#নীল_শাড়িটা#
রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#
কুমকুম আলমারিটা খুলতেই দুমদাম করে চারটে শাড়ি পড়ে মাটিতে। মনে হচ্ছে শাড়িগুলো মাটিতে পড়েই ওর দিকে তাকিয়ে খ্যাক খ্যাক করে একটা হাসি দিলো। মেজাজটা খচু হয়ে যায় একেবারে, আর সময় পেলোনা হতচ্ছাড়া শাড়ি,খেলো গড়াগড়ি একদম বরের সামনেই!
ঠিক সেই সময়েই কিঙ্কর ঘরে ঢুকে ঠিক ব্যোমকেশ স্টাইলে একটা গোয়েন্দা লুক দিয়ে অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে আড়াল করা আলমারির ভেতরে চোখ চালাতে চাইলো যেটা একদমই বরের সামনে খোলেনা কুমকুম। আজ নেহাতই হঠাৎ ছেলের বায়না বাইরে খেতে যাবার।
যদিও কুমকুমের ইচ্ছে ছিলো কুর্তা পরে ম্যানেজ করে নেবে,ইদানীং বপুবৃদ্ধিতে বেশ ঢোলাঢালা জোব্বা টাইপ ম্যাক্সিড্রেসই ম্যাজিসিয়ানের মত মধ্যপ্রদেশ আর বর্ধিত ক্ষেত্র বিশেষ সবই বেশ ম্যানেজ করে দেয়। তবুও আদুরে বাধ্য বৌয়ের মত বরকে জিজ্ঞেস করতেই বিপত্তি," হ্যাঁ গো কি পরে যাবো।"
" অবভিয়াসলি শাড়ি পরবে। শাড়িতে কিন্তু তোমাকে একদম ফাটাফাটি লাগে মানে তোমার ঐ শাড়ির সাতকাহনে আমার চোখের অবগাহন আর সব মিলেমিশে তুমি বিদ্যা বালন।"
আর নিজেকে সামলাতে পারেনা কুমকুম তাই খুলেই ফেলে ওর শাড়ির ঠ্যালায় শ্বাসবন্দী আলমারিখানা। ব্যাস আর কি সুযোগ পেয়ে আনন্দে গড়াগড়ি করলো বেশ কয়েকটা শাড়ি,তাদের সাথে দল মেলালো আরো কিছু। কুমকুমের তখন জেরবার অবস্থা ওদের শাসন করে সামলাতে।মোটামুটি চুলের ঝুটি ধরে এক একটাকে আলমারিতে ঠুসছে।
" ইশ্ আলমারিটার কি অবস্থা গো,যে কোনদিন তো মনে হয় শাড়ির চাপে দম দেবে। রাখার জায়গা নেই তবুও তো কিনেই যাচ্ছো একের পর এক।"
একেই মাথা গরম মানে সাজুগুজু করার আগেই অবাধ্য শাড়িদের সামলাতে ল্যাজেগোবরে তারপর বরের টিপ্পুনি মার্কা কথায় আরো পিত্তি জ্বলে যায় কুমকুমের, শাড়ির খোঁটা তো দিনরাত দিয়ে যাচ্ছে। আবার কোথাও গেলে বলে শাড়ি পরো।
" এই শোনো শাড়ি নিয়ে একটা কথাও তুমি বলবেনা। বিয়ের সময় তো এই গুণ সেই গুণ দেখে হাতে ধরালে হাড়ি।গয়নাগুলো সব লকারে,পরার মধ্যে ঐ শাড়িগুলোই যা পরি তবুও সবসময় ওটা নিয়েই তোমার মাথাব্যথা।"
বৌয়ের মাথা গরম তাই একটু পিছু হটে কিঙ্কর.." আরে কেনো শাড়ি,তবে কোরনা বাড়াবাড়ি। মানে এটা কাঁথা শাড়ি,ওটা ভাব না আড়ি,আবার ঐটা বালুচরী।"
কিঙ্করের মজার কথায় একটুও ভালো লাগেনা কুমকুমের," কটা শাড়ি হাতে করে কিনে দিয়েছো শুনি? বলো কটা শাড়ি হাতে করে এনেছো? দোকানে নিয়ে গিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকো। কোনদিন এনেছো হাতে করে একটা শাড়ি?"
কিঙ্করের বুকে গিয়ে লাগে কুমকুমের শক্তিশেল তারপর আবার চোখ ছলছল। একটু বাদেই হয়ত ঝরবে জল। ইশ্ কেন যে ঘাটাতে গেলো? সেই মুহূর্তে গৃহত্যাগ করলেই হয়ত শান্তি আসতো,তবে উপায় নেই দেখে রুমত্যাগ করে পাশের রুমে গেলো কুমকুমের সাড়ে চব্বিশ বছরের পুরোনো বর কিঙ্কর।
যেতে যেতে গিন্নীর নাকটানার আওয়াজ পায়,বুঝতে পারে মনটা খারাপ হয়েছে কুমকুমের, শাড়ি টানাটানি অনেকটা মান নিয়ে হানাহানির মত ওর কাছে। মনে মনে ভাবে যাক আজ রাত্রে ভালোয় ভালোয় খাওয়াটা হয়ে যাক।
নিজে জামাটা পরতে পরতে হঠাৎই মনে হয়,সত্যিই তো এই জামাটাও কুমকুমের পছন্দ করে আনা। যখনই বাইরে যায় কেনাকাটা করতে হাতে করে ওদের বাপ ছেলের জন্যও কিছু নিয়ে আসে,মুখের দিকে তাকায় একটু ভালো শোনার অপেক্ষায়। বডি স্প্রে গায়ে ছড়ানোর সময়ও তাই মনে হলো এটাও তো কুমকুমের আনা। চারিদিকে সব আনাতেই আছে কুমকুমের আনাগোনা আর এত কিছু করেও কথা শোনা! না একদম ঠিক নয়। যাক এখন একদম মুখ বন্ধ থাক।
ছেলেও এসে মায়ের পক্ষ নিয়ে বাবাকে একটু দিয়ে গেলো হাল্কা করে,"বাবা এটা ঠিক করোনি।কোথায় মাকে একটু হেল্প করবে তা নয় শাড়ি দেখেই তোমার শুরু হলো। সত্যিই তো কটা শাড়ি তুমি দাও?এ বুটিক সে বুটিক ঘুরে মা কেনে সব। ভাগ্যিস একটা চাকরি করা বৌ পেয়েছিলে।"
******************
একটু দেরিতে হলেও কুমকুম এসে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নাকটা একটু লাল লাল লাগলেও কিঙ্কর দেখলো চোখে আইলাইনার লাগাচ্ছে। যাক কিছুটা নিশ্চিন্ত।
মাঝে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন, হঠাৎই ওদের অফিসে শাড়ি নিয়ে এক ভদ্রমহিলা এসেছেন।মানে উনি আসেন মাঝেমাঝেই এবার চোখে পড়েছে কিঙ্করের,নাহ্ এই সাড়ে চব্বিশ বছরের বদনাম এবার মুছে ফেলতেই হবে। তাই মহিলাদের শাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি আর কাড়াকাড়ির মধ্যেই হাত লাগায় কিঙ্কর.." দেখি ঐ নীলশাড়িটা,এটা কি সিল্ক?"
পাশ থেকে রুমেলা বলে," কি ব্যাপার দাদা,কিছু স্পেশাল নাকি?হঠাৎই শাড়ি!"
ওকে খুব একটা পাত্তা না দিয়ে নিজেই পছন্দ করে ঐ নীলের সাগরেই ঝপাং করে একটা ডুব মারলো সাথে সাথে খসে গেলো ছহাজার। শাড়িটা নাকি কাশ্মীরী স্টিচের। যাক খসুক তবুও বদনাম মুছুক। একদম দুইহাতের দশআঙুলের আদরে যত্নে তুলে দেবে কুমকুমের হাতে শাড়িটা।
বাড়িতে এসে একখানা বেশ চওড়া দাঁত বের করা হাসি হেসে বললো," নিয়ে এলাম, ভীষণ পছন্দ হয়েছে শাড়িটা।"
কুমকুম বললো," ওহ্ বাবা তাই নাকি? দাঁড়াও আজকের দিনটা লিখে রাখি। চব্বিশবছর সাতমাস বাদে আনা শাড়ির কথা।"
নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগলো কিঙ্করের ধুর ব্যাপারটা জমলোনা। তবে গায়ে ফেলে বেশ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শাড়িটা দেখে আলমারিতে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় কুমকুম। দীর্ঘশ্বাস পড়লো কিঙ্করের এইরে ছহাজার ঢুকে গেলো শেষে আবার আলমারিতে।
কুমকুম মনে খুশির ছোঁয়াটুকু গোপনই রাখলো ভাবলো বিয়ের তারিখে শাড়িটা পরবে। কিন্তু লকডাউনে আর অসুখের তান্তবে মনটা বড় অশান্ত। কেন যে শাড়িটা সেদিনই গায়ে দিলোনা?
অসুখের ছোঁয়া লাগলো কুমকুমের সংসারেও।কদিন ধরেই কিঙ্করের জ্বর ডাক্তারের পরামর্শে একদম আলাদা আছে কিঙ্কর,পজেটিভ হলেও ধীরে ধীরে সেরে উঠছে।
ক্যালেন্ডারে চোখ রাখে কুমকুম, কাল একুশদিন শেষ হবে। পরশু ওদের বিয়ের তারিখ। কিছু না হলেও কিঙ্করের পাশে বসে মেঘছেঁড়া আকাশের একমুঠো রোদ মাখবে মুখে চোখে। কদিন মেঘলা মনে একফোঁটাও আনন্দ ছিলোনা।
ঘরের দরজা খুলে অনেকদিন বাদে বাইরে পা রেখেছে কিঙ্কর। নিচে গিয়ে কুমকুমকে খোঁজে দেখতে পায়না,সিঁড়ির দিকে তাকায়। হাতে ফুলের সাজিতে টগর,জবা আর নীল অপরাজিতা নিয়ে উঠে আসছে কুমকুম। অবাক হয়ে যায় কিঙ্কর সেই শাড়িটা না! কিন্তু কাল তো ওদের বিয়ের তারিখ।
" শাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর, কেন যে কালকে পরবো বলে এতদিন পরিনি? আজকের ভালোটা আজই মুঠোভরে নিতে হয়। তুলে রাখলেই বাসী হয়ে যায়।"
কিঙ্করের চোখে শুধুই মুগ্ধতা তখন,যদিও সবার জীবন থেকে চলে গেলো নিঃশব্দে অনেকগুলো দিন তবুও শেখালো অনেক কিছুই যেমন কুমকুমও শিখলো আজকের ভালোটা আজই নিতে হয় মুঠোভরে।
আজকে,তারপর কাল,তারপর আবার একটা আজ এভাবেই ভালো থাক সবাই তাদের জীবনের ছোটছোট খুশিগুলো নিয়ে।
#আমার_লেখনীতে#
#শাড়ি_কাহিনী#
সমাপ্ত:-
Comments
Post a Comment