#হৃদয়_আমার_নাচেরে_আজিকে#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
সকাল সকাল আজ উঠে পড়েছে রীতা ঘরদোর একটু গুছিয়ে নিতে হবে এর মধ্যেই।যদিও ওদের একদম নতুন ফ্ল্যাট এই তো গত বছরই কেনা হয়েছে।তবুও একটু আদুরে হাতে সব গুছিয়ে রাখা যত্নে,আজ যে রক্তিমাকে দেখতে আসবে।
মানে আজকাল দেখাশোনা আর সেভাবে তো হয়না। আগের দিনে যা হত! মাথার চুল দেখা,পায়ের গড়ন দেখা,হাঁটিয়ে দেখা ইশ্ যাচ্ছেতাই সব কান্ড।রীতারও অবশ্য দেখেশুনেই বিয়ে হয়েছে। শুভ্র তো দেখেই একদম পছন্দ করে ফেলেছিলো তবে ওর ঠাকুমা তখনো বেঁচে উনি এসে মোটামুটি বাড়ি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন রাগ হয়েছিলো রীতারও। কারণ উনি বেশ হেসে হেসে ঠাট্টার ছলে রীতার চুলের বেণী টেনেটুনে দেখেছিলেন তারপর এটা দাও সেটা দাও সেই ছুঁতোয় বেশ কয়েকবার হাঁটিয়েও দেখেছিলেন।
ওনার বালাটা রীতার হাতে ঢুকবে কিনা সেটা দেখতে হাতটাও বেশ টিপেটুপে দেখেছিলেন। এখনো বেশ মনে আছে সবটাই।
রক্তিমা এখনকার দিনের মেয়ে তাই এইসব করলে তো একদম কুরুক্ষেত্র করবে। ইংরেজী মিডিয়ামে পড়া স্মার্ট আর স্টাইলিশ মেয়ে, মাথায় লম্বা চুল একদম কালার করে স্ট্রেইট করা। অনেক সম্বন্ধই আসছে তবে রীতার মনে ধরেছে এই সম্বন্ধটা কোন ঝামেলা নেই একমাত্র ছেলে আর মা বাবা। ছেলে ভীষণ ভালো চাকরি করে বছরে দুবার তো বিদেশে যায়ই। আর কি চাই?
কালই রক্তিমাকে পার্লার থেকে পুরো গ্ৰুমড করিয়ে এনেছে।একদম ফেসিয়াল ওয়াস্কিং হেয়ার পলিশ করে আরো রঙিন প্রজাপতির মত হয়েছে দেখতে। তার মধ্যে ওর ঘাড়ের কালার্ড ট্যাটুটা ভীষণ অ্যাট্রাক্টিভ। মেয়ের সাথে সাথে নিজেকেও একটু সাজিয়ে নেয় রীতা।
সকাল সকাল ওর ব্যস্ততা দেখে মেয়ে একটু বিরক্তই হয়..." মম সকালে একটু ঘুমোতেও দেবেনা।এটা ক্লিন করছো,ওটা সাজাচ্ছো। তোমার ঐ ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের আওয়াজটা জাস্ট ডিসগাস্টিং!"
" অনেক ঘুমিয়েছিস,এবার উঠে পড় বেবি।দুপুরে লাঞ্চের পর একটু রেস্ট নিবি। ওরা তো বিকেলেই আসবে বলেছে মানে একটু তাড়াতাড়ি।"
" উহ্ সব ব্যাকডেটেড লোকজন!
দিব্যি কোথাও একটা বাইরে মিট করতাম ব্যাস হয়ে যেতো তা নয় তোমাদের একদিন ডাকলো,এবার নিজেরা আসছে।"
রীতাও প্রথমে বলেছিলো ওদের বাইরেই কোথাও মেয়ে দেখতে কিন্তু ভাবতেই পারেনি ছেলের মা এমন কথা বলবে।
উনি তো সোজাই বললেন.." আপনার মেয়ে যেখানে থাকবে মানে যদি সত্যিই ব্যাপারটা হয় সেটাই আগে দেখা দরকার। আমি তো জাস্ট যাবো একটু গল্প করতে আর শুধু কফি বা চা খাবো বেশ অনেকটা। আর কিছু ব্যবস্থা করবেননা। আজকাল আসলে খোলা বারান্দা,খোলা ছাদ আর আড্ডা খুব মিস্ করি।"
রীতা আর আপত্তি করেনি সত্যিই তো বাড়িতে বন্ধুরা যেমন আসে তেমনি আসতে চেয়েছেন। ওনার বাড়িতে যেদিন ওরা গিয়েছিলো সেদিন উনি অবশ্য রক্তিমাকে আনতে বলেছিলেন। বলেছিলেন "আমাদেরকেই যে যেতে হবে এমন নয় আপনারাও আসতে পারেন মেয়েকে নিয়ে।" সত্যিই এমনটা কজন বলে?
সব ভালোই লেগেছে রীতার খুবই ভদ্র আর রুচিশীল ওরা। বাড়িতে সারাক্ষণই খুব আস্তে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে। দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ, বুকশেল্ফে বাংলা বই। অন্দরসজ্জাও খুব সাধারণ কিন্তু রুচিসম্মত।ছেলে অবশ্য তখন বাড়িতে ছিলোনা। তাই কথা হয়েছিলো একদিন আসবেন ছেলেকে নিয়ে গল্প করতে রীতাদের বাড়ি।
************
বিকেল বেলায় ওরা এলেন, মা বাবা আর ছেলে সাথে ছেলের এক বন্ধু। রক্তিমা লম্বা,ফর্সা বেশ কাটাকাটা চোখমুখ। বাংলা কথাতেও ইংরেজীর ছোঁয়া দিয়ে আদুরে টানে কথা বলে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছে তবে বাংলা গানের চেয়ে বেশি পছন্দ ইংরেজী গান।
প্রণাম করতে ভালোবাসেনা। বাঙালী খাবারের চেয়ে কন্টিনেন্টাল পছন্দ করে,ওয়েস্টার্ন ড্রেস খুবই পছন্দ। শপিং আর মুভি দেখা ভীষণ পছন্দের।শাড়ি পরে বছরে একবারই সরস্বতী পুজোর দিন। ড্রিঙ্কসে আপত্তি নেই,স্মোক রেগুলার না করলেও মাঝে মাঝে করে। ভারতের থেকেও বিদেশে যেতে বেশি পছন্দ করে যদিও এখনো থাইল্যান্ড,মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুর ছাড়া তেমন কোথাও যায়নি।
পাশের ঘরে রীতার সঙ্গে ছেলের মা অসীমা কথায় ব্যস্ত আর দুই বাবা মেতেছেন রাজনীতি আর খেলা নিয়ে।
ওরাও তখন নিজেদের মত কথা বলছে। রক্তিমা খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলো নিজের পছন্দ আর অপছন্দগুলো।ও ঠিকই করেছিলো আগেই সব বলে দেবে।
" বাহ্ খুব ভালো লাগলো,সত্যিই তো এক ছাদের তলায় পাশাপাশি থাকতে হলে পছন্দ অপছন্দগুলো জানা খুবই দরকার।"...বললো সাম্য।
রক্তিমা হাসে মিষ্টি করে, " আমি তো সমানে বলে গেলাম,আপনি তো কিছুই বললেননা। মানে কি ভালো লাগে খেতে? বেড়াতে যেতে কোথায় ভালো লাগে? কেমন গান শোনেন? ড্রিঙ্কসে কোন আপত্তি আছে কিনা? স্মোক করেন কিনা? কি পোশাক পছন্দ করেন?"
আচ্ছা বেশ একটু ভেবে ভেবে বলি,"এই যেমন স্মোক করি তবে কম,ড্রিঙ্কস করি রেয়ার,বেড়াতে ভালোবাসি। কাজের জন্য গেছি কয়েকবার বাইরে কিন্তু দেখতে চাই নিজের দেশকে আর জানতে চাই সংস্কৃতি।প্রিয় জায়গা শান্তিনিকেতন,প্রিয় মানুষ রবীন্দ্রনাথ।রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভালোবাসি। ছোটবেলা কেটেছে শান্তিনিকেতনে তাই ভালো লাগে ওখানকার গাছপালা,লালমাটির পথ আর খোয়াইয়ের ধার। পায়জামা পাঞ্জাবী পরতে বেশি ভালো লাগে।"
রক্তিমা হাসে..." তাহলে তো মিললোনা আমার সাথে পুরোটা।"
বেশ কিছুক্ষণ কথার পর একটু গুমোট লাগে সাম্যর। এদিকটায় বেশ গাছপালা ফাঁকা ফাঁকা ওদের পাড়াটা পুরোনো তাই একটু ঘিঞ্জিও। সত্যিই এবার একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে।
রক্তিমাকে বলে.." এর ওপরেই তো ছাদ তাইনা? একটু যাওয়া যাবে? তাহলে আমরা দুইবন্ধু দেখে আসতাম চারধারটা। আসলে একটু স্মোক..."
রক্তিমা বলে.." হ্যাঁ আপনারা যান,আমাকে মা একটু ডাকছে আমি আসছি একটু বাদেই। রক্তিমা চুলগুলো সামনে করে চলে গেলো নিজের ছন্দে। ওর ঘাড়ের ট্যাটুটা দৃশ্যমান হয়ে ধরা দেয় সাম্যর চোখে।
ছাদে উঠে মনটা ভালো হয়ে যায় সাম্যর চোখে পড়ছে বর্ষার ছোঁয়ায় সবুজ সুন্দরী একটুকরো কলকাতাকে, চারপাশটা বেশ ভালো। ছাদটাও অনেক বড়। হঠাৎই কানে আসে একটা খুব পরিচিত গানের হাল্কা আওয়াজ ছাদের অন্য পাশ থেকে।পা দুটো কেন যেন এগিয়ে যায় সেদিকেই অজান্তে। আকাশ থেকে তখন হাল্কা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নেমেছে আপন মনে গাঢ় নীল ময়ূর রঙের শাড়িতে সেজে নাচছে একটা মেয়ে এলো খোঁপায় বিভোর হয়ে শেডের তলায় স্ট্যান্ডে লাগানো ক্যামেরা। বুঝতে পারে সাম্য নাচের রেকর্ডিং হচ্ছে,চোখ দুটো আর কোন শাসন মানতে চাইছেনা।
সাম্যর পা দুটোও যেন বাঁধা মানছেনা অবাধ্য হতে চাইছে এতদিন বাদে শ্যামাকে দেখে। সেই মাধ্যমিকের পর আর কোন যোগাযোগ ছিলোনা শ্যামার সাথে। কত খুঁজেছে অথচ পায়নি।শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সাম্যও নাচতো।
সেই ছোট থেকে বসন্তউৎসবে,বৃক্ষরোপণ উৎসবে কত নেচেছে শ্যামার সাথে।
শ্যামার গায়ের রঙ কালো কিন্তু ওকে দেখে বোধহয় কৃষ্ণকলি কবিতাটা বারবার বলা যায়। অথবা বলা যায় তন্বী,শ্যামা,শিখরদশনা।
নাচের ছন্দে বিভোর শ্যামার লক্ষ নেই কোনদিকেই..তখনো গানটা বাজছে শত বরনের ভাব উচ্ছ্বাস কলাপের ন্যায় করিছে বিকাশ..আকুল পরাণ আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচেরে।
ওর বন্ধু হাতে একটু চাপ দিলেও নিজেকে আর সামলাতে পারেনা সাম্য। আকাশ থেকে তখন বৃষ্টি ঝরছে নিজের মত ঝিরি ঝিরে করে শ্যামার সাথে বহুদিন বাদে পা মিলিয়েছে সাম্য। দুজনের মুখেই আজ বহুদিন বাদে মিলিত হওয়ার মৃদু হাসি।
বৃষ্টি হচ্ছে দেখে রক্তিমা ছুটে এসেছে ছাদে। তবে অবাক হয়ে যায় শ্যামার সাথে সাম্যকে এভাবে নাচতে দেখে ..গানটা তখনো হচ্ছে..হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মত নাচেরে।
ওর বন্ধুর কাছে শুনে বাকিটা জানতে পারে যে শ্যামা সাম্যর ছোটবেলার বন্ধু। রক্তিমা নিচে নেমে আসে।
বৃষ্টিতে ভিজেই দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে বন্ধুত্বের নিবিড় বন্ধনে। কতদিন বাদে দেখা।
*****************
" শোন সাম্য ভালো ছেলে হলেও কপালটা সত্যিই খারাপ। শেষে ঐ শ্যামার মত একটা কালো মেয়েকে মনে ধরলো?" খুব রাগ হয় রীতার।
" মা সম্পর্কগুলো ওপর থেকেই বোধহয় তৈরি হয়ে আসে। আমার জন্যও হয়ত অপেক্ষায় আছে অন্য কেউ যার সাথে আমার পছন্দগুলো মিলে যাবে। সাম্য সত্যিই আমার সাথে মিসম্যাচ ছিলো মা। ওর তেমন কোন পছন্দই তো আমার সাথে মেলেনি।"
সাম্যর ধন্যবাদ দেওয়া ছোট চিঠিটা যত্নে রেখে দেয় রক্তিমা। মনে মনে বলে ভালো থাক ওরা বর্ষায় অথবা ব্যাকুল করা বসন্তে। যখন রক্তিমা মুভি দেখে বা মোৎজার্ট শোনে তখন সাম্য আর শ্যামা পা মেলাবে মনের আনন্দে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছন্দে। মনের মিলটাই বোধহয় সুখী জীবনের চাবিকাঠি, জোর করে কি কিছু পাওয়া যায়?
#শ্রাবণ_সঙ্গীতের_ত্রিধারা#
#আমার_লেখনীতে#
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment