#পরিযায়ীর প্রেমে#
#রুমাশ্রী সাহা চৌধুরী#
অরুণিমা এদিকে শোনো তো, মমতাজদি কে দেখেছো?
উনি তো গাইডের সাথে সাথেই ছিলেন ম্যাম্ , আমাদের কাছে কত জানা না জানা গল্প করছিলেন হাজারদুয়ারীর। আমরা ছবি তোলার জন্য একটু পিছিয়ে পরেছিলাম সুজাতা ম্যামের সাথে তারপর এসে মমতাজ ম্যামকে দেখছিনা।
ওহ্ মহা মুশকিল হলো তো, একদম নতুন জায়গা কাল রাতে সবে এসেছি। মমতাজদি হাজারদুয়ারীতে এসে রাস্তা ভুল করলেন না তো? যা আত্মভোলা মানুষ। সারাদিন ইতিহাসের পাতায় ডুবে থাকেন।
ও ইবাদত ভাই আমাদের দিদি কে দেখেছেন? ওনাকে দেখছিনা, আপনার সাথেই তো ছিলেন। কোথায় গেলেন?
"ওই দিদিমনি? কিচ্ছু চিন্তা করবেন না আপনারা ,এতো ওনার চেনা জায়গা আমারে বললেন অনেকবার আসছেন ছোট বেলায় ঐখানে। হারাবেন কেন? উনারে উত্তর দিকে যেতে দেখলাম, ঘাবড়াবেননা এসে পরবেন।
আশ্চর্য হয় মধুরা কই মমতাজদি তো কোন দিন বলেননি মূর্শিদাবাদ অনেকবার এসেছেন এর আগে। বরং শিক্ষামূলক ভ্রমণে যখন এখানে আসার কথা হচ্ছিলো মমতাজদি আসতেই চাইছিলেননা। অনেক জোর করে রাজি করানো গেছে।
"আচ্ছা মধুরা চল মেয়েদের নিয়ে আমরা দক্ষিণদিকের দরজার দিকে যাই। ওখানে ওরা ছবি তুলতে চাইছিল তুলুক। ইবাদত ভাই আপনি বরং দেখুন দিদি কোথায়?
মেয়েরা চলো চলো আর দাড়িয়ো না প্লিজ।"
দল ছেড়ে অনেকগুলো দরজা ছাড়িয়ে প্রায় পেছনের দিকে চলে এসেছে মমতাজ, এখানেই কোথায় যেন ছিল? কিন্ত এখনও কি আছে? কেনই বা এত টেনশন হচ্ছে তার? এই শীতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে। হ্যাঁ এই তো সেই ফলক, ওহ্ দেয়ালের অনেক যায়গায় রঙ চটেছে। তবুও একটু লক্ষ্য করে খুঁজে দেখলো ছোট্ট ছোট্ট ইটের ফাঁকে উঁকি মারছে ২৫ বছরের পুরনো একটা লেখা, যা খুঁজবে বলেই হঠাৎ করে দলছুট হয়ে গেছে সে। চোখে পড়লো মমতাজের একটা ছোট্ট পাথরেরগায়ে#শুভ্রতাজ# লেখা। কি এমন আছে এই লেখাটায়? কেন ছুটে আসা এভাবে? শুধুই কি কৌতূহল?
অনেক প্রশ্ন ভীড় করে মমতাজের মনে। সব টুকুই আজ মুছে যাওয়া অতীত। তবুও একদিন যে লেখা দেখে আশঙ্কায় লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলো,আজ ২৫ বছর পরে পরম যত্নে হাত বোলায় তাতে।
কোথায় আছে শুভ্রশেখর কে জানে? এই জন্যই আসতে মন চায়নি।
স্মৃতির জাল ছিঁড়ে যায় ইবাদতের ডাকে, "ও ম্যাডাম এখানে কি করেন?
এটা তো পেছনের দিক। চলেন আপনারে সবাই খুঁজছে। অপ্রস্তুত হয় মমতাজ বলে হ্যাঁ চলো, ভুল দরজা দিয়ে এদিকটায় চলে এসেছি।
মধুরা, সুজাতা দেখলো ইবাদতের সাথে গল্প করতে করতে মমতাজ আসছে।
মুখে রোদ পরে যেন মমতাজদিকে আরও সুন্দরী লাগছে। মমতাজদির কাছে শুনেছিলো ওদের শরীরে নবাব বংশের রক্ত বইছে তাই হয়ত মমতাজদির চেহারায় এত আভিজাত্য।
যাক্ বাঁচালে গো আমরা তো ভাবছি তুমি হারিয়েই গেলে , কি যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো না ওহ্। যখন ইবাদত বললো এখানে তুমি আগেও এসেছো তখন একটু নিশ্চিন্ত হলাম।
ওদের কথা শুনে একটু যেন লজ্জা পায় মমতাজ,বলে ,"দরজাগুলো গুলিয়ে ফেলেছিলাম রে। মেয়েরা এদিকে এসো আর ও অনেক কিছু দেখতে হবে। ইশ্ আমার জন্য অনেক টা সময় নষ্ট হলো চলো চলো। দেখেছো হাজারদুয়ারীর সামনে কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে বয়ে চলেছে ভাগীরথী নদী। চলো ইবাদত ভাই আমরা ইমামবারা , জগৎ শেঠ এর বাড়ী , কাঠগোলা এই সব দেখি তাইনা"। হ্যা ম্যাডামরা চলেন এই বলে হুইসেলে ফু দেয় ইবাদত, ছাত্রীরা হেসে ফেলে। শুধু মমতাজ আজ বড় আনমনা।
সারাদিন ঘুরে ওরা প্রায় মূর্শিদাবাদের পুরোটাই দেখে ফেললো। বিকেলে হোটেলে এসে সবাই ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেয় বিছানায়। মধুরা বলে," উফ্ আর পারছিনা।" এদিকে মেয়েরা সবাই মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত। শুধু মমতাজ যথারীতি ডুব দিয়েছে তার বইয়ে।
নীরবতা ভাঙে মধুরা, "আচ্ছা মমতাজদি তুমি নাকি অনেকবার এখানে এসেছো কই কিছু বলনি তো। সত্যি তাই?" মিষ্টি হেসে মমতাজ বলে, "আমার ছেলেবেলা মূর্শিদাবাদেই কেটেছেরে।"
"ওই জন্যই তোমরা কোনভাবে নবাবের পরিবারের তাইনা?"
"সেটা সঠিক জানিনারে তবে আব্বা বলতেন আমাদের খানদানে নবাবী রক্ত বইছে।"
" সত্যি মমতাজ দি তুমি কি লাকি! আচ্ছা তোমাদের কেউ এখানে থাকেনা এখন? "নারে তুই তো জানিস আমার আম্মা আব্বা অনেকদিন মারা গেছেন ,আর ভাইরা আমাকে পছন্দ করেনা তাই আমি একাই থাকি ।
তবুও একটা কথা বলবো কাল সকালটা আমায় একটু ছাড়বি, বড্ড ইচ্ছে করছে রে একবার ছোটবেলার গ্ৰামে যেতে। আমার ফুফু এখনও ওখানে থাকে একটু দেখা করতাম"। মধুরা বলে,'তুমি নিশ্চয় যাবে মমতাজদি আমরা সবটা সামলে নেবো।'
" কি ভালো রে তোরা!"
ভোরবেলা প্রায় অন্ধকার থাকতেই উঠে মমতাজ তৈরী হলো। ইবাদতকে বলা ছিলো টাঙ্গা র কথা, তাই একটু আলো ফুটতে বাইরে বেরোতেই দেখে টাঙ্গাওয়ালা এসে গেছে।
খুশি হয়ে গেলো বেশ মনটা, একটা সময় এই টাঙ্গা আর নৌকায় চড়ে কত যাতায়াত করেছে আব্বার সাথে ।
যদিও মধু্রা আর সুজাতা বারবার বলেছে গাড়ী ভাড়া করতে। কিন্ত ঘোড়াগাড়ি চড়ার মজাই আলাদা, কি সুন্দর টুং টুং করে গলার ঘন্টি বাজিয়ে টগবগ করে ঘোড়া ছোটে।
মমতাজ কে দেখে টাঙ্গাওয়ালা সেলাম করে, মমতাজ বলে ,"ভগীরথপুর চেনো তো?" ঘাড় নাড়ে লোকটি। মমতাজ উঠে পড়ে টাঙ্গায় ,দুলতে দুলতে চলতে শুরু করে ঘোড়া।
আঃ শীতের আমেজে কি ভালোই যে লাগছে! আবার প্রায় কুড়ি বছর বাদে পুরনো শহরে , গায়ের পশমিনা শাল টা জড়িয়ে নেয় ভালো করে মমতাজ। ভোরের সকাল সবে কুয়াশার ঘোমটা খুলছে, ভাগীরথী বয়ে যাচ্ছে নিজের খেয়ালে একটা দুটো নৌকো ভেসে যাচ্ছে পূব আকাশ একটু একটু করে রাঙা হয়ে উঠছে।
শহর ছাড়িয়ে গ্ৰামের সবুজ দেখতে দেখতে হারিয়ে যায় মমতাজ ,এই পথ যে তার বড়ো চেনা, ছেলেবেলার কথা যেন এক অনাবিল আনন্দের স্বাদ এনে দেয় বিস্বাদ জীবনে।
মনে পড়ে যায় বন্ধুদের সাথে হইহই করে দলবেঁধে স্কুলে যাওয়া, কাবাডি খেলা, লুকোচুরি খেলা। আঃ কি মিষ্টি আমের মুকুলের গন্ধ! কত রকমের আম হত তাদের আমবাগানে, সাহেবপশন্দ, নবাবপশন্দ,বেগমফুলি, গোলাপখাশ, গোপালভোগ, খিরসাপাতি,দুধসাগর বলে শেষ করা যাবেনা।
আর ঝড় উঠলে আমবাগানে ছুট দিত বাড়ীর অন্য বাচ্ছাদের সাথে। তারপর স্কুলে গিয়ে ঝিনুক দিয়ে আমের খোসা ছাড়িয়ে নুন লঙ্কা মাখিয়ে --আহা! এখনো ভাবলে জিভে জল আসে।
ভাবতে ভাবতে টাঙ্গা যে কখন চলে এসেছে ভগীরথপুরের কাছে খেয়াল করেনি মমতাজ।
টাঙ্গাওয়ালা বলে, "দিদি ওই যে সামনে বড় স্কুলটা অনেক পুরানো।" মমতাজ ডুবে যায় স্মৃতির অতলে, মনে হলো একঝাঁক কিশোর কিশোরীদের সাথে সেও ঢুকে পড়লো স্কুলে। ভাগীরথীর ধারেই তাদের স্কুল,এখনও কি সুন্দর দাঁড়িয়ে স্বমহিমায়।
এই স্কুলের থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে সে।
কি অনাবিল আনন্দ ছিলো ঐ দিনগুলোতে। আয়েশা, তনুজা,মাধুরী,হিমাংশু, সুমন্ত, দেবরাজ ওরা সবাই কোথায় কে জানে?
কারো সাথেই আর যোগাযোগ নেই। স্কুলের সেরা ছাত্রী ছিলো মমতাজ,যেমন অপূর্ব সুন্দরী তেমনি মেধাবী আর নম্র। শিক্ষক শিক্ষিকারা খুব ভালোবাসতেন তাকে।
ভাবতে ভাবতেই আবার চমক ভাঙে, "ওই দ্যাখেন দিদি জমিদারবাড়ী"। হ্যাঁ তাইতো, এখন প্রায় ভগ্নদশায় অথচ একসময় আব্বার সাথে কত এসেছে এই বাড়ীতে। হিন্দু মুসলমান তারা পাশাপাশি আত্মীয়ের মতো থাকতো এই গ্ৰামে। ঈদ আর পূজোতে মেতে উঠতো সবাই। আচ্ছা ভাই এই বাড়ীতে এখন আর কেউ থাকেনা? "না দিদি ,বড় কত্তা আর তার ছেলে দুজনেই মারা গেছেন। এক নাতি আছে ,শুনেছি বিদেশে থাকে, এখন ওই বুড়া মালিটাই দেখাশুনা করে।
বড়কত্তার নাতি মানে শুভ্র , হারিয়ে যায় মমতাজ আজ থেকে ২৫ বছর আগে। হঠাৎ করে ঝড় তুলেছিলো শুভ্রশেখর কিশোরী মমতাজ এর জীবনে। মমতাজ যখন খুব ভালো রেজাল্ট করে আব্বার সাথে বড়কত্তার বাড়ীতে আদাব জানাতে যায় সেখানেই দেখে প্রথম শুভ্রশেখরকে।
খুব খুশী হয়েছিলেন বড়কত্তা সেদিন বলেছিলেন, " তুই তো আমাদের গ্ৰামের রত্নরে! মেয়েকে অবহেলা করিস না কালাম।"
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো মমতাজ লজ্জায়। হঠাৎ আব্বু বলেছিলো, ও কে কত্তা? আমাদের ছোটবাবুর ছেলে নাকি? কত্তা বলেন, হ্যা রে ও হিমাদ্রী র ছেলে। হিমাদ্রী আর বৌমা একবছরের জন্য বিদেশে গেলো। তাই কি করি দাদুভাই কে এই একবছর আমার কাছেই রেখে দিলাম ওরও তো এবার এগারো ক্লাশ হবে।
দেখি কাল একবার স্কুলে নিয়ে যাবো দাদুভাইকে, হেডমাস্টারের সাথে কথা বলে নেবো। "
তারপর থেকেই মমতাজদের ক্লাশে নতুন করে আরও একজন এলো, শুভ্রশেখর। জমিদার বাড়ীর ছেলে শুভ্র, মাষ্টারমশাইরাও যেন একটু আলাদা চোখে দেখতেন শুভ্রকে।
শুভ্র ও মেধাবী কিন্ত মমতাজ এর মতো ধীর স্থির নয় খুব ডানপিটে ,দুষ্টুর শিরোমণি। দাদুর প্রশ্রয়ে সারাদিন দুষ্টুমি করে বেড়াতো শুভ্র, কখনও ছিপ নিয়ে মাছ ধরতো আবার কখনও বা আমগাছে উঠে বসে থাকতো বন্ধুদের সাথে। তবে অসাধারণ ছবি আঁকতো শুভ্র। সময় পেলেই আঁকতো অপূর্ব সব অয়েল পেন্টিং।
শুভ্রর প্রতিযোগী ছিলো মমতাজ, পরীক্ষায় মমতাজ বেশি নম্বর পেলেই রাগ হতো শুভ্রর, সব বিষয়ে মমতাজ বেশি নম্বর পেলেও ইংরেজীতে বেশি নম্বর শুভ্রই পেতো,কখনও বা অন্য বিষয়েও। মমতাজ সমীহ করেই চলতো শুভ্রকে, যতই হোক শুভ্র তাদের গ্ৰামের অতিথি। রেষারেষির মাঝে ও কখন যে দুটো কিশোর মন কাছাকাছি এসে গেছিলো মমতাজ বোঝেনি।
এই যে দিদি এসে পড়েছে ভগীরথপুরের পূর্ব পাড়া আপনি যান। আমি ঘোড়াটাকে একটু দানাপানি খাওয়াই। আঃ! জোরে শ্বাস নিলো মমতাজ কতদিন বাদে জন্মভূমির মাটি স্পর্শ করলো, শরীর মন সব জুড়িয়ে গেলো।এক নিমেষে কত পুরনো কথাই যে ভীড় করলো মনে। ওই তো ফুফুর বাসা দেখা যায় ,পাশেই তো ছিলো ওদের ভিটে ,যা আব্বা মারা যাবার পর ভাইরা নুরুল চাচা কে বিক্রী করে দিয়েছে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় মমতাজ, ওকে দেখেই বাচ্ছারা ভীড় করে, খবর পেয়ে ভেতর থেকে ছুটে আসে ওর ফুফুর ছেলেরা। মমতাজ কে হাত ধরে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে যায়। তারপর কি করে যে সময় কেটে যায় ফুফুর সাথে গল্প করতে করতে বুঝতেই পারেনা মমতাজ। ফুফুর কাছেই জানতে পারে ওর ছোটবেলার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আয়েষা এখন এখানে শুনেই মনটা আনচান করে বলে ,' ও ফুফু একবার যাই আয়েষার বাড়ী কতদিন দেখা হয়না।'
সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয় মনেহয় পুরনো বন্ধুকে দেখলে। আয়েষা জড়িয়ে ধরে মমতাজ কে ,'তাজ--কত্তদিন বাদে , এখনও কি সুন্দরী রে তুই!' আনন্দে জল আসে দুজনেরই চোখে।
আয়েষা এরপর মমতাজ এর হাতদুটো ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে আমবাগানে, তাজ আয় এখানেই মনের কথা বলি। মুকুলের গন্ধ পাচ্ছিস? আবেশে চোখ বুজে আসে মমতাজের।
তারপর কত কথা দুই সখীর, আয়েষার মত সুখে সংসার করা হয়নি মমতাজের, মমতাজের উচ্চশিক্ষা আর চাকরি তাকে হতে দেয়নি সুখী গৃহিণী। জীবনে মমতাজ প্রাধান্য দিয়েছিলো তার শিক্ষাকেই ,তাই আপোশ করেনি মমতাজ।
স্কুলশিক্ষক আখতার মেনে নিতে পারেনি পেশাগত দিক থেকে মমতাজ এগিয়ে যাক, সেই মনমালিন্য মমতাজ কে নিয়ে গিয়েছিল বিচ্ছেদের দিকে। আর সেই জন্যই ভাইয়েরা সম্পর্ক রাখেনি মমতাজ এর সাথে। মমতাজ তাই আজ একা আর স্বাধীন। ইতিহাসের বই আর ছাত্রীদের নিয়েই সময় কেটে যায়।
আয়েষা মমতাজ এর গলা জড়িয়ে বলে সই এভাবে আর কতদিন একা থাকবি? মমতাজ হেসে বলে এই বেশ আছিরে। আচ্ছা শুভ্রর কোন খবর জানিস তাজ? নারে সেই যে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ছোটকত্তা এখান থেকে বিদেশে নিয়ে গেলেন তারপর থেকে আর কোন যোগাযোগ নেই রে।
---আজ একটা কথা বলবি সই?শুভ্র কি তোকে ভালবাসতো? চমকে ওঠে মমতাজ,যে ভালবাসা পূর্ণতা পাবার আগেই ভাগীরথীর স্রোতে ভেসে গেছে, আয়েষা কেন তার খোঁজ চাইছে।
---"না রে তা কি করে হয়?ওরা জমিদার আমরা সাধারণ মানুষ। তাছাড়া আমাদের জাতিও ভিন্ন। তুই তো জানিস ছোট থেকেই পড়াশোনাই ছিলো আমার প্রথম ভালবাসা। থাকনা ও কথা আয়েষা।আজও মমতাজের চোখের আনমনা দৃষ্টি অনেক না বলা কথা জানিয়ে দেয় আয়েষাকে।
অন্য প্রসঙ্গে যায় আয়েষা,"আচ্ছা তাজ সেবার আমাদের স্কুলের শেষ চড়ুইভাতির কথা মনে পড়ে? ওহ্ কি মজাই না হয়েছিলো বল।একদল ছেলেমেয়ে আমরা নৌকা করে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম নবাবের রাজত্বের স্মৃতি দেখতে। আমি এখনো ভুলতে পারিনারে। সারাদিন হৈ হৈ করে কেটে গিয়েছিলো আমাদের। সেদিন তুই আর শুভ্র হারিয়ে গিয়েছিলি মনে পড়ে?
স্যার বলেছিলেন, তাজ হারাবেনা, শুধু শুভ্রকে নিয়েই চিন্তা।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলি তোরা দুজন। ফিরে আসার পর আর বিশেষ কিছু বলিসনি তুই। সত্যি তাজ কত কম কথা বলতিস তখন তুই!
আয়েষার কথায় হারিয়ে যায় মমতাজ, সেদিন শুভ্রকে না দেখে মমতাজ একটু এগিয়ে যায় কারণ শুভ্র হাজারদুয়ারীতে একদম নতুন। উত্তরদিকে এগোতেই মমতাজের হাতদুটো কে যেন ধরে ফেলে, চমক ফেরার আগেই শুভ্র ওকে নিয়ে যায় পেছনের বাগানে। লজ্জায় লাল হয়ে যায় তাজ। হাতদুটো ছাড়ানোর চেষ্টা করে। শুভ্র বলে ,"আমি থাকি আর না থাকি, তাজের সাথে শুভ্রই থাকবে।
এই দেখ আমি কি লিখেছি।" তাকিয়ে দেখে মমতাজ, পাথরের গায়ে "শুভ্রতাজ" লেখা।
"এটা ভুল, খুব অন্যায়। বড়কত্তা জানলে কি বলবেন! "ভালবাসায় কোন অন্যায় নেই রে।" এরপর শুভ্রর হাত ছেড়ে একছুটে চলে আসে ওদের স্কুলের দলটার দিকে।
মমতাজ আর শুভ্রর ভালবাসা পূর্ণতা পায়নি।পরীক্ষার পর শুভ্রকে চলে যেতে হয়েছিল বাবার সাথে ফ্রান্সে। তারপর আর কোন খবর জানা নেই। মমতাজ ও চলে আসে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে কলকাতা তারপর দিল্লীতে।
অনেকটা সময় যে কিভাবে চলে গেলো, আজ এখানে এসে হারিয়ে যাওয়া অতীত আবার যেন জীবন্ত হয়ে ফিরে এলো। আজ রাতেই তাদের ফিরে যাওয়ার ট্রেন,তাই এবার ফিরতেই হবে। আয়েষার গলা জড়িয়ে ঝাপসা চোখে তাজ বলে," আসি রে।' গ্ৰামের স্মৃতি, আত্মীয়দের বিদায় জানিয়ে টাঙ্গায় উঠে বসে তাজ।
হোটেলে ফিরতেই মধুরা আর ছাত্রীরা একসাথে বলে ওঠে,' ঐ তো দিদি এসে গেছেন।' মমতাজ হাসিমুখে বলে, "চলো চলো তোমাদের সাথে একসাথে খাবো বলে আমি চলে এলাম তাড়াতাড়ি।"
এরপর প্রায় কেটে গেছে একবছর, হঠাৎই মমতাজকে সেমিনারে আগ্ৰা যেতে হলো। আগ্ৰা বড় প্রিয় শহর মমতাজের, হয়ত এখানে এসে সে নিজেকেই খুঁজে পায়। সেমিনারের শেষে পড়ন্ত বিকেলে তাজমহলের সামনের বাগানে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো । একটা লেখা লিখছে তাজমহলের ইতিহাস নিয়ে তাই হয়ত মাঝে মাঝেই আসতে হবে এখানে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওই শুভ্র ফলকে, সবটাই কি প্রেমের নাকি বিষাদেরও?
হঠাৎই চমক ভাঙে গাইডের ডাকে," ম্যাডাম, উস্ সাহাবজী আপকো বুলা রহা হৈ।" অস্বস্তিতে পড়ে মমতাজ, একজন বিদেশী ছবি আঁকাতে মগ্ন। হঠাৎ তাকে ডাকবেন কেন? তবুও ভদ্রতার খাতিরে এগিয়ে যায়। চোখে পুরু ফ্রেমের কালো চশমা আর মাথায় হ্যাট পরা মানুষটি ওর দিকে না তাকিয়েই বলে,"বস তাজ, আমি ছবিটা শেষ করে নিই।" নিজের কান কে আজ বিশ্বাস হয়না মমতাজের, ভালো করে তাকিয়ে দেখে, কে ইনি? শুভ্র? হঠাৎই উত্তর এলো,' আর ভাবিসনা, আমি শুভ্রই। এখনো তুই তেমনই ব্লাশ করিস। সত্যিই কি এ স্বপ্ন না বাস্তব? এমনও ঘটে?
শুভ্র আর মমতাজ মাঝে একটা ক্যানভাস। মাথা নীচু করে বসে তাজ এখনও যেন ঘোরের মধ্যে। শুভ্রশেখর মগ্ন তার আঁকায়। একসময় শুভ্র নীরবতা ভাঙে,"দেখতো, কেমন এঁকেছি?"অবাক হয়ে যায় সে,শ্বেতশুভ্র তাজমহলের সামনে আনমনা হয়ে বসে থাকা তারই ছবি আঁকা হয়ে গেছে শুভ্রর ক্যানভাসে।
তারপর কত কথায় কত গল্পে কেটে যায় আগ্ৰায় মমতাজের দিনগুলো। কাজের শেষে ওরা কখনও চলে আসতো তাজমহলে, কখনও বা ফতেপুরসিক্রীতে। শুভ্র বসে ছবি আঁকতো আর মমতাজ ডুবে যেতো ইতিহাসের পাতায়। কথায় কথায় জানতে পারে তার মত শুভ্ররও বিবাহিত জীবন স্থায়ী হয়নি। ফরাসী সুন্দরী বিদেশিনী ঘরণীর সাথে থাকা হয়নি শুভ্রর।
আনন্দের দিনগুলো মনেহয় দীর্ঘস্থায়ী হয়না। তাই দুজনেরই এবার কর্মস্থলে ফেরার পালা। যে প্রেম লুকিয়ে ছিলো অন্তরের গভীরে তা যেন আবার নতুন করে বসন্তের ছোঁয়া পেয়ে পল্লবিত হলো। আজ শুভ্রকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসে মমতাজের চোখদুটো কেন যেন ভরে উঠলো। অদ্ভুত একটা কষ্ট আপনজনকে বিদায় দেবার। আর হয়ত দেখা হবেনা।
"আমি প্রতি শীতেই আসবোরে তাজ, তুইও চলে আসিস, আমি মেল করে দেবো। আর কথা তো হবেই,আসিরে।"
প্রতীক্ষায় প্রতীক্ষায় সময় কেটে যায় তাজের, দিন গোনে শীতের অপেক্ষায়।যে প্রেম একদিন ভয়ে লজ্জায় স্বীকৃতি পায়নি, আজ তা পরিপূর্ণ। কবে আসবে তার পরিযায়ী?
শরৎ পেরোতেই মমতাজের মনে খুশির দোলা। মমতাজের মনের খুশির রঙ আরও যেন রাঙিয়ে দিয়েছে ওর গোলাপী গাল দুটোকে। কালই তো মমতাজের ফ্লাইট, শুভ্র আসবে দুদিন বাদে। এই এক বছরে কত কথাই না হয়েছে। তবুও দুজনে ব্যাকুল দুজনকে কাছে পেতে। প্রথম প্রেম মনে হয় এমনই নিবিড় আর মিষ্টি হয়।
সেদিন রাতে শুভ্রর মেল এলো,"তাজ আমি যেতে পারছিনারে, লাস্ট মোমেন্টে জানলাম ল্যুভার মিউজিয়ামে একটা কনফারেন্স হবে 'অন ইন্ডিয়ান আর্ট'। তাই আমাকে থেকে যেতেই হলো। কষ্ট পেলেও পরিণত তাজ জানে কাজের গুরুত্ব, তাই মেল করে,"আমি অপেক্ষায় থাকবো"।
কয়েকদিন একদম যোগাযোগ হয়নি শুভ্রর সাথে, অপেক্ষা করেছে তাজ ও জানে শুভ্র ব্যাস্ত। পরিণত প্রেমে উচ্ছ্বলতা কমে গেলেও গভীরতা বাড়ে, তাই এখানে আসেনা কোন
নিরাপত্তাহীনতা।
কয়েকদিন বাদেই মেল আসে শুভ্রর,"কেমন আছিস তাজ? তোর ছবিটার খুব প্রশংসা হয়েছে। তোকে দূর থেকে দেখে যেটা এঁকেছিলাম। তোর টিকিট পাঠাচ্ছি, আসবি তো আমার দেশে? এই সামারে চলে আয় প্লিজ,এর মধ্যে সব গুছিয়ে নিস। আসবি তো? না বলিস না প্লিজ। আমি দিন গুনছি।"
একঝলক খুশির হাওয়া এসে রঙ মাখিয়ে দেয় তাজের রাঙাগালে। মমতাজ আজ মনে মনে উড়ে গেছে পরিযায়ীর দেশে, যেখানে তার নিজের বাসা। আজ শুধু একটাই প্রশ্ন তাজের মনে, পরিযায়ীরা কি সত্যিই বাসা বাঁধে?
_ সমাপ্ত_
Comments
Post a Comment