Skip to main content

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"

     আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত। 
ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা টুকটুক বৌ,আর আমি হলাম গিয়া তার কালা বর।"
লজ্জায় মাথা নিচু করে রাঙা। ইশ্ ছেলেটা একদম পাজি একটা কোন রাখ ঢাক নাই মুখে। মনে পড়ে গেল দিদির কথা। - " বলি ও রাঙা,তোর এমন টুকটুকা রঙ আর তোর বর তো এক্কেবারে কালা। মানে আমাদের কানাই আর কি। কি রে পছন্দ হইছে তো?"
ইস্ একবারই তো মাত্র দেখার সুযোগ পেয়েছিল কাছ থেকে। তাছাড়া তো লজ্জায় তাকাতেই পারেনি। কি করে বলবে পছন্দ কি না? তবে ছেলেটার কথাগুলো শুনেছে ভালো করে। বাবা বলেছে," পোলাটা ভালো।পড়াশোনা করে ঢাকা শহরে ইউনিভার্সিটিতে। গানও গায় নাকি। আবার ভালো ছবিও আঁকে শুনসি। আর ওদের হল গিয়া জমিদার বাড়ি। যদিও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অনেকটা পথ। তবুও মাইয়া আমাগো সুখেই থাকবো।" 

 আনমনা হয় রাঙা কানে মাখে সানাইয়ের সুর। মনে মনে ভাবে আজ হয়ত এই ফাগুনের প্রথম বিয়ের তারিখ আহা বড় মিঠে এই সুর। মন ভেসে যায় অনেক বছর আগের অতীতে। সেই কবে এমন মিঠে সুরের সানাই ওদের বাড়িতেও বেজেছিল একদিন নয়,বেশ কয়েকদিন ধরে। তবে সে কি আজকের কথা নাকি? কতগুলো বছর কেটে গেছে মাঝে। হিসেব মেলাতে গিয়ে বারবার অন‍্যমনস্ক হয়ে যায় রাঙা। একটু একটু করে মনে উঁকি দেয় অতীতের ঘটনা সারি বেঁধে যা হয়ত এখন শুধুই গল্প। বাড়িতে একলা থাকার অবসরে দোতলার ঘরে বসে আবার মনে ভিড় করে আসে অতীতের ফেলে আসা রঙীন দিনগুলো। চোখ বুজে রাঙা ডুবে যায় অতীতে......... কত বছর আগের কথা তবুও স্পষ্ট হয়ে আঁকা রয়েছে মনে। প্রতি মুহূর্ত এখনও চোখ বুজলেই দেখতে পায় সব ছবি।

         একটা মিঠে সুরে গতকাল থেকেই মন উচাটন রাঙার। বারবারই মনে হয়েছে এই বাড়িঘর সব ছেড়ে চলে যেতে হবে কোন অজানা জায়গায়। চট্টগ্রাম থেকে সেই সুদূর ঢাকায় রায়চৌধুরী পরিবারের ছোট বৌ হয়ে এসেছিল। প্রায় ছমাস আগে হঠাৎই প্রস্তাব দিয়েছিলেন মেজ পিসিমা ওঁর খুড়তুতো ভাসুরের ছোট ছেলের সাথে রাঙার বিয়ের সম্বন্ধের। আর তারপরেই দেখা শোনা হল পর পর দুবার,প্রথমবার শ্বশুর মশাই আর ভাসুর এলেন। বাবা জিজ্ঞেস করাতে ভাসুর বলেছিলেন ভাইয়ের এখন পরীক্ষা চলছে পরে আসবে। এখন এই একটু আলাপ করতে আসা,কাকিমা বলাতেই বাবা রাজী হয়ে গেলেন মেয়ে দেখতে আসতে।
    ওদের আনা দই মিস্টি আর মাছে বসার ঘর ভরে গেছিল। মা খুশি হয়ে বলেছিল," শুধু মাছ আর মিস্টি না। বাগানের কত ফল আনছে রে।"
       রাঙার তখন ষোলো বছর বয়েস। দিদি বৌদিরা বসে ওকে একদম মনের মত করে সাজাতে। তার আগেই এক দফা শুরু হয়ে গেছিল রূপটান মুলতানি মাটি আর হলুদ মাখিয়ে। চুলে আমলা সোনা দিয়ে চুল চকচকে করেছিল দিদি। হাসতে হাসতে বলেছিল," একটা দারুণ শাড়ি নিমু বাবার কাছ থেকে,আর ভাগ বসামু তর জিনিসেও। ওদের কইয়‍্যা দিমু সুন্দর ঢাকাই শাড়ি লাগব।"
     আদুরে গলায় রাঙা বলেছিল," দিদি কেন বিয়া দিতাছ আমার। আমি পড়ুম আরো,স্কুলে যামু।"
-" দেহ,মাইয়‍্যার কান্ড। দ‍্যাশ জুড়ে গন্ডগোল লাগতাছে মাঝে মাঝেই। এর মধ‍্যে উনি যাবেন নাকি স্কুলে! "

          তারপরেই আবার একদিন এসে দাঁড়িয়েছিল একটা বড় গাড়ি ওদের বাড়ির সামনে। তিনতলার ছাদের বড় আম গাছের আড়াল দিয়ে দেখেছিল ওরা বরকে। দিদি ফিক করে হেসে বলেছিল," মন্দ নয় তবে কালা। দ‍্যাখ রাঙা কি করবি।"
       ঠোঁট ফুলিয়েছিল রাঙা," আমার বয়েই গেছে বিয়া করতে।"

             পুরোনো কথা মনে করতে গিয়ে নিজের বয়েস ভুলে যায় রাঙা। একা ঘরেই হেসে ওঠে ফিক করে। ওপাশ থেকে একটা বৌ কথা কও ডেকে যায়। সবাইকে কাঁদিয়ে,নিজেও চোখমুখ লাল করে কাঁদতে কাঁদতে এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে। পিসিমা বলেছিলেন," কি কান্ড দেখো মাইয়‍্যার! ওরে তর লাল টুসটুস গালটা যে এবার ফুইল‍্যা ফাইট‍্যা যাইব। আয় একটু আদর কইর‍্যা দিই। আমি তো আছিই ভাবনা কি সোনা? ওরে ও নির্মল বৌরে সামলাতে পারিস না। আমাদের মাইয়‍্যাটার কি হাল করছস?"
      -" তোমাদের মাইয়‍্যা ছিঁচকাঁদুনে হলে আমি কি করুম শুনি কাকি?"
         সেদিন বরের ঠাট্টায় খুব রাগ হয়েছিল রাঙার তবে একটু একটু করে কখন যে বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল বুঝতেই পারেনি।

       রায়চৌধুরী বাড়িতে তখন গমগম করছে লোকজন চাকর বাকর আর আত্মীয়স্বজনে। প্রণাম করতে করতে হাঁটু ব‍্যথা হয়ে গেছিল রাঙার। মাথার ঘোমটা ফাঁক করে দেখেছিল কত্ত বড় বাড়ি। অন্দর মহল, বাহির মহল দুগ্গাদালান,পুকুর,বাগান। বড় জা বলেছিল," এখনি সব দেখলে পাও লাইগ‍্যা যাবে মাইয়াটার। কাকি একটু একটু করে চিনব সব। তাড়া কিসের?"
      আত্মীয়স্বজন ভিড় করেছিল বৌ দেখতে। সারা গ্ৰাম ভেঙে পড়েছিলো নতুন বৌ কেমন হল যদি একটু দেখা যায়। সেই ভিড়ে হিন্দু মুসলমান সবাই ছিল। ভাসুর বলেছিলেন," কাল আইস সবাই,সক্কলের নেমন্তন্ন আছে তো। কাল দ‍্যাখবা বৌমা রে।"
          পিসিমা কাপড় ছাড়িয়ে কলঘরে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন ভয় পাস না রাঙা আছি আমি বাইরে।
           কেমন যেন সব অচেনা তাই মনে বড় ভয় আর লজ্জা রাঙার। ওর সাথে আসা ভাই দুটো যে কোথায় গেছে কে জানে?
          কলঘর থেকে বাইরে বেরোয় রাঙা,শাড়ি পরতে তখনও সে তেমন পটু নয়। তবে মাথার ঘোমটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে কোমরে শাড়ি প‍্যাঁচায়। 
      বাইরে এসে দেখে পিসিমা নেই,চারদিকের গাছ গাছালি আর বড় ইঁদারা দেখে কেমন যেন ভয় হয় রাঙার। আস্তে করে ডাক দেয়, "ও পিসিমা কই গেলা?"
       হঠাৎই একটা সরু গলার আওয়াজ পায়," নতুন বৌদিমণি তোমার হইয়‍্যা গেসে? ও এই তো। খাড়াও আমি ঠিক কইর‍্যা দেই শাড়ি খান। যা মটমটা একখান কাপড় দিসে পরতে! উঃ বাবা।"
            অবাক হয় রাঙা মেয়েটাকে দেখে। ছিপছিপে পেটানো শ‍্যামলা শরীর আর টানা টানা চোখমুখ। পরনে একটা ডুরে চেকের সবুজ শাড়ি। দেখে বুঝতে পারে মুসলমান মেয়ে। বয়েসে হয়ত ওর থেকে কিছুটা বড় হবে।
     অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায় রাঙা,মুহূর্তে পরিপাটি করে লাল টকটকে জরিপাড় শাড়িখানা ওকে পরিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়।
      " বড়কর্তা বকবে কইর‍্যা কাল আর কাছে আসি নাই। কত রূপসী গো তুমি? আমাগো এই অঞ্চলে এমন বৌ তো একটাও নাই। তুমি হইলে গিয়া রাঙামাটির রাঙা বৌ।"
        প্রথম বোধহয় রাঙা বৌ নামটা ওর মুখেই শুনেছিলো আর লজ্জা পেয়েছিল। তারপরই জিজ্ঞেস করেছিল।
   -" তুমি কে?"
-" আমি আনোয়ারা,এই গ্ৰামেই থাকি। এই বাড়ির বাইরের সব কাজ আমিই করি বৌদিমণি। আমারে ছাড়া বড় বৌদিমণির জগত অন্ধকার।"
            রাঙা হেসেছিল ওর বকবকানি শুনে। কিছু কথা বলতে পারে মেয়েটা। কলতলা থেকে ঘরে আসার পথেই এই বাড়ির কত গল্পই না করে ফেললো। রাঙা শুনল ওর শাশুড়িমা মারা গেছেন সেই কবে, নির্মল তখন অনেকটা ছোট। শ্বশুরমশাই হয়ত চাইলে বিয়ে করতে পারতেন কিন্তু করেননি। দুই ছেলেকে মানুষ করেছেন তারপর বিয়ে দিয়েছেন বড় ছেলের। আর তারপর রাঙা এল ঘরে ছোট ছেলের বৌ হয়ে।
  -" আমি বকবক করি বলে খুব বকা খাই গো বড় বৌদিমণির কাছে। তবে আমাকে খুব ভালোবাসে গো।"
      আনোয়ারার কথার কোন উত্তর দেয় না রাঙা দিদিরা বলে দিয়েছে বারবার," শোন প্রথমেই বেশি কথা কোস না। নতুন বৌদের বেশি কথা কইতে নেই। অত লাফালাফি করতে নেই,জোরে হাঁটতে হয়না দুমদাম করে,আর ক্ষুধা পাইছে বলে গোল করতে নাই বুঝলা।"
       " ধুত্তেরি আর কি কি করতে নাই নতুন বৌদের। ভালো লাগে না।"
       ওকে আসতে দেখেই পিসিমা শান্তি পান," বাতের ব‍্যথা খুব বাড়সে তাই আনোয়ারাকে কইলাম যা একটু লইয়‍্যা আয় ওকে। বাহ্ বেশ শাড়ি পড়ছস গুছাইয়া। যা এবার মোটা কইর‍্যা সিঁদুর দে দেখি। আগে কপালে দিবি তারপর সিঁথিতে। কপালের গুণেই তো সিঁথিতে সিঁদুর পরি আমরা।"
          নিজের শূন‍্য সিঁথিটা একবার আয়নায় দেখে রাঙা, অতীতের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সিঁথির চারপাশে এখন সাদা চুলের ভিড়। কপালের দোষে বেশি দিন সিঁথি আঁকা হয়নি রাঙার। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে হঠাৎই। মন ছুটে যায় আবার অতীতের ঘটনার ভিড়ে।
      ধুমধাম করে বৌভাত হয়েছিল ঐ বাড়িতে,সারা গ্ৰামের লোক খেয়েছিল। সেজেগুজে ঘুরছিল আনোয়ারাও,বেশ লাগছিল ওকে। পিসির মুখে শুনেছিল আনোয়ারা বিধবা,খুব কম বয়েসে বিয়ে হয়েছিল। বিধবা হবার পর শ্বশুরবাড়িতে আর নেয়নি। বাবা মা কেউ নেই অনাথ। এই বয়সের মেয়ের একা থাকা অনেক আপদ ডেকে আনে তাই ওর শ্বশুরমশাই এই বাড়িতেই আশ্রয় দিয়েছেন ওকে। মাঝে মাঝে গিয়ে নিজেদের ঘরে একবার ঘুরে সাফ সুতরো করে আসে। খুব খাটিয়ে মেয়ে একসাথে চার জনের কাজ করতে পারে,বুদ্ধিমতীও। পিসিমা বলতে থাকেন," শুধু বুদ্ধি নাই রে মেয়েটা খুব সৎ। আমাগো বাড়িতে একদিন ডাকছিলাম ঝাঁট দিতে তা বড় বৌমার সোনার হারখানা খাটের তলায় পাইয়াও নেয় নাই। ফেরত দিয়া গেছে।"
          বৌভাতের দিন টুকটুকে রাঙার গা ভরা গয়না। হাতে মানতাসা,কৃষ্ণচূড়া, আমলেট,বালা,চুড়ি,রিসলেট মাথায় সিঁথি,গলায় হীরের চিক আর জরোয়ার ভারী হার। খোঁপা সেজেছিল সোনার বাগানে। রাঙার রূপে আলো হয়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ি। সবাই বলেছিল খুব লক্ষ্মীমন্ত বৌ গো। যেন দুগ্গা ঠাকুর বসে আছে আলো করে। ছোটদাদা বাবুর কপাল বটে। পিসিমা গর্ব করে বলেছিলো," ঘটকালি কিন্তু আমি করছি,কার ভাইঝি দেখতে হবে তো।"

 গ্ৰামে তখন রাঙার রূপের চর্চা চলছে অবশ‍্য ওর বড় জা সন্ধ‍্যাও সুন্দর দেখতে তবে একটা দুঃখের ছায়া মুখে মাখানো। আট বছরেও সন্ধ‍্যার কোলে সন্তান আসেনি। ঢাকায় অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি। তবে অনেকেই বলেছে আশা রাখতে। এখনি হতাশ হওয়ার কিছু নেই। শ্বশুরমশাই খুব একটা কাজকর্ম দেখেন না তাই মোটামুটি সব দায়িত্ব ভাসুরের কাঁধে। বৌভাতের পুরো দেখাশোনা একাই করছেন বিমল,এখনও নির্মলকে ছোট বলেই মনে হয় বিমলের। তাছাড়া পড়াশোনা নিয়েই তো থাকে ছেলেটা। বিয়েও করতে চাইছিল না তবুও বাবার খুব ইচ্ছে ছেলের বৌ আসুক ঘরে তাই অগত‍্যা রাজি হওয়া।
      তবে রাঙাকে দেখার পর এখন নির্মলের মনে শুধু পদ্মার ঢেউ। সত‍্যি কি সুন্দর দেখতে রাঙাকে,ঠিক যেন ফোঁটা পদ্মের কুঁড়ি। আর আজ তো চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা রাঙার দিক থেকে। ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে হীরের নথ পরা মুখখানা যা বারবার টেনে নিয়ে আসছে নির্মলকে। মুখ টিপে হাসে সন্ধ‍্যা," খুব তো বিয়েতে আপত্তি ছিল তা এখানে এত ঘুরঘুর ক‍্যান শুনি? এখন বন্ধু গো সামলাও। একদম রাতে কথা হইবো। আঙটিটা রাখছো তো পকেটে?"
      বৌদির কথায় মাথা নাড়ে নির্মল,একটু লজ্জাও পায়।
       হাতের হীরের আঙটিটা একটু ঘুরিয়ে দেখে রাঙা। অনেকবার মনে হয়েছে খুলে রাখবে আঙটিটা কিন্তু পারেনি কিছুতেই খুলতে। ওটাই তো নির্মলের দেওয়া একমাত্র আদরের চিহ্ন। আরেকটাও অবশ‍্য আছে তবে তা বাক্সবন্দী এখন। কতদিন বাক্সটা খুলে আর দেখেনি রাঙা,আগে মাঝে মাঝে খুলে বসত। আজকাল আর ইচ্ছে করে না।

      বৌভাতের পর্ব মিটিয়ে ঘরে যেতে যেতে অনেকটা রাত হয়ে গেছিলো রাঙার। মা বাবা আসতে পারেনি তবে দিদিরা এসেছিল,কানে কানে বলেছিল আদরে কত কথা," এই যে রাঙারানী বর আদর করবো,চুমা দিব কান্দন জুইড়ো না আবার।"
    "ও দিদি।"
 দিদিদের হাসিতে চাপা পড়ে গেছিল রাঙার কথাগুলো। ওরা নির্মলের সাথেও মজা করেছিল। ফুলের গন্ধে ভেসে গিয়েছিল ঘরটা। সব ফুল আনানো হয়েছিল ঢাকা থেকে। রায়চৌধুরী বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে কথা।
        দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়েছিল নির্মল খাটে গুটিসুটি মেরে বসেছিল রাঙা মাথায় ঘোমটা টানা। সোনার জড়ির কাজ করা বেনারসীর ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল রাঙার সুডৌল মুখখানা। নিজে নিজেই বলে নির্মল," এই জানলা খানা খোলা না থাকলে আমার ভালো লাগেনা। ওরা আড়ি পাতসে ওদিকে। দোতলার এদিকটায় বাগান,রাতে অন্ধকার কেউ আসবো না এদিকে। "
     রাঙার হাতটা ধরে খাট থেকে নিয়ে আসে নির্মল এই হাতের ছোঁয়া আগেই পেয়েছে রাঙা। ওর কাঁপা হাতদুটো শক্ত করে নিজের হাতে ধরেছিল নির্মল সম্প্রদানের সময়। ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নির্মল,মনে হয় নরম তুলতুলে পুতুল ওর বৌটা একদম। সত‍্যি কোন আঁচড় লাগতে দেওয়া যাবে না ওর গায়ে।
     দক্ষিণের জানলা দিয়ে ফুরফুর করে উড়ে আসে দখিনা বাতাস। কথায় কথায় ডুবে যায় নির্মল," আজ রাতে শুধুই কথা কইব তোমার সাথে। আলাপ হল কই তেমন কইর‍্যা। আগে তো মন পড়ব তোমার তারপর বইয়ের একটা একটা করে পাতা খুলুম আর আয়েস কইর‍্যা পড়ুম একসাথে। তুমিও কথা কও যা মনে আসে।"
     নির্মলের কথা শুনে হাসে রাঙা,কি এত কথা বলবে ওর নতুন বরের সাথে? তার থেকে শোনাই ভালো। বাইরে হাসির শব্দ শোনা যায়। নির্মল বুঝতে পারে জেঠতুতো খুড়তুতো ভাই বোনেরা আড়ি পেতেছে।
     তবে কিছুক্ষণ বাদে সব চুপচাপ হয়ে যায়। জানলা দিয়ে নেমে আসা চাঁদের আলোতে নির্মল ঘোমটা খুলে দেয় রাঙার। রূপোলী চাঁদের আলোতে ধুয়ে যাচ্ছে ওর মুখটা। আদরে জড়িয়ে চুমু খায় রাঙাকে, মাথা নিচু করে রাঙা তারপর একটা সময় জড়িয়ে ধরে নির্মলকে পরম অবলম্বনে।
             হঠাৎই নির্মল কোলে তুলে নেয় রাঙাকে,একটু ঘাবড়ে যায় রাঙা। রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙে রাঙার পায়ের মলের ঝুমঝুম শব্দে। দুষ্টুমি করে পা নাড়ায় আবার রাঙা সুর তোলে মল আবার। রাঙার অনাবৃত ধবধবে ফর্সা পা দুটো নজরে পড়ে নির্মলের। মনে ভিড় করে আসে হাজার কবিতা। হয়ত এই পা ধোয়াতেই ভিড় করে আসবে পদ্মা আর মেঘনার ঢেউ। 
     শিহরণ জাগে রাঙার শরীরে,নির্মলের বুকে তখন বিন্দু বিন্দু রক্তের ওঠানামা অলিন্দের সিঁড়ি পথ বেয়ে। একটু ভয় লাগে রাঙার। নব বিবাহিত দাম্পত‍্যের কিছু গল্প তার জানা। ফুলটুসির কাছে শুনেছে ওর ফুলশয‍্যার গল্প। তবে নির্মল যে এভাবে ওকে কোলে তুলে নেবে ভাবেনি।
                    ঘরের এক কোণে রাখা শ্বেতপাথরের চেয়ারে বসিয়ে দেয় রাঙাকে নির্মল। রাঙার রূপে রক্তক্ষরণ হয় শ্বেতপাথরের বুকেও। রাঙার অনামিকায় তখন হীরের আঙটি পরাতে ব‍্যস্ত নির্মল। পেলব আঙুলে দ‍্যুতি ছড়ায় হীরের আঙটি। ওর হাতটা ধরে একটা চুমু খায় আঙটির বুকে নির্মল। তারপর চুমুতে ভরিয়ে দেয় রাঙাকে। রাঙার শরীরের অনাবৃত অংশে নির্মলের আদরের ছোঁয়া। তারপর শাড়িটা একটু তুলে রাঙার মল পরা পা দুটো অনাবৃত করে। সঙ্কুচিত হয় রাঙা। নির্মল হাসে,ওর শরীরে তখন পৌরুষের হানা।
   - " চুপটি কইর‍্যা পা তুইল‍্যা বস একদম ঝামেলা কইর‍্যোনা। তাহলে বকা দিমু কিন্তু।"
    ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দেয় নির্মল তারপর ছবি আঁকতে বসে ঘরের এক কোণে রাখা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে। একভাবে বসে থাকতে থাকতে হাই তোলে রাঙা তবুও বলতে পারেনা কিছু। একটু আগেই নির্মল এসে আদরে ওর ঠোঁট দুটো বুজিয়ে দিয়ে গেছে। এরপর বকবে বলেছে।
           দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকটা সময় এইভাবে। কখন যে ঘুমে চোখ জড়িয়ে গেছে রাঙার বুঝতেই পারেনি হঠাৎই ঘুম ভাঙে জানলা দিয়ে আসা পাখির কলতানে। একটা বুলবুলি উঁকি দেয় জানলায়। কোন একটা ঘর থেকে ভেসে আসছে গানের সুর," রাই জাগো রে, জাগো শ‍্যামের মনমোহিনী বিনোদিনী রাই।"
          চোখটা কচলে উঠে বসে রাঙা,ওদিকে এক মনে ছবির স্কেচে ব‍্যস্ত নির্মল। উঠতে ভয় পেলেও আর বসতে পারে না ভোর হল যে দিদিরা বলে দিয়েছে ফুলশয্যার পরদিন ভোরে উঠে স্নান করে নিতে হয়। না হলে সবাই হাসাহাসি করবে।
     ওকে উঠতে দেখে নির্মল বলে," নাও তোমার এবার ছুটি।"
 ততক্ষণে দরজায় টোকা পড়েছে,দরজা খোলে নির্মল রাত জাগায় চোখ লাল,চুল উস্কোখুস্কো। ঘরে উঁকি দেয় বৌদি দেখে খাটের কোণে দাঁড়িয়ে রাঙা। দেখে মনে হয় সারারাত ঘুমোয়নি। মুচকি হাসে সন্ধ‍্যা," ও ছোট আয় এবার কলঘরে যাইতে হইব। বড় জ্বালাইছে না রাতে? একটুও ঘুমাতে দেয় নাই, না? এরা এমনি পাজি। চল চল তাড়াতাড়ি। তারপর পূজার ঘরে ঢুকবি। আজ থেকে পূজার দায়িত্ব তর। আমি দেখুম ওদিকে। বাবা এতদিকে খেয়াল রাখা! আর পারি না।"

       রাঙা চলে যেতে যেতে একবার তাকায় নির্মলের দিকে। নির্মলের মুখে তখন গাল ভরা হাসি। যেতে যেতে ভাবে রাঙা এমন বর হয় নাকি? সারারাত বৌরে বসাইয়া যে ছবি আঁকে। তবে সত‍্যই তো কি ছবি আঁকলো তা তো দেখা হয় নাই কাছে গিয়া।
         ননদেরা অনেকেই ধরলো রাঙাকে," ও বৌ তা কাল রাতটা ঠিক ছিল তো? না ছোড়দা ঘুমাইতে দেয় নাই।"
     পাশ থেকে খুড়তুতো জা বলে," ঠাকুরঝি তোমরাও যেমন,এমন সোন্দর বৌ রে কেউ ঘুমাইতে দেয় নাকি? তবে ফাঁক পেলে ঘুমাইয়‍্যা লইয়‍্যো। নতুন বিয়া করছো এখন তো প্রতি রাতই কাটবে জাইগ‍্যা।"
       রাঙার রাগ হয়,এমনিতেই কদিন ভালো করে ঘুম হয়নি। বাড়িতে ছোট হবার সুবাদে একদম মায়ের আঁচল জড়িয়ে ঘুমোত। আর এখানে ঘুমই হবে না?

************************
তারপর কবে যে সেই রাগ অনুরাগে পরিণত হয়েছিল বুঝতেই পারেনি রাঙা। দোতলার ঘরে দখিনা বাতাস গায়ে মেখে কত রাতই জেগেছে স্বামী সোহাগে ভিজতে ভিজতে রাঙা। সেদিনের ফুলশয‍্যার রাতে আঁকা রাঙার ছবিটা ওর হাতে দিয়ে নির্মল বলেছিল, ফুলশয্যার রাতে ফুলের বিছানায় শুয়ে লোকে আদরের আলপনা আঁকে প্রেয়সীর বুকে। আর আমি রঙ তুলি হাতে নিয়ে আঁকলাম আমার প্রেয়সীকে একদম আমার কল্পনার মত করে। কাগজটা থাক তোমার কাছে। আর প্রথম রাতের নববধূ রাঙা রইল আমার মনে।
        যত্নে কাগজে আঁকা বরের প্রথম উপহার ভরেছিল নিজের বাক্সে।
              শ্বশুরবাড়িতে পুজোর ঘরে প্রথম দিনই দিদি ঢুকিয়ে দিয়েছে ওকে। কিন্তু দিদিকে কি করে বলবে যে ও এখন ঠাকুর ছুঁতে পারবেনা। মা তো ছোট থেকে তেমনি শিখিয়েছে। তবুও একরাশ লজ্জা মেখে রাঙা বলেছিল," ও দিদি আজ আমি পূজা করুম না,তুমি সারো পূজা। আমার শরীরটা কেমন যেন লাগে। "
     তারপর যা হয়েছিল তা ভেবে আজও লজ্জা লাগে রাঙার মোটামুটি শ্বশুর, ভাসুর সবাই জেনেছিল ও এখন ছোঁয়া। সঙ্গে সঙ্গে স্নান করিয়েছিল দিদি,আর তারপর জল পর্যন্ত ছুঁতে দেয়নি। এমন কি নির্মলের সাথে শোয়াও বারণ ছিল। পাঁচদিন পরে একেবারে মাথা ঘষে স্নান করে এক বিছানায় শুয়েছিল ওরা। জা কানে কানে বলেছিল," বাড়িখান বড় ফাঁকা আমার তো হইল না তোর অন্ততঃ একখান সুখবর আসুক এবার। "
         বেশ কয়েকদিনের বিরহ আর তারপর ভালোবাসার সহবাস এভাবেই কেটে গেছিল একটা বছর তবে তখনও সুখবর আসেনি। জা আর পিসিমা বলাতে লজ্জা পেয়েছিল রাঙা।
   " বলি অত রাত জাইগ‍্যা আলো জ্বালাইয়া,গান গাইয়‍্যা কর কি শুনি দুডায়? এখনও খবর নাই ক‍্যান?"
      মিনমিন করে রাঙা বলেছিল," ও ছবি আঁকে আর আমি গান শুনি। আমারে পড়ায় মাঝে মাঝে বইপত্র বার কইর‍্যা। বলে তুমি এখন ছেলেমানুষ। এখন পড়ার বয়েস।"
      কপাল চাপড়ায় সন্ধ‍্যা," আরে ছেমড়ি,বিয়ার পর আর কেউ ছোট থাকেনা।"
        সত‍্যিই হয়ত বিয়ের পর কেউ ছোট থাকেনা তাই হঠাৎই অনেক পরিণত হয়ে গেছিল নির্মলের আদরের রাঙা।

      দেশ জুড়ে তখন অশান্তি লেগেছে,দেশভাগের আগুনের উত্তাপ ছড়িয়েছে সর্বত্র। একসময় যারা ওদের প্রজা ছিল তারাও আজ চোখ রাঙিয়ে কথা বলে। এই করে বেহাত হল কত জমি। করিম চাচা বলে গেল," বাবু শোনেন,জমিতে হাল দেই আমি,ফসল ফলাই আমি আর জমিন আপনার এ কেমন কথা? আজ থেকে আর ফসল পাইবেন না।"
     ফুঁসে উঠল আনোয়ারা," কও কি চাচা? এত বছর এই বাড়ির নুন খাইয়‍্যা শেষে বেইমানি করলা! বাবুর মনে কতখানি দুঃখ লাগল বোঝ তোমরা?"
         " তুই চুপ যা ছেমড়ি,এটা আমাগো মুসলমানদের দেশ। আর হিন্দুদের দাসত্ব কিছুতেই মানুম না আমরা। সেলিম,আতাউর, মাসুদ সবাই এক কথা বলে। তুই বা কেন আছস এহেনে?"
      " আমি নুন খাই তাই পইড়‍্যা আছি,আমি তো বেইমান নই যে কর্তাদের ছাইড়‍্যা চইল‍্যা যামু? তাছাড়া আছে কে আমার?"

      ভাত দিতে গিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে পায় রাঙা শ্বশুরমশাই ভালো করে খান না। ভাসুরের মুখে চিন্তার রেখা। হাড়ির ভাত হাড়িতেই পড়ে থাকে। আসে পাশের অনেক আত্মীয়স্বজন জমিজমা অল্প পয়সায় ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে কলকাতায় বৌ মেয়েদের নিয়ে। দু একজন পুরুষ আছে কোন বাড়িতে আবার কোন বাড়ি একদম ফাঁকা। নির্মল তখন ঢাকা শহরে গেছে। একলা ঘরে কেমন যেন ভয় ভয় লাগে রাঙার। দক্ষিণের জানলা বন্ধ করে দিয়ে ঘুমোয় তারমধ‍্যে শুনতে পায় দূরে চিৎকার চ‍্যাঁচামেচি আর উল্লাসের শব্দ।
      সকালে দরজা খুলতেই আনোয়ারাকে দেখে বাইরেটা ঝাড় দিচ্ছে। অবাক হয়ে যায় আনোয়ারা রাঙাকে দেখে। 
-"বৌদিমণির কি অসুখ করেছে? কেমন যেন শুকনো চোখমুখ।"
-" না রে,কেমন যেন ভয় করে রাতে। তোর দাদাবাবু নাই তো। কবে ফিরবো কে জানে?"
  -" ও মা তুমি আমারে কও নাই ক‍্যান তোমার ভয় করে। আমি সারারাত দাঁ হাতে শুইয়‍্যা থাকতাম দরজার গোড়ায়।"
    আনোয়ারার কথা শুনে হেসে ফেলে রাঙা। বেলার দিকে একটা চিঠি এনে দিদি হাতে দেয়। খুলে দেখে বাবার চিঠি। অবাক হয়ে যায় রাঙা বাবারা দেশ ছেড়ে চলে যাবার আগে কাউকে দিয়ে এই চিঠি পাঠিয়েছেন। বলেছেন চট্টগ্রামে খুব গন্ডগোল এখানে আর থাকার উপায় নেই তাই মোটামুটি সর্বস্বান্ত হয়ে দেশ ছাড়তে হল। খুব কান্না পায় রাঙার,মনে পড়ে যায় ওর বাপের বাড়ির কথা। আর কোনদিনই যাওয়া হবে না সেখানে। অথচ কত স্মৃতির পাতা জমে আছে মনের খাঁজে খাঁজে। ওর ছোটবেলা আর মেয়েবেলার সবটাই যে বাঁধা আছে ঐ বাড়িতে। আচ্ছা বাবা মায়ের সাথেও কি আর কোনদিন দেখা হবে না?
     ঘরের দরজা ভিজিয়ে বালিশ ভেজায় রাঙা। চোখের জলে লাল হয় গাল না বলতে পারা কথাগুলো ধাক্কা মারে দেওয়ালে শুধু একটা কথাই ঘুরে ফিরে আসে...মা বাবা তোমরা কোথায় গেলা? কোনদিন কি দেখা হইব না আর?
       হঠাৎই একটা শক্ত বাহুবন্ধনের স্পর্শ পায় রাঙা। মনের আবেগ আরো দ্বিগুণ হয়ে শ্রাবণের ধারা হয়ে ঝরে পড়ে। নির্মল রাঙাকে আগলায় একদম বুকের কাছে এনে," ধুর পাগলী আমি আছি তো নাকি? কোথায় যাবেন তারা আমি লইয়‍্যা যামু তোমায় তাগো কাছে। বাড়ি ঢুইক‍্যা না দেইখ‍্যা ছুইট‍্যা আইছি ওপরে।"
        রাঙাকে শান্ত করে নির্মল ছুটে যায় বসার ঘরে এতদিন বাড়ির ছোট ছেলে হয়ে নিজের শখ আহ্লাদ আর পড়াশোনা নিয়ে দিন কাটিয়ে দিয়েছে। দাদা আর বাবাও ওকে বিরক্ত করেনি। তবে এবার অনেক দায়িত্ব মাথায়। ঢাকা শহরে দাঙ্গায় পুড়ছে ঘরবাড়ি, সোনারগাঁও তে আগুন। আর ওরা তো একদম কাছাকাছি থাকে ঢাকা থেকে। এখানেও ছড়িয়ে পড়বে যে কোন সময় আগুন।

      রাতে দরজা বন্ধ করে আলোচনায় বসে নির্মল বাবা আর দাদার সাথে। সেদিন রাতে কেন যেন কারও গলা দিয়ে ভাত নামেনি নির্মলের কথা শুনে। রাঙাকে আনোয়ারা পৌঁছে দিয়েছিল ওর ঘরে,সকাল থেকেই মনটা ভীষণ খারাপ বৌদিমণির বুঝেছিল।
-" তুমি বিছানা কইর‍্যা শোও,আমি বাইরেই আছি। ছোড়দা আইলেই চইল‍্যা যামু নিচে।"
    কেন যেন হঠাৎই আনোয়ারার হাতদুটো চেপে ধরেছিল রাঙা। রাতটাকে মনে হয়েছিল গা ছমছমে একটা রাত।
      অনেকদিন বাদে রাঙাকে কাছে পেয়েও আদরে ডুবিয়ে দিতে পারে না নির্মল। হাতে সময় বেশি নেই এর মধ্যে অনেক কাজ গুছোতে হবে। বাবার শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। এখনকার মত সিদ্ধান্ত হয়েছে দাদা ওদের সবাইকে নিয়ে চলে যাবে কলকাতায় রাতের অন্ধকারে। নির্মল কয়েকদিন থাকবে এখানে,তারপর এদিকটা একটু গুছিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে ও চলে যাবে কলকাতায়।

       সারারাত প্রায় ঘুমহীন কেটে গেল নির্মলের। রাঙা ওর বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। ওকে বুকের আরও কাছে এনে জড়িয়ে রাখে নির্মল। আবার কতদিন বাদে এভাবে রাঙাকে কাছে পাবে কে জানে?
     এমনিতেই মেয়েটার মনটা খুব খারাপ তারপর এই খবরটা শুনে কি করবে কে জানে?
     নির্মলের আলিঙ্গনে ঘুম ভেঙে যায় রাঙার। নির্মলের প্রিয় জানলা আজকাল আর খোলেনা ওরা রাতে। মনে ভয় কি জানি কি হয়। তবুও পাখির ঘুমভাঙা আওয়াজ ভেসে আসে কানে। নির্মলের আদরে সাড়া দেয় রাঙা। ওকে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয় নির্মল। রাঙা অনুভব করে নির্মলের প্রতিটা স্পর্শ। একটা সময় নির্মল রাঙাকে টেনে নেয় একদম বুকের ওপর,তিরতির করে কাঁপে রাঙা। নির্মল বলে একটু একটু করে না বলতে পারা কথাগুলো রাঙাকে ভোরের বাতাসকে সাক্ষী করে। নির্মলের কথায় ভারী হয়ে যায় ভোরের বাতাস। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রাঙা," আমারে একলা ছাইড়‍্যা দিয়ো না। তুমি ছাড়া যে আমার আর কেউ নাই। আমি তোমার লগে থাকুম একসাথেই যামু। তোমাকে এহেনে কে দেখব? আচ্ছা তুমি কবে আসবা? তুমি আসবা তো?"
          প্রশ্নটা করেই নিজের মুখে চাপা দেয় রাঙা। বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ে নির্মলের বুকে মুখ রেখে।
      " ধুর পাগলী আমি আসুম তো শিগ্গিরি,আমার পরাণরে ছাইড়‍্যা থাকতে পারুম নাকি আমি দূরে? বাবার বন্ধু আছে না ইসমাইল চাচা ওনারাই কিইন‍্যা নিব বাড়িখান। টাকাও তো লাগব নাকি?"
         -" আমি তাইলে থাকি তোমার সাথে? একলা যে বড় ভয় লাগে। তুমি খাবা কি? কি করবা?"
     -" ধুৎ পাগলী,আনোয়ারা তো আছেই ও রাইন্ধ‍্যা দিব।"
     -" কিন্তু দিদি তো ওরে রান্নাঘরে কাম করতে দেয় না।"
-" বৌদি তো তখন থাকবে না। তুমি তো জানই আমি ঐ সব জাতপাত মানি না। আর কটাই বা দিন? খুব জোর সাতটা দশটা দিন।"
      খুব কান্না পায় রাঙার,কোথায় যাবে ওরা? সবাই কয় একটা নতুন দ‍্যাশ। ওখানের মানুষ জন বাংলাতেই কথা কয়। তবুও নিজেদের বড় হওয়ার দেশ,বিয়ে হয়ে এসে শ্বশুরঘরের ভালোবাসা বাসির বাসা ছেড়ে কোথায় গিয়া থাকবে ওরা? কেমন হবে সেই নতুন দেশ? নির্মলকে ছেড়ে রাতে ঘুমাবে কি করে? আবার নির্মলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে রাঙা। কান্না পায় নির্মলেরও কিন্তু পুরুষ মানুষের নাকি কাঁদতে নেই। এই দেশ যে তার জন্মভূমি আর ভালোবাসার দেশ তাকে ছেড়ে কি করে থাকবে? কি করবে নতুন দেশে? আর রাঙা, তাকে ছেড়ে থাকাও যে বড় কষ্টের।
     পরক্ষণেই নির্মলের মনে হয়,আগুন জ্বলছে শহরে লুটপাট হচ্ছে বাড়িঘর। মেয়েদের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি। কত মেয়ে যে ধর্ষিতা হচ্ছে। ধর্মের লড়াইয়ে মেতেছে মানুষ,আর হিন্দু মুসলমান বন্ধু নয়। উভয়ে উভয়ের বিরুদ্ধে ধরেছে হাতিয়ার। পুড়ছে সম্পর্ক হিংসার আগুনের ঝলকানিতে। মরছে মানুষ,ধর্ষিত হচ্ছে মানবতা আর সৌভ্রাতৃত্ব। রাঙার রূপের প্রশংসা সারা গ্ৰামে। ঘোমটা ঢাকা রাঙা এখনও অনেকের কাছেই অদেখা সুন্দরী, গ্ৰামের রায় চৌধুরী বাড়ির ছোট বৌ। যদি কোন এক রাতে দুষ্কৃতীরা এই বাড়িতেও হামলা চালায় আর রাঙাকে.....ভাবতে পারে না নির্মল গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ঢাকা শহরে গিয়ে শুনেছে ওর বন্ধু সুবিমলরা কোন রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে কিন্তু নিয়ে যেতে পারেনি বোনটাকে। ওর ফুলের মত বোনটার শরীর ছিন্নভিন্ন করেছে হিংসার লালসা। গ্ৰামে গ্ৰামে এসেছে অপরিচিত দুষ্কৃতী যাদের কাজ লুটপাট করা আর আগুন জ্বালানো। এ কোন অচেনা দেশ!

      **************************
সকালে আনোয়ারার কাছে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাঙা। শুধু আনোয়ারা জানে ওরা গ্ৰাম ছেড়ে চলে যাবে। হয়ত বা আরও দুএকজন জানে। 
-" আমার কিছু ভালো লাগতাছে না আনোয়ারা। তুই একটু দেখস ওরে। পাহারা দিয়া রাখবি যেন রাতে না বাইরে যায়। তোর ভরসায় রাইখ‍্যা গেলাম ওরে।"
    আনোয়ারার চোখ বেয়ে জল ঝরে পড়ে। হয়ত কোনদিন ভাবেনি এমন দিন আসবে। ভেবেছিল এই বাড়ির একজন হয়ে ওর জীবন কেটে যাবে। কিন্তু এ কি হল? গ্ৰামের মানুষজনের মনোবৃত্তি পাল্টাচ্ছে। গ্ৰামের দুর্গামন্ডপে এর মধ‍্যেই গরু কেটেছে ওরা বলেছে এখানে আর কোন পূজা হবে না। অথচ একটা সময় হিন্দু মুসলমান মিলে দুর্গাপূজা,ঈদ সব কত আনন্দে পালন করেছে ওরা। হায় আল্লা এসব কি হচ্ছে?

   - " কিস‍্যু ভাইব‍্যো না রাঙা বৌ আমি দেখুম সব। তারপর যা করেই হোক পাঠায় দিমু ছোড়দারে কলকাতায়। কাইন্দো না,কি করছ মুখটারে! যাও গুছায়ে নাও সব। না হলে কও আমি দিতাছি গুছাইয়‍্যা। "
      চোখের জল মোছে সন্ধ‍্যা কাল সারা রাত ওরা স্বামী স্ত্রী ঘুমায়নি। রাত জেগে কাগজপত্র গুছিয়েছে বিমল,কিছু গয়নাগাটি আর ভারী বাসনও গুছিয়েছে। যেটুকু নিয়ে যাওয়া যায় সাথে। সন্ধ‍্যা পোটলায় বেঁধেছে রাধাগোবিন্দ,সাথে গোবিন্দর গয়না আর সোনার বাঁশী। নিজের গয়নাগাটি যা ছিল সব কিছু নিয়েছে সাথে।
        শাড়িও ভরেছে কয়েকটা ট্রাঙ্কে। শাশুড়ির দেওয়া সোনার জড়ির বেনারসী আর ওঁর ফটোটা নিতে গিয়ে ঝরঝর করে কাঁদে সন্ধ‍্যা। 
    " মা আর তোমার ভিটায় বাতি দিতে পারুম না সন্ধ‍্যাবেলা। কোথায় যামু কি করুম কে জানে? তোমার পোলা গো দেইখ‍্যো মা। "
             দুদিন ধরে শ্বশুরমশাই কিছু খাননি। অনেক কষ্টে একটু দুধ খাওয়ানো গেছে। বারবার বলছেন-" আমারে লইয়‍্যা আর টানাটানি করিস না তোরা। এখানেই ফেইল‍্যা রাইখ‍্যা যা। মরুম তো এখানেই মরি। আর কটা দিনই বা বাঁচুম।"

বিমল বারবার করে বলে ভাইকে," তুই ছেলেমানুষ তুই যা গিয়া ওগো লইয়‍্যা। আমি বরং কদিন থাইক‍্যা এদিকটা সামলাইয়‍্যা যামু।"
    নির্মল শুনতে চায়না," তুমি সকলেরে নিয়া যাও দাদা। তোমারে সকলে চেনে,নতুন দ‍্যাশে গিয়া আমি কি করুম। বরং এহেনে সামলাইয়‍্যা নিমু।"

-" আমি কইয়‍্যা যাইত‍্যাছি যাদের কওয়ার। তুই তাড়াতাড়ি সব সামলাইয়‍্যা চইল‍্যা আসিস। ভাবিস না সব ঠিক হইয়‍্যা যাবে।"
    দাদাকে বলতে পারে না নির্মল রাঙার বুকফাটা কান্নার কথা। শুধু বলে," ছোট বৌরে একটু দেইখ‍্যো দাদা। অবশ‍্য বৌদি তো আছেনই। আসলে মা বাপ সকলেই তো দেশছাড়া তাই ওর মনটা বড় অস্থির। ছেলেমানুষ তো।"
       ছেলেমানুষ ভাই বৌয়ের দিকে তাকিয়ে মন খুব খারাপ হয় বিমলেরও কত আর বয়েস হবে মেয়েটার হয়ত এতদিনে আঠারো হয়েছে। এখন কত স্বপ্ন আর সুখ চোখের পাতায়। হায় ভগবান কি দিন এল!


*************************
    বাগানের পথে গোরুর গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে, এই পথ যাবে সোজা নদীর ধারে। রাতের আঁধারে চারধার শুনশান। বোবা রাতে নীরবে ফুঁপিয়ে কাঁদে রাঙা। বিমল লুটিয়ে পড়ে স্পর্শ করে দেশের মাটি আরেকবার। রাঙার শ্বশুরমশাই কে কোন রকমে ধরে গাড়িতে তোলে নির্মল। ওদের সাথে গ্ৰামের কয়েকজন বিশ্বস্ত লোক। পরপর দুটো গরুর গাড়ি এগিয়ে যায়। রাঙা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রেখেছে নির্মলের হাত। নির্মল ওকে ধরে রেখেছে। " ভাইব‍্যো না এই তো কয়েকটা দিন। তুমি ঘর সাজাইতে সাজাইতে আমি চইল‍্যা আসুম।"

      ফাঁকা বাড়িটা যেন গিলতে আসে আনোয়ারাকে। মনে পড়ে যায় রাঙা বৌয়ের বিয়ের সময়ের কথা। এই তো মাত্র কিছুদিন আগের কথা। বাড়িটা গমগম করছিল লোকজন আর আলোতে। কত আনন্দ,হাসি আর মজা। নিচে রফিক আর ওপরে আনোয়ারা। এতবড় বাড়িতে মাত্র এখন ওরা দুটো প্রাণী। ছোড়দার আসতে আসতে হয়ত ভোর হয়ে যাবে। অবশ‍্য সাথে লোক আছে ছোড়দার তাই কোন চিন্তা নেই।
         বাইরে কোথায় যেন একটা লক্ষ্মী প‍্যাঁচা ডাকছে আজ এই বাড়ি লক্ষ্মীছাড়া। রাঙা বৌয়ের ঘরের দরজা খানার পাল্লায় শব্দ হয় হঠাৎই আসা দমকা ঝড়ে। একটা সময় রাঙা বৌয়ের মলের আওয়াজে ঝমঝম শব্দ উঠত সারা বাড়ি জুড়ে। পায়ে লাল টুকটুকে আলতা পরে রূপোর মলে রাঙা পা সাজিয়ে মাথায় ঘোমটা তুলে ঢাকাই মসলিন পরে রাঙা বৌ ঘুরে বেড়াত সারা বাড়িতে। এক দুইদিন আনোয়ারার চোখে পড়েছে ছোড়দার সাথে রাঙা বৌয়ের ভালোবাসার দু একটা ছোট দৃশ‍্য। একটু শিহরণ জেগেছে আনোয়ারার, ওর বরটাও এমনি ছিল ওকে চোখে হারাত। তবে স্বামী সোহাগের কপাল ওর ছিল না তাই কদিন আর পেয়েছে স্বামীকে? এরপর কত কুপ্রস্তাব এসেছে, অনেকেই ভোগ করতে চেয়েছে ওর যুবতী শরীরটাকে কিন্তু আনোয়ারা ঘেঁষতে দেয়নি কাউকে। আর শেষে আশ্রয় পেয়েছিল এই বাড়িতে। রাঙা বৌ ওর থেকে অনেকটাই ছোট তবুও রাঙা বৌয়ের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল আনোয়ারা। ওকে দিদি বলতে গেলে আনোয়ারা বলেছিল," নাম ধইর‍্যাই বল রাঙা বৌ আমরা হলাম গিয়া কামের মানুষ। লোকে শুনলে কইবো কি?"
      ওর কথা শুনে অবাক হয়ে রাঙা হেসেছিল। খুব শান্ত মেয়ে ছিল রাঙা বৌ,কোনদিন উঁচু গলায় কথা বলতে শোনেনি।

         রাঙার হাত ধরে নৌকোতে তুলে দেয় নির্মল,ডুকরে কেঁদে ওঠে রাঙা। রাঙার আর সন্ধ‍্যার ফোঁপানো কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে পদ্মার বাতাস।
  " সাবধানে থাইক‍্যো ঠাকুরপো,আমি আনোয়ারারে সব কইয়‍্যা আইছি। তাড়াতাড়ি কাম শেষ কইর‍্যাই চইল‍্যা আইসো।"
-" ওরে সামলাইয়‍্যা রাইখ‍্যো বৌদি।"
ভেজা চোখে আবার সবাই দেশের মাটির দিকে তাকায়। থমকে দাঁড়ায় বিমল,জড়িয়ে ধরে ভাইকে। খুব মন খারাপ করে ওর জন‍্য। মাঝিরা চাপা গলায় ডাক দেয়," জলদি করেন কর্তা,হাওয়া ভালা না। কখন কি হয়! ছাড়তাসি নাউ এবার। তাড়াতাড়ি উইঠ‍্যা পড়েন।"

       নৌকা মাঝ নদীতে ভাসতে ভাসতে চলে আসে। টিমটিমে আলোর দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে নির্মল। ওদিক থেকে চাপা গলায় ডাক আসে," জলদি চল ভোরের আগেই বাড়ি ঢুইক‍্যা পড়। এখন যেন কেউ কিছু না জানে। "
        গরুর গাড়ির ক‍্যাঁচকোচ আওয়াজে চাপা পড়ে যায় নির্মলের বুক ফাটা দীর্ঘশ্বাস। নৌকার ছইয়ের মধ‍্যে সন্ধ‍্যার ঘাড়ে মাথা রেখে কেঁদে চলে রাঙা। তারপর একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্তিতে।

     *******************
পরের দিন ওরা পা রাখে নতুন দেশে। রাঙার পায়ের মল আর উচ্ছ্বাসে বাজে না,কারণ তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে কখন যে একটা মল ফেলে এসেছে ঘরে বুঝতে পারেনি। আজ বরং ভয়ে ভয়ে পা রাখে এক অন‍্য দেশের মাটিতে যেখানে তার মনের মানুষ আর তেমন কেউ আপনজন নেই। গাড়ি ছিল ওপারে রাখা তাতেই উঠে বসে ওরা যায় কলকাতার উদ্দেশ্যে। নদীর দিকে বারবার তাকায় রাঙা একবার অন্ততঃ খুঁজতে চায় ফেলে আসা দেশটাকে।
       প্রথমে বিমলের এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠে ওরা। শ্বশুরমশাই কদিনের উদ্বেগ আর এতটা পথ এভাবে আসার ধকলে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রথমেই তাঁর চিকিৎসার দরকার। নিজেদের অত বড় বাড়ি,পুকুর আর বাগান ছেড়ে একতলার দুটো ঘরে ঠাঁই হয় ওদের। কদিনের মধ্যেই ভাড়া বাড়িতে উঠে যাবে কথা হয়। নির্মলকে এই বাড়ির ঠিকানাই দেওয়া আছে। প্রথমে এখানে এলেই জানতে পারবে ওরা কোথায় গেছে।
     রাঙা দিদিকে বলে," তোমার ঠাকুরপো আইলেই না হয় যামু এহেন থনে দিদি। ও আবার কোথায় খুজবো আমাগো।"
-" ছোট, ঠাকুরপো ঠিক আইয়‍্যা পড়ব তুই ভাবিস না কিছু। লোকের বাড়ি কতদিন থাকি ক। কত লোকজন এই বাড়িতে। আমরা ছাড়াও অন‍্য আরও দুইট‍্যা পরিবার আইছে। এত গুলি মানুষের থাকা খাওয়া কত অসুবিধা এহেনে। তবুও এরা মানুষ ভালো।"

        মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন,প্রতি মুহূর্তে রাঙার মনে হয় নির্মলের কথা। কবে যে আসবে সে? এত দেরি করছে কেন? শ্বশুরমশাই এখন একটু ভালো আর কয়েকদিনের মধ‍্যে হয়ত ওরা নতুন বাসায় চলে যাবে। ভাসুর খুব দেখাশোনা করছেন তবে ভাড়া বেশি বলে একটু পিছিয়ে আসছেন। নির্মলটা চলে এলে ভালো তাড়াতাড়ি করে চলে আসাতে সব টাকাপয়সা তুলতেও পারেন নি। নির্মল বাকিটা নিয়ে আসবে তেমনি কথা হয়ে আছে। মাঝে একটা খবর পেয়েছিলেন অনেক চেষ্টায়,শুনেছিলেন ভালো আছে সে। বিমল আশা করেন হয়ত এই সপ্তাহের মধ‍্যে চলে আসবে ভাই।
      -" তুমি এত ভাব কিসের তরে,এখন আমাগো গয়না বন্ধক দিয়া তুমি বাসা লও পরে দেখা যাইব ঠাকুরপো আইলে। এ বাড়িতে অনেক মানুষ। একটা পোলা রাঙাকে দেখলেই তাকায় থাকে। কম বয়েসী মাইয়‍্যা আমার ভালো লাগে না।"
      দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিমল হয়ত সেটাই করতে হবে শেষ পর্যন্ত। নির্মল যে কেন এত দেরি করছে? তাহলে কি টাকা পয়সা হাতে পায়নি এখনও?

        সারা বাড়িতে যেন প্রেতাত্মার মত ঘুরে বেড়ায় একা নির্মল। যে রান্নাঘরে এক সময় দশ পনেরো জন মানুষের রান্না হত উৎসবের দিনে পঞ্চাশ জনের আজ সেখানে কোন রকমে একটু ডাল ভাত ফোটায় আনোয়ারা। গলা দিয়ে ভাত নামতে চায় না নির্মলের বারবার রাঙার মুখটা মনে পড়ে। অথচ এখনও টাকা পয়সা কিছুই হাতে এল না। আর কত দিন থাকবে এখানে? শুনেছে কাল এলে পেয়ে যাবে কিছু টাকা। ঠিক করেছে সেটা নিয়েই চলে যাবে কোন রকমে দেশ ছেড়ে। যদিও জানেনা কি করবে ওখানে গিয়ে? তবুও মনে হয় সেখানেই যে আছে আপনজনেরা আর তার রাঙা। তাই যেভাবেই হোক যেতে তাকে হবেই। 

থালায় গরম ভাত আলুর চোখা,খেতে ইচ্ছে করে না। আনোয়ারা বলে," এই টুকু খান ছোড়দা আজ রফিকরে দিয়া পুকুর থনে একটা ছোট মাছ ধরাইছি। বড় মাছ তো কবেই জাল ফেইল‍্যা লইয়‍্যা গ‍্যাছে শয়তান গুলা। বারণ করাতে,জোর যার মুলুক তার কইয়‍্যা গেছে। খান আমি আনতাছি মাছ।"
      মাছ ভাতও খুব বিস্বাদ লাগে নির্মলের। কাল থেকে মাথাটা ভার রাত এলে গা গরম লাগে। দক্ষিণের জানলা খানা আর খুলতে পারে না নির্মল, ভয় পায়। বাগানে কারা যেন আসে প্রতি রাতে। অনেকক্ষণ জটলা করে ওখানে বসে। সন্ধ‍্যার পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে যায় রায়চৌধুরী বাড়ি। সন্ধ‍্যাবাতি পড়ে না। নির্মলের শোবার ঘরে টিমটিমে লন্ঠনের আলো। ঝাড়বাতি আর জ্বলেনা, কার জন‍্য জ্বালাবে ঝাড়বাতি?

        সকাল থেকে বসে থেকে কিছু টাকা আদায় হয়েছে। সারাদিন কিছু তেমন খাওয়া হয়নি নির্মলের। টাকাগুলো যত্নে কাপড়ে মুড়িয়ে ব‍্যাগে রাখে। রফিক গাড়ি নিয়ে এসেছে ওর সাথে। কাল রাতের অন্ধকারে ও চলে যাবে যে করেই হোক,আর দরকার নেই টাকার। সবই যখন পড়ে রইল কি হবে টাকায়?

        বাড়িতে এসে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে নির্মল। আনোয়ারা খাবার গরম করে ডাকলে সাড়া দেয় না কোন। খুব সংকুচিত হয়ে ছোড়দার গায়ে হাত দেয় দেখে ধুম জ্বর নির্মলের। তাড়াতাড়ি খাবার ঢাকা  দিয়ে কাপড় ছিঁড়ে জলপটি দিতে থাকে। জলপটি দিতে দিতে জ্বর একটু কমলে আনোয়ারা বলে," একটু কিসু খান দাদাবাবু, শরীর দূর্বল হইয়‍্যা যাইব। ওঠেন একটু বসেন।"
       হাত নাড়ে নির্মল তবুও খাবার দেখে হাত বাড়ায় কিন্তু গলার কাছে খুব জ্বালা করে জিভও খুব ভারী যন্ত্রণায়। তাই কিছু খেতে পারে না। হাত নেড়ে আনোয়ারাকে বলে খাবার নিয়ে যেতে।
          " দেখি একটু হাঁ করেন দেখি কি হইছে?"
 নির্মলের মুখের ভেতরটা দেখে চমকে ওঠে আনোয়ারা সারা মুখের ভেতর আর জিভে লাল গুড়ি গুড়ি। নিজের অজ্ঞাতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে," হায় আল্লা।"
                 রাত বাড়তেই নির্মলের শরীরে দেখা যায় গুটি বসন্তের গুটি যা একটু একটু করে প্রথমে মুখে তারপর গায়ে প্রকাশ পায়। ছোড়দাকে দেখে কান্না পায় আনোয়ারার। কাল রাতে তো চইল‍্যা যাবেন কইতাছিলেন তা এখন এভাবে যাবেন কি কইর‍্যা?
           রাতে ধুম জ্বরে একদম প্রায় অজ্ঞানের মত পড়ে থাকে নির্মল। আনোয়ারা বারবার ছুটে যায় রফিকের কাছে ওরা কি করবে বুঝতে পারে না। দেওয়ালে ঝোলানো ঘন্টা ঘড়িতে চোখ রাখে আনোয়ারা রাত দুটো বাজে। ছোড়দা খাটে অচৈতন‍্য হয়ে শুয়ে। দেখতে দেখতে বাড়ছে বসন্তর গুটির থাবা সারা গায়ে। মাঝে মাঝে মুখ হাঁ করিয়ে একটু করে জল দেয় আনোয়ারা। একতলায় রফিক বসে,সেও রাত জাগছে ওদের সাথে। হঠাৎই আনোয়ারা শুনতে পায় কি যেন বলছে ছোড়দা মুখের কাছে গিয়ে শোনার চেষ্টা করে বুঝতে পারে রাঙা বৌকে ডাকছে জ্বরের ঘোরে। হায় আল্লা! রাঙা বৌ যে কি করে ওখানে কে জানে? নিজের মনেই বিড়বিড় করে বকে আনোয়ারা।

           ******************
দুদিন আগে নতুন বাড়িতে এসেছে রাঙা,ওদের শ্বশুরবাড়ির বৈঠক খানার ঘরকে তিনভাগে ভাগ করে তিনটে ছোট খুপরির মত ঘর বের করা হয়েছে এই বাড়িতে। তার ভাড়া জোগাতেই দিদির গয়না বন্ধক পড়েছে। সে যে কবে আসবে কে জানে? এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতিও ভালো না। প্রায়ই অশান্তি লেগে রয়েছে এদিকে সেদিকে। কতদিন রাতে ভালো করে ঘুমায় না রাঙা। দিদি ওর কাছে শুয়েছে ও বারণ করেছিল শোনেনি। বলেছে নির্মল আসুক তারপর দেখা যাবে। দাদার কাছে খবর পেয়েছে ওর বাবা মা এই দেশের উত্তরে কোথায় যেন উঠেছে। সময় সুযোগ মত কাজ কারবার বসলে নিয়ে যাবেন একবার দাদা বলেছেন। এখন তো চারদিকেই অশান্তি। না নিজেও যেতে চায়না রাঙা সেখানে ওর রাতজাগা চোখ দুটো কেবল এখন নির্মলকে খোঁজে। ঘুমোতে ভয় পায় কখনও যদি নির্মল এসে পড়ে? হয়ত বা ডেকে সাড়া না পেয়ে চলে যায়?

           আনোয়ারা ডাকে," ও ছোড়দা ওঠেন একটু খানি খাইতে হইবো যে, না হলে ক‍্যামনে জোর পাইবেন।"
     নির্মল চোখ খুলতে পারে না,অসহ‍্য যন্ত্রণা সারা শরীরে বসন্তের থাবায় চোখদুটো বন্ধ। শুধু অস্ফুটে বলে ওঠে," গাড়ি আইছে নাকি? খাড়াও আসতাছি।"
       আনোয়ারার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। হায় রে বাড়ির কত আদরের পোলা। অথচ কেউ নাই এমন সময় তার পাশে। কবে যে যাইতে পারবো কে জানে?
        সেদিন রাতে হঠাৎই ঘটে গেল অঘটন,সদর দরজায় অনেক লোকের চিৎকার আর মশালের আলো দেখলো দোতলা থেকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আনোয়ারা। ততক্ষণে রফিক উঠে এসেছে ওপরে হাঁঁফাতে হাঁফাতে বলে ,"ওরা লোহার গেট ভাইঙ্গা ফেলবো এক্ষুনি হয়ত। তারপর দরজা ভাইঙ্গা ওপরে উঠবো। নিশ্চয় কেউ খবর দিছে দাদার কাছে টাকা আছে। আমাগো পলাইতে হবে এক্ষুনি না হলে ওরা মাইর‍্যা ফালাইবে দাদারে। সময় নাই তাড়াতাড়ি কর যা করার আমি দোতলার সিঁড়ির লোহার গেট দিয়া আইছি।"
    হাত পা কাঁপতে থাকে আনোয়ারার অনেকদিন আগেই শুনেছে বলতে ছোড়দা গেলেই এই বাড়ির দখল ওরা নেবে। কিন্তু কি করবে? কোথায় লুকাবে? টাকাই বা কোথায়?"
             তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে আন্দাজের ওপর ছোড়দার হাতব‍্যাগটা মাথা দিয়ে গলিয়ে নেয় আনোয়ারা। তারপর মুহূর্তে ঠিক করে কি করবে এখন। দুজনে মিলে চ‍্যাংদোলা করে ছোড়দাকে ধরে পেছনের ঘোড়ানো সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকে তারপর একদম সোজা গিয়ে কোনরকমে চাদর মুড়ি দেওয়া নির্মলকে শুইয়ে দেয় রায়চৌধুরীদের পরিত‍্যক্ত পাতাল ঘরে। যে ঘরে অনেকদিন কেউ যায় না। হদিসও তেমন কেউ জানে না। শুধু আনোয়ারা মাঝে মাঝে নামত সাফাই করতে। বৌদির কাছে শুনেছে এক সময় বিপদ আপদের কথা ভেবেই এই ঘর বানানো হয়েছিল। তারপর ঐ ভাবেই পড়ে আছে।
                  দুজনে ধরাধরি করে শুইয়ে দেয় চাদর পেতে নির্মলকে। নির্মলের তখন কোন জ্ঞান নেই,চোখ খুলে তাকানোর ক্ষমতাও নেই। দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকে চুপচাপ ওরা দুটো প্রাণী।
      ওপরে তখন জয়োল্লাশ চলছে তার কিছু শব্দ ক্ষীণ হলেও শোনা যায় পাতাল ঘরের পুরু দেওয়ালের ভেতর থেকে।
          আনোয়ারা এর মাঝেই কান পাতে নির্মলের বুকে। এত কিছু হয়ে গেল একবারও তো কোন কথা কইলো না ছোড়দাদা। তাহলে আছে তো মানুষটা বেঁচে? বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত হয় আনোয়ারা ক্ষীণ হলেও চলছে ধুকপুক করে জীবন ঘড়ি। রফিকটা অন্ধকারে এক কোণে বসে ঝিমোচ্ছে তখন। পাতাল ঘরের লোহার দরজায় কান পাতে আনোয়ারা আর কারো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। লুটপাট করে নিশ্চয় গুন্ডারা চলে গেছে। কিই বা ছিল বাড়িটাতে? আবার হয়ত অনেক কিছুই ছিল এদিক ওদিক ছড়িয়ে। কিন্তু একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরতে থাকে এভাবে এখানে কি করে দিন কাটবে? ছোড়দাকেই বা কি খেতে দেবে? বাঁচাবে কি করে মানুষটাকে?
           ধাক্কা দিয়ে রফিককে জাগায়,অনেকটা বয়েস হয়ে গেছে রফিকের তবুও যদি কিছু পরামর্শ দিতে পারে।
     " তুমি সাবধানে একবার যাও তো চাচার বাড়িতে এহেনে থাকলে তো বাঁচাতে পারুম না ছোড়দা রে।"
               গ্ৰাম ঘুরে খবর আনে রফিক কাল খালেক চড়াও হয়েছিল রায়চৌধুরীদের বাড়িতে সাথে বাইরে থেকে আসা কিছু লোকজন ছিল। ওরা সব লুটপাট করেছে ইচ্ছামত তবে টাকাপয়সা তেমন কিছু পায়নি। বারবার খোঁজ করেছে ছোট কর্তার ওঁকে পেলে জানে মেরে ফেলত টাকা না দিলে। তবে আলি চাচার বাড়ির কেউ রাখতে চায়না ছোড়দাকে কারণ বসন্ত বড় ছোঁয়াচে রোগ। তবে ওরা দেখবে যাতে আর কোন বিপদ না হয়।
     -" তাইলে কি এই বাড়িতে থাকুম আমরা?"
  -" না এই বাড়ি শুনছি খালেকরা দখল করছে।"
   অসহায় লাগে আনোয়ারার কি করবে ও? হঠাৎই বাইরে আলি চাচার ডাক শোনা যায় বোধহয় রফিক খবর দিয়ে এনেছে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে চাচা বলেন," তোর বাড়িতে বরং নিয়া রাখ। তর বাড়ি আমাগো পাড়ার মধ‍্যে, কিছু যাতে না হয় তা আমরা দেখুম। এমন রোগীরে কে ঠাঁই দিব?"

************************
কদিন ধরেই ডান চোখটা লাফাচ্ছে রাঙার মনে কেমন যেন কু ডাক। কই এতদিন হয়ে গেল নির্মল তো এখনও এল না। আচ্ছা সে আছে তো? নাকি? আর ভাবতে পারে না রাঙা। নিজের মনেই কাঁদে ঘরে গিয়ে।
     বাড়ির সবাই খুব চিন্তা করছে অথচ নির্মলের কোন খবর নেই। বিমল প্রায় প্রতিদিনই খবর নেয় আগের বাসায় গিয়ে যে নির্মল এসেছিল কি না?

            মাঝে কেটে গেছে প্রায় আরও মাসখানেক। কলকাতার বিভিন্ন জায়গা দাঙ্গার আগুনে জ্বলছে। হিংসা ছড়িয়ে পড়েছে দ্রুত। বাইরে বেরোনো খুব মুশকিল যখন তখন বিপদ হতে পারে। তাই বিমলের আর বেরোনো হয় না। ঘরে মজুত চাল ডালের খিচুড়ি অথবা ফ‍্যানাভাত খেয়ে কোন রকমে দিন কাটছে। আশঙ্কায় কাটছে প্রতিটা দিন। তার মধ‍্যেই কোন খবর নাই ভাইটার কোথায় যে গেল?

      সেই দিনটার কথা আজও ভুলতে পারেনা রাঙা,আকাশে তখন সূর্যাস্তের লাল রঙ। লম্বা চুলের জট ছাড়িয়ে কোন রকমে একটা হাত খোঁপা বেঁধেছে রাঙা, আয়নায় এঁকেছে সিঁথি লাল রঙে ভরাট করে কপালে সিঁদুরের বড় টিপ। হঠাৎই শোনে কান্নার রোল উঠেছে পাশের ঘরে। তাড়াতাড়ি পা বাড়ায় রাঙা বড়দি মাথা ঠুকছে দাদার বুকে," সব দোষ তোমার তুমি ক‍্যান ঠাকুরপো রে রাইখ‍্যা আইলে? কি কাম ছিল টাকার? এখন যে সব গেল। ওরে নির্মল রে...আমি কি কমু রাঙা রে?"
         তারপর আর কিছু মনে নেই রাঙার ওর ঘুম ভেঙেছিল প্রায় চারদিন বাদে। ততক্ষণে মুছে গেছে কপালের লাল টিপ। তবে অন‍্য কিছু সব একরকম আছে। কাউকে ওর গায়ে হাত দিতে দেয়নি সন্ধ‍্যা।
         ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকানো রাঙার মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল," ভগবান সব লাইয়‍্যাও কিছু ফেরত দিয়া গ‍্যাছেন আমাগো। ওরে ওঠ কিছু মুখে দে। তোর প‍্যাটের টা তো কষ্ট পাইতাছে।"
        দিদির কথা শুনে কোন অনুভূতি হয়নি রাঙার শুধু মনে হয়েছিল ও কেন মরে গেল না? কি নিয়ে থাকবে সারাটা জীবন?
             শ্বশুরমশাই বিছানা নিয়েছিলেন আর ওঠেননি। শুধু ভাসুরকে অসম্ভব চুপচাপ লেগেছিল রাঙার। নিঃশব্দে ভাইয়ের সমস্ত কাজ করেছিলেন এমন কি প্রায়শ্চিত্ত ও। দিদি জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলেন পাপ গো পাপ,না হলে ভাইটারে রাইখ‍্যা আসি ওদেশে শেষ হবার তরে? তাই প্রায়শ্চিত্ত করলাম,আসল পাপী তো আমিই।

            ওদের বাড়িটা যেন নিষ্প্রাণ এক গুম ঘর,সবাই অদ্ভুত রকম চুপচাপ। শোকস্তব্ধ রাঙার মনে তখন হাজার স্মৃতির ভিড়। ঘুমের ঘোরে কখনও কেঁদে ওঠে হাউহাউ করে। বুকের কাছে রেখে সামলায় সন্ধ‍্যা ছোট জাকে। কত আনন্দ বাড়িতে নতুন কেউ আসছে এই সময় কি দিন দেখালে রাধাগোবিন্দ।

           আহ্নিক সেরে রাধাগোবিন্দের পা ধরে নিভৃতে কাঁদে বিমল হে ভগবান আমাকে ক্ষমা কর এছাড়া আমার যে আর কোন কিছু করার ছিল না। হায় ভগবান কত জন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছি এভাবে।

 ************************
ঘটনা প্রবাহ আসলে ঘটে চলেছিল সম্পূর্ণ অন‍্য খাতে নিয়তির অদৃশ‍্য ইঙ্গিতে। তবে এই ঘটনা প্রবাহের জেরে সুতো ছেঁড়া সম্পর্কগুলো কোথাও জুড়লো আবার কোথাও ছিঁড়ে গেল একদম চিরতরে। অথচ এই সংবাদ সম্পূর্ণই অজ্ঞাত থেকে গেল রাঙার কাছে। কিছুই জানল না রাঙা অথচ ঘটে গেল এক চরম দুর্ঘটনা। 
        আনোয়ারার সেবা যত্নে আর কড়া পাহারায় সেরে উঠেছে নির্মল। সময় লেগেছে প্রায় দুই মাস তবে একটা চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। অন‍্য চোখেও খুব কম দেখে। কত কথা ভুলে গেছে,কি হয়েছিল? কতদিন অসুস্থ ছিল? এখন শুধু দিন গুনছে কবে যেতে পারবে রাঙার কাছে। আনোয়ারা ভেতর ভেতর চেষ্টা করছে ওকে পাঠানোর। কিন্তু একা মেয়েমানুষ কাকেই বা ধরবে?
         এর মধ‍্যেই ঘটে যায় এক অঘটন। এক রাতে আনোয়ারার ঘরে চড়াও হয় কিছু দুষ্কৃতী তারা আনোয়ারাকে বলে," আয় দেহি এবার, অনেক দ‍্যামাক দেখাইয়াছস এতদিন। এবার আমাগো খুশি করবি।"
     বিরাট বঁটি নিয়ে রুখে দাঁড়ায় আনোয়ারা।  ওরা ওর শাড়ি ধরে টানাটানি শুরু করে," বেশ‍্যা মাগীর আবার এত লাজ কিসের? এতদিন তো পরপুরুষের বুকের কাছে আইস‍্যা কতই ঢলাঢলি করলি। বন্ধ ঘরে একসাথে শুলি।"
- " আর একটা কথা কইলেই লোক ডাকুম।"
    ওরা হামলা করতে যায় নির্মলের ওপর,ঝাঁপিয়ে পড়ে আনোয়ারা। ততক্ষণে পাড়ার কিছু লোক এসে জড়ো হয়েছে।
           আনোয়ারার কোন অনুরোধেই কাজ হল না।
-"বিশ্বাস করেন আমি ওঁদের দাদা ছাড়া আর কিছু মানি না।ওরা মালিক,আমরা হলাম গিয়া চাকর বাকর। শুধু রাঙা বৌ কইয়‍্যা গেছে তাই। তাছাড়া ফেইল‍্যা যাইতাম কি কইর‍্যা?"
   সবাই এক বাক‍্যে বলল নির্মল অসুস্থ ছিল তাই এই বাড়িতে তখন কেউ ঢোকেনি রোগের ভয়ে। যা খুশি করেছে ওরা একলা ঘরে। কিন্তু একজন বিধবা সোমত্ত মেয়ে মানুষের সাথে এতদিন এক ঘরে থেকেছে নির্মল সুতরাং আনোয়ারাকে ওকে বিয়ে করতে হবে। নির্মলের জীবন হঠাৎই এক অদৃশ্য নাগপাশে বন্দি হল। আনোয়ারা চিৎকার করে," পলাইয়া যান এহান থনে। ও দেশে রাঙা বৌ যে আছে পথ চেয়ে আপনার। এ কিছুতেই হতে পারেনা। হায় আল্লা এত বড় অধর্ম আমারে দিয়া করাইলা!"
             " অধম্ম এতদিন করছস এবার অন্ততঃ ধর্মের পথে হাঁট। পরপুরুষের লগে একসাথে রইলি এতদিন। তার সারা শরীরে তো হাত দিছস।"
       কান চাপা দেয় আনোয়ারা," দিছি তবে রুগী ভাইব‍্যা।"
         নির্মলের অনুরোধ বা আনোয়ারার কান্না কোনটাই টিকলো না মৌলবাদীদের বিচার সভায়। আনোয়ারাকে নিকা করতে হল নির্মলকে। শুধু তাই নয় জোর করে ওকে ধর্মান্তরিত করল ওরা ওকে। নির্মলের চোখের সামনে মুছে গেল হাজার স্বপ্ন আর ও দেশে অপেক্ষা করা একটা কচি মুখ রাঙা।

                হাবড়ায় যেই বাড়িতে ওরা প্রথম এসে উঠেছিল সেই বাড়িতে অনেকদিন বাদে সেখানে গিয়েছিল পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হতেই বিমল। সেখানে গিয়ে জানতে পেরেছিল সব এক খাম বন্দি চিঠিতে। আর সাথে পেয়েছিল আনোয়ারার যত্নে আগলে রাখা টাকাও। টাকা ফেরতের ব‍্যবস্থা করে গঙ্গা স্নান করে বাড়ি ফিরেছিল দুঃসংবাদ নিয়ে বিমল। নীলকন্ঠের মত পান করেছিল সবটা বিষ বাবার অনুরোধে। বন্ধ ঘরে বাপ ব‍্যাটার কি কথা হয়েছিল তা সন্ধ‍্যাও জানত না। তাই চিরতরে ভাইকে মৃত ঘোষণা করে প্রায়শ্চিত্ত করেছিল বিমল। 
             জাতপাতের বেড়াজাল আর দুই দেশের মধ‍্যের কাঁটাতার ছিঁড়ে আর উদ্ধার করতে পারেনি ভাইকে। তাছাড়া ও তো এখন বিবাহিত আর জাত খুইয়ে মুসলমান। তাকে ফেরাবেই বা কি করে?

 নিজের দেশে থেকেও পরিজন হারালো নির্মল,নতুন নাম আর নতুন সঙ্গী নিয়ে শুরু হল এক অন‍্য জীবন। যে জীবন এখন শুধুই অভিশপ্ত মনে হয়। এক সময় রূপো বা কাঁসার থালায় ভাত খাওয়া নির্মলের দিন কাটে আনোয়ারার কষ্টে জোগাড় করা শাক ভাত খেয়ে। বাড়ি ঘর সম্পত্তি সবই গ্ৰাস করেছে অন‍্য লোকে। শখ শৌখিনতায় ভরপুর নির্মলের এখন মুখ ভর্তি দাড়ি,বেশি কথা সে বলে না। চোখেও ভালো দেখে না। এক চোখে কোন মতে কাজ চলে যায়।
                 অনেক কষ্টে পাঠানো টাকা বহুদিন বাদে ফেরত আসে অনেক হাত ঘুরে আনোয়ারার কাছে সাথে একটা চিঠি । বুঝতে পারে নির্মল ও এখন মৃত ওর আত্মীয় স্বজনের কাছে। ডুকরে কাঁদে বিছানায় নির্মল," আচ্ছা এত কঠোর শাস্তি কেন আমি পেলাম বলতে পারিস আনোয়ারা। সব কি আমার জন‍্যই তোলা ছিল? না জানি তোদের রাঙা বৌ কেমন আছে? খুব কেঁদেছিল সে সেইদিন। আসলে বাচ্চা মেয়ে তো তাই ভয়ে আঁকড়ে ধরেছিল আমার হাতটা আর বারবার বলেছিল চলে আসতে তাড়াতাড়ি। যে টাকার জন‍্য রয়ে গেলাম সেই টাকা কি কোন কাজে এল?"
             মাটিতে বসে অঝোরে কাঁদে আনোয়ারা মনে মনে ভাবে ওপারে গিয়ে আল্লাকে কি জবাব দেবে? রাঙা বৌ যে ওকে বিশ্বাস করে ছোড়দাকে রেখে গেছিল।
               যান্ত্রিক দাম্পত‍্য কোন রকমে চলে টানাটানি করে। আনোয়ারা সব সময় বুঝতে পারে ওদের মাঝে রাঙা বৌ এখনও আছে। গ্রামের মাটি গিলতে আসে নির্মলকে, কিছুতেই ঘর থেকে বেরোতে পারে না। ওদের বাড়িটা যেন ঘুমের মধ‍্যে এসে গলা টিপে ধরে ওর। মনে পড়ে যায় রাঙার সাথে কাটানো সেই প্রথম রাতের কথা। মাঝরাতে উঠে নোংরা হয়ে যাওয়া ক‍্যাম্বিসের ব‍্যাগটা হাতড়ায় নির্মল।
       ঝুমঝুম শব্দে ঘুমের ঘোরে চমকে ওঠে আনোয়ারা। এ যে খুব চেনা শব্দ,মনে পড়ে রাঙা বৌ মল পরে সারা বাড়ি ঘুরত ঘোমটা টেনে। তবে কি রাঙা বৌ এল?
              ঘরের এক কোণে রাখা বাতিটা উস্কে দিয়ে দেখে হাতে একখানা মল নিয়ে অন্ধকারে বসে আছে নির্মল। আর মাঝে মাঝে নাড়া দিচ্ছে।
    - " এই মল কোথায় পাইলেন আপনে?"
-" ভুইল‍্যা গেছিলাম হঠাৎই মনে হল। আসলে তাড়াহুড়াতে বোধহয় রাতের বেলা খাটেই একখান মল ফেইল‍্যা গেছিল রাঙা। ব‍্যাগে ভরছিলাম,নিয়া যামু কইর‍্যা।"
      রাতের আঁধারে আনোয়ারার বুক চিরে উঠে আসে একটা শব্দ," হায় আল্লা, ও গো যে জন্মান্তরের বন্ধন। আমি এখানে কি করুম।"

             মেঝেতে শুয়ে কাঁদে আনোয়ারা, তক্তপোষে শুয়ে মলখানা ঝুমঝুমিয়ে বাজাতে বাজাতে ঘুমিয়ে পড়ে নির্মল একটা সময়।

************************
  রাঙাকে যখন সাদা থান পরিয়ে দাঁড় করানো হয়েছিল হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে গেছিল বিমল। সবাই ব‍্যস্ত হয়েছিল বিমলকে সামলাতে। প্রথমে বাবার সাথে গিয়ে রাঙাকে নিজেই পছন্দ করে এনেছিল। কাঁদতে থাকে সন্ধ‍্যাও,শুধু বোবা হয়ে চুপটি করে বসে থাকে রাঙা। জ্ঞান ফিরতেই বিমল বলে," সন্ধ‍্যা ওরে কুমারী মাইয়‍্যার মতই রাইখ‍্যো। আমাদের ছোট বোন হইয়‍্যাই থাকব। অত নিয়ম করাইতে হইবো না।"
          কিন্তু রাঙাকে রাজি করানো যায় না। তাছাড়া আত্মীয় স্বজন প্রতিবেশী যারা ছিল তারা তো নিয়মের পরাকাষ্ঠা। 
       নিজের দিকে কোন খেয়াল রাখতে পারে না রাঙা। বরাবরই আদরে মানুষ হয়েছে,শ্বশুরবাড়িতে এসেও তার অন‍্যথা হয়নি। সন্ধ‍্যা হিমসিম খায় ওকে খাওয়াতে আর সামলাতে। একটা সময় রায়চৌধুরীদের দাপুটে বড় বৌ আজ টানাটানিতে অভ‍্যস্ত মধ‍্যবিত্ত সংসারের হেঁসেল সামলায় বহু কষ্টে।
          রাঙাকে অবশ‍্য ওর বাবা এসে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। রাঙা যেতে রাজি হয়নি আর সন্ধ‍্যা বা বিমলও যেতে দেয়নি। চোখ মুছে সন্ধ‍্যা বলেছিল," তুই চইল‍্যা যাইবি? আমি বাধা দিমু না তবে আর কিছুই থাকবো না এই সংসারে। "
             দিদি না বললেও রাঙা যেত না। ভাসুর যতই বলুক সে নেই,কোথায় যেন মনে হয় রাঙার সে আছে। এ বাড়িতে তার কাছে কাছেই ঘুরে ফেরে সে। রাতে শুয়ে আজও অনুভব করে নির্মলের স্পর্শ।

              মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা মাস,রাঙার সন্তান মাঝে মাঝেই পেটে নড়াচড়া করে জানান দেয় সে আসবে খুব তাড়াতাড়ি আর বেশি দেরি নেই।
     নিয়ম রক্ষার মত একটু পায়েস আর পাঁচপদ রান্না করে খাওয়ায় সন্ধ‍্যা রাঙাকে। চোখ মুছে বলে," মাগো কি কপাল দিল‍্যা। কত আনন্দ হইত আজ ওদেশে থাকলে! গ্ৰাম জুইর‍্যা মানুষ আইত খাইত। আয় বোন এই নতুন শাড়িখানা পইর‍্যা বোস। খাড়া দেহি আমি পরাইয়া দেই।"
              হাল্কা আসমানী রঙে সরু নীল পাড় শাড়ি খানা বুকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে রাঙা," এ শাড়ি কে আনছে? এ আমি পরুম না। মনে আছে দিদি আমার বিয়াতে বৌভাতে এই রঙের বেনারসী পরছিলাম।"
        - " তর দাদা আনছে হাতে কইর‍্যা এখন থেকে এমন হাল্কা রঙ পরবি। যে আইতাছে তার সামনে হাসিখুশি থাকবি বুঝলি।"
-" ওরে তোমরা নাও দিদি,তোমাদের মা বাবা বইল‍্যা জানুক ও। আমি কি কইর‍্যা একা মানুষ করুম ওরে?"
-" ধুর বোকা মাইয়‍্যা সে হচ্ছে আমাগো নির্মলের স্মৃতি,সাত রাজার ধন এক মানিক আমাগো। সবাই আগলাইয়‍্যা রাখুম তারে। আর আমিও তো মা,বড় মা।"

            একা ঘরে বিমলের কাছে কাঁদে সন্ধ‍্যা, এক ঢোক কান্না এসে ভিড় করে বিমলের গলার কাছে। যে বাড়িতে রাধাগোবিন্দের পুজো না হয়ে কেউ অন্নগ্ৰহণ করত না সেই বাড়ির ছেলে আজ মুসলমান হয়েছে। এ খবর পাবার আগে মরে যাওয়াই তো ভাল ছিল। সব দোষ তার,ভাইটাকে কেন যে রেখে এল সেখানে? আর আনোয়ারা সেও কি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল? এত ভালোবাসা দিয়ে কাকে আশ্রয় দিয়েছিল ঐ বাড়িতে?
         কিছু খবর অজানাই রয়ে গেল বিমলের কাছে। অবশেষে সময় ওষুধের প্রলেপ পড়ল সবার মনের ক্ষতে।
         একটা সময় নির্মল অতীত হয়ে গেল। মনে পড়ত সবারই তবুও নির্মলের চলে যাওয়া অনেকটাই ভুলিয়ে দিল রাঙার সন্তান সূর্য। সত‍্যিই বোধহয় সে সূর্য,যেমন তার আগুনের মত গায়ের রঙ আর তেমন তেজ। সূর্যের আলো একটু একটু করে দূর করতে থাকল রায় চৌধুরী বাড়ির অন্ধকার। এদেশে এসে অনেক কষ্টে দাঁড় করানো বিমলের ব‍্যবসা এখন ভালোই চলে। তবে বাবা নাতির মুখ দেখে আর বেশিদিন বাঁচেননি। মা বাবা মিলিয়ে দেখতে হয়েছে সূর্য, গায়ের রঙ তার রাঙার মত ধবধবে। চোখ নাক বাবার মত। বড় বাবা আর বড়মা সারাক্ষণ ব‍্যস্ত বংশের শিবরাত্রির সলতে কে নিয়ে।
   রাঙা দেখে দিদি আবার ফিরে গেছে যেন সেই ওদের ওদেশের বাড়ির মেজাজে। বাড়িতে এখন সারাক্ষণ ডাকাডাকি চলে.."সূর্য মাণিক আমার কই গেলি বাবা। আর কতক্ষণ খাড়ামু আমি। ও রাঙা দ‍্যাখ না। কেমন মা রে তুই?"
         রাঙা হয়ত তখন ডুবে রয়েছে নির্মলের সাথে মধুচন্দ্রিমার রাতের সোহাগের ঘোরে। শাড়ির আঁচল সামলে বলে "হ দিদি যাই,দেখি ছাদে উঠসে নাকি?"
     " না না ছাদে যাওয়ার কাম নাই। আমি দেখত‍্যাসি।"
    রাঙার রূপের ছটার আলোয় আসেপাশের বাড়িও উদ্ভাসিত। কিছু কথা কানে আসে সন্ধ‍্যারও এই সেদিনই কাজের মেয়ে বলছিল," ছোট বৌদিকে বাইরে দাঁড়াতে দিয়ো না। ছাদে উঠেছিল সেদিন দেখলাম ঐ বাড়ি থেকে মুখপোড়াটা দেখছে। সারাদিন বোধহয় ওত পেতে বসে থাকে।"
        তবুও বিমল একবার ভেবেছিল রাঙার বিয়ে দেবে। কারণ কিছুদিন আগে ওর জামাইবাবু এসে একই কথা বলে গেছে," দাদা মেয়েটার সারা জীবন পড়ে আছে। আর এখন তো বিধবাদের বিয়ে হচ্ছে।"
      সন্ধ‍্যা শুনে রেগে উঠেছিল," তুমি বলাতে ও রঙের শাড়ি পরে। ওর পোলা আছে না? তুমিই বা কি করে কও! আর সেই বাড়ির লোকজন যদি ওরে কষ্ট দেয়?"
    " ভালো পরিবার দেখেই দেব। আর দরকারে ওর পোলারে আমরাই দেখুম। তুমিই তো সামলাও ওরে।"
          সন্ধ‍্যা নিমরাজি হলেও রাঙাকে কিছুতেই রাজি করানো যায়নি। কেঁদেকেটে দরজায় খিল দিয়েছিল রাতে কিছু খায়ও নি।

*******************

     নির্মলের সারা শরীর আর মুখে এখন বসন্তের নির্মম আঁচড়ের দাগ। আজকাল নিজেকে আয়নায় দেখে চমকে যায় নির্মল। প্রথমদিন ওর চিৎকারে ছুটে এসেছিল আনোয়ারা দেখেছিল মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাঁচের টুকরো। অভাবের সংসারে একমাত্র মুখ দেখার আয়নাটুকু ভেঙে চুরমার। আজকাল বিছানাতে বসেই সময় কেটে যায় নির্মলের অথচ একটা সময়ে দুচোখ ভরা কত স্বপ্ন ছিল। নির্মলের আঁকা ছবিরা কথা বলত। স‍্যারেরা কত প্রশ‌ংসা করতেন। এখন এক চোখের জ‍্যোতি নেই,আরেক চোখে দেখে শুধু নরক। আর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে আনোয়ারার ওপর।
-" কিসের লাইগ‍্যা আমারে লইয়‍্যা আইছিলি তর বাসায় শুনি? তরও ষাট আছিল ওগো সাথে।"
-"আপনারে ওরা মাইর‍্যা ফ‍্যালাইত সেদিন রাতেই,তখন আপনার গায়ে জ্বর ভুল বকতেছেন।"
-" মরণই ভালো ছিল আমার। এ কেমন জীবন দান করলি আমায়! সবাই বেইমান, সব বেইমান। আমারে যাইতেই হইব কইলকাতা যে ভাবেই হউক। থাকুম না এহেনে। টাকা কোথায় দে দেহি আমায়, আমি নিজেই চাইল‍্যা যামু।"
     কি করে বলে আনোয়ারা সেই টাকা সে যাকে দিয়ে পাঠিয়েছিল সে প্রায় অনেক টাকা আত্মসাৎ করে কিছু ফেরত দিয়েছে আর সাথে একটা চরম দুঃসংবাদ যে ওপারে নির্মলের সব খবর শুনে ওর শ্রাদ্ধ পর্যন্ত হয়ে গেছে। নির্মল এখন মৃত তার পরিবারের কাছে।
                  তাছাড়া নির্মল চলে যেতে চাইতেই আনোয়ারার বুকের মধ‍্যে হু হু করে ওঠে। সত‍্যি এতদিন একসাথে থাকতে থাকতে মানুষটাকে ও ভালোবেসে ফেলেছে। এখন তো নির্মলই ওর সব। তাই নির্মলের উত্তেজিত হয়ে চ‍্যাঁচামেচির মধ‍্যেই ও বলে ওঠে," কোথায় যাইবেন শুনি? তারা কি আপনাকে ঘরে তুলবো ভাবছেন? আপনার জাত ধম্মো সব গেছে।"
আরও চিৎকার করে নির্মল, নির্মলের শিরায় শিরায় জমিদারী রক্ত প্রবাহ তার মেজাজের গতি বাড়ায় হয়ত বা সীমাও ছাড়ায়।
-" জাত আবার যায় নাকি? আমি ঐসব মানি না। কতদিন সকলেরে দেহি না। এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো শুনছি আমি যামু্। দাদা না মানুক,রাঙা নিশ্চয় আমারে মানবো। ওরে লইয়‍্যা আমি ঘর বাঁধুম আবার।"
 -" ঘর আপনার আগুনে পুড়ছে,আর আপনিও একখান মৃত মানুষ তাগো কাছে। রাঙা বৌ এখন বিধবা। আপনার শ্রাদ্ধ হইয়‍্যা গেছে।"

       যে খবর গোপনে রেখেছিল আনোয়ারা আজ তা চরম অশান্তির মুহূর্তে বাইরে বেরিয়ে আসে। কি না করেছে এই মানুষটার জন‍্য। এখনও প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে। অথচ ঘৃণা ছাড়া আর কিছু পায়নি কখনও। আনোয়ারা নিজেও কি চেয়েছিল ছোড়দা থেকে যাক এখানে? কোথা থেকে ঐ মারণ রোগ এসে সব এলোমেলো করে দিল। হায় আল্লা এত পাপ কোথায় রাখবে?
      আনোয়ারার কাছে কথাটা শুনে তক্তপোষে উপুড় হয়ে শুয়ে কেঁদেছিল নির্মল। এত কান্না সে বোধহয় কোনদিনই কাঁদেনি। ঘর থেকে বাইরে এসে সামনের বটগাছের তলায় বসেছিল আনোয়ারা চুপটি করে আজ আর দুজনের কারো খাওয়া হয়নি।
         ওর কাঁধে হাত রাখে পাশের বাড়ির ফাতিমা,চোখ তোলে আনোয়ারা।
-" আমি সব শুনি পাশের বাড়িতেই তো থাকি। শোন এখন সে তোর পুরুষ তুই তারে বশ কর। জোয়ান মানুষ শরীরের টান তো আছে। তুইই বা কম কি। দেহে বান ডাকছে ওনার তাই এত মাথা গরম। ভালো কইর‍্যা চুল বাইন্ধ‍্যা নতুন কাপড় পইর‍্যা কাছে যাবি রাতে। আদরে আদরে পাগল কইর‍্যা দিবি একদম দেখবি মাথা ঠান্ডা হইয়‍্যা যাবে একদম।"
      আনোয়ারা চুপ করে শোনে,কথাগুলো আগুন ধরায় ওর মনেও। শরীরের সবটাতেই হাত দিয়েছে একটা সময় কিন্তু কোন একটা বাধায় এতদিনের মধ‍্যে কখনও কাছে যেতে পারেনি। আজ যেতেই হবে। সত‍্যিই তো ওর নিকা করা মানুষের কাছে আবার শরম কি?

   সারাদিনের মনখারাপ আর ক্লান্তিতে এমনিতেই চোখ ভারী হয়ে আসে নির্মলের। হঠাৎই ঘুম ভেঙে যায় বুঝতে পারে কারো গরম নিশ্বাস পড়ছে ওর সারা গায়ে। আনোয়ারা জাগিয়ে তুলতে চায় আজ নির্মলকে,আগুন জ্বালাতে চায় শরীরের প্রতি খাঁজে। পারতেই হবে ওকে। মেয়েরা কি না পারে?
         আনোয়ারার আদরে দমবন্ধ হয়ে আসে নির্মলের সারা শরীরে জ্বালা করতে থাকে। ঘেন্নায় গা গুলিয়ে আসে হঠাৎই সমস্ত শরীরের শক্তি এক করে ধাক্কা দেয় আনোয়ারাকে," ছাড় আমারে,ছাড়।"
-" ছাড়ুম না আজ। তোমার সব দুঃখ জ্বালা আজ জুড়াইয়‍্যা দিমু আমি।"
-" বেইমান, একটা সময় আমাগো বাড়ি ঝাড়পোছ করতিস,জল তুলতিস,সে কিনা আজ আমার শয‍্যাসঙ্গিনী! জানিস আমি নির্মল রায়চৌধুরী।"

       একটা বড় থাপ্পড় গিয়ে পড়ে আনোয়ারার গালে। ধাক্কা দিয়ে ওকে মাটিতে ফেলে দেয় নির্মল। তারপর আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। বালিশের তলা থেকে বের করে রাঙার মলখানা। ঝুম ঝুম করে বাজতে থাকে মল। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি।

*******************
  বাইরে থেকে খটখট করে কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নির্মলের। উঠতে ইচ্ছা না করলেও ওঠে,দেখে পেছনের দরজা খোলা। তবে খবরটা শুনে কিছুক্ষণ আর কোন কথা বলতে পারে না নির্মল। আনোয়ারা ভোর রাতে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছে।
     হাহাকার করে ওঠে ফাতিমা," হতভাগী মাইয়‍্যা সেই রায়চৌধুরীদের পুকুরেই ডুইব‍্যা মরলো। এরেই কয় নিয়তি। কি হইছিল,কন তো? নিশ্চয় আপনে ওরে কিছু কইছেন?"
      কিছুটা বাকবিতন্ডা হলেও নির্মলের কাছ থেকে কোন কথা বের করতে পারে না কেউ। নির্মল বরাবরই কম কথা বলত তারপর হাজার হোক জমিদার বাড়ির ছেলে। অনেক অত‍্যাচারের দাগ এখনও দগদগে ওর মনে। আনোয়ারাকে নিয়ে কারো তেমন মাথাব‍্যথা ছিল না। তাই একটা সময় সব চুপচাপ হয়ে গেল। তবে একদিন সকালে হঠাৎই নির্মলকে পাওয়া গেল না। হারিয়ে গেল নির্মল।

****************************
মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর রাঙার ছেলে সূর্যও হাঁটি হাঁটি করে পা রেখেছে যৌবনে। সূর্যের ছটায় রায়চৌধুরী বাড়ি এখন আবার ঝলমলে। বড়মা আর বড় বাবার আদরের মণি পড়াশোনায় খুব ভালো হয়েছে। নির্মলের ছেলের থেকেও অনেকটাই বেশি রাঙার ছেলে সূর্য। তবে নির্মলের একটা গুণ পুরোপুরি পেয়েছে ছেলে। অসাধারণ ছবি আঁকে সূর্য। প্রথম দিকে যখন রঙ পেন্সিল নিয়ে বসত ছেলে চোখে জল টলটল করত রাঙার। দিদিকে বলত," দিদি দেখছ পড়ায় মন নাই শুধু আঁকতে চায় পোলা।"
    সন্ধ‍্যা বিমলকে বলাতে বিমলের মনটাও ভিজে যায়,ভাইটাকে যেন আবার দেখে ছেলের মধ‍্যে।

          বিমলের বন্ধু অপরেশের ভাই অনিরুদ্ধর কথা অনেকদিন শুনেছে ওর কাছে। ব‍্যবসা নিয়েই সারা জীবন কেটে গেল বিমলের ঐসব আঁকা,লেখা মাথায় তেমন আসেনা। তবে মনে উঁকি দেয় মাঝে মাঝেই ভাইটার কথা কে জানে কেমন আছে সে? কোথায় বা আছে? তবে বাবাকে দেওয়া কথা কোনদিন ভাঙার সাহস হয়নি। ত্রিসন্ধ‍্যা আহ্নিক না করে জলগ্ৰহণ করতেন না বাবা বাড়িতে নিত‍্যপূজা হত রাধাগোবিন্দের। সেই বাড়িতে কেন এত বড় অনাচার ঘটল তা ভাবতেই বাবার শেষ দিনগুলো কেটে গেছিল। 
    তবে ছেলেটাকে এবার একটু আঁকা শেখাতে হয়। যদিও নিখুঁত রঙ তুলির টান টানে ছেলে তবুও তো একটু শেখার দরকার। তাই অনিরুদ্ধ এসেছিল সূর্যর আঁকার মাস্টারমশাই হয়ে,সূর্য তখন স্কুলের গন্ডী পেরিয়েছে সবে। সত‍্যি এক পাগল ছেলে অনিরুদ্ধ, যার সারাক্ষণের ধ‍্যান জ্ঞান ছবি। হয়ত সূর্যর এমনিই একজন শিক্ষকের দরকার ছিল।
                     প্রথমটা সন্ধ‍্যা রাঙাকে খুব একটা সূর্যর পড়ার ঘরে যেতে না দিলেও একটা সময় অনিরুদ্ধ বাড়ির ছেলে হয়ে গেছিল। সন্ধ‍্যা আর রাঙার অনেকটা সময় কেটে যেত ওদের ছাত্র আর স‍্যারের রঙ তুলির খেলা দেখে।
        প্রথম যেদিন রাঙাকে দেখেছিল অনিরুদ্ধ ওর আলতো ঘোমটার ফাঁকে অবাক হয়ে গেছিল দেখে এত সুন্দর কেউ হতে পারে? মুখটা এখনও সরলতায় ছেয়ে আছে,সূর্যর মা বললে ভুল হবে। বরং বড় বৌঠানকে সূর্যর মা বলে মনে হয়। রাঙার রূপ দেখে ছটফট করেছিল ওর রঙ তুলি। যদি কোনদিন ছোট বৌঠানের একটা ছবি আঁকা যায়। তবে মনের কথা মনেই রয়ে গেছিল কোনদিনই সেকথা বলতে পারেনি।
                     একটা সময় পরে অনিরুদ্ধ ঢুকে পড়েছিল রায়চৌধুরী বাড়ির অন্দরে। ছেলেটার মধ‍্যে তেমন কিছু খারাপ না দেখে আর কেউ বিশেষ আপত্তি করেনি। বয়েস আর কত হবে হয়ত রাঙারই বয়সী বা ওর থেকে একটু বড়। আঁকা শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে অনিরুদ্ধ কলকাতার কত খবর দিত ওদের। শুনতে শুনতে অনেক সময় হেসে গড়াত ওরা দুই জা। সন্ধ‍্যা বলত," এবার একটা বিয়া কর ঠাকুরপো। কও তো আমি দেখি মাইয়া। কি আর বয়েস তোমার।"
     -" না বৌঠান এই বেশ আছি, যেখানে খুশি যাই যা খুশি করি। আর বয়েস তো কম হয়নি।"
-" পুরুষ মানুষের আবার বয়েস?"

    অনিরুদ্ধর মনে জমা কথা মনেই রয়ে যায়,হয়ত রাঙা বৌঠানের মত কাউকে পেলে ভাবত একবার। রাঙা বৌঠানের সরল মায়ামাখা চোখদুটো দেখে কেমন যেন মন হারায়। তবে কিছু সম্পর্কের হয়ত নাম হয়না তাই অনামী সম্পর্কের বন্ধনেই বেঁচে থাক সম্পর্কগুলো। 
                      সেদিন বাড়িতে কেউ ছিলো না। সন্ধ‍্যাকে নিয়ে সূর্য গেছে মন্দিরে। বিমল দোকানে গেছে সেই সকালে। বিকেলে দরজায় কড়ার আওয়াজ হতেই রাঙা দরজা খুলে দেয়।
হেসে বলে," ও ঠাকুরপো, সূর্য তো এখন নাই। আজ আপনার আসার কথা ছিল?"
-" না বৌঠান এদিকে এসেছিলাম তাই ভাবলাম একবার ঘুরে যাই। বড়বৌঠান নাই?"
         অনিরুদ্ধ সূর্যর আঁকাগুলো নাড়াচাড়া করতে থাকে। রাঙা ব‍্যস্ত হয় চা করতে যেতে।
     আজ মনে জমা কথাটা বলেই ফেলে অনিরুদ্ধ," ছোট বৌঠান প্রায় অনেকদিন আসছি এই বাড়িতে। আঁকা আমার নেশা,মুখের ছবি আঁকতে ভালোবাসি। একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করেন।"
       অবাক হয়ে তাকায় রাঙা,একটু হলেও পুরুষের চোখের ভাষা সে বোঝে। তাই বলে," এমন কিছু বলবেন না যাতে আমার খারাপ লাগে।"
-" বৌঠান, আপনার একটা ছবি আঁকতে পারি?"
     গলার স্বরটা যেন একটু বেশিই তেতো হয়ে যায় রাঙার," রায়চৌধুরী বাড়ির ছোট বৌয়ের ছবি যে কোন মানুষ আঁকতে পারে না ঠাকুরপো। আমাকে ক্ষমা করবেন।"
অবাক হয়ে যায় অনিরুদ্ধ এতটা সরল সুন্দর একটা মুখের পেছনে যে কঠোরতা লুকিয়ে আছে তা ভাবেনি সে। রাঙার কথাটা বারবার কানে বাজে বেশ অপমানিত লাগে। নিজেকেই দোষী মনে হয়। যে কথা এতদিন বলেনি তা আজ না বললেই পারত।
             রাঙা চা করে নিয়ে এসে দেখে অনিরুদ্ধ চলে গেছে। নিজের ঘরে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাঙা। ওর সমস্ত স্বত্তাকে তো কবেই মেরে ফেলেছে তবুও এখনও কেন? রূপোর মিনে করা বাক্সটা বের করে রাঙা,গোল করে পাকানো ছবিটা খুলে ফেলে। ফুলশয্যার রাতের সুখের মুহূর্তে ডুবে যায় রাঙা। চোখের জল ঝরে পড়ে দুএক ফোঁটা। তারপরেই একটু খারাপ লাগে,অনিরুদ্ধকে এভাবে না বললেই হত। তারপর মনে হল যা করেছে হয়ত ঠিকই করেছে।

**************************
সেই ঘটনার পর মাঝে অনেকদিন আসেনি অনিরুদ্ধ। খুব খারাপ লেগেছে রাঙার,সূর্য ছটফট করেছে।  বিমল খবর নিয়ে আসে নানা কাজে এখন খুব ব‍্যস্ত হয়ে পড়েছে সে। সূর্য যদি একান্তই শিখতে চায় তাহলে যেন কয়েকটা দিন ওর বাড়িতেই আসে কষ্ট করে।
        সন্ধ‍্যা মুখ বেজার করে বলে," ওমা ঠাকুরপো আর আইবো না। ইশ্ ও আইলে একটু গল্প করতাম।"
    বিমল হাসে," তুমি যাও এবার গিয়ে বলো তাকে।"

              অনিরুদ্ধ আসে বেশ কয়েকমাস বাদে হঠাৎই একদিন হাতে বিখ‍্যাত ময়রার দোকানের মিস্টি আর সিঙ্গাড়া। ওকে দেখে খুব খুশি হয় সন্ধ‍্যা। শুধু রাঙার খুব অস্বস্তি হয়,সেদিনের পর আর আসেনি অনিরুদ্ধ। কিন্তু আজ সবার সামনে কি বলবে তাকে রাঙা?
             সন্ধ‍্যা অভিযোগ করে," ওমা এতদিন আস নাই কেন শুনি? আজ হঠাৎ আইলা সাথে এত্তগুলা মিঠাই। বিয়া করছ নাকি?"
       মাথায় ঘোমটা টেনে লুচি আলুরদম টেবিলে সাজিয়ে দেয় রাঙা। এক মুহূর্তের জন‍্য চোখাচোখি হয় অনিরুদ্ধর সাথে। ওকে দেখে স্বাভাবিক গলায় বলে অনিরুদ্ধ," না না এ জীবনে আর বিয়ে হবেনা আমার বৌঠান। আমি বিদেশে যাচ্ছি কিছুদিনের জন‍্য হয়ত কয়েক বছরের জন‍্য।"
     সূর্য গা ঘেঁষে দাঁড়ায়," তাহলে আমার আঁকার কি হবে স‍্যার?"
      " আমি সব ব‍্যবস্থা করে যাব। আর তুই এখন আমার থেকেও ভালো আঁকিস। আর আমি ফিরে এসে আবার একসাথে তুলি ধরব। তবে তখন চিনতে পারবি তো আমাকে?"
     কথাটা হয়ত অনেকটাই ঠিক। সূর্যর রক্তে রঙ তুলির আলপনা মিশে আছে। ছবি ওর হাতে কথা বলে।

          অনিরুদ্ধ চলে যাওয়ার পর কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। প্রথমটা টুকটাক খবর জানতে চাইত সন্ধ‍্যা অনিরুদ্ধর। একটা সময়ে অবশ‍্য সবটাই চাপা পড়ে যায়। এভাবে তো কত মানুষই আসে আবার কত মানুষ চলে যায়। সূর্যও কলেজের গন্ডী ছাড়িয়ে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পা দিয়েছে। তবে রঙ তুলি ওর নিত‍্য সঙ্গী আর সেই তুলির হাত ধরে সূর্যর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে চন্দ্রিমার। রাঙা প্রথমে শুনে হেসেছিল," দিদি দ‍্যাখছ খুইজ‍্যা খুইজ‍্যা চাঁদেরেই পসন্দ করছে পোলা।"
হাসে সন্ধ‍্যাও," কদিনই কইছি পোলাডারে একদিন লইয়‍্যা আসতে মাইয়াটারে তা আনেই না। বলে সে নাকি লজ্জা না ভয় কি যেন পায়। আমরা কি বাঘ নাকি?"
       " তুমি দেখছ দিদি কদিন খুব ব‍্যস্ত পোলা আঁকা লইয়‍্যা। চাঁদের নাকি জন্মদিন,আর তাতে সে নিজের হাতে আঁকা ছবি দিতে চায়।"
   " চাঁদ আবার কেডা?"
-" ও দিদি আমি চাঁদই বলি ওরে,অত বড় নাম আসেনা মুখে। সূর্যর বৌ চাঁদ সেটাই ভালো তাই না?"
     ছোট জায়ের ছেলেমানুষী দেখে হেসে ফেলে সন্ধ‍্যাও। 
     ছবিটা শেষ করে মাকে আর বড়মাকে ডাকে সূর্য," এবার দেখ এই হচ্ছে চাঁদ। কেমন এঁকেছি বলতো?"
-" তোর চাঁদ রে না দেইখ‍্যা কেমনে কমু শুনি? দেখলে মিলাইতে পারতাম।" বড়মার চোখে দুষ্টুমি খেলা করে।
     -" আচ্ছা একদিন নিয়ে আসব বাড়িতে।"
    -" আমার রাঙারে তো তুই দেখছস। রাঙার ছবি দেখছস?"
-" হ‍্যাঁ দেখব না কেন? সবাই মিলে তো একটা ছবি তুলিয়েছিলাম ফটোগ্রাফার দিয়ে।"
      দিদির কথায় খুব অস্বস্তিতে পড়ে রাঙা,দিদি কেন এসব বলছে? তাই বারণ করে বলে ওঠে," ও দিদি চুপ যাও।"
         কৌতূহলী হয়ে ওঠে সূর্য, "কি ছবি দেখাও না মা।"
  -" ও কিছুনা, বড়মা এমনি বলত‍্যাছে।"
-"দেখাবে না তো,ঠিক আছে।"
-" আন না ছোট ও দেখুক ওর বাবা কেমন শিল্পী ছিল।"
    অনেকদিন বাদে আবার রূপোর বাক্সখানা খুলেছে রাঙা। বাক্স খুলতেই মলটা ঝুমঝুমিয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় রাঙার একপাটি হয়ত ঐ বাড়িতেই ফেলে এসেছিল তাড়াহুড়ো করে। শেষ মুহূর্তে নির্মল বলে মল খুলে রাখতে।
       সঙ্কুচিত হয়ে মোড়ানো কাগজটা ছেলের হাতে দেয় রাঙা। আস্তে আস্তে মোটা কাগজটা খোলে সূর্য,তেলরঙে আঁকা চিত্র তবে ছোট কাগজে। কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারে না। তারপর হঠাৎই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে মাকে.." তুমি এত সুন্দরী ছিলে মা। এই ছবি যে একদম জীবন্ত এমনকি পায়ের মলটাও কি সূক্ষ্ম ভাবে আঁকা। আমার বাবা এত ভালো ছবি আঁকতেন। আমি তো কিছুই শিখিনি তাহলে এতদিন। এ ছবি তুমি লুকিয়ে রেখেছ মা? কত ভাজ পড়ে গেছে।"
        রাঙার চোখের জল আজ বাধা মানে না। ছেলে তো আজন্ম মাকে বিধবাই দেখেছে। বাবার মুখও দেখেনি কোনদিন। আজ এই ছবিতেই হয়ত খুঁজে পেল বাবাকে।
    " তোর বাবার দেওয়া প্রথম উপহার।"
 ফুলশয্যার রাতের কথাটা বলতে পারে না রাঙা। তবে সূর্য এখন বড় হয়েছে মায়ের শরীরের ফুলের সাজ বলে দেয় অনেক কিছুই।
    " মা ঐ মলটা আছে?"
" আছে বাবা,কিন্তু একখান। আরেকটা ঐ দ‍্যাশেই ফেলে এসেছি। ভাবছি এই ডিজাইন দাদাকে দিয়ে পাঠিয়ে আরেকটা গড়াবো চাঁদের জন‍্য।"
  -" ওটা তোমার কাছেই থাক মা,চাঁদকে অন‍্য কিছু দিয়ো।"
     মা ছেলের কথার মধ‍্যে উঠে যায় সন্ধ‍্যা,ঠাকুরঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদে। 

       রাঙা বাধা দিলেও শোনেনি সূর্য,রীতিমত বাড়িতে লোক ডেকে ছবিখানা বাঁধিয়ে রেখেছে নিজের আঁকার ঘরে। কেউ জিজ্ঞেস করলে গর্ব করে বলে আমার বাবার আঁকা ছবি।

      চাঁদের বাড়ি আর এবাড়ির দেখাশোনা আর কথাবার্তা মোটামুটি হয়ে গেছে। বাড়ির একমাত্র ছেলে তার যখন পছন্দ তখন আর কোন কথা নেই। বিমল সানন্দে রাজি হয়ে যান বিয়েতে। অনেকদিন বাদে সানাই বাজবে বাড়িতে। দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এগিয়ে আসছে। আর মাসখানেক পরেই ওদের বিয়ে। রাঙা আর সন্ধ‍্যা গয়নার বাক্স নিয়ে বসেছে। এইসব ভারী গয়না আর কি কাজে লাগবে? রায়চৌধুরীদের ছেলের বিয়ে বলে কথা নাই বা থাকল জমি,বাগান আর পুকুর তবুও তো জমিদারী রক্তটুকু তো আছে শরীরে। তাই বৌকে ভালো করে সাজিয়ে আনবে ওরা গা ভরা গয়না দিয়ে। বিমল আর সূর্যের একদম ইচ্ছে নেই পুরোনো গয়না ভাঙার তাই পালিশ করা গয়না পরে শাশুড়ি আর জেঠিশাশুড়ির আশীর্বাদ মেখেই আসবে চাঁদ এমনি কথা হল। 

   ************************
দূরে সানাইয়ের মিঠে আওয়াজে কান পাততে পাততে কত কথাই মনের কোনে উঁকি দিল রাঙার। তারপর হঠাৎই মনে পড়ে যায় অনেক কাজ পড়ে আছে নিচে। সুলতাও নেই আজ মেয়ের বাড়ি গেছে। দাদা দিদি আর বাবু সবাই বাইরে নাহ্ কাজ সারতে হবে।
           কাজের মাঝেই কানে আসে সদর দরজায় ঘন্টি বাজছে। আবার কে এল এখন?
      দরজা খুলতে অবাক হয়ে যায় রাঙা ওমা রীতিমত একজন সাহেব। গালে কাঁচাপাকা দাড়ি,চোখে কালো চশমা পরনে কোট প‍্যান্ট। মাথার ঘোমটাটা আরেকটু বেশি নামায় রাঙা জিজ্ঞেস করে," কাকে চাইছেন?"
    প্রশ্ন করা মাত্রই পরিচিত একটা ভরাট গলা শুনতে পায়," ছোট বৌঠান এর মধ‍্যেই ভুলে গেলেন আমাকে। আমি অনিরুদ্ধ। দেশে ফিরেছি তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই।"
           বুকের ভেতরটা হঠাৎই তিরতির করে কাঁপতে থাকে রাঙার। সেদিনও সে বাড়িতে একা ছিল। আর আজও একা। তবে এখন রাঙা অনেক পরিণত। দুদিন বাদে শাশুড়ি হবে সে। আজ অনিরুদ্ধর কাছে ওর সেদিনের ব‍্যবহারের জন‍্য দুঃখ প্রকাশ করবে।
     -" অনেকদিন বাদে ঠাকুরপো, আমি সত‍্যি চিনতে পারি নাই। আসেন সূর্য এখন নাই খানিকটা বাদেই এসে পড়বে।"
  -" বড় বৌঠান কোথায়? সবাই ভালো তো?"
 -" দিদি দাদা দক্ষিণেশ্বর গেছেন আইস‍্যা পড়বেন। বসেন আপনি আমি চা করি।"
-" আমি ততক্ষণ দেখি সূর্য কেমন আঁকছে আজকাল।  শুনেছি তো অনেকগুলো প্রদর্শনী করেছে এর মধ‍্যে।"
      রাঙা রান্নাঘরে ঢোকে তাড়াতাড়ি চা বানাতে,অনিরুদ্ধ সূর্যর আঁকার ঘরে এসে মুগ্ধ হন। এই কয় বছরে বেশ ভালো হাত হয়েছে ছেলেটার। আর হবেই না বা কেন প্রথম হাতে খড়ি তো তার কাছেই হয়েছিল। হঠাৎই চোখ আটকে যায় দেওয়ালে অনিরুদ্ধর, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে ছবিটার দিকে। অনেক পুরোনো ছবিটা তবে এর মধ‍্যেই বাঁধানো হয়েছে মনে হচ্ছে কারণ ফ্রেমটা নতুন। রাঙা বৌঠানের আলো করা নব যৌবনের রূপ আর শিল্পীর হাতের টান টান তুলির ছোঁয়ায় অন‍্য মাত্রা পেয়েছে। এই ছবির বাজার দর এখন অনেক। এমন রঙই হয়ত পাওয়া যাবে না খুঁজলে।
             গভীর চিন্তায় ডুবে যায় কিছুক্ষণের জন‍্য অনিরুদ্ধ। বারবার করে ছবিটা দেখে,কি অদ্ভুত মিল! কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? 
     রাঙা ততক্ষণে চা আর প্লেটে কুচো নিমকি সাজিয়ে এনেছে। অনিরুদ্ধকে ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অস্বস্তি হয় রাঙার। মনে মনে ভাবে রতনে রতন চিনেছে। এইজন্যই বাবুকে বলেছিলাম ছবিটা থাক যেমন আছে। কিছুতেই শোনেনি ছেলে বলেছিল ওটা নাকি ওর অনুপ্রেরণা। সারাদিন ধরে দেখলেও দেখা শেষ হয়না।
    -" ঠাকুরপো আপনার চা। আসেন নাইলে জুড়াইয়া যাইব।"
     রাঙার পরনের সাদা শাড়ি আর মাথার আলতো ঘোমটায় স্নিগ্ধ জুঁই ফুলের মত লাগছে ওকে। অনিরুদ্ধ আবার মুগ্ধ হয় তবে এবার বলে ফেলে," ছবিটা অপূর্ব! বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। কি অসাধারণ তুলির টান। কার আঁকা ছবি? তবে এ ছবি আমার খুব চেনা।"
    " সূর্যর বাবার আঁকা ছবি,হঠাৎই বায়না করেছে ছবিটা রাখবে নিজের কাছে।"
    তির্যক দৃষ্টিতে অনিরুদ্ধ তাকায় রাঙার দিকে," সত‍্যি অসাধারণ আঁকার হাত ছিল ওনার। তবে রায়চৌধুরী বাড়ির বৌ যে পরপুরুষের সামনেও দাঁড়ায় মডেল হতে সে প্রমাণ আমার কাছে আছে। আর এই ছবিটা সেটা আরও জোড়ালো করল।"
         অপমানে চোখ কান লাল হয়ে যায় রাঙার। গাল দুটো লাল হয়ে যায় রাগে। ভরা যৌবনে বিধবা হয় রাঙা,আজ সে মধ‍্যবয়স্কা দুদিন বাদে শাশুড়ি হবে। এতদিন কতভাবে কত রকমের নজর সে এড়িয়ে গেছে অবহেলায়। এমন কি ভাসুর তার বিয়েও দিতে চেয়েছিলেন তাতেও সে নিজেই বাধা দিয়েছিল।
   " কি বলতে চান আপনি ঠাকুরপো? কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে? ছিঃ এত বড় অভিযোগ আপনি করতে পারলেন!"
 -" আপনার ছবি আমি দেখেছি,তবে তখন চেনা মনে হয়েছিল। ভাবিনি আপনারই ছবি সেটা। আজ অনুমানটা সত‍্যি হল।"
 অবাক হয়ে যায় রাঙা,এক সময় রায়চৌধুরীদের বাড়ির বৌয়ের মুখ ঘোমটার আড়ালে ঢাকা থাকত। এখানে এসেও জা সবসময় আগলে রেখেছে তাকে। প্রথম প্রথম তো অনিরুদ্ধর সামনেও আসত না রাঙা। পরে যখন এসেছে তখনও মাথায় ঘোমটা থাকত।
  রাঙার ঠোঁট কাঁপতে থাকে উত্তেজনায়," কোথায় দেখেছেন আমার ছবি? বলুন,কোথায় দেখেছেন?"
-" সে অনেক কথা....আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? আমারই চেনা এমন কত প্রফেশনাল আছে।
      অনিরুদ্ধর পুরো কথাটা শেষ হবার আগেই বাইরে গাড়ির আওয়াজ হয় তার সাথে দরজার বেলটা বেজে ওঠে। বাকি কথাটা শোনার আগেই দরজা খুলতে যেতে হয় রাঙাকে। নিজেকে কোন রকমে সামলে ঘোমটা টেনে দরজা খোলে রাঙা। দেখে ছেলে ফিরে এসেছে।
     ওকে তেমন কিছু বলার আগেই ও নিজেই দেখতে পায় অনিরুদ্ধকে। কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারেনি রাঙা।
 -" স‍্যার আপনি! কখন এসেছেন? আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আমি তো ভেবেছিলাম ভুলেই গেছেন আমাকে।"
-" সেরা ছাত্রকে ভোলা যায় কখনও তাই তো চলে এলাম এত বছর কি করেছিস দেখতে। তবে চলে যাচ্ছিলাম এখনি।"
     সূর্য আর কোন কথা না শুনে অনিরুদ্ধকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। কিছুক্ষণ ওদের কথাবার্তা চলে। অনিরুদ্ধ আবার বলে ছবিটার কথা। 
-" এটা একটা ঐতিহাসিক মূল‍্যবান জিনিস স‍্যার। মা এটাকে বাক্সে ফেলে রেখেছিল। আমি জোর করে বার করেছি। এটা আমার অনুপ্রেরণা স‍্যার। যতই আঁকি মনে হয় বাবার মত হয়নি।"
   অনিরুদ্ধ কথা বলতে বলতেও ডুবে যায় ছবিটাতে। ছোট বৌঠানের বৈধব‍্য রূপেই মুগ্ধ হয়েছিল সে। আর এই ছবিতে যেন রাজেন্দ্রাণী বৌঠান। অনুরাগে রাঙা লজ্জাবনত একখানা মুখ।
     হঠাৎই দরজায় এসে দাঁড়ায় রাঙা ছেলেকে বলে," বাবু যা হাতমুখ ধুইয়‍্যা নে। তারপর স‍্যারে রে নিয়া টেবিলে বসবি। খাবার করছি।"
      কিছুক্ষণের জন‍্য ছেলেকে সরিয়ে দেয় রাঙা। সে অনিরুদ্ধর সাথে কথা বলতে চায়। কথা তেমন হল না তবে ঠিক হল একদিন বাইরে দেখা করবে অনিরুদ্ধর সাথে।

***********************
   দুটো দিন বড় অস্থিরতার মধ‍্যে কাটিয়েছে রাঙা। এই কথা সে বলতে পারত ভাসুর জাকে। যে কথা অনিরুদ্ধ তাকে বলেছে,কিন্তু তাতে অযথা জটিলতা হত। রাঙা এখন অনেক পরিণত নিজের সমস‍্যার সমাধান সে নিজেই করতে পারে সে সাহস সময়ই তাকে জুগিয়েছে। কিন্তু এই অপমান সে মেনে নেবে না কিছুতেই। অনিরুদ্ধ যে অতীতের সূত্র ধরে তাকে এমন ভাবে অপমান করবে ভাবেনি রাঙা। যোগ‍্য জবাব দেবে সে এই অপমানের।

   সূর্য জন্মাবার পর এই পঁচিশবছরে রাঙা এখন অনেক পরিণত। একা বাইরে বেরোয় সে দরকার হলে। আজ বাড়ির গাড়ি নেয়নি রাঙা, কালীঘাট মন্দিরে যাবে বলে টানা রিক্সায় উঠেই বাড়ি থেকে বেরোয়। মাতৃদর্শন শেষে মায়ের ভোগের চুপড়ি নিয়ে অনিরুদ্ধর বলা জায়গাতে অপেক্ষা করে রাঙা।
           উত্তেজনা অনিরুদ্ধর মনেও বাড়ি এসে মনে হয়েছে কথাগুলো বৌঠানকে না বললেও হত। কিন্তু সেই পাঁচ বছর আগের কথাগুলো যে এখনও কানে বাজে।
         এক সময় যেটা ইচ্ছে ছিল আজ সেটা পূর্ণ হয়েছে। মানে আজ শুধুই সে আর ছোট বৌঠান কিছুক্ষণ কাটাবে নিভৃত আলাপে। কিন্তু রাঙার থমথমে মুখে কোন আনন্দ নেই আছে সেখানে প্রশ্নের ভিড়। হালকা করতে অনিরুদ্ধ বলে," একটু চা আর খাবার বলি বৌঠান?"
-" আমি বাইরে কিছু খাই না ঠাকুরপো। আসল কথায় আসি আমি যে অন‍্য কাউরে ছবি আঁকতে দিছি নিজের চেহারার তার কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে কন?"
     নিজের জন‍্য এক কাপ চা আর স‍্যান্ডউইচ উইথ স‍্যালাড বলে অনিরুদ্ধ। তারপর রাঙার চোখে চোখ রাখে। অনুভব করে অনিরুদ্ধ রাঙার চোখে এখনও বেশিক্ষণ চোখ রাখা যায় না। মন হারিয়ে যায়,অথবা সর্বনাশের পথে হাতছানি দিয়ে ডাকে।
-" কন,কি প্রমাণ আছে? আমার সময় কম।"
-" আপনার ছবি আমি প‍্যারিসে দেখেছি। প্রথমে অবাক হয়েছিলাম দেখে মনে হয়েছিল চেনা চেনা লাগছে তবে ঠিক বুঝিনি। তবে আপনাদের বাড়িতে এসে বুঝলাম সেটা আপনারই ছবি। আসলে আমি তো আপনাকে সধবা দেখিনি। আপনার ঐ রূপ আমার অদেখা।"
-" কোথায় দেখছেন? প‍্যারিসে? ঢাকা বললে বা চট্টগ্রাম বললে তাও বিশ্বাস যাইতাম। "
  হাসে অনিরুদ্ধ," বৌঠান,ঢাকা বা চট্টগ্রামে আপনার কোন অনুরাগী ছিল নাকি? যা অপূর্ব সুন্দরী আপনি।"
    অনিরুদ্ধর এই ঠাট্টা আজ আর ভালো লাগে না রাঙার। গম্ভীর হয়ে বলে," ওখানে আমার বড় হওয়া,স্কুল গেছি। বিয়া হইছে তাই ওখানের অনেকেই দেখছে আমারে।"
-" তার মধ‍্যে মুসলিম কেউ ছিল নিশ্চয়। আপনি ঠিকই বলেছেন ছবিটা যদিও আমি প‍্যারিসে দেখেছি একজন বিখ‍্যাত শিল্পীর বাড়িতে। কিন্তু তিনি আসলে বাংলাদেশী মুসলিম। অসাধারণ আঁকেন,মানে কতটা ভালো আঁকেন তা বলে বোঝাতে পারব না। ওঁর হাত শুধু আঁকে না সারা স্বত্ত্বা আঁকে?"
     অবাক হয়ে যায় রাঙা,কে এই বাংলাদেশী মুসলিম শিল্পী? ওর বাবার বাড়ির গ্ৰামের কেউ? নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে।
-" নাম কি তার?"
-" নিজামুদ্দিন চৌধুরী। আপনি চেনেন তাকে? মনে পড়ে?"
   স্মৃতির গলিপথে কিছুক্ষণ বৃথাই ঘুরে মরে রাঙা। কই এমন কোন নাম তো মনে পড়ছে না।
  অসহায় ভাবে মাথা নাড়ে রাঙা। কিন্তু মনটা খুব অস্থির লাগে। কে এই লোক? যার জন‍্য এই মাঝ বয়েসে তার চরিত্রে কালি লেগেছে?
     অনিরুদ্ধ বলে যায়," কলকাতা থেকে গিয়ে প্রথমে লন্ডনে কিছুদিন থাকার পর প‍্যারিসে যাই। প‍্যারিস হচ্ছে শিল্পের স্বর্গ। প‍্যারিসের নিঃশ্বাসে,আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে শুধু প্রেম,রোমান্স আর শিল্প আর ভাস্কর্য। সে এক স্বপ্নের দেশ বৌঠান। লুভার মিউজিয়ামে গেলে মনে হয় আমরা কি ছবি আঁকি তার চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে ছিলেন আমাদের আগের প্রজন্ম। রেনেসাঁর আলোতে আলোকিত হয়েছিল প‍্যারিস আর উদ্ভাসিত হয়েছিল শিল্পে,কলায়,সাহিত‍্যে।"
    একটানা বলে জল খায় অনিরুদ্ধ। রাঙার মন উড়ে গেছে তখন প‍্যারিসের বর্ণনায়। এমন কত গল্প করত নির্মল,পাগলামি করে রাত জাগিয়ে রাখত ওকে। ওর কাছে শুনেছে নবজাগরণের কথা রাঙা। তাই আবিষ্ট হয়ে বলে," তারপর?"
   লুভার মিউজিয়ামের গ‍্যালারীতে ঠাঁই পেয়েছে ইউরোপের বিখ‍্যাত সব শিল্পীদের চিত্র,ভাস্কর্য আরও কত কি। লোকে মোনালিসা দেখার জন‍্য ভিড় করে কিন্তু আরও অনেক অনেক কিছু আছে দেখার আর জানার।"
        এক এক করে কত বড় বড় শিল্পীর কথা বলতে থাকে অনিরুদ্ধ রাঙা অবাক হয়ে শোনে। একসময় অনিরুদ্ধ বলে ওঠে," আপনি শুনছেন আমিও বলে যাচ্ছি। বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে আপনার। আমি আসল কথা বলি এবার।"
         স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফেরে রাঙা সত‍্যিই তো বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। অবশ‍্য দিদিকে বলেছে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।
 -" আপনি কি যেন কইলেন নিজামুদ্দিন চৌধুরী না? আমি চিনি না মানে এমন নামের কারও কথাই তো মনে পড়লো না। তার কাছে দেখছেন আমার ছবি?"

-" ওখানে আমি একটা এক্জিবিশানে অংশগ্ৰহণ করি সেখানেই আলাপ ওঁর সাথে। নাম শুনেছিলাম কিন্তু দেখা করার সৌভাগ্য হয়নি। আমি বাঙালী শুনে খুব আনন্দ পান। আসলে বিদেশে বাংলা ভাষী কাউকে পেলেই খুব ভালো লাগে। পরপর কদিন দেখা হল,একটা সময় ভীষণ হৃদ‍্যতা গড়ে উঠল। অত বড় শিল্পী অথচ ভীষণ অমায়িক।"
   নিজেকে আর সামলাতে পারে না রাঙা বলে ওঠে," কোথায় দেখলেন আমার ছবি?"
  -" বলছি। আসলে একদিন আমাকে উনি নৈশভোজে ডেকেছিলেন আমি চলে আসার ঠিক আগে। তার আগে ওঁর ওখানে যাওয়া হয়নি কখনও। সেখানেই দেখেছি আপনার ছবি। প্রথমে চেনা মনে হয়েছিল, আপনাদের বাড়ি এসে বুঝলাম ওটা আপনারই ছবি।"
-" আপনি সেদিন আমারে অপমান করছেন কইছেন আপনার কাছে প্রমাণ আছে। প্রমাণ দেন ওটা আমারই ছবি। অনেক বড় কথা কইছেন আপনি আমার প্রমাণ চাই। "
   রাঙার একরোখা ভাবে হকচকিয়ে যায় অনিরুদ্ধ। সত‍্যিই তো তেমন করে কোন প্রমাণই নেই তার কাছে।
" কি হইল? আমারে দেখান সেই ছবি। আমি দেখতে চাই। আপনি কইছেন প্রমাণ আছে।"
-" বৌঠান আমি খুব দুঃখিত আসলে সেদিন ঐ ছবিটা দেখে উত্তেজনায় কথাটা বলে দিয়েছিলাম। সে ছবি আর তার স্রষ্টা দুজনেই তো এখন প‍্যারিসে। নিজামুদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে নৈশভোজে গিয়ে ওঁর সৃষ্টি দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। প্রতিটা সৃষ্টি মুগ্ধ করে আমাকে আর বেশিরভাগ পোট্রেট। হঠাৎই আমার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হয়। শুনি বাইরের বাথরুমের কলের গন্ডগোল তাই ভেতরের বাথরুমেই আমাকে যেতে হয়। যদিও খুব অস্বস্তি হচ্ছিল আমার তবুও গেলাম। আর তখনি ওঁর বেডরুমে রাখা বিরাট পোট্রেটে নজর পড়ে যায় আমার। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি আমি মুখ থেকে নিজের অজান্তেই অপূর্ব,সেরা কথাটা বেরিয়ে আসে।
   হঠাৎই নিজামুদ্দিন চৌধুরী পেছন থেকে বলেন," চলুন,নিশ্চয় আপনার কাজ হয়ে গেছে।"
    আমি নিজেকে সামলাতে পারি না ছবিটার কথা তুলি এড়িয়ে গিয়ে বলেন," ওটা আমার ভীষণ পছন্দের ছবি। অনেক ধৈর্য্য ধরে সৃষ্টি করা।"
" এত অপূর্ব সৃষ্টি এভাবে আড়ালে রেখেছেন কেন?" জিজ্ঞেস করি আমি।
" আড়ালে কোথায়? এই তো আপনি দেখে ফেললেন। আমি দেখি প্রতিনিয়ত। কিছু সৃষ্টি করতে হয় শুধু আনন্দের জন‍্য।"
 আবার প্রশ্ন করি,"উনি কে? "
  ঠোঁটের কোণে একটা রহস‍্য রেখে বলেন,"সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই।"
               -"আমি আর কোন প্রশ্ন করিনি,তবে ছবিটা আমার মনে রয়ে গেছে হুবহু তবে কি করে প্রমাণ দেব? আমিই জলজ্যান্ত প্রমাণ।"
মুখটা রাগে লাল হয় আবার রাঙার এবার ওকে ফিরতেই হবে। তাই উঠে পড়ে। উঠতে উঠতে বলে," শুধুমাত্র ভাবনার ওপর কোন কথা বলবেন না প্রমাণ ছাড়া।"
" দুঃখিত বৌঠান ক্ষমা করবেন আমাকে। কথাটা আমি বলতাম না যদি আপনাদের বাড়িতে ছবিটা দেখতাম। তবে যেটুকু দেখেছি ছবিটা পুরোটা আঁকা আছে মনে শুধু আশ্চর্যজনক ভাবে মেয়েটার একটা পায়ে মল। অপর পা ধবধবে সাদা,আর তাতে চওড়া আলতা আঁকা।"
  হঠাৎই অদ্ভুতভাবে চমকে ওঠে রাঙা। কে এই মানুষ নিজামুদ্দিন চৌধুরী? এরাই কি ওদের বাড়ি লুঠ করে নির্মলকে মেরেছে? হয়ত ও চলে আসার পর নির্মল কোন ছবি এঁকেছিল সেটা চুরি করেছে। সত‍্যিই তো একটা মল সে ফেলে এসেছিল তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে।

     চলে যাবার জন‍্য পা বাড়ায় রাঙা হঠাৎই অনিরুদ্ধ বলে," আপনি তার সাথে দেখা করতে চান? সামনের মাসে আসছেন কলকাতায় একটা বড় আর্টগ‍্যালারী উদ্বোধনে। ওঁরও কিছু ছবি থাকছে।"
      বিহ্বলভাবে রাঙা বলে," কবে আসবেন ? সত‍্যিই একবার তার সাথে দেখা হলে ভালো হত। আমি নিজে জিজ্ঞাসা করতাম তারে। অনেক কিছু জানার আছে আমার।"
             অনিরুদ্ধ একটা তারিখ বলে,একটু খানি ভাবে রাঙা তারপর ওর মুখটা বিষণ্ণ হয়ে যায়," কিছুতেই হইবো না,ওদিন তো বাবুর বিয়া। আপনারেও তো আসতে হইব।"
   সত‍্যিই তো সেদিনই সূর্য বলছিল,অবশ‍্য ব‍্যাপারটা আগেই জেনেছেন। চন্দ্রিমাও ভালো আঁকে সেই সূত্রেই চেনা জানা। ভালোই হচ্ছে বিয়েটা,মতের মিল হওয়াটা খুবই দরকার।
  -" হ‍্যাঁ তাইতো আমার একদম মনে ছিল না। আচ্ছা আমি দেখছি যদি দেখা করানো সম্ভব হয়।"
-" জানি না,কি হবে তবে দেখা করাটা সত‍্যি আমার খুব দরকার। তবে উনি কি রাজি হইবেন?"
  
     অনিরুদ্ধ বুঝতে পারে কোথাও একটা গিয়ে ধাক্কা খেয়েছেন ছোট বৌঠান। যদিও রাঙার অতীতের সব গল্প জানা নেই অনিরুদ্ধর। টুকরো কিছু কথা জেনেছে ওদের সাথে গল্প করে। তবে বৌঠানের স্বামী যে কত বড় শিল্পী ছিলেন তার প্রমাণ অবশ‍্যই অনেক বছর আগের ছবিটা। তবে এমন সুন্দরী বৌ যার তার রঙ তুলি তো কথা বলবেই। রাঙাকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে চলে যায় অনিরুদ্ধ।
         বাড়িতে আসতেই সন্ধ‍্যা বলে," হ‍্যাঁ রে সেই কোন সকালে গেছস। এত দেরী হইলো ক‍্যান?"
    রাস্তাতেই নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিয়েছিল রাঙা তাই বলল," একেবারে নকুলেশ্বর ভৈরব দেইখ‍্যা এলাম দিদি। একটু নাটমন্দিরেও বইছিলাম। আর বোল না হঠাৎই রাস্তায় দেখা হইল অনিরুদ্ধ ঠাকুরপোর সাথে ঐ সূর্য বিয়ার কথা কইলাম।"
       প্রসাদের ঝুড়ি মাথায় ঠেকায় সন্ধ‍্যা। মনে মনে মাকে স্মরণ করে রাঙাও। মিথ‍্যে কথা সে বলতে পারেনা। তবে এটা তো ঠিক মিথ‍্যে নয়,অনিরুদ্ধর কথাও সে বলেছে।

***************************
মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন,বাড়িতে বিয়ের জোগাড়ে সবাই ওরা ব‍্যস্ত। এর মধ‍্যেই অনেক কিছু বাজার হয়ে গেছে। ওরা দুই জা ছেলের সাথে গিয়ে কেনাকাটা করেছে। ভাসুরও ব‍্যস্ত দোকান নিয়ে খুব তবু তার মধ‍্যেই বাইরের দিকগুলো দেখছেন। সারাদিন কাজের মধ‍্যে থাকলেও রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে রাঙা। মাথার মধ‍্যে একটা চিন্তাই ঘুরতে থাকে। কে সেই মানুষ যে রাঙার ছবি শোবার ঘরে রেখে নিভৃতে দেখে। ভাবতেই সারা গায়ে কাটা দিল রাঙার অবশ্য আনন্দে নয় ঘেন্নায়। ছিঃ ছিঃ অনিরুদ্ধ ঠাকুরপো তো তেমনি ইঙ্গিত করেছিলেন যে এভাবেই হয়ত গোপনে টাকা উপার্জন করে রাঙা। ওর সৌন্দর্য্য কে বেচে হয়ত মোটা টাকার বিনিময়ে।
             চন্দ্রিমার শাড়ি আর গয়নাগুলো এক জায়গায় গুছিয়ে রাখে ওরা। তখনকার দিনে রায়চৌধুরীদের তেমন কিছুই না থাকলেও একমাত্র বংশধরের বিয়েতে যাতে কোন ত্রুটি না থাকে তার জন্য সব ব‍্যবস্থাই করেছিলেন বিমল। কতদিন বাদে বাড়িতে সানাই বাজবে ভিয়েন বসবে। তবে সেই দিন কোথায়? আজ শুধু স্মৃতির নদীতে মনখারাপের বৈঠা টানা। একমাত্র ভাইয়ের বিয়ে কত ঘটা করে দিয়েছিলেন। নিজে দেখে পছন্দ করে এনেছিলেন ভাই বৌ। মেয়েটা বড় অভাগা,এখন তো মা বাবা আর কেউ নেই। মেয়ের অকাল বৈধব‍্য আর দেশ ছাড়ার শোকে পরলোকে গেছেন সেই কবেই। তবে সন্ধ‍্যার সত‍্যিই কোন তুলনা হয়না,বুকে করে আগলে রেখেছে জা আর জায়ের ছেলেকে আদরে অপত‍্যস্নেহে। ওদের নিয়েই সন্ধ‍্যার এক অন‍্য সংসার। তবে মাঝে মাঝেই চোখের জল ফেলে দেওরের জন‍্য। ওপারের কোন লোককেই বাড়ির হদিস দেয়নি বিমল। অনেক কষ্টে বানানো সংসারটাকে রাখতে চেয়েছে আগলে।
     ঘটা করে চন্দ্রিমার আশীর্বাদ হয়ে গেল। সন্ধ‍্যা খুব বলেছিল রাঙাকে যেতে কিন্তু রাজি হয়নি রাঙা -" তুমি যাও দিদি তুমিই তো বড়মা ওর। আমি যেখানে যামু অনেক প্রশ্ন উঠবো।" 
     আশীর্বাদের সব গল্প একটু একটু করে সন্ধ‍্যার কাছে শুনলো রাঙা। মন ডুবে গেল নিজের অতীতে।
" হ‍্যাঁ দিদি,কেমন লাগতাছিল গো চাঁদ রে? খুব সুন্দর তাই না?"
      " হ‍্যাঁ রে খুব সুন্দর। খুব গুণী মাইয়া,কত ছবি আঁকছে। আমাগো মত নয়। আজ নির্মল থাকলে বড় খুশি হইত। বৌমা আর শ্বশুরে ভালো জমত।"
    সন্ধ‍্যার মুখটা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কল্পনায় ডুবে যায় রাঙাও।

      আগামীকাল সূর্যর বিয়ে। এ এক পাগল ছেলে,কোন তাল নেই সারাক্ষণ শুধু মা আর বড় মা। বিমল বকা দেন," রাখছো পোলারে আঁচলে বাইধ‍্যা। এবার বুঝবা বৌ আইলে।"
   হাসে ওরা দুই জা। দুই মাকে জড়িয়ে ধরে সূর্য। ছেলের এই আদরটুকু প্রাণভরে উপভোগ করে রাঙা।

 বিয়ের আগের দিন রাতে শুয়ে ছটফট করে,কিছুতেই ঘুম আসে না। রাঙার। বিয়ের কোন নিয়মেই ও হাত দেয়নি। অন্ততঃ ছেলে বৌয়ের সংসারটা শুভ হোক।
     মাঝরাতে উঠে জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়, খুলে দেয় দক্ষিণের জানলা। বারবার মনে হচ্ছে কালই তো সেই ভদ্রলোকের আসার কথা কিন্তু অনিরুদ্ধ ঠাকুরপো তো কিছু বললেন না। হতে পারে হয়ত ভুলে গেছেন। আর তো আসেননি এই বাড়িতে,তবে কাল আসার কথা সূর্য বারবার বলেছে বরযাত্রী যেতে হবে। জেঠু আর স‍্যার দুজনকেই চাই তার। তবে জানতেই হবে তাকে কেন একজন মুসলমান আর্টিস্টের শোবার ঘরে রাঙার ছবি?

  ****************************
বাড়ির বাইরে গাড়ির ভিড় জমেছে একটু বাদেই বর নিয়ে বরযাত্রী রওনা দেবে। সূর্যর বন্ধুরা সবাই এসে গেছে। দাদার কিছু পরিচিত মানুষজনও আছেন। সবার সামনে নামতে পারেনা রাঙা। তবে কি অনিরুদ্ধ ঠাকুরপো আসেননি? এলে নিশ্চয় আসতেন একবার। তারপরেই মনে পড়ে আজই তো সেই উদ্বোধন, তাহলে হয়ত আর আসবেন না।
         বরযাত্রী চলে গেছে অনেকক্ষণ। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে রাঙা। কেন যেন সূর্যর চোখ দুটোও আজ জলে ভেজা। সত‍্যিই তো কিছুই পায়নি মা জীবনে,ওর মুখ চেয়েই কাটিয়েছে সারাজীবন। চন্দ্রিমা সব জানে,সূর্যর হাতটা মুঠোয় রেখে বলেছে," মাকে আমরা কোন কষ্ট পেতে দেব না। এরপর মাকে নিয়ে আর বড়মাকে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াবো। সারা জীবন অন্দরে কাটিয়ে দিল মানুষ দুটো।"
       অনিরুদ্ধর আসার আশা ছেড়ে দিয়েছে রাঙা। ব‍্যস্ত মানুষ, নিশ্চয় কাজ পড়ে গেছে। হয়ত বা বৌভাতে আসবেন। তবে রাঙার দেখা করার কি হবে?
     ফাঁকা বাড়িতে এখন ওরা দুই জা,সাথে সুলতা। হঠাৎই সুলতা ডাকে," ও বৌদি ছবি স‍্যার এসেছেন নিচে, আপনারে ডাকছেন তাড়াতাড়ি। কি যেন দরকার।"
     তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে রাঙা। অনিরুদ্ধর পরনে আজ ধুতি পাঞ্জাবী। একদম অন‍্য রকম লাগছে দেখতে। রাঙাকে দেখেই বলে," অনেকটা দেরি হয়ে গেছে বৌঠান। কার্ডটা হারিয়ে ফেলেছি তাই ভাবলাম ঠিকানাটা জেনে যাই বিয়েবাড়ির। কথার ফাঁকেই একটা ভাজ করা চিরকুট রাঙার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় অনিরুদ্ধ। রাঙার বুকটা কাঁপে হঠাৎই কেন যেন।
       দিদিকে পুজোর ঘরে দেখে ঘরে এসে দরজা দেয় রাঙা। বুকে অদ্ভুত ধুকপুক,যেন একটা নিষিদ্ধ কাজ করার অপরাধবোধ আর ভয়। কেউ তো জানেনা কোন কথা। এরপর যদি সূর্য বা দাদা জানতে পারে? তারপরই নিজেকে সামলায় রাঙা চোখ রাখে চিরকুটে.." বৌঠান দেখা হবে ব‍্যবস্থা করেছি তবে কালই এগারোটার দিকে। উনি কাল রাতেই চলে যাবেন,হাতে সময় কম। আমি অপেক্ষায় থাকব গাড়ি নিয়ে।"
           এই শীতেও রাঙার কপালে আর শরীরে জমেছে ঘাম। ওর গালে বিন্দু বিন্দু রক্ত জমেছে। তাড়াতাড়ি জায়গাটা দেখে নেয় রাঙা। কালীঘাট মন্দিরের কাছেই দাঁড়াবে ঠাকুরপো। কিন্তু কি বলবে দিদিকে? যা হয় একটা বলবে। তবে সময়টা ভালো কারণ বাবু বৌ নিয়ে ফিরবে সন্ধ‍্যার পর ততক্ষণে ফিরে যেতে পারবে রাঙা। কতটা আর সময় লাগবে?
তাছাড়া বধূবরণ আচার অনুষ্ঠান সবই তো দিদি করবে। ও তো বিধবা,এসব ছোঁবেও না আর দেখবেও না।

*********************
সন্ধ‍্যা প্রথমে একটু কিন্তু করলেও কিছু বলতে পারে না। কারণ জানে কোন শুভকাজে অথবা মনখারাপে মায়ের মন্দিরে যায় রাঙা। হয়ত ছেলের মঙ্গলের জন‍্য যেতে চায় মন্দিরে তা যাক। বাড়িতে তেমন কোন কাজ নেই।
 " তা মন্দিরে যাবি তো ভোরবেলা গেলি না ক‍্যান? এত বেলায়?"
" হঠাৎই মনে হল দিদি তাই। আমার তো একটা বড় ভাবনা গেল তাইনা? চইল‍্যা আসুম তাড়াতাড়ি।"
     রাঙার পরনে চন্দন রঙের সিল্কের শাড়ি তাতে গাঢ় সবুজ পাড়। সদ‍্য স্নান করা এলোচুলের খোঁপা থেকে কিছু চুল এলোমেলো করে ছড়িয়ে আছে মুখের চারপাশে। প্রথমে মন্দিরে গিয়ে মায়ের আশীর্বাদ নেয় রাঙা তারপর এগিয়ে আসে অনিরুদ্ধর বলে দেওয়া জায়গাটার দিকে। রাঙাকে দেখে আজ আবার মুগ্ধ হয় অনিরুদ্ধ। কত সাধারণ নিরাভরণ সাজ অথচ তাতেই অনন‍্যা বৌঠান।
  গাড়িতে উঠে রাঙা জিজ্ঞেস করে," কি কইছেন তারে আমার কথা? মানে..."
-" ওভাবে কি বলা যায়? আমি একটু সময় চেয়ে নিয়েছিলাম আলাদা দেখা করার জন‍্য। উনি ভীষণ অমায়িক রাজি হয়ে গেছেন।"
" আমায় দেইখ‍্যা বিরক্ত হইবেন না তো?"
অনিরুদ্ধ হাসে," দেখা যাক,তবে আমি কথা রেখেছি বৌঠান। কিন্তু খুব সঙ্কোচ হচ্ছে আমার যে ঐ ছবিটা নিয়ে আমি হঠাৎই উত্তেজনার বশে এত কান্ড করে ফেলেছি। আমাকে হয়ত ভুল বুঝবেন উনি।"

  সঙ্কোচ হয় রাঙারও সত‍্যি বোধহয় এভাবে আসা ঠিক হয়নি। ঐ ছবি যে ওর প্রমাণ কি? কি করবে? ফিরে যাবে?

        ভাবনার জাল ছিঁড়ে যায় অনিরুদ্ধর কথায়," আসুন বৌঠান এসে গেছি।"
    
       হোটেলের দরজায় নক করে অনিরুদ্ধ দরজা খোলেন নিজামুদ্দিন। রাঙা তখন কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে।
 হাসির আওয়াজে চমকে যায় রাঙা,পা দুটো কাঁপে ওর। শুনতে পায়..." আসুন আসুন আপনার জন‍্যই অপেক্ষা করছি। "
    এ গলার স্বর কার? কে এই নিজামুদ্দিন চৌধুরী?
অনিরুদ্ধ ডাকে," বৌঠান আসুন। আমার বৌঠান এসেছেন। আপনার সাথে আলাপ করার ইচ্ছে।"
   রাঙার যত্নে মাথায় তোলা ঘোমটা তখন এলোমেলো হয়ে খোঁপার প্রান্ত স্পর্শ করেছে।
  অনিরুদ্ধর ডাকে এগিয়ে আসে রাঙা কোনরকমে হাতদুটো তুলে নমস্কার করে। 
          এক মুহূর্তের জন‍্য তাকায় ভদ্রলোকের দিকে। মুখ ভর্তি বসন্তের দাগ,গালে দাড়ি। চোখে হাইপাওয়ারের রঙীন চশমা।
       রাঙা বৌ এখানে ! এটা কি স্বপ্ন না বাস্তব! কিন্তু এতদিন ধরে কল্পনা করে আসা তার রাঙা বৌ আজ যে একদম সাদা ক‍্যানভাসে আটকানো একটা ম্লান ছবি। কোথায় সেই লাজুক হাসি? গালের লালিমা? মাথার সিঁদুর আর পায়ের মল?
 নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে প্রতি নমস্কার জানান। কিন্তু হায় এতদিন বাদে কেন আবার অতীত এলো সামনে? তার থেকে তো কল্পনার রাঙা বৌ ভালো ছিল। নাহ্ কিছুতেই ধরা দেবেন না রাঙার কাছে। নিজেকে সামলাতেই হবে। এক মুহূর্তে ঠিক করে নেন নিজামুদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু রাঙা বৌ কেন এসেছে এখানে?
    নিজামুদ্দিন বলাতে ওরা এসে বসে সোফায়। এই কয়েক মিনিটে নিজেকে শক্ত করেছে রাঙা। যদিও এক বুক কান্না হাহাকার করছে তার মনে তবুও আরেকবার গলাটা শুনতে চায় ভালো করে। আর কোন সঙ্কোচ করবে না। সোজাসুজি কথা বলতেই তো এখানে আসা।
    রাঙা বলার আগেই কথা শুরু করে অনিরুদ্ধ," প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। উনি রাঙা বৌঠান। কলকাতার রায়চৌধুরী পরিবারের। আমার সাথে আলাপ ওঁর ছেলেকে আঁকা শেখানোর সূত্রেই। গতকাল অবশ‍্য আমার ছাত্রর মানে ওঁর ছেলের বিয়ে ছিল,তবুও বৌঠান এসেছেন অবশ‍্য সবটাই আমার দায়।"
       বুকটা ঝড়ে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে তবুও নিজেকে কষ্টে ধরে রাখেন নিজামুদ্দিন। রাঙার সন্তান? মানে তো তারও সন্তান। বুকের মাঝে আবার পিতৃত্বের সুখ ডানা ঝাপটায়। একবার যদি দেখা যেত তাকে।
   অবাক হয় রাঙা ভদ্রলোক অদ্ভুত চুপচাপ কোন কথা বলছেন না কেন? নির্মলের মতই চাপা গায়ের রঙ ভদ্রলোকের। এমনটাই লম্বা ছিল নির্মলও। কিন্তু মুখটা....

রাঙার চোখ যে তাকে দেখছে বুঝতে পারলেও তাকান না। গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলেন," কি দায়? ঠিক বুঝলাম না তো?
 রাঙার এবার অস্থির লাগে এ গলার স্বর যে তার খুব পরিচিত। বুঝতে পারে অযথা সময় নষ্ট হচ্ছে। হাতে বড় সময় কম। আজ বাড়িতে ছেলে বৌ আসবে,অনেক কাজ। 
হঠাৎই উঠে দাঁড়ায় রাঙা," আমারে বলতে দ‍্যান ঠাকুরপো। আমাদের বাসায় আমার স্বামীর নিজের হাতে আঁকা একখানা ছবি আছে। সেই ছবি আমার ফুলশয্যার রাতে বধূবেশের। দীর্ঘদিন সেই ছবি ছিল গোপনে রাখা। তবে ছেলের আবদারে তা বাধানো হয়েছে। ঠাকুরপো হঠাৎই বলছেন এতদিন বাদে বিদেশ থেকে এসে এমন ছবি মানে আমার ছবি আপনার শোবার ঘরে দেখেছেন উনি।"
      অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে যায়, বৌঠানের তেজের সাথে পরিচিত ছিল কিন্তু বৌঠান যে এত সুন্দর গুছিয়ে একজন অচেনা মানুষের সাথে কথা বলতে পারবে তা ভাবেনি কখনও।
 আচমকা প্রশ্নে হকচকিয়ে যান নিজামুদ্দিন। কি উত্তর দেবেন? এই এত বছরের জীবনে কম নারী দেখেননি তবুও আজও প্রতিটা ভোর হয় রাঙাকে দেখে আর ওর মলের শব্দ শুনে। প্রতিটা রাতে ঘুম আসে রাঙার মলের শব্দে।
   হা হা করে হেসে ওঠেন নিজামুদ্দিন সেই হাসির শব্দে আবার কেঁপে ওঠে রাঙার বুক। কতদিন এমন হাসির শব্দে চমকে উঠে বলেছে," ইশ্ ডাকাতের মত হাসো আমার বুক কাঁইপ‍্যা ওঠে।"
-" তাই দেখি একবার হাত দিয়া কেমন কাঁপে। ভয় নাই আমি চাইপ‍্যা ধইর‍্যা থাকুম। আর কাঁপবো না।"
   লজ্জায় নির্মলের চওড়া বুকে মুখ লুকাতো রাঙা।
-" আচ্ছা অনিরুদ্ধ আপনি কি করে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলেন যে আমার বেডরুমে যে ছবি আপনি দেখেছেন তা আপনার বৌঠানের ছবি? সে ছবি তো একজন লজ্জাবনত ষোড়ষীর ছবি,লাজে রাঙা। "

 পরিস্থিতি এতটা জটিল হতে পারে অনিরুদ্ধ নিজেও ভাবেনি একটা কথার কথাই বলে ফেলেছিল," আমি খুব দুঃখিত, আসলে বৌঠানের বাড়িতে একই ছবি রাখা আছে। আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন।"
  " কিন্তু আপনার এখনকার তপস্বিনী স্নিগ্ধ রূপের বৌঠানের সাথে তো সেই ছবি মেলে না।"
-" নাই বা মিললো তবুও মানুষটা তো বৌঠানই।"
-" কিন্তু আমার সাথে তো ওঁর এই প্রথম দেখা হল।"
নিজামুদ্দিন আবার সেই হাসি হাসেন। হঠাৎই রাঙা উঠে দাঁড়ায়। একদম এগিয়ে যায় নিজামুদ্দিন চৌধুরীর কাছে। উত্তেজনায় রাঙার ঘোমটা খুলে গেছে,খোঁপা অবাধ‍্য হয়ে উঠেছে। এতদিন বাদে রাঙাকে দেখে নিজেকে ঠিক রাখা বড়ই মুশকিল তবুও ঠিক রাখতেই হবে। 
হঠাৎই রাঙা বলে ওঠে," আচ্ছা আপনি তো শুনেছি ঢাকার মানুষ। একটা কথা সত‍্যি করে বলুন আমার হাতে বেশি সময় নেই। আমার স্বামী নির্মল রায় চৌধুরীকে কি আপনি চেনেন। ভীষণ ভালো আঁকত সে। ঢাকাতেই পড়াশোনা করত। কোথায় যেন তার একটা ছায়া আপনার মধ‍্যে আছে। কিন্তু তার মুখে..."
নিজেকে ঢাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজামুদ্দিন বলেন," কি নাম বললেন? নির্মল রায় চৌধুরী? দাঁড়ান একটু ভাবি। হ‍্যাঁ মনে পড়েছে।আমাদের সাথে একজন নির্মল পড়ত তবে শুনেছি সে তো বহু বছর আগে মারা গেছে।"
    " উত্তজনায় কাঁপে রাঙা,আমি যদি বলি আপনারাই কেউ তারে মেরে তার জিনিসপত্র চুরি করছেন সাথে ঐ ছবি খানাও।"
       কথা বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে আসে রাঙার। নিজেকে সামলাতে পারেনা। 
- " অনিরুদ্ধ আপনি দয়া করে বৌঠানকে বসতে বলুন। আমার হাতে সত‍্যি বেশি সময় নেই। ফ্লাইট আমার একটু পরেই তাই আমাকে বেরোতে হবে। তার আগে একটা কথা বলতে চাই। সত‍্যিই ঐ ছবি নির্মলের আঁকা। তবে তাকে আমি খুন করিনি। তাকে খুন করেছে ধর্মান্ধ সমাজ,একদম নির্মম ভাবে গলা টিপে মেরে ফেলেছে একটা তরতাজা, হাসিখুশি, ডাকাবুকো ছেলেকে। ধর্মের নামে এভাবে আর কতদিন মানুষ খুন হবে জানিনা। কোনদিন ভাবিনি আপনার সাথে দেখা হবে। নির্মলকে আমি আর ফিরিয়ে দিতে পারব না তবে ওঁর দুটো জিনিস আছে আমার কাছে চাইলে আমি দিতে পারি।"
      "কি জিনিস? আর আমার ফটো?"
হাসেন নিজামুদ্দিন," সেটা তো এখন সাথে নেই। যদি কোনদিন পারি ফেরত দেব। তবে অনিরুদ্ধকে আমি ধন‍্যবাদ জানাব। আপনার বৌঠানকে না নিয়ে এলে হয়ত সারাজীবন এই জিনিসের বোঝা বয়েই আমাকে যেতে হত। এত বড় পৃথিবীতে কোথায় খুঁজে পেতাম আপনার বৌঠানকে? আপনার বৌঠানের বাড়ির ঠিকানা খানা যদি একবার দেন আমাকে তাহলে চেষ্টা করব ছবিটা ভবিষ্যতে ফেরত দিতে।"
-" কিন্তু আমার যে অনেক কিছু জানার ছিল,অনেক কিছু। আমি নির্মলের সব কথা জানতে চাই। কোথায় যেন নির্মলের সাথে অদ্ভুত মিল আছে আপনার। সেই ঘর কাঁপানো হাসি,উচ্চতা অনেক কিছুই। কিন্তু নির্মলের তো এমন মুখ ভর্তি...."
    বাকি কথা রাঙা বলতে পারে না। গলা আটকে আসে উত্তজনায় আর আবেগে।
ওর মুখের কথা কেড়ে নিজামুদ্দিন বলে," হ‍্যাঁ অনেকটা মিল আমাদের তবে আমার মুখ ভর্তি বসন্তের আঁচড়,এক চোখ অন্ধ। আরেক চোখও আধ বোজা।
আর প্রধান অমিল তো ধর্মে,যদিও কর্মে দুজনেই এক। নাহ্ আর কথা বলার সময় নেই। একটু বসুন আমি আসছি।"
         নিজামুদ্দিনের শেষ কথাগুলো হাতুড়ির মত আঘাত করে রাঙার কানে - ধর্মে অমিল,কর্মে মিল।

       অনিরুদ্ধর অদ্ভুত লাগে পুরো ঘটনাটা,মনে হচ্ছে চোখের সামনে একটা ছায়াছবি দেখছে যেখানে চরিত্ররা ছায়ার মত ঘোরাঘুরি করছে। তবে ছোটবৌঠানকে আজ বড় আঘাত দিয়ে ফেলেছে এই ভেবে খুব খারাপ লাগে। এখনি বাড়ি ফেরা দরকার ছোট বৌঠানের,বাড়িতে হয়ত এতক্ষণে খোঁজাখুঁজি পড়ে গেছে।
        " বৌঠান চলুন,অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। সূর্যরা আসবে তো আজই। আপনার বাড়িতে অনেক কাজ আজ।"
     " হ‍্যাঁ যাইতে হইবো এবার।" আচ্ছন্নের মত বলে রাঙা। 
    ততক্ষণে নিজামুদ্দিন চৌধুরী এসে দাঁড়িয়েছেন।
ওঁর হাতে মোটা কাগজের খামে মোড়ানো একটা কিছু আর একটা ছোট কাপড়ের ভেলভেটের থলে। তার সাথে রোল করা একটা ছবি। অবাক লাগে রাঙা এবং অনিরুদ্ধর এত কিছু কি এনেছেন মানে কি আছে এর মধ‍্যে?
     " আপনি এদিকে আসেন,আপনাকে এগুলো দিয়ে আমি হাল্কা হতে চাই। "
-" কিন্তু আমার স্বামী নির্মল রায় চৌধুরীর কথা?"
-" হয়ত সেটাও কিছুটা আছে এর মধ‍্যেই।"
 জিনিসগুলো দিতে হাত বাড়ান নিজামুদ্দিন, হাত পাতে রাঙা। হঠাৎই চমকে ওঠে রাঙা,একি! ওঁর বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলের ওপরে গভীর কাটা দাগটা কেন? এমন দাগ তো মানে ঠিক এক জায়গায় কেটে গেছিল খুব গভীর ভাবে নির্মলের। ওকে নিজের হাতে কেটে বাগানের গাছের ডাব খাওয়াতে। সে কি কান্না রাঙার ঐ রক্ত দেখে। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে চেপে ধরেছিল, রক্তে মাখামাখি হয়েছিল সব। তবে তাতেও হয়নি সেলাই করতে হয়েছিল।
    তারপর যে কত আদর খেয়েছে নির্মল ঐ অজুহাতে ঠিক নেই। সেইসব দিনের কথা মনে পড়লে আজও গালে শিমুলের রাঙা ছোঁয়া লাগে রাঙার।
" আপনার হাতে অত গভীর কাটা দাগ কি করে?"
" এক প্রিয় মানুষকে ডাব কেটে খাওয়াতে গিয়ে। যাক আর সময় নেই এগুলো আপনি রেখে দিন। আর এটা আমার নিজের হাতে আঁকা ছবি। আপনার ছেলেকে দেবেন। এবার সময় হল না,মানে এত কিছু তো জানতাম না তাহলে আমি নিজে ওকে আশীর্বাদ করে যেতাম। শুনেছি সেও ভীষণ ভালো আঁকে।"
      নিজামুদ্দিন চৌধুরীর বলা কথাগুলো কানে যায় না রাঙার। উথালপাথাল করে তখন মনের মধ‍্যে। কিন্তু অনিরুদ্ধ ঠাকুরপো আছেন সামনে। তাই নিজেকে সামলাতেই হবে।
    হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার আগে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখে রাঙা ওঁর দিকে,অবাক হয়ে দেখে চশমায় ঢাকা চোখদুটো খোঁজার চেষ্টা করে কিছু। তারপরেই মাথা নিচু করে,ঘোমটা টানে ভালো করে । 
অনিরুদ্ধ ঠাকুরপো তখন ওদের বাড়ির ঠিকানা ওঁর ডায়েরিতে লিখে দিচ্ছেন।
     রাস্তায় পা রেখেছে রাঙা,ঘাড়ের কাপড়ের ব‍্যাগে ভরে নিয়েছে জিনিসগুলো। শুধু ছবিটা হাতে রাখা।
 " বৌঠান আমি পৌঁছে দিই আপনাকে?"
-" না,ঠাকুরপো এই পথটুকু আমি একাই যেতে পারব। একটা ট‍্যাক্সি শুধু ডেকে দিন।"
           ঘটনা প্রবাহ কেমন যেন একটা সরীসৃপের মত এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে যে নিজেও দিশাহারা অনিরুদ্ধ। নিজেকে খুবই অপরাধী লাগছে বৌঠানের কাছে। তাই বলে," আমাকে ক্ষমা করবেন বৌঠান।"
 -" ভগবান যা করেন হয়ত ভালোর জন‍্যই করেন। আমি আসি। কাল আসবেন।"
     বাড়িতে আসতেই হৈ হৈ শুরু করে সন্ধ‍্যা তার সাথে বকাবকি," আচ্ছা তোর কি কোন কান্ডজ্ঞান নাই নাকি? পূজার নামে বারাইয়া তিনঘন্টা বাদে আইলি। তোর ভাসুর আইছিল রাগ করছেন শুইন‍্যা। আজ না ওরা আইবো সন্ধ‍্যায়। কই গেছিলি শুনি?"
       -" একটু জিরাইতে আর কাপড় ছাড়তে দাও আমারে। শরীর ভালো লাগত‍্যাছে না,মাথা ধরছে গো খুব। পরে সব কমু।"
-" হ আয়নার সামনে গিয়া একবার দ‍্যাখ চোখমুখের হাল। মাথা ঘুরছে নাকি রাস্তায়?"
   দিদির কথার উত্তর না দিয়ে ঘরে এসে ঢোকে রাঙা। ঘড়ির দিকে তাকায় এখনও হাতে কয়েক ঘন্টা আছে ওদের আসতে।
          কাঁধের ব‍্যাগটা তাড়াতাড়ি নামায় রাঙা,আগে কি কাপড় ছাড়বে? না আগে দেখবে কি আছে ঐ খামের ভেতর আর ভেলভেটের ব‍্যাগে?
  নাকি গোল করে গোটানো ছবিখানা দেখবে আগে? না না সেই ছবি বরং সূর্যই দেখবে। ওটা তো ওকে দিয়েছেন উনি।
   খাটের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে রাঙা,লাল মেঝেতে তার নিরাভরণ পা দুটো শ্বেত পদ্মের কুড়ির মত ছড়ানো। ছড়িয়ে পড়েছে শাড়ির আঁচল,মাথার লম্বা চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে গেছে মুখের চারপাশে। খামে মোড়ানো ভেলভেটের মলাট দেওয়া ছোট বাঁধানো খাতাটা থেকে এতক্ষণ চোখ সরাতে পারেনি রাঙা। এ হাতের লেখা তার বড় পরিচিত। একটার পর একটা পাতা পড়ে চলে রাঙা,কত পরিচিত ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মুক্তদানার মত প্রতি পাতায়। আছে কত সোহাগ আদরের কথাও। তবে এ সবই তার মোটামুটি জানা। কিন্তু কখন লিখত এসব নির্মল?
       তারপর রাঙা শুধু পড়ে গেছে আর পড়ে গেছে বাঁধানো খাতার প্রতিটা পাতা। একটা একটা করে না জানা ঘটনার দরজা খুলে গেছে কখনও শব্দে আবার কখনও বা নিঃশব্দে। হঠাৎই খেয়াল হয় নির্মলের মৃত‍্যুদিন আর সেই বিষাক্ত বছরটার কথা। কিন্তু একি? রাঙার কাছে যে নির্মল মৃত তার লেখনী যে নদীর স্রোতের মত বয়ে চলেছে তার মৃত্যুর পরেও বছরের পর বছর ধরে। এক একটা ঘটনা পড়ে আর তারিখে চোখ রাখে রাঙা। তারপর উন্মাদের মত মেঝেতে গড়াগড়ি খায়। তাকে পেয়েও হারালো ধরে রাখতে পারলো না। এমন কি সন্দেহও করল? হায় ভগবান এবার কোথায় যাবে? কোথায় পাবে তাকে?
  ভেলভেটের ব‍্যাগের মধ‍্যে কাগজে মোড়ানো রাঙার পায়ের সেই জোড়া ছুট মল খানা। যার একখানা পড়ে আছে রূপোর বাক্সতে। মলটা দুহাতে জড়িয়ে হাউ হাউ করে কাঁদে রাঙা।

         কিন্তু নির্মলকে মৃত বলেছেন কেন ভাসুর? তাহলে কি তিনি সব জানতেন? নাকি জানতেন না? আর সত‍্যিই তো জানবেন কি করেই বা?

     এর মধ‍্যে বেশ কয়েকবার দরজার কাছে এসে মৃদু টোকা দিয়েও ফিরে গেছে সন্ধ‍্যা। রাঙার যে একবার মাথা যন্ত্রণা হলে চট করে সারে না তা জানে। কিন্তু এদিকে কি হবে? আর ঘন্টা খানেকের মধ‍্যেই তো বৌ নিয়ে আসবে সূর্য।

**************************
ফ্লাইট ছাড়তে বেশ কিছুটা সময় বাকি তবুও সময় নষ্ট না করে এয়ারপোর্টে বেশ তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। মনটা বড় অস্থির আজ,আর হয়ত কলকাতায় থাকা উচিত হবে না কোন মতেই। অদ্ভুত একটা অঘটন ঘটে গেছে আজ। তবে সত‍্যিই কি অঘটন? কতবার তো ইচ্ছে করেছে একবার রাঙাকে দেখতে। আর আজ যখন এত বছর বাদে রাঙা এসে সামনে দাঁড়ালো তখন অবাধ‍্য চোখ দুটোকে শাসন করে সংযত হয়ে থাকতে কতই না চেষ্টা করেছেন। আজও রাঙাকে দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন নিজামুদ্দিন। নিজের নামটা মনে পড়াতেই বুকটা কেঁপে উঠল। রায়চৌধুরী বাড়ির ছোট বৌ রাঙা আছে কিন্তু নির্মল তো অনেকদিন আগেই মারা গেছে।

কিন্তু আবেগে ভেসে রাঙাকে ডায়েরিটা হঠাৎই দিতে গেলেন কেন? এই প্রশ্ন নিজেকে যত বার করেছেন তত বারই মনে হয়েছে নির্মল অতীত,বর্তমান নিজামুদ্দিন। কিন্তু রাঙা রয়ে গেছে অতীত আর বর্তমান দুয়েতেই জড়িয়ে। রাঙার চোখেমুখে আজও প্রস্ফুটিত এক চাপা দুঃখ আর অভিমান হয়ত বা কোথাও একটা ভুল বোঝাও। কিন্তু এ দেখা না হলেই বোধহয় ভালো হত। কেন যে নিয়তি তাকে এনে দাঁড় করালেন ফেলে আসা অতীতের মুখোমুখি কে জানে? এ রাঙা তো সেই রাঙা নয় যে নিত‍্য আসে মল বাজিয়ে নিজামুদ্দিনের একান্ত শয়নকক্ষে। গভীর রাতে চুপিচুপি ওর কানে বলে যায় কত কথা।
নির্মল বহুদিন মৃত ধর্মান্ধ সমাজের কাছে। নিজামুদ্দিনের বয়েস হয়েছে তবুও রাঙা তো ছিল সেই প্রথম যৌবনের সুবাসে ভরপুর স্বর্ণচাঁপার মত যার সুবাসে ঘুমিয়ে পড়েছেন স্বপ্ন দেখতে দেখতে কত রাতে। এই রাঙাও সুন্দর তবে দুঃখের অভিজ্ঞতা আর জীবন সংগ্ৰামে ক্লান্ত। সমাজ আর সংস্কার মুছে দিয়েছে তার জীবনের সবটুকু রঙ।
 হঠাৎই কেন দেখা হল? আজ যে আবার খুব নির্মল রায় চৌধুরী হতে ইচ্ছে করছে তার। সত‍্যি যদি তাই হত,তাহলে অন্ততঃ একবার রাঙাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারত, আমি মরিনি রাঙা বৌ আছি বেঁচে। তুমি আবার সাজাও তোমার সিঁথি গাঢ় লাল রঙে। একখানা লাল বেনারসী পরে এসো আবার আমার সামনে। কিন্তু নাহ্ তা ভাবাই তো পাপ। আচ্ছা এরপর রাতে ঘুম আসবে কি করে? রাঙার ফেলে আসা মলটা তো তাকেই দিয়ে এসেছেন। 
            তবে আজ কেন যেন বড় হাল্কা লাগছে। আনোয়ারা মারা যাবার পর যখন ঐ গ্ৰাম থেকে একদিন রাতের অন্ধকারে পালিয়ে কোন রকমে ঢাকায় এসেছিলেন তখন খুব ইচ্ছে হয়েছিল একবার যে করেই হোক ফিরতে কলকাতায় অন্ততঃ যে কোন ভাবেই খোঁজ করে যদি একবার পৌঁছনো যায় রাঙার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গিয়েছিল আনোয়ারার কথাগুলো দাদা নাকি ওর শ্রাদ্ধশান্তি করেছেন। তাই ইচ্ছেপূরণ হয়নি কোনমতেই। 
    তারপর নিজেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন উন্মত্ত হয়ে, বাঁচিয়েছিল প্রিয় বন্ধু সামসুদ্দিন। একটু একটু করে মরে যাওয়া মনটাকে আবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল রঙ,তুলি আর কাগজ। এক বছর হিজিবিজি টেনেই কেটেছিল। তারপর এঁকেছিলেন রাঙার সেই ছবিটা যা দেখে প্রতিদিন রাতে ঘুম আসে আর সকালে ঘুম ভাঙে। তারপর কেন যেন নিজেকে আর একলা মনে হয়নি। আজ মনে হল,আজকে দেখা রাঙা বড় বেশি অচেনা। বরং অনেক চেনা সেই ছবিটা,আর সেই টানেই তো ফিরে যাওয়া আবার। রাঙা যে ওখানে অপেক্ষায় আছে। প্রথমটা অনেকেই কিনতে চেয়েছিল ছবিটা অনেক অনেক দামে,কিছুতেই রাজি হননি। তারপর শোবার ঘরে সবার দৃষ্টির অন্তরালে রেখে দিয়েছিলেন ছবিটা। আজ মনে হয় ঐ ছবিটাই ভাগ‍্যলক্ষ্মী। কত ছবি প্রসব করেছে ঐ ছবিটা। ভাষাটা কেমন যেন নিজের কানে লাগল। রাঙাও তো প্রসব করেছে ওঁর সন্তান,নাম তার নাকি সূর্য। রাঙা হয়ত কোথাও আছে তা ভেবেছেন কিন্তু কখনই মনে আসেনি রাঙার সন্তানও আছে। মনে পড়ে গেল শেষবার রাঙার সাথে মিলিত হওয়ার কথা। খুব ইচ্ছে ছিল তাকে দেখার,ইচ্ছে করছিল অনাস্বাদিত পিতৃত্বকে ছুঁতে। কিন্তু হল না দেখা। হয়ত আর কোনদিন দেখা হবেও না......
 কেমন হয়েছে সে? নির্মলের মত কালো না রাঙার মত ফুটফুটে। তবে সে যখন সূর্য তাহলে তার সূর্যের মতই রূপ হবে হয়ত। দাদা বৌদি ছেলে সবাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে হঠাৎই। আরেকজনও তো এসেছে, নিজের মনেই হাসি পায় ভেবে ইশ্ শ্বশুর হয়ে গেছেন তো। কি নিষ্ঠুর নিয়তি! ছেলের বিয়ের দিন কলকাতায় এসেও কিছুই দেখতে পেলেন না। অবশ‍্য দেখবেনই বা কি করে? রাঙার সাথে দেখা হওয়াটাই তো একটা রূপকথার গল্পের মত।

*************************
সন্ধ‍্যা প্রায় হয় হয় কই এখনও তো রাঙা দরজা খুলল না। সন্ধ‍্যার পরেই তো এসে পড়বে ওরা। বিমল এবার সত‍্যিই ব‍্যস্ত হন," তুমি এবার দরজায় নাড়া দাও জোরে। এ আবার কি দরজা দিয়া ঘুম। শরীর খারাপ তো ডাক্তার ডাকন লাগে। তাছাড়া নতুন বৌ আইব বাড়িতে। বুঝলাম সে বরণ করব না তবুও তো পোলাটা খুঁজব তারে।"
     সন্ধ‍্যা জোরে জোরে দরজায় ধাক্কা দেয় এবার,লোহার কড়াও নাড়ে। তবে বেশি ডাকাডাকি করতেও অস্বস্তি হয় নিচে লোকজন আছে কিছু। যদিও সবাইকে বলেছে রাঙার মাথা যন্ত্রণা।
       -" ও রাঙা,মাথা ছাড়ে নাই এখনও? খোল দেখি একবার। আমি ওষুধ আনাইছি। সেই কখন আইছস,খোল শিগগির দরজা।"
            দরজা খুলে যায়,কিন্তু রাঙাকে দেখে নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারে না সন্ধ‍্যা। কেউ দেখে ফেলার আগেই দরজার শিকল টেনে বিমলকে ডাকতে ছুটে যায়। হাত পা কাঁপতে থাকে ভয়ে,তবে কি মাথা খারাপ হল রাঙার? কি হবে এখন? হায় ভগবান! হে রাধাগোবিন্দ।
      সন্ধ‍্যার ডাকে ছুটে আসেন বিমল। দুজনে ঘরে ঢুকে দরজা দেন। রাঙা তখন পাথরের প্রতিমার মত মেঝেতে বসে। পরনে বিয়ের জরির বেনারসী,মাথা ভর্তি পুজোর সিঁদুর। কপালে বড় সিঁদুরের টিপ।
   ওঁরা দুজনেই বলে ওঠে একসাথে," পাগল হইছ নাকি ? যার বৌ পোলা আইব একটু বাদে তার কি মাথা খারাপ হইয়‍্যা গেল নাকি?"
      কোন উত্তর দেয়না রাঙা,মাথার ঘোমটাও তোলে না। বুকটা কাঁপে বিমলের, কোন রকমে নিজেকে সামলে বলেন," ওরে বোঝাও সন্ধ‍্যা,হাতে সময় নাই বেশি না হলে ঘরে তালা দাও এহন। বাড়িতে লোকজন আছে। হঠাৎ কি হইল?"
      সন্ধ‍্যা একপাশে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে আজ রাঙার সিঁদুর মুছতে বলার সাহসও যেন তার নেই ঠিক সেদিনের মতই।
     ভাসুরের দিকে খাতা খানা এগিয়ে দেয় রাঙা।
" এটা কি? "
  " ও আছে দাদা,আমি দেখছি ওরে। আমি বিধবা নই,আমি সধবা। ও মরে নাই আছে।" চিৎকার করে কেঁদে ওঠে রাঙা। ভয় পেয়ে যায় সন্ধ‍্যা ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে। রাঙার বুকে হঠাৎ ওঠা কালবৈশাখীর ঝড়টা সব এলোমেলো করে দিয়ে মুশলধারে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। সন্ধ‍্যার বুকে মুখ গুজে ছেলেমানুষের মত হাউহাউ করে কাঁদে রাঙা।
     অবাক হয়ে যায় বিমল,যে জানলা বহুদিন আগেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন আজ হঠাৎই তা খুলল কি করে? সত‍্যিই কি সে এসেছিল? অবশ‍্য মাঝে একবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল তার একটা খবর নেবার কিন্তু শুনেছিলেন সে মরে গেছে না বেঁচে আছে তা কেউ জানে না। আনোয়ারা মরে যাবার পর হঠাৎই একদিন হারিয়ে গেছিল সে। এমনিতেই সে নাকি পাগল হয়ে গেছিল। হয়ত কোথাও গাড়ি চাপা পড়েছে বা পাগল হয়ে ভিক্ষা করছে পথে পথে। আর শুনতে পারেননি বিমল। তবুও মাঝে মাঝেই রাস্তায় কোন অসহায় লোক দেখলেই খুঁজতে চাইতেন একটা চেনা মুখ।
       রাঙার দেওয়া খাতাটা পুরোটা পড়ার সময় নেই এখন তবে শেষটুকুই তো জানতে হবে। প্রথমটা তো জানাই। পড়তে পড়তে চোখটা ঝাপসা হয়ে যায় বিমলের। তবে না নরম হলে চলবে না। কঠোর হতে হবে তাকে। বাবা নিজে নির্মলকে ত‍্যাগ দিয়েছিলেন।
     " তুমি ভুল করছ বৌমা,সে নেই। নিজামুদ্দিন চৌধুরী নির্মল হবে কি কইর‍্যা সে আলাদা মানুষ।"
     " সে আছে দাদা,আমার মল সে আমাকে ফেরত দিয়া গেছে। নির্মলের নিজামুদ্দিন হবার ঘটনা তো সব খাতাতে লেখাই আছে দাদা। তার হাতের কাটা দাগ আমি দেখছি।"
  " আচ্ছা সে না হয় হল,কাটা দাগ তো থাকতেই পারে। তার মানেই সে কি নির্মল? বৌমা সে মুসলমান বিধর্মী।"
   রাঙার প্রতিবাদে আজ কাঁপে রায়চৌধুরী বাড়ির প্রতিটা ইট। বিমল বোঝে রাঙাকে আজ কিছুতেই সামলানো যাবে না।
 মুহূর্তে উঠে দাঁড়ায় রাঙা চোখের জল মুছে ফেলে ঝমঝম করে বাজে তার পায়ের মল। চমকে ওঠে সন্ধ‍্যা সেই আওয়াজে। মনে হয় আবার ফিরে এসেছে সেই পুরোনো দিন।

  " সে মুসলমান তা হয়ত সত‍্যি, তেমন আমি বিধবা নই সেটাও তো সত‍্যি। তারে মুসলমান বানাইছে আমাগো অন্ধ সমাজ। আমি এখন আর কাউরে ডরাই না। আপনারা থাকতে না দিলে আমি চইল‍্যা যামু যেখানে দু চোখ যায়।" 
 " আর তোমার পোলা সে মানবো এই সব?" শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করেন বিমল।
   " আমি আর কারেও ডরাই না। আর এ সিঁদুর আমি মুছুম না।"
        বিমলের বুকটা থরথর করে কাঁপে। কি করবেন এখন? লোকজন যারা এসেছে তারা কি বলবে? ইশ্ সূর্যই বা কি বলবে? 
         
            শঙ্খের আওয়াজ কানে আসে রাঙার,নিচে উলুর শব্দ। ঐ বোধহয় বৌ নিয়ে সূর্য এল। দিদি চওড়া লালপাড়ের গরদ পরে নিশ্চয় এতক্ষণে নিচে নেমে গেছে বরণ ডালা নিয়ে। ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালিয়ে নতুন বৌয়ের মুখ দেখে দুধ আলতায় পা ডুবিয়ে ঘরে তুলবে দিদি। কিন্তু নতুন বৌকে বরণ করে ঘরে তোলার কাজ তো রাঙারই ছিল। তবে ওকে ঘরে আটকে রেখে ওরা চলে গেছে সবাই। রাঙা আবার খাতাটা খুলে ডুবে যায় তাতে। এভাবে যে কতক্ষণ কেটে গেছে বুঝতেই পারেনি। হঠাৎই দরজা খোলার আওয়াজ পায় রাঙা। খাটের বাজু দুহাতে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকে খাতাটা রেখে। কিছুতেই সিঁদুর মুছবে না ও,দেখি কত জোর ওরা করতে পারে।
        " মা আমরা অনেকটা আগে এসেছি,তোমাকে কতক্ষণ ধরে খুঁজছি। তুমি তোমার সূর্য আর চাঁদকে বরণ করবে না?"
    ছেলের গলার ঐ আবদারের সুরে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না রাঙা। আজ রাঙার কান্নায় যেন নড়ে ওঠে এই বাড়ির ঠুনকো জাতপাতের দেওয়াল।
   " আমি তো বরণ করতেই চাইছিলাম,তাই তো বেনারসী পইর‍্যা সাজছি। কিন্তু দেখ না বাবা,দিদি আমারে ঘরে বন্ধ কইর‍্যা রাখছে। লোকে নাকি ছি ছি করবো। তুই নাকি আমারে ভুল বুঝবি।"
    সূর্যর হাতে হাত রাখে চন্দ্রিমা দুজনে এসে দাঁড়ায় রাঙার দু পাশে। মাকে জড়িয়ে ধরে সূর্য,"দেখেছো চাঁদ আমাদের মাকে সিঁদুরের বড় টিপ পরে কি অপূর্ব লাগছে দেখতে, ঠিক যেন দুর্গা ঠাকুর। কই এদিকে এসো না মা বরণডালা হাতে নাও,তোমার আশীর্বাদ ছাড়া যে সবই অসম্পূর্ণ থাকবে।''
        একটা সঙ্কোচ বিমলকে জড়িয়ে ধরলেও আজ বড় হাল্কা লাগে ওঁর। একটা সময় রাঙার বৈধব‍্যের দায়ভার বুকে লোহার শেকলের মত জড়িয়ে ছিল। আজ তা হঠাৎই হাল্কা হয়ে গেছে। ছেলেই যখন সব মেনে নিয়েছে তখন আর কিছু বলবেন না তিনি। যুগটা যে এই সাতাশ বছরে অনেক এগিয়ে গেছে।
       ও ঘর থেকে শাঁখের আর উলুর আওয়াজ ভেসে আসে,এটা বোধহয় রাঙার উলুর শব্দ। হাত জোড়া করে প্রণাম করেন ভালো থাকে যেন ওরা।
             সূর্য কান পাতে মায়ের পায়ের মলের শব্দে কল্পনায় আঁকে মায়ের আগের ছবি। কত গল্প শুনেছে ছোটবেলায় মায়ের কাছে ওদের দেশের বাড়ির। চন্দ্রিমার গলায় চন্দ্রহার পরিয়ে হাতে একটা ভেলভেটের ব‍টুয়া দেয় রাঙা। অবাক হয় চন্দ্রিমা," এতে কি আছে মা?"
-" এতে আছে এক জোড়া মল। আমাগো বংশের নিয়ম বৌ মল পইর‍্যা সারা বাড়িময় ঘুরবো। আগে আমারটা পাইলে সেটাই দিতাম।"
      বলতে বলতে রাঙার গলা আটকে আসে,গালে জমে বিন্দু বিন্দু রক্ত। মনে পড়ে যায় নিজামুদ্দিন চৌধুরীর হাতের কাটা দাগটার কথা।
      ওহ্ আরেকটা কাজ তো বাকি,তাড়াতাড়ি করে টেবিলের ওপর রাখা গোটানো কাগজটা এনে ছেলের হাতে দেয় রাঙা ," এটা তোরে দিয়েছেন। মনে হয় খুব ইচ্ছা ছিল তোরে দেখার।"
      ছবিটা খুলে অবাক হয়ে যায় ওরা সবাই। ততক্ষণে বিমলও এসে দাঁড়িয়েছেন ঘরের সামনে।
- "এই তো আমাগো নির্মল,ও মা দ‍্যাখ রাঙা গলায় চেন। পাঞ্জাবীতে লাগানো সোনার বোতাম সব আছে। নিজের ছবি শেষে নিজেই আঁকছে পোলাটা!"
  মনে মনে ভাবে রাঙা একজন পিতার উপহার তার পুত্রকে। নিজের প্রতিকৃতির মধ‍্যে দিয়েই হয়ত সন্তানকে ছুঁতে চেয়েছে মানুষটা।

      রাঙা বুঝতে পারে নির্মলের জাত ধর্ম,চেহারা,চোখ সব গেলেও আজও নিজামুদ্দিনের মধ‍্যে হাহাকার করে নির্মলের সত্ত্বা।
    হঠাৎই কেঁদে ওঠেন বিমল," ওরে নির্মল,আর কি কোনদিন দেখতে পামু তোরে?"
     বড় বাবার ঘাড়ে হাত রাখে সূর্য, "আর বাবাকে হারিয়ে যেতে দেব না আমি। সারা পৃথিবীতে যেখানেই থাক সেখানে গিয়েই ধরে আনবো তাঁকে। তুমি ভেব না বড় বাবা।"
    
  


 


     
     
    
            
   




     




      


       

       



       
 
   
       
          

                      

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...