Skip to main content

# ভৈরবী￰#

#ভৈরবী#

#রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী#

হঠাৎ খুব তাড়াতাড়ি আজ ঘুম ভেঙ্গে যায় কুহেলির। মনে হয় যেন ভোর হয়ে গেছে , জেগে গেলে আর বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করেনা । লম্বা টানা বারান্দা ওদের, সামনে কত গাছ,বাবা লাগিয়েছিলেন শখ করে।বাড়ীর সামনে দুপাশে দেবদারুগাছ দুটো মাথা লম্বা করে তিনতলার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। সামনে শিউলি,জবা,টগর, বেলফুল,স্থলপদ্ম কত রকম গাছ।আর পেছনে নানা রকম ফলের গাছ।
         কি মিষ্টি আম হয় ওদের বাগানে এছাড়া পেয়ারা,জাম সব রকম গাছই আছে।দুটো কাঁঠাল গাছও আছে।বাগানে ঘুরে ঘুরেই  কতটা  সময় যে কেটে যায়।
           কুহেলি হালকা ওড়না  গায়ে জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়,শরতের শিশির পড়েছে গাছগুলোর  পাতায়,সামনেই দূর্গা পূজা। শহরের একটু বাইরে তাদের বাড়ী তবুও পূজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে আকাশে,বাতাসে,প্রকৃতিতে।
         সবে দুদিন আগেই কুহেলি বাপের বাড়ীতে এসেছে আর হয়ত তার শ্বশুরবাড়ি ফেরা হবে না । কাল সকালে এতটাই মানসিক দিক দিয়ে বিধ্বস্ত  ছিল যে সারাদিন প্রায় শুয়েই  ছিল। আজ তাই অনেক ভোর বেলা উঠে পড়েছে |
            সত্যি প্রকৃতি অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয় তার স্নেহের স্পর্শে। হয়ত প্রকৃতির কোলে মানুষ নরম স্নিগ্ধ স্বভাবের কুহেলি তাই মানিয়ে নিতে পারলোনা অগ্নির সাথে। বাবা অনেক সাধ করে বিয়ে দিয়েছিলেন কুহেলিকে,কিন্তু মুম্বাইয়ে গিয়ে কুহেলি কিছুতেই হয়ে উঠতে পারেনি অগ্নি দের পরিবারের  মনের মতো।
          পড়াশোনা,গান সব বাবা শিখিয়েছিলেন  তাকে,একটু চাপা গায়ের রঙ হলেও কুহেলির মধ্যে এক অপূর্ব সৌন্দর্য আর স্নিগ্ধতা আছে |
         অনেক গুণ থাকলেও মুক্ত বিহঙ্গ কুহেলির হয়ত মানসিকতার অনেক ফারাক  ছিল অগ্নির  সাথে।বাধ্য হয়ে পার্টি  তে যেতে হতো অগ্নি র সাথে মানিয়ে নেবার চেষ্টা  অনেক করেছিল ও সবসময় যা অগ্নি আর ওর বাড়ির লোকেরা  পছন্দ করতো সেটাই মুখবুজে করত।শাশুড়িমায়ের এর খারাপ ব্যবহার এ কষ্ট পেলেও কখনো কিছু বলেনি বাবা মাকে  কুহেলি।শুধু ভাবতো ওরা অনেক দূরে থাকেন,এসব শুনলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।ফোনে  কথা হলেই বলত ভালো আছি বাবা।

শ্বশুরবাড়িতে একমাত্র ভালোবাসতেন ওকে বাপী মানে কুহেলির শ্বশুরমশাই | প্রকৃতির হাতে হাত রেখে মানুষ হওয়া কুহেলির দম আটকে আসত উনিশতলার ফ্ল্যাটে  যখন অগ্নি ড্রিংক করে বাড়ী ফিরত আর ফোনে মেসেজ করত পিঙ্কিকে।
           সেবার প্রায় 15 দিনের জন্য অগ্নি অফিস এর কাজে সুইজারল্যান্ডে যায় | ফেসবুকে পিঙ্কির সাথে অগ্নির ক্লোজ ছবিগুলো কুহেলিকে যেন চাবুক মারে।এই মানুষটার সাথে কি করে সে এক ঘরে থাকবে !  হয়তো  অনেকটা মানসিকতার  তফাৎ  কুহেলির অগ্নির সাথে , সে আধুনিকা নয়।তাই বলে এতটা নিচে নামতে পারলো অগ্নি ! না আর একদিনও নয় |
        বাপী কে সবটা বললেও অগ্নির মা কে বলে সে কয়েকদিনের জন্য বাবার কাছে যেতে চায়। শাশুড়ি আপত্তি করলেও যাবার সব ব্যবস্থা বাপীই করে দিয়েছিলেন ।

         মা , বাবা কোলে টেনে নিয়েছেন তাদের একমাত্র সন্তান কে। শুধু ভেবেছেন কুহেলি যেন সামলে নেয় সবকিছু।শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা বলেছিলেন কেন নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ওখানে ছিলি?আমরা কি বেঁচে নেই? কুহেলি মায়ের গলা জড়িয়ে কেঁদে ফেলে।বাবা বলেন আর কক্ষনো যাবিনা ওখানে।

        কুহেলি নাক উঁচু করে শ্বাস নেয়,আঃ !  কি মিষ্টি শিউলি ফুলের গন্ধ!কতদিন বাদে এমন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। প্রকৃতির কি অসীম দান,এই জন্যই বোধহয় বাবা মা বলতেন ভোরে ওঠ ,শরীর মন ভালো থাকবে।
           ছোট্ট মেয়ের মত ছুটে নিচে নামে কুহেলি , হাতে তুলে নেয় কচুপাতা আর কুড়িয়ে রাখে শিউলি ফুল।
     মা , বাবা উঠে পড়েছেন দোতলার জানালা  দিয়ে উঁকি মেরে দেখছেন কুহেলির ছোটবেলা।
     মেয়েকে শান্ত দেখে আজ কিছুটা নিশ্চিন্ত নিখিলেশবাবু ,কুহেলির জন্য দুশ্চিন্তায়  তারও কয়েকদিন রেওয়াজ করা হয়নি।সঙ্গীত সাধনায় এমন জাদু  আছে যা ভুলিয়ে দেয় অনেক দুঃখ আর না পাওয়া।
তাই আজ আবার পুরোনো অভ্যেসে বাবা ধীরে ধীরে গানের ঘরে এলেন ,তানপুরার  তারে  হাত    ছোঁয়াতেই  মিষ্টি আওয়াজে ভরে গেলো চারিদিক  ।
         কুহেলিও চমকে উঠলো , কতদিন শোনেনি  বাবার গান ।সে নিজেও  গায়নি কতদিন ।মুম্বাই গিয়ে আর হয়নি গানের রেওয়াজ সারাদিন সংসার আর শাশুড়িমায়ের  নানান কাজ করে দিতেই ক্লান্ত হয়ে পড়তো কুহেলি ।অগ্নি বলতো এটা ফ্ল্যাট এখানে ভোরবেলা উঠে প্লিজ তোমার ওই আ আ করে চিৎকার কোরোনা।

            মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাতে ফুল নিয়ে ￵￲দোতলায়
এসে তানপুরার সামনে ফুলের অঞ্জলি দিয়ে বাবা কে প্রণাম করে হাঁটুমুড়ে  বাবার পায়ের কাছে বসে পরে কুহেলি, সেই ছোটবেলার মত।

      বাবা বাজান রাগ ভৈরবী,কুহেলি বাবার সাথে চোখ বন্ধ করে গলা মেলায়,'ভোর হলো বিভাবরী।' সুরের মূর্ছনায় ভেসে যায়  সারা বাড়ী।
       আজ  মনোরমাও ঠাকুর ঘরে বসে মন্ত্রমুগ্ধ। কতদিন বাদে আবার বাবা মেয়ের যুগল বন্দী শুনছেন,রাগ ভৈরবী। মনোরমা আজ খুব শান্তিতে সূর্য প্রণাম করলেন।শুধু ভাবলেন তার এত সুন্দর মেয়েটা কেন এমন শাস্তি  পেলো ?

       কুহেলি মুম্বাই থেকে আসার পর বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোয়নি।নানা জনের  নানা প্রশ্নে দম আটকে আসতো। বাবা যখন বিকেল বেলায় ছাত্র ছাত্রীদের গান শেখাতেন কুহেলি পাশের ঘরে বসে একমনে শুনত আর জানলা দিয়ে দেখত  গোধূলি আর সন্ধ্যার আকাশের রঙ।
            তানপুরার  সাত সুর আর আকাশের সাত  রঙ মিলে মিশে এক হয়ে যেত।ঘরে ফেরা পাখিদের  দেখতে দেখতে বিভোর  হয়ে যেত কুহেলি।
         মা এসে বলতেন,' খুকু আয় চা খেয়ে নে'। এমন স্নেহের স্পর্শ কতদিন যে ও পায় নি।সত্যি মেয়েরা বিয়ের পর হঠাৎ করে যেন কেমন বড় হয়ে যায়।একরাতেই অনেক দায়িত্ব এসে পরে।
         খুব তাড়াতাড়ি অনেক ভালো লাগা কে ভুলে  গিয়ে অন্যের  ভালো মন্দ নিয়ে ভাবতে বসতে হয়| সবাই কে খুশি করতে গিয়ে নিজের খুশি গুলোর  সাথে কখন যে আড়ি করতে হয় কে জানে?
          এক এক দিন খুব মন কেমন করলে বাবার সাথে গঙ্গার  ঘাটে ভোরবেলা বসে ঢেউয়ের শব্দ শুনত। আর কানে কানে নদী কে বলতো ,'  তোমার দেশে আমায় নিয়ে যাবে ঝর্ণা করে '।
         অনেকটা সময় রাগের সাধনায় বাবার সাথে কেটে যায় কুহেলীর, বাবা মা শুয়ে পড়লে কোনোদিন গভীর রাতেও  মালকোষ  গায় কুহেলি বাবা মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েন।
         
এছাড়া আর কোনো বন্ধু ছিল না তার।সোশ্যাল  নেট ওয়ার্কিং সাইট  অগ্নির উপদ্রবে পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে বাধ্য হয়ে।অগ্নি আর তার মায়ের হুমকিতে ফোনের নম্বর ও পাল্টে ফেলেছে সে | কুহেলির মত এমন বাধ্য চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক মুম্বাই শহরে  দুষ্প্রাপ‍্য।
              তাই অগ্নির হাত থেকে মুক্তি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল কুহেলির বাবাকে। ডিভোর্স  পেতে পেতে দুবছর কেটে গিয়েছিলো।
            অশান্তির এই দিনগুলোতে সাহস হারায়নি কুহেলি,শান্তি খুঁজে নিয়েছিল তার প্রিয় সঙ্গীত , প্রকৃতি,আর বাবার গানের স্কুলের মধ্যে |
       বিপর্যয়ের ঝড় কাটিয়ে একদিন বাবা বললেন ,'খুকু চল আমরা কিছুদিনের জন্য বেনারস বেড়িয়ে আসি,বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছি রে।আমাদের একটু পরিবর্তন দরকার,তোর  মায়ের ও খুব ইচ্ছে বিশ্বনাথ দর্শনের।'ওখানে আমার এক বন্ধুর গঙ্গার ধারে বড় বাড়ী,অনেক দিন ধরে বলছে আমাদের ওখানে একবার ঘুরে আসতে। কুহেলি ইতস্তত করে বলে কিন্তু, নিখিলেশ বাবু অভয় দেন ওরা ওখানে থাকে না রে ,তুই সঙ্কোচ করিস না।
           আনন্দে খুশী হয়ে উঠলো কুহেলি অনেকদিন বাদে আবার মা বাবার সাথে বেরোনো মনের গ্লানি হয়ত নতুন পরিবেশে  কিছুটা হাল্কা হবে।
বেনারসে পৌঁছে যখন কেদারঘাটের থেকে একটু দূরে বাবার বন্ধুর বাড়িতে ওরা এলো চোখ জুড়িয়ে গেলো কুহেলির,কি অপূর্ব বাড়িটা যেন গঙ্গার বুকে একখানা সাজানো নৌকা।
         মালীকাকা এসে দোতলার ঘরগুলো খুলে দিলো ওদের জন্য,বারান্দায় এসে কুহেলির মনে হলো ব্যালকনিটা যেন গঙ্গার ওপর।সত্যি কি কুহেলি তবে এসে পড়েছে ঝর্ণা হয়ে গঙ্গার দেশে?
         ঘরগুলো সুন্দর করে সাজানো,মালী কাকা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন,এবার যে ঘরে কুহেলি এলো অবাক হয়ে গেলো। ঘরে পরিপাটি করে সাজানো তানপুরা,হারমোনিয়াম,তবলা,সেতার আরো কত রকম বাদ্যযন্ত্রে। আলমারি ভর্তি কত বই ,কার এসব? কুহেলির মনে অনেক প্রশ্ন এলেও সে চুপ করে থাকে ভাবে বাবাকে জিজ্ঞেস করে নেবে।
        ঘরে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করে,' বাবা এগুলো কে বাজায়? কি সুন্দর করে সাজানো সব! বাবা বললেন,'দেখেছি রে ওগুলো আমার বন্ধুর ছেলের,ভীষণ গান পাগল ছেলেটা। বেনারস হিন্দু  ইউনিভার্সিটিতে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অধ্যাপক এখানেই থাকে?একটু যেন অস্বস্তি হয় কুহেলির।
      বাবা বলেন চিন্তা করিসনা খুকু আমরা ছাড়া এখন কেউ নেই এখানে,ছেলেটি এখন এলাহাবাদে গেছে কিছুর জন্যে।
         কিছুটা স্বস্তি পায় কুহেলি,বাইরের কারো সামনাসামনি হতে এখন তার একটুও ভালো লাগে না। একটু খোলা হাওয়ায় প্রানভরে শ্বাস নিতে চায় সে।
      বিশ্বনাথ দর্শন করে অন্নপূর্ণা দর্শন করলেন মা,কুহেলিও সাথে গেলো মা বাবার।ঠাকুরকে  শুধু বললো একটু শান্তি দিতে।
    মা বাবা প্রতিদিনই  সকালে কেদার ঘাটে গিয়ে বসেন,গঙ্গা স্নান করে ফেরেন।কুহেলি খুব একটা বেরোতে চায় না , নিখিলেশ কখনো জোর করেন না ,গঙ্গার পারে বারান্দায় বসে কত রাগ রাগিনী  গুনগুন  করে গায় খুব ভালো লাগে ওর।
      নিখিলেশ আজ বলেন,' খুকু , তোকে বলা হয় নি আমার বন্ধু কাল ফোন করে বলেছে আমরা যেন এখানেও রেওয়াজ করি |' গান ছাড়া যে আমি ভালো থাকিনা রে।খুকু তুইও তানপুরা নিয়ে বোস।এখানে তো সব কিছুই আছেরে', কুহেলি খুব ইতস্তত করে।
        নিখিলেশ হাসতে হাসতে বলেন গৃহকর্তার আদেশ কি করে অমান্য করি বল? আয় মা , গঙ্গার ঢেউয়ের সুরে ভাসিয়ে দিই আমাদের রাগিণী আর রাগ কে।
          কুহেলির মনে একটু কিন্তু থাকলেও রেওয়াজ করার সুযোগে মনটা নেচে উঠলো তার। এই দুবছর গানই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো   তাই ,গান তার একমাত্র বন্ধু। যার সাথে গল্প না করলে বড় ফাঁকা লাগে |
         শুরু হলো রেওয়াজ,নিমগ্ন হয়ে যেতেন  নিখিলেশ আর কুহেলি।নিখিলেশ মাঝে মাঝে মনোরমাকে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে বা বিশ্বনাথ দর্শনে  গেলেও কুহেলির সারাদিন কেটে যেত রেওয়াজে।
           সুরের মূর্ছনায় কখনো আসতো গঙ্গাতে জোয়ার,কখনো আকাশ ভেঙ্গে নামতো বৃষ্টি আবার কখনো বা সূর্যের কিরণে ঝিকমিক   গঙ্গার ঢেউ।
         কোথা দিয়ে যে এক সপ্তাহ কেটে গেলো , বোঝাই গেলো না। কুহেলি এখন অনেক শান্ত ,জায়গা বদলে মনের ভার অনেকটাই হাল্কা হয়েছে।
           প্রতিদিনের মত আজও কুহেলি ভোরে উঠে বাগান থেকে জুঁই ফুল এনে তানপুরাকে  প্রণাম করে রেওয়াজে বসেছে।বাবা এসে ইশারায় বলে গেলেন মা কে নিয়ে গঙ্গার ঘাটে যাচ্ছেন। কুহেলি জানে মা গঙ্গায় স্নান করে সূর্য প্রণাম করে,বাবা বিশ্বনাথ এর মন্দির  হয়ে আসবেন।
            
সঙ্গীত সাধনায় নিমগ্ন হয়ে গেলো কুহেলি ধরলো  রাগ ললিত,সুরের মূর্ছনায় যেন আলো হয়ে গেল চারিদিক।পূব আকাশ আলো করে সূর্য উঠছে , কুহেলি এবার ধরে রাগ ভৈরবী |  কুহেলির বড়ো প্রিয় রাগ ।আলাপ করে মুখরা থেকে এখন অন্তরায়  কুহেলি,বাবা থাকলে খুব ভালো হতো দুজনে একসাথে গাইতে পারতো।
  
চোখ বুজে একমনে গাইছে কুহেলি।একতলায়  বসে মালীকাকাও শুনছে একমনে কুহেলির গান। কখন সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ায় সৌরাশিস মালী কাকা লক্ষ্যই করেননি। দেখতে পেয়ে দরজার কাছে এসে অবাক হয়ে বললো' দাদাবাবু  আপনার তো এক সপ্তাহ বাদে আসার কথা।'
             সৌরাশিস ইশারায়  চুপ করতে বলে আস্তে জিজ্ঞেস করে,' কে গান গাইছে গো? বাবার বন্ধুর আসার কথা ছিল শুনেছিলাম।'মালী কাকা  বলেন,' দিদিমনি গো।'
 
সৌরাশিস মুগ্ধ হয়ে যায়, সে নিজেও গান পাগল , সারাদিন গানের ঘরেই  তার কেটে যায় | ভারতীয়
শাস্ত্রীয়  সঙ্গীত নিয়ে তার গবেষনা | কিন্তু এই ভৈরবী রাগে যেন কি অদ্ভুত এক দুঃখ মিশে আছে যা আরো অপূর্ব করে তুলেছে  সুরের সাধনাকে |
         আস্তে আস্তে গানের ঘরের দরজায় এসে দাড়ায় সৌরাশিস।চোখ পরে যায় কুহেলির দিকে চোখ বন্ধ করে অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় মেতেছে  কুহেলি।সৌরাশিস আর পারলো না নিজেকে সংযত রাখতে,কুহেলির সাথে অন্তরায় গলা মেলালো সে।কুহেলি আশ্চর্য হয়ে যায় এতো বাবার গলা নয় তবে কে?
      কিন্তু গানকে মাঝপথে কখনো থামাবার  শিক্ষা সে পায়নি তাই আবার চোখ বুজে সৌরাশিস এর সাথে যুগলবন্দী ভৈরবী গেয়ে যায় সে।
          বাড়ীর একতলার বারান্দায় তখন বিভোর  হয়ে যুগলবন্দী শুনছেন আরো চারজন | কুহেলির মা বাবা আর সৌরাশিসের মা বাবা |
     নিখিলেশ বাবুর ছোটবেলার বন্ধু শুভেন্দুবাবু, নিখিলেশ এর কাছে কুহেলির  সব ঘটনা শুনেছেন তিনি।অনেক ছোট বেলায় তিনি দেখেছেন কুহেলিকে।মাঝে চাকরি সূত্রে দিল্লীতে ট্রান্সফার হওয়াতে অনেকদিন যাওয়া হয়নি নিখিলেশের  কাছে |
            শুভেন্দু নিখিলেশ কে গতকালই  ফোন করেছিলেন সৌরাশিসের এলাহাবাদের  কাজ শেষ , সে আজ ফিরবে | সে যদি কোন কারণে  ওদের সাথে আলাপ না থাকায় অস্বস্তিতে পরে তাই তারাও  আসছেন  দিল্লী থেকে |  ভালোই হবে সবাই মিলে জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে কদিন |

   তাছাড়া  নিখিলেশ ও তো ফিরে যাবেন আর কয়েকদিন বাদেই।তাই নিখিলেশ গঙ্গা থেকে এসে অপেক্ষা করছিলেন ওদের জন্য একতলার বাগান লাগোয়া  বারান্দায়।যুগলবন্দী ভৈরবীর তানে মুগ্ধ নিখিলেশ,কি অপূর্ব গাইছে ওরা।

    শুভেন্দু ও আজ নিশ্চুপ , সৌরাশিস যেন নিজেকে উজাড়  করে গাইছে | মনটা ভরে যায়, সারা বাড়ীটা যেন আজ ভরে গেছে সংগীতের  মূর্ছনায়।
       গান শেষ হলে চোখ মেলে কুহেলি ,ততক্ষনে  নিখিলেশরাও ওপরে  উঠে এসেছে। নিখিলেশ পরিচয় করিয়ে দেন ওদের ,যদিও গানে গানে সুরের  পরিচয় হয়ে গেছে ততক্ষণে।

   কুহেলির একটু জড়তা  থাকলেও শুভেন্দু আর স্নিগ্ধা বড় আপন করে নিয়েছে কুহেলিকে।আর গানই বন্ধুত্ব করিয়ে দিয়েছে সৌরাশিসের সাথে। গান,গল্প,বেড়ানো কোথা দিয়ে যে দিনগুলো কেটে গেলো। কুহেলির খুব ভালো লাগলো বাবা মাকে এমন প্রাণ খুলে হাসতে,নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতো কুহেলির,বাবার কত দুশ্চিন্তা সে বাড়িয়ে দিয়েছে।

         আজ নিখিলেশদের রাতে ফেরার ট্রেন, সবারই মন খারাপ,কিন্তু ফিরতে তো হবেই|নিখিলেশের ছাত্র ছাত্রীরাও অপেক্ষায়  আছে।
           মনোরমা হাতজোড় করে প্রণাম করলেন মা গঙ্গাকে,আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুহেলি বললো ,'গঙ্গা ,তোমার এই দেশে এসে মনটা আমার জুড়িয়ে গেলো'।
    শুভেন্দু আজকাল সৌরাশিসকে একটু আনমনা দেখেন।রেওয়াজ করতে বসে মাঝে মাঝেই মন হারায় ছেলে।কখনোই  বিয়েতে মত দেয়নি ছেলে ,কথা উঠলেই বলেছে ,'বাবা আমার সাধনা ,গবেষণা সব যাবে।

       কুহেলির সব টুকুই জানেন শুভেন্দু , তবুও কেমন যেন এক অদ্ভুত মায়ার বাঁধনে বেঁধে গেলো মেয়েটা।কিন্তু বাবু কি রাজী হবে?তবুও ছেলের সাথে তিনি কথা বলেন কুহেলির সব টুকু জানিয়ে।
ছেলের নীরবতা দেখে বোঝেন তারও ভালো লেগেছে কুহেলিকে | সৌরাশিস কুহেলি যাবার পর বুঝেছে তার রাগ রাগিণীরা কেন যেন ঠিক মতো আর সুর ছড়াচ্ছে না |
   কুহেলির সুর মূর্ছনায় ভরে গিয়েছিলো তাদের সারা বাড়ী।
       শুভেন্দু ফোনে কিছু বলেননা নিখিলেশ কে , একদিন ডাকে চিঠি এলো শুভেন্দুর কাছ থেকে। তাতে লেখা ছিল," জানি রে এক দুঃস্বপ্নের রাত্রি কাটিয়ে উঠেছিস তোরা। আমায় ভুল বুঝিস না , আমার রাগ বড় একা তোর রাগিনীকে ছাড়া। রাগ আর রাগিণীর যুগলবন্দী শোনার জন্য মনটা বড় অস্থির করছে রে।
আমায় দিবি তোর রাগিণী কে ? খুব আদরে যত্নে রাখবো , আমাদের চোখের মণি করে।ভালো করে ভেবে জানাস।কোনো তাড়া নেই , আমরা অপেক্ষা করবো।
নিখিলেশের দুচোখে ধারা গড়িয়ে পরে বন্ধুর চিঠি পড়ে।কি সুন্দর মন শুভেন্দুর!এই একাত্মবোধ শুধু ছেলেবেলার  বন্ধুর কাছেই  বোধহয় পাওয়া যায়।
পরদিন কুহেলির হাতে চিঠিখানা দিয়ে বলেন , "  আমার ভৈরবী কি বেহাগ এর সাথে যুগলবন্দী গাইবে?" চিঠি টা পড়ে আমায় উত্তর দিস খুকু। কোনো তাড়া নেই।কুহেলি চিঠি হাতে নিয়ে গানের ঘরে চলে গেলো , আজ তার চোখেও জলের ধারা ।
 
     নিখিলেশ শুনলেন  রাগ মধুবন্তী ধরেছে কুহেলি অনেকদিন বাদে।

সমাপ্ত:-

Comments

Popular posts from this blog

কথা দিলাম

#কথা_দিলাম# #রুমাশ্রী_সাহা_চৌধুরী# "চৌধুরীদের বাড়ির ছোটমেয়ে না? কি চেহারা হয়েছে গো! এই তো গত পুজোর আগের পুজোতে ওদের দুগ্গাদালানে দেখেছিলাম চুল ছেড়ে ধুনুচি সাজাচ্ছিলো।কি সু...

চিত্রাণী (উপন‍্যাস ১)

 দক্ষিণের জানলাটা খুলে দিয়ে ওদের ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে রাঙা আজও সানাইয়ের মিঠে সুর টানে ওকে সেই কতবছর আগের ওর বিয়ের দিনের মতই। সেদিনের ছেলেমানুষী ভরা রাঙা আজ মাঝবয়েসে পা রেখেছে। পরনে লাল চেলীর বদলে শান্তিপুরের সরু পাড়ের আসমানী নীল শাড়ি। নিজের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে একটা খোঁপা বেঁধে বারান্দায় একটু ঝুঁকে দেখে রাঙা। ওর জা মানে বড়দি অবশ‍্য দেখলেই বলত, " সত‍্যি রাঙা তোর স্বভাব আর গেল না। এক রকম রইয়‍্যা গেলি, মাঝবয়সী বিধবা মানুষ তার আবার অত কি শখ বিয়েবাড়িতে উঁকি মারার? যা একবার নিচে গিয়া রান্নাঘরে ঢুইক‍্যা দ‍্যাখ গিয়া সুলতা কি করত‍্যাছে।"      আজ অবশ‍্য সেই চিন্তা নেই,দিদি দাদার সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর গেছেন সেই কোন সকালে। ফিরতে নাকি দুপুর গড়াবে একদম প্রসাদ পেয়ে আসবেন। বাবু ইউনিভার্সিটি গেছে ফিরবে সেই বিকেলে। মনে পড়ে যায় একসময় সবাই ওকে রাঙা বৌ বলে ডাকত।  ওর বর প্রথমদিনই বলেছিল," ইশ্ আমি প্রথম যখন শুনছিলাম রাঙা নামটা তখন এত হাসি পাইছিল কি কমু আর। রাঙা, এ আবার ক‍্যামন নাম? তবে মুখখানা দেইখ‍্যা বুঝলাম এমন লাল টুকটুকে সুন্দরীরে রাঙাই বলে বোধহয়। তুমি হইল‍্যা গিয়া আমার রাঙা ...
বাড়ি থেকে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে আসা পর্যন্ত সময়ের মধ‍্যেই একটা ছোটখাটো কনটেন্টের ওপর শর্টস বানিয়ে নেবে ভেবেছে পিউলি। তারপর যখন এয়ারপোর্টে ওয়েট করবে তখন আরেকটা ছোট ভ্লগ বানাবে সাথে থাকবে প্লেনের টুকিটাকি গল্প। দেশে ফেরার আনন্দের সাথে অবশ‍্যই মাথায় আছে রেগুলার ভিডিও আপডেট দেওয়ার ব‍্যাপারটা। আর এই রেগুলারিটি মেনটেইন করছে বলেই তো কত ফলোয়ার্স হয়েছে এখন ওর। সত‍্যি কথা বলতে কী এটাই এখন ওর পরিবার হয়ে গেছে। সারাটা দিনই তো এই পরিবারের কী ভালো লাগবে সেই অনুযায়ী কনটেন্ট ক্রিয়েট করে চলেছে। এতদিনের অভিজ্ঞতায় মোটামুটি বুঝে গেছে যে খাওয়াদাওয়া,ঘরকন্নার খুঁটিনাটি,রূপচর্চা,বেড়ানো এইসব নিয়ে রীলস বেশ চলে। কনটেন্টে নতুনত্ব না থাকলে শুধু থোবড়া দেখিয়ে ফেমাস হওয়া যায় না। উহ কী খাটুনি! তবে অ্যাকাউন্টে যখন রোজগারের টাকা ঢোকে তখন তো দিল একদম গার্ডেন হয়ে যায় খুশিতে। নেট দুনিয়ায় এখন পিউলকে অনেকেই চেনে,তবে তাতে খুশি নয় সে। একেকজনের ভ্লগ দেখে তো রীতিমত আপসেট লাগে কত ফলোয়ার্স! মনে হয় প্রমোট করা প্রোফাইল। সে যাকগে নিজেকে সাকসেসফুল কনটেন্ট ক্রিয়েটার হিসেবে দেখতে চায় পিউল।         এখন সামার ভ‍্যাকেশন চলছে ...