#প্রশ্ন#
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
বাইরের খোলা হাওয়ায় নিজেকে খুঁজতেই এখন বেশি ভালো লাগে দিগন্তের তাই মাঝে মাঝেই বাইরে বেড়াতে চলে যাওয়া অবশ্যই সঙ্গে থাকে ওর দশ বছরের বিবাহিত জীবনের সঙ্গিনী দীপা।
বন্ধুবান্ধব নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাওয়া একদম পছন্দ নয় দীপার। একটা অদ্ভুত মানসিক সমস্যায় ভোগে সবসময় যেন মনে হয় দিগন্ত কোথাও চলে যাবে। মাঝে মাঝে একটু বিরক্তও লাগে ওর। কিন্তু বুঝতে পারে অ্যাক্সিডেন্টের পর অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে দীপা।
মাঝে তো সমানে খেলনা আর পুতুল নিয়ে বসে থাকতো যখন ডাক্তার বললো আর মা হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সিঁড়ি দিয়ে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় গড়িয়ে পড়ে গেলো কি করে ও তা এখনো মাঝে মাঝে বুঝতে পারেনা দিগন্ত। অনেকগুলো দিন হসপিটালে কাটিয়ে অবশেষে বাড়ি ফেরা।
এখন যেন কেমন একটা হয়ে গেছে চিৎকার গন্ডগোল বাচ্চা কিছুই সহ্য করতে পারেনা । তাই মাঝে মাঝেই ওকে নিয়ে ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউডে চলে যায় দিগন্ত। দীপা রেস্ট হাউসের বারান্দায় বসে পাহাড় দেখে খুব একটা কোথাও যায়না হাঁটতে সমস্যা হয় বলে আর দিগন্ত একটু হেঁটে আসে ঘোরানো পাহাড়ি পথ দিয়ে।
এবারও তেমনি নিরিবিলিতে কয়েকটা দিন কাটাবে বলে দার্জিলিং মেলে উঠে এক বিপত্তি।কোচ ভর্তি অনেক কমবয়েসী ছেলেমেয়ে যাদের কথা,হাসাহাসি আর গন্ডগোলে দীপার ওষ্ঠাগত অবস্থা।
" আচ্ছা আগে তো একবার দেখবে এই একগাদা এনসিসির ছেলেমেয়ে যাচ্ছে এখানে? আজকাল আমি এতো গন্ডগোল আর নিতে পারিনা তুমি জানোনা?"
দীপার কাঁধে হাত রাখে দিগন্ত," আমি জানি দীপা,তবে এটা কি করে জানবো বলতো একদল ছেলেমেয়ে এখানে উঠবে?"
মুখ গোঁজ করে বসে দীপা তারপর টি টি আসতেই বলে ." আমাদের সীটটা একটু পাল্টে দেবেন?"
" কিছু প্রবলেম ম্যাডাম? আপনাদের তো দুটোই লোয়ার দেখছি। এতো ভীষণ ভালো সীট।"
" না যদি পাশের কোচে একটু দিতেন আ্যডজাস্ট করে,আসলে এখানে অনেকগুলো বাচ্চা উঠেছে তো।আমার আবার সাইনাসের সমস্যা মাথা ধরে যায়।"
দীপার কথার মধ্যেই দিগন্তের চোখ চলে যায় বাচ্চাগুলোর দিকে অবশ্য খুব বাচ্চা নয় সবেই ওরা পাখা মেলেছে আকাশে মা বাবা ছাড়া স্বাধীন সফরে ভোগ করছে অনাবিল আনন্দ।
একটা সময় তো ওরাও কত গেছে এমন সফরে স্কুল থেকে কখনো কলেজ থেকে। কি মজাই না করছে ওরা।ওদের দেখে দিগন্তের মনটা ডুব দেয় সেই ছোট্টবেলার দিনে। অদ্ভুত শিহরণ হয় কলেজের কথা ভেবেও সেই প্রথম প্রেমের দিনগুলো ছোঁয়াতে যখন ছিলো শিহরণ।
এর মাঝেই কানে আসে," না ম্যাডাম আর হবেনা আ্যডজাস্ট। এই তো রাতটুকু, সকাল সকাল ঘুমিয়ে যান সকালেই তো এনজিপি।আর রাতে ওরাও তো ঘুমোবে।
দিগন্তের গানের কর্ডটা কানে দিয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে বসে দীপা। দিগন্ত ওদের খুনসুটি দেখতে ব্যস্ত,ব্যাপারটা আরো অসহ্য লাগে ওর মনে মনে যেন আরো বেশি খোঁচা খায় আঘাতে।
ও জানে দিগন্ত খুব বাচ্চা ভালোবাসে। আজকাল তাই দেওর ননদ কারো বাড়িতেই যেতে ভালো লাগেনা দীপার। খুব আদিখ্যেতা করে দিগন্ত ভাইয়ের ছেলে আর বোনের মেয়েকে নিয়ে।
দুটো ছেলেমেয়ে মাঝে মাঝেই ছুটোছুটি করছে এদিক ওদিক।ওদের এখানেও চলে আসছে কখনো তারপর আবার দীপার দিকে তাকিয়ে সরি বলে চলে যাচ্ছে।কারণ দীপা এর আগে একবার ওদেরকে চোখ পাকিয়ে একটু ইশারায় চুপ করতে বলেছিলো।
রাতে ওষুধ খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে দীপা দিগন্ত জানে একটু বাদেই ও ঘুমিয়ে পড়বে আর ঘুমটা ঠিকঠাক হলেই শান্তি। না হলেই মাথা ধরবে,মেজাজ খারাপ হবে।
দিগন্ত বসে থাকে কিছুক্ষণ.. ওদিক থেকে কে যেন ডাকে বর্ষা,বসন্ত এদিকে এসো খাবে। নাম দুটো শুনে কেমন যেন আনমনা হয়ে যায় দিগন্ত খুব চেনা নামদুটো। হয়তো বা ভীষণ পছন্দেরও। মনে পড়ে যায় কলেজ থেকে বেড়াতে যাবার কথা পুরীতে সমুদ্রের ঢেউয়ের মূর্ছনায় প্রেমের আবেগে ভেসে গিয়েছিলো সমুদ্রার সাথে। সেই প্রেমের শুরু তারপর আবার বাইরে যাওয়া কিছুদিন বাদে আর একটা সময় শারীরিক ঘনিষ্ঠতা । এক বৃষ্টির রাতে ভেসে গিয়েছিলো প্রথম প্রেমের উন্মাদনায় দুজনেই। ভেঙে গিয়েছিলো সব আগল,চুপিচুপি কানে কানে বলেছিলো সমুদ্রা বিয়ের পর যখন আমাদের মাঝে কেউ আসবে তখন ছেলে হলে নাম দেবো বসন্ত আর মেয়ে হলে বর্ষা।
তবে বিয়েটা হয়নি ওদের হবেই বা কি করে? দিগন্ত তখন সবে পাশ করেছে আর সমুদ্রা তখনো পড়ছে। মাঝে কিছুদিন গ্ৰামের বাড়িতে চলে গিয়েছিলো সমুদ্রা পরীক্ষার পর বাবার অসুখের জন্য। হঠাৎই মাস দুয়েক পরে একদিন হঠাৎই এসে কেঁদে পড়েছিলো," দিগন্তদা তুমি আমাকে বিয়ে করো,আমি মা হতে চলেছি। সেই রাতের পর তো আরো বেশ কয়েকবার..."
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো দিগন্তর এখনই বিয়ে করে কি করবে? কি করে সব চলবে?
এদিকে কান্নায় সমানে ভিজছে সমুদ্রা তখন "বাবা খুব অসুস্থ,আমি আর পারছিনা।তুমি আমাকে বিয়ে করো।"
কথা রাখেনি দিগন্ত ওর হাতে টিউশনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে রাখা কিছু টাকা দিয়ে বলেছিলো.." কোথাও গিয়ে একটা কিছু ব্যবস্থা করে নে তবে আমার নামটা দিসনা প্লিজ। তুই তো অনেকদিন বাড়িতেও ছিলি।"
সমুদ্রার চোখে হঠাৎই চোখের জলের বদলে আগুন দেখেছিলো দিগন্ত।টাকাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিলো সমুদ্রা এখনো মাঝে মাঝে ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে সেই আগুন ঝরানো দৃষ্টি দেখতে পায় দিগন্ত। তবে সমুদ্রাকে আর কোনদিন দেখেনি দিগন্ত মানে খোঁজও করেনি। কিছুদিন বাদেই দীপা চলে এসেছিলো ওর জীবনে,দীপা কখনোই চাইতোনা দিগন্ত আর সমুদ্রার বন্ধুত্ব হোক। তাই সুযোগ পেয়েই সমুদ্রার অবর্তমানে ঢুকে পড়ে দিগন্তের জীবনে। তবে সন্তান আসনি কখনোই। হয়ত সমুদ্রার ঐ আগুনঝরা চোখের অভিশাপ আজও তাড়া করে বেড়াচ্ছে ওদের।
সত্যিই তো নিজেকে বাঁচাতে সমুদ্রার চরিত্রের দিকেও একসময় কাঁদা ছুঁড়েছিলো। আর কখনো খোঁজও করেনি ওর।
চিন্তামগ্ন দিগন্তের চোখ খোঁজে ঐ দুটো নামের কাউকে কিন্তু ততক্ষণে ট্রেনের কামরায় যে যার সীটের পর্দা টেনে চলে গেছে ঘুমের দেশে।
সকালে তাড়াতাড়ি করে স্টেশন আসতেই সবাই নেমে পড়লো। দিগন্তকে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে দীপা বললো.." কি দেখছো এদিক ওদিক? আমার ব্যাগটা একটু ধরো পা ফেলতে পারছিনা।"
ততক্ষণে ওদের সেই বিঘ্নসৃষ্টিকারী বাচ্চাবাহিনী নেমে পড়েছে। দিগন্ত আবার যেন কি খুঁজতে যায়,দীপা ওর হাতটা ধরে টানে। এগিয়ে যেতে যেতে দিগন্ত শোনে..' বসন্ত,বর্ষা'... দুটো ছটফটে গলা বলে ওঠে," ঐ তো মা এসে গেছে।"
পেছন ফেরে দিগন্ত ওর হাত দুটো চেপে ধরে আছে দীপা। কিছুটা দূরে সমুদ্রা জিন্সের প্যান্ট আর সাদা গেঞ্জি পরা...দুটো ছেলেমেয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছে মা মা করে। মাতৃত্বের আনন্দে সন্তানদের বুকে আগলে ধরে সমুদ্রা ওরা মায়ের আদরের ওম নেয়.." কেমন ছিলো তোদের কলকাতা ট্যুর? কলকাতা কেমন লাগলো?"
দিগন্ত একটু দূর থেকে ভিড়ের মধ্যে একবার দেখতে চায় বর্ষা আর বসন্তের মুখ দুটো। ওর অতৃপ্ত পিতৃত্ব খুঁজতে চায় অনেক কিছু কিন্তু পারেনা। একটা প্রশ্নই তখন বাজে মনের মাঝে তাহলে বর্ষা আর বসন্ত কি ওরই যমজ সন্তান?
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment