনিয়া নাচের সাথে সাথে গানেও বেশ ওস্তাদ একদম চুটিয়ে লড়ে গেলো। এখানে না এলে ওর গুণের এত পরিচয় পেতোই না।
আসলে ওখানে অফিস আর ল্যাপটপ নাহলে মোবাইলে টেক্সট করা উল্টো হয়ে শুয়ে এই তো দেখেছে এতদিন মানে এই চার পাঁচ মাস।
দুর্গা দুর্গে দুর্গতিনাশিনী গাইছে মুনিয়া, পুজো পুজো পরিবেশে একদম পারফেক্ট গান।
ভাই বোনেরা হাত তালি দিচ্ছে.."ওহ্ চলবে। তুমি যদি আগে আসতে তাহলে আমরা সবাই মিলে একটা ছোট নাটক করে ফেলতাম। খুব ভালো হত তাহলে।"
ডল বলছে," এবার কিছু হিন্দী হয়ে যাক।"
" বাংলাই তো বেশ ছিলো।" বলে রাণা।
মুনিয়া বলে,"তোর দাদা তো ইংরেজী গান শোনে,হঠাৎ বাংলা গান শোনার ইচ্ছে? হ্যাঁ হ্যাঁ
রাণা এবার তুই গাইবি ।"
বিজয়ার বাতাসে রাণার গাওয়া গান ভাসছে..' কতবার তোর আয়না ভেঙেচুরে ঘুরে তাকাই,আমার মতে তোর মত কেউ নেই।'
গানটা শুনে পুতুল মুনিয়ার হাতে চাপ দেয়। মুনিয়া পাত্তা না দিয়ে হৈ হৈ করে ওঠে ডলের সাথে..." কে সেই সিঙ্গেল পিস শুনি?"
" আরে এটা জাস্ট একটা গান ক দিয়ে। আমার ভালো লাগে গানটা।
এতো এক্সাইটেড হওয়ার কি আছে?
আমি কিন্তু খেলবোনা এইরকম লেগপুলিং করলে। "
"আচ্ছা বাবা আর হবেনা দাদা,চলো ক্যারি অন।" ডল বলে। ওর মনে হলো দাদার হয়ত খারাপ লাগতে পারে একসময় ওর তো একটা এক্স ছিলো। সত্যি এতো ভালো দাদাটা অথচ একটা ভালো বন্ধু পেলোনা।
সবাই মিলে বেশ জমাটি আড্ডা দিতে দিতেই বেশ অনেকটা রাত্রি হয়ে গেলো। রাতে শুয়ে মুনিয়ার ঘুম আসতে চাইলোনা,বারবার মনে হলো রূপোর কাজললতা নেওয়া ওর ঠিক হবেনা। কিন্তু কি করবে?ঠাম্মু বয়স্ক মানুষ ফেরত দিয়ে গেলে সবাই ওকে খারাপ ভাববে। তাই বলে ওদের ঠাকুরের মানতের কাজললতা নিয়ে ও বাড়ি চলে যাবে?
তাহলে কি এটা রাণাকে ফেরত দেবে ওখানে গিয়ে?
নাকি আন্টিকে দিয়ে যাবে?
ভাবতে ভাবতে মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়।
পুতুলটা বেশ আছে,কোন প্রেম করেনা তাই চাপও নেই বেশ ঘুমোচ্ছে।
ওদিকে রাণা রাতে মাকে বলে," এটা কি করলো মা ঠাম্মু?
ওকে কাজললতা দিলো কেন?
এই বাড়ির মেয়েদের কাছে থাকে এটা।
ও এই বাড়ির কে শুনি?
মা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো মনে হচ্ছে।"
" আচ্ছা আমাকে এত কথা বলছিস কেন বলতো?
আমি কি বলেছি দিতে?
আমি তো শুধু একটা শাড়িই কিনে রেখেছিলাম।
ওর বন্ধুকেও তো একটা দিলাম।
পুজোতে এসেছে।
তোর ঠাম্মু যে দেবে আমিও জানতাম না।
নিজের মনেই দিয়েছে।"
পরের দিন মুনিয়ার চলে যাবার কথা,থেকে যাবার কথা সবাই বললেও থাকার উপায় নেই কারণ মাকে অনেক ম্যানেজ করে এসেছে।আসলে মাও চায় মুনিয়া কদিন বাড়িতেই থাক। যদিও ডলের মুখটা ঝুলে গেছে। বাবা মোটামুটি বেশ কয়েক প্যাকেট মিষ্টি সাথে দিয়ে বললো.." মা বাবাকে খাইয়ো আর পুতুল তুমিও নিয়ে যেয়ো বাড়িতে,আমি সব আলাদা করে গুছিয়ে দিয়েছি একদম।"
সত্যিই মাঝে মাঝে রাণার খুব ভালো লাগে ভেবে যে ওর বাবা এত ভালো মানুষ। কত তাড়াতাড়ি মানুষকে আপন করে নিতে পারে।
মুনিয়াকে একটু যেন অন্যরকম লাগলো। হয়ত বাড়ি চলে যাচ্ছে তাই হবে হয়ত। মেয়েদের মনের খবর স্বয়ং ভগবান রাখতে পারেনা আর ও তো সামান্য মানুষ।
" দাদা,পুতুলদি একবার আয় সবাই একটা লাস্ট সেল্ফি হয়ে যাক।"
" হ্যাঁ তুলে দে তো,রাণার সাথে আমার ছবিই তোলা হয়নি।"
পুতুলের ছবি তোলার ঘটা দেখে একটু সরে দাঁড়ায় মুনিয়া। ওকে কেউ ডাকছেনা তো।
ডল আর পুতুল এবার ওকেও টানে।
কোনরকমে একটা ছবি তুলে মুনিয়া বলে..." আমি একটু ঠাম্মার সাথে দেখা করে আসি।"
ঘোরানো বারান্দা দিয়ে একাই মুনিয়া যায় ঠাম্মার ঘরের দিকে। একটু বাদেই চলে যেতে হবে তাই দেখা করে নেওয়া,উনি বলেছেন কাল।
"ঠাম্মা আমি আসি,দেখা করে গেলাম।তুমি বলেছিলে কাল।"
" আবার সামনের পুজোয় এসো নতুন দিদিভাই। আরো দুএকটা দিন হাতে নিয়ে এসো।"
ঘাড় নেড়ে হাসে মুনিয়া,মনে মনে ভাবে আর কোনদিনই হয়ত আসা হবেনা এখানে। সামনের পুজো হয়ত প্রমোদের সাথেই কাটবে ওর।
যাক ওদেরকে ট্রেনে তুলে দিয়ে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাণা। উঃ এত ফর্মালিটি আর হৈ হৈ শেষে একটু শান্তি পাওয়া যাবে এবার।লক্ষ্মীপুজোর পরদিন তো ওকেও চলে যেতে হবে। একবছর বাদে অনেক করে ম্যানেজ করে এসেছে বাড়িতে। যাক এবার নো টেনশন বাড়িতে একটু নিজের মত করে থাকতে পারবে। ঘরে এসে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয় রাণা।
মা ঘরে কখন এসেছে বুঝতেই পারেনি।
মা এসে কপালে হাত রাখে ওর.." কি রে তোর শরীর খারাপ?"
" না মা একটু ক্লান্ত লাগছে তাই শুয়ে আছি।"
" শোন মুনিয়ার একটা ব্যাপার আমার একটুও ভালো লাগেনি। মনটা খারাপও লাগছে,যদিও কিছু বলিনি। আর কি বা বলতাম।
আসলে আমরা সরল সাধারণ মানুষ চট করেই মানুষকে ভালোবেসে ফেলি।"
এবার একটু চাপ লাগে রাণার কি হলো আবার কে জানে? মা সবসময় খুবই দায়িত্বশীল চারদিকে নজর মায়ের। মুনিয়া কি কিছু বলেছে মাকে?
" কি হয়েছে বলো প্লিজ,আমি কাল রাতেই বলেছিলাম বাড়াবাড়ি করছো তোমরা।
সবাই সব কিছুর যোগ্য নয়।
বাবাও পারে,আর তোমরাই বা কম কি?"
মা আলমারি খুলেছে তখন, একটু বাদেই রাণার হাতে লাল ভেলভেটের বটুয়াটা দেয়। আশ্চর্য লাগে রাণার ওটাই তো কাল মুনিয়াকে দিয়েছে ঠাম্মু। তাহলে মা পেলো কোথায়? নিশ্চয় ফেলে গেছে। যা কেয়ারলেস মেয়ে মা তো জানেনা। বাথরুমে ঘড়ি খুলে রাখে কখনো কানের দুল,কখনো বা আঙটি।যাচ্ছেতাই একেবারে।
" ওহ্ ফেলে গেছে তাহলে?
আমি আগেই জানতাম। ও ভীষণ কেয়ারলেস মা কোন দায়িত্ব ওর নেই। সবাই কি সব জিনিসের মর্ম বোঝে?যাক ভালো হয়েছে তুলে রাখো।যদি মনে পড়ে তো ফোন করবে। নাহলে রেখে দাও এটা। তবে আমাকে প্লিজ বোলোনা।এটা নিয়ে গিয়ে মহারাণীকে দিতে। আমি পারবোনা।"
************
" নাহ্ ফেলে যায়নি,ফেরত দিয়ে গেছে।"
" মানে?"
" বলেছে এটা নিতে পারবেনা ও।
তাই আমি যেন তোর ঠাম্মাকে বুঝিয়ে বলি একটু। আমি বললাম তুমিই তো দিতে পারতে।"
তাতে বললো,"আমার খুব মানসিক চাপ হচ্ছিলো উনি যদি আমাকে খারাপ ভাবেন।
তুমি বুঝিয়ে দিয়ো।"
খুব রাগ হয় রাণার " ভালো হয়েছে,বাড়াবাড়ি করো এবার বোঝো ফেরত দিয়ে গেছে।
ইস্ কতটা ইনসাল্টিং ভাবো তো?
আমারই তো লজ্জা করছে আবার রাগও হচ্ছে। ওর সাথে আমাকে থাকতে হবে আবার, কথা বলতে হবে ওকে খাবার দিতে হবে।"
রাণার রাগী মুখটা দেখে বোধহয় ওর মাও একটু ভয় পায়।ছেলেপুলে বড় হলে যা হয় তখন সমঝে চলতে হয় মাকেও।
" তাই তো তোকে বলে রাখলাম।"
" কি লাভ হলো বলে?
তুমি ওটা রেখে দাও তোমার কাছে, ঠাম্মাকে কিছু বলতে হবেনা।"
" সে আমি দেখছি তুই ভাবিসনা।"...মা ওর মাথায় হাত রাখে।
মনটা অস্থির হয় রাণারও।যত্তসব ফালতু ঝামেলা করে ঠাম্মাটা। কতটা ছোট হয়ে গেলো রাণা সেটা কেউ ভাবলোনা।
ট্রেনে বসে হাল্কা লাগে জানলার ঠান্ডা হাওয়াতে মুনিয়ারও। সময়ের কাজ সময়ে করেছে সেই ভালো। আর হয়ত কোনদিনই আসবেনা এখানে।রাণার বাড়ির লোকেরা খুবই ভালো তবুও ও কাজললতা নিতে পারেনি ওরা যা ভাবেন ভাববেন কিন্তু একটা এমন উপহার ও কিছুতেই নিতে পারবেনা। ওর মা জানলে খুব রাগ করবে।আর প্রমোদ যদি কিছু জানতে পারে তাহলে হয়েছে।প্রমোদ এখন পাটনায়,বলেছিলো আসবে কিন্তু ছুটি না পাওয়ায় আসা হয়নি। অনেকদিন দেখা হয়নি ওদের। যা দিনে একবার কথা হয় রাতে তাও গতকাল দুএকটা টেক্সট ছাড়া আর কোন কথা হয়নি।
কাজললতার মানে মুনিয়া বোঝে এটা সাদা বাংলায় ওকে আশীর্বাদ করার মত ব্যাপার। ঐ বাড়ির মেয়েদের কাছে যেটা থাকে সেটা ও নেবে কেন হঠাৎ। রাণা ওর কে?
পরক্ষণেই মনে হয় আন্টির মুখটার কথা,ও।ফেরত দেওয়াতে আন্টির মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে গিয়েছিলো। খারাপ লাগছিলো দেখে।
ট্রেনে হকার উঠেছে...' ঝালমুড়ি চাই।'
পুতুল গুঁতো দেয় " কি রে খাবি নাকি? তখন থেকে চুপ করে বসে আছিস।কি ভাবছিস বলতো?
কাজললতার ব্যাপারটা পুতুল জানেনা,ইচ্ছে করেই বলেনি মুনিয়া।
তাই বলে "কিছুনা রে এই বাইরে দেখছি আর ভাবছি।"
"রাণাদের কথা? ওদের বাড়িটা মানে বাড়ির লোকজন খুব ভালো তাইনা?
কলকাতার বাইরের লোকজন একটু আলাদা এখনো অনেক সরলতা ওদের মধ্যে।
বাড়িতে কি সুন্দর দুর্গা পুজো হয়।
ইশ্ এমন একটা শ্বশুরবাড়িতে যদি তোর বিয়ে হত!"
" পুতুল ও আমার বন্ধু,প্রেমিক নয়।
আর বিয়ের গল্প তুই ভুলে যা।
তুই বরং বিয়ে করে নে রাণাকে।"
" ধুর নায়িকাকে ছেড়ে পার্শ্বচরিত্রের সাথে বিয়ে।
ছাড় তুই প্রমোদকেই বিয়ে কর।
রাণারও নিশ্চয় অন্য কেউ আছে।"
তা থাকতেই পারে হয়ত।তবে মনে হয়না মুনিয়ার। কই কথা বলতে তো শোনেনা কারো সাথে।গার্লফ্রেন্ড থাকলে নিশ্চয় গল্প করতো ওতো ডাইনিংয়ে শোয় তাই বুঝতেই পারতো।
আবার অন্যমনস্ক হয় মুনিয়া মনে মনে ভাবে পরে ওরা যা কথা বলে বলুক ওর সম্বন্ধে।ও নিজের দিক দিয়ে ঠিক আছে তাই ঠিক। আর তো আসবেনা কোনদিনই এখানে। আর রাণাও ফ্ল্যাট ছেড়ে গেলে যাবে।
একদিন তো ওকেই বলতে হত," তুই এবার অন্য বাড়ি দেখে নে।"
প্রমোদের কথাটা অবশ্য ওভাবে বলতে পারতোনা,বলতো হয়ত একটু অসুবিধা আছে। তবুও বলতে খারাপই লাগতো।যাক পরে খারাপ হওয়ার চেয়ে আগে খারাপ হওয়াই ভালো।
প্রমোদ কলকাতায় হস্টেলে থাকতো ওর বাবা মা পাটনায়।আজ পর্যন্ত প্রমোদের বাড়ির লোকের সাথে আলাপই হলোনা। যতবারই বলেছে ততবার বলেছে.." উনলোগকো মিলনে তো পাটনা যেতে হবে। আচ্ছা বাবা মাম্মা পাপা কলকাত্তা আসবে একদম তোমাদের বাড়িতে শাদীর বাত করতে।"
প্রমোদ কখনো ওদের ছবি ফেসবুক বা হোয়াটস আ্যপ স্ট্যাটাস দেয়না।বললে বলে.." হাজার এক আদমী আছে আমার বাড়ির ওরা সারাদিন পিএনপিসি করতে থাকে তাই দিইনা।আর তুম ভি দিয়োনা,কি দরকার সব বাত পাবলিক করার।"
কথাটা খারাপ নয়,এইজন্য প্রমোদকে ভালো লাগে মুনিয়ার। আবেগ থাকলেও খুব নিয়ন্ত্রিত। একদিক দিয়ে ভালো। ওর মা জানে কিছুটা প্রমোদের কথা.." মুনিয়া ওরা অনেক বড়লোক তারপর অবাঙালী।তুই পারবি তো মানিয়ে নিতে?"
" মা আমার চাকরি তো আছে,আমি কতদিনই বা থাকবো ওদের বাড়িতে?"
" তবুও ভেবে নিস একবার ভালো করে।"
প্রমোদকে কলকাতা চেনাতে চেনাতেই প্রেম হয়ে গিয়েছিলো।লম্বা ফর্সা ঝাঁকড়া চুল আর হাত ভর্তি ট্যাটু করা প্রমোদের পাশে যখন মুনিয়া দাঁড়াতো তখন বন্ধুরা বলতো.." টল হ্যান্ডসাম শর্মাজির সাথে প্রেটি মৌবনী একদম পারফেক্ট ম্যাচ ।"
প্রমোদ শর্মার সাথে গঙ্গার জলের জোয়ার ভাঁটা দেখতে অথবা ভিক্টোরিয়ার সবুজে হারিয়ে যেতে যেতে কখন যে প্রেমটা হয়ে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেনি। প্রথমে শুধু ভালোলাগা আর মাঝে মাঝে ঝগড়া তারপর প্রেম। দুটো বছর এইভাবেই বেশ কেটে গেছিলো তারপর প্রমোদ পাটনা চলে গেলে একটা চাকরি নিয়ে,বললো এমবিএ র প্রস্তুতি নেবে চাকরির পাশাপাশি। আর মুনিয়া ব্যাঙ্গালোরে। মাঝে দুবার অবশ্য দেখা হয়েছে,মুনিয়ার মন তখন ঢেউ ভাঙা মেঘের মত জমে থাকা আবেগ অনুভূতি উজাড় করে দেওয়া।
পুতুলটা ঝিমোচ্ছে,ট্রেনটা বেশ ফাঁকা দেখতে দেখতে ট্রেন প্রায় শিয়ালদার কাছাকাছি।এর মধ্যে রাণাদের বাড়ি থেকে কোন ফোন আসেনি। একটু মন কেমন করে মুনিয়ার, তা না করুক ও বাড়িতে গিয়ে আঙ্কেলকে ফোন করে দেবে এটা একটা ভদ্রতা। আর রাণাকে ডলকে মেসেজ করে দিতে হবে।
ফোনটা রিং হচ্ছে নিশ্চয় মা..ফোন খুলে দেখে ডল.." পৌঁছে গেছো মুনিয়াদি?
মিস্ ইউ গো।"
" না রে পৌঁছাতে পারিনি এখনো। আমি পৌঁছে টেক্সট করবো।আমিও তোদের মিস্ করছি।"
বাড়িতে পৌঁছে একটু ক্লান্ত লাগে মুনিয়ার ,মায়ের কাছে মিষ্টিগুলো দেয়।
তাড়াতাড়ি একটা ফোন করে," আঙ্কেল আমি পৌঁছে গেছি আন্টিকে বোলো।"
" তোমার আন্টি কাজ করছে আমি বলে দেবো।"
মুনিয়ার কেন যেন মনে হলো আন্টি হয়ত ওর সাথে কথা বলতে চাইলোনা। যাক আর কি করা যাবে?
হয়ত দোষটা ওদেরই তবুও কেন যেন রাণার মায়ের কথা বলতে ইচ্ছে করলোনা। একটা রূপোর কাজললতা একজন বয়স্ক মানুষ হাতে করে দিয়েছেন।নিলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত! ওরা সবাই জানে যে ও রাণার প্রেমিকা নয়। তবে মনের খবর কে আর রাখে,ওদের দুটিকে একসাথে দেখে খুব মনে হচ্ছিলো রাণার মা শান্তার রাণার যদি এমন সুন্দর ছটফটে একটা বৌ হতো। আসলে ওদের সুখে থাকা নিয়েই কথা। তবে মুনিয়ার কাজললতা ফেরত দেওয়া বুঝিয়ে দিলো মুনিয়ার মনের কথা।
বিকেলে শাশুড়ির ঘরের দিকে যায় শান্তা,ও নিজেও চায়না সবাই জানুক ব্যাপারটা এমনিতেই একটা পুরোনো পাড়াতে থাকে ওরা।
" মা, আসছি একটু। বাবা কি ঘুমোচ্ছেন?"
" তোমার বাবাকে একটু বাইরে নিয়ে গেলো গণেশ হাঁটাতে।
"এসো বৌমা।
কিছু বলবে?"
শান্তা আঁচলের তলা থেকে লাল ভেলভেটের ব্যাগটা বের করে।
" এটা রেখে দিন মা যত্ন করে তুলে। মুনিয়া যাবার সময় এটা দিয়ে গেছে। ও বললো।এটা নিতে পারবেনা। মা এটা না দিলেই পারতেন। আমার খুব খারাপ লাগছে। আমরা মনে হয় ছোট হয়ে গেলাম। আপনার সম্মান নষ্ট হলো।"
হাসেন রাণার ঠাম্মা," তা না নিয়েছে না নিয়েছে,তুমি রেখে দাও বড় বৌমা।
রাণা এ বাড়ির প্রথম ছেলে, ওর বৌ এলে দিয়ো।জানিনা আমি তখন থাকবো কিনা?"
" আপনি থাকবেন মা,আপনার নাতবৌকে বরণ আপনাকেই করতে হবে।"
" কি জানি বৌমা,তোমাদের বাবার শরীর ভালোনা।
সেদিন ওদের নাচ দেখে বারবার মনে হচ্ছিলো যেন শিব পার্বতীকে দেখলাম সামনে।"
শাশুড়িমা আগের দিনের মানুষ ঠাকুর বিশ্বাসী তাই হয়ত মনে বাসা বেঁধেছে কিছু। বুঝতে পারে শান্তা। তাই বলে...
" মা যুগ পাল্টেছে,আপনার নাতনিদের দেখছেননা একটা কথা বললে ফোঁস করে ওঠে। এখনকার মেয়েরা আর কাজললতা থেকে কাজল পরেনা।
ওদের চোখে অনেক স্বপ্ন এখন,ওরা যাচাই করে নেয় সবকিছু।
ওরা এখন নামী কোম্পানির পেন্সিল কাজল পরে।"
হাসলেন শাশুড়িমা,শান্তা অবাক হয় দেখে।
" মা হাসছেন কেন?"
" কি জানি বৌমা আজকাল ছানি পড়ে যাওয়া চোখেও কি সব স্বপ্ন দেখি তাই মনে হয়েছিলো নতুন দিদিভাই হয়ত যত্নে কাজল টানবে ডাগর চোখে ঐ কাজললতা থেকেই।
মন খারাপ কোরনা বৌমা সবই মায়ের ইচ্ছে।"
মায়ের কাছ থেকে শোনার পর সারাদিন মাথাটা কেমন চাপ চাপ লেগেছে রাণার। তার মধ্যেই মেসেজ করেছে মুনিয়া ভালো ভাবে পৌঁছে গেছে অন্য সময় হলে হয়ত ফোন করতো সেদিন ওকে করে ছেড়ে দিলো। এমনিতেই খুব দরকার না হলে ফোন করেনা রাণা কখনোই মুনিয়াকে।
মা কফি দেয়,কফিটা খেয়ে একটু ভালো লাগে।
" মা এখানে বসবে একটু আমার কাছে?তুমি ঠাম্মার কাছে গেছিলে?"
" হ্যাঁ গেছিলাম রে, কথা বললাম।"
মনের ভেতর একটা চাপা কষ্ট হচ্ছে রাণার, কেন বুঝতে পারেনা।
" কি বললো ঠাম্মা?কষ্ট পেলো নিশ্চয়? অবশ্য দোষ তো ঠাম্মারই,কি আর করা যাবে?"
মা হাসলেন," ঠাম্মা হাসলেন,মনে হলো যেন কিছুই হয়নি।বললেন ওটা রেখে দিতে তোর বৌয়ের জন্য। যখন তোর বিয়ে হবে তখন যদি উনি না থাকেন।"
" তোমরাও পারো সারাক্ষণ বিয়ের কথা শুধু।
ছাড়ো তো,আমি বিয়ে করবোনা মা।
এই বেশ ভালো আছি,তাছাড়া কত আর পাই যে বৌকে খাওয়াবো ভালোভাবে রাখতে পারবো। এখনকার মেয়েরা তো তোমাদের মত নয়।"
" মেয়েরা চিরকাল মেয়েদের মতই হয়,ভালোবাসবি তাতেই অনেক ঘাটতি ঢাকা পড়ে যাবে।"
" শুধু ভালোবাসা এখন কোন কাজের নয় মা।
এখন পার আ্যনাম কত স্যালারি,ফ্যামেলি কেমন?
বিদেশে যেতে পারবে কিনা সব দেখে মেয়েরা।"
"কত খবর রাখিস বাবু মেয়েদের।
তাইতো বলি বিয়ের কথা।
তা তো হবেই বাবা, যুগ পাল্টাচ্ছে।
আমাদের মত নাকি সারাজীবন ঘরকন্না করে কাটিয়ে দিলাম।
এখনো শাশুড়ির মুখের ওপর কথা বলতে পারিনা।"
রাণা হাসে..." ডিগনিফায়েড পোস্ট, বড় বৌমা অফ রায়চৌধুরী ফ্যামেলি।
মাথায় লম্বা কোঁকড়া চুল,কপালে লাল সিঁদুরের টিপ পরনে শান্তিপুরের তাঁতে আমার মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। যার ত্রিনয়নের সিগন্যালে বাঁধা আছি আমরা।"
অনেকদিন বাদে আবার মা ছেলের হাসির আওয়াজে ছুটে আসে ডল আর ওর বাবা।
" দেখেছিস,ডলু আমাদের বাদ দিয়ে কেমন দুজনে হেসে গড়িয়ে পড়ছে।"
" বাবা তুমি তো জানোই মা সবসময় দাদাকে বেশি ভালোবাসে।আর আমি যেন ভেসে এসেছি গঙ্গায়।"
" কেন আমি তোকে ভালোবাসিনা বুঝি?
এটা কিন্তু ঠিক নয় বাপ বেটিতে দল পাকানো।"
হাসিতে গল্পে সন্ধ্যেটা কাটলো বেশ মুনিয়ার কথাও হলো। বাবা মাকে বললো এমন একটা মেয়ে যদি রাণার বৌ হত বেশ হত।
" বাবা ঐ জন্যেই বুঝি ওকে এত মিষ্টি খাওয়ালে? ফালতু খরচ করলে গো।
আরে ওর বন্ধু আছে।"
ডল লাফ দিয়ে ছুটে আসে দাদার কাছে," তাই নাকি রে? কে রে বলনা? ফেসবুকে ছবি আছে?"
" সব খবর ফেসবুকে থাকেনা বুদ্ধুরাম। "
" ধুর তাহলে বাজে কথা,মা সব ওর বানানো।"
শান্তা একটু গম্ভীর হয় এবার..." ছাড় তো সবসময় বিয়ে বিয়ে।ডল এবার কিন্তু ভালো করে পড়তে হবে,পুজো গেলো।"
*****************
জামা কাপড় ছেড়ে একদম নিজের ঘরোয়া ইউনিফর্মে মুনিয়া..." ও মা এক কাপ কফি দাওনা,বাবাও তো অনেকক্ষণ ধরে চা চাইছে।"
'' দিচ্ছি বাবা দাঁড়া,আমি চা কফি করতেই এসেছি।"
মুনিয়ার বাবা নিজের কাজ করে খুব একটা সময় পাননা। এখনো বেশ পরিশ্রম করতে হয়। তবে চায়ের আড্ডায় থাকলে আর খাবার টেবিলে গল্প হয়। বাবা বললো....
"তোর ঐ অফিস কলিগের বাড়িতে কারা আছে রে? অনেক মিষ্টি পাঠিয়েছে তো।"
" সে এক চাঁদের হাট বাবা প্রচুর লোকজন।বড় বাড়ি,বাগান,পুকুর,দুর্গামন্ডপ। আমাদের মত থ্রী বেডরুম ফ্ল্যাট নয়।সবাই খুব ভালো। ভীষণ আনন্দ হয়েছে।"
" মানুষ ভালো তা বুঝেছি আগেই,নাহলে এত কিছু কেউ পাঠায়?"
রাণাকে অফিস কলিগ বলেই চালিয়েছে মুনিয়া।
" যাক,আর বাইরে যাবার নাম করবিনা।এই কদিন একটু বিশ্রাম নে বাড়িতে।"
" আচ্ছা বাবা আর কোথাও যাবোনা।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। ডল অনেকগুলো ছবি পাঠিয়েছে হোয়াটস আ্যপে। আবার একবার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। ইশ্ সিঁদুরের ছাপ্পাওয়ালা ছবিটা কেমন যেন বোকা বোকা দেখতে হয়েছে।তবুও বারবার ছবিটা দেখে মুনিয়া মুখে গালে লাল সিঁদুরের চুমু,গাল দুটো লাল লাল,পাশে রাণা কপালে টিপ,গালে লম্বা রেখা সিঁদুরের। ইশ্ কেমন যেন বৌ বৌ লাগছে।
সিঁথিতে লাল আবির দেওয়ার অনুভূতি অবশ্য আজও ভুলতে পারেনা মৌবনী মানে মুনিয়া। কলেজ থেকে ফিরবে তখন।গেটের বাইরে সবে বের হয়েছে এমন সময় পেছন থেকে হঠাৎই দুটো হাত ওর মাথায় লাল আবির মাখিয়েছিলো একদম সিঁথি ভরে।তখন প্রমোদকে সবে একটু একটু ভালো লাগছে।অল্প ছোঁয়া,একটু কথা,টুকরো গান আর টুকরো অনুভূতি তার সাথে আবিরের ছোঁয়া।একদম ওকে জড়িয়ে ধরে তারপর আবির মাখিয়েছিলো মুখে। বন্ধুরা আওয়াজ দিয়েছিলো শর্মাজি, ক্যায়া বাত।
লজ্জায়, ভালোলাগায় লাল হয়ে গিয়েছিলো মুনিয়া।
" এটা ঠিক নয়,আমি ভূত সেজে বাড়ি কি করে যাবো এবার?"
শর্মাজি হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছিলো "হোলি হ্যায় আজ হোলি হ্যায়।"
তারপর নিজেই ক্যাব বুক করে দিয়েছিলো ওরা চার বন্ধু তাতেই ফিরেছিলো। ঘরে এসে আয়নার সামনে লাল রঙের সিঁথিতে নিজেকে দেখেছিলো বারবার।মা ভীষণ বকা দিয়েছিলো বলেছিলো এক্ষুণি শ্যাম্পু কর। ইশ্ লাল আবির কেউ মাখায়?
পরের বছরও লাল আবির মেখে সেল্ফি তুলেছিলো প্রমোদের সাথে। তবে প্রথম সব কিছুই বোধহয় আলাদা অনুভূতি দেয়। যা ভোলা যায়না কোনদিন।
রাণার সাথে যেমন পাল্লা দিয়ে ধুনুচি নাচ নাচলো এবার।
একটা সময় দুজনেই ডান হাতে ধুনুচি ধরে হাতে হাত রেখে নেচেছিলো। নাচের নেশায় বুঝতেই পারেনি কখন হাত ধরেছে ওরা।
তবে ধুনুচি নাচের ভিডিওটা দারুণ হয়েছে।আঙ্কেল নাকি করেছে।
ডল বলেছে," এটা বোধহয় সবচেয়ে ভালো মুনিয়াদি।ঢাকের বোল,মায়ের ছলছল চোখ আর তার সাথে ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ,ঠাকুর যাবে বিসর্জন। ঠাম্মুকে তো ল্যাপটপে দেখাতে হলো।"
রাণাকে বেশ লাগছে কোমরে লাল ওড়না জড়িয়ে। হাসে মনে মনে মুনিয়া বাংলা সিনেমার হিরো বনেদি বাড়ির পুজোতে নাচছে সাথে আ্যক্ট্রেসরা।কাকে ছেড়ে কাকে দেখবে।রাণার প্রমোদের মত জিমখানায় তৈরি শরীর না হলেও সুপুরুষ বলা চলে। শ্যামলা,লম্বা,চোখে চশমা শুধু মুখটা একটু সিরিয়াস।
পুতুল অনেকগুলো ছবি ফেসবুকে দিয়েছে।মুনিয়া বলে দিয়েছে ওকে যেন ট্যাগ না করে।
" এত ভালো সব ছবি উঠেছে,তাও দিবিনা?"
" না দেবোনা,জানিস তো।"
প্রেম করলে এই এক জ্বালা,তবুও ভালো বয়ফ্রেন্ড দূরে থাকে।
*******************
লক্ষ্মীপুজোর নাড়ু মুড়কি খাওয়া শুরু হতে না হতেই রাণার যাওয়ার ঘন্টা বাজলো। ফেরাটা ট্রেনে যাতে বাড়ি থেকে একগাদা ভালো মন্দ নিয়ে ফিরতে পারে। মায়ের মোটামুটি ব্যাগ গোছানো কতদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে।
বাড়ির সবার মন খারাপ... মায়ের মুখটা আবার ভার,চোখ ছলছল। বোনটা ঘ্যানঘ্যান করছে।
" দাদা এই বেশ ভালো ছিলাম সবাই,আবার চিন্তা হবে তোর জন্য।"
" কিছু চিন্তা নেই,প্রতিদিন ফোন করবো।তবে তুই মন দিয়ে পড়বি।"
ঠাম্মা,কাকা,কাকিমা ভাই সবার গলাতেই এক কথা মিস্ ইউ,আবার এসো তাড়াতাড়ি।
" এবার তোমরাও এসো আমার ওখানে,আমরা এবার উটি ঘুরে আসবো। আমারও উটি যাওয়া হয়নি। খুব মজা হবে তাহলে।"
সবাই চলে গেলে রাণার মা হাত রাখে ওর কাঁধে.." এখনি নয় বাবা যা বলছি মন দিয়ে শোন ধীরে ধীরে একটা আলাদা কিছু ভাব। তুই আলাদা ফ্ল্যাট নিলে আমরা সেখানে যাবো। এখনি নয় কিন্তু বাবা,মুনিয়া তাহলে ভাববে আমরা রাগ করেছি।"
রাণা হাসে," আমি জানি মা, এখনি আমি কোথাও যাবোনা। তাছাড়া ওর তো দোষ নেই মা,তোমরাই ওকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছো।"
" হয়ত ঠিক বলেছিস। একদিন ফোনে কথা বলে নেবো।সেদিন আমাকে খুঁজছিলো।"
**********
কলকাতা থেকেই ট্রেন ধরবে রাণা তেমনি টিকিট কাটা তবে বাড়ির কাউকে আসতে দেয়নি সাথে। নিজেই একটু আগে এসে হাওড়াতে অপেক্ষা করেছে।তারপর ট্রেন দিলে উঠে বসেছে,ওহ্ রাজ্যের জিনিস দিয়েছে মা। এটা খাবি,ওটা খাবি সব ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে।
সাইড লোয়ার পেয়ে ভালোই হয়েছে।
মালপত্র রেখে গুছিয়ে বসেছে তখনো কিছুক্ষণ বাকি,মাকে জানিয়ে দিয়েছে সব ঠিক হ্যাঁয়।
যাক নিশ্চিন্ত এবার।কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকা গেলোনা।
একটা পরিচিত গলা শুনতে পায়," হ্যাঁ এটাই তো বি ওয়ান..এর পরেরটা হবে।"
রাণা দেখে অবাক হয়ে যায়...তুই!
"সারপ্রাইজ,শুধু আমি না বাবাও আছে সাথে। "
রাণা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করে।
" তুমি রাণা,অনেক শুনেছি তোমার কথা।একই অফিসে আছো তোমরা। তা বেশ।তাই চলে এলাম ওর সাথে।"
চোখ কপালে ওঠে রাণার বহুত মিথ্যেবাদী তো,কেমন ওকে অফিস কলিগ বানিয়েছে।
" শোননা আমার একটা কাজ করবি প্লিজ... এই ব্যাগটা একটু নিয়ে যাবি আসলে এগুলো তো ফ্লাইটে আ্যলাউ করবেনা। আমার দিদুর হাতে বানানো সব ছাড়তেও পারছিনা। আর আমি তো আরো চারদিন বাদে যাবো। তোর কাছে রাখিস আমি গিয়ে নেবো।"
রাণা ওর দিকে তাকায় চোখে আর মুখে মুচকি হাসি মাখানো মুনিয়ার। সত্যিই কি দু কান কাটা মেয়ে বাবা! একদম সুযোগ সন্ধানী।আর রাণা যাতে কিছু বলতে না পারে তাই বাবাকে সাথে করে নিয়ে এসেছে।
রাগ হলেও কিছু না বলে বললো," ওকে,রেখে দে।"
মুনিয়া ব্যাগটা সীটের তলায় রেখে দেয়।
" আর শোন,এটা তোর জন্য।"
" এটা কি? গরম তো? কোথায় রাখবো?"
" গরম মানে খাবার,আপাততঃ মাথায় রাখ পরে পেটে দিয়ে দিস। আরে কলকাতার সেই ইয়ে দোকানটার ইয়ে।যেখানে মাঝে মাঝেই যেতিস গন্ধ শুকতে। আরে এটা এখানকার জিনিস, কৃষ্ণনগরে পাওয়া যায়না এটা।"
তারমানে আবার ঘুষও দিলো।
" মা খাবার দিয়ে দিয়েছে তো।"
ঠিক আছে পেটে জায়গা ধরলে খাস নাহলে খাসনা।"
মুনিয়ার বাবা মেয়ের কান্ড কারখানা দেখে মুচকি হাসেন ওহ্ কিছু কথা বলতে পারে।
ততক্ষণে ট্রেনের বাঁশী বাজে। রাণা দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।ওরা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, মুনিয়ার হলুদ বাঁধনি ওড়নাটা হাওয়ায় উড়ছে।ট্রেন ছেড়ে দেয়,ওরাও চলে যাচ্ছে রাণা তখনো দাঁড়িয়ে, হঠাৎ পেছন ফেরে মুনিয়া দেখে রাণা তখনো দরজায় দাঁড়িয়ে ও হাত নাড়ে।
*************
কবে মুনিয়াকে গল্প করেছিলো বিরিয়ানি
আর চিকেন চাপ খেতে চিৎপুরে যেতো।সেটা ঠিক মনে রেখেছে।পারেও মেয়েটা স্কুটি নিয়ে এতসব নিয়ে পৌঁছে গেছে।তবে একটা ব্যাগ বাড়লো। বিরিয়ানি গিললো গোগ্ৰাসে রাণা,মায়ের লুচিগুলো চারটে আগে খেয়ে নিয়েছিলো।বাকিটা সকালে খাবে।সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিলো। দারুণ দারুণ। একটা ফোনই আজ করবে রাতে।
খাওয়ার আর আন্তরিকতায় রাগ রাগ ভাবটা যেন একটু কমে গেলো রাণার।
" হ্যালো, বল।
হঠাৎ ফোন?
মানে আমি তো চমৎকৃত।"
যা তা মেয়ে তো!
" মানে খাবার টা খুব ভালো ছিলো। থ্যাঙ্কু।"
" হুঁ আমার ব্যাগেও কিছু ভালো খাবার আছে সামলে রাখিস।"
ফোনপর্ব শেষে একদম হাত পা ছড়িয়ে ঘুম। এরপর তো ওখানে গিয়ে আবার চলবে।খুব চালাক মেয়েটা, রাণা সব গুছিয়ে নেবে সাফাই করবে তারপর আসবে।
**************
যথারীতি ঘরদোরে ধুলো পড়েছে,বিন্দিয়া বেপাত্তা।অগত্যা রাণাকেই সাফাই করে নিতে হলো।চাদর পাল্টে থাকার মত করে নিলো।তবে মহারাণীর বিছানায় হাত দিলোনা।
বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। কাল পুতুলও টেক্সট করেছিলো ওকেও জানিয়ে দিলো।
ক্রিং ক্রিং..." স্ক্রীনে ময়না ভেসে উঠলো,মুনিয়া নামটা সেভ করতে গিয়ে ময়না হয়ে গেছে।
" ঐ শোননা,ব্যাগটা একটু খুলবি প্লিজ।"
" আমি পারবোনা,তুই এসে খুলিস।"
" কয়েকটা জিনিস একটু ফ্রীজে তোল পচে যাবে।
মুনিয়া না থাকায় এই দুদিন রাণার তেমন আর কিছু করতে ইচ্ছে করেনি।তাছাড়া মায়ের দেওয়া অনেক কিছু ছিলো হয়ে গেছে।
বেশ রাতে ঢুকলো মুনিয়া,নিজে খেয়ে শুয়ে পড়েছিলো রাণা নাইট ল্যাচ দিয়ে।ভেবেছিলো উঠবেনা।কিন্তু যখন দেখলো অন্ধকারেই বেচারা পা টিপে টিপে কাজকর্ম করছে তখন আলোটা জ্বালিয়ে দিলো।
" ইশ্ তোর ঘুমটা ভাঙালাম সরি। কাল তোর সকালে উঠতে হবে।"
" থাক অত ভদ্রতা করতে হবেনা। খাবি তো? ফ্রেশ হয়ে নে। সব আমি রেডি করেই রেখেছি।"
" আমি খেয়ে নেবো ইয়ার। ভাগ্যিস তুই ছিলি,নাহলে হয়ত না খেয়েই শুয়ে যেতাম।"
হাসে রাণা," এই জন্যই মেয়েদের বিয়ে করা দরকার।"
" নো,এই জন্যই একটা ভালো বন্ধু দরকার।"
" মানিস আমাকে বন্ধু বলে? আমার তো মনে হয় তুই বাড়িওয়ালি আর আমি ভাড়াটে।"
মুখটা গম্ভীর হয় মুনিয়ার..." বৎস্য রাণা,তুমি তো এত কথা বলোনা। আজ হলো কি?
যাও শুয়ে পড়ো।"
ওর কথা শুনে হাসে রাণাও,কি জানি হয়ত অনেকদিন বাদে আবার নিজেদের জায়গায় ফিরেছে তাই কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সত্যিই তো অনেকদিন কথা হয়নি।
সকালে একটু ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে যায় রাণার,পর্দাটা সরিয়ে দেখে বাইরে পাখির দলের আনাগোণা। সূর্যের আলো ততক্ষণে ছড়িয়েছে শহরের সব বাড়ির মাথায় মাথায়।
উহ্ কত বেলা হয়ে গেলো! কখন ব্রেকফাস্ট বানাবে?
আশ্চর্য হয়ে যায় রাণা টেবিলে ফ্লাক্সে চা ব্রেকফাস্ট সব রেডি...কাপের পাশে একটা চিরকুট রাখা। এই প্রথম বাংলায় লেখা কোন কিছু মুনিয়া রেখেছে। মাঝে মাঝে কিছু আনতে হলে ইংরেজিতে লিখে যায়।
হাতের লেখাটা খুব সুন্দর.. কয়েকটা লাইন... ঘুম আসছিলোনা তাই ভোরবেলা চা খেলাম,আর খাবারটাও বানিয়ে নিলাম। আমাকে ডাকিসনা,একটু ঘুমোবো। আজ আর অফিস যাবোনা।"
অবাক হয়ে যায় রাণা,কেমন যেন লাগে ওর সব কিছু এমন কি কাপটাও গোছানো টেবিলে।
ও কি কিছু লিখবে? ভাবে রাণা। প্রতিদিন ও আগে যায় মুনিয়া একটু পরে।
কি লিখবে? থ্যাঙ্ক ইউ? নাকি অন্য কিছু?
*********
অনেক বেলায় আজ ঘুম ভাঙে মুনিয়ার, বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন। বাথরুমে গিয়ে একেবারে স্নান করে বেরোয়।
তারপর আবার বিরক্ত লাগে উফ্ আবার কিচেনে ঢুকতে হবে? কিচেনে গিয়ে ফ্রীজটা খুলতে যায়।ডোরে কয়েকটা লেখা দেখতে পায়,রাণা কাগজে লিখে স্টিকার দিয়ে আটকে গেছে। 'বাসি খাবার দুপুরে খাসনা, অর্ডার দেওয়া আছে একটায় দিয়ে যাবে।'
আজ প্রমোদের সাথে অনেকটা সময় ভিডিও কলে কথা হয়েছে মুনিয়ার।
প্রমোদ বলে, " ছুনে কো মন কর রহা হৈ তুমকো।"
বাংলা যেটুকু শিখেছিলো সবটাই বোধহয় ভুলে গেছে অনভ্যাসে। বুকটা তির তির করে কাঁপে মুনিয়ার। হয়ত কয়েক মাস বাদে এই ফ্ল্যাটে থাকবে শর্মাজী আর ও..এমনি কোন নির্জন দুপুরে যতখুশি পাগলামি করবে।
একটা ফ্লাইং কিস্ উড়িয়ে দিয়ে বলে মুনিয়া.....
" জলদি আ যাও..মিস্ ইউ বেবি।"
**************
রাণা আজ একটু আগেই এসেছে,ঘরে আজ চন্দনের গন্ধ।গন্ধটা খুব চেনা লাগলো।মুনিয়া কি ধূপ ধরিয়েছে?
ওর ঘরের পর্দা টানা,রাণা জানে যখন তখন ওর ঘরে যেতে নেই। মনে হচ্ছে ধূপই জ্বালিয়েছে।
একটু বাদেই ঘর থেকে বেরোয় মুনিয়া, "ও তুই চলে এসেছিস! গন্ধ পাচ্ছিস?"
" পাচ্ছি তো,আমাদের বাড়ির গন্ধ।"
" আমার খুব ভালো লেগেছিলো তাই ব্রান্ডটা দেখে কিনে এনেছি।"
রান্নাঘরে খুটখাট করছে মুনিয়া, রাণা ফ্রেশ হয়ে দেখে প্লেট ভর্তি খাবার মানে দুজনের বাড়ি মিলে।
" এই এত!"
" হম্ ডল মেসেজ করেছিলো আমাকে দায়িত্ব নিয়ে তোকে বাড়ির খাবারগুলো দিতে। নাহলে হয়ত পচবে। হম্ আর থ্যাঙ্কু ফর দ্য লাঞ্চ।"
মাথা নিচু করে রাণা,"লেখাটা পেয়েছিলি?"
" পেয়েছি তো। ফ্রীজে লটকানো ছিলো।"
রাতে মা ফোন করে," হ্যাঁ রে সব ঠিক আছে তো? মুনিয়া কিছু বলেছে? তুই কিছু বলেছিস?
"না মা কেউ কিছুই বলিনি।"
সব ঠিক আছে,ভেবোনা।হয়ত একটু বেশি ঠিক আছে।"
সত্যিই পুজোতে বাড়ি থেকে আসার পর মুনিয়া অনেক কাজের আর কেয়ারিং হয়ে গেছে। কে জানে রাণাদের বাড়িতে সব দেখেশুনে কি বদলে গেলো?
তবে এখন একটা নতুন খেলা হয়েছে চিরকুট দেওয়া, আগে ফোন করতো দরকারে এখন দুজনেই লিখে রেখে যায়।
ছোট ছোট টুকরো কথা,টুকরো অনুভূতির ছোঁয়া।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস,প্রমোদ এখনো ঠিক করে জানায়নি কবে আসবে তাই রাণাকে এখনো কিছু বলেনি মুনিয়া। বলতে সংকোচ হয়েছে।
**************
জুনি অন্য সেকশনে কাজ করে তাই খুব একটা দেখা হয়না। সেদিন জুনি ফোন করে
" কাল যাচ্ছি তোর ফ্ল্যাটে,কি খাওয়াবি বল।"
" কেন হঠাৎ আসবি শুনি,অফিসের দিনে?
" মুনিয়া বলেছে তাই।"
"কেন রে?"
"আরে তোর সাথে থাকে আর তুই জানিসনা?"
" কি জানবো আবার?"
"কাল তো মুনিয়ার বার্থডে।"
" তাই নাকি?"
" ফেসবুকে তো দেখিনি।"
" তোর ফেসবুক দাদু কি সব কথা বলে? ওখানে মেয়েদের বয়েস হাইড করা থাকে।মানে তালা মারা থাকে।"
আসলে এই কদিন রাণাও খুব ব্যস্ত ছিলো।গত মাসেই প্রমোশন হয়েছে তাই খুব চাপ কাজের। অনেক সময় শিফ্টও চেঞ্জ হচ্ছে। আজকাল দেখা আর কথা কম হচ্ছে। চিরকুট আদান প্রদান ছাড়া। মুনিয়া কিছু বলার থাকলে লিখে দেয়।রাণাও তাই করে।
" আমরা যাবো তো কাল। তোকে বলেনি কিছু?"
" আসলে কাল ফিরেছি অনেক রাতে,আবার আজ ও যখন গেছে আমি ঘুমোচ্ছিলাম।"
দেখনা আজও ফিরবো রাতে,আবার কাল সকালে বেরোনো।
" কাল একটু ম্যানেজ কর প্লিজ, বাড়ির বাইরে ঐটুকু আনন্দই তো।"
" আচ্ছা দেখছি রে।"
যথারীতি বেশ রাত্রি হয়ে গেছে ফিরতে রাণার,ততক্ষণে মুনিয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। রাণার খুব ইচ্ছে করে আজ ওকে জাগিয়ে হ্যাপি বার্থডে বলতে। আজ শর্ত ভেঙে পর্দাটা সরায় রাণা,একটু আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে জানলাটা খোলা আবছা আলো খেলছে মুনিয়ার চোখেমুখে গুটিশুটি মেরে ঘুমোচ্ছে মুনিয়া।
নাহ্ থাক আর জাগাবেনা। টেবিলে চিরকুট পায়.." ডিনার করে ঘুমোস,ব্রেকফাস্ট না করে যাসনা।আমি ওটস এনে রেখেছি। কাল একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস প্লিজজজজ।" সাথে একটা স্মাইলি।
সকালে ফোন বাজতেই চোখ খোলে মুনিয়া।বিছানার পাশে একদম তরতাজা অর্কিডের বোকে রাখা একটা মিষ্টি টেডি বিয়ারের হাতে ধরানো একবাক্স চকোলেট আর একটা চিরকুট।
" হ্যাপি বার্থডে,আমাকে বলিসনি কেন? অত রাতে কি পাবো? কাল রাতে তোর ঘরে ঢুকেছিলাম সরি,রাগ করিসনা। আজ চেষ্টা করছি তাড়াতাড়ি আসতে।"
শেষে একটা যাচ্ছেতাই দেখতে স্মাইলি আঁকা,ওটা দেখেই হাসলো মুনিয়া। পর পর ফোন আসে।
" হ্যালো মুনিয়াদি হ্যাপি বার্থডে। মায়ের সাথে কথা বলো।"
" হ্যাপি বার্থডে মুনিয়া ভালো থেকো।"
আন্টির সাথে আজকাল কথা বলতে আর সঙ্কোচ হয়না মুনিয়ার।রাণাই কাটিয়ে দিয়েছে পুরোটা।
***************
আজ অফিসে যাওয়া নেই,প্রমোদকে ভিডিও কল করলো ধরলোনা।পরে মেসেজ করলো মিটিংয়ে আছে।অবশ্য বারোটার পরেই ফোন করেছিলো মা আর প্রমোদ।ওদের সাথে কথা বলেই ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
অর্কিডের বোকেটা সাজিয়ে রাখে যত্নে। ইউটিউব খোলে,আজ চিকেনটা ও করবে।
জুনিকে আর ওর বরকে আসতে বলেছে,আরো দুজন কোলিগ আসবে।ছোট ফ্ল্যাট তাই নিজেরাই একটু আনন্দ করবে।
লম্বা স্লিভলেস হোয়াইট গাউন পরেছে মুনিয়া। সাদা ওর খুব প্রিয়,চোখে আইলাইনার দেয়।হাল্কা কাজল টানতে যায়,হঠাৎই কাজললতার কথা মনে পড়ে যায়। কেমন যেন এক ম্যাজিকাল কাজললতা,মাঝে মাঝেই মনে পড়ে রূপোর কাজললতার গল্প মুনিয়ার।
ঘাড়ে হাতে হাল্কা পারফিউম ছোঁয়ায়।ঘরে ধূপকাঠির গন্ধে চন্দনের আবেশ।নিজের একটা সেল্ফি তোলে অর্কিডের পাশে দাঁড়িয়ে।
রাণা ফেরার সময় ক্যাবে বসে ফেসবুকটা অন করে,সারাদিন বাদে ফেসবুক খুলতেই স্ক্রীনে ভেসে ওঠে অর্কিডের পাশে মুনিয়া,দৃষ্টিতে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে রাণার তবে কমেন্ট করেনা।
***********
সেদিন রাতে বেশ জমাটি আড্ডা হলো সবার।চিকেনটা ভালোই রেঁধেছে মুনিয়া,বাকিটা বাইরে থেকে আনিয়েছে। ওদের আড্ডার মাঝেই রাণা ফিরেছিলো হাতে একটা গিফ্ট।
" পারফিউম! আই লাভ পারফিউম।"
হাসে রাণা," আমরা সবাই জানি।"
বেশ অনেকটাই রাত হয়ে গেলো জুনিরা তখন যাবার পথে।
"চলিরে রাণা আর মুনিয়া, আবার আসবো রাণার বার্থডে তে।"
" হম্ সিওর তবে সেটা অন্য কোথাও হবে।"
" মানে!"
" আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি সামনের মাসেই হয়ত ওখানে শিফ্ট করে যাবো। যেতে তো হতই একদিন।"
জুনি বলে," ওকে,গুড নিউজ। রাণা তাহলে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট হবে এবার। ট্রিট দিতে হবে কিন্তু নতুন ফ্ল্যাটে।"
ওদের হৈ হৈয়ের মাঝে হাসলেও কেমন যেন মেঘলা লাগে মনটা মুনিয়ার, হয়ত রাণারও
মনে একটুকরো মন খারাপের কুয়াশা এসে গলাটা বন্ধ করে দেয়।
মুনিয়ার ঘুম আসেনা,কত কি মনে হচ্ছে। রাণাটা একবারও বললোনা বাড়ি খুঁজছে। থাক হয়ত সবটাই ভালো হয়েছে,একসময় তো ও বলতো বাড়ি খুঁজতে তার চেয়ে এই ভালো।
রাণারও মনে হয় জড়িয়ে পড়ছে যেন একটু করে আজকাল মুনিয়ার চিরকুট পাওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে।রাতে ওর হাতে তৈরি ডিনার টেবিলে গুছোনো দেখে ভালো লাগে। ওর ঘর থেকে আসা চন্দন ধূপের গন্ধ কেমন যেন বাড়ি বাড়ি ফিলিংস আনে। তাই হয়ত আর থাকাটা হয়ত ঠিক নয়। এমনিতেই প্রথমেই কথা হয়েছিল ছমাস থাকতে পারে রাণা,সেটা অলরেডি পার করেছে।
টুকটাক করে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছে রাণা। এমন আর কি আছে? যাক তবুও গুছিয়ে নেওয়া। মুনিয়া কদিন আর ওকে রান্না করতে দেয়নি।রাণা রাগ করলে বলেছে..." অভ্যেস করছি।"
" আরে আমাকেও তো অভ্যেস করতে হবে নাকি?"
" এরপর তো সানডে হলেই আমি চলে যাবো তোর রান্না খেতে। কিন্তু বেশ অনেকটা দূর।"
হয়ত ইচ্ছে করেই একটু দূরে গেছে রাণা তবুও মুখে হাসির ছোঁয়া মাখিয়ে বলে..." একটা বাইক কিনবো ভাবছি। যেদিন যাবি বলিস আমি নিয়ে যাবো।"
" এত খরচ করবি একসাথে! অনেক টাকা পকেটে আছে মনে হচ্ছে?"
" নারে ই এম আই দিয়ে নিয়ে নেবো,ক্যাবের খরচটা বাঁচবে।"
*************
প্রায় একমাস হলো রাণা চলে এসেছে ওর ফ্ল্যাটে যদিও ওয়ানরুম তবুও বেশ বড়। মাকে ভিডিও কলে দেখিয়েছিলো। মায়েরও পছন্দ হয়েছে।
তবে মুনিয়া এখনো আসেনি ওর ফ্ল্যাটে, হয়ত একটু অভিমান হয়েছে। বুঝতে পারে রাণা।
ও চলে আসার সময় ছিলোনা মুনিয়া,রেখে গিয়েছিল চিরকুট আর একটা খুব সুন্দর বুদ্ধমূর্তি..." নতুন বাড়িতে রাখিস। আজ একটু কাজ আছে বেশি তাই থাকতে পারলাম না। ভালো থাকিস। মাঝে মাঝে চলে আসিস আড্ডা মারবো।"
মাঝে মাঝে ছোট ছোট টেক্সট করে রাণা... কেমন আছিস?
উত্তর পায় ঠিকঠাক।
পুতুল আর জুনির কাছে ওর খবর পায়।তবে রাণারও যাওয়া হয়নি আর।
মুনিয়াকে আনাও হয়নি,একটু সাজিয়ে নিয়ে ভেবেছে সামনের মাসে ডাকবে জুনি আর মুনিয়াকে তার সাথে আরো কয়েকজনকে।
একলা হয়ে রাণারও কাজ বেড়েছে। আগে মনে হত মেয়েটা কিছু করেনা।রাগ হত।এখন দেখে যেটুকু করতো তাই অনেক। আর্ধেক দিন রুটি কিনে খেয়ে রাতে শুয়ে পরে।সকালে রেডিমেড ওটস আর দুপুরে বাইরে।
মা প্রতিদিন জানতে চায় কি খেলি কি রাঁধলি তবে শুনে খুব রাগ করে।
" ঐ জন্যই বলেছিলাম একটা মেয়ে দেখি।এখন তো একা থাকিস,অন্ততঃ ঘরে এলে একটা কথা বলার লোকও তো দরকার তাইনা?"
চুপ করে থাকে রাণা,ওদিক থেকে পাকা বোন আওয়াজ দেয়..." চুপ করে আছে,তার মানে ইচ্ছে আছে।"
" মা তুমি ফোনটা স্পীকারে করে রেখেছো?"
" হ্যাঁ, বাবা বোন সবাই শুনছে কথা।"
" সবাই ভালো থেকো আর এবার রাখো।"
******************
ভেবেছে নেক্সট সানডেতে ওদের আসতে বলবে।
ফোন করে রাণা..মুনিয়া অভিমানের সুরে বলে," এতদিনে আমাকে ফ্ল্যাট দেখতে নিয়ে যাবি? আমি যদি কোনদিন গিয়ে হাজির হই তাই এতদিন দেখাসনি। যাক ভালো হয়েছে,এরপর হলে আমি যেতে পারতাম না। আমার এক বন্ধুর আসার কথা।"
রাণা আর কথা বাড়ায়না বুঝতে পারে বিশেষ কেউ হয়ত।
কদিন ও ফ্ল্যাটটাকে একটু সাজিয়েছে,বুদ্ধমূর্তিকে সেন্টার টেবিলের ওপর রেখেছে। সামনে সুন্দর ধূপদানি।আজকাল রাণার ঘর থেকেও চন্দনের গন্ধ ছাড়ে। নতুন পর্দা লাগিয়েছে দরজা জানলায়।
দেখতে দেখতে শনিবার এলো,অফিসেই মুনিয়াকে ফোন করেছিলো একবার রিমাইন্ডার দিতে যা ভুলো মন।ফোন ধরলোনা মুনিয়া, হয়ত বিজি আছে। একটা ছোট মেসেজে লিখে পাঠায় রাণা।
সন্ধ্যেবেলা ফোনটা খোলে রাণা,কি মেয়েরে বাবা কখন মেসেজ করেছে রিপ্লাই দিলোনা।
আবার একটা কল করে...রিনরিনে একটা হাসি ভেসে ওঠে "হম্ এই ফোনটার জন্য ওয়েট করছিলাম।"
" ভেরি ব্যাড এতটাও ভাউ খাওয়া উচিত নয়।"
" ইশ্ কি সব আজেবাজে কথা বলছে। আমাকে নিতে আসবি তো?"
" আবার নিতেও আসতে হবে?"
" এইসেই তো বাথ হুয়া থা ইয়ার, বাইক মে উঠাকে লে যাওগে।"
" আচ্ছা বাবা তাই হবে আসবো আমি শার্প টেন,রেডি হয়ে থাকিস।"
একটু সকাল সকাল উঠেছে আজ রাণা, ভোরের আকাশে রঙের মাখামাখি। আকাশ বেশ পরিস্কার আজ। রুম ক্লীন করে স্ন্যাক্সগুলো গুছিয়ে রাখে টেবিলে। সাথে বেশ কিছুটা ক্যাডবেরি,কারণ জুনি আর জুনির বন্ধু দুটোই চকোলেট পাগলী। সবটাই আজ অর্ডার দিয়েছে শুধু একটা ড্রাই চিলিচিকেন বানাবে।মুনিয়ার ওটা খুব পছন্দ।
সব শেষ হয়ে গেলে নিজে সেভ করে একটা গুড শাওয়ার নেয়। স্কাই ব্লু টি শার্ট আর জিন্সটা পরে নেয়। ঘরে রুম ফ্রেশনার ছড়ায়,কর্ণাটক এম্পোরিয়াম থেকে চন্দন ধূপ আর ফ্রেশনার এনেছে বেশ একটা সুন্দর আমেজ পাওয়া যায়। পর্দাতে হাওয়া লেগে টুংটাং আওয়াজে বাজছে ঘন্টাগুলো।
ব্যাস রেডি এবার রওনা দিতে হবে মহারাণীকে আনতে। জুনি একটু দেরি করবে বলেছে,দেখা যাক কখন আসে।
মা ফোন করলো.." কি রে সব ঠিক করেছিস তো? এতজন আসবে,আমারই টেনশন হচ্ছে।"
পেছন থেকে আওয়াজ আসে রাণাগিন্নী সব সামলে নেবে ভেবোনা।
" মা ঐ পাকা বুড়িটাকে চুপ করতে বলো। রাতে কল করবো ওকে। জুনি আর মুনিয়া আছে তো ওরা হেল্প করবে।"
************
বাইকটা স্টার্ট দেয় রাণা,নিজস্ব যানবাহনের একটা মজা আছে। তার আগে একটা কল করে.." আমি আসছি একটু বাদেই রেডি তো?"
ওদিকে একটা হাই তুলে একজন আদুরে গলায় বলে..." আয়,হয়ে যাবো রেডি।"
" মানে এখনো রেডি হোসনি?"
" আয় তো।"
ব্যাস ফোন কুটুস করে কেটে দেয়।
অনেকদিন বাদে আবার পুরোনো রাস্তা,পুরোনো লিফ্ট আর পুরোনো স্মৃতি।খুব খারাপ অভিজ্ঞতা ছিলোনা।
বেলে হাত রাখে রাণা এখন তো আর চাবি নেই ওর কাছে। দরজা খুলে দাঁড়ায় মুনিয়া,হাল্কা স্কাই ব্লু ডেনিম টি শার্ট আর হোয়াইট থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট পরেছে মুনিয়া। চুলের রঙটা আর স্টাইলটা বোধহয় একটু চেঞ্জ করেছে।
সত্যিই রাণার গাইতে ইচ্ছে করলো..'আমি চিনি গো চিনি তোমারে ও গো বিদেশিনী।'
কিন্তু খুব মজা করবে মুনিয়া তাই চুপ করে রইলো।
" কি রে ঠিকঠাক লাগছে তো? তোর ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেবে তো? সারাদিন থাকবো তো তাই।"
" একদম ঠিক লাগছে।এবার চল..."
" একটু ভেতরে আয় কতদিন বাদে এলি.."
রাণা গাইতে না পারলেও মুনিয়া গানের ছন্দেই বললো..' কতদিন পরে এলে একটু বোসো..."
" কফি করা আছে খা আমি জাস্ট একটু কাজল পরবো আর লিপস্টিক দেবো।"
কাজললতার কথাটা মনে পড়লো রাণার উঃ কি বাজে একটা এক্সপিরিয়েন্স। কফি খেতে খেতে ঘরটা দেখে রাণা মুনিয়া বেশ সাজিয়েছে ঘরটা।যেটাতে ও শুতো তাতে সুন্দর ডিভান কাভার আর কুশন।জানলায় ম্যাচিং পর্দা হাওয়ায় নড়ছে।
" ইশ্ তোর আর আমার তো প্রায় ম্যাচিং।"
প্রথমেই দেখেছে রাণা তবুও অন্য কথা বলে.." ঘরটা খুব সুন্দর সাজিয়েছিস,ভালো লাগছে।আসলে আমি থাকতে এলোমেলো রাখতাম।"
" চুপ,এবার চল।"
***************
Comments
Post a Comment