#এলো বরষা যে সহসা মনে তাই#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
দুর্গাপুজোতে অন্য বন্ধুদের সাথে আনন্দে ড্যাং ড্যাং করে নাচতে নাচতে সবুজে ঘেরা শালবনের সারির আদরমাখা ক্যাম্পাস ছেড়ে মিঠুয়া একদম একটা ঢাউস ব্যাগ গুছিয়ে টাটা বাই বাই বলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। যাবার সময় অবশ্য ইট্টুখানি মনটা উদাস হয়েছিলো বন্ধুদের ঘরে বসে জমাটি সন্ধ্যের আড্ডার জন্য।
আর ছুটির পর হস্টেলের মাঠের আড্ডাটাই বা কম কি? একপাল ছেলেমেয়ে মিলে একদম নির্ভেজাল আড্ডা।
গতকাল সন্ধ্যেবেলা ওদের ডিপার্টমেন্টের অরুণ বলেছিলো.."আর দুটো দিন পরেই তো যেতে পারতি একদম মহালয়ার আগেই দৌড়চ্ছিস কেন বাড়িতে? কি আছে ওখানে?"
" কি আর থাকবে? মা বাবা বোন ভাই সবাই আছে। আর এখানে থেকেই বা কি করবো? হস্টেল তো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কেন তুই বাড়ি যাবিনা?"
মিঠুয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে খুব বলতে ইচ্ছে হলো অরুণের..হস্টেল ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বলেই চলে যেতে হবে? আমি তো আছি। নাহয় আমার জন্যই থেকে যেতিস আর দুটো দিন। তবে ওটা না বলে বললো...
" যাবো তো তবে এখনি নয় সপ্তমীর দিন যাবো।"
" সে কি রে? এত দেরিতে যাবি! কেন?"
" আমার কতগুলো টিউশন আছে রে তাই ওদের একটু পড়াটা টেনে দিয়ে যাবো।"
" ইশ্! বাজে স্যার একটা। দুগ্গাপুজোতেও শান্তি দিলোনা ছাত্রদের! থাক তুই তোর ছাত্রদের নিয়ে আমি ভাগলবা একদম বাড়িতে। আমাদের পাড়ার পুজো খাওয়াদাওয়া কত আড্ডা। পুজোর দিনগুলো একদম মস্ত কাটাবো।"
মিঠুয়ার চোখে স্বপ্ন নাচছে,চোখের তারায় মাখানো আনন্দের পরশ। একটু আনমনা হয়ে যায় অরুণ। ওর দুই ছোট ভাইবোন এখনও ছোট।বাবা অসুস্থ খুব কম পেনশন পান।নিজের রোজগারের টাকায় কোন রকমে চালিয়ে নেয় পড়ার খরচটা আর কিছু পাঠায় বাড়িতে।
তাই মাস শেষ হলে একদম মাইনেটা নিয়ে যাবে বাড়িতে।
" আর কি যা তবে চলে আসিস খোলার পরেই কারণ পরীক্ষা তো ডিসেম্বরেই হবে।"
পুজোর আনন্দ আর খুশিতে একদম এদিকের সুইচটা অফ করে দিয়েছিলো মিঠুয়া। আর তখন ফোনটোনও ছিলোনা তাই আর কোন যোগাযোগ হয়নি অরুণের সাথে।
যথারীতি টিউশনের টাকা পেয়ে মায়ের জন্য আর বাড়ির সবার জন্য জামাকাপড় কিনে বাড়ি যেতে যেতে সপ্তমীর রাত হয়ে গিয়েছিলো।
প্যান্ডেলে তখন সবাই ঠাকুর দেখছে খুশির ঝলক সবার মুখে। ভাইবোনরা জামাগুলো নিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছিলো দাদা এসেছে দাদা এসেছে। মা বলেছিলো," কি দরকার বাবা এতোগুলো টাকা খরচ করার? তোর পড়াশোনা তে কত খরচ!"
মায়ের গায়ে নতুন শাড়ি আর বাবার গায়ে নতুন জামা দেখে মন ভরেছিলো অরুণের। মা একটা পায়জামা পাঞ্জাবী বের করে দিয়ে বলেছিলো," এটা পরে অঞ্জলি দে।আমি জানি তো বলবি তোর কত জামা তাই কিনিসনি।"
মায়ের আদরের ছোঁয়ায় আর যত্ন করে মায়ের রাঁধা আমিষ নিরামিষ খেতে খেতেই ফিরতে হলো হস্টেলে। মা বললো," লক্ষ্মীপুজোর পরের দিনই চলে যাবি? তোদের তো খুলতে অনেক বাকি।"
" হ্যাঁ মা ছাত্রদের পড়ানো আছে যে তাই যেতেই হবে।"
ওদের সবুজে ঘেরা ক্যাম্পাস তখন একদম উদাসী আর শূন্য। অলস ছুটিতে কাটাচ্ছে যেন সেও। কিচেন বন্ধ তাই কদিন বাইরেই খেতে হলো। নিজের পড়াশোনা আর ছাত্র পড়ানোর ফাঁকে মাঝে মাঝেই এসে বসা শালবনের ধারে বসার বেদীটাতে ওখানে বসে কত গল্প করে ওরা। দুএকদিন সাঁঝবেলায় মিঠুয়া আর ও পাশাপাশি হেঁটেছে ওখানে। একমনে বকবক করতো মিঠুয়া আর ও শুনেছে চুপ করে। কবে যে আবার ফিরবে সবাই কে জানে। ক্যাম্পাসটা বড় ফাঁকা।
অরুণের হঠাৎই মনে হয় ওর বোধহয় বেশি মিঠুয়ার জন্যই মন কেমন করছে। ভেবে একটু হাসি পায়,মিঠুয়া হয়তো ওর কথা মনেই করেনা মেতে আছে পুজোর পর কালীপুজোর হৈ হল্লা নিয়ে।ওর কি আর মনে আছে একটা কেউ ওর জন্য অপেক্ষায় আছে হয়ত বা মনে করছে ওকে নানা কাজের মাঝে অথবা কখনো ক্লান্ত উদাস করা বিকেলে।
পাখির ডাকে আর কাশফুলের শুভ্রতায় মনটা হারিয়ে যায় অরুণের।
******************
পুজোর ছুটির পর যথারীতি কলকল করতে করতে ফিরে এলো ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীদের দলবল। কিন্তু তখনো মিঠুয়া ফিরলোনা ওর বসার জায়গায় চোখ রেখেই মনটা কেমন যেন হু হু করে উঠলো অরুণের। তাপসীকে জিজ্ঞেস করলো.." মিঠুয়া আসেনি রে?"
তাপসী মজা করে বলেছিলো.." কেন রে হোল ক্লাস ফিরেছে তাতে তোর হচ্ছেনা। মিঠুয়াকে কি দরকার শুনি?"
সত্যিই মিঠুয়াকে ছাড়া বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে অরুণের।
একদিন দুদিন নয় প্রায় সাতদিন পরে এলো মিঠুয়া মুখটা খুব শুকনো ওর জ্বর হয়েছিলো শুনলো অরুণ।
"তোকে খুব মিস্ করছিলাম,আসলে আমি তো অনেকদিন আগেই এসে গেছি।"
" এতোদিন আগে থেকে এসে বসে আছিস!"
" কি করবো বল উপায় নেই।"
অবসরের দুপুরগুলোতে কখনো ক্যান্টিনে কখনো বা মাঠে আড্ডা জমতো ওদের তার মাঝেই অরুণের চোখ চলে যেতো মিঠুয়ার দিকে। অরুণের চোখের ভাষা মাঝে মাঝেই উদাস করতো মিঠুয়াকে কিন্তু কি করে অরুণের হাত ধরবে? ওর বাড়ি থেকে খুব বিয়ের চেষ্টা করছে বাবার ইচ্ছে যেন ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পরই বিয়েটা হয়ে যায়।
সেদিন ডিপার্টমেন্ট থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি এলো একদম মেঘের ঘন কালো ঘনঘটায় সেজেগুজে। অনেকেই তখন চলে গেছে আটকে পড়েছে শুধুই মিঠুয়া। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভেবেছিলো কোন রকমে দৌড়ে চলে যাবে হস্টেলে কিন্তু এলো ভীষণ জোরে একদম রেগেমেগে আবার বৃষ্টি।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটু যেন বৃষ্টিটা কমলো।মিঠুয়ার পরনে আজ চিকনের সাদা কুর্তা আর লাল সবুজ ওড়না হাতে চুড়ি চারিদিকে কেউ নেই হঠাৎই গেয়ে ফেললো আর নাচের ছন্দে ছুটে পা বাড়ালো...' এলো বরষা সহসা মনে তাই,রিমঝিম ঝিম রিমঝিম ঝিম গান গেয়ে যাই।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ধারা চুল ভিজিয়ে মুখ বেয়ে গড়িয়ে শরীরে পড়ছে।হঠাৎই পেছন থেকে কে যেন ছাতা ধরে মাথায়।
খিলখিল করে হেসে ওঠে মিঠুয়া..." তুই কোথা থেকে এলি? দিলি তো নাচের আর গানের মুডটা নষ্ট করে। দিব্যি নাচতে আর গাইতে গাইতে আসছিলাম।"
কিছুটা হলেও বৃষ্টিতে ভেজা ময়ূরীকে দেখে ফেলেছে অরুণ,মিঠুয়া মনে দোলা দেয় ওর। এক ছাতার ভেতরে মিঠুয়ার ভেজা শরীরটা ছুঁয়ে যাচ্ছে ওকে। গায়ে আর মনে লাগছে ভালোলাগার সৌরভ।
" টা টা থ্যাঙ্কু হস্টেলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এবার তুইও রিমঝিম গিরে শাওন করতে করতে চলে যা।"
মিঠুয়াকে কেন যে তোকে খুব ভালোবাসি কথাটা বলে উঠতেই পারছেনা অরুণ। আচ্ছা মিঠুয়া কি বোঝেনা কিছু? কেন অরুণ ওকে এত বই দেয়,নোটস তৈরি করে রাত জেগে ওর জন্য।
সামনে সপ্তাহে মিঠুয়ার জন্মদিন...তোকে কিছু দিতে চাই আমি খুব বলতে ইচ্ছে অরুণের।মনে মনে ভাবে না এভাবে বলা ঠিক হবেনা। মিঠুয়াকে গীতবিতান দেবে,সত্যি মিঠুয়া খুব ভালো গান গায়। আর এক গোছা লাল গোলাপ।
জন্মদিনের দিন সকালে মিঠুয়ার খোঁজ করে অরুণ। গত সাতদিন ও ছিলোনা বাড়ি গিয়েছিল, কাল রাতে ফিরেছে। তাপসী বলে মিঠুয়াকে নিতে ওর বাবা এসেছিলো মনে হয় ওর বিয়ের কথা চলছে। অবাক হয়ে যায় অরুণ।বোকার মতো জিজ্ঞেস করে..." কবে?"
তাপসী বলে," এই চারদিন আগে।"
একদিন অবশ্য হাসতে হাসতে বলছিলো মিঠুয়া পুজোর মধ্যে কোন এক ছেলের মায়ের ওকে খুব পছন্দ হয়েছে। সেই ছেলে বাইরে থাকে। শুনে মনটা ভারী হয়েছিল অরুণের। ওর এখন তো কোন ক্ষমতাই নেই যে মিঠুয়াকে বলবে তোকে রাখবো একদম নিজের করে।
তারপর আর অনেকদিন কিছু শোনেনি। তবে এভাবে হঠাৎই মিঠুয়া চলে যাবে ভাবেনি। অদ্ভুত যেন একটা কুয়াশা মাখা সকাল সেদিন শালবনের পাতাগুলো হিমে ভেজা।আস্তে আস্তে গিয়ে ছোট ঘোরানো ব্রীজটা পার হয়ে বেদীটার ওপর বসে অরুণ। আজ ভেবেছিলো যে কথা হয়নি বলা তা বলবে রবীন্দ্রনাথের সাথেই। গোলাপের সাথে হাতে দেবে গীতবিতান।
কাঁধের ব্যাগটাতে যত্নে রাখা ফুলগুলো কাগজের মোড়কে...গীতবিতানে লেখা হৃদয়ের না বলা কথাগুলো দিলাম তোকে।
ফুলগুলো ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিলো অরুণের তবুও পারেনা ওগুলো যে খুব কষ্টে জোগাড় করেছে শুধু মিঠুয়ার জন্য।
বেশ কিছুক্ষণ বসার পর ঘরে গিয়ে সাজিয়ে রাখে ফুলগুলো কাঁচের গ্লাসে।
মাঝে কেটে গেছে তিন চারদিন। বিকেলের আড্ডা আর তেমন জমেনা প্রতিদিনই একটা সময় গিয়ে বসে অরুণ সেই বেদীটাতে। মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা হয়ত একেবারে বিয়ের পরই নতুন কাউকে নিয়ে আসবে মিঠুয়া।
হঠাৎই ওর পিঠে হাত রাখে কেউ..." কি রে তুই এখানে? আমি সারা ক্যাম্পাসে খুঁজছি তোকে?"
" তোর নাকি বিয়ে? কবে?"
" কি জানি,একজনকে ভালোবাসি যেদিন তার সময় হবে সেদিন হবে। বাবাকে বলে দিয়েছি ঐ সব বিদেশে আমার যাওয়া হবেনা...আই হ্যাভ প্রমিসেস টু কিপ।"
"ঐ গানটা একটু গাইবি মিঠু?"
" কোন গানটা?"
" সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে যেটা গাইছিলি..এলো বরষা সহসা মনে তাই,রিমঝিম ঝিম রিমঝিম ঝিম গান গেয়ে যাই।"
হি হি করে হেসে ওঠে মিঠুয়া.." ধুৎ এখন তো শীতকাল।এখন কেউ বর্ষার গান গায় নাকি?"
অরুণ হেসে বলে," আজ সহসাই যে প্রেমের প্রথম বর্ষায় ভেজার দিন।"
অরুণের পিঠে হেলান দিয়ে বসে মিঠুয়া গায়...'এলো বরষা সহসা মনে তাই,রিমঝিম ঝিম রিমঝিম ঝিম গান গেয়ে যাই।'
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment