ইচ্ছেখেয়ালে শ্রীর পাতায় তখন আমার মনে হওয়া হিজিবিজি দিয়ে গল্প লিখছি। খুব সাধারণ সাধারণ অপূর্ণ ইচ্ছের গল্পগুলো একদম একশোভাগ পূরণ করে দিচ্ছি লেখার পাতায়। আমি লিখে ভাবছি আহা যাক মেয়েটা একটু সবার ভালোবাসা পেলো, বিধবা বৌটার আবার ঘর হল অথবা বাড়ির বৌ পেল সেরার তকমা। তোমরা আমার পাঠিকা,আমি ইচ্ছেমত তোমাদের কখনও পাঁচ সাত মিনিট অথবা কখনও বেশ কয়েকটা পর্ব ধরে স্বপ্ন দেখিয়ে গেছি আর তোমরাও আমার সাথে সেই স্বপ্ন দেখে গেছ। আসলে আমরা মেয়েরা ভীষণ বোকা একটা সময় পুতুলের সংসার সাজাই তারপর পুতুল হয়ে নিজের সংসারের বাটি ঘটি শিশি বোতলের সাথে দিব্যি বন্ধুত্ব করে দিন কাটিয়ে দিই। আমাদের কত শরীর খারাপ আর চোখের জল চাপা পড়ে যায় এই পুতুলের সংসার সাজাতে। একলা ভোরে যখন হয়ত বাড়ির আর পাঁচটা লোক আরামের ঘুম ঘুমোচ্ছে তখন উঠে পড়ে যত্নে রান্নাঘরে খুটখাট চলছে আমাদের যাতে আর কারো ঘুম না ভাঙে। চাকরিতে যাবার আগে অথবা ঘরে থেকে সারাদিনই ব্যস্ত হাতে অনেকেই সামলাই বরের ছেলেমেয়েদের টিফিন আর রান্নার জোগাড় গুছিয়ে রাখি পরিপাটি করে নিজেদের সংসার। ভালো রাখতে চাই নিজেদের আসেপাশের আর কাছের মানুষগুলোকে। খুশি করার চেষ্টা করি বাড়ির লোকগুলোকে। বিছানা থেকে ওঠার সময় ক্লান্ত চোখ আর শ্রান্ত পা দুটো না চললেও কর্তব্য নামক চাবুকের ঘায়ে আবার সে দুটো বেশ চাঙা হয়ে চলতে থাকে সারাদিন।
এই ভাবে আমাদের বয়েস বেড়ে চলে লাফিয়ে লাফিয়ে কখন যে তিরিশ,চল্লিশ,পঞ্চাশ, ষাট থেকে সত্তরে পৌঁছয় বুঝতেই পারি না। সারাদিন পুতুলের সংসার সাজানো কিশোরী মনের বাড়ির বৌ,মা অথবা শাশুড়ি এরপর টিভির সামনে বসে পুতুলের বাক্স খুলে আবার জমে যায় অন্যের জীবনের পুতুলখেলা দেখতে টিভিতে,কখনও বা ওল্টায় শাড়ি গয়নার পাতা। কেন যেন জটিলতা ভরা জীবনে আর জটিল কিছু ভালো লাগে না। এভাবেই কেটে যায় দিনের পর দিন ভালোবাসা আর ভালো থাকাকে সাজাতে। কিন্তু তবুও কি আমরা ভালো হতে পারি? আমাদের পুতুলের সংসারের চারপাশেই ছড়িয়ে রয়েছে এমন কিছু মানুষ যারা তোমাকে ভালো বলতে ঢোক গেলে। সারাদিন খেটেখুটে ননদদের খুশি করতে চাইলেও বাড়ির বৌরা কখনও ভালো মানুষের তকমা পায় না বেশিরভাগই শুনতে হয় আমার দাদা বড্ড ভালো। বাড়ির ছেলের অনেক দোষই ঢাকা পড়ে গিয়ে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড়ায় বৌরা। তবে আমরা মেয়েরাই আমাদের বিপক্ষে এসে দাঁড়াই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এমনি সব আটপৌরে মেয়েদের ছোটছোট চাওয়াপাওয়ার গল্প লিখতে গিয়ে কমেন্ট বক্সেই ভাব তোমার সাথে বা তোমাদের সবার সাথে। আজ তোমার কথাই শুধু বলি শুধু নামটা উহ্য থাক। তুমি আমাকে দিভাই বলে ডাকতে ঐ নামটুকুই আমার বড় চেনা ছিল সত্যি বলতে কি কোনদিন প্রোফাইল খুঁজে দেখার সময় পাইনি। তারপর একটু একটু করে মেসেজবক্সে কথা হয়েছে। তুমিও কোনদিন ফোননম্বর চাওনি আর আমিও দিইনি। মেসেঞ্জারে জেনেছিলাম তুমি অসুস্থ। জানতে চেয়েছিলাম কি হয়েছে?
মনটা ভারী হয়েছিল শুনে। বলেছিলাম ঠিক হয়ে যাবে,খুব ভালো ডাক্তার দেখিয়েছ আর চিন্তা নেই।
বইমেলায় যখন এসেছিলে মনটা ভারী হয়ে গেছিল তোমাকে দেখে চোখের কোণে টলটল করেছিল জল। কান্না আমার বড় তাড়াতাড়ি পায়,অনুভূতি গুলো যে মরেনি আজও। তার আগেই জেনেছিলাম তুমি আমাদের শ্বশুরবাড়ির দিকের আত্মীয়া আমি বলেছিলাম মামীমা বলতে পারব না এই দিদি ডাকটাই থাক। কোথায় যেন তোমার অসুখটা বড় চেনা ছিল আমার। আমার মায়ের অসুখের সাথে বড় মিল ছিল,তবে তোমার বাঁচার ইচ্ছে ছিল,এখনও তো কত কাজ বাকি ছিল তাই না? এই তো সেদিনই কত কথা হল,বললে পুজো আসছে গত পুজোতে একটা আসাম সিল্ক কিনেছিলে অনেক দিনের শখ ছিল পরার কেনা হয়নি। আমি বলেছিলাম নতুন ফ্ল্যাটের বারান্দায় ঐ শাড়িটা পরে বসবে। আবাসনের লোকজনেরা যখন সেজেগুজে বেরোবে তখন তুমি দুর্গাপুজোর গন্ধ নেবে মনে মনে।
মা যখন অসুস্থ হয়ে আমার কাছে সেবার শেষ পুজোটা মায়ের সাথে কাটানোর খুব ইচ্ছে হয়েছিল। মাকে কথা দিয়েছিলাম তোমার ইচ্ছে মত আমরা যাব মালদায় সেখান থেকে আমাদের দেশের বাড়িতে। তোমার গোপাল ঠাকুর দেখা হবে,আমাদের দেশের বাড়ির দুর্গা পুজোর গন্ধটুকু এবার তোমাকে দেব মন ভরে মনে মনে ভেবেছিলাম আমি জানি না আসছে বছর কি হবে? নাহ্ হয়নি,মহালয়ার পরেই মা হারিয়ে গেছিলেন তারাদের দেশে শেষ ইচ্ছেগুলো অধরাই রয়ে গেছিল। আর যাওয়া হয়নি মালদাতে,দেখা হয়নি তাঁর ফেলে আসা সংসার আর আত্মীয়স্বজনের সাথে।
আগামীকাল আরেকটা মহালয়া তার আগে তুমি চলে গেলে পেছনে পড়ে রইল তোমার পাট না ভাঙা আসাম সিল্ক যেটা খুব পছন্দ করে কিনেছিলে আর কত ভাজ না ভাঙা ঢাকাই শাড়ি। তোমার নতুন আবাসনের বারান্দায় আর বসা হল না ম্যাচিং ছাড়া যে কোন একটা ব্লাউজ দিয়ে ঐ প্রিয় শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে।
তোমার খুব ইচ্ছে ছিল নবপত্রিকা হাতে পাবার বারবারই বলতে ও দিভাই নবপত্রিকা কবে বেরোবে? আমিও কেমন যেন মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম বইটা তোমাকে পৌঁছতে। বলেছিলে পা ফুলেছে,চোখ লাল তবুও আস্তে আস্তে পড়ব দিভাই বইটা। বড্ড খুশি হয়েছিলে বইটা পেয়ে। আর আমি খুশি হয়েছিলাম তোমার একটা ছোট্ট ইচ্ছে পূরণ করতে পেরে। আমিও যে তোমারই মত একজন সাধারণ গৃহবধূ যে একটু ভালোবাসার কাঙাল বাঁচতে চায় ছোটছোট ইচ্ছে নিয়ে। তাই হয়ত অনুভব করেছি তোমার না পাওয়ার জায়গাগুলো। শেষ সময়ে পাশে চেয়েছিলে আত্মীয়দের যাদের সাথে একসময় কাটিয়েছো অনেকদিন,খুঁজেছো পরিচিত জায়গার গন্ধ,মনে করতে বাড়িতে করা নববর্ষের অথবা জন্মাষ্টমীর উৎসব। কষ্ট পেয়েছো মনে মনে ঠিক যেমন আমার মা পেত যখন আত্মীয়স্বজন যাদের জন্য একসময় অনেক করেছে তারা খবর নিত না। কোথায় যেন বড় বেশি মিল ছিল তোমার সাথে মায়ের তাই হয়ত পাঠিকা থেকে কমেন্ট বক্সের থেকে উঠে আমার এই নরম মনের চোরাবাক্সে ঠাঁই নিয়েছিলে নিজেরই অজান্তে। ভালো থেকো তারাদের দেশে তুমি। এই সময় মনটা ভারী থাকে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাদেই মায়ের চলে যাওয়ার দিন। মায়ের মত তোমার জন্যও ঠাকুরকে বলেছিলাম পুজোটা অন্ততঃ কেটে যাক আসলে কেউ বোধহয় কথা রাখে না। তারপর নিজেই ভাবি মনকে বোঝাই দুর্গা মা তো সকলের মা তাই হয়ত তোমার কষ্ট মুছিয়ে দিলেন হাত ধরে নিয়ে গেলেন তোমাকে সব পাওয়ার এক আলোর দেশে যেখানে খুব ভালো থাকবে তুমি। তোমার বাড়ির মানুষদের মত আমিও মিস্ করব তোমাকে কমেন্ট বক্সে কখনও নিভৃত অবকাশে কানে বাজবে তোমার উচ্ছ্বল গলায় দিভাই ডাকটা। ভালো থেকো তুমি,সব অভিমান আর কষ্ট ভুলে পুতুলের সংসার ছেড়ে গিয়ে নতুন আলোর দেশে।
Comments
Post a Comment