Skip to main content

অনুস্মৃতি

বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিভির সিরিয়ালে মন ডোবান অতীন। দেখতে দেখতে বয়েসটা সত্তর ছুঁই ছুঁই হতে চলল। তবুও মনে হয় এই তো সেদিনের কথা সবটাই। কবে যে ছোটবেলা পেরিয়ে যৌবনে পা রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেছেন বার্ধক‍্যে বুঝতেই পারেননি। কুমকুম সুতোর রীল ছড়িয়ে ব‍্যস্ত অকাজে। চিরকালই কুমকুমের খুঁজে খুঁজে কাজ বের করাকে অকাজ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি। বললেই বলত,' বুঝলে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা তাই এটা ওটা নিয়ে ব‍্যস্ত থাকি,নিজেকে এই করেই ভালো রাখি।'
      একটু সেলাই করেই ঘাড়ে টান ধরে তাই কিছুক্ষণ বাদে আবার সেই ভালো লাগছে না বলে সুতোর রীল ছড়িয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ায় কুমকুম। ওঁর অস্থিরতা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সিরিয়ালে চোখ রাখেন অতীন। আজকাল যে কি হয়েছে কে জানে? সবসময় এক না ভালো লাগা অসুখ ঘিরে ধরেছে ওদের দুজনকে। হাতে টাকা পয়সা আছে অথচ যেন সবই ফিকে কিছুতেই ভালো লাগে না। মন খুঁজে পায় না কোন কিছুতেই আনন্দ। শুধু মনে হয় বড় তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়ে গেল। সময়কে মুঠোতে ধরতে না ধরতেই মানে ট্রেনে গুছিয়ে বসতে না বসতেই স্টেশন চলে এলো।
     ও কুমকুম কোথায় গেলে? বাইরে দাঁড়িয়ে কি করছ? মাথায় হিম পড়বে তো।
   বাইরে দাঁড়িয়ে গজগজ করেন কুমকুম একটা সময় সারাক্ষণ বাইরে বাইরে ঘুরেছে লোকটা একা হাতে সামলাতে হয়েছে ছেলেমেয়ে সংসার সব। আর এখন দুদন্ড চোখের আড়াল হলেই ও কুমকুম, ও কুমকুম। মহা জ্বালা হয়েছে! মেয়ে বলেছে মা এত পারবে না তুমি এবার একটা লোক রাখো,বাবাকে দেখাশোনা করবে। তুমি মাঝেমাঝে একটু এদিক সেদিক যাবে।
      আর এদিক সেদিক এই লোক তো মোটেই চোখের আড়ালে যেতে দেয় না।
    আবার ভেতর থেকে ডাক আসে ও কুমকুম জুতোটা পাচ্ছি না বাথরুমে যাব তো? তুমি কি করছ এতক্ষণ বাইরে?
     আমি হাওয়া খাচ্ছি বাইরে সারাক্ষণ এই বদ্ধ ঘর আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। সামনেই তো পুজো এই সময় আগে আমাদের কত প্ল‍্যান হত তোমার মনে আছে? 
অতীনের ঘোলাটে চোখে হঠাৎই আনন্দের ফুলকি ফোটে। মনে নেই আবার? কত আগে থেকে ট্রেনের টিকিট কেটে রাখতাম। মোটামুটি পয়লা বৈশাখের পর থেকেই তো দিন গোনা শুরু হত।

    সত‍্যি কি বেড়ানো পাগল ছিলাম আমরা বল,ছুটি তো দে ছুট বাইরে। আচ্ছা আমাদের কাশ্মীর যাওয়ার কথা তোমার মনে আছে?
   অতীন স্মৃতির পাতা উল্টে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যান অতীতে, একদম মনে আছে। আরে প্রথম হানিমুন, প্রথম প্রেম, প্রথম ফুলশয‍্যার রাত সে কি ভোলা যায় কুমকুম? অতীনের চোখে অতীতের সুখস্মৃতির ভিড়। কুমকুম অতীত সাগরে ডুব দিয়ে মুক্তো খুঁজতে খুঁজতে বলেন,আরে ঐ যে তুমি অফিস থেকে দেরিতে এলে তারপর তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে বের হলাম। কোন ট‍্যাক্সি পাই না হাওড়া যাবার উঃ সে কি টেনশন!
   শুধুই টেনশন তার সাথে তোমার বকাঝকা আমার অফিস থেকে দেরি করে ফেরার জন‍্য।
   হ‍্যাঁ আমি তো সারাজীবন শুধুই তোমাকে বকেই গেলাম। আর কিছুই করিনি।
    আঃ সেইসব কথা ছাড়ো হানিমুনের কথা বল বেশ লাগছে কিন্তু শুনতে।
    মনে আছে আমরা সুটকেস টানতে টানতে দৌড়তে দৌড়তে প্ল‍্যাটফর্মে পৌঁচেছি ব‍্যাস ততক্ষণে ট্রেনের ল‍্যাজটুকু প্ল‍্যাটফর্মে। তার মধ‍্যে মালের গুতোতে সুটকেসের হ‍্যান্ডেল গেছে ভেঙে। সে কি কান্ড তুমি তো আমাকে ভীষণ বকছ রাজ‍্যের জিনিস নিয়েছি তাই জন‍্য। আমার তখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে হাউমাউ করে। ইস্ বিয়ের প্রায় নয় মাস বাদে হানিমুনে যাওয়া সবাইকে কত গল্প করেছি কাশ্মীরে যাচ্ছি আর সেই যাওয়াটাই হবে না!
    হাওড়া স্টেশনে তখন কাতাড়ে কাতাড়ে ভিড় সবাই মালপত্র ছানাপোনা নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছে। ঢাকিরা শহরে এসে ভিড় জমিয়েছে পুজোর বায়না পাবে বলে। আর আমার মনে হচ্ছে বোধনের আগেই বিসর্জন হয়ে গেল। আমি ধপাস করে সুটকেসের ওপরে বসে পড়লাম। রীতিমত কেঁদেই ফেললাম। অনেকেই তাকিয়ে দেখছিল আমাকে।
    অনেকের মাঝে আমিও ছিলাম,বড় খারাপ লাগছিল বৌটাকে একটু বেড়াতে নিয়ে যেতে পারলাম না বলে। মনে হচ্ছিল অফিসের সেই সেন সাহেবের মাথার টাকে হাতুড়ি পেটাই। বদমাশি করে ঠিক বাড়ি যাবার আগে একটা কাজ দিয়ে গেল। কি যে করি তখন? বাড়ি ফিরবে না বলে তুমি হাতল ভাঙা সুটকেসের ওপর বসে। তারপর হঠাৎই একজন বলল যে কোন ট্রেন পেলেই তাতে উঠে বসে দিল্লি,লক্ষ্মৌ, কানপুর যেখানে হোক চলে যেতে। 

বেশ মজা করে বললেন আরে নতুন বৌ নিয়ে যেখানে যাবেন তাতেই আনন্দ। দরকারে দিল্লি থেকে জম্মুর ট্রেন ধরে নেবেন। 
বলেছিলাম কথাটা মন্দ নয় তবে টিকিট কি পাব? বলতেই কাঁধ চাপড়ে বলেছিলেন আরে মশাই এই জন‍্য বাঙালির কিচ্ছুটি হল না। একটা কিছু কেটে উঠে পড়ুন বলবেন ট্রেন মিস্ করেছেন। তারপর তেমন হলে দাঁড়িয়ে বা মেঝেতে পেপার পেতে বসেই চলে যাবেন একজন আরেকজনকে ভালোবেসে চোখে চোখ রেখে।
      সত‍্যি কি অদ্ভুত আইডিয়া দিয়েছিলেন মানুষটা। এখনকার সময় হলে নম্বরটা রেখে দিতুম। তখন ফোন কোথায়? 
      কুমকুম হেসে ওঠেন,হাসলে এখনও কুমকুমের দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না অতীন। একটা সময় সেই গালের টোল মাখা হাসিতেই তো ভুলেছিলেন। 
আবার বলতে শুরু করেন আমি তখন তোমার দিকে তাকিয়ে। বুঝতে পারছি না ভদ্রলোকের প্রস্তাব শুনে এবার কি বোমা ফাটবে। হয়ত হাওড়া স্টেশন কেঁপে উঠবে।
     ইশ্ সবসময় খালি বদনাম। আমিই তো বললাম যে বাড়ি ফিরব না ওভাবেই চল যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব। তবে কপাল ভালো শেষে মানে একটু দেরিতে আর অসুবিধা করে হলেও পৌঁছেছিলাম আমাদের স্বপ্নের ভূস্বর্গ কাশ্মীরে।
    হ‍্যাঁ অসুবিধা বলে অসুবিধা। আমি মাথায় সুটকেস চাপিয়ে মোটামুটি কুলি হয়ে তোমাকে নিয়ে দিল্লির ট্রেনে চেপে বসলাম। হা হা সে আবার চেপে বসা নাকি,বাথরুমের কাছে সুটকেস পেতে তোমাকে বসিয়ে আমি মোটামুটি তোমার চন্দ্রমুখের দিকে তাকিয়ে দিল্লি চলে গেলাম। ওখানে গিয়ে হতচ্ছাড়া সুটকেস বিদায় করে দুটো ব‍্যাগ কিনে রাজ‍্যের মাল ঢুকিয়ে তারপর আবার জম্মুর ট্রেন ধরা হা হা হা।

     অনেকদিন বাদে অতীন কুমকুমের একলা বার্ধক‍্যের সংসার থেকে হাসির আওয়াজ আসছে। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে তারা যে যার মত বিদেশে চলে যাওয়ায় অদ্ভুত একটা একাকীত্ব গলা টিপে রেখেছে সবসময়। সব কিছুর মাঝেই মনে হয় কেউ নেই যেন পাশে। হঠাৎ একটা কিছু হলে কি হবে?

     কুমকুম হাসছেন তখনও আহা গো শালপাতায় মোড়ানো সেই পুরি সব্জীর স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে যেন গো। কতই বা টাকা ছিল তখন আমাদের তবুও সেই বাথরুমের পাশে সুটকেসে বসে যাওয়ার সুখস্মৃতি আজও স্পষ্ট। তুমি যেন আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছ,আমাকে খুশি করতে পারলেই খুশি।

   গিন্নী আজও তেমনি তোমার দিকেই তাকিয়ে আছি,তখন চোখে জ‍্যোতি ছিল ভালোবাসার রঙ চিনতে এখন আর পারো না বিরক্ত হও এই বুড়োটার ওপর।

    আবার সেই কথা! একটু হাসছি তা সইছে না? সত‍্যি মনে হয় এই তো সেদিনের কথা গো। তারপর হোটেলে গিয়ে যা করেছিলে মনে নেই? কথা বলতে বলতে গালটা লাল হয়ে যায় কুমকুমের।
       হ‍্যাঁ একটা দিন আর কোথাও বেরোই নি বন্ধ ঘরে তোমাকে কাছে টেনে যতবার খুশি আদর করেছিলাম ইচ্ছেমত। বলেছিলাম কাশ্মীরে এনে পৌঁছে দিয়েছি এবার আমাকে আদর করতে দিতে হবে ইচ্ছেমত।

     ইশ্ আদর বলে আদর! সেই আদরের পরেই তো বাবু পেটে এলো মনে নেই। ছেলের ফুটফুটে রঙ দেখে বন্ধুরা বলেছিল এ নিশ্চয় কাশ্মীর থেকে আনা। ইশ্ ভীষণ লজ্জা করেছিল তখন আমার! কি করে বলব এ হচ্ছে আমার বরের অত‍্যন্ত আদরের ফল।

         ঢংঢং করে বুড়ো ঠাকুর্দা ঘড়িটাতে দশটা বাজে। কোথা দিয়ে যে এতটা সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারেননি ওঁরা দুজন। কুমকুম তাড়া দেন অতীনকে ইশ্ কথায় কথায় কতটা রাত হয়ে গেছে তুমি এবার ঘুমের ওষুধ খেয়ে নাও। দাঁড়াও জলটা এনে দিই।

    আদুরে সুরে অতীন বলেন আজ আর ঘুমের ওষুধ খেতে হবে না বুঝলে। মনটা খুশিতে ভরে গেছে তোমার সাথে পুরোনো কথা বলে। আজ শুধু আমার হাতটা তোমার গায়ে রাখবো তাহলেই সুন্দর ঘুম আসবে। অনেকটা সময় পেরিয়েও এই স্পর্শ টুকু আর অনুস্মৃতি গুলো নিয়েই তো ভালো আছি। আরেকটু কথা বল না গো খুব ভালো লাগছে শুনতে।
    কুমকুমের গলায় হঠাৎই সুর বেজে ওঠে... আজ তবে এইটুকু থাক বাকি কথা পরে হবে।
সমাপ্ত:-

   

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...