Skip to main content

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম#
#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

"চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সুন্দর চাঁদপানা মুখখানা।যদিও গায়ের রঙ তেমন উজ্জ্বল নয় তবুও হলুদ জরিপাড় শাড়ি আর কোমর অব্দি চুলে বেশ লাগছিলো।"
         " হ‍্যাঁ গো সেই,দেখছো না গাড়ি থেকে নামছে মুখটা কেমন ফ‍্যাকাশে। দেখে তো মনে হয় শরীরে রক্ত নেই। অথচ ঐ গতবছরই তো ওদের বাড়িখানা সাজলো আলোতে। শহর থেকে বর এলো।শুনেছি তো ঐ পুকুরের ধারের জমিখানা বন্ধক না বিক্রি করে লোভে পড়ে ওর বাবা মেয়েটাকে পাশ দিতে না দিতেই বে দেলো।"
        " শুনেছি তো বড়লোক শ্বশুরবাড়ি তা খেতে দিতোনা নাকি? কি মেয়ে কি হয়েছে! বরখানা যা কেলে আর ধুমশো ঐ মেয়ের সাথে মানায় নাকি?তখনই পাড়ার লোক বলেছে।যেন ঐ মেয়েরে গিলে খাবে রাক্ষসের মত বর।"
             পাড়ার লোকজনের কানাকানি চলছে দূর থেকে। দাদার সাথে মাথা নিচু করে ওদের হেলে পড়া দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে তুলি। অষ্টমঙ্গলাতে এসে একরাত্রি কাটিয়ে গেছিলো তারপর কতদিন ওদের মায়ায় জড়ানো গ্ৰাম বাতাসপুরে আসা হয়নি। শ্বশুরবাড়ির দম আটকানো ঘরে যখন ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো তখন মাঝে মাঝেই চোখে জল আসতো বাতাসপুরের কথা ভেবে।সেই পুকুর ঘাট,ধূধূ মাঠ যেখানে ঝড় উঠলে ওরা দৌড়তো ওদের খিড়কি দিয়ে সোজা আমবাগানের দিকে।আর তারপর ভাইবোনেরা মিলে নিয়ে আসতো এই এতো কাঁচা আম। সেই আমের আম কাসুন্দি মাখা মনে করলেই জিভে জল আসে।স্কুলে গিয়ে ঝিনুক দিয়ে আমের ছাল ছাড়িয়ে নুন ছড়িয়ে খেতো টিফিনের সময়।
                শ্বশুরবাড়িতে এসে শুনেছিলো মেয়েমানুষের গলা আর নোলা দুইই নাকি থাকতে নেই। শাশুড়ি বলেছিলো," শোনো বেশি কথা কোয়োনা বুঝলে। কইতে কইতে গলা বাড়ে আর খাইতে খাইতে নোলা।"
         আর তাই বোধহয় না খেতে দিয়ে ওকে মেরে ফেলার জোগাড় করেছিলো ওরা। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ভাবলেই..অনেক কাপড় দিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি বন্ধ করে দিতো বাথরুমে ওরা। স‍্যাঁতসেতে বাথরুম শ‍্যাওলা ভর্তি তাতে,কেমন যেন ভয় করতো তুলির। " শোনো কাপড় কাচা হলে দেখাবে তারপর যদি পরিস্কার হয় ঠিকমত তাহলে বেরুতে পারবে।"
          একদিন ভয়ে আতঙ্কে ছিটকিনি নাড়া দিয়ে ভেঙে ফেলেছিলো তুলি আর তারজন‍্য সারারাত বাইরে বের করে দরজা দিয়েছিলো বর। তবে সেদিন ছাদে দাঁড়িয়ে একলা তারাদের সাথে গল্প করেছিলো মনে মনে। রাতের অত‍্যাচারের থেকে হয়ত এই একলা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকাই অনেক ভালো। ওরা মানে ওর শ্বশুরবাড়ি নাকি বড়লোক,তাই শুনেছিলো ওর বাবা।বড় বাড়ি,একটা ভাঙা আ্যমবাসাডার গাড়ি দেখে ভুলে গিয়েছিলো।জামাই কালো দশাসই তাতে কি এসে যায়?পুরুষ মানুষ হলো গিয়ে ঐ সোনার আঙটি। গা ভর্তি সোনার গয়না দিয়ে সাজিয়েছিলো ওরা।বাতাসপুরের ওদের বাড়ির লোকজন অবাক হয়ে গিয়েছিলো। আর গয়না কে না ভালোবাসে মন ভুলেছিলো তুলিরও। তবে বেশিক্ষণের আনন্দ নয় ফুলশয‍্যার রাত্রে বর ঢোকার আগে শাশুড়ি ঘরে ঢুকে যা বলেছিলেন তা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করছিলো তুলি..
  " শোনো আমার ছেলের তো কান্ডজ্ঞান নাই।ধস্তাধস্তি করে আবার গয়নাগুলো বাঁকিয়ে ফেলোনা। নিজের বাপের বাড়ির টুকু পরে আমাদের গুলো খুলে রেখো।"
        বর নির্লজ্জ এবং অমানুষ সেটা খুব ভালো করেই বুঝেছিলো।কিন্তু কান্ডজ্ঞান যে তার ভালো আছে সেটাও বুঝেছিলো। একটা একটা করে গয়না খুলতে খুলতে গায়ে সুতোটুকুও রাখেনি।ভয়ে লজ্জায় শিউরে উঠেছিলো তুলি।
     " বয়েস তো খুব একটা কম নয় তোমার।তোমার বাবা তো বলেছিলো উনিশ আমার তো মনে হয় আরো বেশিই হবে।"
     মুখে পান চিবুতে চিবুতে বলেছিলো ভবেন। আদরের চোটে ঐ বিচ্ছিরি পানের রস লেগেছিলো তুলির সারা গায়ে।
         বাথরুমে গিয়ে স্নান করে এসেছিলো তুলি শেষ রাতে।
     আধোঘুমে চোখ খুলেছিলো ভবেন.." এই মাঝরাতে স্নানের মানেটা কি? অশুদ্ধ করে দিলাম নাকি? কই মেজো বৌদির তো এমন কিছু নেই। এসো ভোর হয়ে আসছে প্রায় আরেকবার অশুদ্ধ করে দিই তোমাকে।"
                সেই মেজো বৌদির কথা প্রথম শুনেছিলো ভবেনের মুখে।কই বিয়ের সময় তো শ্বশুর বাড়িতে অনেককেই দেখেছে কিন্তু মেজবৌদি বলে তো কাউকেই দেখেনি।তবে সে কে? শাশুড়ি পরদিনই গয়নাগুলো ওর কাছ থেকে গুছিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিলেন মেজো বৌমার গয়না তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
       ওর বড় ভাসুর শুনেছে আলাদা বাড়িতে থাকে তাদের সাথে সম্পর্ক ভালো নয় তাই তারা বিয়ে বাড়িতেও আসেনি। আসে পাশের আত্মীয়স্বজনের সাথেও তেমন সদ্ভাব নেই।তাহলে মেজোভাসুর আর মেজো জা কোথায়?
             অষ্টমঙ্গলাতে অল্প কিছু গয়না পরে বাপের বাড়ি ঘুরে আসে তুলি। সবাইকে বলে অনেক দূরের পথ তাই বেশি কিছু পরে আসেনি।
  শুধু ওর মা বলেছিলেন," তুলি তুই ভালো আছিস তো মা? জামাই তোকে ভালোবাসে তো?"
      শাড়ির আড়ালে চাপা দেওয়া কালসিটে আড়াল করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে ভেবেছিলো হয়ত একটু বেশিই ভালোবাসে মা। কখন যে এগুলো যন্ত্রণা হয়ে গেছে ভালোবাসার বদলে। বাপের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তুলতুলে খরগোশের মত মায়ের বুকের মাঝে এসে মাকে আঁকড়ে বলেছিলো," আমাকে এত তাড়াতাড়ি কেন পর করে দিলে মা?বাবাকে বলোনা গো আর দুটোদিন ওনাকে থাকতে বলতে।"
    " নতুন জামাই দেখেছো তো বড়ঘরের ছেলে রাশভারী।তার বড় ব‍্যাবসা আছে,তাকে কি আটকে রাখা যায়? বলেছি তো আগেই।তার অসুবিধা হবে বললো।"
        তারপর থেকে বাপের বাড়ি আর আসা হয়নি তুলির। সারা বাড়ির কাজ সামলাতে হত,আর বরের কান শাশুড়ি ভাঙালে থাকতে হত ঘরের বাইরে। তার মাঝেই একদিন আলাপ হয়ে গিয়েছিলো পাশের ছাদের সুনন্দার সাথে।
    রিনরিনে গলায় বলেছিলো," তুমি নতুন বৌ নাকি গো? কোথায় থাকো সারাদিন? কখনো তো দেখতে পাইনি। এই ভোরে কি করছো ছাদে?"
    অনেকগুলো প্রশ্ন,কি উত্তর দেবে ভেবে পায়না।  ছাদ ঘেষা করবী ফুলের গাছটা দেখিয়ে বলেছিলো ফুল পাড়তে এসেছি।
  " বেশি ঝুঁকে যেয়োনা পরে যাবে,ওদিকটা ভাঙা কিন্তু।দেখেছো তো?"
      একটা অদ্ভুত রহস‍্যের ইঙ্গিত খেলে যায় ওর চোখেমুখে। ওর কাছেই একদিন শুনেছিলো ওখান থেকেই নাকি ওর মেজোভাসুর পড়ে মারা গেছিলো। তারপর আর কথা হয়নি মানে সুযোগ পায়নি।বুঝতেই পারেনি একদিন কথা বলার ফাঁকে ভবেন কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। সুনন্দা সরে যেতেই তুলির চুলের মুঠি ধরে তাকে নিচে নামিয়ে এনেছিলো ভবেন আর তারপরেই ছাদে পড়েছিলো তালা।
            এর মাসদুয়েক বাদেই মা হতে চলেছিলো তুলি।ভবেন খবরটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলো যেন এই জন‍্যই তুলিকে বৌ করে আনা। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলো," শোনো মেয়েমানুষের আমার অভাব নেই কিন্তু বংশধর তো চাই,তাও আবার বিয়ে করা বৌ নাহলে হবেনা।তাই আমার কিন্তু ছেলেই চাই।"
       কি জানি কি ছিলো পেটে রাতে ঘুমের ঘোরে পেটে হাত রাখে তুলি।কিন্তু সে তো পৃথিবীর আলোই দেখতেই পায়নি। কেন যেন মনে হয়েছিলো শাশুড়ি খুব একটা খুশি হয়নি খবরটা শুনে।কেমন যেন একটা মুখচোখ করেছিলো। তারমধ‍্যেই একদিন তুলি জিজ্ঞেস করেছিলো.." মা মেজদি কোথায় থাকেন? আপনি বলছিলেন না মেজদির গয়না।"
    ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন উনি," তোমাকে বলেছিনা নোলা আর গলা কম রাখবে।এত কৌতূহল কিসের বাপু? আমি মরছি আমার জ্বালায় আর এর মধ‍্যে এত খবর সারাক্ষণ।আসুক আজ ভবেন।"
       ভয়ে কাঁটা হয়ে গেছিলো তুলি..ওনাকে বললে উনি কি গায়ে হাত দেবেন? নাকি এই ঠান্ডায় বাইরে বের করে দেবেন?
      তেমন কিছু হয়নি,তুলি জানে ওর বাবা ওকে ঘাড় থেকে নামিয়ে বেঁচেছে, মাথার ওপরে অনেক দেনা। ভাই আর দাদা তেমন কিছু করেনা।তারপর গ্ৰামের ব‍্যাপার লোককে বলবে কি? সবাই জানে ওর ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে।বড় বাড়ি গাড়ি সব আছে,সুখে আছে ও।বর বাপের বাড়ি আসতেই দেয়না চোখে হারায়।তারপর ছেলেপুলে হবে তাই আরও যত্ন করছে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা।এই গ্ৰামেগঞ্জে পাঠাবে নাকি তারা শহরের ডাক্তার নার্সিংহোম ছেড়ে?
                  ভগবান বোধহয় কোন আশাই অপূর্ণ রাখেননা।অথবা তিনি অঙ্ক কষেন একদম নিজের মত যাকে খুশি কাটাকুটি গোল্লা বসান আপন খেয়ালে। একদিন ভবেন বেড়িয়ে যাওয়ার পর নিচে একটু চ‍্যাঁচামেচি শোনে তুলি উঁকি দিয়ে দেখতে যায় কে?
      ...." ও এই বুঝি সেই কচি বৌ?বাহ্ বাহ্ আমার মা মরলো,বাবা খুব অসুস্থ যেই বাপের বাড়ি গেলাম সেই ফাঁকে তোমরা বাড়িতে একেবারে বিয়ে দিয়ে দিলে।আমার আদরের দেওরের বিয়ে আর আমি জানতেও পারলামনা। ওকে বড় করলো কে? যে বৌদিকে চোখে হারায়,বৌদির কথায় ওঠবোস করে।আমাকে ছাড়া যার একদন্ড চলেনা সে এমন করলো?"
        শাশুড়ি যেন কেঁচো হয়ে আছে মেজো ছেলের বৌয়ের কাছে।দেখে আশ্চর্য হয়ে যায় তুলি।অথচ যিনি ওকে ধমকে আঙুলের ওপর রাখেন তিনি অত চুপচাপ কেন?
              এইটুকু শুধু বুঝে যায় ওর শত্রু আরেকজন বাড়লো বাড়িতে। ভবেন আসতেই প্রথমে গিয়ে বৌদির ঘরে ঢুকলো। রান্নাঘরে যাওয়ার পথে বাইরে থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ পেলো তুলি। ভবেন আস্তে আস্তে কথা বলছে।
      কি এমন হয়েছে বুঝতে পারেনা তুলি শুধু এইটুকু বুঝতে পারে ও যেন খুব অন‍্যায় করে ফেলেছে এই বাড়িতে এসে। ওর জায়ের সংসারে যেন অনধিকার প্রবেশ করেছে।
            প্রথম দিনে বলা ভবেনের কথাটা কানে বাজতে থাকে‍,মেজ বৌদি এমন নয়। তাহলে কি ওদের মধ‍্যে কোন সম্পর্ক ছিলো?কেমন সম্পর্ক?শারীরিক? আর ভাবতে পারেনা তুলি মাথাটা কেমন ঘুরে ওঠে শুয়ে পড়ে।
       তুলির মেজো জায়ের নাম রমলা কিন্তু তুলির মাঝে মাঝে মনে হয় নামটা রঙ্গীলা হলে ভালো হত।কথায় কথায় বাপের বাড়ির দেমাক দেখায়।এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে তার হাড়ির হাল হয়েছে তাও বলে। সেদিন তো কথায় কথায় বলছিলো," তোমাদের সবসময় লুকোছাপা তাইনা? হচ্ছে তোমাদের। নিজে বিয়ে করলে লুকিয়ে। তোমার দাদার কোন ক্ষমতা ছিলোনা তাও লুকিয়ে ছিলে। ছিঃ ছিঃ।আমার মত মেয়ে বলে এই বাড়ির মাটি কামড়ে আছি।শ্বশুরের ভিটে যাবো কেনো ছেড়ে শুনি?"
         বিধবা হয়েও সবসময় টিপটপ থাকতো রমলা। পিঠকাটা ব্লাউজ,গায়ে গয়না,সুগন্ধি।ওর সব কাজ তুলিকে করে দিতে হোত। এমনকি ঐ অবস্থাতেও কাপড় কাচা। ভবেন শুধু বলে দিয়েছিলো..." শোনো তোমার তো এখনও পাঁচ মাস হয়নি তাই বাইরের কাউকে কিছু বোলোনা। বৌদিকেও বোলোনা,আমি মাকেও বারণ করে দিয়েছি বলতে।"
       " কেন বলবোনা? জানতে তো পারবেই।" আসলে বৌদির ছেলেপুলে হয়নি তো,স্বামী সুখও পায়নি তাই কষ্ট পাবে। আমি তোমাকে মাস দুয়েক বাদে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবো।ওখানেই হবে বাচ্চা।"
     একটা অদ্ভুত আনন্দের ঢেউ খেলে যায় তুলির মনে বাপের বাড়ি যাবে।আবার সেই মিঠে গন্ধ,আমমাখা,মায়ের হাতের আমড়ার টক,কচুবাটা কতদিন খায়নি। মায়ের আঁচলের গন্ধ কতদিন পায়নি। দিন গুনতে থাকে কবে দুমাস হবে।এখন তো ওর তিনমাস চলছে তারপর দেখতে দেখতে দুমাস পার হয়ে যাবে।এবার পুজোটা ওদের দুগ্গামন্ডপে বসে দেখবে।আরতি দেখা,সিঁদুর খেলা,কুমারী পুজো,শিউলি ফুলের গন্ধ মনটা ভরে যায়।
               একদিন অনেকগুলো কাপড় বের করে দিয়েছে রমলা কাচার জন‍্য।ভবেন দেখে কেন যেন বলে.." আস্তে আস্তে দাও একদিনে এত দিয়োনা।"
  " ও বৌ কচি বলে বেশি দরদ বেড়েছে।এরপর তো আমাকে চিনতেই পারবেনা দেখছি।"
    বৌদির এত অধিকার আসে কোথা থেকে তবে কি পুরোটাই সাজানো বছর কুড়ির তুলির মনে হয় কোথাও যেন একটা গোপন সম্পর্ক আছে ওদের মধ‍্যে যা হয়ত শুধু তুলি বাদ দিয়ে আর সবাই জানে।শাশুড়িরও সায় আছে,উনিও যেন মেজো বৌকে ভয় পান।
       ভবেন চলে যাওয়ার পর কাপড়শুদ্ধ ওকে বাথরুমে পাঠায় রমলা বাইরে থেকে ছিটকিনি তুলে দেয়। কেমন যেন দমবন্ধ লাগে তুলির মনে হচ্ছে শ্বাস আটকে যাবে।
                তবে মেয়েদের নজর তো তাই গোপন করতে গিয়েও গোপন করতে পারেনি তুলি।একদিন রমলা ওকে খেয়ে উঠে বমি করতে দেখে সাঁপের মত হিসহিস করে ওঠে.." বমি করছো কেন শুনি তাহলে কি বেইমানটা।"
  এই রকম মুখের চেহারা এর আগে কখনো দেখেনি তুলি ওর মেজো জায়ের। ভবেন রাতে ফিরতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায় আবার ঘরের অনেক রাতে ঘরে ঢোকে ভবেন।আজ তুলিরও শরীরটা ভালো নয়। তবুও ভবেন হ‍্যাঁচকা মেরে ওকে তুলে ওঠায়.." কেলেঙ্কারি না করে ছাড়লেনা।বললাম যে বৌদির ছেলেপুলে হয়নি হজম করতে পারবে না ধাক্বাটা।তবুও ওর সামনেই বমি করতে হলো। এবার ঠ‍্যালা সামলাও আরো অত‍্যাচার বাড়বে।"
            আশ্চর্য হয়ে গেলো তুলি হঠাৎই যেন রমলা অন‍্য মানুষ হয়ে গেলো একটু বেশিই যেন যত্ন করতে শুরু করলো তুলিকে।মুখের কাছে খাবার এনে দিতে শুরু করলো।দুধের গ্লাস দিতে শুরু করলো।কাপড় কাচা বারণ হয়ে গেলো তুলির।এমনকি রমলা আব্দার করলো বাড়ির বৌ বাড়িতেই থাকবে বাচ্চা এখানেই হবে।
                  এভাবেই কয়েকমাস কেটে গেলো পুজোতে তুলির বাপের বাড়ি যাওয়া হোলনা। মনটা উদাস হয়ে ভেসে গেলো ডাকের সাজের দুর্গা দেখতে বাতাসে খুঁজলো শিউলির গন্ধ। পুজোর আগে বাবা আর ভাই এসেছিলো জামাকাপড় দিতে।বাবা তো মেজোজায়ের আতিথেয়তায় মুগ্ধ। ওকে বললেন," কি ভালো শ্বশুরবাড়ি তোর! এতো যত্ন তো আমরাও করতে পারবোনা।
        পুজোর পরে তুলি একদিন গড়িয়ে পড়লো সিঁড়ি দিয়ে বুঝতে পারলেও বলতে পারলোনা সিঁড়িতে সাবানজল ফেলে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে দিয়েছিলো রমলাই। বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর ভবেনের সে কি সাঙ্ঘাতিক মূর্তি আর আড়ালে মুখ টিপে হেসেছিলো রমলা। মনে পড়ে গিয়েছিলো ওর বাচ্চা হবে শুনে কি সাঙ্ঘাতিক অশান্তি করেছিলো রমেন বলেছিলো আমার যখন বাচ্চা করার ক্ষমতাই নেই ডাক্তার বলেছে তাহলে বৌয়ের বাচ্চাটা আসে কোথা থেকে শুনি। সব ভাইদের এদের দাপট কম ছিলোনা খুব মার খেয়েছিলো রমলা সেদিন ধাক্কা দিয়ে ওকে ফেলে দিয়েছিলো রমেন রক্তে ভেসে গিয়েছিলো।শুধু ভবেন লোক জানাতে দেয়নি কয়েক দিন পরে ছাদের ভাঙাটা দিয়ে পড়ে যায় রমেন ফুল পাড়তে উঠেছিলো নাকি।
       সবাই আ্যক্সিডেন্ট ভাবলেও রমলা জানে ভবেন নিজের কলঙ্ক ঢাকতেই এই কাজ করেছে। আর তারপর থেকে সে ভবেনকে যা বলেছে তাই করেছে সে। তবুও পুরুষ মানুষের ছোঁকছো়কানি যায়না বোধহয়। কি দেয়নি ও ভবেনকে যাতে আবার ভবেনের বিয়ে করার দরকার হলো।
          রমলার পরিকল্পনা সার্থক হলো সবটা বুঝলো তুলিও আর এটাও বুঝলো যে এখানে থাকলে ওকে যে কোনদিন রমলা হয়ত মেরেই ফেলবে।পাশের বাড়ির সুনন্দা একদিন চুপ করে ছাদেই বলেছিলো..." চলে যাও,এবেলা চলে যাও।নাহলে মরবে।"
  " কোথায় যাবো?"
  " যেখানে হোক চলে যাও।"
বাপের বাড়ি যাবার নাম করেছিলো ওরা আপত্তি করেনি।দাদা এসে নিয়ে গিয়েছিলো।মা চমকে উঠছিলো দেখে।চমকে উঠেছিলো পাড়া প্রতিবেশীরাও।
   তারপর আর ফেরেনি শ্বশুরবাড়িতে তুলি। জীবনটা অতিষ্ঠ লাগতো মাঝে মাঝে।পাড়ার লোকেদের নানা কথা কৌতূহল। মানসিক অন্ধকারে তলিয়ে যায় মাঝে মাঝে।রাতে ঘুম ভেঙে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে হাউহাউ করে। এক একদিন বাথরুমে ঢুকে ভয় পায়। মানসিক ডাক্তার দেখানো হয় ওকে। চিকিৎসা চলে বেশ কিছুদিন।তখন কিছুটা ভালো তুলি একদিন হঠাৎই দাদা বললো," কলেজে ভর্তি হবি?"
    ততক্ষণে আত্মবিশ্বাস ভেঙে গেছে তুলির। তবুও সবার বোঝানোতে আবার উঠে দাঁড়ায়.. সত‍্যিই তো সবার বোঝা হয়ে কি করে থাকবে?
                একটু একটু করে দুটো বছর কেটে গেছে মাঝে। পাল্টেছে তুলিও,আজকাল ও শালোয়ার কামিজও পরে। মাথার চুল আরো লম্বা হয়েছে।এখন আবার দুর্গাপুজোতে ধুনুচি সাজায় কখনো বা ফল কাটে তুলি। তবুও মাঝে মাঝে তাড়া করে ওর ফেলে আসা শ্বশুর বাড়ির পুরোনো ছাদটা,রমলার ধাক্কা আবার চুপচাপ হয়ে যায় কদিন।
            বাবা মায়েরও খুব চিন্তা ওকে নিয়ে অনেকেই বলছে বিয়ে দিতে আবার। মাকে জড়িয়ে ধরে তুলি বিয়ে সে আর করবেনা।
               এর মধ‍্যেই এবারের দুর্গাপুজোতে ওদের বাড়িতে এলো শুভময় দাদার বন্ধু। তুলি তখন শিউলির সাজি নিয়ে এলোচুলে মন্ডপের দিকে যাচ্ছে। প্রথম দেখেই একটা ভালোলাগা ছুঁয়ে যায় শুভময়কে।তারপর ওদের বাড়িতে কদিন থেকে তুলিকে ভালো লেগে যায় শুভময়ের।
           কিছুতেই রাজি করানো যায়না তুলিকে বিয়ে ওর কাছে দুঃস্বপ্ন তখন।
     সোজাসুজি শুভময়কে বলে,"কেন আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন দয়া করছেন? আমি আবার অন্ধকারে যেতে চাইনা।একটু ভালো আছি এখন।"
    " যদি কথা দিই আরো ভালো রাখার দায়িত্ব নেবো।সত‍্যিই যদি প্রমিস করে বলি।"
         আবার লাইটে সাজলো তুলিদের হেলানো দরজার পুরোনো বাড়িটা তবে সবাই বললো এবার কিন্তু বেশ মানিয়েছে তুলিকে নতুন বরের সাথে।
             দুধে আলতায় পা রাখে তুলি সবই তো পুরোনো নিয়ম তবুও আবার নতুন করে নতুন সংসারে পা রাখা জানেনা এখানেই কি ওর নতুন বাড়ি হবে।না বাড়ি খুঁজতে আবার যেতে হবে অন‍্য কোথাও! বুকটা ভয়ে যেন কেঁপে ওঠে আবার। পাঁচবছর আগের তুলি এখন অনেক পরিণত আর হার মানবেনা কিছুতেই।
               হঠাৎই বাড়ির ভেতর থেকে এলোমেলো পায়ে ছুটে আসে একটা ছোট্ট দুষ্টু তুলি নিচু হয়ে দুহাতে কোলে তুলে নেয় তাকে।তুলি জানে পুতুল ওর ননদের মেয়ে। ওর ননদ যে হয়ত তুলির মতই অত‍্যাচারের শিকার হয়ে একদিন পালিয়ে গিয়েছিলো কোন অজানা দেশে অভিমান করে মেয়েকে ফেলে। কেন যে মেয়েরা এত বোকা হয়!
    পুতুল আহ্লাদি গলায় বলে মা। বুকটা কেঁপে ওঠে তুলির।ওর শাশুড়িমা বলেন..মামীমা বলো।
তুলি বলে," আবার বলো"
  পুতুল বলে মাম্মা। একফোঁটা জলে চোখটা ছলছল করে তুলির।
    পরদিন তুলির ভাতকাপড়। এমন তো আগেও হয়েছে ও জানে কি বলে ছেলেরা যেমন ভবেন বলেছিলো.." ভাতকাপড় তো দিতেই হবে।এ আবার বলার কি আছে? এই নাও ধরো।"
             নিয়ম মত শুভময়ের হাতে থালাটা তুলে দিলেন শাশুড়িমা। সবার হাসাহাসির মধ‍্যে শুভময় বলে," কাপড়টাপড় কেনার অভ‍্যেস আমার খুব একটা নেই।তবে খাওয়াটা সবাই একসাথেই খাবো। আর তোমার মন ভালো রাখার দায়িত্ব আমার আর আমারটা তোমার। কি নেবে তো?"
            মনটা হঠাৎই কেমন যেন ছুঁয়ে যায় তুলির আস্তে করে মাথা নাড়ে। পুতুল পাশে থেকে ওর আঁচলে টান দেয় মাম্মা বলে। তুলি ভাবে নিজের অজান্তেই হয়ত কত দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে ও, শুভময়ের সাথে যে পুতুলকেও ভালোবেসে ফেলেছে।
সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...