#জলছবি#
রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী
আজ ও স্কুল থেকে ফেরার পথে সুমতি নালিশ জানায় ,ও বৌদি , বিল্টু কে স্কুল বাস নামিয়ে দিলে ও বাড়ি তে না এসে ঢুকে পরে রেল এর ইয়ার্ড এ |
কি যে করে তিস্তা , এক রাশ মন খারাপের বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিলো তাকে | বিল্টু কে নিয়ে কি করবে ও ? তিস্তা ফেরার আগেই বিল্টু ফেরে স্কুল থেকে , বাস ওকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায় , যতদিন শিবানী র মা ছিল ওকে সামনের রাস্তা থেকে নিয়ে আসতো।
শিবানীর মা কাজ ছেড়ে যাবার পর খুব ঝামেলা বেড়েছে তিস্তার | চাকরি ,সংসার, অসুস্থ শ্বশুর মশায় , শাশুড়ি মা কে সামলে বিল্টু কে সেভাবে সময় দিতে পারে না তিস্তা | নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় | আজকাল কাজের চাপে , নানান সংসারের ঝামেলায় বড্ডো খিটখিটে মেজাজের হয়ে গেছে তিস্তা | সংসারে কোনো ভুল ত্রুটি এমন ভাবে সবাই সমালোচনা করে যে মাথা ঠিক রাখতে পারে না তিস্তা |
স্কুলেও বড়দির খারাপ ব্যবহার আর সমালোচনা অসহ্য মনে হয় মাঝে মাঝে |
মা বাবা র কাছে গিয়ে কেঁদে ফেলতো মাঝে মাঝে | আর এই মন খারাপ আর রাগের প্রভাব পড়তো বিল্টু আর অনিমেষের ওপর ।বিল্টুকে পড়াতে বসে মাঝে মাঝে ই মেজাজ হারাতো তিস্তা । সারাদিনের পরিশ্রম আর মন খারাপ ঝড়ে পড়তো বিল্টুর ওপর , কখনো কখনো মারধর ও করতো বিল্টু কে।
আবার বিল্টুর ফর্সা ফোলা ফোলা গালে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে দেখে অনুতাপ আর দুঃখে তার নিজের চোখ বেয়ে জল ঝরতো ।
রাতে অনিমেষ বোঝাতো , কি করছো তিস্তা ? তুমি না এতো বুদ্ধিমতী নিজেকে বোঝাও । সবার জীবন এক খাতে বয় না । আমাদের জীবনে এখন দুঃখ বেশি তুমি অবুঝ হোয়োনা ।
ঘুমন্ত বিল্টু কে দুই হাতে বুকের কাছে জড়িয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে তিস্তা । মনে মনে ভাবে কেন এমন হয় ?
বিল্টু দুষ্টু নয় ও এই বয়েসেই মা এর কষ্ট বোঝে কিন্তু পড়াশোনায় বড্ডো পিছিয়ে পড়ছে ।আর তিস্তা যখন সব কাজ শেষে বিল্টু কে অঙ্ক করাতে বসে তখন কিছুতেই মাথা ঠিক রাখতে পারতো না। এক কথা বার বার বলতে বলতে অধৈর্য হয়ে যেত তিস্তা কখনও বা চেঁচামেচি করত , আবার এক এক সময় নিজের দম বন্ধ হয়ে আসতো।একটু খুশির ছোঁয়া পেতে ছটফট করতো তিস্তা।কতই বা ইনকাম ছিলো তখন ওদের।টানাটানি করে কষ্টে দিন কাটতো।
বাড়ি এসে বিল্টু কে দেখে তিস্তা কাছে টেনে জিজ্ঞেস করে তুই কেন আবার রেল ইয়ার্ড এ ঢুকেছিলি ? কত মালগাড়ি ওখানে থাকে যদি হঠাৎ চলতে শুরু করে , কি হবে বাবু ? ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে তিস্তা | ওখানে যদি কোনো ছেলে ধরা থাকে কি হব ? আমার যে কেউ নেই তুই ছাড়া |
বিল্টু মা এর চোখে জল দেখে অসহায় হয়ে বলে , তুমি তো আমি আসার অনেক পরে স্কুল থেকে ফের | ঠাম্মা , দাদাই ঘুমিয়ে থাকে মা , শিবানীর মা ও নেই তাই আমি ইয়ার্ড এ ট্রেন দেখে বাড়ি আসি | ছেলে কে বুঝিয়ে কোলে টেনে নেয় তিস্তা , ক্লাস ফোরে পড়া বিল্টু মা এর কোলে চুপটি করে শুয়ে উদাস হয়ে ভাবে কবে সে ট্রেন চালাবে |
পরদিন স্কুলের পর খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরে তিস্তা , অনেক টা দূরের পথ তাকে আসতে হয় | দেখে বিল্টু আজ বারান্দায় বসে খেলছে তার গাড়ি গুলো নিয়ে | ছেলের গাল টিপে আদর করে তিস্তা | তাড়াতাড়ি হাতের কাজ গুলো শেষ করে দ্যাখে সুমতি একজন রান্নার লোক এনেছে হাফ ছাড়ে তিস্তা , যাক এবার ও একটু বিল্টু কে সময় দিতে পারবে |
সুমতি তিস্তা কে আড়ালে ডেকে ফিসফিস করে বলে , বিল্টু আজ ও রেল লাইন এর দিকে গিয়েছিলো ও দোতলা থেকে দেখেছে |
সুমতি চলে যাবার পর বিল্টু র ওপর রাগে , দুঃখে ভাষা হারিয়ে ফেলে তিস্তা |
আজ আর স্কুলে যায়নি তিস্তা বিল্টুর ক্লাস টিচার এর সাথে দেখা করে ব্যাপারটা বলে | উনি বিল্টু কে বলেন মা কাঁদছেন , মা কে দুঃখ দিস না , আর হাসতে বললেন ও তো পথের পাঁচালীর অপু| খুব কল্পনাপ্রবন , একদিন দেখবেন অনেক বড় হবে | ভালো মানুষ হবে |
বিল্টু আর সত্যি যায় নি রেল লাইন এ , মা এর কথা না শুনলেও মাস্টারমশায় এর কথা শুনেছিলো | আর তিস্তা ও একটু একটু করে পাল্টে ফেলেছিলো নিজেকে , জীবনের ছোট খাটো দুঃখ গুলো কে মুছে দিয়ে সাজিয়ে নিয়েছিল জীবন কে নিজের মতো করে।
Comments
Post a Comment