Skip to main content

লিভিং টুগেদার

#লিভিং_টুগেদার#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

#শেষটুকু#

   "আচ্ছা এমন শুনেছিস কখনো বিয়ের কথা শুনে ছেলে বাড়ি থেকে চলে যায়? মেয়েরা শুনেছি অনেক সময় বাড়ি থেকে চলে যায় কিছু না বলতে পেরে ভয়ে।"

           " মা ও কোথাও যায়নি কলকাতা গেছে। এই আমাকে মেসেজ করেছে।কাল ওদের বন্ধুদের মধ‍্যে কথা হয়েছে ওখানে ঠাকুর দেখবে ওরা। কি পাজি দাদা দেখেছো কতদিন আমি কলকাতার ঠাকুর দেখিনা।"

           " বাড়ির পুজো ছেড়ে কলকাতা যাওয়া সাত সকালে চুপিচুপি, দাঁড়া দেখাচ্ছি আমি।"

            যতবারই ফোন করে শান্তা দেখে ছেলের ফোন নেটওয়ার্ক সীমার বাইরে। বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে বলে..." শোন কাউকে কিছু বলিসনা, বলবি অফিসের একটা কাজে যেতে হয়েছে। আমার হয়েছে জ্বালা ছেলের দোষ ঢাকতে মিথ‍্যে কথা বলা।"

            মায়ের কথাতে মাথা নাড়ে ডল।

      যথারীতি আবার বাড়ির কাজে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই।পুজোর বাড়ি আবার অতিথি আসছে তাই অনেক কাজ আছে।

          মাঝে কেটে গেছে কিছুটা সময় অতিথিরা চলে এসেছে। মহা মুশকিল এসেই ওরা জিজ্ঞেস করে রাণার কথা,সবার এক কথা ছেলে কই।

      " আসলে ওর অফিসের একজনের আসার কথা তাকে রিসিভ করতে গেছে এয়ারপোর্ট। তারপর কিছু কাজও আছে।"..কথাগুলো কোন রকমে বলেই ওদের আদর আপ‍্যায়ন করতে লেগে যায় রাণার মা। ওরা ভীষণ খুশি অনেকদিন বাদে ফেসবুক মিলিয়ে দিয়েছে বন্ধুর সাথে বন্ধুকে তারপর আবার এই পুজোবাড়িতে আসা সব মিলে একদম জমজমাট ব‍্যাপার।

         খাবার গুছোতে গুছোতে ডলকে ওর মা বলে," দাদাকে পেয়েছিস ফোনে?"

         ফোনটা মায়ের নাকের ডগায় আনে ডল "এই দেখো পুতুলদি স্ট‍্যাটাস দিয়েছে সবাই মিলে কোথায় যেন খাচ্ছে। 
ও মা!অনেক ছেলেমেয়ে তো এখানে। 
আচ্ছা ময়না কোনটা হতে পারে?"

       ডলকে ইশারা করে ওর মা।
পরে চুপ করে বলে ,"মুনিয়াই তো ভালো ছিলো আবার ময়না কেন? 
দেখিস তো যে মেয়েটার পাশে বসে সে কিনা।"

        " মা দাদার পাশে কে কিছু বোঝা যাচ্ছেনা।"

        "ফোন করতো ওকে,তোর বাবা খুব রাগ করছে"।
         ফোন করতেই মাখন লাগানো গলায় রাণা বলে," সত‍্যিই কাল অনেক রাতে জানতে পারলাম,অফিসের একজন আসবে তাই হঠাৎই চলে আসতে হলো।ডলকে জানিয়েছি তো।"

            " আমি কিছু জানিনা তুই বাড়ি ফিরে আয় তাড়াতাড়ি। কাকে রিসিভ করতে গেছিস ময়না?"

          রাণার মুখটা হাঁ হয়ে যায়..." কোন ময়না? মা আজকে ঠাকুর দেখার প্ল্যান হয়েছে সব বন্ধুরা আছে এখানে।কাল সকালেই চলে যাবো।"
             " তোর বাবার বন্ধুরা এসেছে। তোকে খুঁজছে। কাল করিসনা আজই চলে আয় বাড়িতে পুজো।"
        " আচ্ছা দেখছি আমি। তুমি একটু ম‍্যানেজ করে নাও প্লিজ।"

             

                        মুনিয়াদের বাড়িতে যাওয়াটা ভালো দেখায় না তাই জুনিদের বাড়িতে থেকেই ওদের আড্ডা ঠাকুর দেখা খাওয়া সব চলছে।
         মুনিয়াকে সবটা বলেছে রাণা.." শোন এমনিতেই আসতাম আমি কথাই ছিলো একসাথে ঠাকুর দেখবো তারপর যেই শুনলাম বাবার বন্ধু আসছে আমাকে দেখতে আমি হাওয়া।"

      মুনিয়ার মুখটা সিরিয়াস লাগে.." বুঝলি আমার বাড়ি থেকেও খোঁজাখুঁজি করছে। মা বলছে আর একা ওখানে থাকতে দেবেনা তাই পাত্র চাই করতে কোমর বেঁধেছে।"

         " শোন রাণা,আজ রাতে মুনিয়ার বাড়িতে আঙ্কেল আন্টির সাথে দেখা করে বলেই দে কথাটা, মুনিয়া ঘ‍্যানঘ‍্যান করছে সারারাত ঠাকুর দেখলে মা বকবে। কারো কোন চাপ থাকবেনা,আর মনে হয় আন্টি আপত্তি করবেনা। মুনিয়া তুইও তো বলতে পারিস মাকে রাণার কথা।" জুনি বলে

       হাসে মুনিয়া," কতবার আর ভালোবাসার এক কথা মাকে বলবো। দেখি শেষে তো বলতেই হবে।"

                   এবার সত‍্যি নার্ভাস লাগে রাণার ইশ্ এতো সেই সিনেমার ঢঙে বলা আমি আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। ইশ্ মা শুনলেই বা কি বলবে।
            "শোন খাওয়াদাওয়া ঠাকুর দেখা মোটামুটি হয়েছে,আমি এখন বাড়ি যাই। মা বারবার ফোন করছে। প্রমিস মা বাবাকে পাঠাবো মুনিয়ার বাড়ি। বলছি কোন সমস‍্যা হবেনা।"
         জুনি হাসে," মুনিয়া দেখেছিস কেমন ভীতুর ডিম। তার থেকে তুই চল ওদের বাড়ি গিয়ে বলবি আপনাদের ছেলের কোথাও বিয়ে হবেনা।"

       মুনিয়া কাজললতার কথা ভেবে কেমন থমকে যায়। রাণা ওর ঘাড়ে হাত রাখে.." মা বাবা আমাদের ছোট থেকে বড় করেছে তাই এই ব‍্যাপারে ওরাই একটু প্রাধ‍্যান‍্য পাক।"

                      রাণার পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ অনেকটা রাত হয়ে গেছে। মা তখনো জেগে কাজ করছে.." তুই বললি যে সারারাত ঠাকুর দেখবি আবার কি হলো? সেই এলি যদি একটু বিকেল বিকেল আসতিস দেখা হত। খাবি তো?"

               রাণার মনে তখন বাজছে একটা কথা যা করেই হোক মাকে রাতেই বলতে হবে। মায়ের কাছে এসে বলে..." আচ্ছা মা সেই কাজললতাটা তোমার কাছে আছে? ওটা আবার মুনিয়াকে দেওয়া যায়না?"

                   মায়ের মুখটা দেখতে অদ্ভুত গম্ভীর লাগে রাণার..." ও তাহলে এতো সব কান্ড চলছে, তা ময়না আবার কে? ঐ কাজললতা তো ঠাম্মার কাছে। আমি জানিনা কিছু তুই দেখ ঠাম্মাকে বলে।"

              " ময়না কেউ না,ময়নাই মুনিয়া মা। নামটা ভুল করে সেভ হয়ে গেছে। তুমি ঠাম্মাকে একটু বোলো। আসলে মুনিয়ার খুব খারাপ লাগছে।"

          " তুই কাল সকালে ঠাম্মার পুজোর পর গিয়ে বলিস।আমার এখন অনেক কাজ। এইজন‍্য তুই বাড়ি থেকে চলে গেছিস তা আগে বললে কি হত শুনি?"
                   মায়ের হাবভাব দেখে খুব একটা খুশি হয়েছে মনে হলোনা।সারারাত ভালো করে ঘুম হলোনা রাণার।ও চলে এসেছে বলে ওরাও আর রাতে ঠাকুর দেখার প্ল‍্যান ক‍্যানসেল করেছে।

              ভোরবেলায় উঠে পড়ে রাণা সত‍্যিই এবার পুজোটাও যেন কেমন চাপে চাপেই কেটে গেলো।প্রথমে মুনিয়া না আসার চিন্তা তারপর বাড়ি থেকে চলে যাওয়া আবার আজকে কি করবে কে জানে?

           রাণা জানে ঠাম্মু সকালে দশটার আগে ফ্রী হয়না।তারপর আবার আজ দশমী...মন্ডপে গিয়ে দেখে ঢাকিরা তখনো ঘুমোচ্ছে।বাড়িও চুপচাপ তখনও কারো ঘুম ভাঙেনি।

              দুর্গা ঠাকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রাণা মা বলতো নবমীর পরেই ঠাকুরের মুখ ভার হতে থাকে আর দশমীর বিকেলে মায়ের চোখদুটো লাগে কান্নাভেজা। মায়ের সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ায় রাণা মনে মনে বলে মা একটু সামলে নিয়ো সব কিছুই। বাবা মাকে যেন রাজী করতে পারি মুনিয়ার বাড়ি যেতে। ঠাম্মা আবার কি বলবে কে জানে? সব মিলিয়ে মনে যেন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলছে। দুগ্গামন্ডপ থেকে বাইরে এসে ক্ষীরপুকুরের ধারে এসে বসে রাণা চার পাশের গাছগুলোর ডালে কত চেনা অচেনা পাখির বাসা আর তাদের কিচিমিচিতে মনটা হারিয়ে যায়। বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে এই করে।হঠাৎই পেছনে শোনে....." এই তো পেয়ে গেছি।চল চল চা জলখাবার খাবি। ও হাঁফিয়ে গেলাম।মা তো বললো আবার তুই পালিয়েছিস নাকি?"

             বকবক করতে করতে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় ডল। বলে," দাদা মনে আছে আমাকে ছোটবেলায় কেমন টানতে টানতে স্কুলে নিয়ে যেতি? আজ আমি নিয়ে যাচ্ছি টানতে টানতে তোকে। হ‍্যাঁ রে ময়নাটাই মুনিয়া, মা বললো। আমার কি মজা হচ্ছে মুনিয়াদি বৌদি হবে।"
          " খুব পাকা হয়েছিস না? একদম কান মলা
দেবো।" বলে রাণা

         " কে কাকে কানমলা দেয় দেখবি এবার?বাবা তো ভীষণ রেগে আছে তোর জন‍্য বন্ধুদের কাছে কথা থাকেনি বাবার। আর ঠাম্মা কেমন দেবে দেখো।"এক নিঃশ্বাসে বলে যায় ডল।

        সত‍্যিই ছোটবেলার মত আজ পেটটা কেমন গুড়গুড় করছে রাণার।টেনশনে ভালো করে লুচি খেতেও পারলোনা। বাবার মুখোমুখি এখনো হতে হয়নি..বাবা বাজারে গেছে তবে ঠাম্মার ঘরে যেতে হবে এবার।

**************

          ঠাম্মার ঘর বাড়ির একদম শেষে, ঘোরানো বারান্দা দিয়ে যেতে হয়।এখনো বাড়িতে সবাই ঠাম্মা দাদুকে মেনে চলে।মাকেও তেমনই দেখেছে রাণা।

          ঘরে উঁকি দিতেই একগাল হাসি দেয় ঠাম্মা," আমি ভাবছি তাই আমার দাদা গেলো কোথায়?কাল সারাদিন তোমাকে দেখিনি। এবার তো গপ্পই হলোনা তেমন তোমার সাথে। এসো এসো। এবার সেই নাচ হবে তো? ধুনুচি হাতে?"

         ঠাম্মা বলাতে একটু সুযোগ পায় রাণা..." আমি তো তেমন নাচতে পারিনা ঠাম্মা, গতবছর বন্ধু এসেছিলো তাই।"

           " তা এবছর তাকে আনলেনা কেন?
আমি তো ভাবলাম তুমি কলকাতা গেছো তাকে নিয়ে আসবে। 
সে যা হোক নাচ কিন্তু হবেই আমার দিদিভাইরা তো আছে।তারাই বা কম কি?"

           " ঠাম্মা ঐ কাজললতা তোমার কাছে আছে নাকি গো?" বলে রাণা।

       " কেন রে দাদা? আছে তো।তোর বৌ এলেই দেবো ভেবেছি তাই তো মায়ের পায়ে ঠেকিয়ে রেখেছি।"

         একগাল হাসে ঠাম্মা...
রাণা একটু কিন্তু করে বলে," না তোমার নতুন দিদিভাই যদি আসে..."

         পুরো কথাটা বলে ওঠা হয়না রাণার হঠাৎই বাইরে বাবার গলার আওয়াজ পায়। বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে ঠাম্মা বাইরে বেরোয়,ঘরে বোকার মত বসে রাণা।

      বাইরে বেশ কথার আওয়াজ শুনতে পায়..." আপনি বলেছেন আর না এসে পারি। কাল যদি থাকতো রাণা তাহলে আজ আর আসতে হতোনা।"
          কে এলো আবার! ওর বাবার সেই বন্ধু নাকি? এবার তো আর পালাবার পথই নেই। উঃ সত‍্যিই কি যে মুশকিল। কি করবে এখন?

       বাইরে থেকে বাবার বেশ গুরুগম্ভীর গলার আওয়াজ পাওয়া যায়..." রাণা বাইরে আয়।"

          আর কোন উপায় নেই অগত‍্যা বাইরে বেরোনো।
         হঠাৎই যেন মনের মধ‍্যে একটা গান বেজে উঠলো..' তুমি এলে অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো। তুমি এলে অনেক কথা এলোমেলো মনে হলো। তুমি এলে অনেকদিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো।'

             ইশ্ শরতের রোদের মিঠে আলোয় ভরেছে উঠোন তবুও হঠাৎই বৃষ্টির গান মনে হলো কেন? তবে বৃষ্টি তো নেমেছেই মন জুড়ে। ভিজিয়ে দিচ্ছে ওর প্রেমিক মনটাকে যা এতক্ষণ ভয়ে চুপসে ছিলো।

           মুনিয়ার পরনে আজ সোনালী জড়ির  পাড়ের গাঢ় সবুজ সিল্কের শাড়ি,কপালে সবুজ টিপ। এবার পুজোতে ওকে কিনে দিয়েছে এই শাড়িটাই জোর করে রাণা। মাথা নিচু করে ঠাম্মাকে প্রণাম করছে মুনিয়া পাশে আন্টি আঙ্কেল আর পেছনে হায়নার মতো দাঁত বের করে জুনি আর পুতুল। ইশ্ এত বড় বোকা বানানো!

          ঠাম্মা কাছে ডাকে রাণাকে," একসাথে প্রণাম করতে হয় দুজনকে এসো দাদুভাই।

ইশ্ কাল কেন যে পালাতে গেলে?
নতুন দিদিভাই না এলে আমার দাদুর সাথে ধুনুচি নাচবে কে শুনি? 
পুজোর দিন দাদুটা আমার বাড়ি নেই মনটা খুঁত খুঁত করছিলো।

মুনিয়ার মা তো তোমার বাবার বান্ধবী মিতা। 
তবে ঘটক বিদায় পাবে আমার দুই দিদিভাই  পুতুল আর জুনি।"

  ঠাম্মার সব কথা যেন পাঁচমিশালি ডালের খিঁচুড়ি হয়ে ওর কানে ঢোকে কিছুই বুঝতে পারেনা ভালো করে।ইচ্ছে করে জুনিটাকে একটা দেয় আচ্ছা করে,পুতুলটাও তো কম মিচকে নয় সারাদিন ওর সঙ্গে থাকলো অথচ বললোনা মুনিয়ার বাবা মা ওদের বাড়ি গেছে। আর মুনিয়া, ও তো কিছু বলেনি তেমন। একবার বলছিলো বাবা মায়ের কোথায় একটা নেমন্তন্ন আছে রাতে আসবে তাই রাতে আর বেরোনো হবেনা।

         নিজের মাথাটাতেই দুটো থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করে রাণার।

******************

     মুনিয়ার মা হাসতে হাসতে ওর বাবাকে বলছে.."কাল মেয়েকে কত বলেছিলাম চল আমাদের সাথে ঘুরে আসবি আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে কিছুতেই এলোনা। ওর নাকি বন্ধুদের সাথে প্ল‍্যান আছে।"
           " আজ আনলি কি করে? মানে রাজী হলো?"
           " আর কি শেষে প্যান্ডোরাস বক্স খুলতেই হলো,আমার বন্ধুর ছেলের ছবি দেখাতেই ভোরে উঠে সেজেগুজে একদম রেডি। এই বয়েসে পরপর এতো জার্নি ভালো লাগে? তবুও করতে হলো মাসিমার হুকুমে দশমীতে নতুন দিদির নাচ দেখবেন উনি।"

        " তাইতো মিতা তোমাকে থেকে যেতে বলেছিলাম কাল।তুমি মেয়ের জন‍্য চলে গেলে।" রাণার মা বলে।

        ওদের দুটোকে অপরাধীর মত দাঁড় করিয়ে রেখে জুনি আর পুতুল হাওয়া ডলের সাথে ঠাকুর দেখতে।

  ******************

                   রাণা আর কৌতূহল রাখতে পারেনা ওরা সবাই তখন খাওয়াদাওয়াতে ব‍্যস্ত তখন মাকে বলে," এতদিন বাদে বাবা বান্ধবীকে পেলো কোথায়?"
          " মুনিয়ার মা খুঁজে পেয়েছে তোর বাবাকে। তোকে ফেসবুকে খুঁজতে গিয়ে।"
       রাণা জিভ কাটে লজ্জায়.." এই রে আন্টি তো রীতিমতো গোয়েন্দা। বাবার ক্রাশ ট্রাশ ছিলো না তো?"
        ওর মাথায় একটা চাঁটি মারে ওর মা," ডুবে ডুবে জল খাওয়া? কেমন জব্দ আমাদের কাছে?"

        রাণা বলে," মহারাজা,মহারাণী তোমাদের সেলাম।"
         কোথা থেকে উদয় হয়েছে জুনি আর পুতুল..." কি রে আমরা কেউ নই?লিঙ্কটা তো আমরাই দিলাম মিতা আন্টিকে। আজ মুনিয়াকে নিয়ে এলাম।"

        হাসিতে জমে ওঠে দশমীর বিদায়বেলা।ততক্ষণে বাড়ির সামনে মেলা বসে গেছে। গতবারের মত মেয়েগুলো চুড়ি পছন্দ করতে ব‍্যস্ত। 
        একগোছা সবুজ চুড়ি মুনিয়ার হাতে দিয়ে রাণা বলে," এটা নে ভালো লাগবে।"

         আস্তে আস্তে বলে মুনিয়া," এবার তুমি বলার অভ‍্যেস কর। "

           দশমীর ধুনুচি নাচ শুরু হবে একটু বাদেই রাণার ধুতি পাঞ্জাবি দিয়ে গেছে মা সাদা পাঞ্জাবি তে লাল প‍্যাচ বসানো বাবা কাকারও এক ড্রেস। 
      তৈরি হয়ে আয়না দেখে রাণা...

    " আরে কি লাগছে! আমরাও আছি কিন্তু।"

        ওরে বাবা! লাল সাদাতে রেডি মহিলা বাহিনী। সব নাকি মায়ের দেওয়া। কি আশ্চর্য সব ব‍্যাপার ছুপকে ছুপকে হয়েছে শুধু ওরা দুইজন কিছু জানেনা।
                 আজ আর রাণাকে বলতে হলোনা নাচতে। মন তো নেচেই রয়েছে তাই এমনিতেই শরীর নাচছে ঢাকের ছন্দে আর আনন্দে।
     নাচতে নাচতে তাকায় রাণা, ঠাম্মার পাশে বসে দাদান। মুগ্ধতা সবার চোখে। 
    জুনি বলে," ইশ্ আমার বরটা এলে বেশ হাত ধরে নাচতাম।ক্লাব নিয়ে এত ব‍্যস্ত যে এলোই না।"

                 মুনিয়াকে আজ একটু বেশি লাজুক লাগছে ও বুঝতে পারে আজ অনেকগুলো চোখ ওর দিকে আটকে আছে।
           আজ নতুন মোবাইলে সেল্ফি তোলায় খুব ব‍্যস্ত ওর মা বন্ধু আর হবু বেয়ানের সাথে।
                             নাচ প্রায় শেষ,মায়েরা সিঁদুর খেলছে। ঠাকুরের চোখটা ছলছলে পানপাতা বাতাসার সাথে সাথে প্রদীপের শিখার আলোয় মায়ামাখা ঠাকুরের মুখ।

                          মুনিয়ার গালে সিঁদুরের ছোঁয়া মুনিয়া হাসছে।মুখের লালিমা ছড়িয়ে পড়েছে মনেও। ওর একদম কাছে এসে দাঁড়ায় ছবি তোলার সময় রাণা জুনি ঠেলে দেয় ওদের..." নাও নাও পুজোর প্রেম করে নাও। সামনেবার আর সুযোগ হবেনা।"
       অবাক হয়ে যায় মুনিয়া.." কেন?"

  " আবার কেন?
সামনেবার রায়চৌধুরী বাড়ির বৌমা মাথায় ঘোমটা দিয়ে পুজোর কাজ করবে,ঠাকুর বরণ করবে। 
তাই এখন যত খুশি নেচে আর নাচিয়ে নাও।"

          " ইশ্..এখনি বিয়ে! বয়েই গেছে"..মুনিয়া বলে।

********************

         বিসর্জনের শেষে বিজয়া শুরু,রাণার মনে হয় খুব গতবারের কথা। মা বলে দেয়," ঠাম্মা দাদানের ঘরে যাবার সময় যেন মুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে যায় রাণা। যথারীতি খাম আর মিষ্টির হাড়ি আর নাড়ু নিয়ে ঠাম্মা বসে। বোনেরা সব খুশিতে ভরপুর পেটে আর পিঠে ভালো করে দিয়েছে ঠাম্মা। রাণা মুনিয়াকে নিয়ে প্রণাম করে ঠাম্মাকে। ওদের হাতে খাম দিয়ে মিষ্টি খাইয়ে ঠাম্মা বলে...
  " নতুন দিদি ঠাম্মার চোখটা বুড়ো হলেও বুঝেছিলো এই নতুন দিদিই আমাদের কাজললতা থেকে কাজল পরবে। তা তুই তো সেটা ফেরত দিয়ে গেছিস চুপ করে।"

     মুনিয়া বলে," আবার যদি চাই দেবেনা তুমি?"

           ঠাম্মা বলে..." ও তো এমনি দেওয়া যাবেনা আর,অনেক নিয়মকানুন আছে একেবারে সুদসমেত ফেরত দেবো।"
                লজ্জা পায় মুনিয়া।হাসে রাণা..." আবার সুদও দেবে?"

      "দেখতেই পাবি সময়ে। এখন যা আনন্দ কর।"

      ছাদে গানের আসর বসেছে রাণা গেয়েই ফেলে...' তুমি এলে অনেকদিনের পরে তাই বৃষ্টি হলো।'
             মুনিয়া গাইছে...' বারে বারে তোর আয়না ভেঙেচুরে ফিরে এলাম,আমার মতে তোর মত কেউ নেই।'
       ডল বলে.." এমা এটাতো দাদার গান।"
   পুতুল হেসে বলে," এখন এটা দুজনেরই প্রিয় গান।তাইনা রে মুনিয়া?"

       ওদের কলকাতা ফেরার সময় হলো প্রায়,ঠাম্মা বলে," কবে আছি কবে নেই বেশিদিন সময় নিয়োনা নতুন দিদি তোমার সুদসহ উপহার ফেরত নিতে।"

        লজ্জা পায় মুনিয়া। ওর মা বলে," আমি কথা বলে জানাচ্ছি মাসিমা।"

                     ***************

সামনের বসন্তে যখন মুনিয়ার বারান্দা জুড়ে ফুলের মেলা। ঠিক তখনই কোন এক উদাসকরা বিকেলে গোধূলি লগ্নে রাণাদের বাড়িতে সানাই বাজছে আর সাথে হৈ হুল্লোড়। বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা।পিছিয়ে নেই ঠাম্মাও,দাদানের শরীর ভালো নয় তাই সবার ইচ্ছে ছিল বিয়েটা হয়েই যাক।
                 মুনিয়ার গায়ে হলুদের তত্ত্বের সাথে একটা চিরকুট আসে ঠাম্মার লেখা.." বেশি কান্নাকাটি কোরনা নতুন দিদি তোমার আসল পাঠালাম সুদ সমেত। ঠাম্মার পাঠানো রূপোর মিনে করা গাছকৌটো আর কাজললতা হাতে নিয়ে বেনারসী পরে মুনিয়ার সাথে মালাবদল,দৃষ্টিবদল আর মনবদল হয়ে গেলো রাণার।

     

             মুনিয়াকে লালপাড় গরদ পরে বরণ করে 
গোলাপের পাপড়ি ডোবানো দুধ আলতায় পা ডুবিয়ে ঘরে আনলেন ঠাম্মা হাতে সিঁদুর কৌটো দিয়ে বললেন," আজন্ম এয়োস্ত্রী হয়ে থাকিস নতুন দিদি।চোখে যত্নে মাখিস ভালোবাসার কাজল।"

       সবই ভালো ভাবে হলো শুধু চাপ গেলো জুনির আর পুতুলের ওরা নাকি বরপক্ষ আর কনেপক্ষ দুইই। তাই রীতিমতো খেটেখুটে বেহাল অবস্থা। তবে পুতুলকে খুব পছন্দ হয়েছে রাণার পিসিমণির ভাসুরের মনে হয় ভ্রমরের আনাগোনা এবার শুরু হবে ওর জীবনেও।

******************
     রাণার ফ্ল্যাটটা ছেড়ে আপাততঃ মুনিয়ার ওখানেই চলে এসেছে রাণা। বসন্তের ফুলগুলো মাথা নাড়ছে আনন্দে। অফিস যাওয়ার জন‍্য ছুটোছুটি চলছে..মুনিয়া অভ‍্যেসমত হাঁক দেয়," গিভ মি টাওয়েল রাণা ডোন্ট বি নটি....কি করছো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।" আজ আর কোন বাধাই নেই ওদের মাঝে...ওর পেলব হাতটা ধরে বলে," হোক দেরি মিসেস রায়চৌধুরী উই আর নিউলি ম‍্যারেড....সো দুষ্টুমি চলতে পারে।"

          এই শহরটাকে আরেকবার নতুন করে ভালো লাগে রাণার। খুব ভালোবাসতে ইচ্ছা করে। একটা সময় ভেবেছিল এই শহর ছেড়ে হয়ত চলে যাবে খুব তাড়াতাড়ি। সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো মনে হত তখন। বাড়ি থেকে নতুন আসা এখানে তারপর ভীষণ কড়া রুম পার্টনার সব মিলে লাইফটা একদম হেল হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল।

      তারপর কোথা থেকে যে মনখারাপের আকাশে উড়ে এল রাশি রাশি শরতের রোদ্দুর মাখানো ঝুরো ঝুরো নীল সাদা মেঘের দল বুঝতেই পারেনি রাণা। প্রথম প্রেমের বিচ্ছেদের পর হঠাৎই দ্বিতীয় বার প্রেমে পড়ে রীতিমত হাবুডুবু খাওয়া। মুনিয়া মজা করে একদিন রাতে  আদরে ডুবে যেতে যেতে," এই একটা কথা বল না সত‍্যি করে?"
   রাণা একটু সিরিয়াস হয়ে যায় হঠাৎই," কি কথা বলব সত‍্যি করে।"
   " আমার প্রেমে কবে পড়লি প্রথম? খুব জানতে ইচ্ছে করছে আজ। কেন জানি না হঠাৎই। একমাস তো হয়ে গেল,দুজন এত কাছাকাছি আছি তাই না?

" আবার সেই তুই তোকারি! ঠাম্মু বারণ করেছে কিন্তু। কবে আবার প্রেমে পড়ব? সে জানি না পড়েছিলাম হঠাৎই হয়ত কোনদিন। এত সুন্দরী মেয়েকে চোখের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখলে যে কারও মনে দোলা লাগে। আর আমি তো একটা পুরুষ মানুষ তাই নয় কি? অবশ‍্য আমাকে মানুষ বলেই তো ভাবতিস না তখন।"
  " ইশ্ যত সব বাজে কথা। কত ব্রেকফাস্ট করে কফি করে খাইয়েছি। আদর করে বিছানা পেতে থাকতে দিয়েছি তারপরেও অভিযোগ। ওসব ছাড় এখন প্লিজ বল না, আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে।"

           নতুন বৌয়ের আব্দারে আবার ঢোক গেলে রাণা কি করে বলবে, ঐ ফ্ল্যাটে থাকতেই মুনিয়াকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল। তারপর আলাদা ফ্ল্যাটে যখন এল তখন খুব মিস্ করতে শুরু করল মুনিয়াকে।
      প্রথম যেদিন মুনিয়াকে বাইকে করে ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিল সেদিনের কথাটা আজও ভুলতে পারে না রাণা। তারপর মুনিয়ার দেওয়া চিরকুটটা আর গিফ্ট।
   " ঘুমোতে হবে না নাকি? না কাল অফিস নেই বলে আজ সারারাত জাগবি? অবশ‍্য জাগলে মন্দ হয় না। আগে আরেকটু কাছে আয় তারপর বলব, খুব কাছে।"
" রাণা,প্লিজ দুষ্টুমি করে না। বল না। সত‍্যিই তো কাল পরশু পরপর ছুটি আছে। গল্পই তো হয় না তেমন করে। আজ একটু গল্প করতে ইচ্ছে করছে। মানে প্রথম প্রেম কিভাবে হয়েছিল জানতে খুব ইচ্ছে করছে।"

   " একবার মাথার পোকা নড়লেই হল তাই না? কি করে শুরু করব বল তো? এই যেমন তোর ফ্ল্যাট থেকে যাবার পর খুব মিস্ করতাম তোকে। যদিও আমি জানতাম তুই আমাকে তাড়িয়ে বেঁচেছিলি। তারপর যেদিন তোকে বাইকে করে নিয়ে এসেছিলাম প্রথম খুব ভালো লেগেছিল অনেকদিন বাদে তোকে দেখে। অনুভব করেছিলাম তোর ছোঁয়া। মনে হচ্ছিল আরেকটু এইভাবেই যদি পথ চলা যেত।"

  রাণাকে অনেকগুলো চুমু খায় মুনিয়া,ওর নরম হাতে এলোমেলো করে দেয় রাণার চুলগুলো। আদরে ভাসে রাণাও। 
মুনিয়া আদুরে গলায় বলে," আচ্ছা, এত কিছু ছিল মনে? আমি তো কিছু বুঝতেই পারিনি। ইশ্ খুব মিস্ করেছি। এখন হলে ভালো করে জড়িয়ে বসতাম বাইকে।"
 " এখন হলে মানে কি? এখন তো আমার কাছেই আছিস। একদম কাছে।( মুনিয়ার এলোমেলো চুলগুলো রাণার চোখেমুখে লাগে। রাণা ওর মাথায় হাত রেখে নিজের কাছে টানে) ও বুঝলাম তখন যদি আমার প্রতি ফিলিংস থাকত তোর। মানে এখন যেমন আছে। তারপর তুই যখন ঐ যাচ্ছেতাই কান্ডটা করলি তখন ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। সারারাত বলেছিলাম ঠাকুরকে মুনিয়া ভালো থাকুক। ঐ পৃথিবীর যেখানেই থাক না কেন ভালো থাক মেয়েটা। আর খুব রাগও হয়েছিল। মনে হচ্ছিল খুব বকে দিই। মুখেই শুধু বড় বড় কথা। এদিকে হারতে এত ভয় পায়। জীবনে না হারলে যে জেতার মজাটাই পাওয়া যায় না।"

                  মুনিয়া রাণার বুকের মাঝে মুখটা ঢুকিয়ে রাখে ঠিক পাখির ছোট ছানার মত, কেন যেন রাণার কথা শুনে হঠাৎই চোখটা ঝাপসা হল। সত‍্যিই কি প্রথম প্রেম ভোলা যায়? হয়ত যায় না। কিন্তু রাণাকে ও এখন খুব ভালোবেসে ফেলেছে,খুব। ওর জীবনের শুকিয়ে যাওয়া গাছটাকে আবার যত্ন করে আদরের বারিধারায় সিঞ্চিত করে ফুল ফুটিয়েছে রাণা। ওকে হাসতে শিখিয়েছে আর বাঁচতে শিখিয়েছে। 
       শ্বশুরবাড়িতে সবাই কত আদরে ভরিয়ে রেখেছে ওকে। এমন করে মেঘভাঙা বৃষ্টির মত পুরোনো যা কিছু তছনছ করে আবার নতুন নতুন কত আশার জন্ম নেবে ওর জীবনে কখনও ভাবেইনি মুনিয়া।
                রাণা এক মনে বলতে থাকে কথাগুলো, মুনিয়া চুপ করে শোনে কি সরল ভাবে বলে যাচ্ছে সব কথা রাণা।
     হঠাৎই রাণা চুপ করে যায়," কি হল কিছু বললি না তো? এখনও জানতে চাস ভালোবাসি কিনা? ঠাকুমার কাছ থেকে কাজললতা কে চেয়েছিল শুনি? তুই তো ফেরত দিয়ে এসেছিলি।"
     " দিয়েছিলাম তো,সত‍্যিই তখন তো ভাবতেই পারিনি একদিন ঐ কাজললতা পাওয়ার জন‍্য একদিন আমাকে তপস‍্যা করতে হবে। খুব মন খারাপ হয়েছিল ফিরিয়ে দিয়ে। আবার নিতেও পারিনি। তুই বুঝবি না সবটা। তোরও তো খুব রাগ হয়েছিল তাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলি।"
       রাণাকে সবটা দোষ দিয়ে চুপ করালেও মুনিয়ার মন আবার ওকে বকল এসে। সত‍্যিই তো ও নিজেও চেয়েছিল রাণা চলে যাক।
      অফিসের পর প্রমোদ আসবে বলে কত কি কিনেছে। সাজিয়েছে ওর ছোট ফ্ল্যাটটা নিজের মত করে। তারপর একটা সময় ভেঙেচুরে গেছে সবটা। অদ্ভুতভাবে রাণা কখনও ওর অতীত নিয়ে কিছু জিজ্ঞেসা করেনি। মুনিয়ার মাঝে মাঝে মনে হয় রাণা কি সব কিছু জানে ওর ব‍্যাপারে? জুনি কি ওকে সব কিছু বলেছে? অবশ‍্য জুনিও হয়ত জানে না সবটা। প্রেমের সব অনুভূতি কি সেভাবে শেয়ার করা যায়?

         বরং ও একদিন জিজ্ঞেস করেছিল রাণাকে বিয়ের আগেই। "তোর তো একজন এক্স ছিল,তাই না? সে আবার কোনদিন আসবে না তো ফিরে মানে খুব তো ভালোবাসতিস তাকে। তার জন‍্য আমাকেও এড়িয়ে চলতিস।"
   " এড়িয়ে চলতাম না, ভয়ে থাকতাম। ঘর পোড়া গরু তো। এক কথা তো আমিও জিজ্ঞেস করতে পারি মুনিয়া। কিন্তু করব না। আমরা না সবাই অতীত নিয়েই জীবনের বেশি সময় কাটিয়ে ফেলি। তার থেকে আয় না একটু বর্তমান বা ভবিষ‍্যত নিয়ে ভাবি। ভালো থাকি যা পেয়েছি তাই নিয়ে।"
     মুনিয়া রাগ করেছিল শুনে," খুব ঝগড়ুটে তো তুই। কত কথা বলে দিলে! যা পেয়েছি তাই নিয়ে মানে আমি কি খারাপ নাকি? মানে যা একটা কিছু নিয়ে অ্যাডজাস্ট করে নিলি জীবনে?"
     রাণা ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছিল ওর অভিমান মোছাতে। শেষে রবীন্দ্রনাথকেই স্মরণ করেছিল...আমি তোমারে পেয়েছি সকল সাধনে। রাণার গান শুনে অভিমান ভেঙেছিল মুনিয়ার।

       রাণা অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। মুনিয়ার চোখে ঘুম নেই। এলোমেলো চিন্তার জট ঘুরে ফিরে এসে গোল পাকায় মস্তিষ্ক নামক অতি সক্রিয় যন্ত্রটিতে। রাণাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করে মুনিয়া। ঘুমের ঘোরেই আরেকবার রাণা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সত‍্যিই ভীষণ কেয়ারিং ওর বরটা।

************************

    বিছানায় এলোমেলো চুল ছড়িয়ে বালিশে মুখ ডুবিয়ে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা। হঠাৎ হঠাৎ পাগলামি মাথায় চেপে বসে। কাল কত রাত অবধি বকবক করে গেল যা মনে এল তাই বলল। খবরের কাগজ এনে, ইলেকট্রিক কেটলিতে গরম জল বসায় রাণা। তারপর সবুজ চায়ের ছোট্ট ব‍্যাগ তাতে ফেলে বারান্দায় এসে বসে। চা খাবার মাঝে গাছের তদারকি করা আর শুকনো পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলা। কচি পাতাগুলোর সবুজে মনকে সবুজ করা কিছুক্ষণ। উল্টোদিকের ফ্ল্যাট থেকে মিস্টার আয়ার হাত নাড়েন। অপরিচিত জায়গাতেও বন্ধু হয়ে যায় কেউ কেউ। ওঁরা বয়স্ক,মুনিয়া আর রাণা দুজনকেই খুব ভালোবাসেন। ওদের ফ্ল্যাটের একটা চাবি ওদের কাছেই রাখা আছে।
       মিসেস আয়ার মুনিয়ার খোঁজ করেন রাণা হাসে ইশারায় দেখায় এখনও ঘুমোচ্ছে। একটা হাসির রেখা খেলে যায় ওদের মুখেও। 
                          হঠাৎই মুনিয়া এসে দাঁড়ায় পেছনে," ইশ্ সকাল হয়ে গেছে কতক্ষণ! ডাকনি কেন? মিস্ করলাম গাছে জল দেওয়াটা।"
      মুনিয়াও হাত নাড়ে ওদের। তারপর আলস‍্যে আর অগোছালো কথায় বারান্দায় কিছুক্ষণ বসে থাকতে থাকতেই ফোন আসে মায়ের.." কি রে ঘুম থেকে উঠেছিস? তোর বাবা সেই কখন থেকে বলছে মেয়েকে ফোন কর। আমিই চুপ করিয়ে রেখেছি বলছি দাঁড়াও ঘুম ভাঙুক মেয়ের। হ‍্যাঁ রে আজ কি খাবি? চা খেয়েছিস? আজ তো নিশ্চয় কিছু স্পেশাল হবে? কে রাঁধবে তুই না রাণা? সত‍্যিই আমার বন্ধুর ছেলেটা ভীষণ ভালো। এইরকম একটা জামাই পেয়ে একদম নিশ্চিন্ত আমরা।"
      রাণা কিছু কথা শুনতে পায় ব্রেকফাস্ট বানাতে বানাতে। টুক করে বলে যায়," মামণি ঠিকই বলেছে। যা পাগলী মেয়েটা,একটা ভালো গার্জেন দরকার ছিল। এই যে মেমসাহাব আপকো গ্ৰীন টি। ব্রেকফাস্ট আ রহা হ‍্যায়।"
      ভালোবাসায় রাণার গালটাতে আদুরে গাল ছোঁয়াছুঁয়ি করে নেয় একবার মুনিয়া। রাণা ওতেই খুশি হয়ে চলে যায়। তারপরেই মায়ের সাথে খুনশুটির ঝগড়া শুরু করে," আচ্ছা মা,তোমাদের মেয়েটা কি বেগুণ নাকি? যত গুণ তোমার বন্ধুর ছেলের তাইনা? সারা সপ্তাহ অফিস করি,একদিন একটু বসিয়ে খাওয়াবে না। কাজের আবার ছেলেমেয়ে কি শুনি? ও এখন ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। তারপর আমরা দুজন মিলে লাঞ্চ বানাব। তুমিও বাবাকে নিয়ে রান্না কর একসাথে। দেখবে ভালো লাগবে।"
  " তাহলেই হয়েছে! এক গ্লাস জলও ভরে খায় না। তুইও যেমন তেমন তোর বাবা।"
     " মা আমি এখন অনেক কাজ করি,তুমি বাবাকে ট্রেনিং দাও বরং। এখানে এস,তোমাকে সব কিছু বানিয়ে খাওয়াব। মানে যা খেতে চাও।"
          ওপাশ থেকে বাবার সাড়া পাওয়া গেল," দিলি তো রবিবারটা মাটি করে। আর পেপার পড়া যাবে না শান্তিতে। সবে বাজারটা করে এসে বসেছি। এক্ষুনি কোন কাজ চাপাবে ঘাড়ে। তুই তো বেশ এখন বসে অমলেট টোস্ট খাচ্ছিস।"
      বাবার কথা শুনে হেসে ওঠে মুনিয়া,"বাবা নো চাপ। তোমাকে রান্নাঘরে নিয়ে মা আর চাপ নেবে না আমি জানি। কোন কাজই তো শিখলে না এতদিনে। রাণার কাছে একটু ট্রেনিং নিলে পারতে। আমরা পাস্তা খাচ্ছি আজ। আজকে টোস্ট নয় বাবা।"
    " আহা,আহা বেশ তো খা ভালো করে। আমার রুটি আলু ছেচকি আসছে।"
   " ট্রেনিং নেওয়ার বয়েস পার হয়ে গেছে মুনিয়া। এই জিনিসকে ট্রেনিং দেওয়া!....আমার বন্ধুর ছেলের মত কি সবাই নাকি? কি করছে রাণা? দে একটু কথা বলি।"
      " তোমার বন্ধুর সঙ্গে ব‍্যাপারটা কি ছিল একদিন জানতে হবে আমাকে ও বাড়িতে বাপিকে ফোন করে। আমি চেনালাম বন্ধুকে। মানে আমার জন‍্য চিনলে আর শুধু বন্ধু আর বন্ধু। নাও কথা বল এবার।"
         রাণা কথা বলতে শুরু করে। হঠাৎই মুনিয়া খেয়াল করে বেচারার তো খাওয়া হয়নি। মা বাবা এখন বেশ কিছু সময় নেবে ও জানে। উইকএন্ডে একটু ভালো করে কথা বলার সময় হয় ওদের। মানে আড্ডাটা বেশ জমে। তাড়াতাড়ি করে প্লেটটা এনে রাণার মুখে খাবারটা দেয় মুনিয়া। মুনিয়ার এইটুকু যত্নই অনেক বড় প্রাপ্তি মনে হল রাণার।
            মুনিয়াকে আদরে জড়িয়ে ধরে রাণা খেতে খেতে কথা বলতে থাকে। মুনিয়া চাপা গলায় বলে," হাতটা ছাড়ো খাওয়াব কি করে?"
      ওদের ছোট্ট ভালোবাসার বাসার প্রেমের দখিনা হাওয়ার ছোঁয়া কিছুটা হলেও পৌঁছয় মুনিয়ার মায়ের কানেও। মনে মনে শান্তি পায় অনেকটা এই ভেবে যে ভালো আছে মেয়েটা। দমবন্ধ করা একটা অতীত একটা সময় তো ওকে মেরেই ফেলেছিল প্রায়। তবুও সব অন্ধকার কাটিয়ে আলোমাখা ঝলমলে সকালটা এসেছে মুনিয়ার জীবনে।

          ***************************
রাণা আর মুনিয়া এখানে আসার পর অনেকবার মা বাবা আর ডলকে বলেছে এখানে আসতে। কিন্তু সংসারের ঝামেলায় আর হয়ে ওঠেনি। যদিও রাণার বাবা একটু উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন," ওরা এত করে বলছে নতুন সংসার দেখতে যেতে। আমি একদিন বরং যাই সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে আসি সেবারের মত।"
   " অত দরকার নেই,তোমার ছেলের এখন দেখাশোনার লোক হয়েছে। দুটিতে মিলেমিশে আছে আবার কেন যাওয়া সেখানে হুটহাট শুনি? আর ওরা তো আসছেই সামনের ষষ্ঠীতে। তাছাড়া পুতুলের বিয়েও তো আছে সেই সময়।"
        ডল আরেকবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল," মা পুতুল দি যে কি করল কে জানে? যেই বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেল অমনি ব‍্যস্ত হয়ে গেল বিয়ে করার জন‍্য একদম। পিসিমণির ভাসুর কি গো? এই পচা গরমে ছেলের বিয়ে দেবে? আমি হলে তো একদম রাজি হতাম না।"
        শান্তা বকুনি দেয় ডলকে," কেমন পাকা হয়েছে দেখেছ! এইসব কথা পুতুল শুনলে কি ভাববে? জন্ম,মৃত‍্যু আর বিয়ে কখন হবে কেউ বলতে পারে নাকি?"
      " জন্ম আর বিয়ে আজকাল ভগবানের হাতে নেই। এই তো তুমি বল আমার এই পৃথিবীতে আসার তারিখ ডাক্তার ঠিক করেছিল। আর সেদিনই তোমার পেট কেটে আমাকে বের করল।"
   " ওহ্ কিছু কথা জানে আমার এই মেয়েটা! আমি চললাম কাজে। রাতে একটু ভিডিও কল করিস তো দাদাকে। সকালে ওদের অনেক কাজ থাকে। তারপর দুটোই তো ঘুমকাতুরে।"

     সকালে মা বাবার সাথে কথা বলে আর রাতে কৃষ্ণনগরের আদরের গন্ধ মেখে ছুটির দিনটা ভালোই কেটে যায় রাণা আর মুনিয়ার।
           ফোনে পুতুলের বিয়ের আর ষষ্ঠীর প্ল‍্যানিং কিছুটা হয়ে যায়। সত‍্যিই পুতুলের বিয়েটা হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল। রাণাকে বলতেই রাণা বলেছিল," পুতুল খুবই ভালো মেয়ে। ভালোই হয়েছে আমাদের চেনাজানা বাড়িতেই ওর বিয়েটা হল। কৌশিক খুব ভালো ছেলে,ভালো ফুটবলও খেলে।"
      রাণার কথা শুনে মুচকি হাসে মুনিয়া," পুতুলের ওপরেও তোর ক্রাশ ছিল নাকি? মানে আমার প্রেমে পড়ার আগে?"
   " কি যে বলিস না? একটা দুটো দিন ছুটি পেয়ে একটু ভালোবাসা বাসি করব তা নয় শুধু জেরা। পুতুল ভালো মেয়ে,ভালো লাগত ওকে। তবে বন্ধুর মত,আর অন‍্য কিছু না।"
     " তোর পরদা পছন্দ করা,ঘর সাজানোর অ্যাডভাইস কে দিত শুনি?"
  " যে দিলে খুশি হতাম। সে তো তখন আমাকে পাত্তাই দিত না। তাই অগত‍্যা। পুতুলের কি খবর রে? আজকাল তো আমার সাথে কথাই হয় না। অবশ‍্য আমার হোয়াটস অ্যাপ ফেসবুক তেমন করে দেখাও হয় না।"
   " আর কি করবে? তোর ভালো ছেলে কৌশিকের সাথে এদিক সেদিক ঘুরছে। তবে ওর শ্বশুরবাড়ি মনে হয় একটু কনজারভেটিভ। তাই একটু চুপিচুপি সব কিছু।"
    " সবাই তো আমাদের মত দিলওয়ালে নয় মহারাণী। মোটামুটি বাড়ির লোকজন এমন কি ঠাম্মুও কোমরে গামছা বেঁধে বাড়ির ছেলেকে ঝুপ করে প্রেম সাগরে ফেলেই ছাড়ল।"
     রাণার বাংলায় বক্তৃতা শুনে মুনিয়া একটা চুমু দিয়ে বলল," অনেক হয়েছে, আমার ঘুম পাচ্ছে চল এখন একদম সোজা টু বেড।
    কাল জুনির ওখানে যেতে হবে মনে আছে তো। জুনিটাকে অনেক দিন দেখি না। কাল একটু সকাল সকাল উঠে একটু রান্না করে নিয়ে যাব।"
          " সব মনে আছে মহারাণী,কাল রাতে ঘুমোও নি আজ ঘুমোও ভালো করে। নাহলে জুনি আমাকে বকবে ঘুমোতে দিচ্ছি না বলে। আচ্ছা জুনির কি কোন খবর আছে নাকি? বেশ কদিন অফিসে আসে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম কিছু বলল না।"
       কোন উত্তর না পেয়ে মুনিয়ার গায়ে হাত রাখে রাণা। বুঝতে পারে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। যাক শান্তি।

****************************
আজ সকালে বারান্দার পাখিগুলোর কিচিরমিচির শুনে ঘুম ভেঙেছে মুনিয়ার। উঠে পড়ে আলস‍্য ছেড়ে। একটু ফ্রায়েড চিলি চিকেন করবে জুনির জন‍্য। কিছুই নাকি খেতে ইচ্ছে করছে না। রাণাকে অবশ‍্য এখনও কিছু বলেনি মুনিয়া। আসলে এখনও টেস্ট করেনি জুনি। তবে ওর মনে হচ্ছে হয়ত পজেটিভ হতে পারে রিপোর্ট।
                 রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজে উঠে পড়ে রাণা। টেবিলে ততক্ষণে ফ্লাক্সে আর ক‍্যাসারোলে সব রেডি দেখে। তার সাথে এক টুকরো চিরকুট...জলদি খাবি,শেভ করবি, তারপর স্নান করে রেডি হবি। শেষে দুটো গোল্লা গোল্লা লাভ সাইন। সকাল সকাল মনটা খুশি হয়ে গেল। একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে গুডমর্ণিং বলেই নিজের কাজে লেগে পড়ল।

         অনেকদিন বাদে জুনির ওখানে এসেছে ওরা। জুনিটা বেশ রোগা হয়ে গেছে।
    রাণা ওর সাথে মজা করে," কি ব‍্যাপার ওয়েট লস করছিস নাকি? ভালোই লাগছে বেশ।"
 জুনি হাসে," মুনিয়া কিছু বলেনি তোকে? মনে হয় গুডনিউজ কিছু আসছে তোদের জন‍্য। আজই জানতে পারলাম ফাইনালি।"
      মুনিয়া জড়িয়ে ধরে জুনিকে,চক চক করে ওর গালে চারটে চুমু দেয়। অম্লান হাসে ওর কান্ড দেখে। রাণা কনগ্ৰ‍্যাচুলেশন জানায় অম্লানকে।
    অম্লান ওর সাথে মজা করে," হ‍্যাঁ অবশেষে ফ‍্যামিলি বাড়াতে যাচ্ছি মনে হয়। এরপর তুমিও ভাবো।"
   -" দাঁড়াও,এখনও হানিমুন সারতে পারলাম না।"
-" সে তো প্রতিদিনই হানিমুন এখন। আর সেটা তো উটিতেই হয়ে গেছে। ওখানে মুনকে দেখেই তো মুনিয়াকে হানি লেগেছে।"
    -" অম্লানদাও কিছু মজা করতে পারে,মুনিয়া হেসে ফেলে এবার। আসলে মুডটা খুব ভালো আছে তাই বোধহয়।"
-" তা তোমরা কোথায় যাচ্ছ হানিমুনে? সত‍্যিই তো।" বিয়ের পরই তো যেতে পারতে।"
-" দাঁড়াও একটু ভালো জায়গায় যাবার কথা ভাবছি।"
           -"মুনিয়া কি রে কোথায় যাচ্ছিস সিক্রেট হানিমুনে? বল না।"
-" আমি কিছুই জানি না। আমার কলকাতা আর কৃষ্ণনগর করে ভালোই সময় কেটে যাচ্ছে। এখন টু মাচ এক্সাইটেড আমি পুতুলের বিয়ে নিয়ে আর সামনেই জামাইষষ্ঠী। তাছাড়া আমাদের ফ্ল্যাটে তো নিত‍্য হানিমুন অম্লানদা বলেছে।"
     রাণা মুনিয়ার কথার খোঁচাটা এনজয় করে। দেখা যাক একটা বড়সড় সারপ্রাইজ দেওয়া যায় কিনা মুনিয়াকে?

     মুনিয়ার আনা চিকেন সাথে অম্লান শেফের ফ্রায়েড রাইস আর ফিস ফিঙ্গারে খুব ভালো কাটল দিনটা। পুতুলের বিয়েতে জুনিরও নেমন্তন্ন আছে কিন্তু জুনি কি যেতে পারবে তখন? সেটা নিয়েও জোর আলোচনা চললো। জুনি না গেলে তো জমবেই না পার্টি।
-" শরীর ঠিক থাকলে তো আমি যাবই,অনেকদিন বাড়ি যাই না রে। সবাই আমাদের মিস্ করছে।"
     ্
-" তাহলে তো খুব মজা হবে সবাই মিলে অনেক আনন্দ।"

    আনন্দের একপশলা মিঠে মন ভালো করা প্রথম গরমের বৃষ্টি নিয়ে ওরা ফিরল ওদের বাড়িতে।
      আজ পুতুলের সাথেও ভিডিও কলে অনেক কথা হল। মুনিয়াকে নাকি বিয়ের সাতদিন আগেই যেতে হবে। ও না গেলে শাড়ি কেনা হবে না।
       মুনিয়া বকবক করতেই থাকে," আচ্ছা এতদিন আগে যাওয়া কি সম্ভব হবে? কে জানে অফিস ম‍্যানেজ করতে পারব কি না? আচ্ছা তুই পারবি এতদিন ছুটি নিতে?"
     রাণা হাই তোলে," তুই আগে চলে যাস,আমি বিয়ের আগের দিন যাব। আমার ঐসব শাড়ি গয়না কেনা পোষাবে না।"
-" একসাথেই যাব দুজনে, আমি যাব না আগে। সব সময় আলাদা থাকার চিন্তা। তুই একদম সেই আগের মতই থাকলি। তুমি এখন ম‍্যারেড ব‍্যাচেলার নও।"
-" তা আর জানি না। পাশে আমার বৌ শুয়ে আছে। কি করে বলি আমি ব‍্যাচেলর বা লিভ ইনে আছি। যতই বৌ তুই তোকারি করুক বর বলে পাত্তা না দিক। তবুও যাকে ঠাম্মু ভালোবেসে কাজললতা দিয়েছে তাকে কি ভুলতে পারি?"
         রাণার আদরে নিশ্চিন্তে মুখ ডোবায় মুনিয়া।

*****************************
কলকাতার বাতাসে তখন শুধুই বন্ধুর বিয়ের গন্ধ।ঢাউস ট্রলি নিয়ে নামে রাণা আর মুনিয়া। অনেক ম‍্যানেজ করে আসা অফিসকে। আজকে সারাদিন পুতুলের সাথে শপিংয়ের প্ল্যান।
        পুতুলটা একগাদা কাজ জমিয়ে রেখেছিল মুনিয়ার জন‍্য। একদম সোজা জবাব," তোর বিয়ের সব করেছি,মানে বিয়েটাই তো সাজিয়ে দিলাম আমি আর জুনি। সুতরাং কিছুটা পরিশ্রম কর ভাই বন্ধুর বিয়েতে। জুনিটা যে কবে আসবে?
  -" জুনি আসবে কিন্তু কাঁচকলা করবে সেটা জানিস তো। বরং ওকেই চোখে চোখে রাখতে হবে আমাকে। অম্লানদা একটু আপত্তি করছিল প্রথমে।"

         মাঝে কেটে গেছে দুটো দিন। এরমধ্যে কৃষ্ণনগরে ঘুরে আসতে হয়েছে ওদের। সবার আদর আর সরভাজা খেয়ে মুনিয়ার মোটামুটি অবস্থা খারাপ। এরপর আবার বিয়েবাড়ি আছে। যদিও ঠাম্মু বলেছিল," ও নতুন দিদি,কেনাকাটা তো সব করেই এসেছো। এখান থেকেই তো বরযাত্রী যাবে। তখন বরং ওদের সাথেই যেয়ো।"
        -" ও ঠাম্মু তাহলে আমাকে খেয়ে ফেলবে পুতুল। তোমার নাতিকে রেখে দাও নাহলে। আমাকে যেতেই হবে গো।"
ঠাম্মু হাসেন," রাই বিনে কি শ‍্যামের মন টিকবে এখানে? যাও দুটিতে মিলে। তবে কাজললতা থেকে টানা কাজল দিয়ো চোখে। যা সুন্দরী হয়েছ কারও নজর যেন না লাগে।"
      লজ্জা পায় মুনিয়া, রাণার চোখে টুকরো হাসি খেলে যায়।

            জুনির ইচ্ছে ছিল মুনিয়াকে আর ওকে সাজিয়েছে সুশ্রী পার্লার সেখান থেকেই পুতুলকে সাজানোর ব‍্যবস্থা করা। কিন্তু কৌশিকের ইচ্ছে ওদের বাড়িতে যেখান থেকে ব্রাইডাল মেকআপ বুক করা হয়েছে সেখান থেকেই কেউ আসুক সাজাতে পুতুলকে। কিছুদিন আগেই তো কৌশিকের বোনের বিয়েতে ওরাই সাজিয়েছে। ননদিনীর প্রেফারেন্স তাই সে কথার ওপর কিছুই বলার নেই। ফটোশ‍্যুট আর পার্লারের সব ব‍্যবস্থাই মিউচুয়‍্যাল কনট‍্যাক্টে করেছে ওরা।

       সকালটা পুরো সামলে,দুপুরের খাওয়া খেয়ে মুনিয়া আর রাণা চলে গেছিল ওদের বাড়িতে। একটু রেস্ট নিয়ে নিজেকে আর রাণাকে গুছিয়ে নিতে নিতে বাইরে কনে দেখা আলোর লুটোপুটি দেখে মুনিয়া। মনে পড়ে যায় ওর বিয়ের সন্ধ‍্যের কথা। তারমধ‍্যেই একটা ছোট্ট মেসেজ ঢুকেছে ফোনে...আমি সাজতে ঢুকলাম। তোরা তাড়াতাড়ি চলে আসিস। ফাইনাল টাচ দেওয়ার আগে একবার প্লিজ দেখে নিস তুই আর জুনি।
        রাণাকে মেসেজটা দেখায় মুনিয়া," মহারাণীর অর্ডার, আমাদের একবার দেখে নিতে হবে সাজুগুজু।"
" আচ্ছা আমি সাজব কখন বল?"
রাণা গুনগুন করে 'ও কেন এত সুন্দরী হল! দেখে তো আমি মুগ্ধ হলাম'
-" তোমার কি অত সাজতে লাগে নাকি?  
-" কি যে বল না! এতগুলো শাড়ি কিনলাম কেন তবে শুনি? তারপর আবার দুই বাড়ি থেকে পেলাম এখানে এসেই।"
    রাণা হাসে আর বলে," আমার তো ছোট প‍্যান্ট পরা মুনিয়াকেই বেশ লাগে। মানে চোখে ওটাই সয়ে গেছে।"
 -" চুপ কর,এখন মাথা গরম করাস না। অনেক কাজ আমার।"
-" এটা শ্বশুরবাড়ি তাই নো তুই, তুমি তে ফিরে এস সোনা।"

************************

       সাজানোর সময় আর অন‍্য কেউ থাকলে খুব অসুবিধা হয় সোহিনীর। তাই আগেই বলে দিয়েছিল যে শুধু ও আর ঝুম থাকবে। ঝুমকা কিছুদিন হল এসেছে ওদের পার্লারে সাজানোর হাতটা ভালো। কিন্তু একা ওকে ঠিক পাঠানো যায় না তাই সোহিনীও সাথে এসেছে। ঝুমকাকে দেখে অনেকেই আঁতকে ওঠে প্রথমে। ও কি সাজাবে? মানে পারবে তো? একটু ভালো কাউকে পাঠাতে পারতেন আপনারা? তাই এবার সোহিনী নিজেও এসেছে।
         
           মোটামুটি মেকআপ শেষ, পুতুলের কপালে চন্দনের ছোঁয়া দিচ্ছে নিপুণ হাতে ঝুমকা। সোহিনী ওর যা লাগছে এগিয়ে দিচ্ছে। আজ ঝুমকাই সব করছে একা। মাঝে মাঝে এক এক বার জিজ্ঞেস করছে," দিদি দেখ ঠিক আছে তো?"
      সোহিনী হাসে হাতের ইশারায় বলে একদম ঠিক আছে। পুতুলের চোখ বন্ধ। অনেকক্ষণ একদম পুতুল করেই ওকে বসিয়ে রেখেছে ওরা। কি জানি কি সাজাচ্ছে কে জানে? প্রথমে পার্লারের মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠেছিল পুতুল। গলাটা বিচ্ছিরি ভাবে পোড়া। অথচ মুখখানা খুব সুন্দর, হালকা নীলচে চোখ,দুধ আলতা গায়ের রঙ। লম্বা টানটান চেহারা।
            কি জানি কি ভাবে এমন হয়েছে কে জানে? ঠিকমত সাজাতে পারবে তো? এত সুন্দর একটা মেয়ে অথচ গলাটা এভাবে! সত‍্যিই অদ্ভুত মানুষের জীবন।

                  চন্দন পরানো শেষ হয়ে গেছে। পুতুলকে এখন ছোট্টখাট্টো লক্ষ্মীঠাকুরের মতই লাগছে। সোহিনী বলে," দেখ আয়নায় কেমন লাগছে? এবার গয়নাগুলো দিতে বল। আর বাড়ির কাউকে ডাক সামনে থাকবে।"
         সাজ নষ্ট হয়ে যাবে তাই ফোনটা স্পীকারেই দেয় পুতুল। মুনিয়াটা ফোন ধরছে না। কি করছে কে জানে! ওকেই তো বলেছিল শেষে মায়ের কাছ থেকে গয়নাগুলো এনে একবার দেখে নিতে মেকআপটা।
          বাধ‍্য হয়ে রাণাকে ফোন করে পুতুল..." হ‍্যালো রাণা,তোরা কোথায়?
    রাণা নামটা শুনেই হঠাৎই কেমন যেন চমকে ওঠে ঝুম।

     কান পাতে ওদের কথায় সাজাতে সাজাতে। ফোনটা স্পীকারে রাখা। রাণা কথা বলছে। বড় চেনা লাগে গলাটা ঝুমকার। কে এই রাণা?
      -" মুনিয়া সাজছে,ওর হলেই চলে আসছি। অনেকটা আগেই বলেছে পাঁচ মিনিট। এখন সেই পাঁচ মিনিটেই আটকে আছি।"
-" ইশ্ এতক্ষণ কি করছিল? আমার সাজগোজ তো প্রায় শেষ। আচ্ছা আমি মাকে ফোন করছি। ওর হলে চলে আসিস তোরা।"
     অগত‍্যা পুতুল মাকে ফোন করে।

 বেনারসী ঠিক করতে করতে বারবার হারিয়ে যায় ঝুমকা। নতুন কনের মুখে শোনা নামটা আর গলার আওয়াজটা ভীষণ চেনা ওর। রাণা, কতদিন পরে শুনল এই নামটা? তবে কি এই রাণা সেই রাণা?
          বাবা মারা যাবার পর দিদির বাড়িতে মা পাঠিয়ে দিয়েছিল কলকাতা থেকে ওকে। ওদের পরিবার খুবই সাধারণ পরিবার, পাড়াটাও ভালো ছিল না খুব একটা। ঝুমকা ছোট থেকেই দেখতে সুন্দর, একবার যে কেউ দেখলে আরেকবার ঘুরে দেখবে।
    সেই সময় মা আর কিছু না ভাবতে পেরে বলেছিল," তুই দুটো বছর ওখানেই থাক। মন্দিরা যখন বলছে ওর বাড়িতে থাকতে সেটাই ভালো। এখানে আমি আর টুটুল থাকব। এই সময় টিউশন পড়ার চাপ থাকে। রাতবিরেতে ফিরবি,এ পাড়া ভালো নয়। তার চেয়ে ওখানেই ভালো থাকবি।"
      মায়ের জন‍্য খুব মন খারাপ হলেও ঝুমকাকে চলে আসতে হয়েছিল দিদির কাছে। ওখানে গিয়ে ইলেভেনে ভর্তি হয়েছিল। রাণাকে দেখে ওখানেই। এক কোচিং ক্লাশে পড়ত ওরা। প্রথমে টুকটাক কথা তারপর মন দেওয়া নেওয়া। কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পা রেখে প্রথম প্রেম দুজনেরই। কতদিন কোচিংয়ের শেষে সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে আসত দুজনেই গল্প করতে করতে।
                  দুর্গা পূজার সময় দুজনে বন্ধুদের গ্ৰুপে ঠাকুর দেখেছে। নতুন জুতোতে ফোস্কা পড়ে পায়ে হাঁটতে না পারা ঝুমকাকে রাণা রিক্সা করে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েও গেছে। ওর দিদি মন্দিরা জানতে পেরে অনেক প্রশ্ন করেছিল সেদিন," হ‍্যাঁ রে ছেলেটা কে? দেখিস আবার এখানে এসে এমন কিছু করিস না যাতে আমার মুখ খারাপ হয়।"
- " দিদি,আমাদের কোচিংয়ে পড়ে। হাঁটতে পারছিলাম না তাই পৌঁছে দিয়ে গেল।"
-" তুই যে বলছিলি আরও বন্ধুরা যাবে তারা কোথায়?"
-" সবাই ছিল দিদি এক রিক্সাতে কজন উঠবে তুই বল।"
     বোনের কথা শুনে আর কিছু বলতে পারেনি মন্দিরা। তবে একটু কড়া হয়েছিল। তারপর থেকে ঝুমকা দেখত দিদি অথবা জামাইবাবু ওকে নিতে আসে। তখন চিঠিতে প্রেম হত,তারমধ‍্যেই ফাঁকি দিয়ে দেখা করত ওরা।
       জানাজানি হয়েছিল রাণার বাড়িতেও। শান্তার চোখে একদিন পড়ল একটা চিঠি বইয়ের তাক গোছাতে গোছাতে। খুব রাগ করেছিল শান্তা,চিঠিটা রাণার বাবার সামনে ছুঁড়ে ফেলে বলেছিল," আর কি এবার পড়াশোনা সব যাবে। এ তো প্রেমে পড়েছে দেখছি।"
          রাণার বাবা বুঝিয়ে বলাতে কোনরকম মাথা ঠাণ্ডা করেছিল শান্তা। সেবার রাণার জন্মদিনে ঝুমকাকে ডেকেছিল ওঁরা সবার সাথে। মেয়েটাকে দেখে খারাপ লাগেনি শান্তার। এই বয়েসের ছেলেরা যাতে মুগ্ধ হয় সেই রূপের ডালি সাজানো মেয়ে একদম। একটু জানতে চেয়েছিল পরিবার সম্বন্ধে। তবে সবটা শুনে মনটা একটু যেন কিন্তু করেছিল। বাবা নেই,মা অসুস্থ। এমন পরিবারে গিয়ে কতটা আদর পাবে ছেলেটা? 
     সেই একবারই রাণাদের বাড়িতে গেছিল ঝুমকা। তারপর আর যাওয়া হয়নি। ক্লাশ টুয়েলভের রেজাল্ট খুব একটা ভালো হয়নি ওর। মোটামুটি পাশ করে গেছিল।
    রাণা বলেছিল," চিন্তা নেই,তুমি কলেজে পড়। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি পেলেই বিয়ে করে নেব। দেখতে দেখতে চারটে বছর কেটে যাবে।"

           টুয়েলভের পর দিদি আর রাখতে চায়নি ওকে। অগত‍্যা আবার কলকাতায় ফিরতে হয়েছিল। শুনে খুশি হয়েছিল রাণা," ভালোই তো আমি হস্টেল থেকে চলে যাব দেখা করতে তোমার সাথে।"
        কলেজে ভর্তি হয়ে একটু একটু করে পাল্টাতে শুরু করেছিল ঝুমকা। ওর সাজগোজ দেখে অবাক লাগত রাণার। সেই দুদিকে দুই বিণুনী ঝোলানো মেয়েটাকে খুব মিস্ করত রাণা। অনেকদিন কলেজের পর আসব বলেও আসত না ঝুমকা।
       মাঝে মাঝেই ঝগড়া হত ওদের। রাণার মনে হত ঝুম ওকে অ্যাভয়েড করছে।
সেই নিয়ে ঝামেলা করত ঝুমকাও," বাড়িতে অসুবিধা ছিল বলছি তো। তুমি কি আমাকে বিশ্বাস কর না।"
    রাণা একদিন বলেই ফেলেছিল," আচ্ছা আমাকে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যেয়ো। আমি কথা বলব দরকার হলে।"
    -" না না এখন বাড়িতে যেয়ো না, আমাদের পাড়াটা ভালো নয় একদম বাজে। তারপর ওখানে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে আমাদের।"
       ঝুমকা তখন বসন্ত বাতাসে উড়ছে মৈনাকের সাথে এদিক ওদিক ঠান্ডা গাড়িতে বসে। ওর কলেজের বন্ধু মহুয়ার মাসতুতো দাদা মৈনাক। ওদের বাড়িতে জন্মদিনের নেমন্তন্নে গিয়ে আলাপ হয়েছিল মৈনাকের সাথে। একদম হ‍্যান্ডসাম,আধুনিক আর জিমে যাওয়া বলিষ্ঠ চেহারার মৈনাকের চোখে প্রেমের আগুন দেখেছিল ঝুমকা। সঙ্গে সঙ্গে অবশ‍্য পাত্তা দেয়নি। তবে একটু একটু করে ওর মনের বরফ গলিয়ে দিয়েছিল মৈনাক। প্রায়দিনই কলেজের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত মৈনাক। একসাথে মহুয়া আর ওকে নিয়ে বেরোত,তারপর কিছু খেয়েদেয়ে মহুয়াকে বাড়িতে ছেড়ে। একটু বাইরে ঘুরে বাড়ি ফেরা। এই করতে গিয়ে অনেকদিনই মিথ‍্যা কথা বলতে হয়েছে রাণাকে।
      একটা সময় হিসেবের দাড়িপাল্লায় মৈনাক আর রাণাকে মাপতে চেষ্টা করেছিল ঝুমকা। রাণাদের বাড়িতে ও ঘুরে এসেছে। গ্ৰামের পড়ন্ত অবস্থার বনেদি বাড়ি। আগেকার দিনের মত,তবে সেই ঠাঁটবাট গাড়ি ফ্ল্যাট কিছুই নেই। তাছাড়া রাণা সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে,ওরই বয়সী। মৈনাকদার পাশে ওকে আজকাল কেমন ক‍্যাবলা বলে মনে হয় ঝুমকার। পঞ্চাশ টাকা বের করতেও যেন হাত কাঁপে। ওর সাথে প্রেম করা মানে হয় বাসে নাহলে ট্রামে চড়ে কোন পার্কে গিয়ে বসা। তারপর ফুচকা বা রোল খেয়ে ফিরে আসা। ঝুমের জন্মদিনে রাণার উপহার মানে বড়জোর একটা ছোট পার্স,ক‍্যাডবেরি অথবা কানের দুল।
    সেখানে মৈনাকদা ওকে বড় হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে যায়,দামি ড্রেস কিনে দেয়। রাণাটা কেমন যেন ভীতু,খুব সাহস করে ওর হাতটা ধরে কোনরকমে। কখনও বা কাঁধে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ভাবতে থাকে। মৈনাকদার সাথে তোলা ছবিগুলো দেখে ঝুম। খুব হট দেখতে মৈনাকদাকে,রাণার মত ভ‍্যাবলাকান্ত নয়। সবসময় মা কি বলবে আর বাবা কি বলবে? মাপা টাকার মধ‍্যে চলতে শিখেছে।
      একটা সময় না পেরে দিদিকে বলেছিল সবটা। মন্দিরা খুব একটা নাক গলায় নি।
  বলেছিল," বড় হয়েছিস,তোকেই ঠিক করতে হবে। আমি দায় নেব না বাবা। তারপর বলবি আমি তোর জীবন খারাপ করেছি। মা জানে?"
-" মাকে এখনও বলিনি রে। আর মা তো আমাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে। সব সময় ঘ‍্যান ঘ‍্যান করছে বিয়ে দিয়ে দেব। আর কত পড়বি। কত ছেলেপুলের নজর থেকে তোকে বাঁচাবো শুনি? এবার সম্বন্ধ দেখব।"
-" তাহলে তো ভালোই বলে দে মাকে যে আমার যাকে পছন্দ তাকে বিয়ে করব। তোমাকে মাথা খারাপ করতে হবে না।"
     চুপ করে গেছিল ঝুম। মুখ টিপে হেসেছিল মন্দিরা। মনে মনে ভেবেছিল সত‍্যি কত পাল্টে গেছে এই দুবছরে বোনটা। ভাগ‍্যিস তখন পাঠিয়ে দিয়েছিল কলকাতা। নাহলে কত কথা শুনতে হত।
     মায়ের কাছে কিছু কিছু শুনেছে মন্দিরা। আজকাল মায়ের সাথে ঝগড়া করে ঝুম। রাত করে বাড়ি ফেরে দামি জিনিস ব‍্যবহার করে। কোথায় পাচ্ছে এসব কে জানে?
          তাই নিজে আর যেচে অপমান হতে যায়নি। বড় হয়েছে যা পারে করুক। তাছাড়া ওদের তেমন ক্ষমতাও নেই, এভাবে বিয়ে করতে চাইলে করুক।
            
*************************
বেশ অনেকদিন দেখা হয়নি রাণার সাথে ঝুমের। ফোন করলেও কিছু এলোমেলো কথার পর ফোন কেটে দেয়। দেখা করার কথা বললে কিছু অজুহাত দেখায়। সেদিন রাণার অফ ডে ছিল। একটু আগেই এসে দাঁড়িয়েছে ওদের কলেজের গেটের সামনে। এক কাপ চা নিয়ে পাশের দোকানে বসে। এদিক দিয়েই যায় ওরা,সামনের বাস স্ট‍্যান্ড থেকেই বাসে ওঠে ঝুম। আজ একটু সারপ্রাইজ দেওয়া হবে ওকে।
                      বেশ কিছুটা সময় কেটে গেছে,বাসস্ট‍্যান্ডে এসে দাঁড়ায় রাণা। হঠাৎই নজর পড়ে ঝুমকাকে, কিন্তু রাণা এগিয়ে যাবার আগেই। ও লাল রঙের গাড়িতে উঠে পড়ল। হাসতে হাসতে সামনের সীটে বসে পড়ল। রাণা একটু দেখার চেষ্টা করছিল গাড়ির চালককে। কিন্তু দেখতে পেল না ভালো করে। কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে গেল ঝুম। সেদিন খুব অস্থিরতা আর রাগ নিয়ে ফিরেছিল রাণা। রাত্রে অনেকবার ফোন বেজে যাবার পর ফোন ধরেছিল ঝুম। রাণা মাথা ঠান্ডা রেখেছিল। বলেছিল, " আমার কিছু কথা আছে সামনাসামনি বলতে চাই। তুমি কবে ফ্রী থাকবে জানিয়ো। দেখা করব।"
            সেই শেষ দেখা রাণার সঙ্গে। আইসক্রিম নিয়ে বাবুঘাটে বসেছিল ওরা। রাণা ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল খুব," তুমি কি আমাকে অ্যাভয়েড করছ? আজকাল কথা বল না দেখা কর না। সত‍্যি বল আমি কিছু মনে করব না। দু নৌকাতে পা দিয়ে চলা যায় না ঝুম।"
      সেদিন রাণাকে মিথ‍্যা কথা বলেছিল ঝুম। আজও সে কথা মনে পড়লে নিজেকে অপরাধী মনে হয় ঝুমের। বারবার মনে হয় সেই পাপের শাস্তি ভোগ করছে এখন।
   রাণাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল----" আমার দিদি আমার বিয়ের চেষ্টা করছে। আমাদের পাড়াটা খারাপ আর আমাকে এভাবে রাখতে ভরসা পাচ্ছে না। একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। তাই ওরা চাইছে আমার বিয়ে দিয়ে দিতে পরীক্ষার পর।"
     রাণা হতাশ ভাবে ওর হাতটা জড়িয়ে ধরেছিল হঠাৎই," আর দুটো বছর অপেক্ষা কর,আমি চাকরি পেয়েই বিয়ে করে নেব। একটু সময় দাও আমাকে প্লিজ। বাড়িতে বল একটু। নাহলে আমাকে একদিন নিয়ে চল।"
    ঝুম এবার বাণটা ছুঁড়েছিল রাণার দিকে," আজ এখনই বিয়ে করতে পারবে আমাকে?"
-" মানে? কি বলছ এইসব? কোথায় রাখব তোমাকে এখন? বাড়িতে মা বাবাকে কি বলব। ওদের সবার অনেক আশা আমাকে নিয়ে। তারপর আমার একটা বোন আছে।"
  -" তাহলে আর কি বলব,কিছু করার নেই আমার।"
রাণা জিজ্ঞেস করেছিল," আচ্ছা একটা কথা সত‍্যি করে বলবে?"
-" কি কথা?"
- "তুমি যার লাল গাড়িটাতে গত শনিবার হাসতে হাসতে উঠলে সে কে? তোমার নতুন বয়ফ্রেন্ড?"
    একটু চমকে গেলেও আর ঢাকে নি ঝুম সোজা বলে দিয়েছিল মৈনাকের কথা ওকে।
   সেদিনের পর রাণার জীবন থেকে হারিয়ে গেছিল ঝুম। কদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল রাণা। মায়ের কাছে ভেঙে পড়েছিল। প্রথমে খুব রাগ করলেও পরে শান্তাই বুঝিয়েছিল রাণাকে," আমি তো প্রথমেই বারণ করেছিলাম বাবু। কতটুকু বয়েস তোর বলত? এই বয়েসে তো ভুল করে মানুষ। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস।"
    একটু একটু করে সব ঠিক হয়ে গেছিল। তবে রাণার প্রথম প্রেম ঝুমকা হারিয়ে গেছিল এই জনারণ‍্যে কোথাও। রাণা ওর দিদির বাড়ি চিনলেও ওদের বাড়ি চিনত না। সুতরাং রঞ্জনা আমি আর আসব না এই গানটা গাইতে গাইতেই হারিয়ে গেছিল রাণা।

*******************************
পুতুলের সাজানো পুরোপুরি হয়ে গেছে,টানা নথ আর টায়রাতে পুরো মুখটা বদলে গেছে পুতুলের। ওর মা ওর মাথায় আলতো ছোঁয়ায় হাত রাখে," ভালো থাকিস মা, আমার সেদিনের সেই ছোট্ট পুতুল কত বড় হয়ে গেছে শ্বশুরবাড়িতে যাবে।"
     মায়ের চোখটা ছলছল করে,জলের বিন্দু জমেছে পুতুলের চোখের কোণে। ঝুম বারণ করে পুতুলকে," এখন মন খারাপ করলে সাজ নষ্ট হয়ে যাবে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে তাই না দিদি?"
        হঠাৎই দরজায় টোকা শোনা যায়..." মে আই কাম ইন?"
  -" মা মুনিয়া এল বোধহয় এতক্ষণে,আচ্ছা যাক ওর সাথেই যাব আমি। তুমি এবার একটু রেডি হয়ে নাও। একটুও তো সাজোনি। তোমার আর বাবার সব কিছু তো সাজানো ছিল।"
           দরজা খুলে যে ঢুকলো তাকে দেখার ইচ্ছে ঝুমেরও খুব ছিল। যদিও ও এখনও জানে না এই রাণা ওর এক্স বয়ফ্রেন্ড কি না?
          খুব স্মার্ট আর স্টাইলিশ দেখতে মেয়েটাকে। ঝুম ভালো করে আবার দেখে। একটা সময় ওর সৌন্দর্য দেখেও তো কত ছেলে ফিদা হয়ে গেছে। এখন সবার আগেই চোখ পড়ে ওর পোড়া গলাটাতে।
       নিজের গলাটায় আলতো করে স্কার্ফ জড়ায় ঝুম।
কান পাতে ওদের কথায় সোহিনীদির সাথে মেকআপের জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে।
-" এই যে মুনিয়া সুন্দরী এতক্ষণে! আমি কতক্ষণ তোকে খুঁজছি। না পেয়ে রাণাকে ফোন করলাম। দেখ তো ঠিক আছে সব নাকি?"
" আমি তো চোখই ফেরাতে পারছি না। সত‍্যিই ভীষণ ভালো সাজিয়েছে রে। কৌশিকদার চয়েস ভালো তার মানে।"
    সোহিনী ঝুমের ঘাড়ে হাত রাখে। আস্তে আস্তে বলে," দেখেছিস তো ওদের পছন্দ হয়েছে সাজানো। বৌভাতের দিন ও তুই সাজাবি।"
       ঝুম সোহিনীর কথায় মন দিতে পারে না। ও তখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মুনিয়াকে দেখছে। আদরে আহ্লাদে ছটফট করছে মেয়েটা। সিঁথি রাঙানো সিঁদুরে।
    হঠাৎই মুনিয়া এসে দাঁড়ায় ওর সামনে," তুমি সাজিয়েছ তাই না? খুব ভালো হয়েছে। আমি তোমার নংটা রেখে দেব। আমাদের বাড়িতে ননদের বিয়ের সময় তোমাকে ডাকব।"
 সোহিনীর দিকে তাকায় ঝুমকা। সোহিনী বলে," এই কার্ডটা রেখে দিলেই হবে। এখানেই পার্লারের নম্বর দেওয়া আছে।"
       কার্ডটা নিয়ে পুতুলের কাছে চলে যায় মুনিয়া। ছবি তোলাতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা। সোহিনীও কতগুলো ছবি তোলে পুতুলের। ঝুমও তোলে ছবি ওর সাজানো কনের।
     সোহিনী এবার চলে যাওয়ার উদ‍্যোগ নেয়। পুতুল ওদেরকে ডাকে কাছে ওদের সঙ্গে একটা ছবি তোলে। সোহিনী ঝুমের সাথেও ওদের ছবি তুলে দেয়। সাজালো তো ঝুমকাই।


ঝুমকার বারবার দেখতে ইচ্ছা করছে এই রাণা নামের ছেলেটাকে। সত‍্যি কি এই রাণা রায়চৌধুরী? রাণা তাহলে বিয়ে করেছে। ভালো আছে রাণা ওর মত খারাপ নেই। বৌ তো বেশ ভালো দেখতে। তবে নিজের আত্মাভিমান ভুলতে পারে না ঝুমকা মনে মনে ভাবে ওর মত সুন্দরী নয় ঐ মুনিয়া মেয়েটা। তবে ঐ আর কি সাজগোজ করে সুন্দর। তবে কি সত‍্যিই ও আর এখন সুন্দরী আছে?

         হঠাৎই চিন্তার ঘোর কেটে যায় ঝুমকার। সোহিনী বলে," তুই মহেশতলার মোড়ে নামবি তো? নাকি তোকে গলির মুখে ছেড়ে দেব? চল ওখানেই নামিয়ে দিই। খাবারের প‍্যাকেট আছে তো তাই ব‍্যাগটাও ভারী হয়েছে।"
     মাথা নাড়ে ঝুমকা। ওখানে বসে খেতে বলেছিল ওরা তবে দিদি রাজি না হওয়াতে ওরা প‍্যাকেট দিয়ে দিয়েছে। ভালোই হল, মা আর ও রাতে খেয়ে নেবে।
              যেটুকু সময় ছিল তারমধ‍্যে রাণা বলে যাকে চিনত তাকে দেখতে পায়নি ঝুমকা। অথচ বারবার ওর চোখদুটো ঐটুকু সময়ের মধ‍্যে কাউকে একটা খুঁজছিল। ছেড়ে এসেছে পুরোনো ঘর আর পুরোনো বর। হেলায় দূরে সরিয়েছিল একদিন যে পুরোনো প্রেমিককে তাকে আজ যে কেন খুঁজছে রাণা নামের অপরিচিত কারো মধ‍্যে?
      অনেকটা সময় জেগে জেগে বিছানায় গড়িয়ে তার কোন উত্তর পায় না ঝুমকা। বারবার একটা প্রশ্ন বিভ্রান্ত করে আর বেশ কয়েকবছর বাদে একটা নাম মনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়.....রাণা।

******************************

     জুনি আর অম্লানকে আনতে যাচ্ছি বলে ওদের বাড়িতে চলে গেছিল রাণা মুনিয়াকে ড্রপ করে পুতুলদের ওখানে। এত আগে থেকে বিয়েবাড়িতে কি করবে? তার থেকে বরং অম্লানের সাথে একটু আড্ডা দিয়ে আসতে পারবে। 
       ওদের সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসে দেখে একদম জমজমাট বিয়েবাড়ি। জুনি যথারীতি মিশে গেল মেয়েদের দলে। ওর দিকে একবার একটু তাকালো মুনিয়া। এমন একটা ভাব যেন কোথায় ঘুরে বেড়ানো হচ্ছে তোর হবে? তবে জুনিকে দেখেই কলকলানি শুরু। পুতুলকে দেখে অবাক হয় রাণা," আরেব্বাস,তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না। একদম নায়িকা লাগছে।"
      পুতুল হাসে," ভালো লাগছে? কৌশিকই সব ব‍্যবস্থা করেছে।"
    জুনি ওর পেছনে লাগে," এখন থেকেই কৌশিকের গুণগান। এই চল আমরা যাই।"
        মুনিয়া প্রজাপতির মত ছটফট করছে। রাণা মুগ্ধ হয়। বিয়ের বেনারসীতে বেশ ভালো লাগছে মুনিয়াকে। একদম বিয়ের সেদিনের মত।

      ওদের কথার মাঝে বাইরে হৈ চৈ শোনা গেল। বরযাত্রী আসছে।
 " শোন এবার আমাকে একটু বাধ‍্য বৌয়ের মত ঘুরতে হবে বুঝলি। শ্বশুরবাড়ির লোকজন সবাই আসবে তো।"
  জুনি মজা করে," পুতুলের ঘটক বিদায়টা ভালোই জুটেছে।"

    সিঁদুরের রাঙা ছোঁয়ায় লাল হয়ে লজ্জাবস্ত্র দিয়ে মাথা ঢাকলো পুতুল। জুনি আর মুনিয়া কানাকানি করল বেশ মানিয়েছে ওদের দুজনকে। শুধু আমাদের সাথে ভালো করে মিলে গেলেই ভালো।
        রাণার বাবা,ডল,কাকা,কাকিমা,পিসিমা,বোন,পিসেমশাই সবাই এসেছে বিয়েবাড়িতে। শুধু ওর মায়েরই আসা হয়নি কারণ সবাই চলে এলে ঠাম্মাকে কে দেখবে?

               মুনিয়া ননদদের সাথে মজায় মেতেছে,অনেকদিন অপেক্ষা ছিল এই বিয়েবাড়িটার।
    যথারীতি তারপরের দিন মুনিয়া আর রাণা পুতুলের সাথেই ফিরল। একেবারে বৌভাত সেরে ফিরে আসবে। শুধু জুনিটা গাড়ি জার্নির জন‍্য আসতে পারল না।

            রাণাদের বাড়িতে গিয়ে ভালো লেগেছিল পুতুলের। মুনিয়াকে বলেছিল এমন একটা শ্বশুরবাড়ি হলে ভালো হয়। শ্বশুরবাড়িতে এসে দুধে আলতায় পা ডোবায় পুতুল। কৌশিকদের বাড়িতে রাণাদের মত অত লোকজন নেই,শ্বশুর শাশুড়ি আর দেওর নিয়ে ছোট সংসার পুতুলদের। আগে সবাই একসঙ্গে থাকত এখন সবার আলাদা বাড়ি। তবে ওদের বাড়িতে কালীপুজো হয়। মুনিয়া মজা করল,দুর্গাপুজো আমাদের বাড়িতে সেরে একদম কালীপুজো দেখে ফিরব।
        কৌশিক মাঝেমধ‍্যেই এসে ঘুরে যাচ্ছে। একটু মুখচোরা কৌশিক। পুতুলের আজ কালরাত্রি। মুনিয়া সেদিনের মত কৃষ্ণনগরে ফিরে গেছে। বলে গেছে একদম বৌভাতের সন্ধ‍্যায় আসবে। কৌশিক অবশ‍্য বারবার বলছিল রাণাকে," থেকে যা না এখানে,যেতেই হবে?"
  " হ‍্যাঁ রে,এত কম সময় নিয়ে এসেছি বাড়িতে থাকাই হয়নি। একটা রাত্রি একটু থাকব সবার সাথে।

    ***************************

সোহিনী সকাল সকালই প্রস্তুতি নিয়েছে বিয়েবাড়িতে আসার। কারণ কৌশিক সম্পর্কে ওর জেঠতুতো দাদার শালা হয় তাই একদম নিজেদের মধ‍্যে সম্পর্ক সুতরাং বর্ধমান হলেও ওকে যেতে হবে। তবে ঝুমকাকে বলেছিল যদি ও যেতে না পারে তাহলে অন‍্য কাউকে নিয়ে যাবে। কারণ সেদিন রাতে আর ফেরা হবে না ওদের। একটা দিন থেকে দাদা আর বৌদির সাথেই ফিরবে। যাবেও ওদের সাথে গাড়িতে। ওর এই পার্লারকে বড় করার পেছনে দাদা বৌদির অনেক অবদান আছে। বৌদির অফিসের দাদার অফিসের ওদের আত্মীয়স্বজনের সব বিয়েতেই সাজাতে যায় সোহিনী।
        প্রথম যখন ঝুমকাকে বলেছিল সোহিনী তখন ওর যেতে একটু আপত্তি থাকলেও মানে বলছিল মা একা থাকবে। আজ নিজে থেকেই মোটামুটি রেডি হয়ে এসেছে যাবার জন‍্য।
    ঝুমকা দেখতে খুব সুন্দর, শুধু গলার ঐ পোড়াটা ছাড়া। ওটা এখন চাঁদের কলঙ্কের মত। আজ গলাবন্ধ একটা কুর্তা পরেছে ঝুমকা। গলাতে একটা পমপম দেওয়া স্কার্ফ বেঁধেছে বেশ লাগছে ওকে।
     সোহিনী বলে," বিয়েবাড়িতে যাবার সাজুগুজু বেশ হয়েছে। এমনি সুন্দর সেজে থাকবি। জীবনটাকে আরেকবার গুছিয়ে নে নিজের ইচ্ছেমত।"
       হাসে ঝুমকা,ওর হাসিতে আজ দুঃখের ঝলক মেশানো," হ‍্যাঁ গো সেটাই তো চেষ্টা করছি। আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আসলে বি.এ পরীক্ষাটা তো দিতে পারলাম না। তার আগেই বিয়ে করে নিলাম।"
-" যা হয়েছে তা ভুলে যা, সামনে কি করবি সেটা ভেবে নিজেকে ভালো রাখ। জীবনে সব কিছু ফুরিয়ে যায় না। কখনও শেষ থেকেই শুরু হয়।"

            সামনের সীটে সোহিনী বৌদির সাথে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। ইচ্ছে করেই হাত পা ছড়িয়ে বসার জন‍্য ঝুম পেছনের সীটে বসেছে। থাক ওরা গল্প করুক নিজেদের মত।
         অনেকদিন বাদে কলকাতার বাইরে যাচ্ছে ঝুম। ওর অবাধ‍্য চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। এভাবে একসময় কত গেছে মৈনাকের সঙ্গে লঙ ড্রাইভে। পাখনা মেলে উড়ত তখন ঝুম। প্রায়ই তো কোলাঘাট,নাহলে ডায়মন্ড হারবার চলে গেছে লঙ ড্রাইভে। ঝুমকার ছিপছিপে কোমর জড়িয়ে ধরে ভেসে যেত মৈনাক ভালোবাসার আবেগে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিত ওকে। রাণাকে কেমন যেন ভীতু আর ঠান্ডা লাগত ওর কাছে। কোনদিন সাহস করে...নাহ্ একবার চুমু খেয়েছিল কৃষ্ণনগরে সরস্বতী পুজোর দিন। মনীষাদের বাড়ির ছাদে উঠেছিল ওরা,মনীষা নিচে নেমে আসতেই। রাণাকে জড়িয়ে ধরেছিল ঝুম। অনেকক্ষণের জন‍্য ডুবে গেছিল ওরা ঠোঁট ভেজানোর খেলায়। মুছে গেছিল ঝুমের লিপিস্টিক। হাঁফাচ্ছিল রাণা প্রথম চুমু খাওয়ার উত্তেজনাতে। তারপর মনীষা নিচ থেকে ডেকেছিল ওদের। রাণা হাত দিয়ে ওর ঠোঁটটা মুছিয়ে দিয়েছিল। তারপর তাড়াতাড়ি নেমে এসেছিল ওরা। মনীষা মুখ টিপে হেসেছিল। পরে মজা করেছিল। সত‍্যিই কোথায় যে হারিয়ে গেছে ঐ ছোটবেলার বন্ধু গুলো কে জানে?

         রাণার সাথে সম্পর্ক মুছে যাবার আগেই একদিন মৈনাকের সাথে ওদের নতুন ফ্ল্যাটে ডুবে গেছিল আদরের খেলায় ঝুমকা। ও প্রথমে রাজি না হলেও মৈনাক ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছিল। ওর শরীরের প্রতিটা অংশ ছুঁয়েছিল আদরে, বলেছিল..." এত সুন্দর ফিগার তোমার, সত‍্যি আমার একটা ছবি তুলতে ইচ্ছে করছে। এই শরীরে বিকিনি পরলে তো আমি চোখই ফেরাতে পারব না। কোনদিন বিকিনি পরেছ? অবাক হয়ে তাকিয়েছিল ঝুমকা, "বিকিনি!"
    মৈনাক ওর বুকে ভালোবাসার ক্ষত এঁকে দিতে দিতে বলেছিল, আমাদের হানিমুনে যখন আমরা মালদ্বীপ যাব তখন তুমি বিকিনি পরবে। ইচ্ছেমত ছবি তুলব তোমার তখন।"
      ঝুমকা তখন মালদ্বীপের স্বপ্নে বিভোর। রাণা ওকে আর কি দিতে পারবে? এখন যা চাকরির বাজার তাতে কি চাকরি পাবে, কবে চাকরি পাবে কে জানে?
    মৈনাকের পার্স সব সময় চার পাঁচটা কার্ডে সাজানো থাকে। থরে থরে সাজানো থাকে পাঁচশো হাজার টাকার নোট। কত রকমের ব‍্যাবসা ওর।
              হঠাৎই গাড়িটা লাফিয়ে ওঠে,চমকে ওঠে ঝুমকা। সোহিনী পেছনে ফিরে ওকে বলে," ঠিক আছিস তো? কেন যে পেছনে বসলি? বললাম সামনেই বস আমাদের সাথে।"
   - " আমি ঠিক আছি গো, অত ভেব না। বেশ পা তুলে বসে ঘুমোতে ঘুমোতে যাচ্ছি। আর কত দূর গো?"
   -" এই তো আর বেশি দূর নয়,পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে মোটামুটি।"

       ঝুমকা আবার তলিয়ে যায় স্বপ্নের ঘোরে। একটা সময় মহুয়াও ওকে বারণ করেছিল মৈনাকের সাথে এত ঘোরাঘুরি করতে।
-" ঝুম পড়াশোনা কর মন দিয়ে। মৈনাকদা কিন্তু আলাদা থাকে একদম। মাসিমণির সাথে ওর বিশেষ সম্পর্ক নেই। বড়দা একদম ওকে পছন্দ করে না। একটা সময় খুব উৎপাত করেছে বাড়িতে।"
-" উৎপাত মানে?"
-" ঐ পড়াশোনা করত না, একটু বখে গেছিল আর কি?" বাকি কথাটা চেপে যায় মহুয়া। মাসিমণির সব টাকা তুলে নিয়েছিল ব‍্যাঙ্ক থেকে একটু একটু করে। পরে বলেছিল ব‍্যাবসার জন‍্য তুলেছে।"
-" তোর জন‍্যই তো আলাপ ওর সাথে। নাহলে আমি চিনতাম নাকি ওকে? এখন তুই বলছিস ওর সম্বন্ধে নানা কথা। বুঝতে পারছি তোর হিংসা হচ্ছে। আমি তোর দাদার সাথে প্রেম করছি সেটা সহ‍্য হচ্ছে না।"
        এক কথা দু কথায় ঝগড়া করে বসেছিল মহুয়ার সাথে ঝুম। মহুয়াও উত্তর দিয়েছিল," যা খুশি ভাব,আমার কিছুই বলার নেই। আমার খারাপ লাগে তোর বয়ফ্রেন্ডের জন‍্য। একটা নিরীহ ছেলে। মাঝে মাঝেই কলেজ গেটের পাশের দোকানে বসে থাকে। এক সঙ্গে দুটো ছেলেকে নাচাচ্ছিস কেন?"
-" বেশ করেছি,আমার বন্ধু আমি বুঝব। কেন আমি ছাড়লে কি তুই ওকে ধরবি?"
-" ছিঃ ঝুম! সত‍্যিই আজ বুঝলাম তুই কেমন মেয়ে। আসলে পরিবেশের প্রভাব বোধহয় সত‍্যিই মানুষের ওপর পড়ে।"
  রাগে ফেটে পড়েছিল ঝুম," কি বলতে চাইছিস তুই! আমি বস্তীতে থাকি সেটা! সবাই হিংসুটে তোরা আমার রূপ দেখে তোদের যত জ্বালা। আসলে আমার পেছনে কত ছেলের লাইন সেটা তোরা নিতে পারিস না।"
  -" অত রূপের দেমাক ভালো নয় ঝুম। মানুষের মনটাই আসল। যাক যা ভালো বুঝিস কর।"
  
      বাড়ি ফেরার পথে ট্রামে বসে সেদিন বারবার চোখটা ভিজে যাচ্ছিল মহুয়ার। কেন যে সেদিন হঠাৎই মৈনাকদা ওদের বাড়িতে এল! বাবা ওকে একটুও পছন্দ করে না। তবে মা ফেলতে পারে না। তারপরেই ঝুমের জন‍্য কলেজে ঘোরাঘুরি শুরু করল। কি করে,তা ওরা জানে না তেমন। বলে কনস্ট্রাকশনের ব‍্যবসা করছে। একটা সময় সব রকমের গুণ ছিল তবে এখন বলে বদলে গেছে। একা একা থাকতে আর ইচ্ছা করছে না এবার বিয়ে করে সংসারী হতে চায়।
        কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে রেজেস্ট্রী করেই ওদের বিয়েটা হয়ে গেছিল। পরে একটা ছোট হোটেলে রিসেপশনের পার্টি দিয়েছিল মৈনাক। ওর দিদি আর মা এসেছিল ভাই তখন মিলিটারি ট্রেনিংয়ে। মহুয়ারা কেউই আসেনি। মৈনাককে জিজ্ঞেস করেছিল
             -"বিয়েতে মহুয়ারা আসবে না?"
-" ছাড় তো সব আত্মীয়স্বজনকে আমার চেনা হয়ে গেছে। নিজের মা যখন পর করে দিয়েছে তখন আবার মাসি?"
        মৈনাকের বন্ধুদের দেখে ভালো লাগেনি ঝুমের। সবার চোখে যেন একটা অন‍্যরকম ভাষা। কানে এসেছিল হঠাৎই," মালটা তো দারুণ সাল্টেছো গুরু,একদম নায়িকা।"
     অবশ‍্য এমন ভাষা এর আগেও শুনেছে ঝুম। দিদি গয়নাগুলো নেড়েচেড়ে দেখেছিল," সব সোনার? নাকি ইমিটেশন? তবে যাক মায়ের কিছু খরচা করতে হল না। "
    মায়ের দিকে তাকায় ঝুম,মায়ের মুখটা কেমন যেন কালো। মায়ের যা কিছু টাকা রাখা ছিল ওর বিয়ের জন‍্য সেটা তো রেজেস্ট্রীর আগেই দিয়ে দিতে হয়েছে মৈনাককে।
  মৈনাক বলেছিল," আপনাকে কোন খরচ করতে হবে না। মানে ঝামেলা করতে হবে না। কিছু খরচ শুধু আমাকে দিয়ে দিন তাহলেই হবে। আমি অবশ‍্য ওর নামেই ফিক্সড করে রাখব টাকাটা।"

       পরে বুঝতে পেরেছিল সবটাই মিথ‍্যে ছিল। সব কিছুই মিথ‍্যে। হয়ত সত‍্যি ছিল মহুয়াই,যাকে ও অপমান করেছিল আর ভুল বুঝেছিল। মালদ্বীপে হানিমুন! নাহ্ হয়নি। গোয়াতেও হয়নি এমন কি পুরীতেও হয়নি। তবে হয়েছিল হানিমুন মন্দারমণির একটা হোটেলে। তাতেই খুব খুশি হয়েছিল ঝুমকা। একগাদা ছোট ছোট ড্রেস কিনে দিয়েছিল মৈনাক। তারমধ‍্যে দুটো বিকিনিও ছিল তাতেই খুশি হয়ে গেছিল ঝুম। প্রচন্ড গরমে হোটেলের প্রাইভেট বীচে বিকিনি পরে পোজ দিয়েছিল ঝুম। একটার পর একটা ভিডিও করেছিল মৈনাক। তারপর নিজের ভিডিও নিজে দেখেই মুগ্ধ হয়েছিল ঝুম। কোথায় সানি লিওন আর ক‍্যাটরিনা কাইফ।
       ওর সারা শরীরে জ্বালা ধরাতে ধরাতে মৈনাক বলেছিল," উফ্ কি লাগছে না তোমাকে। কে বলবে এটা মন্দারমণি। এমন করে এডিট করে দেব যে মনে হবে গোয়া বা আন্দামানে দাঁড়িয়ে আছ।"
-" আমরা মালদ্বীপে যাব না? তুমি বলেছিলে কিন্তু। কবে যাব?"
   মৈনাক বুঝতে পারে ঝুমের বেশ নেশা হয়েছে। ওকে শান্ত করে আদরে আদরে দক্ষ শিকারীর মত। 
             তারপর একটা সময় বুঝতে পারে ও নেতিয়ে পড়েছে। ওকে উল্টো করে শুইয়ে ওর খোলা পিঠের বেশ কয়েকটা ছবি তোলে মৈনাক। ওর কোমরের উল্কি আর ঘাড়ের কাছের বৃশ্চিকের ছোঁয়ায় পেছন থেকেই ভীষণ সেক্সি লাগছে ওকে। এই ছবিরও বাজার দর মন্দ হবে না।

      মন্দারমণির কয়েকটা দিন স্বপ্নের মত কেটে যাচ্ছে ঝুমকার। ভালো ভালো খাওয়া, হোটেলের নরম বিছানা। বিভিন্ন পোজে ভালো ড্রেস পরে ছবি। ও তো কোনদিন জানতই না ওকে এত হট দেখতে। সত‍্যিই মৈনাকের চোখ আছে। তেমনি ভালো ফটোগ্ৰাফার। কিছু ছবি এরমধ্যেই ফেসবুকে দিয়েছে ও স্ট‍্যাটাসে দিয়েছে ফিলিং এক্সাইটেড এট গোয়া। সত‍্যিই ওর ছোঁয়ায় মন্দারমণি গোয়া হয়ে উঠেছে।
         এবার হিংসায় যারা জ্বলবে তারা লুচির মত ফুলবে। লাইকের বন‍্যায় ভেসে যায় ঝুম।
যদিও সব ছবি ঝুমকে দেখায়নি মৈনাক। তবে যা দেখিয়েছে তাতেই পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা। ও যত পাগল হয়ে থাকে সুবিধা তাতেই বেশি।

****************************
    বর্ধমান পেরিয়ে গেছে কিছুটা আগে। শহর ছাড়িয়ে একটু আধা মফস্বলে ঢুকেছে গাড়ি। এদিক ওদিক পুরোনো বাড়ি,পুকুর আর মন্দির। হঠাৎই একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে গাড়িটা।
     সোহিনীদির বৌদি বলে," কি গো ঘুমোলে নাকি? এবার আমাদের নামতে হবে। এসে গেছি আমরা।"
           চোখটা কচলে চুলটা তাড়াতাড়ি ঠিক করে নেয় ঝুম। কাঁধের ব‍্যাগটা নিয়ে নেমে পড়ে বিয়েবাড়িতে তখন সানাইয়ের সুর বাজছে।
           ওরা আসতেই সবাই বলল প্রথমে ফ্রেশ হয়ে একদম খাওয়া দাওয়া করে নিতে। কারণ দুপুরের খাওয়া চলছে।
       অনেকদিন বাদে এইরকম খাওয়াদাওয়া করল ঝুম। একদম ডাঁটা ওয়ালা বেগুন ভাজা সাথে ঘি আর কাঁচালঙ্কা,সুক্তো,ছ‍্যাঁচড়া, আলুভাজা,মাছের কাঁটা দিয়ে ডাল পাবদার সরষে বাটা আর রুইমাছের কালিয়া,দই,বড় বড় মিস্টি চাটনি সবই আছে মেনুতে।
     আজকাল আর এত খেতে পারে না ঝুম। বেশিরভাগ ডিমভাত বা আলুর চোখা ভাত খেয়ে ওদের দিন কাটে। মায়ের কথা খুব মনে হল। হয়ত পান্তা খেয়েই আজকে কাটাবে রান্নাও করবে না। খুব আশা ছিল ভাইয়ের ওপর। কিন্তু ভাইও ওকে দেখার পর হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ভাই বৌয়ের খুব রাগ ঝুমকার ওপর। ওর চোখে ঝুমকা একটা নষ্ট চরিত্রের মেয়ে।
     অবশ‍্য মৈনাক যা করেছিল! তাতে আর কি ভাববে?

      খেয়ে একটু গড়িয়েই কনে সাজাতে বসে ঝুমকা। আজ সোহিনী অনেকটা রিল‍্যাক্সড। বিয়েবাড়িতে দাদা বৌদির সঙ্গে আনন্দ করছে, অবশ‍্য অনেকক্ষণ ছিল এই ঘরেই। সিঁদুরের ছোঁয়ায় মেয়েটাকে বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। সত‍্যিই সিঁদুর কেমন পাল্টে দেয় চেহারা। ওর সেই সিঁদুর মাখা ঘোমটা টানা ছবিটা কতদিন ওদের বাপের বাড়ির আলমারিতে ছিল।
         পুতুলের চোখে স্বপ্নের আনাগোনা, বারবারই বলছে "আজ কিন্তু বেশ অন‍্যরকম সাজিয়ো। আসলে বৌভাতের সাজ তো। অবশ‍্য তোমার হাত তো পাকা।"
       এখানে এসে খেতে বসে অনেকবার এদিক ওদিক সেদিন দেখা সেই নতুন বৌটাকে খুঁজেছে ঝুম। কি যেন নাম? মুনিয়া। যাকে খুঁজতে গিয়ে রাণাকে ফোন করেছিল নতুন কনে।
    চুলের খোঁপার ভাজে সোনালী কাঁটা দিতে দিতে গল্পের ছলে বলে ঝুম," তোমার মাথায় কত চুল! আজ একদম অন‍্যরকম খোঁপা বেঁধে দিয়েছি। ফুলের সাজ সাজবে তো তাই।"
     আয়নায় নিজেকে দেখে পুতুল, আজ বুকের ভেতরে অদ্ভুত শিহরণ। কৌশিকের চোখের কোণে ভালোবাসার হাসির ইশারা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে।
-" তোমার বন্ধু কই? থাকলে একটু দেখতে পারত কেমন সাজাচ্ছি। খুব সুন্দর দেখতে তোমার বন্ধুকে। আজ দেখছি না তো।"
     পুতুল হাসে," আসবে,ফোন করেছিল। শ্বশুরবাড়ি থেকে আসবে সবার সাথে।"
   হয়ত প্রশ্নটা করা উচিত নয় তবুও সাজাতে সাজাতে আলগোছে বলে ফেলে," তাই! আচ্ছা। কোথায় শ্বশুরবাড়ি? এখানে?" 

        পুতুল আয়নাতে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলে, "এখানে না কৃষ্ণনগরে।"
         হঠাৎই খোঁপার কাঁটার খোঁচা খায় ঝুম অন‍্যমনস্ক হওয়াতে। অদ্ভুতভাবে অতীত এল এত বছর বাদে ওর সামনে। এখন আর রাণাকে দেখতে ইচ্ছে করছে না ওর। রাণা এখন বিবাহিত, নিশ্চয় ভালো চাকরি করে। ও কি মুখ নিয়ে রাণার সামনে? মানে যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে কি হবে? সত‍্যিই কি সেদিনের সুন্দরী তন্বী,রূপসী আর অহঙ্কারী ঝুমকা এখনও বেঁচে আছে?

********************************
শান্তা সকাল থেকেই একটু তাড়া দিয়েছে ওদের,নাহলে তো উপায় নেই। ছেলে বৌমা আর মেয়ে সবগুলোই হচ্ছে লেটলতিফ কখন বেরোতে পারবে কে জানে!
-" মুনিয়া এখনই সব সাজিয়ে রেখো কি পরে যাবে। আমি গয়নাগুলো আলমারিতে রেখেছি। যখন লাগবে বলবে। এই যে তোর সব গুছিয়ে রাখবি। বেরোনোর সময় তখন আমাকে কিছু বলবি না। ওদিকে আবার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে ঠাম্মু দাদান আছেনা বাড়িতে।"
-" দেখেছ বৌদি,মা তোমার সাথে কত ভালো করে কথা বলছে আর আমার সাথে কেমন করছে।"
-" দেখেছ হিংসুটে মেয়ের কান্ড আমি আর পারি না।"

      মুনিয়া ডলকে একটু আদর করে ফেসবুকে মন দেয়। রাণা অবশ‍্য ফেসবুক করে না তেমন। একদিক দিয়ে ভালো। অম্লানদাকে নিয়ে তো জুনির মাথাব‍্যথার শেষ নেই।
   রাণা মুনিয়াকে বলে," মা কি বলেছে শুনলে তো,তাড়াতাড়ি সব করতে হবে। এইই...."
    "এক মিনিট দাঁড়াও ছবিগুলো একটু এডিট করে নিয়ে তারপর...."
-" আঃ আবার এডিট করার কি আছে? তুমি এমনিতেই সুন্দরী।
    দেখি কোন ছবিটা।"
     ছবিটা দেখে হঠাৎই চমকে ওঠে রাণা। কে এটা?
মানে পুতুল, মুনিয়ার সাথে এরা কারা? ওহ্ শীট্
            মুখ থেকে ওহ্ শীট্ কথাটা বাইরে বেরিয়ে আসে নিজেকে সামলাতে পারে না রাণা। উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ে। মুনিয়া ওকে ধাক্কা দেয়," কি রে হঠাৎ ওহ্ শীট্ বললি কেন? কেন বললি?"
  ডল মুখ টিপে হাসে," বৌদি এটা কৃষ্ণনগর,মা আছে কাছাকাছি।"
     নিজেকে সামলায় মুনিয়া, ততক্ষণে সামলে নিয়েছে রাণাও।
         " আরে এই ছবিটা এডিট করার আবার কি আছে? এরা কারা? আমি ভাবলাম তোমার ছবি। তাই ওহ্ শীট বললাম।"
 " রাণা দ‍্যাটস নট ফেয়ার। ওরা বিউটিশিয়ান, পুতুলকে সাজাতে এসেছিল। তুমি তো বললে দারুণ সাজিয়েছে। মেয়েটা মনে হল নতুন কাজ করছে। কিন্তু হাতটা বেশ ভালো। দেখতেও খুব সুন্দর মেয়েটাকে, শুধু গলাটা খুব বাজে ভাবে পোড়া। দেখ.."

     মুনিয়া হঠাৎ যেন এই বিউটিশিয়ান মেয়েটাকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করছে। তাই ওকে আর খুব একটা পাত্তা দেয় না রাণা। কিন্তু হঠাৎই অতীত যে এভাবে কালবৈশাখী ঝড়ের মত জানলা দিয়ে আসবে ওর সুখী জীবনে তা ভাবতে পারেনি। মেয়েটা তো ঝুম,হ‍্যাঁ ঝুমই তো। এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে,ঝুমকে মনে মনে খুব ঘেন্না করেছে কিন্তু ভুলতে পারেনি রাণা।

      আজ একটা বড় গাড়ি করে যাচ্ছে ওরা গাড়িতে ভীষণ হইচই। ছবিটা দেখার পর কেন যেন রাণার সব উৎসাহ নিভে গেছে বিয়েবাড়ি যাবার। তারপর হঠাৎই মনে হয়েছে এই বিয়েবাড়িতে ঝুম আসবে কি করে? এটা তো বর্ধমানে হচ্ছে। ভেবে একটু নিশ্চিন্ত হয় রাণা। ছবিটা আরেকবার কেন যেন দেখতে ইচ্ছা করে রাণার। উঃ ভগবান প্রাক্তনের পাশে বর্তমান। কেমন যেন একটা শরীর খারাপ করার মত অবস্থা। আচ্ছা মুনিয়াকে কিছু বলবে এ ব‍্যাপারে? তারপরই নিজেকে শাসন করে রাণা,ও যা অভিমানী কেঁদে কেটে অস্থির হবে হয়ত। তারপর মা জানতে পারলে আর রক্ষা নেই।


************************
পুতুলের সাজগোজ একটু আগেই শেষ হয়েছে। ফিরোজা রঙের বেনারসীতে লাল পাড় সাথে হাতে কুচি দেওয়া লাল ব্লাউজে বেশ মানিয়েছে ওকে। ফুলের মুকুটের সামনে ছোট্ট সোনার চূড়া। ওদের বাড়ির ঐতিহ্য তাই শাশুড়িমা ওটা পরেই সাজতে বলেছেন। কৌশিক চোখ ফেরাতে পারে না পুতুলের দিক থেকে। লজ্জা পায় পুতুলও। ওর শ্বশুরমশাই বলেন," দেখি মা,এদিকে এস একবার। এই দেখ আমার লক্ষ্মী নারায়ণ। কেমন মানিয়েছে।"
       ঝুমকে সোহিনী প্রশংসা করে," তোর কনফিডেন্স এসেছে তো? আজকের সাজানো আরও ভালো হয়েছে। এবার একটু রেডি হয়ে নে। আজ তো এখানেই থাকতে হবে।"
    ঝুম বলে," এখন তো প্রায় ছটা বাজে,চলে গেলেই হত।"
      সোহিনী হাসে," উপায় নেই,বর্ধমান শহর হলে বলতাম চলে যা। কালই চলে যাব,একটু এনজয় কর। অবশ‍্য কনেযাত্রীরা যদি ফেরে ওদের সাথে চলে যেতে পারিস।"
     দোটানায় পড়ে ঝুম বলে," আচ্ছা থাক,তোমার সাথেই যাব কাল।"

           ব‍্যাগ থেকে সরু জড়ি পাড়ের তুঁতে শাড়িটা বের করে ঝুম। গাঢ় নীল রঙের গলাবন্ধ ব্লাউজ টা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কানে একটা জাঙ্ক জুয়েলারী পরে নেয়।
  " বাহ্! দারুণ লাগছে তোকে দেখতে। চল একটু ঘুরে দেখি আসেপাশে। দুপুরে যা রোদ ছিল কিছুই দেখা হয়নি। এখানে একটা রাধাগোবিন্দর মন্দির আছে। শুনেছি খুব জাগ্রত।"
      সোহিনীর কথায় রাজি হয়ে যায় ঝুমকা। সত‍্যিই এখানে কিই বা করবে ওরা এখন। তার থেকে বাইরের হাওয়ায় একটু ঘুরে আসা ভালো। নিজেকে যতটা আড়ালে রাখা যায়। বিয়ের দিন যাকে দেখতে চেয়েছিল,খুঁজেছিল আজ কেন যেন বড়ই অস্বস্তি ছেলেটা সত‍্যিই রাণা জেনে।
          একটু এগিয়েই রাধাগোবিন্দ মন্দির,এমন জায়গায় এত সুন্দর একটা মন্দির থাকতে পারে ভাবতেই পারেনি। যেমন মূর্তি তেমন সুন্দর চারপাশের প্রকৃতি। বিকেলে এলে আরও ভালো লাগত।
      মন্দিরের ঘন্টা বাজে। সোহিনী বলে," একটু দাঁড়িয়েই যাই। আরতি হবে এখনি।"

        রাণা এক সময় ফেসবুক করত। কতবার চুপ করে ঝুমের প্রোফাইলে গেছে। ওকে দেখেছে নীরবে। ওর প্রোফাইল সার্চ করে দেখেছে ওর বিয়ের ছবি। সেদিন খুব মন খারাপ হয়েছিল রাণার। সত‍্যিই ঝুম বিয়ে করে ফেলল এত তাড়াতাড়ি। একটা সময় হানিমুনের ছবিও দেখেছিল। যাক ভালো আছে ঝুম, হানিমুন করতে গেছে গোয়াতে। কিন্তু এটা কি গোয়া?

      প্রশ্নের উত্তর আর খোঁজে নি রাণা। হঠাৎই একদিন ফেসবুক স্ক্রল করতে করতে নজরে পড়েছিল একটা ভিডিও। একঝলক দেখে সরাতে গিয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়েছিল রাণা। আবার ভিডিওটা খুলেছিল। এটা ঝুম না? নাম অবশ‍্য সুইটি চিঙ্কি। অল্প জামাকাপড় পরে চটুল হিন্দী গানের সাথে লিপ ম‍্যাচিং করে নাচছে। পাগলের মত ইউটিউব ঘাটতে থাকে রাণা। তারপর ইনস্টাগ্রাম, তারপরেই ফেসবুক। কখনও নিতম্বের ভাজ অথবা কখনও ক্লিভেজ দেখিয়ে নাচছে ঝুম। কমেন্টে চোখ রেখে রাণার শরীর খারাপ করেছিল। এত নিচে নেমে গেছে ঝুম! পাবলিসিটির জন‍্য! 

     হঠাৎই খুব কান্না পেয়েছিল রাণার,বেসিনে গিয়ে চোখের জল ধুতে গিয়ে অনেকটা বমিও করে ফেলেছিল। তারপর একদিন ডল দেখিয়েছিল একটা ভিডিও। ওকে খুব বকেছিল প্রথমে রাণা।
   তারপর বলেছিল," আমাকে আর দেখাস না এসব। আমি দেখেছি আগে। ভালো হয়েছে ওর সাথে আমার ব্রেকআপ হয়ে গিয়ে। আর শোন মাকে এসব দেখাস না। মা খারাপ ভাববে।"
-" তার মানে তুই এখনও ঐ মেয়েটার কথা ভাবিস দাদা! তবে আজকাল এসব কোন ব‍্যাপার নয়। ইউটিউব বা ইনস্টাতে পপুলার হলে বসে বসেই রোজগার।"
-" ডল,আমাদের এমন রোজগারের দরকার নেই। আমরা নিজের ভাগ‍্যকে ঘষেমেজেই চকচকে করেছি। সেটাই ঠিক আছে। ভালো কিছু করে পপুলার হবার চেষ্টা করাই ভালো। কমেন্ট গুলো দেখেছিস! "
-" ওরা কি পড়ে নাকি কমেন্ট! সবটাই পাবলিসিটির জন‍্য।"

    ফেসবুক করা ছেড়ে দিয়েছিল রাণা। ভালো লাগত না করতে। মায়ের কানেও গেছিল খবরটা। মা বলেছিল ভগবান যা করেছে মঙ্গলের জন‍্যই। এই মেয়ে কি এই বাড়ির বৌ হবার যোগ‍্য নাকি! 

       এই করেই কেটে গেছিল বেশ কয়েকটা বছর। রাণার জীবনেও আবার নতুন করে প্রেম এসেছিল। ভালোবেসেছে মুনিয়াকে,ঘর সাজানোর স্বপ্নে এখন বিভোর রাণা। তারমধ‍্যে হঠাৎ দুঃস্বপ্নের উঁকিঝুঁকি কেন?

***************

ওদের গাড়িটা প্রায় পৌঁছে গেছে কৌশিকদের বাড়ির কাছাকাছি। সামনেই রাধাগোবিন্দর মন্দির দূর থেকে ঘন্টার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
   শান্তার মনে হল মুনিয়াকে একবার মন্দিরে প্রণাম করিয়েই বিয়ে বাড়িতে ঢুকলে ভালো হয়। কতদিন দর্শন হয়নি ঠাকুরের। সেই কবে এসেছিল। সুতরাং আব্দার করে," এই শোন না,পাঁচমিনিটের জন‍্য একটু দাঁড় করাও গাড়িটা সাইডে। একটু ঠাকুর প্রণাম করে যাব। আরতি হচ্ছে।"
-" দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ওদিকে। আবার থামবে?"
-" একটু দাঁড় করাও না।"
   মাতৃদেবীর ইচ্ছে সুতরাং কোন উপায় নেই। রাণা ভেবেছিল একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাবে হল না। যেতেই হল। 
 মুনিয়া হাসে," চল,বাঁচার উপায় নেই। প্রণাম করেই চলে যাব। পুতুল আজকেও ক্ষেপে যাবে। সবাই মিলে আসা একটু দেরি তো হবেই।"

           মায়ের আব্দারে মন্দিরে এসে যে এভাবে ঝুমকে দেখবে এত বছর বাদে ভাবেনি রাণা। 
           চোখাচোখি হয়ে যায় কয়েক মুহূর্তের জন‍্য বিস্বাদ হয়ে যায় হঠাৎই সমস্ত মুডটা রাণার। ইশ্! গলাটা কি বিভৎস ভাবে পোড়া! হাই নেক ব্লাউজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছে।
        কপালে হাত ঠেকিয়ে তাড়াতাড়ি সরে যায় রাণা। ওর পেছন পেছন আসে ডলও। শান্তা প্রণামের তালে এতক্ষণ কিছু খেয়াল করেনি। মুনিয়া ওদের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। ঝুমের আজ একটুও ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওহ্ যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই যেন সন্ধ‍্যা হয়।
     এই মন্দিরেই আসতে হল ওদের। এত বছর পর হলেও রাণাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয় না ওর।

     শান্তা ডাকে মুনিয়াকে," চলো ওরা সবাই এগিয়ে গেছে। আমার প্রদক্ষিণ করতে দেরি হল। এরা কে? তুমি চেন?"
       -" পুতুলকে সাজিয়েছিল মা,এখানেও এসেছে।"
শান্তা ব‍্যস্ত চাউনি দিয়ে ওদের দিকে তাকায়। তারপরেই পা বাড়ায়,হঠাৎই মনে হল কোথায় যেন দেখেছে মেয়েটাকে? সত‍্যিই আজকাল খুব ভুলো মন হয়েছে কিছুই মনে পড়ে না।

        পুতুল সাজুগুজু করে একদম বাধ‍্য বৌ হয়ে বসে আছে। চারদিকে ফুলের গন্ধে আর আলোতে জমে উঠেছে বিয়েবাড়ি। মুনিয়াকে দেখে চোখ পাকালো পুতুল," বাড়ির গিন্নী এলেন এতক্ষণে। কি সুন্দর সেজেছিস রে? রাণা কোথায় মানে ডল মাসিমা ওরা?"
        রাণাকে খুঁজতে পেছন ফেরে মুনিয়া। সত‍্যিই তো কোথায় গেল? অবশ‍্য মামণি আর বাপি আছে ঐদিকটায় কথা বলছে। যাক হয়ত বাইরে কারো সাথে গল্প করছে রাণা। এই বাড়ির তো সবাই ওদের পরিচিত।
       মুনিয়াকে এগিয়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে রাণা। ওর কেমন যেন দম আটকে আসছে। একটা সিগারেট খেতে হবে। গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায় রাণা। হঠাৎই পিঠে একটা ছোঁয়ায় চমকে ওঠে। ওহ্ ডল।
-" দাদা মন্দির থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলি কেন?"
-" তুইও তো এলি আমার পেছন পেছন। কেন কি হয়েছে?
-" তুই ঝুমকাকে দেখে চমকে উঠেছিলি তাই না? আমিও রে। আসলে ওর ভিডিওগুলো আমি মাঝেমাঝেই দেখতাম।"
-" তোকে আমি বারণ করেছিলাম তাও! যা ভেতরে যা মুনিয়া খুঁজলে বলবি আমি বাইরে আছি। "
-" হ‍্যাঁ যাচ্ছি, ওর গলাটা দেখেছিস? মনে হচ্ছে কেউ অ্যাসিড ছুঁড়ে মেরেছে। তাই বোধহয় আর ভিডিও করে না।"
-" তুই যা ভেতরে,এসব কথা এখন থাক। এবার বাড়ি যেতে পারলে বাঁচি। একটুও ভালো লাগছে না আমার এখানে। "
            রাণাকে দেখার পর শরীরটা কেমন যেন অস্থির করে ঝুমের। ওর পরাজিত চেহারাটা আজ রাণা দেখল। যে রূপের দেমাকে একদিন রাণাকে সরিয়ে দিয়েছিল আজ তা বীভৎস হয়ে গেছে কোন এক পশুর অত‍্যাচারে। যাকে ওর সব কিছু ভেবে একদিন ওর ইশারায় নেচেছিল ঝুম।
     ছোট থেকেই নাচের দিকে ঝোঁক ছিল ঝুমের। অনেকদিনই ছোট পোশাক পরে নাচতে বলত মৈনাক.." আরে নাচ না, আমার বৌয়ের নাচ আমি দেখব না? তোমার জন‍্য হেভি একটা ড্রেস দেখে এসেছি আর গয়নাও। কাল এনে দেব।"
           প্রতিদিনই মৈনাকের সঙ্গে দু এক পেগ খাওয়া অভ‍্যেস হয়ে গেছিল ঝুমের। নেশাতে ভালোবাসাও জমত।
     মৈনাক ইচ্ছেমত গানের ভিডিও চালিয়ে ওর শরীরের বিভিন্ন খাঁজের ওঠানামার ছবি তুলত। একটা সময় সারাদিনের অনেকটাই ভিডিও করতে কেটে যেত। কিছু ভিডিও ঝুমকে জানিয়ে করত কিছু না জানিয়ে। তারপর কিছু ভাইরাল করত ফেসবুকে আর কিছু গোপন ক‍্যামেরায় তোলা ভিডিও বিক্রি করত চড়া দামে মৈনাক। মনে মনে ভাবত বেশ সোনার ডিম পাড়া হাঁস পুষেছে বাড়িতে,টুকটাক জিনিসের বিনিময়ে খুশি হয়ে ওর যা খুশি তাই করছে।

        প্রথমে নিজের দুএকটা ভিডিও দেখে সোশ‍্যাল মিডিয়ায় দেখে একটু খারাপ লাগলেও। পরে মৈনাকই বুঝিয়েছিল," আচ্ছা এতে খারাপের কি আছে বল তো? এই সিনেমায় হিরোইনেরা ছোট জামা পরে নাচে না? কত লাইক আর শেয়ার হয়েছে দেখেছ ভিডিওটা? এই রকম চলতে থাকলে তো পোয়াবারো।"
-" কি পোয়াবারো? সেদিন দিদি আর ভাই ফোন করে যা তা বলছিল। আমার জন‍্য নাকি ওদের লজ্জা হয়।"
-" সে আবার কি? কিসের লজ্জা? আসলে হিংসা হয়। সোশ‍্যাল মিডিয়ায় এক ডাকে সবাই তোমাকে চেনে।
  ওদের সাথে সম্পর্ক রাখতে হবে না। তোমার দিদি আবার একটা কিছু নাকি? ঐ একটা ভুড়িমোটা টাকলু বরকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিল। আমার মত হ‍্যান্ডসাম বর তুমি পেয়েছ এত ড্রেস পরছ তা সহ‍্য হচ্ছে না।"
     মৈনাকের আদরে আদরে ডুবিয়ে দিতে যায় ওকে।
-" ছাড়,ভালো লাগছে না। ভাইটাও আজ যা খুশি বলল। আর ভিডিও করব না আমি। আমার ড্রেস চাই না।"
-" মালদ্বীপেও যেতে চাও না? এই ভিডিওটা দেখ কি সুন্দর জায়গা! তুমি এমন করে লাইক বাড়াতে থাকলে আমরা এরপর লাসভেগাস চলে যাব একদম সোজা।"
    মৈনাকের দেখানো স্বপ্নে হারিয়ে যায় ঝুমকা। মৈনাক শরীরের খেলায় মেতে ওঠে। দেখে নেয় একবার ক‍্যামেরাটা ঠিকমত চলছে কি না তাকিয়ে। আবেশে হারিয়ে যায় ঝুম। মৈনাক ওকে নিজের ইচ্ছেমত ব‍্যবহার করতে থাকে।

       তারপর মালদ্বীপে... না না গোয়াতে গিয়ে কি হয়েছিল? উঃ আর ভাবতে পারে না ঝুম। সোহিনীকে বলে," আমি একটু ঘরে গিয়ে শুলাম বুঝলে। আসলে অনেকটা গাড়ি করে এসেছি তারপর সাজানো শরীরটা ভালো লাগছে না।"
-" সে কি রে? ওষুধ খাবি মাথা ব‍্যথার? রাতে খাবি না? একটু বাদেই তো ব‍্যাচ বসবে।"
-" আচ্ছা সে দেখছি,এখন গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই। তুমি একটু দেখ যদি মেকআপ ঘেটে যায় ঠিক করে দিয়ো।"
   ঘাড় নাড়ে সোহিনী, ঝুম শাড়িটা আলগা করে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়।

      রাণাকে এক ঝলক দেখলেও একটুও চিনতে ভুল হয়নি ওর রাণাও ওকে চিনতে পেরেছে নিশ্চয় তাই বাইরে বেরিয়ে গেল তাড়াতাড়ি। কত বড় বড় কথা বলেছিল একদিন রাণাকে আজ সবই মিশে গেছে মাটিতে। দিদি আর ভাই কেউই ওর জন‍্য বাড়িতে আসে না। তবুও ভালো পাড়াতে তেমন কেউ ওকে বিরক্ত করে না। শুধু মা ফেলতে পারেনি আশ্রয় দিয়েছিল কোন উপায় না দেখে।
     সোহিনীদি বিউটি পার্লার চালানোর পাশাপাশি এনজিও চালায়। সেই সূত্রেই ওদের পাড়ায় এসেছিল সোশ‍্যাল ওয়ার্ক করে ওখানেই ঝুমকে দেখে।
        ঝুমের মত মেয়েদের পাশে দাঁড়ায় ওরা আইনের সাহায‍্যও দেয়। কাজের সুযোগও করে দেয়।

             আঁকার হাতটা খুব ভালো ছিল ঝুমের তখন তো হাতে টাকা ছিল না রাণাকে নিজের হাতে কার্ড বানিয়ে দিয়েছে ওর জন্মদিনে। একবার তো একটা সাদা পাঞ্জাবীতে এঁকেও দিয়েছিল। অতীতে ডুব দেয় ঝুম।
-" ইশ্ তোর পাঞ্জাবী টা কেমন সাদা ফ‍্যাটফেটে। আমাকে একদিন দিস।"
-" কি করবি শুনি?"
-" আগে দিস একদিন তারপর তো।
    রাণার পাঞ্জাবীতে একটা দুর্গার মুখ এঁকে দিয়েছিল। অবাক হয়ে গেছিল রাণা," এত ভালো আঁকিস তুই! এটাই তো প্রফেসন হতে পারে। সবাই কি চাকরি পায় নাকি? তোকে বরং একটা বুটিক করে দেব। পড়াশোনাতে একটুও মন নেই তোর।"
   সত‍্যিই বোধহয় এত ছোটবেলা থেকে শুনেছে ও সুন্দরী আর কিছু দরকার নেই। এই কথাটাই বোধহয় একদিন ওর জীবনকেও খেয়েছিল।

****************************

     মুনিয়া এদিক ওদিক তাকায়,রাণা গেল কোথায়? ছেলেটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। 
   পুতুলের সাথে দেখাও করল না।
ঐ তো আসছে ছেলে সাথে ডল। অবশ‍্য এই বাড়ির সবাই তো ওর পরিচিত তাই হয়ত কারো সাথে কথা বলছিল।
   পুতুলকে দেখে একটু মজা করে রাণা। কৌশিক বলে," আরে কোথায় গেছিলি,বৌদি তো পুলিশকে খবর দেবে ভাবছিল।"
   - " কার বিয়ে ঠিক বুঝতে পারছি না আমরা। দারুণ লাগছে তোদের আমি তো কখন থেকে খোঁজ করছি।"
     রাণাকে একটু অন‍্যমনস্ক দেখে মুনিয়া। কিছু একটা ভাবছে যেন। ডলটাও একটু চুপচাপ বসে আছে। অন‍্যসময় গল্প করে পুতুলের সাথে।
   হঠাৎই ওদের মুড অফ হয়েছে কেন কে জানে? দুই ভাইবোনের ঝগড়াও হতে পারে। খুনশুটি তো লেগেই আছে।
     রাণার দিকে তাকায় মুনিয়া," কি হয়েছে? এনিথিং রং?"
- " কি হবে! কিচ্ছু হয়নি। চল ওদিকে যাই।"
   হঠাৎই মুনিয়াকে ডাকে পুতুল পেছন থেকে.." মুন এদিকে আয় একটু।"
       ইশ্ পুতুলের আইল‍্যাশটা মনে হচ্ছে আলগা হয়ে গেছে। এটা তো ও পারবে না ঠিক করতে।
  " তুই একটু সামলে বোস,আমি দেখছি। তোর বিউটিসিয়ান কোথায়? ওকে তো মন্দিরে দেখেছিলাম। কৌশিকদাকে বলি?"


     চোখটা একটু বুজেছিল ঝুম হঠাৎই সোহিনীদি ডাকে," একটু আয় না,আমিই করে দিতে পারতাম তবে আমার কাছে তো কিছু নেই।"

       ঝুম তাড়াতাড়ি উঠে শাড়িটা গুছিয়ে পুতুল যেখানে বসেছে সেখানে আসে। তাড়াতাড়ি সবটা ঠিকঠাক করে দেয়। একটু টাচও দিয়ে দেয় চটজলদি। অনেকটা আগে সাজানো হয়েছে তাই একটু ঠিক করে দিল ওড়না মাথার চূড়ো।

     সোহিনী ওকে বলে," তোর যখন ভালো লাগছে না চল বরং খেয়ে নিবি। বৌদি তুই শুয়ে আছিস শুনেই বলছিল খেয়ে নিতে। খাবি?"
-" আছি তো আজ,আমার রাত্রি করে খাওয়া অভ‍্যেস। বারোটা হলেও হবে। আজ তো থাকব এখানে।"
  -" তাহলে আর ঘরে যাস না,এখানেই কাছাকাছি থাক।"
            ঝুমের অবাধ‍্য চোখ ঠিক রাণাকে দেখেছে একপাশে দাঁড়িয়ে গল্প করতে আর কফি খেতে। নতুন বৌয়ের কাছে শুনেছিল ওরা চলে যাবে।
   নতুন বৌকে বোধহয় সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিচ্ছে। মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে ঝুমকার। একদিন যাকে নিজে পায়ে ঠেলেছিল আজ তাকে দেখে নিঃশ্বাস ফেলে কি হবে? সত‍্যিই বোধহয় কাউকে ঠকালে দুঃখ পেতে হয়।
      আসেপাশের অনেকেই ঝুমকে দেখছে। ও যেখানে বসে আছে সেখানে কয়েকজন মহিলা বসে। একজন জিজ্ঞাসা করল ,"আপনি কি কনেযাত্রী?"
-" নাহ্ আমি মেকআপ করাতে এসেছি।"
-" ওহ্! আচ্ছা। খুব ভালো সাজানো হয়েছে। আপনার গলাটা পুড়েছে কি করে? অ্যাক্সিডেন্ট?"
   হঠাৎই ঝুমের রাগ হল খুব,এখানকার মানুষগুলোর এত কৌতূহল কেন কে জানে? এই নিয়ে তিনজন জানতে চাইল। অথচ রাণা যেন ওকে দেখে একদম না চিনেই চলে গেল একবারও কি মনে হল না কিছু?

     সোহিনীদির কথা না শুনেই আবার দোতলার ঘরের দিকে পা বাড়ায় ঝুম। সত‍্যিই আজ খাওয়ার ইচ্ছেও একটুও নেই।
       যেতে যেতে হঠাৎই ফিরে তাকালো অতীতের প্রাক্তনের দিকে। কি আশ্চর্য! রাণাও তো ওর দিকেই তাকিয়েছিল! আবার দূর থেকে চোখে চোখে ছোঁয়াছুঁয়ি। মুখ ঘুরিয়ে পা বাড়ায় ঝুম।

************************
   রাণা বাড়ি ফেরার জন‍্য একটু তাড়াহুড়ো করল,মুনিয়াকে না তাড়া দিলে হবে না। তখন থেকে পুতুলের সাথে কি গল্প করছে কে জানে? আবার তো এতটা ফিরতে হবে?

        বাড়িতে ফিরে ফুলের গন্ধের রেশ থেকে যায় মুনিয়ার মনেও। মনে পড়ে গেল এই ঘরেই ওর ফুলশয‍্যা হয়েছিল। ঘরের বড় বড় জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে আদরে ওদের ছুঁয়ে গেছিল। লোকজনের কোলাহল শান্ত হলে রাণা জানলা খুলে ওকে চাঁদ দেঠিয়েছিল। সারাটা রাত গল্পে গল্পে কেটে গেছিল। মুনিয়াকে জিজ্ঞেসা করেছিল রাণা," কাজললতা পেয়ে খুশি? আমাকে ভালোবাসতে পারবি মানে পারবে তো?"
" এসব আবার কি কথা? বোকা বোকা সব কথা। ভালোবাসা না থাকলে বিয়ে করলাম কেন?"

        রাণা চোখ বুজে আছে,মুনিয়া ওর কাছে এসে বুকে মুখ রাখে," কি হয়েছে? টায়ার্ড? মুড অফ কেন? এত তাড়াতাড়ি করলে পুতুলকে কিছু টিপস দেওয়া হল না। পুতুল কি বাচ্চা মেয়ে নাকি? ঘুমোও এখন অনেক রাত হয়েছে।"
      -" না আমি চাঁদ দেখব এখন।"
     -" পাগলী একটা,আয় ঘুম পাড়িয়ে দিই।"

     বেশ অনেক আগে ঘুমিয়ে পড়েছে মুনিয়া। রাণার চোখে আজ ঘুম নেই। কেন যেন দুইয়ে দুইয়ে চার করতে পারে না। এত ভিডিও যে দিয়েছে সোশ‍্যাল মিডিয়ায়। পেয়েছে লাইক আর কমেন্টের বন‍্যা। সে হঠাৎ আজ বিউটি পার্লারে কাজ নিল কেন?
     এরকম বিচ্ছিরি ভাবে পুড়ে গেল কেন?
 অন‍্য কেউ হলে হয়ত খুশিই হত। মনে করত উচিৎ শিক্ষা পেয়েছে ঝুম। তবে রাণা মানে জীবন যা নেয় তার থেকে ফিরিয়ে দেয় অনেক বেশি তাই শুধু শুধু ঝুমের ক্ষতি দেখে আনন্দ পাবেই বা কেন?

        বেশ কিছুদিন হল মুনিয়ারা ফিরে এসেছে ব‍্যাঙ্গালোরে। পুতুল কৌশিকের সাথে পুরী ঘুরে এল। খুব খুশি পুতুল। বেশ ভাব হয়েছে ওদের,মিলেমিশে আছে ওরা। মুনিয়া পুতুলের ছবিগুলো দেখায় রাণাকে। 
    -" আমরা কবে বেড়াতে যাব?"
ওর কথা শুনে চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ রাণা।
    হঠাৎই একদিন মুনিয়া ওকে বলেছিল," আচ্ছা সুইজারল‍্যান্ডে তো এখন অনেকেই যাচ্ছে। একবার দেখ তো নেট ঘেটে কেমন খরচা পরবে?"
    ওর মুখে সুইজারল্যান্ডের কথা শুনে কেন যেন অবাক হয়ে গেছিল রাণা। সত‍্যিই আজকাল অনেকে যাচ্ছে। কিন্তু কৃষ্ণনগরের বাড়িতে সবাই যখন জানবে রাণা সুইজারল্যান্ডে গেছে জাস্ট বেড়াতে। তখন?
   হয়ত কেউ কিছুই বলবে না,তবুও।
" আচ্ছা আমি দেখব,আসলে বোঝই তো অনেকটা খরচ। আমাকে তো বাড়িতেও কিছু..."
" আমি যদি কিছু টাকা দিই তাহলে?"
" আচ্ছা দেখছি।"

    মুনিয়াও ব্লক করবে ভেবেও ব্লক করতে পারেনি প্রমোদকে। ওর প্রোফাইলে যায় মাঝে মাঝে। বুকের রক্তক্ষরণের মাঝে হয়ত আজও বেঁচে আছে প্রাক্তন।
       সেদিন হঠাৎই দেখেছিল বরফের মধ‍্যে গড়াগড়ি করছে প্রমোদ সাথে ওর মোটাসোটা নতুন বৌটা।
        সরে এসেও আবার গেছিল প্রমোদের প্রোফাইলে পায়চারি করতে মুনিয়া। বুঝতে পেরেছিল ওরা ইউরোপ ট্রিপে গেছে। হঠাৎই কেমন যেন জেদ চেপে বসেছিল সুইজারল্যান্ড যাবার।

        রাণা অবশ‍্য বলেছিল," প্রমিস,আমরা যাব সুইজারল্যান্ড বাট এখনই নয়। টিকিটটা রাখ। একেবারে টিকিট কেটে ফেললাম। দেখ তোর পছন্দ হয়েছে কিনা? অম্লানদা সাজেস্ট করল। ওরা সাথে গেলে ভালো হত।"
  রাণার গলা জড়িয়ে হাত থেকে টিকিটটা নেবার আগেই বলে," কোথায় যাচ্ছি আমরা?"






    


     
   

               ্
              

     
      
  
     




     

              

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...