#ভেলার ফকির#
#রুমাশ্রী#
আকাশের রকম সকম ভালনা রে কুলসুম এর মা, আজও মনে হয় ঢালবে রে, তুই চুলাটা ধরাইয়্যা ফ্যালরে। দাওয়াতে পিড়ে পেতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ফতিমা।
কদিন একটানা বৃষ্টিতে তাদের উঠোন অব্দি জল। তার মধ্যেই খেলায় মেতেছে কুলসুম আর জাবেদ। চ্যাচাতে থাকেন ফতিমা, ' ওরে উইঠ্যা আয়, জ্বর জারি হইলে যামু কই, চারদিক জল থই থই করত্যাসে। খুব মজা পাইছস্ না? দিমু পিঠের গোড়ায় এক কিল।
চুলায় ফু দিয়া দিয়া কিসুতেই ভেজা লকড়ী ধরেনা আম্মু, কি যে করি? তেড়ে ওঠে ফতিমা , ধরত্যাসে না কইলেই হইবো? কি দিবি গুষ্ঠির মুখে শুনি। আর তর প্যাটের টা, খাইতে দেবার মুরাদ নাই। লজ্জায় মাথা নীচু করে কুলসুমের মা।
গজগজ করতে থাকে ফতিমা, অহন কি আর আমাগো যুগের মত। কত ব্যাবস্থা বারাইসে, চোখে দেহনা নাকি।
ফতিমা সানকি হাতে যায় ঘরে, হাড়ির তলায় চাল, আবার হাঁক মারে, ওরে পরী জাবেদরে কইছিলি ঘরে যে সব বাড়ন্ত। জ্বরে শুইয়্যা ছিলাম চারদিন, সব খাইয়্যা রাখছস্।
হায় আল্লা! কি দিন দিলা, কই যামু পোলাপান নিয়া তারপর এই পোয়াতী বউ।
আশেপাশের সব গ্ৰাম জলে ডুবেছে।দ্বীপের মত জেগে আছে তাদের গ্ৰামটি। আধিদারের জমিতে কাজ করে নুরুল, ফসল নিড়ানি করে, রোয়া দেয়। সারাদিন জলে কাদায় কাজ করে যা পায়, ওদের কোনরকমে চলে যায়। নিজের একবিঘা জমিতে শাকশব্জী লাগিয়ে, কোনমতে জোগাড় হয় মোটা কাপড়।
শুধু ফাতিমা নয়, সারা উত্তরবঙ্গের মানুষ এখন অসহায় প্রকৃতির কাছে।
এর মাঝে জাবেদ আর কুলসুমের মারামারি লাগে।চিৎকার করে ওঠে ফাতিমা, ওগো স্কুলে পাঠাসনি ক্যান শুনি। জ্বালাইয়্যা মারত্যাছে।
পরী মাটির হাড়িতে জাল দিতে দিতে বলে , আম্মু ভেলায় কইর্যা ওর বাপ নিয়া গেছিলো পরশুদিন। পড়া হয়নাই খাবারও দ্যায় নাই। মাস্টার রা আসেনাই চারিদিকে জল। কি করুম কও।
মর মর সবকটা, পোলাপানগুলা দুটা খাইত তাও দিলিনা। হায় আল্লা!
এর মাঝেই মাথায় কচুপাতা দিয়ে ভিজে জবজবে হয়ে ফিরলো নুরুল। হাতে একমুঠি কচুর শাক। ফতিমা এগিয়ে যায় , আইছস বাপ, দে আমারে দে। নুরুল কচুর শাকের মুঠি দিলে ফাতিমা বলে , ঘরে যে কিছুই নাই বাপ।
নুরুল বলে চারিদিকে কোমর সমান পানি আম্মু, জানোনা বুঝি, কিচ্ছু পাইলাম না। যা আনছি ওই আজ সিদ্ধ কইর্যা দাও। এরপর এও জুটবো না। না খাইয়া মরতে হইব পোলাপান লইয়্যা। ফাতিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হায় আল্লা।
নুরুল হাঁক পারে , ও পরী শাগে একটুস রসুন ফোড়ন দিস।
আম্মি বাগানে একখান মাইট্যা আলুর গাছ দ্যাখছিলাম, উপরাইয়্যা দেহি। এমন ধারা চললে কি খামু? পানিও পাওন যাইব না। কোন বাচ্চাকাল থনে বাংলাদেশ থনে আইয়্যা এহেনে আছি , এমন পানি এই দিনাজপুরে দেখি নাই। হায় আল্লা! পোলাপান, পোয়াতি বউ আর বুড়ি মাডারে লইয়্যা কই যাই?
পরী এদিকে আয় তো দেহি, এই যে একখান আলু পাইছি কেজি দু এক হইব, লইয়্যা যা। দাড়া আমি জলে ধুইয়্যা দিই। যা যা খারাইয়্যা থাকস না, তর ও তো শরীর খারাপ, মাথা মুইছ্যা ফেল।
আমি ভেলা খান শক্ত কইর্যা বান্দি, কখন কামে লাগে কে জানে?
সারা রাত বৃষ্টিতে বার হয় নাই নুরুল, ভোর রাতে ঘুম ভাঙে ফাতিমার চিৎকারে , ওরে বাপ সব শ্যাষ, ঘরে জল ঢুকছে। হায় আল্লা।
ধরমরিয়ে উঠে নুরুল মেঝেতে পা দিতে গিয়ে দেখে ঘরে জল।
কি দেখছে ! মনে হয় যেন অগাধ জলে ওদের বাড়ীর মাথাগুলো জেগে। একরাতে কোথায় এলো ওরা? এতো মাঝ দরিয়া।
নুরুল ফতিমাকে হাত ধরে এনে ইট দিয়ে উঁচু করে রাখা চৌকির ওপর বসায়। ফতিমা বুক চাপড়ে কাঁদতে থাকে।
আম্মি চুপ যাও, কাইন্দো না। পোলাপান গুলারে দ্যাখো। ওরে পরী ওহেনেই বইয়্যা থাক। আমি ভেলা কইর্যা দেখি আবুল আর মজিদ রা কই যাইবো? কি করবো। আমি আইত্যাসি।
সাবধানে বাপরে আমার। কি যে করুম আল্লা। চুপ যাও কাইন্দোনা।মনে বল রাখো।
ভেলায় দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে নুরুল। হায় আল্লা , ভিটা মাটি, জমি সব খাইলো বানের জল। একরাতে পথের ভিখারী হইলাম।গরীব ছিলাম তবুও তো নিজের বাসায় বইয়া শাগ ভাত টুকু খাইতাম পোলাপান লইয়্যা।
আজ যে আর কিছুই নাই। মজিদ, আবুলরা বলে ওরা চলে যাবে রিলিফ ক্যাম্পে, বসে আছে অপেক্ষায় কখন আসবে রিলিফের নৌকা।
নুরুল বাড়ী এসে বলে , আম্মু দুইখান পোটলা বান্দ দেহি, আমাগো কিই বা আছে ? একটাতে তোমার আর পোলাপানদুটার ন্যাতা কাপড় গুলা বাইন্দ্যা লও। ওরে পরী তর আমার যা যা আছে বাইন্দ্যা লে। আম্মু ছেড়া পাটি খান ও লও সাথে।
সারাদিন বইয়্যা আছি রিলিফ এর নাও কই বাপ? কখন আইব? ওরে বাপ পানিতো কোমর ছুঁইতে আসে রে, ও জাবেদ ও কুলসুম চালটা ছাড়িস না বাপ। জলে পইর্যা যাবি রে।
সারাদিন বাচ্চাদুইটা কিচ্ছু খায়নাই। হায় আল্লা।
এভাবেই রাত নামে উদ্ধার করতে কেউ আসেনা। উপোস করে বাচ্ছাগুলো ঝিমিয়ে পরেছে । পরদিন দুপুরে রিলিফের নৌকা আসে। ওরা বলতে থাকে প্রথমে বুড়োবুড়ি বাচ্চারা আসবে। তারপর মেয়েরা উঠবে, সব শেষে ছেলেরা।
ফতিমা বলতে থাকে, তরে ছাইর্যা আমি যামুনা বাপ। নুরুল বলে আম্মু উইঠ্যা আইস ওরে জাবেদ, কুলসুম আমার কোমর টা ধইর্যা খারা দেহি বাপ। তগো নাওয়ে দিয়া আসি। কুলসুম আর জাবেদ আয় আয় আর কান্দস না পরের নাও এ যাইত্যাসি আমরা।
পুটলি মাথায় নৌকায় ওঠে ফাতিমা, জাবেদ আর কুলসুম কে নিয়ে। বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় ডুবে যাওয়া ভিটার দিকে তাকিয়ে। ওইখানে এখনো মাচায় বসে অসহায় পোয়াতি বউটা।
নৌকা ছাড়ে, ফাতিমা হাক মারে বাড়ী যা বাপ।
মাচা ধরে ঝুলে থাকে পরী আর নুরুল কিন্তু কোথায় রিলিফের নৌকা? জল বাড়তে থাকে, চাল টাও এবার ডুবে যাবে। নুরুল এক ঝটকায় পরীকে হাত ধরে টেনে মাথায় পোটলা নিয়ে সাতরে উঠে পরে ভেলায়।
ওরে চল এমনিও মরুম অমনিও মরুম , হয় সাপের কামড়ে নয় পানিতে ডুইব্যা।
ভেলা টানতে থাকে নুরুল প্রাণপনে রাতের অন্ধকারে। হঠাৎ কানে আসে পরীর গোঙানির আওয়াজ। হায় আল্লা, আর কি দিন দেখাবা! এই অবস্থায় কি কষ্টই না পাইতাছে বউটা।
আর একটু সবুর যা বউ, পরী উত্তর দেয় আর পারতাছি না গো, প্যাটের টা ঠ্যালা মারে গো। বমি করে ফেলে পরী। যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। প্রাণপনে অবস হাত দুটো দিয়ে দাঁড় টানে নুরুল।
হায় আল্লা আর পারিনা, ভেলায় লুটিয়ে পরে পরী। ততক্ষণে চাঁদ ও অস্ত যাবার পথে। হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে শোনা যায় শিশুর কান্না।
ভোররাতে ভেলায় জন্ম নিলো বানভাসি মায়ের নবজাতক।
কান্নায় গলাটা বুজে আসে নুরুলের , খুব কষ্ট হয় পরীটার জন্য।
হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে দেখা যায় জোরালো আলো, নুরুলের কানে আসে মজিদের গলা, ওইখানেই খারা, আমরা আসতাছি।
নুরুল আর মজিদ পরীকে ধরে নৌকায় তোলে, পরী অসহায় ভাবে দেখে মজিদের কোলে ধরা বাচ্ছাটার দিকে। বৃষ্টির জলের ফোটা গড়িয়ে পড়ছে ওর মাথা বেয়ে।
নুরুল রাগ করে বলে জন্ম লইবার আর সময় পাইলো না অপয়াটা। হালায় আমাগো ফকির বানাইয়্যা ছাড়লো।ওরে ভেলায় কইর্যা ভাসাইয়া দে। কথাটা শুনে শিউরে ওঠে পরী।
মজিদ বাচ্চাটাকে পরীর কোলে দিয়ে বলে ও আমাদের বানভাসি ফকির রে। বানভাসি নবজাতক মায়ের কোলের ওম পেয়ে শূন্যে হাত তুলে চিৎকার করে জানান দেয় তার অস্তিত্ব।
Comments
Post a Comment